পর্ব ৩৯+৪০
#আমার_আসক্তি_যে_তুমি
#Part_39
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
.
?
সকালে আরিশা আর রিংকির চেঁচামেচিতে ঘুমটা ভেঙে যায়। পিটি করে চোখ খুলি আর আবছা চোখে তাদের দিকে তাকাই। কোন কিছু স্পষ্ট দেখতে না পেড়ে চোখ দুটো কচলিয়ে, আরমোড় ভেঙে বিছানা থেকে উঠে এইবার ভালো মত ওদের দিকে তাকিয়ে। তাকিয়ে যা দেখি তাতে আমি হা হয়ে থাকি।
আরিশা আর রিংকির দুইহাতেই দুটি থাল, তার মধ্যে পাউডার রঙ (গুলাল)। আর ওদের মুখের মধ্যে দুষ্টু হাসি।
আমি এইবার তাদের দিকে বিষ্ময়কর চোখে তাকিয়ে থাকি তা দেখে আরিশা বলে,
.
— কি গো মনু এমনে চাহিয়া চাহিয়া কি দেখো? (আরিশা)
.
— তোরা রঙ নিয়ে দাড়িয়ে আছিস কেন?
.
— কেন মনু তুমি জানো না? (রিংকি)
.
— না।
.
— আজকে রঙ খেলার অনুষ্ঠান। আজকে ইচ্ছা মত রঙ দিয়ে খেলবো। দাঁত কেলিয়ে। (আরিশা)
.
— তোকে যদি আজ মেরে থুরি রং দিয়ে রাঙ্গিয়ে ভূত না করেছি তাহলে আমার নামও রিংকি না। (রিংকি)
.
— তবে রেএএএ।
এই বলে বিছানা ছেড়ে রিংকির দিকে তেড়ে যাই। রিংকি ভয়ে দে দৌড়। আমি আর রিংকি পুরো ঘর দৌড়াতে থাকি আর পিছে আরিশা চেঁচাতে থাকে।
.
.
?
.
সাদা শাড়ি গায়ে জরিয়ে মুখে হাল্কা মেকাপ করেছি। চুল গুলো সামনে এনে সাইড দিয়ে খোঁপা করেছি। হাতে সাদা রঙের রেশমি চুড়ি। আমাদের বাসার ছাদেই নাকি রঙ খেলা হবে। তাই আরিশা আর রিংকি আমার ছাদে নিয়ে যায়। ছাদে গিয়ে দেখি নিলা, হিমেল , রিনা, সিয়াম, মাইশা, জ্যাক, শুভ ভাইয়া,দোলন ভাবি, ড. সিয়াম, ইশান সকলেই এসেছে। সকলেই আজ সাদা রঙে রাঙ্গিত। দেখে মনে হচ্ছে যে স্বচ্ছ আকাশের মেঘগুচ্ছ গুলো এসে ভীড় করেছে এইখানে।
আমি সকলকে দেখে কিছুটা অবাকই হই। তাদেরকে আমি এইখানে আশা করি নি। আরিশা আর রিংকি আমায় সকলের মাঝে নিয়ে যায়। আমি সকলের সাথে কুশল বিনিময় করে চারদিকে চোখ বুলাতে থাকি। চোখ জোড়া বার বার রিয়ানকে খুঁজে চলেছে। এক ঝলক তাকে দেখবার জন্য।
তখনই নিলা আমার কাছে এসে বলে,
.
— ভাবি আপনার দুই নয়ন যাকে খুঁজিতে সে ওইখানে। ডান দিকে ইশারা করে।
.
আমি ওই দিকে তাকিয়ে দেখি রিয়ান ফোনে কথা বলতে বলতে আসছে। পড়নে তার সাদা পাঞ্জাবি আর সাদা চুড়িদার৷ বুকের বা পাশে সাদা সুতোর সরুকাজ করা। তারপর মধ্যে হাল্কা পাথর বসানো। চুল গুলো সামনে এসে কপালে বারি খাচ্ছে। মুখে সেই মন ভুলানো হাসি। আমি তার দিকে একনজর তাকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে বলি,
.
— আমি তো তাকে খুঁজছিলাম না। আমি তো আসলে..
.
— থাক থাক আর বলতে হবে না, আপনি না বললেও কিন্তু আমরা সবই বুঝি। কুছ কুছ হোতা হে! তাই না। বলে নিলা হেসে উঠে।
.
— যাহ! লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল আমার তাই সেখান থেকে সরে আসি আমি।
.
.
এক কিনারে দাড়িয়ে ছাদের ডেকোরেশনটা দেখছি। চারদিকে চারটি বাঁশ লাগিয়ে উপর দিয়ে বিভিন্ন রঙের নেট কাপড় গুলো মাঝ বরাবর নিয়ে এসে একত্রিত করে প্যান্ডেলের মত করা হয়েছে। তার মধ্যেই ঝুলছে ভিন্ন ভিন্ন রঙের জড়ি। দেখতে বেশ শোভনীয় লাগছে।
আমি এইসব দেখছি তখন রিয়ান আমার পাশে এসে দাড়ায় তারপর বলে,
.
— এত মনোযোগ দিয়ে কি ভাবছো?
.
আমি তার কথায় চমকে পাশে তাকাই তারপর তাকে দেখে কিছুটা স্বাভাবিক হই। তারপর ধীর কণ্ঠে বলি,
.
— ভাবছি কালকে আমার জীবন পুরোপুরি বদলে যাবে। কালকে আমি মিস থেকে মিসেস হয়ে যাবো। নিজের একাকিত্ব জীবন পেড়িয়ে সাংসারিক জীবনে পা রাখবো। নিজেকে অন্যের কাছে সারাজীবনের জন্য বিলীন করে দিব। আনমনে।
.
— প্রথমত্ব তুমি অনেক আগেই মিসেস খান হয়ে গিয়েছো। কালকে তুমি সকলের দৃষ্টিকোনের জন্য দ্বিতীয়বারের মত আবার মিসেস খান হবে। আর রইলো সাংসারিক জীবনের কথা, তা সকল মেয়েকেই এক না এক সময় করতে হয়। এই সময়টা সকলের মেয়ের জীবনেই আসে তাই এত ভেবে কাজ নেই।
আর একটা কথা বুঝে নিও, তোমাকে আমি কোন কিছুর জন্য বাঁধা দিব না কিন্তু যে জিনিসটা আমার অপছন্দ তা কখনো করিও না। যাকে যে অধিকার দেওয়ার দিও কিন্তু ভালবাসারটা দিও না। কেন না তোমাকে ভালবাসার অধিকারটা শুধুই আমার। আর সেটা আমারই থাকবে।
আর রইলো নিজেকে বিলীন করার, তোমাকে ভালবেসেছি এই শর্তে নয় যে কিছু পাবো বলে। আমার ভালবাসা নিরস্বার্থ। একদম স্বচ্ছ পানির মত। শুধু এতটুকুই চাই তোমার মনের এক কোনে শুধু আমি থাকতে।
.
রিয়ানের কথায় চোখটা ছলছল হয়ে আসে। আমি কোন মতে নিজেকে সামলিয়ে বলি,
.
— আমার পুরো মন, হৃদয়টা জুড়ে শুধুই আপনি আছেন। আমিটা জুড়েই শুধু আপনি আর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শুধু আপনি এই থাকবে।
.
রিয়ান মুচকি হেসে পাশ থেকে রঙের থাল থেকে লাল রঙ নিয়ে আমার গালে ছুঁয়ে দেয় তারপর বলে,
.
— নাও আজ তোমায় নিজের ভালবাসার রঙে রাঙ্গিত করে দিলাম।
.
আমিও রঙ নিয়ে তার গালে ছুঁয়ে দেই। আর মুচকি হেসে অন্যদিকে চলে যাই।
.
.
?
.
— ওই মি. ব্রিটিশ বান্দর। লুক এট মাই খুম্মা।
.
— ওয়েট হোয়াট ডিড ইউ স.. এই বলে পাশে ঘুরতে নিবে তার আগেই রিংকি থালে থাকা লাল রঙগুলো ইশানের মুখের উপরে ছুঁড়ে মারে।
তারপর হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে খেতে থাকে৷ কোন মতে নিজের হাসিটা থামিয়ে বলে,
.
— নাও ইউ আর লুকিং লাইক খাটি বাংলাদেশি লাল বান্দর। আহা! আজ একদম দেশি দেশি ফিলিং আসতেছে। বলে আবার হাসিতে মেতে উঠে।
.
— ইউউউউ মিস বকবক! হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান! রাগে ফুসতে ফুসতে।
.
— যা করেছি অনেক ভালো একটা কাজ করেছি। ব্রিটিশ বান্দরকে বাংলাদেশি বান্দরে রুপান্তরিত করেছি। আমাকে নোবেল না না ওস্কার দেওয়া উচিৎ। ভাব নিয়ে।
.
— ওস্কার মাই ফুট!
.
— বাই দ্যা রাস্তা আপনাকে না পুরো “লালে লাল শাহাজালাল” লাগছে।
.
— আমাকে নিয়ে মজা করা তাই না? দাড়াও দেখাচ্ছি মজা!
.
এই বলে রিংকি দেয় দৌড় আর ইশানও হাতে রঙ নিয়ে তার পিছে ছুটে।
.
.
?
.
— এইটা কি করলেন? এইভাবে কেউ রঙে কাউকে মাখায়?
.
— আমি মাখাই। বুঝাতে হবে না যে তোমায় আমি ঠিক কতটা ভালবাসি?
.
— অহহ তাই না? তা ডক্টর থেকে কবে এই ভালবাসা দেখানোর কাজে জয়েন করেছেন শুনি?
.
— যবে থেকে তোমায় ভালবাসতে শুরু করেছি। আরেহ আগে থেকে বুঝাতে হবে না যে বিয়ের পর আমি ঠিক কতটা ভালবাসবো৷ অবশ্য বিয়ের পর কিন্তু একটু বেশি এই ভালবাসবো। দুষ্টু হাসি দিয়ে।
.
— আপনি আসলেই একজন অসভ্য লোক।
.
— শুধু তোমার জন্য! চোখ টিপ দিয়ে।
.
— দাড়ান দেখাচ্ছি মজা।
.
এই বলে আরিশা দুই মুঠো রঙ নিয়ে সিয়ামের মুখে মাখিয়ে দেয় তারপর তাকে ভেঙ্গিয়ে দৌড়ে পালায়।
.
.
?
.
সকলেই রঙ খেলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। রঙের আসর যেন ছড়িয়ে পড়েছে সাথে রঙের গোধূলি। সকলের মুখেই স্নিগ্ধ হাসি। রঙ নিয়ে একেক জন ছুটে চলেছে একেকজনের পিছে। আমার সাদাটা এখন বিভিন্ন রঙে পরিপূর্ণ। আপাদমস্তক আমি রঙের আবরণে ঘেরা। বাহ্যিক এমন কোন অংশ নেই যে এই রঙ তুলির ছোঁয়া পাই নি।
সকলের সাথে রঙের খেলাতে মেতেই উঠেছিলাম তখনই কেউ এসে আমার মুখে রঙ ছিটিয়ে চলে যায়। হুট করে এমন হওয়াতে আমি অপ্রস্তুত হয়ে যাই যার ফলে রঙের কিছুটা অংশ আমার চোখে চলে যায়। রঙ যাওয়ার সাথে সাথে চোখ প্রচন্ড রকম জ্বালা শুরু করে। আমি দ্রুত পানির সন্ধান করতে থাকি। সকলে রঙ খেলায় ব্যস্ত হওয়ার কারনে কাউরো নজর আমার উপর ঠিক ততোটা পড়ছে না। আমি অনেক কষ্টে ছাদ থেকে বেড়িয়ে এসে সিড়ির দিকে পা বাড়াই। তখন হাল্কা পিটিপিটি চোখে সিড়ির শেষ প্রান্তে রিয়ানকে দেখতে পাই। যে ফোনে কথা বলছে। আমি এইবার রিয়ানকে ডাক দেই।
.
— রিয়ান!!
.
আমার ডাকটা তার কানে পৌঁছাতেই সে ঘুরে দাড়ায়। আমাকে দেখে সে ফোনে “পরে কথা বলবে জানিয়ে কেটে দেয়। আমি ধীর পায়ে রেলিং ধরে তারদিকে আসতে থাকি। ঠিক তখনই আমার পাটা স্লিপ কেটে যায় আর রেলিং থেকে হাতটা ছুটে যায় আর আমি পড়ে যেতে নেই। ঠিক তখনই রিয়ান এসে আমায় সামলে নেয়। যেহেতু রিয়ান আমায় দেখছিল তাই আমায় স্লিপ খেতে দেখে দ্রুত পায়ে আমার কাছে চলে আসে আর আমায় সামলে নেয়।
আমি তখনও চোখের জ্বালায় ছটফট করছি। তাই রিয়ান দ্রুত আমায় নিচে নিয়ে যায় মুখ ধুঁয়ার জন্য।
.
রিয়ানের আর এইটি নজরে পড়া হলো না যে সিড়ির ও রেলিং এর গায়ে তেল ছড়িয়ে আছে। যার জন্যই রিয়ানা আজ পরে যেতে নিয়েছিল। হয়তো যদি আজ রিয়ান না থাকতো তাহলে হয়তো বা আজ রিয়ানা মৃত্যুর মুখে থাকতো।
#Part_40
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
.
?
রাত ১২ টা বেজে ১৩ মিনিট,
মধ্যরাতের প্রথম ভাগ চলছে। ঢাকা নামক যান্ত্রিক শহরটি এখন একদম নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। আকাশটাও আজ মেঘাচ্ছন্ন। চারদিকটা সাদা ও কালো মেঘে ঢাকা। বাইরে শো শো করে বায়ু বয়ে যাচ্ছে। এই বায়ুর সাথে দুল খেয়ে গাছের পাতাগুলো মচমচ করে উঠছে।
আমি বিছানার একপাশে হেলান দিয়ে বসে আছি। পাশের আরিশা আর রিংকি। রিংকির মুখটা কেমন শুকিয়ে আছে। আরিশাও কিছুটা থম মেরে বসে আছে। আমি চুপচাপ তাদের দেখে চলছি। আমার যে কিছু বলার নেই। রিংকি তখন হুট করে বলে উঠে,
.
— আবিরের সাথে এমনটা না হলে কি হতো না? ওর সাথেই এত খারাপটা কেন হলো? (রিংকি)
.
— কোন কিছু বলে হয় না! জীবনে যা হয় তা সবই অনাকাঙ্ক্ষিত। তাই আমাদের সাথে যা হয় তা ভাগ্য বলা ছাড়া উপায় নেই। (আরিশা)
.
— ভাগ্য এত নির্মম কেন? একটা এক্সিডেন্ট ওর পুরো কেরিয়ারটা নষ্ট করে দিল। ওর আওয়াজ নিয়ে নিল। ওর জীবনটাই নষ্ট করে দিল? (রিংকি)
.
.
[ কিছুক্ষণ আগেই আবিরের পেজে ওর রিসেন্ট কান্ডিশন এর কথা শেয়ার করা হয়েছে। রিয়ানাকে যে নিউজটা দেওয়া হয়েছিল ঠিক তাই সকলের কাছেও বলা হয়েছে। পোস্ট করার কিছু মিনিটের মধ্যে এই নিউজটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
এতদিন ওর কোন খোঁজ না পাওয়ায় সকল ফ্যানস্ রা প্রায় ওর খোঁজ জানার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এখন এই নিউজটা জানার পর সকলেই কান্নায় ভেঙে পড়েছে। রিংকিও এইটা শুনার সাথে সাথে শোকড হয়ে যায় আর মন খারাপ করে বসে থাকে। ]
.
.
— দেখ এইখানে কাউরো কোন হাত নেই। চাইলে কিন্তু ওর মৃত্যুও হতে পারতো কিন্তু তা হয় নি। ওর ভাগ্যে যা ছিল তাই হয়েছে। এখন আমরা আপোশ করলেও ও আগের অবস্থায় ফিরে আসতে পারবে না।
তাই এখন আমাদের উচিৎ ওকে মোটিভেশান দেওয়ার আর ওর সুস্থতার কামনা করা। (আরিশা)
.
— হুম!মন খারাপ করে। (রিংকি)
.
— আবির এখন ঠিক কেমন আছে? জানিস কিছু!
.
— পুরাপুরি জানি না রে রিয়ানু। কিন্তু যতটুকু জানি তার মতে ও এখন কিছুটা সুস্থ। কিন্তু এখনো বেড রেস্টে আছে। (রিংকি)
.
— অহহ আচ্ছা।
.
— আচ্ছা এইসব বাদ দে। কালকে রিয়ানুর বিয়ে আর আজকে যদি আমরা এইভাবে মন খারাপ করে বসে থাকি তাহলে কিভাবে হয়? আজকে রিয়ানাকে হাসি খুশি থাকার কথা কিন্তু আমাদের জন্য ওর মনটাও খারাপ। এইটা কি ঠিক! (আরিশা)
.
— অহহ হো! কাল তো রিয়ানার বিয়ে! আমি তাহলে নিউজটা তোদের বলে পুরো মজাটাই নষ্ট করে দিলাম তাই না। সরি! (রিংকি)
.
— চুপ! কিসের মজা নষ্ট করেছিস তুই? কোন কিছুই না। আর এমনেও সুখ দুঃখ মিলিয়েই জীবন। এই খুশি তো, এই কষ্ট। কিন্তু সব কিছুর মধ্যেও তোরা আমার পাশে আছিস এর চেয়ে বেশি আর কি চাই?
.
— তুই ও না। (আরিশা + রিংকি)
.
এই বলে দুইজনেই আমায় জড়িয়ে ধরে। আমিও ওদের জড়িয়ে ধরি। তখনই আরিশা বলে উঠে,
.
— কাল থেকে তুই আর আমাদের সাথে এইভাবে থাকবি না রে। (আরিশা)
.
— কালকে তুই মিসেস রিয়ানা সাদাত খান হয়ে যাবি। আমাদের ছেড়ে চলে যাবি তাই না? আমরা তোর পর হয়ে যাব তাই না? কাদো কাদো হয়ে। (রিংকি)
.
— তোকে আর আগের মত জ্বালাতে পারবো না। আগের মত আর মজা করতে পারবো না। (আরিশা)
.
— কিছু বদলাবে নারে। আমরা আগে যেমন ছিলাম ঠিক তেমনই থাকবো। আমার নামের সাথে অন্যের নাম লেগে গেলে যে আমি পর হয়ে যাব তা তোদের কে বললো? কোন কিছুই বদলাবে বুঝলি? তোদের যখন আমার সাথে থাকতে ইচ্ছা করে তখনই একটা ফোন করে জানিয়ে দিবি এসে পড়বো।
আর বাকি আগে আমরা যেমন হাসি-মজা করতাম ঠিক ওমনই করবো বুঝলি। তোরা আমার জীবনের অধিকাংশটা ঝুড়েই আছিস। তোদের থেকে দূরে কিভাবে যাই বল?
.
বলা শেষ হতেই দেখি আরিশা আর রিংকি কেঁদে দেয় তারপর একসাথে বলে উঠে,
.
— We love you a lot yarr.
.
ওদের কান্নায় আমার চোখেও পানি এসে পড়ে। আমি এইবার কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলি,
.
— I also love both of you a lot.
.
.
?
.
আজ রিয়ান আর আমার বিয়ে। সকাল থেকেই বাসায় হৈ-হুল্লোড় লেগে আছে। আরিশা আর রিংকি তো এইটা সেটা করেই চলেছে। একটু পর পর আন্টিরা এসে কিছু না কিছু খায়িয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। রিংকি আর আরিশাও একটু পর পর বিভিন্ন ধরনের ফেস প্যাক নিয়ে হাজির হচ্ছে। না চাওয়া সত্তেও বাধ্য তা নিজের চেহারায় লাগাতে হচ্ছে। সব কিছু শেষে মেকাপ আর্টিস্টরা এসে হাজির হয়। এসেই লেগে পড়ে তাদের কাজে।
.
.
বিকেল ৫ টা বেজে ৬ মিনিট,
আয়ানার সামনে বধু সেজে বসে আছি। পড়নে ভারি এক গাড় লাল লেহেঙ্গা। তার মধ্যে সোলানি রঙের জড়ি সুতা দিয়ে কারুকাজ করা। এর উপর আবার হাল্কা পাথরের কাজ। মুখে বধু সাজ। গলায় ছোট, মাঝারি ও বড় তিনটি সাইজের সোনার সেট পড়া। মেহেদি রাঙা দুইহাতে রেশমি চুড়ি আর সামনের দিকে দুইটি সোনার বালা। মাথায় একটা টিকলি আর সাইডে একটা ঝাপটা পড়া। নাকে একটি নথ দুল খাচ্ছে। চুল গুলো সাইডে খোঁপা করে তার মধ্যে তিনটি রক্তগোলাপ গাথা।যার মিষ্টি গন্ধটা বার বার আমার নাকে এসে বারি খাচ্ছে। মাথায় লাল চুড়নি দিয়ে ঘুমটা দিয়ে দেওয়া।
.
.
নিজের দিকে তাকাতেই মুখের মধ্যে এক লাল আভা ফুটে উঠছে। হয়তো বা লজ্জার কারণে। নিজের মনের মধ্যেই কেমন যেন এক শিহরণ তৈরি হচ্ছে। বুকের ভিতরটার মধ্যে যেন কেউ ধাম ধাম করে ঢোল পিটাচ্ছে। কেমন এক অজানা অনুভূতি জাগ্রত হচ্ছে। সাথে কেমন এক অজানা ভয়। বিয়ের দিন সকল মেয়েদেরই কি এমন হয়? নাকি এমনটা শুধু আমার বেলায় হচ্ছে?
আরিশা তখন রুমে এসে বলে,
.
— রিয়ানু তোর হলো নাকি আরও দেরি হবে রে?
.
আমি ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলি,
.
— হ্যাঁ আমি রেডি।
.
আরিশা আমার কাছে এসে আমার থুতনিটা ধরে বলে,
— মাশাল্লাহ রিয়ানু। তোকে আজ দেখতে একদম ডানা কাটা পরী লাগছে রে। তোর থেকে আজ চোখ সরানোটাই দায়ভার হয়ে উঠেছে।
.
আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলি। আরিশা তা দেখে বলে,
— ইশশ আমার লজ্জাবতীরে।
.
রিংকি তখন রুমে এসে আমাকে দেখে এক চিৎকার দিয়ে বলে,
.
— ওরেএএ রিয়ানুরেএএএএএএএ!! তোরে আজ পুরা সেই লাগতাসে। আমি তো আবার তোর উপর ক্রাশ খেলাম রে।
.
আমি কিছু না বলে শুধু মুচকি হাসি। তা দেখে রিংকি বলে উঠে,
.
— আজ তোকে দেখে না একটা কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে। বলি?
.
— বল।
.
— চলো না বিয়ে করি। দাঁত কেলিয়ে।
.
আমি ওর পিঠে এক চাপড় মেরে বলি,
— কুছভি!
.
— অনেক হয়েছে এখন চল। দেরি হচ্ছে।
.
— হু।
.
.
?
.
স্টেজের মধ্যে বসে আছি। চারপাশটা খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। চারদিকটা লাল গোলাপে ঘেরা। কিনারে কিনারে ফুলের স্টেন্ড বসানো। মাথার উপরই ঝুলছে ঝুমুর। বেশ মোহনীয় লাগছে সব কিছু।
মেহমানের আনা গোনা শুরু হয়ে গিয়েছে। দেখতেই দেখতে চারদিকটা মেহনানে পুরিপূর্ণ হয়ে গেল। একেক জন এসে আমার সাথে ছবি তুলছে তো একেক জন এসে আমায় দেখে যাচ্ছে আর দোয়া করে যাচ্ছে।
তখন আবার ফোটোগ্রাফার এসে আমায় সাইডে নিয়ে আমার ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
বেশ কিছুক্ষণ পরই বেশ চেঁচামেচির আওয়াজ পাওয়া যায়। তখন পাশে তাকাতেই একটা মেয়ে চেঁচিয়ে উঠে, “বর এসেছে, বর এসেছে। ” কথাটা কান পর্যন্ত পৌঁছাতেই বুকটা ধক করে উঠে।
চোখ জোড়া দরজার দিকে স্থির হয়ে যায়। আরিশা আর রিংকি দরজার কাছে গিয়ে দরজা ধরে। সাথে সাথে আমাদের মেডিক্যাল বেচের বাকি মেয়েরাও। সকলের একই দাবি, ” টাকা না দিলে ঢুকতে দেওয়া হবে না। ”
এই নিয়ে দুই পক্ষে মধ্যে বেশ কথা কাটাকাটি হতে থাকে। বিশেষ করে রিংকি আর ইশানের। দুইজন একদম বাচ্চাদের মত ঝগড়া করতে থাকে। তা দেখে রিয়ান অতিষ্ঠ হয়ে দ্রুত টাকাটা বের করে ওদের হাতে ধরিয়ে দেয়। তা দেখে সকলে খুশি হয়ে তারাতারি গেট ছেড়ে দেয় এবং রিয়ান ফিটা কেটে ভিতরে প্রবেশ করে।
রিয়ান আমার দিকে তাকিয়ে ধীর পায়ে স্টেজের দিকে অগ্রসর হতে থাকে আর আমিও মুগ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকি।
রিয়ানের পড়নে সোনালী রঙের শেরওয়ানি। মাথায় গাড় লাল রঙের পাগড়ি। সাইডে গাড় লাল রঙের শেরওয়ানি ওরনা। উজ্জ্বল শ্যামল মুখটা একদম ঝলঝল করছে। চোখে মুখে এক আলাদাই উজ্জ্বলতা। বেশ লাগছে তাকে।
রিয়ান আমার পাশে এসে দাড়ায়। তারপর ধীর কণ্ঠে বলে,
.
— বি রেডি মিসেস খান। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনি দ্বিতীয় বারের মত মিসেস খান হতে চলেছেন সাথেই সমাজের দৃষ্টিকোন হতে পুরোপুরি ভাবে আমার হতে চলেছেন।
.
আমি রিয়ানের এমন কথায় আমি তার দিক থেকে চোখ নামিয়ে ফেলি। আর লজ্জায় লাল হয়ে যাই। কেন যেন বেশ লজ্জা করছে তার এমন কথায়। তখন আবার ফোটোগ্রাফারা এসে আমাদের সাইডে নিয়ে যায় আর আমাদের বিভিন্ন ভাবে কাপল পিক তুলতে থাকে।
.
.
?
.
কাজীর সামনে বসে আছি। কাজী সাহেব কাবিন নামা পড়েই চলেছে। আমার আর রিয়ানের মধ্যে একটা লাল পর্দা ধরা হয়েছে। কাবিন নামা পড়া শেষে কাজী সাহেব মোনাজাত ধরে। মোনাজাত শেষ করে তিনি রিয়ানের কাছে গিয়ে বলে,
.
— মরহুম হাবিব রহমান ও মরহুম আয়েশা বেগমের একমাত্র মেয়ে “রিয়ানা রহমান” এর সাথে জনাব মরহুম ওসমান খান ও মরহুম সালমা বেগমের একমাত্র ছেলে “সাদাত খান রিয়ান” এর সাথে এত টাকা দেনমহরে আপনাদের বিবাহ ধার্য করিয়া হইলো। বাবা তুমি কি এই বিয়েতে রাজি? রাজি থাকিলে কবুল বলো।
.
রিয়ান এইবার ধীরে সুস্থেই বলে,
.
— কবুল
.
— আরেকবার বলো।
.
–কবুল
.
— আরেকবার বলো।
.
— কবুল।
.
— আলহামদুলিল্লাহ।
.
কাজী সাহেব এইবার আমার কাছে এসে বলে,
.
— মরহুম ওসমান খান ও মরহুম সালমা বেগমের একমাত্র ছেলে “সাদাত খান রিয়ান” এর সাথে আপনার বিবাহ ঠিক করা হইলো। মা তুমি কি এই বিয়েতে রাজি? রাজি থাকিলে কবুল বলো।
.
আমি মাথা নিচু করে ধীর কণ্ঠে বলি,
.
— কবুল
.
— আরেকবার বলো।
.
–কবুল
.
— আরেকবার বলো মা।
.
— কবুল।
.
— আলহামদুলিল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহ। বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। সবাই মিষ্টি মুখ করান।
সকলের মধ্যেই এইবার খুশির বন্যা বয়ে যায়। আরিশা আর রিংকি এসে আমার আর রিয়ানের মুখ মিষ্টি করে আর বাকিদেরও করিয়ে দেয়।
.
.
?
.
ফোটোসুটের জন্য স্টেজের মধ্যে দাড়িয়ে আছি। আমার থেকে বেশ খানিকটা দূরত্বেই রিয়ান দাড়িয়ে অন্যদের সাথে কথা বলছেন আর ফাঁকে ফাঁকে আমাকে দেখে চলেছেন।
আমি হাসি মুখে ছবি তুলে যাচ্ছি। হুট করেই আশে পাশের লোকজন বলতে শুরু করে,
.
— “আরেহ আরেহ ঝুমুরটা তো নরছে! এখনই তো পড়ে যাবে! কেউ বধুকে সরাও।”
.
কথা গুলো আমার কানে ঠিক স্পষ্টভাবে পৌঁছায় নি যার জন্য আমি ঘটনাটা বুঝে উঠতে পারি নি।
কিন্তু রিয়ানের কানের ঠিকই কথা গুলো স্পষ্টভাবে পৌঁছায় আর সে চট জলদি আমার উপরে তাকায়। তাকিয়ে দেখে ঝুমুর নিচে দিকে নেমে আসছে। রিয়ান তা দেখে চেঁচিয়ে উঠে,
.
— রিয়ানায়ায়া!!
.
কানে কিছু শব্দ এসে বারি খেতেই উপরের দিকে তাকাই। হুট করেই চারদিকে এক চাঁপা আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ে,
.
— “আয়ায়ায়ায়া”
.
.
#চলবে