অল্প থেকে গল্প🍁
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব:১০
বিকেলবেলা নাশতার সময় অনু সবাইকে ডেকে নিয়ে এলো। ছবি এইমুহূর্তে কিছুতেই শুদ্ধর সামনে আসবে না।এমনিতেই যা লজ্জা পেয়েছে তাতে শুদ্ধর সামনে দাঁড়ানো মানে লজ্জায় সমুদ্রে ডুবে প্রান দিয়ে দেওয়া।
মাথাব্যথার অজুহাত দিয়ে নিজের ঘরে বসে রইলো সে।অনু আর বেশি চাপাচাপি করে নি।কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।মুক্তা এবং মৌনতা মিলে ওকে টেনে ঘর থেকে বের করে আনলো।
ডাইনিং এ এসে দেখলো শুদ্ধ টেবিলে নেই।ছবি এই সুযোগে আনোয়ারা বেগমের পাশের চেয়ারে গিয়ে বসলো।এইমুহূর্তে শুদ্ধ সামনে থাকলে ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে যেত সে।খুশিখুশি ভাব নিয়ে আনোয়ারা বেগমকে এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছিলো সে।উনি বিরক্ত হলেও ঘরভর্তি মেহমান দেখে দমে গেলেন।
একে একে সবাই বসে পড়লো নাশতা করার জন্য।
টেবিলের হাসি ঠাট্টায় শুদ্ধর কথা প্রায় ভুলেই গেছিলো সে।হঠাৎ হাতে একগাদা খাবারের প্যাকেট নিয়ে ডাইনিং টেবিলে এসে বসলো শুদ্ধ।ছবির মুখের খাবার সহই হেঁচকি উঠে গেলো শুদ্ধকে দেখে।
শুদ্ধ অনুকে প্যাকেট বের করতে সাহায্য করছে আর মিটমিট করে হাসছে।চিকেন কাবাব,শর্মা,গ্রিল চিকেন,স্যান্ডউইচ,আলুর চপ,ডিম পরোটা,জিলাপি,ফালুদায় টেবিল ভর্তি হয়ে গেলো।সবাই মজা করে খাওয়া শুরু করে দিলো।কিন্তু ছবির হেঁচকি থামছে না। মৌনতা ছবির দিকে পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
—পানি খাও!
ঢক-ঢক করে পুরো পানিটা খেয়ে নিল সে।যাক!অবশেষে হেঁচকি থেমেছে।
টেবিলে খাবার সাজানো শেষে শুদ্ধ আনোয়ারা বেগমের পাশের চেয়ারে বসলো।
ছবি আড়চোখে ওকে দেখছে।পানির জগ থেকে পানি গ্লাসে ঢেলে নিলো শুদ্ধ।কিন্তু খেলো না। সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ পানির গ্লাসটাকে করছে সে।
মুক্তা অবাক হয়ে বলল,
—পানির গ্লাসে কি খুঁজছিস তুই?
—লিপবাম!
ছবি বিষম খেলো।কাশির চোটে নাকেমুখে খাবার উঠে গেলো।সবগুলো মুখ একসাথে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।শুদ্ধ যেন দেখতেই পায় নি এমন ভান করে বলল,
—তোদের বিশ্বাস নেই।তাই চেক করে দেখছি গ্লাসে লিপবাম লেগে আছে কি না।কেমিক্যাল পেটে গেলে তো সমস্যা!
ছবি কাঁদোকাঁদো চেহারা নিয়ে বসে আছে।এভাবে তাকে অস্বস্তিতে ফেলে কি মজা পাচ্ছে শুদ্ধ?
ওর এমন অসহায় মুখ দেখে অনু বলল,
—কি রে তুই এমন হাড়ির মত মুখ করে রেখেছিস কেন?
ছবির এবার বিলাপ করে কাঁদতে মন চাইছে।অনু কেন সবসময় রং টাইমে রাইট কথা বলে? শুদ্ধ ঠোঁট কামড়ে হাসছে।
আগামীকাল সবাই ঢাকায় ফিরে যাবে।সবার গোছগাছের আয়োজন চলছে।ছবি আনোয়ারা বেগমের ঘরের দরজায় এসে দেখলো উনি ভেতরে নেই।সম্ভবত গোসলে গেছেন।ঘরে ঢুকে চুপচাপ উনার জামাকাপড় গুলো গুছিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলো সে।উনার ওষুধের কৌটা, চশমা, টুকটাক জিনিসত্র এক এক করে ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলো সে।
আনোয়ারা বেগম গোসল সেরে ঘরে ঢুকছিলেন।রুমের ভেতর ছবিকে দেখে দরজায় দাঁড়িয়ে গেলেন।আড়াল থেকে ওর কর্মকান্ড সব পর্যবেক্ষণ করলেন।ছবিকে উনার ব্যাগ গোছাতে দেখে অবাক হয়ে গেলেন।কিন্তু কোন শব্দ করলেন না।নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলেন।
ছবির গোছানো শেষ বেরোতে যাবে এমন সময় আনোয়ারা বেগমের মুখোমুখি পড়লো।আনোয়ারা বেগম কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
—তুমি আমার ঘরে কি করছিলে?
ছবি ভয়ে সেঁটে গেলেও ইতস্তত করে বলল,
—জ্বী আপনার ব্যাগ গোছাতে এসেছিলাম!
—কে বলেছে তোমাকে আমার ব্যাগ গোছাতে?আমি বলেছি? গরু মেরে জুতো দান করতে এসেছো?
ছবি মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।আনোয়ারা বেগম ধমকে উঠে বললেন,
—এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন?যাও নিজের কাজ করো!..কাজ দেখাতে এসেছে আমাকে।
ছবি বেরিয়ে গেলো।আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে আনোয়ারা বেগমের কথায় ওর যতটা খারাপ লাগার কথা ততটা লাগছে না।বরঞ্চ উনার ব্যাগ গোছাতে পেরে অদ্ভুত এক শান্তি লাগছে ওর।প্রচন্ড রকম আত্মতৃপ্তি হচ্ছে,যেটা আগে কখনো হয় নি।
আনোয়ারা বেগম থম মেরে কিছুক্ষন বসে রইলেন।ছবির হঠাৎ এমন কর্মকান্ডের কোন রকম সন্তোষজনক উত্তর তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না!ছবি কি নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত? সে কি তার ভুল বুঝতে পেরেছে? নাকি নিছক ঝোঁকের বশে এমন করছে? সত্যি যদি সে অনুতপ্ত হতো তাহলে তো নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইতো? কই চায় নি তো? মন ফিরিয়ে নিলেন আনোয়ারা বেগম!উনি কিছুতেই ছবিকে মেনে নেবেন না।উনার ছেলেকে অপমান করে উনার সাথে ভালোমানুষি দেখাতে আসছে? কিন্তু ব্যাখ্যাটা নিজের কাছেই যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে না।অবশেষে আশানুরূপ কোন উত্তর খুঁজে না পেয়ে তিনি নামাজ পড়তে চলে গেলেন।
ছাদে বসে সবাই আড্ডা দিচ্ছিলো।পড়ন্ত বিকেল! সূর্য ডুবুডুবু।হলুদ কমলা আভা ছড়িয়ে আছে সারা ছাদজুড়ে।আকাশটাকে মনে হচ্ছে কেউ যেন সাদা আর্ট পেপারে তুলি দিয়ে সাদা,নীল,কমলা, হলুদ আঁকিবুঁকি করেছে!দূরে কয়েকটা পাখি উড়ে যাচ্ছে।মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করছে ওরা!
হঠাৎ মৌনতা বলে উঠলো,
—এই ছবি তুমি গান গাইতে পারো?
ওর এমন প্রশ্নে শুদ্ধ ছবির দিকে তাকালো। উত্তরের অপেক্ষায় আছে সে।ছবি একটু হেসে মিষ্টি গলায় বলল,
—না আপু আমি গান পারি না!
—কিন্তু আমার যে মনে হচ্ছে তুমি গান গাইতে পারো?
ছবি নিরুত্তরভাবে লাজুক হাসি হাসলো।মৌনতা ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ বাঁকা করে বলল,
—তুমি কি লজ্জা পাচ্ছো?..লজ্জার কিছু নেই।আমরা আমরাই তো! গাও একটা গান।তোমার গলা মিষ্টি, সুর না থাকলেও খারাপ লাগবে না।
জোরাজুরি শুরু করে দিলো মৌনতা।ছবি দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলো।শুদ্ধ হাঁটতে হাঁটতে রেলিং এর কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।
মুক্তা অনুরোধ করে বলল,
—কি সুন্দর বিকেল! গাও না একটা গান!
ছবি কি গান গাইবে বুঝতে পারছে না।মৌনতা খোঁচা মেরে ফিসফিস করে বলল,
—রোমান্টিক দেখে গাইবে।তোমার হিরো কিন্তু এখানে আছে।
গতকাল রাতে ছবির পেট থেকে সব কথা বের করে নিয়েছে মৌনতা আর মুক্তা।ওদের বিয়ে কীভাবে হলো,শুদ্ধ ওকে পছন্দ করেছিলো কি না?বিয়ের দিন ছবি কি করেছিলো এমনকি ওদের বাসর রাতে কি হয়েছিলো এটা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করেছিলো মৌনতা।উপায়ান্তর না পেয়ে ছবি ঘুম পাচ্ছে বলে কোনরকমে ওদের কাছ থেকে পালিয়ে এসেছিলো।
শুদ্ধ একহাত ট্রাউজারের পকেটে ঢুকিয়ে অন্য হাতে ফোন স্ক্রল করছে।ওর পরনে খয়েরী রংয়ের ফুলহাতা শার্ট আর কালো ট্রাওজার।
ছবি নিষ্পলকভাবে শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে রইল।বিকেলের হলুদ আলোতে শুদ্ধর ফর্সা শরীর অদ্ভুত দীপ্তি ছড়াচ্ছে!ওর সেই দীপ্তি পুলোকিত করে দিচ্ছে ছবির সমস্ত শরীর এবং মন।পবিত্রতায় ছেয়ে যাচ্ছে সারা শরীর!আপনাআপনি চোখ বুজে এলো ওর।মৃদু আওয়াজে শুরু করলো সে,
— এত রোদ্দুর তুই এনে দিলি তাই,
তোর বৃষ্টি আমি একটু পেতে চাই!
মেঘলা হয়ে যাক আর পাঁচটা বারোমাস
কোন বিকেলবেলাতে তুই আমার হয়ে যাস!
শুধু তুই শুধু তুই আর চাইছি না কিছুই
শুধু তুই শুধু তুই আর চাইছি না কিছুই
চোখ খুলে দেখলো শুদ্ধ ফোন থেকে চোখ তুলে পলকহীন ওর দিকে চেয়ে আছে।সবাই চুপ করে আছে।নাহিদ মিটমিট করে হাসছে।ছবি সবার দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসি হাসলো।এমন সময় নিচ তলা থেকে অনুর গলার আওয়াজ শোনা গেলো,
—ছবিইই?..এই ছবি?
ছবি গান থামিয়ে দ্রুত পা ফেলে নিচে নামলো।
—কি আপু?
অনু চাপা স্বরে বলল,
—তোর কি কোন আক্কেল আন্দাজ নেই?
—কেন কি হয়েছে?
—এমন বেসুরা গলায় গান গাচ্ছিলি লজ্জায় আমার গা শিরশির করছিলো।তোর ভাইয়া ডেকে বলল, ছবিকে থামাও!আমি হাতের কাজ ফেলে চলে এসেছি।এই শুদ্ধ ছাদে ছিলো? ও শুনেছে?না একা একা গাইছিলি?
ছবির মুখের হাসি উধাও হয়ে গেলো।একটু আগে আবেগে ভাসতে থাকা ভেলাটা দুপ করে ডুবে গেলো।চিনচিন একটা অনুভূতি হচ্ছে বুকের ভেতর!।মুহূর্তগুলো কেন সসবসময় এমন নিষ্ঠুর হয়?শুদ্ধভাইয়া নিশ্চই মনে মনে ওক নিয়ে হাসছে? উনার বন্ধুরা? আর দাঁড়ালো না ছবি।নিজের ঘরে ঢুকে দুম করে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।ডিনারের আগের আর ঘর থেকে বেরোলো না সে।
রাতে ঘুমানোর আগে শুদ্ধর কফি খাওয়ার অভ্যেস আছে।সুগারফ্রি!ছবি ভেবে পায় না এত তিতা কফি শুদ্ধ এত আরাম করে খায় কি করে?আয়েশি ভঙ্গিতে কফির মগে একটা চুমুক দিতে দিতে বই পড়ে শুদ্ধ।ছবি লুকিয়ে লুকিয়ে অনেকবার সেই দৃশ্য অবলোকন করেছে।
অনুর শরীর খারাপ তাই অগত্যা কফিটা ছবিকেই বানাতে হলো।কালকে বিকেল থেকে এইপর্যন্ত যা যা ঘটেছে তাতে শুদ্ধর সামনে যাওয়া ভীষণ মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে ওর জন্য।কিন্তু উপায় নেই! তাই লাজলজ্জা ঝেড়ে অবশেষে কফি নিয়ে শুদ্ধর ঘরের দিকে পা বাড়ালো সে। দরজার কাছে আসতেই প্রচুর হাসাহাসির আওয়াজ পেলো সে।মৌনতা সালমানের সাথে ঝগড়া করছে সেই নিয়েই হাসাহাসি করছে সবাই।
—আসবো?
শুদ্ধ কোলের ওপর বালিশ নিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে খাটের কোনায় বসে হাসছিলো।ওর গলার আওয়াজ শুনে হাসি থামিয়ে বলল,
—এসো!
ছবি কফিটা খাটের পাশে ছোট টেবিলের ওপর রেখে চলে আসছিলো।যত দ্রুত এখান থেকে বেরোনো যায় ততই মঙ্গল।কিন্তু কথায় আছে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়।শুদ্ধ ওকে উদ্দেশ্য করে অস্ফুটসরে বলল,
—কবিতাটা দারূণ ছিলো।
ছবির রিয়েকশনের অপেক্ষা না করে কফির মগের চুমুক দিয়ে তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ করে ফেললো সে!ছবি ভ্যাবলাকান্তের মত দাঁড়িয়ে আছে!শুদ্ধ ওকে এভাবে লজ্জা দিতে পারলো? কত আবেগ দিয়ে গানটা গেয়েছিলো সে?গানের প্রতিটা শব্দে প্রতিটা বর্ণে শুদ্ধর কথা ভেবেছিলো সে!আর সেই মানুষটা ওর গানকে কবিতা বানিয়ে দিলো? কি নিষ্ঠুর!একরাশ অভিমান এসে ভর করলো ছবির হৃদয়ে জুড়ে।আর একসেকেন্ডও দেরী করলো না সে।দ্রুত বেরিয়ে গেলো। ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে শুদ্ধ!
.
.
চলবে
অল্প থেকে গল্প🍁
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব:১১
ঢাকায় ফিরে এসে সবাই যারযার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।ছবিকে কোচিং এ ভর্তি করানো হয়েছে।নিয়মিত কোচিং করছে সে।শুদ্ধ ওর কলেজ নিয়ে ব্যস্ত।উপল তার অফিস নিয়ে।মোটকথা অনু আর আনোয়ারা বেগম ছাড়া সবাই ব্যস্ত।
দুপুরবেলা ছবি নিজের ঘরে পড়ছিলো।অনুর চিৎকার শুনে দৌঁড়ে এলো। অনুর লেবার পেইন শুরু হয়ে গেছে। খাটের ওপর শুয়ে পেট ধরে অনবরত চিৎকার করছে সে।আনোয়ারা বেগম গোসলে গিয়েছেন। ছবি ঘাবড়ে গেলো। উপলের নাম্বারে ফোন করে কান্না করতে করতে বলল,
—ভাইয়া আপুর পেইন উঠেছে জলদি আসেন।
—কখন?
—এইমাত্র!
—তুমি তোমার আপুর কাছে থাকো আমি এক্ষুনি এম্বুলেন্স নিয়ে আসছি।
অনুর চিৎকারে ওর শ্বাশুড়ি তাড়াতাড়ি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলেন।ওর মাথায় কাছে বসে দোয়া দরুদ পড়তে পড়তে বললেন,
–আল্লাহ আল্লাহ করো বউমা।আল্লাহ ভরসা,ধৈর্য রাখো।…কিচ্ছু হবে না মা।একটু সহ্য করো।এইতো আর একটু!
অনু উনার হাত চেপে ধরে দাঁতমুখ খিঁচে চিৎকার করছেন।আনোয়ারা বেগম অস্থির কন্ঠে বলল,
—আল্লাহ ভরসা মা!এই তো আমি আছি।কিচ্ছু হবে না তোমার।
ছবি বোনের হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেললো।অনুর গগনবিদারী চিৎকার শুনেই বোঝা যাচ্ছে কত কষ্ট হচ্ছে ওর।কাঁটা মুরগীর মত তড়পাচ্ছে সে!কিছুতেই শান্ত রাখা যাচ্ছে না ওকে।
মিনিট দশেকের ভেতর কলিংবেল বেজে উঠলো।শুদ্ধ এম্বুলেন্স নিয়ে এসেছে।শুদ্ধ যেহেতু হস্পিটালে আছে তাই উপল ওকেই ফোন করে এম্বুলেন্স নিয়ে আসতে বলে।
ছবি দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকলো।সারা শরীর ঘামে ভিজে একাকার!
সোজা গিয়ে অনুর ঘরে ঢুকলো।অনুকে স্ট্রেচারে তুলে নিলো।ছবিও সাথে গেলো।আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার করছে অনু।ওর কান্না দেখে ভয়ে ছবিও হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলো।একটা বাচ্চা জন্মের সময় এত পরিমান কষ্ট সহ্য করতে হয় সেটা অনুকে না দেখলে বুঝতে পারতো না সে।অথচ সময়ের বিবর্তনে কারো কারো কাছে এই মা-ই হয়ে যায় উপেক্ষিত অবহেলিত! অনুর হাত ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছে সে।
—আল্লাকে ডাকো আপু!এই তো আমরা এসে গেছি।
—ছবি তোর ভাইয়াকে খবর দিয়েছিস?আমি বোধহয় আর বাঁচবো না।
ছবির দুগাল বেয়ে অনবরত পানি ঝরছে।ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
—অলক্ষুণে কথা বলো না আপু।তোমার কিচ্ছু হবে না।
হস্পিটালে পৌঁছে আর দেরী করে নি ওরা।সাথে সাথেই অনুকে ওটিতে ঢোকানো হয়েছে।শুদ্ধ আগেই ওটি রেডি করতে বলে গেছিলো।দুজন ডক্টর হন্তদন্ত হয়ে ওটিতে ঢুকলেন। রিকোয়েস্ট করাতে শুদ্ধকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হলো।
ওপারেশান স্টার্ট হওয়ার পনেরো মিনিটের মাথায় উপল হাঁপাতে হাঁপাতে হস্পিটালে ঢুকলো।মুখ খুলে মাছের মত হাঁ করে নিশ্বাস নিচ্ছে সে।দরদর করে ঘামছে।সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ছবিকে জিজ্ঞেস করলো,
–তোমার আপু কেমন আছে?
–ওটিতে নেওয়া হয়েছে।শুদ্ধ ভাইয়া ভেতরে আছে।
দেড়ঘন্টার মত হয়ে গেছে এখনো অনুকে বের করা হয় নি।উপল অস্থির ভাবে বারান্দায় পায়চারি করছে আর একটু পরপর ঘড়ি দেখছে।একটুপর একজন নার্স বেরলো।দৌঁড়ে গেলো ওরা।
—সিচুয়েশন ক্রিটিক্যাল,বাচ্চার পজিশন ঠিক নেই।আপনারা আল্লাকে ডাকুন।
উপল ফ্যালফ্যাল করে নার্সের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন।তারপর হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলো।নার্স কোনরূপ সন্তোষ প্রদান না করে ভেতরে ঢুকে গেলো।ভেতরে ঢুকার সময় উপল অনুরোধ করে বলল,
—প্লিজ সিস্টার,ডাক্তারকে বলে দেবেন অনুর যাতে কোন ক্ষতি না হয়!
দুহাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো সে।উপলের অবস্থা দেখে ছবি নিজের শোক ভুলে গেলো।এইপ্রথম উপলকে কাঁদতে দেখছে সে! দুহাতে মুখ ঢেকে অসহায়ভাবে কাঁদছে মানুষটা।ওর এই কান্না যদি অনু দেখতে পেতো ছবি নিশ্চিত,ভালোবাসার তৃপ্তিতে অনুর অর্ধেক কষ্ট কম হয়ে যেত।ভালোবাসার মানুষের বিপদে যখন প্রিয়জন অস্থির হয়ে যায় তখন তার কষ্টটা সার্থকতায় পরিবর্তিত হয়।ছবি মনে মনে বলল,
—এই মানুষটার জন্যের হলেও আপুর কোন ক্ষতি তুমি হতে দিও না খোদা!
ছবি উপলকে সান্ত্বনা দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।কিন্তু কিসের কি?ওর কোন কথা উপলের কানে ঢুকছে কি না সন্দেহ আছে।ওটি থেকে হাসিমুখে বেরিয়ে এলো শুদ্ধ।কোনরকম ভনিতা ছাড়াই উপলকে জড়িয়ে ধরে বললো,
–কংগ্রাচুলেশনস ভাইয়া!তোমার মেয়ে হয়েছে।
—তোর ভাবি?..অনুর কি অবস্থা?
—ভাবি ভালো আছে।
উপল খুশিতে শুদ্ধকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো।ছবি হাসিমুখে এগিয়ে এসে বলল,
–আন্টিকে ফোন করে জানিয়ে দেন ভাইয়া।উনি টেনশনে আছেন।
শুদ্ধ স্থির দৃষ্টিতে ছবির দিকে তাকালো।যেন এই প্রথমবার দেখছে ওকে।হ্যাঁ এই প্রথম ওর চোখে মুগ্ধতা দেখতে পেলো ছবি।লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেললো সে।ধীর গলায় বললো,
–আপুর সাথে কি দেখা করা যাবে?
–এখন না জ্ঞান ফিরলে দেখা করতে পারবে।এনেস্থিসিয়া দেওয়া হয়েছে তো,জ্ঞান ফিরতে একটু সময় লাগবে।
একঘন্টা পরই অনুর জ্ঞান ফিরলো।ছবি আর শুদ্ধ দেখা করে বেরিয়ে গেলো।অনুর পাশে ওদের ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েটাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে।উপল একদৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে।মেয়ের দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসছে।অনুর বেশ ভালো লাগছে।একটু আগের কষ্টটা নিমিষেই দূর হয়ে গেছে।কারণ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর একটা দৃশ্য দেখছে সে।পরোক্ষনেই আগের অভিমান মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো।কই উপল তো তার খবর নিলো না?মেয়ে নিয়েই ব্যস্ত সে!মুখ ঘুরিয়ে নিলো সে।
উপল মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে অনুর পাশে এসে বসলো। অনুর ডানহাতটা আলতো করে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে গভীরভাবে একটা চুমু খেলো।ওর চোখের পানিতে অনুর হাত ভিজে যাচ্ছে!অনু অবাক হয়ে বলল,
—কাঁদছো কেন?
উপল মাথা নাড়িয়ে বলল,
—কিছু না।
অনুর কপালে একটা চুমু খেয়ে বললো,
–থ্যাংকস অনু।আমি আজকে আমার জীবনের সেরা পুরষ্কার পেয়েছি।তুমি আমাকে আমার লাইফের সবচেয়ে সেরা গিফটটা দিয়েছিলো।আমাদের মেয়ে!আমাদের টুনটুন!
অনু একটু হাসলো।উপল ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
—এন্ড সরি ফর এভ্রিথিং!আমার ব্যবহার এর জন্য আমি মন থেকে অনুতপ্ত!তুমি আমাকে যা শাস্তি দেবে আমি মাথা পেতে নেবো।
আনুর ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিতে দুহাতে ওকে জড়িয়ে ধরলো উপল।ঘাড়ের কাছে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা অনুভূতি হচ্ছে।উপলের চোখের পানি অনুর ঘাড় চুইয়ে বালিশ ভিজিয়ে ফেলেছে।অনু জানে না তার কন্ডিশন কত ক্রিটিক্যাল ছিলো!তাকে বাচানোর জন্য ওটির ভেতরে তিনজন ডক্টর কীভাবে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলো। উপলের হাবভাব দেখে ধারনা করে নিলো তার কন্ডিশন বোধহয় ভালো ছিলো না!আচ্ছা সে যদি মরে যেত উপলের কি হতো? সে কি অনুকে ভুলে যেত? ও কি আরেকটা বিয়ে করতো?
চোখ বন্ধ করে আগের কথা মনে করলো অনু।ওর স্পষ্ট মনে আছে উপলকে যখন প্রেগেন্যান্সির কথা জানিয়েছিলো সেদিন উপল কি পাগলামিটাই না করেছিলো।একগাদা গিফট নিয়ে বাসায় ফিরেছিলো সে।অনু দরজা খুলতেই ওকে ঠিক এইভাবে জড়িয়ে ধরে একইভাবে কপালে একটা চুমু খেয়েছিলো।কোলে নিয়ে সারাবাসা হেঁটে ছিলো। অনুর সামনে হাটুগেড়ে বসে কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে বলেছিলো,
–আজ থেকে আই এম অলওয়েজ এট ইউর সার্ভিস ম্যাম।আপনি শুধু হুকুম করবেন,বান্দা হাজির হয়ে যাবে।
সেই থেকে ওর খাওয়া দাওয়া সব কিছু নিয়ে অতিরিক্ত সতর্কতা,ঘন্টায় ঘন্টায় খোঁজ নেওয়া।টাইমমত ওষুধ খাওয়ানো কোন কিছুতেই কোন ত্রুটি রাখে নি ও।
অনুর চোখের পানি গাল গড়িয়ে পড়লো।উপল যত্ন করে মুছে দিয়ে বললো,
—আর কখনো তোমাকে কষ্ট দেবো না প্রমিস।
—সত্যি তো?
হাসি ফুটে উঠলো উপলের ঠোঁটে। অনুর নাকে নাক ঘষে বললো,
—তিন সত্যি।
অনুর কাছে উপল থাকবে।সে কিছুতেই অনুকে ছেড়ে আজকে রাতে বাসায় যাবে না।ছবি থাকতে চেয়েছিলো উপল নিষেধ করে দিলো।তাছাড়া কালকে কোচিং এ ওর মডেলটেস্ট পরীক্ষা আছে।সারারাত হস্পিটালে থেকে পরীক্ষা দিবে কি করে?
শুদ্ধ একটু আগে বাসা থেকে এসেছে।আনোয়ারা বেগম অনুর জন্য মেক্সি,পানির ফ্লাস্ক ,উপলের জামাকাপড় আর টুকটাক জিনিসপত্র সহ খাবার দিয়ে দিয়েছেন।
রাত অনেক হয়ে গেছে ছবি বাবুর কাছে বসে একবার ওর গাল টিপে আদর করছে একবার নাক টিপে আদর করছে।শুদ্ধ চেয়ারে বসে আড়চোখে ওর কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করছে।
উপল বললো,
—এবার তোরা বেরিয়ে পড় শুদ্ধ।বেশি রাত হলে প্রবলেম হতে পারে।
শুদ্ধ উঠে দাঁড়ালো।অনু কাছে এসে বললো,
—ভাবি যাচ্ছি? সাবধানে থেকো কেমন? রাতে কোন সমস্যা হলে সিস্টারকে জানাবে।আমি বলে রেখেছি!ঠিক আছে?
—ঠিক আছে।তোমরা সাবধানে যেও।
উপল বললো,
—এই ছবি তুমি আসো আমরা নামছি।
—আসছি ভাইয়া।আপনারা নামুন!
ওরা বেরিয়ে লিফটের কাছে আসতেই উপল বলল,
—ফেরার পথে ছবিকে কিছু খাইয়ে নিস।ও তো কিছুই খায় নি!
—ঠিক আছে!
ছবি হস্পিটালের গেট থেকে বেরিয়ে দেখলো শুদ্ধ ওর জন্য অপেক্ষা করছে।চুপচাপ গিয়ে শুদ্ধর পেছন বাইকে উঠে বসলো।
সেদিন শুদ্ধ ওকে সোজা বাসায় নেয় নি।একেবারে আউটসাইড এলাকায় একটা রেস্টুরেন্ট নিয়ে গিয়েছিলো।ছবি প্রথমে বুঝতে পারে নি।শুদ্ধ হাসিমুখে বলল,
—ভাতৃআজ্ঞা!..চলুন!
রেস্টুরেন্টে ঢুকে ছবি মুগ্ধ হয়ে চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো।মনে হচ্ছে যেন ঘন জঙ্গল দিয়ে ঘেরা একটা রাজপ্রাসাদ,মাঝখানে পানির ফোয়ারা!এককথায় অসাধারণ মনোমুগ্ধকর একটা পরিবেশ।ছবির ভীষণ ভালো লাগছে।শুদ্ধর চয়েজ আছে বলতেই হবে।
তবে ভেতরে লোকজন তেমন নেই।আউটসাইড বলে হয়ত অথবা রাত বেশি হয়েছে তাই।ওরা একটা ফাঁকা টেবিলে বসতেই ওয়েটার এগিয়ে এলো।ছবির বারন করা সত্বেও একগাদা খাবার অর্ডার করলো শুদ্ধ।
ছবি খাবারের আইটেম শুনে হাঁ করে শুদ্ধর মুখের দিকে কতক্ষন তাকিয়ে রইলো।কিন্তু শুদ্ধর কোন ভাবান্তর নেই।নিজের জন্য একটা কফি অর্ডার করে ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে।
দশমিনিটের ভেতর খাবার এসে গেলো। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে শেষে জিজ্ঞেস করেই ফেলল,
–আপনি খাবেন না?
–হ্যাঁ আমার জন্য কফি অর্ডার করেছি।
–মানে?
–সরি ছবি আমি চাইনিজ বলতে পারি না।
শুদ্ধ আবার ফোনে মনযোগ দিলো।ছবি অবাক হয়ে নিজেকে একবার দেখে নিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
–ডু আই লুক লাইক আ ফুডি?
শুদ্ধ ফোন থেকে মুখ না উঠিয়েই বললো,
–নো ইউ আর নট।তোমাকে দেখলে তো মনে হয় তোমার ঘরে সৎ মা আছে।যে তোমাকে খেতে দেয় না।কিংবা তোমার স্বামী তোমার ওপর নির্যাতন করে।
এইটুকু বলেই শুদ্ধ ঠোঁট টিপে হাসলো।
.
.
চলবে