আজও_তোমারই_অপেক্ষায় পর্ব-০৮

0
115

#আজও_তোমারই_অপেক্ষায়
#আফসানা_মিমি
৮.

কফি কার বা নাই পছন্দ! বাংলাদেশের সত্তর পার্সেন্ট কর্মজীবী মানুষ কাজের ফাঁকে দশ মিনিট সময় হাতে নিয়ে কফি শপে যায় এবং সেখানে নিরিবিলিতে কফি পান করে। এতে করে মস্তিষ্ক এবং শরীর দুটোই চাঙ্গা হয়ে যায়।
উত্তরার একটি কফি শপে হিমা এবং রিপ্তী বসে আছে। রিপ্তীর মাথায় হাত সে এই পর্যন্ত তিন গ্লাস কফির পরিবর্তে পানি পান করেছে। হিমা শান্ত হয়ে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। তার কোন ভাবগতি নেই যেন সে পূর্ব থেকেই জানতো, রিপ্তী এমনটাই করবে। হিমা কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে বিরক্তির সুরে বলে, “ তোর নাটক এবার বন্ধ কর, বদ মাইয়া। আমাকে বুদ্ধি দে এখন কি করব।”

হিমা নিজের অনুভূতি গোপন রেখে মীরের ব্যপারে এ টু জেড সব রিপ্তীকে জানিয়েছে। গতকাল রাতে মীরের বলা কথা জানানোর পর রিপ্তী অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম। বর্তমানে হিমার কথার সে জবাব দেয়, “ দোস্ত, তুই আমাকে এভাবে ছ্যাঁকা দিলি!”
হিমা আগে থেকে আরো বেশি বিরক্ত হয়ে বলে,“ ন্যাকামি বন্ধ করে এবার বল, তাকে সুযোগ দিব! নাকি যেভাবে চলছে চলুক!”

রিপ্তী এবার নড়েচড়ে বসে। সে হিমার কাছাকাছি এসে বলে, “ যেভাবে চলছে চলুক,দোস্ত। তুই সুযোগ বুঝে কো’প মা’র’বি। খবরদার! আমার মতো মীর ভাইয়ের গলায় ঝুলে পড়বি না! রিপ্তীর বেস্ট ফ্রেন্ডের একটা ভাবসাব আছে না!”

রিপ্তীর নাটকীয় কথায় হিমা ফিক করে হেসে ফেলে। সে রিপ্তীর মাথায় চাটা মে’রে বলে, “ আমিও তাই ভাবছিলাম। এখন তোর অবস্থা বল। তোর নতুন ডুগডুগির কি খবর? আছে নাকি ফুস!”

হিমার হাসি দেখে রিপ্তী লজ্জা পায়। মুখে দুষ্ট হাসির রেখা টেনে ফোন বের করে উত্তর দেয়, “ দেখ হিমুউউ! পুলাটা জোস না! জানিস এই ছেলে আমাদের পাড়ায়ই থাকে। আমাকে নাকি পথে ঘাটে অনেক দেখেছে কিন্তু আমি কেন দেখিনি? মনে হচ্ছে প্রপোজ করে দিবে।”

“ আর আমার কি হবে, রিপ্তী ডার্লিং!”

আকস্মিক মীরের কথায় চমকে উঠে দুজন। মীর হাসিমুখে হিমা ও রিপ্তীর মাঝখানে এসে বসে। সাথে সাথে ভয়ে হিমার হাতের অবশিষ্ট কফি পড়ে যায়। রিপ্তী ভয়ে আল্লাহ গো বলে বুকে থু থু দিতে থাকে। মীর দুজনের অবস্থা দেখে বাঁকা হাসে। হাতের ইশারায় ওয়েটারকে ডেকে টেবিল পরিষ্কার করতে বলে। হিমা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে মীরের দিকে তাকিয়ে বলে, “ তুমি কারো সাথে দেখা করতে এসেছো,মীর ভাই!”

“ হুম! একটা বন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছি, মেয়ে বন্ধু। তুই এত সকালে বান্ধবীর বাসায় না গিয়ে কফি শপে কি করছিস!”

হিমা জানে মীরের কোনো মেয়ে বান্ধবী নাই। আশার কাছে শুনেছে মীর ভার্সিটি লাইফ পর্যন্ত কোনো মেয়ের আশেপাশে থাকেনি। বর্তমানে হিমাকে ক্ষ্যাপাতেই মেয়েদের কথা একটু বেশি আলোচনা করে। হিমার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি আসে সে মীরকে জ্বালাতে ঢং করে বলে, “ আমাদের এক বন্ধু আসবে; ছেলে বন্ধু। তার জন্যই এখানে আসা। তুমি কিছু বলবে,মীর ভাই! না হলে তোমার বান্ধবীর কাছে যাও।”

মীর চেয়ারে আরাম করে বসছিল। হিমার কথা শেষ হতেই তার চুয়াল শক্ত হয়ে আসে। তড়িৎ গতিতে সোজা হয়ে বসে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “ তোর কোন বন্ধু? বাড়ি কই?নাম কি শুনি? আজ তো তাকে!”

হিমাকে মীরকে থামিয়ে লাজুক স্বরে বলতে শুরু করে,! ওর নাম কালা চান, দেখতে সাদা চাঁদের চারপাশের আন্ধার রাতের মতোন। তুমি দেখলে তো হিংসা করবে, তাই তোমাকে দেখাবো না।”

মীরের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে সে হিমার হাত ধরে উঠে দাঁড়িয়ে রিপ্তীর উদ্দেশ্যে বলে,“ একা যেতে পারবে না!”
রিপ্তী বিস্ময় হয়ে মাথা নাড়ায়। মীর আর এক মুহূর্তও সেখানে থাকে না। হিমাকে টেনে শপের বাহিরে চলে এসে রিকশা ডাকে। মীর হিমার হাত তখনও শক্ত করে ধরে রেখেছে রিকশায় উঠেও ছাড়েনি। এদিকে হিমা এটা সেটা বলে বকবক করেই যাচ্ছে, “ মীর ভাই, তুমি কাজটা ঠিক করো নাই। কালা চান এসে যদি আমাকে না দেখতে পায় তো খুব কষ্ট পাবে।”
“ আর আমও যে তোর সামনেই কষ্ট পাচ্ছি, তা তুই দেখতে পারছিস না!”

মীরের রক্তিম বর্ণ মুখ দেখে হিমা চোখ বন্ধ করে ফেলে। এরপর মিনমিন করে বলে, “ তোমার তো কয়েকদিন ধরেই শরীরে অসুখ। আমি কতো করে বলছি ডাক্তার দেখাও, শুনলে না। এখন রাস্তায় কিছু হলে আমি ডাক্তার পাবো কোথায়!”

মীর রাগে হিমার গাল চেপে ধরে। হিমার খুব কাছাকাছি এসে বলে, “ তুই তো আমার মনের ডাক্তার। চিকিৎসা করে এবার আমায় সুস্থ করে দে।”

মীরের এতো কাছাকাছি আসায় হিমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ইচ্ছে করছে তিন শব্দের জাদুকরী কথা বলে মীরের সকল কষ্ট দূর করে দিতে কিন্তু সে এত সহজেই মীরেকে বলবে না। হিমার গাল চেপে ধরা মীরের হাতের উপর হিমা হাত রেখে চোখ মুখ কুঁচকে বলে, “ তোমার মুখ থেকে সিগারেটের গন্ধ আসছে, মীর ভাই! যার জন্য আমার বমি পাচ্ছে।”

মীর হিমার গাল ছেড়ে দেয়। তার নজর হিমার হাতের দিকে, যেই হাত হিমেলের হাত ধরে রেখেছে। হিমা বাহিরে তাকিয়ে অনরগল কথা বলেই যাচ্ছে। সে কার হাত ধরে রেখেছে তার কোন খবর নেই।
“ মীর ভাই জানো! আমার না রিকশায় চড়তে বেশ লাগে। আর যদি সাথে রিপ্তী হয়,তাহলে তো কথাই নাই। তুমি কখন বন্ধুদের সাথে এভাবে ঘুরেছো!”

হিমা কথা শেষ করতেই মীরের দিকে তাকায়। মীরের দৃষ্টি অনুসরণ করে সে নিজে মীরের হাত ধরে রাখতে দেখে ভীষন লজ্জা পায়। হাত সরাতে নিলে মীর বাঁধা দেয়। সে আরেকটু শক্ত করে হিমার হাত ধরে সামনে তাকিয়ে বলে, “ এভাবেই থাক। আমার অসুখ ভালো হয়ে যাবে।”

হিমা আর কথা বাড়ায় না। লজ্জায় লাল নীল হয়ে শুধু বাহিরে তাকিয়ে থাকে।
_________________________________________

হিমাদের বাড়ির রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে। আশা সোফায় মাথা হাত দিয়ে বসে আছে। তার এতো সাধের রান্নাঘরের আজ কী বেহাল দশা হবে তাই ভাবছে। কেননা আশার ঘরের আদরের দুলালী আজ রান্নাঘরে ঢুকেছে। সে আজ সকলের জন্য নাস্তা বানাবে। নাস্তার আইটেম খুবই সামান্য, শুধু নুডলস রান্না করবে সে। আশা অনেকবার বলেছিল যে সে রান্না করে দিবে কিন্তু হিমার তখন এক উত্তরই ছিল, “ মা তুমি আমাকে সবসময় অকর্ম ভাবো।তুমি কী জানো! তুমি যা ভাবো আমি তা নই! আজ আমি প্রমাণ করেই ছাড়বো আমি অকর্ম নই।”

মীর বাহিরে ছিল। হিমার পছন্দের কিছু চকলেট আর চিকেন আনতে গিয়েছিল।আশাকে এই অবস্থায় বসে থাকতে দেখে বলে,“ তোমার সোয়ামীকে দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছে দেখে আসলাম। তাহলে কে ম’রে’ছে শুনি! এভাবে বসে আছো কেনো?”

মীরের কথা শেষ হতেই আশা আহত দৃষ্টিতে তাকায়। আঙুল দিয়ে রান্নাঘরের দিকে ইশারা করে বলে, “ আমার রান্নাঘর বাঁচিয়ে দে বাপ! হিমা সব চুরমার করে ফেলবে।”

আশার কথায় মীরের খুব হাসি পায়। আশা শুধু পারছে না কান্না করে দিতে। মীর আশ্বস্ত করে আশার উদ্দেশ্যে বলে, “আমি দেখছি।”
এরপর সে রান্নাঘরের কাছে গিয়ে হিমাকে ডাক দেয়,“ কি করছিস, হিমালয়?”
মীরকে দেখে হিমা খুবই খুশি হয়। আজ সে স্পেশালি মীরের জন্যই নাস্তা বানাচ্ছে। হিমা হাসিমুখে জবাব দেয়,“ তুমি এসেছো,মীর ভাই! আমি তোমার জন্য!”

হিমার কথা শেষ না হতেই প্রেশার কুকারে জোরে শব্দ হয়। ভেতরে থাকা নুডলস ছিটকে এদিক সেদিক ছড়িয়ে পড়ে। হিমার শরীরে লাগার আগেই মীর হিমাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে। হিমার মাথায় বাম হাত ধরায় গরম নুডলস সেখানে ছিটকে পড়ে। গরমে মীর চোখ বন্ধ করে নেয়। অনুভব করে নুডলস পড়া জায়গাটুকু জ্বলছে হয়তো পুড়ে গিয়েছে। হিমা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে মীরের দিকে তাকায়।কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, “ আজ মা আমাকে মে’রে’ই ফেলবে।”

আশা শব্দ পেয়েই বুকে হাত দিয়ে বসে পড়ে। সে তার সযত্নে রাখা রান্নাঘরের করুণ অবস্থা ভেবে কপাল চাপড়ায়।
এদিকে মীর হিমাকে ধরে দরজার কাছটায় দাঁড় করায়। এরপর চুলা বন্ধ করে রান্নাঘর নিজেই হালকা পরিষ্কার করে নেয়। হিমা সাহায্যের জন্য হাত বাড়ালে মীর থামিয়ে দিয়ে বলে,“ ঐখানেই দাঁড়িয়ে থাক,হিমালয়! আমার কাজ শেষ হলে তোকে ডাকবো।”

হিমা তাই করে। শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জোরে নাক টানে যার অর্থ সে কষ্টে কাঁদছে। মীর প্রেশারকুকারের অবস্থা দেখে হেসে ফেলে। হিমার দিকে কুকার এগিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করে, “ এই আইডিয়া টা কার শুনি? রান্নাঘরে জীবনেও পা দিয়েছিস? আমি ভাবছি বিয়ের পর তোর কী হবে।”

” বিয়ের পর তো তুমিই আছো,মীর ভাই!”

হিমার বিড়বিড় উত্তর মীরের কান অব্দি পৌঁছে না। হিমা তা দেখে দুষ্ট হাসে।সে জানে মীর যদি তার এই কথা জানতো, তো আজই কাজি অফিসে নিয়ে বিয়ে করে ফেলতো। হিমার মিটমিট হাসি দেখে মীর শুধায়,“ বরকে বিয়ের পর কীভাবে রান্না করে খাওয়াবি সেটা ভাবছিস নাকি?”

“ বরকে কোন বি’ষ দিলে মরবে, সেটাই ভাবছি মীর ভাই! তুমি কি এই বিষয়ে আমাকে সাহায্য করবে?”

হিমার কথায় মীরের কাশি চলে আসে। সে হিমাকে ধমকে বলে,“ বেশি পাকামি না করে এদিকে আয়! আমি তোকে রান্না করা শিখাচ্ছি।”

হিমা ভদ্র বাচ্চার মতো মীরের কাছে এসে দাড়ায়। একটি পরিস্কার পাত্রে সে অনেক আগেই পানি বসিয়েছিল যা এখন ফুটতে শুরু করেছে। মীর তার মধ্যে নুডলস ছেড়ে দেয়। এরপর অন্য চুলায় হিমার কে’টে রাখা মুরগির টুকরো করা গোস্তো ভেজে নেয়। নুডলস সেদ্ধ করে পানি ঝড়িয়ে প্রয়োজনীয় উপকরণ দিয়ে খুবই অল্প সময়ে রান্না করে ফেলে। হিমা খুব মনোযোগ সহকারে মীরের রান্না দেখেছে। মীর যখন রান্না শেষে হিমাকে নুডলস পরিবেশন করতে ঠিক তখনই তার নজর মীরের বাম হাতের দিকে পড়ে। জায়গাটা লালচে হয়ে আছে। হিমার তা দেখে খুবই খারাপ লাগে। সে বিচলিত হয়ে বলে,“ ইশশ কতটুকু জায়গা লাল হয়ে গেছে। তোমার কি অনেক কষ্ট হচ্ছে, মীর ভাই? ”

হিমার আদুরে কথার মীরের অন্তর কেঁপে উঠে। হিমা কবে এভাবে ভালোবাসার কথা বলবে? আদৌও কি বলবে নাকি সারাজীবন তাকে এভাবেই জ্বলতে হবে! সে সকলের অলক্ষ্যে বুকে হাত দিয়ে বলে,“ এখানেও কষ্ট হচ্ছে, হিমালয়! সারিয়ে দিবি?”

বিকালের নাস্তার পর্ব শেষে হিমা ফাস্ট এইড বক্স হাতে নিয়ে সেফায় মীরের পাশে এসে বসে। আশা আপাতত রান্নাঘর পরিষ্কার কাজে ব্যস্ত। হিমা আলতো হাতে মীরের হাত ধরে খুবই সাবধানে পু’ড়ে যাওয়া অংশে মলম লাগিয়ে দেয়। মীর এক দৃষ্টিতে হিমার মুখের ভাবভঙ্গী দেখছে। কপোলের উপর কিছু অবাধ্য চুল এসে হিমাকে দেখার মধ্যে বাঁধা প্রদান করে। মীর সেটা সযত্নে সরিয়ে দিতে নিলেই হিমাদের বাড়ির সদর দরজা খুলে যায়।
“ ওয়াও!” বলে রাদিফ ক্যামেরা তাক করে ক্লিক করে সেই মুহূর্তটাকে ক্যামেরাবন্দী করে নেয়।
মীর রাদিফকে দেখে ভ্রু যুগল কুঁচকে নেয় এরপর বিড়বিড় করে বলে,“ চলে এসেছে, আমার সতীন। হিমাকে এবার মনের কথা বলি কীভাবে?”

চলবে ইনশাআল্লাহ……….