আজও_তোমারই_অপেক্ষায় পর্ব-০৭

0
188

#আজও_তোমারই_অপেক্ষায়
#আফসানা_মিমি
৭.

যাদের জীবনে এখন পর্যন্ত একবারও জে’লে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি, তাদের জন্য জে’লে যাওয়ার দারুণ এক সুযোগ। উত্তরার তিন নাম্বার সেক্টরে আরএকে টাওয়ারর
চতুর্থ তলায় উত্তরার সেন্ট্রাল জে’ল ক্যাফেতে হিমেল পরিবারদের নিয়ে এসেছেন। সাদা কালো কম্বিনেশনের জে’ল খানার ১৪ শি’কে’র রং দেখেই হিমার ভয় হচ্ছে। সে বান্ধবীদের কাছে অনেক শুনেছে। সে জানে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এই জে’লে আসলে বরং সাজার বদলে পাওয়া যাবে সুস্বাদু সব খাবার খাওয়ার সুযোগ। আর তাই কারাগারের ভেতর বসে খাবার খাওয়ার চমৎকার এই অভিজ্ঞতা পেতে চলে হিমেল পরিবারদের নিয়ে এসেছে।

হিমার ভীতু চোখ মীরের চোখে এড়ায় না। হিমেল এবং আশাকে ৭৮৬ নামের কারাগারে বসিয়ে হিমাকে নিয়ে বাহিরে চলে আসে। মীর এত দ্রুত কাজ করেছে যে হিমা বুঝে আসার আগে সে তাকে বাহিরে নিয়ে আসে।
হিমা ঘুরে ঘুরে কিছু প্ল্যাকার্ড ছুঁয়ে দিতে থাকে। মীর কোথায় থেকে এসে হিমার হাতে হাত কড়া পরিয়ে দেয়। হিমা হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করে, “ আমি তোমার কী চু’রি করেছি, মীর ভাই!”

মীর হাসিমুখে উত্তর দেয়, “ মন!”

হিমা তড়িৎ গতিতে ফিরে তাকায়। একদম চোখ বড়ো করে। মীর ভাবলেশহীন এদিক সেদিক দেখছে সে এই মুহূর্তে যে হিমার চোখ কানে বো’ম ফাটিয়ে দিয়েছে সেই ব্যাপারে তার কোন মাথা ব্যাথা নাই। অথচ হিমার অন্তরে অজানা যন্ত্র সমানতালে লাফাচ্ছে। হাত বাঁধা বিধায় সেখানে ছুঁয়ে দিতেও পারছে না। মনের সাথে শরীরও কাঁপছে। হিমা লম্বা লম্বা নিশ্বাস ফেলছে শুধু তা দেখে মীর বলে, “ বুঝতে পারছিস! আমার এখানে কেমন হয়! খুব তো পারিস, আমাকে তোর আগুনে ভষ্ম করতে। এবার তুই ভষ্ম হো, হিমালয়!”

“ কিন্তু আমি তো এখানে কোনো আগুন দেখতে পাচ্ছি না, মীর ভাই? না শুনতে পারছি ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির হর্ণ। তুমি কোন আগুনের কথা বলছো, একটু খুলে বলো শুনি?”

মীরের ইচ্ছে করছে চার তলা থেকে লাফ দিয়ে নিজের জান দিয়ে দিতে। হিমা কী তার কথা সত্যিই কিছু বুঝে না? নাকি অবুঝ সেজে মীরের ধৈর্যের পরীক্ষা নেয়! হিমার দিয়ে তাকিয়ে দেখে নিষ্পাপ চোখে মীরের উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে। সে রেগে শুধায়, “ তোর মাথায় কি মস্তিষ্ক নামক যন্ত্র আছে? নাকি মস্তিষ্ক ছাড়াই জন্মেছিস। তোকে যে বিয়ে করবে তার জীবন রফাদফা হয়ে যাবে।”

“ তুমি তো আর আমাকে বিয়ে করবে না, তাহলে এতো চিন্তা করছো কেন মীর ভাই!”

মীর রাগে হিমাকে ঐভাবেই একা ফেলে চলে আসে। পিছন থেকে হিমা ব্যথিত কণ্ঠে চিৎকার করতে থাকে, “ আমাকে একা ফেলে যেও না, মীর ভাই।”

মীর বিড়বিড় করতে করতে আশার পাশে এসে বসে। আশা নীরকে একা আসতে দেখে মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করে, “ হিমা কই রে?”
“ দেখো গিয়ে জে’ল খানায় ঢুকে কোন বোকামি করছে!”

মীরের চাবানো কথায় আশা বুঝতে পারছে এরা আবারও ঝগড়া করেছে। সে নিজেই এগিয়ে যায় হিমাকে উদ্ধার করতে। এদিকে মীর রাগে কাঁপছে। সে এমন এক বোকা মেয়েকে মন দিয়ে ফেলেছে যাকে মন বুঝাতে তাকে ভালোই নাকে চুবানি খেতে হচ্ছে। মীরের টেনশনে হাত নিশপিশ করছে সে হিমেলের দিকে তাকায়। ভদ্রলোক খাবারের মেন্যু পড়তে ব্যস্ত। মুখে হালকা শিশ বাজিয়ে শুধায়,“ হবে নাকি?”

দুই আঙুলের ইশারা হিমেল সহজেই বুঝে যায়। ঘাড় একটু উঁচু করে সতর্ক দৃষ্টি ফেলে ফিসফিস সুরে জবাব দেয়, “ বউ বাচ্চার সামনে কে’স খাওয়াবে নাকি? রাতে ডাবল আয়োজন করব, তখন এসো।”
মীর হিমেলের কথায় ভ্রু যুগল কুঁচকে নেয়। এরপর চোখের ইশারার হ্যাঁ বলে দুজনেই হেসে ফেলে।
আশা হিমার হাত কড়া খুলে নিয়ে আসে। এতটুকু সময়ে বেচারি হিমা কেঁদে কুটে একাকার। কাজল কালো চোখ জোড়া ফোলে গেছে। মীর এক পলক সেদিক তাকিয়ে মেন্যু কার্ডে মনোযোগ দেয়।
হিমা চিকেন আইটেম খুব পছন্দ করে তার সাথে পাস্তা। মীর নিজের জন্য সি ফুড অর্ডার করে আর আশা হিমেল বিফ আর কফি। ইতিমধ্যে খাবার চলে আসলে হিমার নজর সি ফুডের দিকে যায়। মীর খুব মজা করে তা খাচ্ছে। হিমার ঐসব সেদ্ধ খাবার দেখে নিজের খাওয়ার রুচি নষ্ট হয়ে যায়। তার হাত গুটিয়ে নেওয়া দেখে মীর বিরক্তির সুরে বলে,“ আবার কি হলো, ড্রামা কুইন?”

“ তুমি কাঁচা গোস্তও খেতে পারবে, মীর ভাই?”

হিমার আহত স্বর শুনে মীর খাওয়া বন্ধ করে দেয়। পাশাপাশি বসার কারণে সে হিমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে, “ আর একটা কথা বললে তোর গোস্ত ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবো, হিমালয়। আমাকে আর জ্বালাস না।”

হিমা রাগে মীরের মতোই ফিসফিস করে জবাব দেয়,“ তুমি রাক্ষস নামক মীর গুন্ডা, মীর ভাই। তোমার সাথে কথা নেই।”

হিমার রাগ করা দেখে মীর চিংড়ি বেছে তার প্লেটে রাখে। চোখের ইশারায় একবার টেষ্ট করতে বলে। হিমা মাথা না বোধক ইশারা করে মানা করায় মীর চোখ রাঙায়। বেচারি হিমা কাঁদো কাঁদো চোখে, ঠোঁট উল্টে তা মুখে নেয়। দুই একবার চাবানোর পর হিমার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে আসে। সে ভেবেছিল নুন, মসলা হীন শুধু চিংড়ি সেদ্ধ করে হয়তো পরিবেশন করা হয়। কিন্তু হিমার ধারণা ভুল। ভিন্ন ভিন্ন মসলার ফ্লেভারের চিংড়ি খেতে মজাদার লাগছে। মীর নিজের সব চিংড়ি হিমাকে বেছে দেয়। আশা তা দেখে বলে, “ ওকে সব দিচ্ছিস যে? তুই খাবি কী?”

মীর তখন হিমার দিকে তাকিয়ে দুষ্ট স্বরে জবাব দেয়,“ কেন, ওর গোস্ত!”

_____________________________

বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা বেজে যায়। অবশ্য ঢাকা শহর রাত বারোটায় সন্ধ্যা হয়। মানুষের আনাগোনা চলতেই থাকে। হিমার আজ বেশি খাওয়া হয়ে যাওয়ায় সে সরাসরি উপরে চলে যায়। এখন সে সাওয়ার নিয়ে লম্বা ঘুম দিবে। আশা রান্নাঘরে কফি বানাতে গিয়েছে। ঘুমানোর আগে তার বই পড়ার অভ্যাস। বইয়ের সাথে গরম কফির কম্বিনেশনটা তার মন ভালো করে দেয়। এই ফাঁকে মীর ও হিমেল ছাঁদে চলে যায়। দুজন আয়েশ করে ছাঁদে সাজানো বেতের চেয়ারে বসে সিগারেটের ধোঁয়া আকাশে উড়াতে থাকে। এক সময় হিমেল গলা পরিষ্কার করে জিজ্ঞেস করে, “ তা বিয়ে শাদি করবে না?”

মীরের উত্তর দিতে ইচ্ছে করছিল, “ এখনও তো আপনার মেয়েকে মনের কথা জানাতে পারলাম না, তার আগেই বিয়ে! দেখা যাবে আমি বিয়েট আসরে বসলে আপনার মেয়ে সেখানে এসে বলবে, মীর ভাই, তুমি কতো নারীর মন ভেঙে বিয়ে করতে বসলে?”
মীর হিমার কথা ভেবে হাসে। অকপটে উত্তর দেয়, ” আমার মতো ছোট বাচ্চার উপর এতে বড়ো বোঝা দিও না, ফুফাজি। শেষে আমার বউয়ের সাথে আমার সংসার না করে,তোমার করতে হবে।”

মীরের কথায় হিমেল কেশে উঠে। সে নরম সুরে জবাব দেয়, “ আশাই প্রথম, আশাই শেষ। আর কাউকে এই জীবনে চাই না।”

মীর চুপচাপ কথাটা শুনে। এরপর গাঢ় আঁধার আকাশের দিকে নজর দিয়ে আনমনে বলে,“ পৃথিবীর সমস্ত প্রেমিকের দীর্ঘ অপেক্ষার রাত ফুরিয়ে প্রেম নেমে আসুক। প্রেম নামক অসুখে প্রেমিকারাও আক্রান্ত হোক। তবেই কাল পরিবর্তন হবে, বাগানে সারাবছরই ফুল ফুটবে।”

গভীররাতে হিমার ঘুম ভেঙে যায়। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে আসে। সে ঘুম ঘুম চোখে নিচে নেমে এসে ফ্রিজ খুলে বোতল বের করে ঢকঢক করে পান করে ফিরে আসতে নিলেই কোন কিছুর সাথে হোঁচট পড়ে যেতে নিলে এক জোড়া হাত এসে ধরে ফেলে। হাত জোড়ার মালিক হিমাকে বুকে টেনে নেয়। হিমা স্পষ্ট সেই মানুষটার হৃদপিণ্ডের আওয়াজ শুনতে পায়। হিমার কাছে শব্দটা ভালো লাগছে। সে চোখ বন্ধ করে শুনতেই থাকে। কিছু সময় পাড় হতেই মানুষটার কথা হিমার কানে আসে। সে ধীর স্বরে বলে, “ তুই ঠিক আছিস,হিমালয়?”

হিমা মীরের বুকে হাত চেপে দূরে সরে যায়। নিজের দ্রুত বক্ষস্পন্দন টের পেয়ে বলে, “ মীর ভাই!”

মীর খাবারের টেবিলে সাজানো চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়ে। এরপর নীচু স্বরে বলে,“ হুম, আমি। ঘরে যা, হিমালয়!”

হিমা ভাবে মীরের আবার অসুখ হয়েছে তাই সে না গিয়ে আরো কাছে এসে বলতে শুরু করে, “ আজ আমি কোথাও যাব না,মীর ভাই! তোমার আবার অসুখ হয়েছে। মাকে ডাকব?”

“ আমি ম’রে গেলেই বা তোর কী, হিমালয়! অন্য একজন ছেলের গলায় ঝুলে পরবি!”

মীরের চোখ জোড়া রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। হিমা তা দেখে বেশ ভয় পেয়ে যায়।
“ আমি অন্য কাউকে বিয়ে করব না,মীর ভাই!”
মীর এইকথা শুনে বলে,“ তাহলে আমাকে করবি,তো!”
হিমা নিরুত্তর! এক পা এক পা করে পিছনে চলে যেতে নিলে মীর তার হাত ধরে ফেলে, খুব শক্ত করে; এরপর কাছে টেনে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, “ ভালোবাসবি নাকি ভালোবাসতে দিবি! চিঠির বলা হাস্যকর কথা যদি সত্যি হয়, আমায় তখন কী গ্রহণ করবি?”

————-

আজ সকাল সকাল হিমা তড়িঘড়ি করে তৈরী হয়ে নিচে নেমে আসে। মা মা বলে কয়েকবার ডেকে নিজেই রান্না ঘরে প্রবেশ করে চা বসায়। বাহিরে ফিরে সোফার দিকে নজর যেতেই আৎকে উঠে সে। মীর সারারাত এখানেই ঘুমিয়েছিল? মীরের এক হাত ঝুলে আছে। হিমার বড্ড মায়া হয়। সে ধীরেপায়ে মীরের কাছে এসে হাত উঠিয়ে দেয়। মীরের মুখের দিকে চোখ যেতেই গলা শুকিয়ে যায়। তার। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে মীরকে আজ সত্যি সত্যি গু’ন্ডা লাগছে। ঠোঁটে চোখ যেতেই হিমার রাতের কথা মনে পড়ে যায়। মীর তাকে গ্রহণ করতে বলছে। কিন্তু সে কীভাবে গ্রহণ করবে! এমনটাও নয় যে সে মীরের ইশারা বুঝতে পারছে না। সব বুঝে, কিন্তু কীভাবে মীরের ইশারায় সায় দিবে বুঝতে পারছে না। তাই তো সকাল সকাল প্রিয় বান্ধবীর সান্নিধ্যে যেতে চাইছে। মীরের চেহারা পর্যবেক্ষণ করতে করতে চা হয়ে আসে। চা কাপে ঢেলে সে মীরের সামনের সোফায়ই বসে। কপালের উপর সিল্কি চুলগুলো উড়ছে। হিমা মুগ্ধ হয়ে তা দেখছে। বলতে গেলে, সে মীরের ঘুমের মধ্যে সুযোগে সৎ ব্যাবহার করছে। সজাগ থাকলে তো মীর শুধু হিমাকে জ্বালাতে থাকে। হিমা সাহস করে ঐ চেহারার দিকে তাকাতেই পারে না। হিমার ভাবঘোর ভাবনার মাঝেই মীরের ঘুমন্ত স্বর শুনতে পায়, “ এত কী দেখছিস! নাকি আমার প্রেমে পড়েছিস, হিমালয়!”

চলবে ইনশাআল্লাহ…………..