আপনিময়_তুমি 2 Part -27 & Last Part

0
3076

#আপনিময়_তুমি?[ An unbearable Crazy love]
#Season: 02
#Written_By_Åriyâñà_Jâbiñ_Mêhèr[Mêhèr]
#Part: 27 & last part…

সকালে মৃদু পানির আঁচে ইহানের ঘুমটা হালকা হয়ে আসে। সারারাত না ঘুমানোর জন্য বিরক্তি ভরা চেহারায় চোখ মেলে তাকায় ইহান। বিরক্তির কারণ জানতে আশ-পাশ দেখিতেই দেখে আনহা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঝারছে৷ চুল হতে বিন্দু বিন্দু পানি ঝরছে৷ অপরুপ লাগছে আনহাকে। ও ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠে আনহার সামনে পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। আয়নার মধ্যে আনহার নজর ইহানের দিকে পড়তেই ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে কী দেখছে? ইহান চোখমুখে মুগ্ধতার হাসি ফুটিয়ে জানায় কিছুই হয়নি। তাতে আলতো হাসল আনহা। হঠাৎ ইহান ধীরস্থ আনহাকে জড়িয়ে ধরে গাল গালে ঠোঁটের পরশ বুলিয়ে বলে, ‘আই লাভ ইউ আনহা। ভালোবাসি আপনাকে…’

তৎক্ষনাৎ আনহা ওকে নিজের কাছ থেকে ছাড়িয়ে থাপ্পড় বসায় ইহানের গালে। ইহান গালে হাত রেখে আশ্চর্যান্বিত চোখে আনহার দিকে তাকায়। আনহা রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলে, ‘অসভ্য ছেলে সাহস কী করে হয় আমাকে ভালোবাসার কথা বলার?’

‘আনহা আমি সত্যি… ‘

‘ইহান…’ জোরে চিৎকার করল আনহা৷ ইহান তড়িঘড়ি চোখে আনহার দিকে তাকায়। আনহা ডাকছে, ‘এই ইহান…, এই ইহান..’

আনহার ডাকে হুশ ফেরে ইহানের। নিজের গালে হাত দিয়ে আশ-পাশ দেখে। ও আনহার পিছনে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারমানে আনহা ওকে থাপ্পড় মারেনি। সবটাই ওর ইমাজিনেশন ছিল।

আনহা ওর নীরবতায় মুখে বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘কিরে গালে হাত দিয়ে কী ভাবছিস? তখন থেকে ডাকছি।’

‘আপনি?’

‘আমি কী?’

ইহান কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায়। কিছুটা চিন্তিত মুখে অন্যদিকে তাকিয়ে ভাবান্বিত হয়। আনহা ভাজ পড়া কপালে জিজ্ঞেস করে, ‘কি রে কী ভাবছিস? আর খাম্বার মতো আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’

কিন্তু ইহান কোনো কথা বলল না৷ এখনো সেই একই ভঙ্গিমায় ভেবেই চলেছে। আনহা এবার বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তুই কি কিছু বলবি নাকি?’

‘চুপ করুন আনহা। ভুলে যাবেন না আমি আপনার হাজবেন্ড। সেই অনুযায়ী ভদ্রতা দিয়ে কথা বলুন। আমি আপনার বয়সে ছোট কিন্তু ভুলে যাবেন না আপনি এখন আমার স্ত্রী।’

কথাটা বলেই আনহার হাত থেকে তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে চলে গেল। হঠাৎ ইহানের এমন কথায় আনহা জাস্ট অবাক। ও বিস্মিত হয়ে ইহানের যাওয়া দেখল। বিস্মিত কণ্ঠের অস্পষ্ট কথায় বলল, ‘দিন গেল, রাত গেল ইহানের এখন মনে হলো আমি ওর ওয়াইফ!’
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
‘কিরে ভায়া এখানে আসার কথা বললি কেন?’ পাথরের উপরে ইহানের পাশে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল জিহাম। ইহান ওকে নদীর এখানে দেখা করতে দেখেছে। ‘কিরে ইহান বলছিস না কেন? আমাকে এখানে কেন ডাকলি? সব ঠিক-ঠাক ছিল নাকি কাল রাতে…’

‘আহ! ফালতু কথা শুরু করিস না তো?’

‘আচ্ছা যা করলাম না। কিন্তু কী হয়েছে তা তো বলবি?’

‘রাইসার সাথে দেখা করতে হবে।’

‘মানে!’

‘মানে আর কী আনহার সাথে বিয়ের ব্যাপারটা রাইসাকে বুঝিয়ে বলতে হবে।’

‘কেন বলত? তুই কী বউ, গার্লফ্রেন্ড একসাথে রাখতে চাস নাকি রে?’

জিহামের এই কথায় ইহান দাঁত কিড়মিড়িয়ে জিহামের দিকে তাকায়। ঠাসসঃ করে জিহামের গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে বলে, ‘বিয়ে করেছি বলে গার্লফ্রেন্ডকে ভুলে যাব৷ এমন অমানুষ আমি অন্তত নই। চল এবার…’

জিহামের ঘাড়ে হাত দিয়ে গরুর মতো ওকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল৷ জিহাম গালে হাত দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে শুধু এটাই ভাবছে, ‘এ কিরে বাবা। সালায় করতে চাইতাসে ডা কী?’

.
.
.
.
.
.
.
.
সারাটা দিন ইহান জিহামকে নিয়ে পাগলের মতো বেরিয়েছে। সন্ধ্যার পর রাইসাকে লাভার্স পয়েন্টে আসতে বলেছে। ইহানের বিয়ের ব্যাপারে এখনো কিছু জানেনা। সন্ধ্যার পর রাইসা লাভার্স পয়েন্টে আসে৷ ইহান আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিল। ইহানকে সামনে দেখেই রাইসা এসে ওকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু ইহান কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। রাইসা ভ্রুকুটি করে ইহানের কাছ থেকে সরে জিজ্ঞেস করে, ‘কয়দিন ধরে তোমার কোনো খবর না পেয়ে আমি যেন পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। থ্যাংকস গড আজ তোমার দেখা পেলাম। নাহলে তো আজ তোমার বাড়িতে যাওয়ার কথা ভেবেছিলাম আমি।’

ইহান প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে পারল না। কিছুটা শঙ্কিত হলো রাইসা৷ একবার জিহাম আরেকবার ইহানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী হলো তোমাদের এমন দেখাচ্ছে কেন? কিছু হয়েছে?’

এবারেও ইহান চুপ। তাতে শান্ত থাকতে পারল না রাইসা৷ ভয়ার্ত কণ্ঠে ইহানের হাত ধরে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে ইহান? কিছু বলছ না যে?’

ইহান রাইসার দু’কাঁধ ধরে ওকে শান্ত হতে বলল। কিন্তু ইহানের নীরবতায় উদ্বেগিত রাইসা কিছু শুনতে নাকচ। ইহান শক্ত করে ওর কাঁধ ধরে বলল, ‘অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে রাইসা। আই এম সরি৷’

‘কী হয়েছে?’ শঙ্কিত কণ্ঠে জানতে চাইল রাইসা। ইহান একবার রাইসা, আরেকবার জিহামের দিকে তাকায়। জিহাম ইশারায় ওকে সাহস দিয়ে সবটা বলতে বলে।

‘কী হলো ইহান চুপ আছ কেন? কিছু বলো?’

‘আমার বিয়ে হয়ে গেছে৷ আমি বিয়ে করে নিয়েছি রাইসা।’

কথাটা বলেই রাইসাকে ছেড়ে কিছুটা দূরে সরে গেল ইহান। রাইসা বিস্ফোরিত চোখে ইহানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি মজা করছ তাই না ইহান। সবসময়ের মতো আজকেও তুমি মজা করছ?’

‘সরি রাইসা, বাট এটাই সত্যি। আমি কোনো মজা করছি না। আমি সিরিয়াসলি বলছি।’

”কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না ইহান। তুমি…’

রাইসার কথা শেষ হওয়ার আগেই জিহাম বলে উঠল, ‘ও সত্যি বলছে রাইসা। ইহান সত্যি বিয়ে করেছে।’

‘কিন্তু… ‘

তৎক্ষনাৎ রাইসা পড়ে যেতে নেয়। ইহান ধরতে গেলে ওকে সরিয়ে দেয়৷ জিহাম ওকে সামলায়। বলে, ‘দেখ রাইসা আমি জানি তুমি ইহানকে ভালোবাস। কিন্তু সত্যি এটাই ওর বিয়ে হয়েছে। আর কার সাথে হয়েছে জানো?’

‘কার সাথে?’ প্রশ্ন ছুড়ল রাইসা।

জিহাম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘আনহার সাথে।’

‘আনহা আপুর সাথে! কিন্তু ওনি তো ইহানের বড়…’

‘তাহলেই বুঝো। কালকেই ওদের বিয়েটা হয়েছে। তবে ইচ্ছেকৃত নয়।’ তারপর সব ঘটনা খুলে বলে রাইসাকে। রাইসা সবটা শোনার পর ইহানের কাছে যায়। ওকে বলে, ‘ইহান তুমি কী আনহাকে ডিভোর্স দেবে? তোমাদের বিয়েটা তো… ‘

‘সার্ট আপ রাইসা। আমি এখানে তোমার থেকে সরি বলতে এসেছি। না চাইতেও আমি তোমার সাথে অন্যায় করে ফেলেছি৷ তারমানে এটা নয় যে, আমি আমার বিয়েটা…’

আর কিছু বলার আগেই রাইসা ইহানের গালে প্রচন্ড জোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। ইহানের শার্টের কলার ধরে বলে, ‘তাহলে আমার সামনে এসেছ কেন? তোমার বিয়ে হয়েছে সেই খবরটা জানাতে? কী করে ইহান?’

ইহান চুপ।

রাইসা নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে নিজেই নিজের চুল ছিঁড়তে লাগল। ইহানকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ঠিক আছে। তুমি যখন তোমার সো কল্ড বিয়ে থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারবে না, সো এই রিলেশনে আমি টাইম ওয়েস্ট করব না। আজ এখানে, এই মুহূর্তে আমাদের সকল সম্পর্ক শেষ। তুমি তোমার লাইফ, তোমার বিয়ে নিয়ে ভালো থেকো। গুড বায়।’

বলেই চোখ মুছে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল রাইসা। রাইসা চলে যেতেই ইহান যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। দপ করে মাটিতে বসে পড়ে। তা দেখে জিহাম বলে, ‘কি রে গার্লফ্রেন্ড চলে গেল বলে মন খারাপ হয়েছে নাকি রে? তবে যাই বল থাপ্পড়টা কিন্তু বেশ জোরেই দিয়েছে।’

ইহান এক বুক শ্বাস নিয়ে বলল, ‘আমি ভেবেছিলাম হয়তো আরও কয়েকটা দেবে। কিন্তু একটাতেই যে কাজ হয়ে যাবে ভাবতে পারি নি।’

‘বেচারিকে কিন্তু কষ্ট দিয়ে ফেললি।’

‘আরে রাখ তোর কষ্ট। থাপ্পড় তো অপরাধের জন্য খাইলাম। ওর সাথে এক বছরের রিলেশনশিপে ছিলাম বলে। নাইলে এই থাপ্পড়ের বদলে ওকে দুইটা দিতাম।’

‘মানে!’ জানতে চাইল জিহাম।

ইহান দায়সারাভাবে উত্তর দিল। ‘রাইসা লেখাপড়ার জন্য আর কয়দিন পরই ইউএসএ যাবে। এই জন্য ও নিজেও ব্রেকয়াপ করতে চাইছিল। কিন্তু আমার জন্য পারে নাই। এতদিন তো খালি ছুঁতা খুঁজছে।’

‘কীহঃ’

‘আচ্ছা তোর কী মনে হয় বলত? এক বছর রিলেশনে থাকার পর শুধু একটা কথাটাই কোনো মেয়ে এভাবে ব্রেকাপ করে নেয়। তাও আবার সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে। আমি যদি এখন গিয়ে বলি না যা বলছি সব মিথ্যে বলছি রাইসা এটাই বলবে—আমি নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি।’

‘তাহলে তুই কেন এটা করলি?’

‘থাক না ভাই ও নিজের মতো। আমি তো ওকে কোনোদিন ভালোবাসিনি। জাস্ট…। শুধু শুধু নিজের কাছে ওকে অপরাধী করার মানে হয় না। ওর স্বপ্ন ইউএসএ। কিন্তু আমার চাওয়া তো অন্যকিছু। তাহলে কেন আমি ওকে ওর নজরে দোষী বানাব। বরং ও গ্লানি ছাড়া নিজের স্বপ্ন পূরণ করুক, আর আমি আমারটা। তাই আমিই ওকে নিজের বিয়ের কথা বললাম।’

‘তারমানে তুই রাইসাকে ভালোবাসতি না। তাহলে কী আমার ধারণাই ঠিক তুই আনহাকে…’

হাসল ইহান। এক বুক প্রশান্তির শ্বাস নিয়ে বলল, ‘নাহলে কী ভাই এত কিছু করতাম।’

‘মানে?’ বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইল জিহাম। ইহান কিছুটা ইতস্তত হয়ে বলল, ‘তোর কী মনে হয়—আমি বললে আনহা আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যেত? কখনোই না।’

‘তাহলে…?’

ইহান দপ করে মাটিতে বসে পড়ে। আলতো হাসে। অতঃপর বলে, ‘সেই ছোট্ট বেলা থেকে আনহার মাঝে আমি নিজের খুশি পেয়েছি। ওনাকে জ্বালিয়ে নিজের শান্তি পেয়েছি। সেদিনকার বলা আনহার মিথ্যে কথায় এতটা আঘাত পেয়েছিলাম বলার মতো না। ছোট ছিলাম তো। তাই বুঝিনি আনহা কেন মিথ্যে বলেছিল। কিন্তু বড় হয়ে বুঝেছি কথাগুলো বলা কতগুলো দরকার ছিল।

তারপর বাবার সাথে আবার ঢাকায় ফিরে আসি। জানতে পারি আনহারা চলে গেছে। কিন্তু কোথায় গেছে জানতাম না। জিজ্ঞেস করার মতো কাউকে খুঁজে পাইনি। আমি জানতাম না বাবা আনহাকে চেনে। তারপর সেই ভার্সিটির থাপ্পড়। আনহার গলায় নিজের লকেট দেখা। ওনাকে চেনা। ব্যস, এইটুকুই…’

‘তুই কী আনহাকে ভালোবাসতি ইহান?’

‘হয়তো বাসতাম। কিন্তু মানতে পারিনি ইয়ার। এই সমাজের বয়সের ভেদটা যে অনেক বেশী। কিন্তু একটা বছর আনহার সাথে থাকার পর আমি মানতে বাধ্য হই আমি আনহাকে ভালোবাসি। নাহলে দেখ, রিসা আমার গার্লফ্রেন্ড। অথচ, দিন-রাত ২৪ঘন্টা আমার ভাবনা-চিন্তায় শুধু আনহাই ছিল। সেটা তো এমনি এমনি নয়।’

‘তারমানে তোর বাবা ছেলের মন বুঝেছ বল।’

দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ল ইহান। বলল, ‘বাবা যদি এমনি এমনি আমার মন বুঝত তাহলে তো হয়েই যেত রে পাগলা। সেটা তো হয়নি। তাই এত কাঠ-খড় পোড়াতে হলো।’

‘কী বলিস? তুই তো বিয়ে করতে চাইছিলি না। আংকেল নিজেই তো…’

‘তুইও না। আচ্ছা একটা কথা বলতো, আমি কিভাবে বাবাকে বলতাম বাবা আমি আমার থেকে তিনবছরের একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছি। তাকে বিয়ে করতে চাই। তুইই বল এটা কী আদৌতেও সম্ভব ছিল?’

‘তাও ঠিক।’

‘আর আনহা। আমি কোথাও না কোথাও জানতাম সে রাইসাকে নিয়ে জেলাস। কিন্তু স্বীকার করবে না। আমি যদি মরেও যেতাম, তবুও তিনি কোনোদিন আমার ভালোবাসা স্বীকার করত না। তাই তো শেষ পর্যন্ত বাবাকে ইমোশনালি ব্লাকমেইল করতে হয়েছে।’

‘কী বলতে চাইছিস?’

হাসল ইহান। বলল, ‘আসলে বাবাকে দেখে আমি বুঝে গিয়েছিলাম বাবা আনহার প্রতি স্নেহশীল। তুই জানিস আমার ধারণা মতে, বাবা আনহার জন্য ছেলে ঠিক করেছিল। আমি এত কষ্ট করে, নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাহিদের কাছ থেকে ওনাকে বাঁচিয়ে আনলাম। আর আমার বাপটা কিনা অন্যের হাতে তাকে তুলে দিতে চায়। তাই তো আনহাকে বাড়িতে এনে বাবাকে ইমোশনালি ব্লাকমেইল করেছি। যাতে ওনার এটা মনে হয়—আমি আনহাকে ভালোবাসি, কিন্তু মেনে নিতে পারছি না।’

‘তারপর…’

‘তারপর আর কী? পরেরদিন মাহিদ এল। আমার বাপ ছেলে ও আনহার ভালোর কথা ভেবে আমাদের বিয়ের কথা বলল। ব্যস আমাকে আর কিছু করতেই হলো না। যা করার আমার বাবাই করে দিল। আনহা আমার কথায় রাজি না হলেও আমার বাবার কথায় রাজি হতে একপ্রকার বাধ্যই হলো। আমার আর কী আমার তো আমার আপনিময় তুমির প্রয়োজন ছিল। বাকিটা রসাতলে যাক।’

‘দাঁড়া দাঁড়া একটু দম নিতে দে।’ জিহাম নিজের বুকটা ঘঁষে বলল, ‘বাকিটা এবার বল। তাহলে বাসর রাত নিয়ে এত ন্যাকামি করার কী ছিল মশাই। সবটা তো মনের মতোই পেয়েছিলি।’

ইহান এবার নিজের মুখে কিছুটা লজ্জার ছাপ ফেলে বলল, ‘যাতে বিয়ের পর চড়-থাপ্পড় খেয়ে মান-ইজ্জত না যায় তার জন্য।’

‘মানে?’

‘আসলে কী বলত? এই কাহিনীর পরে আনহার মনে বদ্ধ ধারণা জন্ম নেবে ওনার আর আমার বিয়েটা আল্লাহর রহমত। এতে মানুষের কোনো হাত নাই। আর আমি যদি তখন ওরকম না করতাম তাহলে ওনি এটাই ভাবতো আমি বোধহয় ওনার ব্যাপারে আগে থেকেই এরকম চিন্তা পোষণ করেছি। না চাইতেও ওনার নজরে ছোট হয়ে যেতাম। তাই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বর্তমানটাকে বলিদান দিয়েছি। কয়েকদিনের তো ব্যাপার। তারপর সবটাই তো আমার ইয়ার।’

‘সালা খচ্চর তোর মতো জিনিস আমি আরেক পিছ দেখি নাই। ভাই ব্যাপারগুলোরে এতটাই নরমাল দেখাইছিস, তাতে যে এরকম সত্যি লুকানো থাকব কে জানত?’

‘ধুরঃ, আমি পিচ্চি মানুষ এতকিছু কী বুঝি নাকি? তবে হ্যাঁ, এবার আমার স্বাদ পূরণ হবে। বিয়ে হয়েছে। এবার বাসরও হবে। সাথে তিনটে বাচ্চা-কাচ্চাও হবে।’

‘সব বুঝলাম। কিন্তু তুই খালি বাচ্চা-কাচ্চার কথা চিন্তা করস কেন?’

‘আরে এখন বাচ্চা-কাচ্চা হইলে আমার বাবা-মা পেলে পুষে বড় করে দিব। আমার ঝামেলা কম হবে। নাহলে তো…’

‘থাক ভাই তুই এবার যা। আমার কাজ আছে। তোর সাথে থাকলে এবার আমার মাথা নষ্ট হয়ে যাবে।’

‘কিন্তু…’

জিহাম ইহানের আর কোনো কথা না শুনে সেখান থেকে স্থান ত্যাগ করল।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
আনহা ছোট একটা ব্যাগে নিজের টুকিটাকি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে৷ ইহানের বাড়িতে এসে অন্তির বাড়ি থেকে নিজের সমস্ত কিছু নিয়ে এসেছিল, সেগুলোই গুছিয়ে রাখছে। ইহানের কাছ থেকে যা যা পেয়েছে তা মূলত কিছুই নিচ্ছে না। নেবেও বা কী? এখানে এসে যা পেয়েছে সবটাই ইহানের বাবা আসাদের কাছ থেকে পেয়েছে। সেটা প্রয়োজনের কিছু হোক বা স্নেহ। ইহানের মা অপর্ণা আনহাকে সহ্যই করতে পারেন না। আর ইহান ও তো থেকেও না থাকার মতো হয়ে পড়েছে। বিয়ের হয়েছে বেশ কিছুদিন কেটেছে। অথচ আনহার সাথে একটা বার কথা বলার সময় ইহানের হয়নি। বিগত কয়েকদিন ধরে ঠিক মতো বাড়ি ফেরেনি। আসাদ যদিও আনহাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছে সবটা ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু অপর্ণার কথায় আনহা বুঝে গেছে কিচ্ছু ঠিক হবে না। বরং ও না থাকলেই সবটা ঠিক হয়ে যাবে। ইহানও আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যাবে। বাড়ি ফিরবে। আনহাও তো তাই চেয়েছে। এ কয়দিনে ও ইহানের সাথে ডিভোর্সের কথা বলতে চেয়েছে। কিন্তু কোনোটাই বলার সুযোগ পায়নি৷ তাই আজ ঠিক করেছে, এ বাড়ি থেকে ও চলে যাবে। ডিভোর্স তো অন্য কোথা হতেও দেওয়া যায় তাই না? যে ভাবা সেই কাজ। আনহা নিজে যা এনেছিল শুধু সেগুলোই গুছিয়ে নিচ্ছে। যা এখান থেকে পেয়েছে সবটাই রেখে যাচ্ছে। এমনকি ইহানের দেওয়া সেই লকেটটাও। চেয়েছিল আজ রাতেই চলে যাবে। কিন্তু না প্রায় ১০টা বাজে। এখন যাওয়া যাবে না। তাই সকালে যাওয়ার ডিসিশন নিয়েছে। কারণ আজ রাতেও ইহান বাড়ি ফিরবে না। তিন দিন আগে ফিরে কয়েক মুহূর্ত থেকে চলে গেছে৷ তাই আর এসব নিয়ে আনহা ভাবছে না। তাছাড়া আকাশের অবস্থায় ভালো না। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। আনহা সমস্ত ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে পাশে রেখে দেয়। ঘুমোনোর জন্য বিছানায় উঠে। সহসা ধমকা হাওয়া বইতে শুরু করে। আনহা দ্রুত জানালা বন্ধ করতে ছুটে যায়। ততক্ষণে ভারী বর্ষন শুরু হয়ে গেছে। আনহা বন্ধ করার লক্ষ্যে জানালায় হাত দেয় ঠিকি। কিন্তু কিছু একটা ভেবে থেমে যায়। বন্ধ না করে জানালা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। বাইরে থেকে আসা প্রবল হাওয়ার সাথে ঝাপসা পানির আঁচ আনহার মুখে উপর পতিত হচ্ছে। স্তব্ধ আনহা আঁখিদুটি বন্ধ করে তা কেবল অনুভব করছে। তৎক্ষনাৎ লোডশেডিং হওয়ার আভাস পায়। বৃষ্টির মধ্যকার স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু মোম জ্বালিয়ে আলোর রেখা দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেয় নেই ওর মন। অন্ধকারই যেন এখন প্রকৃত সঙ্গী হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।

এভাবে কিছুক্ষণ কাটিয়ে দেবার পর আচমকা জানালা বন্ধ হওয়ার আভাস পায় না আনহা। কুঞ্চিত কপালে চোখ খুলে পিছন ফিরতেই থমকে যায়। ইহান দাঁড়িয়ে। ভিজে ছিপছিপে হয়ে দাঁড়িয়ে। আনহা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকায়। অন্ধকারের আবছা আলোয় একজন অপরজনকে স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাচ্ছে। ইহান কেমন একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে। খানিকটা ইতস্তত হয় আনহা। ইহানের চোখের থেকে চোখ সরিয়ে আমতা আমতা কণ্ঠে বলে, ‘তুই এখন?’

‘আমার ঘরে আমার আসা বুঝি মানা আনহা?’

‘আমি তো তা বলিনি। তুই তো এমন সময় আসিস না তাই।’

ইহান ওর কথার জবাব না দিয়ে ড্রয়ার থেকে মোমবাতি জ্বালায়। সেটা আয়নার সামনে রেখে আনহার দিকে এগিয়ে যায়। ইহান আনহার কাছে এসে ওর দিকে হাত বাড়াতেই আনহা পিছনে সরে যায়। কিন্তু ইহান আরেকটু এগিয়ে বুড়ো আঙুলে ওর মুখের পানিগুলো মুছিয়ে দিয়ে বলে, ‘এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছেন কেন? যদি ঠান্ডা লেগে যায়?’

‘লাগবে না।’

‘আমি জানি লাগবে।’

‘তুই আমার চেয়ে আমাকে বেশী চিনিস?’ ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বলল আনহা। কিছুটা হাসল ইহান। শান্ত ভঙ্গিতে হাসল। যার মানেটা হ্যাঁ নির্দেশ করছে। আনহা ইহানের সাথে আর কথা না বাড়িয়ে সরাসরি বলে ওঠে, ‘আমি তোকে ডিভোর্স দিয়ে দিচ্ছি৷ এই টানাপোড়েনের সম্পর্কটাকে না তোর টেনে নিতে হবে, আর না আমি নেব।’ বলেই ইহানের সামনে থেকে চলে যেতে যায়। কিন্তু পারে না। ইহান আনহার হাত ধরে একটানে নিজের কাছে নিয়ে এসে আনহার দু’গাল ধরে বলে, ‘যদি ছেড়ে যাওয়ার হতো তাহলে বিয়ে কেন করেছিলেন?’

‘ইহান…’

‘আমি তো ছেড়ে দেব বলে বিয়ে করিনি। বিয়েটাকে বিয়ের মর্যাদা দেব বলেই বিয়ে করেছি।’

‘সেটা সম্ভব নয়।’
ইহানের কাছ থেকে ছাড়াতে চাইল নিজেকে। কিন্তু পারল না৷ ইহান আরও শক্ত করে ওর গাল ধরে আছে৷ আনহা বাধ্য হয়ে বলল, ‘আমাদের সম্পর্কটা কোনোদিন স্বাভাবিক হওয়ার নয়। তাছাড়া, আমার মা মাহিদের কাছে আছে ওনাকে…’

‘মাহিদ এখন জেলে আনহা।’

কথাটা শুনে বিস্ফোরিত চোখে তাকায় আনহা। ইহান মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, আনহা মাহিদ এখন জেলে। এ কয়দিন এখন কষ্ট করে ওর বিরুদ্ধে প্রমাণ যোগাড় করে ওকে জেলে যেতে বাধ্য করেছি। কাল সকালে সাহানা আন্টি আপনাকে নিতে আসবে।’

‘তাহলে কাল চলে যাব আমি।’ ছলছল চোখে বলল আনহা।

ইহান ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, যাবেন৷ তবে ইহানের স্ত্রী হিসেবে। আমি নিয়ে যাব আপনাকে৷’

তৎক্ষনাৎ ফুঁপিয়ে ওঠে আনহা। বলে, ‘আমার জন্য তোকে আর কিছু করতে হবে না ইহান। অনেক করেছিস। এবার নিজের মতো করে ভালো থাক।’

আনহা সরতে চাইলে আনহাকে সরতে না দিয়ে তৎক্ষনাৎ বেডের মধ্যে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় ইহান। আনহা উঠার চেষ্টা করলে সহসা ইহান ওর পেটে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে৷ ততক্ষণে আনহার কান্না প্রবল আকার ধারণ করেছে৷ কিছু বলতে পারছে না৷ ইহান ওর কান্নার সুরে নিজে থেকেই বলল, ‘ভালোবাসি আপনাকে আনহা৷ তাই আমি বিয়েতে রাজি হয়েছি৷ আপনাকে করুণা করতে নয়। আর না মাহিদের হাত থেকে আপনাকে বাঁচাতে। শুধু ভালোবেসে বিয়েটা করেছি আমি।’

‘মি…থ্যে বলছিস ইহান। তুই কোনোদিনও আমাকে ভালোবাসিস নি। সবটাই শুধু সম্মান আর শ্রদ্ধার জন্য ছিল।’

এ-কথায় ইহান পেট থেকে মুখ তুলে আনহার দিকে তাকায়৷ ওর মুখের কাছে গিয়ে কপালে আলতো ভালোবাসার পরশ ছোঁয়ায়৷ আনহার বাম হাতটা নিজের ডান হাতের ভাজে নিয়ে আলতো চুমো খায়। বলে, ‘হয়তো তাই আনহা। সেই ছোট্ট বেলা থেকেই হয়তো সম্মান-শ্রদ্ধা দিয়েই আপনাকে ভালোবাসি৷ বিশ্বাস করুন এই বছরগুলোতে আপনাকে শুধু ভালোইবেসে গেছি। কিন্তু কোনোদিন তাতে আপনাকে চাই নি। আমি কোনোদিন আপনাকে পাওয়ার কথা চিন্তা করিনি। আমি জানি আমি ভালো নই। অনেকটা বদ-খারাপ একটা ছেলে। কিন্তু এর মাঝেও একটা কথা সত্যি আনহা। এই বদ ছেলেটা কোনোরূপ খারাপ ভাবনা ছাড়াই আপনাকে ভালোবেসেছে।’

আনহা নিশ্চুপ হয়ে কাঁদছে। ইহান ওর দু’চোখের পানি মুছিয়ে দিল। ইহানের নিজের চোখেও পানি।

‘আমি শুধু আপনাকে ভালোবাসতাম আনহা। তাতে কোনো রকম পাপ ছিল না। আমি আপনার প্রেমিক হতে চাইনি। ভালোবাসার মানুষ হতে চেয়েছি। নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে চেয়েছি। তাতে আমি সফলও আনহা৷ আমি পেরেছি সমস্ত চাওয়া-পাওয়ার উর্ধ্বে গিয়ে আপনাকে চাইতে। এবং তা পেরেছি আমি। তবে এবার আর আমার ভালোবাসা নিঃস্বার্থ হবে না আনহা। স্বার্থ থাকবে তাতে।’

ইহানের এই কথায় প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকায় আনহা।

ইহান আলতো হেসে বলে, ‘আমি হয়তো কোনোদিন আপনাকে খারাপ ভাবে পেতে চায়নি। কিন্তু পেতে যে চায়নি তেমনটা কিন্তু নয়। হ্যাঁ, চেয়েছি আমি। আজ পেয়েছিও। তাই তো আপনি আমার স্ত্রী আনহা৷ ভালোবাসায় আমার চাওয়াটা না থাকলেও প্রাপ্তি হয়েছে আমার। সেই প্রাপ্তিটুকু আমি ছেড়ে দেব না।’

‘ইহান…’

‘আপনি আমার স্ত্রী৷ আপনি কী মনে করবেন তাই ভেবে ভালোবাসার কথা বলতে দ্বিধা ছিল আমার। কিন্তু আজ আর সেটা নেই। আপনি আমার স্ত্রী। যেটা একসময় আমার জন্য নিষিদ্ধ ছিল, তাই আজ আমার অধিকার। তাই আজ আমি আমার আপনিকে নিজের তুমি রূপে চাই। তাতে আপনি সম্মতি দিলেও চাইব, আর না দিলেও।’

আনহা কিছু বলতে চাইল। তার আগেই ইহান বলল, ‘ ডিভোর্স দেওয়া, আমাকে ছেড়ে যাওয়া, এসব কিছু ভেবে থাকলে ভুলে যান। আপনি ইহানের পাগলামী দেখেছেন, ভালোবাসা দেখেননি। আপনাকে আমি শুধু আমার মৃত্যুতেই ছাড়ব। তাছাড়া…’

কথাটা শুনেই আনহা ওকে জড়িয়ে ধরে আরও জোরে কান্না করে দেয়। হাসি ফোটে ইহানের ঠোঁটে। নিজেও আনহাকে জড়িয়ে বলে, ‘তাহলে কী আপনি আমার আপনিময় তুমি হতে চান আনহা। ইহানের #আপনিময়_তুমি?

আনহা কিছু বলতে পারল না। আনহার কান্নাটাই ইহান নিজের উত্তর হিসেবে নিয়ে নিল। আপনিময়তায় তুমিকে সাজিয়ে ভালোবাসার এক অদ্ভুত নাম দিল রূপ দিল। যার নাম রাখল #আপনিময়_তুমি?

সমাপ্তি…

#মেহের…