অর্ধাঙ্গিনী(An Ideal Wife) পার্ট০৫+৬

0
1720

#অর্ধাঙ্গিনী(An Ideal Wife)
#পার্ট০৫+৬
#আফরিন_ইনায়াত_কায়া
.
.
মায়ের কথা শুনে প্রচন্ড রাগ উঠল।বৃষ্টি কখনো এমনটা করতে পারবে আমি ভাবতেও পারিনি।রাগে গজরাতে গজরাতে রান্নাঘরে গিয়ে দেখি বৃষ্টি আর রামিসা খাল মিলে রাতের খাবার রেডি করছে।রান্নাঘরে ঢুকেই চেচামেচি শুরু করে দিলাম।
-তোমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি বৃষ্টি।বিয়ের আগে তো আমাকে প্রতিদিন বাটিতে বাটিতে করে নিজের হাতে রান্না করে খাবার আনতে। এখন আমার মা এ খেতে চেয়েছেন আর সেই সামান্যটুকু রান্না করার সময় হয় নি তোমার?……
.
.
বেশ কিছু কথা শুনিয়ে দিলাম বৃষ্টিকে। এত কিছুর মধ্যে বৃষ্টি টু শব্দও করেনি।আমি রান্নাঘর থেকে চলে আসব এমন সময় রামিসা খালা বৃষ্টিকে জিজ্ঞেস করে উঠল
-আপামনি আপনে ভাইজানরে বলেননি সরিষায় আপনার এলার্জি?
রামিসা খালার কথা শুনে থমকে গেলাম আমি।পিছন ফিরতেই আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে রামিসা খালা বললেন
-ভাইজান আপনে জানতেন না বৃষ্টিমনির সরিষায় এলার্জি?কত করে কইলাম শুনল না। সরিষা বাটে মাছে মাখাইতে যায়ে হাত ফুইলা লাল হয়ে গেছে।চুলকাইতে চুলকাইতে হাতের চামড়া ছিড়া ফেলাইছে।বেচারি তো দুপুরের ভাতটাও খাইতে পারে নি।আমি কইলাম খালাআম্মারে কয়া না হয় অন্য তরকারি আন্দি কে শুনে কার কথা।
আমি হা হয়ে রামিসা খালার কথাগুলা হজম করছি। বৃষ্টির যে সরিষায় এলার্জি এটা আমার অজানা নয়।এত একটা ইম্পর্ট্যান্ট একটা বিষয় কিভাবে মাথা থেকে বের হয়ে গেল আমি ভেবে কুল পাচ্ছি না।চুপচাপ মাথা নুইয়ে সেখান থেকে চলে আসলাম।নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল।আমি এত কথা বলেছি কিন্তু বৃষ্টি হাসিমুখে সবটা সয়ে গেছে।আমি জানি ওর হাসিটার পিছনে হাজারো কষ্ট হাজার অভিমান লুকিয়ে আছে।
.
.
-এই মেঘ কি হল?শাড়িটা পরিয়ে দেও না প্লিজ।কতক্ষন এভাবে দাড়িয়ে থাকব?
বৃষ্টির কথায় ওর হাত থেকে শাড়িটা সড়িয়ে ওর হাতদুটো মেলে দেখলাম।গোলাপের পাপড়ি দুমড়ে মুচড়ে যেমন কালচে বর্ন ধারন করে ওর হাত দুটোর অবস্থাও সেরকম হয়েছে।হাতের গোলাপী নখগুলোতে কালি জমে আছে।অথচ ওর গোলাপী নখের জন্যে ভার্সিটির সব মেয়েরা ওকে হিংসে করত।
রেডি হয়ে বৃষ্টিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।ওকে রিক্সায় নিয়ে আজ পুরো শহর ঘুরব।আকাশী রঙের শাড়িতে বৃষ্টিকে নীল আকাশের মত লাগছে।আকাশের বিশালতা যেন পুরোটাই ধারন করেছে সে।হালকা হাতে খোপার কাটাটা খুলে দিলাম। সাথে সাথেই এক রাশি চুল ছড়িয়ে পড়ল ওর পিঠ জুরে।বৃষ্টি কটমট করে আমার দিকে তাকাচ্ছে।আমি ভান ধরে আছি যেন কিছুই জানি না।পুরোটা সন্ধ্যা বৃষ্টিকে নিয়ে ঘুরে ডিনার শেষে বাসায় ফিরে আসলাম।
বাসায় ফিরেই বৃষ্টি দৌড় মারল মায়ের রুমে।হাতে দুটো হাওয়াই মিঠাই। মায়ের কাছে গিয়ে মাকে একটা হাওয়াই মিঠাই ধরিয়ে দিল।দুই মা মেয়ে গল্প করছে আর খিলখিল করে হাসছে।আমি ওদের বিরক্ত না করে রুমে চলে আসলাম।আমি জানি বৃষ্টি গল্প শেষে মাকে ঘুম পাড়িয়ে তারপর রুমে আসবে।…….
চলবে

#অর্ধাঙ্গিনী(An Ideal Wife)
#পার্ট০৬
#আফরিন_ইনায়াত_কায়া
.
.
বৃষ্টির সাথে মা কখনো খিটখিট ব্যবহার করে নি। মা শুধু এই ভয়েই থাকতেন বৃষ্টি তার কাছ থেকে তার ছেলেকে দূরে না সরিয়ে দেয়। কিন্তু মায়ের সব ভুল ধারনা দূর হয়ে যায় আফরার বিয়ের সময়।একমাত্র ভাগনীর বিয়েতে মাকে এক সপ্তাহ আগেই যেতে হয়েছিল। বিয়ে বাড়িতে কাজ অনেক। খালা একা হাতে কত দিকে সামাল দিবেন।আমার অফিসের কাজের জন্যে আমার যাওয়া হয়ে উঠল বিয়ের দিন।
বিয়ে বাড়ির প্রতিটা কাজ বৃষ্টি স্বাচ্ছন্দ্যে করেছিল যেন সে বাড়ির মেয়ে । আফরাকে সাজানোর দায়িত্ব ছিল মা আর বৃষ্টির উপর।দেরী হয়ে যাবে ভেবে মা বৃষ্টিকে পাঠিয়ে দেন রেডি হতে। এদিকে আতশবাজি পড়ে আগুন লেগে যায় আফরার ঘরে।মা কোনমতে আফরাকে ঘর থেকে বের করতে সক্ষম হলেও নিজে আটকা পড়ে যান আগুনের উত্তাপে।বৃষ্টি যতক্ষন রেডি হয়ে এসেছে পুরো ঘরে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে।দাউদাউ করে জ্বলছে সব কিছু। ধোয়া আর অক্সিজেনের অভাবে মায়ের দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম।সবাই হা হয়ে তামাশা দেখছে।দু একজন পানির বালতি নিয়ে ছুটাছুটি করছে। হুট করে বৃষ্টি সবার চোখ ফাকি দিয়ে ঢুকে পড়ে রুমে। কোনরকমে মাকে ঘর থেকে বের করে আনলেও আগুনের ফুলকা উড়ে এসে পড়ে বৃষ্টির শাড়িতে। নিমিষে জ্বলে ওঠে বৃষ্টির শরীর।
.
.

মায়ের ফোন পেয়ে আধ রাস্তা থেকেই ছুটে যাই হসপিটালে।আমাকে দেখেই মা আমাকে জড়িয়ে ধরে সবটা বলতে লাগলেন।অঝোরে কেদে যাচ্ছেন মা।বাবা মারা যাবার পর এই প্রথম তাকে এতটা কাদতে দেখলাম।আমি সবটা শুনে মুহুর্তে যেন পাথরের মত হয়ে যাই।প্রচন্ড অসহায় লাগছিল নিজেকে।
আমি থেকে থেকে মায়ের দিকে অসহায় ভাবে তাকাচ্ছি।মা আমার অবস্থা দেখে আচলে মুখ লুকিয়ে কাদছেন। যে বৃষ্টিকে মা সহ্য করতে পারতেন না আজ সেই বৃষ্টির জন্যে মা কেদে ভাসাচ্ছেন।
প্রায় দেড় দিন পর জ্ঞান ফিরে বৃষ্টির।ধীর পায়ে আগাচ্ছি আমি। ডাক্তার বলেছেন বৃষ্টির শরীরের খুব বেশি অংশ না পুড়লেও ক্ষতগুলো বেশ গভীর।যেকোন সংক্রামক রোগে সহজে আক্রান্ত হতে পারে।বৃষ্টির কাছে গিয়ে ওর মাথায় হাত রাখতেই পিটপিট করে চোখ খুলে বলে উঠল

-মেঘ মা কোথায়?উনি ঠীক আছেন তো?বল না মেঘ চুপ করে আছ কেন?
আমি হালকা মাথা নাড়ালাম৷ওর চোখে মুখে স্বস্তির হাসি ফুটে উঠল।আমি বুঝতে পারছি আমার চোখগুলো ঝাপসা হয়ে আসছে। কান্না দলা পাকাচ্ছে গলায়।ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করলাম
-তুমি তো বাইরে ছিলে। কি দরকার ছিল যেতে আগুনে যাওয়ার???
বৃষ্টি মুচকি হেসে বলল

-মেঘ জানো আমি তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি।আর তোমাকে পেয়েছি মায়ের কারনে।আমার জীবনের সবচেয়ে বেস্ট গিফট মা আমাকে দিয়েছেন।তার জন্যে আমি উনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব।এর জন্যে যদি আমার এই কাজ আবার করতে হয় আমি হাসি মুখে করব।
আমি আর সেখানে থাকতে পারিনি। উঠে চলে আসব হঠাত চোখে পরল মা পর্দার আড়ালে দাড়িয়ে সবটা শুনছেন।মায়ের দিকে তাকাতেই টুপ করে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল চোখ থেকে।
.
.
এক সপ্তাহ পর বৃষ্টিকে হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ দেয়া হয়।মা সারাক্ষন বৃষ্টির পাশে এসে বসে থাকতেন।তার সেবা যত্ন করতেন।আমি চেস্টা করতাম বৃষ্টির সাথে থাকার।কিন্তু অফিসের কারনে তা হয়ে উঠত না।তবুও যথাসাধ্য চেষ্টা করতাম ওকে সময় দেওয়ার। আমি ওর পাশে গিয়ে বসলে আমার বুকে গুটিশুটি মেরে ঢুকার চেস্টা করত।ওকে স্পর্শ করতেও আমার ভয় লাগত। জায়গায় জায়গায় ক্ষত গুলো প্রতিটা মুহুর্তে ওকে অবর্ননীয় কষ্ট দিত। মাস পাচেক পর বৃষ্টি অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠল।মা নাওয়া খাওয়া ছাড়া প্রতিটা সময় বৃষ্টির সাথে থাকতেন।নিজের মেয়ের চেয়েও বেশি ভালবাসতে শুরু করলেন বৃষ্টিকে।
.
.

একদিন আমাকে ডেকে মা বলেছিলেন
-মেঘ সেদিন যদি তুই জেদ করে বৃষ্টিকে বিয়ে না করতি তবে হয়তো আমি আজকে একটা মেয়ে পেতাম না। আমার খুব ইচ্ছে ছিল তোর একটা ছোট বোন থাকবে।কিন্তু আল্লাহ তখন আমার সে ইচ্ছা পূরন করেন নি।আজ করেছেন বৃষ্টিকে তিনি আমার মেয়ে হিসেবে পাঠিয়েছেন।
.
.
-তোমার কি বিছানা বালিশ আজ বাথরুমে পাঠিয়ে দিব?
ওয়াশরুমের বাহির থেকে বৃষ্টির গলা শুনতে পেলাম।শাওয়ারটা অফ করে বের হতেই বৃষ্টি চেচিয়ে উঠল
-বুড়া হয়ে গেছে তাও লজ্জা শরম কিচ্ছু নাই।খালি একটা তোয়ালা পড়ে ঘুরার কি দরকার?বলি কাপড়ের সাথে এত শত্রুতা কেন তোমার?
আমি কপট রাগ দেখিয়ে বৃষ্টিকে জড়িয়ে ধরলাম
-কি আমি বুড়া? আমি বুড়া?তাইলে তুমি কি?তুমি তাইলে বুড়ি।থুরথুরি বুড়ি।
বলেই দাত কেলাতে শুরু করলাম।বৃষ্টি এবার রাগে লাল হয়ে গেল।
-কি?????আমি বুড়ি?তুমি বুড়া। গুলুগুলা বুড়া৷
আমি বৃষ্টির কোমড় জড়িয়ে ধরে একটা ডেভিল মার্কা হাসি দিয়ে বললাম
-আমি গুলুগুলা বুড়া তাই না?তাহলে তো এই বুড়ার শক্তি দেখাতে হয়।
বৃষ্টি আমার কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গেল।ও ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।কিন্তু আমি ওকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।
.
.
তারপরের পাতাগুলো ফাকা। ডায়রীটা আরেকবার শুরু থেকে উল্টে পাল্টে দেখল রেওয়াজ।কিন্তু একটা বর্নও খুজে পেল না।……
চলবে