আরশি পর্ব-২০

0
1980

#আরশি
#Part_20
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

ঘড়িতে নয়টা ছুঁই ছুঁই। ড্রয়িংরুম জুড়ে ভাসছে কোরআন তিলাওয়াতের মধুর ধ্বনি৷ ড্রয়িংরুমের বা পাশের সোফায় বসে আমি আর অহনা সেই মধুর ধ্বনি মন দিয়ে শুনছি। আমি জানি যতক্ষণ না পুরো কোরআন শরিফ খতম হচ্ছে ততক্ষণ এই ধ্বনি প্রতিফলিত হতেই থাকবে। আমি স্থির হয়ে বসে আছি। মনের মধ্যে বিষন্নতা ঝেঁকে বসেছে। মনে পড়ছে মিহি আন্টির কথা। তার স্নিগ্ধ মুখখানি। চোখে ভাসতে শুরু করে পুরনো দিনের স্মৃতি।

_______________________

২০০৭ সাল। তখন আমি ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে পড়ি আর মামার পড়ালেখা প্রায় শেষের পথে। পড়ার সুবাদে মামা আমাদের সাথেই থাকতেন। আমার থেকে মামা ছিলেন বারো বছরের বড় আর ভাইয়ার থেকে সাত বছরের। মাঝে নাকি মামা এক কঠিন অসুখে পড়েছিলেন যা সারতে দুই-তিন বছর লেগে যায় আর মামা পড়ার দিক দিয়ে পিছে পড়ে। স্বভাবে মামা শুরু থেকেই বিচক্ষণ প্রকৃতির মানুষ ছিল। সাথে বেশ বুদ্ধিমানও ছিলেন। তাকে কখনো কোন কিছু ভেঙ্গে বলতে হতো না সে আপনা আপনি বুঝে যেত। ছোট থেকেই মামার সাথে আমি অনেক ফ্রি ছিলাম। আমার সবকিছুই তার জানা ছিল। মামার বিষয়েও আমি টুকুটাকি জানতাম। একদিন কথায় কথায় জানতে পারি মামা একজনকে ভালবাসে। এমনকি সেও নাকি মামাকে ভালবাসে। নাম জানতে চাইলে জানতে পারি তার নাম ছিল মিহি। মিহি আন্টি মামার ভার্সিটিতেই অনার্স প্রথম বর্ষে পড়তো। আর থাকতোও আমাদের এলাকায়। সেই সুবাদে তাদের দেখা সাক্ষাৎ প্রায় হতো। মামার কাছে মিহি আন্টির বর্ণনা শুনতে চাইলে সে বলেছিল, “সে হলো বৃষ্টিবিলাসী। তার রুপ খেলে বর্ষণের ধারায়। হরিণী নয়নের মায়ায় তখন লেপ্টে পড়ে গভীর ছাঁয়া। পা নাচিয়ে মৃদু মৃদু ঝঙ্কার তুলে স্বচ্ছ বর্ষণের ধারায়। সেই সাথেও মাতাল হাওয়ায় ভাসিয়ে বেড়ায় তার রেশমি চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ। পায়ের পৃষ্ঠা রক্তিম আভায় রাঙ্গিয়ে ছাপ ছেড়ে যায় বর্ণহীন পানির ধারায়। আর সেই ছাপের পথচারী বানায় আমায়।” মামার কথা শুনে বুঝতে পেরেছিলাম সে ছিল অত্যন্ত রূপবতী। সাথে এইটাও বুঝতে পারি যে তাদের প্রথম দেখা এই বৃষ্টির ধারায়ই হয়েছিল। সব শুনে আমারও ইচ্ছা হয় সেই রূপবতীকে এক ঝলক দেখার। এবং একসময় আমাদের দেখাও হয়েছিল। তাকে দেখার পর মনে হয়েছিল লজ্জাবতী গাছটা মনে তাকে দেখেই এতটা লজ্জা পায়। মিহি আন্টি যেদিন আমায় প্রথম দেখে সেইদিন আমায় আপন করে নেয়৷ বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেন আমার সাথে। এতটাই ভালো সম্পর্ক ছিল যে আমি পরবর্তীতে তার বাসায়ও যাওয়া আসা শুরু করেছিলাম।
এরপর থেকেই আমি তাদের দুইজনের ভালোবাসার জীবন্ত সাক্ষী ছিলাম। তাদের ভালোবাসার রচনাই ছিল সাধারণের মধ্যে অসাধারণ। অসাধারণ বলার কারণ তারা কখনো ভার্সিটির আঙ্গিনায় বসে আড্ডা দেয় নি, ফোনে কথা বলেনি, রাস্তার পাশে হাতে ধরে হাটে নি,টঙ্গের ঘরে বেঞ্চিতে বসে একসাথে চা খায়নি,সরাসরি দাঁড়িয়ে ভালো মত দুইটা কথা বলেনি, বাকি যুগলদের মত একান্ত বলতে কোন সময়ই তারা কাটায় নি। এখন প্রশ্ন হলো তাহলে তারা ভালোবাসায় পড়লো কিভাবে? তাদের কথা হতো কিভাবে? উত্তরটা হলো তাদের যোগাযোগের মোক্ষম মাধ্যম ছিল চিঠি। তাদের ভালবাসার সূচনাও এই চিঠি আর ইতিও এই চিঠি। তাদের যতকথা, রাগ, অভিমান, আবদার, প্রতিশ্রুতি, ভালবাসা সবকিছুর বহিঃপ্রকাশ ছিল এই চিঠি। এমনকি স্বপ্ন বোনার অঙ্গিকারও ছিল এই৷ ইচ্ছা গুলোকে কাগজের ভাঁজে তারা যত্ন সহকারে তুলে রাখতো,এক হালাল সম্পর্কের বাঁধনে আবদ্ধ হয়ে পূরণ করবে বলে। কিন্তু কে জানতো এই ইচ্ছেগুলোই তাদের কাল হয়ে দাঁড়াবে। তাদের বিচ্ছেদের কারণ হবে।

আমি তখন ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। মামা তখন পড়ালেখা শেষ করে বেকার। ঠিক এমনটাই সময় মিহি আন্টিকে লিখা মামার সকল সকল চিঠি ধরা পড়ে যায় তার বাবার নিকট। সবকিছু তার নিকট হয়ে যায় পরিষ্কার। মিহি আন্টিকে তিনি চিঠির মালিকের কথা জিজ্ঞেস করলে সে নির্ভয়ে সব বলে দেন। অতঃপর তার বাবা যখন খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন পাত্র বেকার তখনই তিনি নাকোচ করে দেন। তার বাবা ছিলেন অতি কঠোর আর এক বাক্যের মানুষ। তিনি যা একবার বলে দিয়েছেন সেটাই হতো শেষ কথা। আর তার শেষ কথা ছিল সে কোন মতেই একজন বেকার পাত্রের নিকট তার কন্যাকে তুলে দিবেন না। কিন্তু মিহি আন্টিও তখন জীদ করে বসে সে মামাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না। কথা জানার পর তার বাবার তার উপর হাত উঠায়। এমনকি তার মাও। শিকার হতে হয় নির্মম অত্যাচারের। কিন্তু তাও মিহি আন্টি ছিলেন তার কথা অটল। যার ফলে হতে হয় গৃহবন্দী। প্রায় ৩ দিন থাকতে হয় ক্ষুদার্ত ও তৃষ্ণার্ত। এতে মিহি আন্টির সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয়েছিল তা কিন্তু নয়। সে তো নিজের কথায় দৃঢ়। তা দেখে তার বাবা তার জন্য উপযুক্ত পাত্র খোঁজা শুরু করে। এইদিকে মামা সব জানতে পেরে মিহি আন্টির বাবার চরণে গিয়ে পড়েছিল, কেঁদে ভিক্ষা চেয়েছিল মিহি আন্টিকে। কিন্তু তার বাবা দেয় নি। উল্টো ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিল মামাকে তার বাড়ি থেকে। আর আমারও সেই বাড়ি যাওয়া আসা বন্ধ হয়ে যায়।
সেইদিন থেকেই মামা আর মিহি আন্টির মধ্যে সকল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। দেখতেই দেখতে কেটে যায় একসপ্তাহ। মিহি আন্টির বাবা খুঁজে আনেন মিহি আন্টির জন্য যোগ্য পাত্র। বিয়ের দিন পাকা হয়। পারা মহল্লায় ছড়িয়ে পড়ে বিয়ের আমেজ। কিন্তু মিহি আন্টি তখনও তার সিদ্ধান্তে অটল। সে মামা ব্যতীত আর কাউকে বিয়ে করবে না। এই নিয়ে চলে আরেক দফা অত্যাচার। একই এলাকায় থাকার সুবাদে মামা বিয়ের কথা জানতে পারলো কিন্তু আন্টির কোন খোঁজই নিতে পারলো না। কেন না তাদের খোঁজ-খবর নেওয়ার সকল রাস্তাই যে বন্ধ ছিল। দিন গুনা ছাড়া আর কোন পথই ছিল না তাদের। এরপর একদিন খোঁজ আসলো। মিহি আন্টি আত্মহত্যা করেছেন। তার নিথর দেহ পড়ে আছে সেই পিছনের গল্লির দশ নাম্বার বাড়ির চারতলায়। বিয়ের আমেজে থাকা বাড়িটি এখন শোকের সাগরে আঁচড়ে পড়ছে। সব জেনে সেইদিন মামা একদম নিশ্চুপ ছিল। একটা টু শব্দও করেনি সে। স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সে। বেশ কিছুক্ষণ পর ছুটে যায় মিহি আন্টির বাসার সামনে। কিন্তু তাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সে উন্মাদ প্রায় হয়ে যায় মিহি আন্টির শেষ দেখা দেখার জন্য। কিন্তু তারা তাকে মিহি আন্টির শেষ দেখাটাও দেখতে দেন নি। মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেন। মামা অনেক চেঁচিয়েছিল,দরজায় কড়া নেড়েছিল কিন্তু কাজ হয়নি। একসময় সে ক্লান্ত সেখানে বসে পড়ে। চোখ দিয়ে গড়িতে পড়তে থাকে অজস্র জল। চিৎকার করে ডেকে উঠেন,”মিহি! মিহি!” বলে। কিন্তু না কোন সাড়া আসে নি। একসময় মামা হাল ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। বেড়িয়ে আসেন সেখান থেকে। কিন্তু এরপর কোথায় যান তা আর জানা হয়নি। অতঃপর তিনি বাসায় ফিরেন রাত ১২ টায়। এসে চুপচাপ রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন। সেইদিন অনেক ডাকাডাকি করেও তাকে রুম থেকে বের করা যায় নি। একসময় আমরাও হাল ছেড়ে দেই। সেইদিন নিশাচর রাতেই ভেসে আসে একজন পুরুষালী কন্ঠের আর্তনাদ। বুক ফাটা আর্তনাদ। ভেসে আসে ভাঙ্গচুরের শব্দ, সাথে কয়েকটা অস্পষ্ট বাক্য, “বিশ্বাসঘাতকতা করেছ তুমি। কথা দিতে কথা রাখো নি। ছেড়ে যাবে না বলে চলে গিয়েছ তুমি। প্রতারক তুমি!” আবার একসময় সব নিরব হয়ে যায়। বন্ধ দরজার ওপারে তখন কি চলে তা কাউরো জানা নেই। অতঃপর সেই বন্ধ দরজা খুলে ঠিক দুইদিন পর। তাও হয়তো খুলা হতো না যদি না মিহি আন্টির শেষ চিঠি আসতো মামার নিকট। মারা যাওয়ার আগে তিনি চিঠিটা কাকে দিয়ে যেন গোপনে পোস্ট করেছিলেন আর সেই চিঠিই সেইদিন এসেছিল। মিহি আন্টির চিঠি এসেছে শুনার পর সাথে সাথেই মামা বেরিয়ে আসে। এগিয়ে আসে আমার কাছে চিঠির আশায়। তখনই আমি দেখেছিলাম মামার বিভৎস মুখখানাটি। চোখ দুইটি লাল,চুল এলোমেলো,পড়নে সেই পুরোনো শার্ট। বাজে এক গন্ধ ভেসে আসছিল তার নিকট থেকে। কিন্তু মামা সেইসবে তোয়াক্কা না করে আমার কাছ থেকে চিঠিটা নিয়ে পড়তে শুরু করে।

“প্রিয় নীরব,

যখন চিঠিটা তুমি পাবে ততক্ষণে আমি হয়তো এই দুনিয়ার মায়া ছেড়ে বহু দূর চলে যাব। যেখানে আমার নাগাল কেউ পাবে না। এমনকি তুমিও না। তা যাওয়ার আগে আমি আমার মনের অবস্থা তোমায় জানাতে চাই। আমি একদম ভেঙ্গে পড়েছি। পারছি না এইসব সহ্য কর‍তে। একদিকে বাবা-মা আরেকদিকে তুমি। আমি উভয়কেই অনেক ভালোবাসি তাই তোমাদের মধ্যে কোন একজনকে মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। একদম নয়। আমি না পারবো বাবা-মার মুখে কালি মেখে তোমার হাত ধরে চলে আসতে আর না পারবো তাদের কথা শুনে তোমার সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করতে। পারবো না অন্যকে স্বামী মানতে। তার নিকট নিজেকে সঁপে দিতে। তাই স্বেচ্ছায় আমি এই পথ বেছে নিচ্ছি। জানি না এই পথ ঠিক কি না তাও আমার কাছে আপাতত এর ব্যতীত কোন রাস্তা নেই৷ জানি তুমি রাগ করবে কিন্তু আমি যে নিতে পারছি না এই মানসিক অশান্তি। আমি জানি না আমার মৃত্যুর পর তুমি কি করবে। আমার প্রতি তোমার অনুভূতি কি রকম হবে। শুধু এতটুকু জানি আমি আজকের পর থেকে তোমার কাছে প্রতারক হয়ে যাব। কিন্তু তাও একটা শেষ প্রতিশ্রুতি চাই আমি তোমার থেকে। জানি না এইটা অন্যায় কি না তাও চাইছি, তোমার বা পাজারের হাড়টাতে আমাকেই থাকতে দিও। আমার জায়গায়টা আর কাউকে দিও না। কাউকে না। দিবে কি আমায় প্রতিশ্রুতিটা?
আর লিখতে পারছি না। সবকিছু আজ এলোমেলো লাগছে। লিখতেও পারছি না খুব কষ্ট হচ্ছে। তাই এইখানেই ইতি টানছি। আর শেষ বারের মত বলতে চাই,” ভালবাসি।” ভালো থেক।

ইতি
তোমার বৃষ্টিবিলাসী ”

চিঠিটা পড়ে মামা মেঝেতে হাটু গেড়ে বসে পড়ে। আর্তনাদ করে কেঁদে উঠে। কন্ঠে ভেসে আসে চিৎকার। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে তপ্ত নোনা পানির ধারা। রক্তিম চোখ দুইটি হয়ে উঠে আরও রক্তিম। ঠোঁট দুইটি ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠে। তার এমন আর্তনাদে কেঁপে উঠে চারপাশ। কেঁপে উঠে দেয়ালের প্রত্যেকটা ইট কনা। বাঁধ ভাঙ্গে আমার, মায়ের,ভাইয়ার চোখের জল। বেশ কিছুক্ষণ পর মামা উঠে দাঁড়ায়। রুমে চলে যায়। রুমের মধ্যে থাকা মিহি আন্টির সকল চিঠি নিয়ে আসেন। মেঝেতে ফেলেন অতঃপর রান্নাঘরে গিয়ে ম্যাচের বক্স নিয়ে এসে আমাদের চোখের সামনে সেই সকল চিঠি পুড়িয়ে দেন। আমরা তাকে থামাতে গিয়েও থামাতে পারি নি। সে শেষে শুধু এতটুকুই বলে, “প্রতারক তুমি।” কথাটা বলেই সে রুমে চলে যান। দরজা দেন। আর এইদিকে মা দ্রুত পানি এনে আগুন নিভানোর জন্য তড়িঘড়ি করতে থাকেন। আমি শুধু সেই আগুনের দিকে তাকিয়ে রই। ধাউ ধাউ করে জ্বলছে আগুনের শিখা আর সেই শিখায় জ্বলছে বছর খানেক ধরে বোনা আবেগ, স্নেহ, ভালোবাসা, প্রতিশ্রুতি, স্বপ্ন। যেই প্রেমের রচনা মামা করেছিলেন তার ইতি মিহি আন্টি টেনেছিলেন।

__________________________

কোরআন শরীফের মধুর ধ্বনি বন্ধ হতেই আমি অতীত থেকে বেড়িয়ে আসি৷ চকিতে তাকাই মামার রুমের দিকে। সে মোনাজাতে বসেছেন। হয়তো কাঁদছেন। মামা যতই বলুক মিহি আন্টি প্রতারক। তার প্রতি তার কোন অনুভূতি নেই। কিন্তু আসলে তো সে এখনো তাকে খুব ভালবাসে। তাই তো তার কথা রাখতে গিয়ে আজও সে বিয়ে করে নি। প্রতি বছর তার মৃত্যু বার্ষিকীতে সে কোরআন শরীফ খতম দেয়। মামা জানে মিহি আন্টি পুড়ছে জাহান্নামের আগুনে। আর হয়তো সারাজীবন পুড়বে। কেন না ইসলাম ধর্মে যে আত্নহত্যা মহাপাপ। পরকালে এর শাস্তি যে কখনো ক্ষমাযোগ্য হবে না। তাও তিনি মনের শান্তির জন্য এই কাজটা করেন। সাথেই এই আশায়ও একটু হলেও যদি মিহি আন্টি আত্না শান্তি পায়। একটু আরাম পায়। জানি না এইটা ধর্মে জায়েজ কিনা তাও মামার ভালোবাসা দেখে আমি সত্যি মুগ্ধ হই। কতই জনে বা পারে এমন ভাবে ভালবাসে। মামা আজো জানে না মিহি আন্টির দেহ কোথায় দাফন করা হয়েছে। কেন না, মিহি আন্টির না হয়েছে জানাযা, না হয়েছে ইসলামিক শরিয়ত অনুযাই দাফন। সে তো আত্নহত্যা করেছিল আর আত্নহত্যাকারীদের জানাযা ও দাফন কার্যক্রম করা ইসলামে নিষিদ্ধ। তকে কোথাও হয়তো মাটি খুঁড়ে তাকে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। আর এইভাবেও মৃত্যুর পরই তার পরিবার সেই এলাকা ছাড়ে। এরপর তারা কোথায় যায় কারো জানা নেই। সেইসাথে মিহি আন্টিকে কোথায় দাফন করে যায় তাও কারো জানা হয়নি। যার ফলে মামাও জানতে পারেন নি। জানলে হয়তো আন্টিকে দুই নজর ভরে একটু দেখতে পারতেন অনুভব করতে পারতেন। আচ্ছা মানুষ কেন বার বার ভুকে যায়, মৃত্যু কখনোই কোন কিছু সমাধান নয়। এতে যে মরে সে তো পরকালে আজীবন শাস্তির ভাগিদার হয়ই সাথেই বঞ্চিত হয় সুন্দর এক জীবন থেকে। অন্যদিকে তার সাথে জড়িত সকল মানুষেই ভুগে আরেক অমানসিক যন্ত্রণায়। কষ্টে, অনুশোচনায়। নিজের মনের কষ্ট বের করার পথ খুঁজে নিতে হয়। আল্লাহ/স্রষ্টার প্রতি ভরসা রাখতে হয়। তিনি কখনো কারো অমঙ্গল করে না তা বিশ্বাস করতে হয়। কিন্তু এই বিশ্বাসটি এই নেই আমাদের মনে। আমরা কিছু হলেই উত্তেজিত হয়ে উঠি। দিশেহারা হয়ে যাই। ধৈর্যহারা হয়ে যাই। যার ফলে এইসব অপ্রীতিকর ভাবনা বাসা বাঁধে। যা ধীরে ধীরে ভয়ংকর রুপ ধারণ করে। সাথেই বয়ে আনে নিজের ধ্বংস।

যখন আমি এইসব ভাবছি তখনই হঠাৎ গোঙ্গানি আওয়াজ কানে আসে। আমি দ্রুত মামার রুমের দিকে চলে যাই। রুমের সামনে গিয়ে দেখি মামা মাটিতে পড়ে আছেন। বুকের বা পাশট চেপে ধরে আছেন। তার চোখ উল্টিয়ে আসছে। ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। ছটফট করছেন। আমি দ্রুত মামার কাছে যাই। মামাকে ডাকতে থাকি। কিন্তু তিনি সাড়া দেন না। আমি রীতিমতো ভয়ে কান্না করে দেই৷ অহনাও আমার পিছু পিছু এসে এই অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে যায়। হিচকি তুলে কান্না করতে থাকে। কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে উঠে,

— আম্মি! নানাভাইয়ের কি হয়েছে? সে এমন করছে কেন? ও আম্মি!

আমার বোধশক্তি ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে। কোন কথাই কানে ঢুকছে না আমার। দিশেহারা হয়ে পড়ছি। হঠাৎ টনক নাড়ে,” মামাকে হসপিটালে নিতে হবে। যেভাবেই হোক নিতে হবে।” কিন্তু আমার একার পক্ষে তা সম্ভব না। আর আশে পাশে আমি কাউকে চিনিও না। আমি দ্রুত অহনাকে বললাম আমার ফোন আনতে। ও দৌড়ে যায় রুমে আমার ফোন আনতে। অতঃপর অহনা আমায় ফোন এনে দিতেই আমি আগে ভাইয়াকে ফোন দেই। কিন্তু ভাইয়ার ফোন সুইচড অফ বলছে। বেশ অনেকবার দেওয়ার পরও কাজ হলো না। আমি ভাবীকে ফোন দিলাম। তার ফোনও অফ। অতঃপর মনে পড়ে ভাইয়া-ভাবী দুইদিন আগেই ভাবীর গ্রামের বাড়ি গিয়েছেন। তার মা নাকি অসুস্থ। তাকেই দেখতে গিয়েছেন তারা। ভাবীর গ্রাম আটপাড়াগায় হওয়ায় সেখানে নেটওয়ার্ক পাওয়া দুষ্কর। আমি এখন বুঝে উঠতে পারছিলাম কাকে ফোন দিব। ভাইয়া বাদে ঢাকা শহরে আমার চেনা পরিচিত কেউ আছে বলেও আমার মনে পড়ে না। এত বছরে আমি সকলের সাথে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। কাউরো সাথে কোন রকম যোগাযোগ ছিল না। যার ফলস্বরুপ এখন আমি নিরুপায়। দারওয়ানকে যে ডাকবো তাও সম্ভব নয়। কেন না এই বাসায় দারওয়ান নেই আজ দুই সপ্তাহ হতে চললো। আগেরজন কাজ ছেড়ে তার গ্রামের বাড়ি চলে গিয়েছেন। কথায় আছে, “বিপদ আসলে চারদিক দিয়ে আসে।” আজ কথাটি হারে হারে টের পাচ্ছি আমি। বুঝে উঠতে পারছি না কাকে ফোন দিয়ে সাহায্য চাইব। এইদিকে মামা ছটফট করেই চলেছে। আমি ফোনের কন্টাক্ট লিস্ট ঘাটছি যদি কাউকে সাহায্যে জন্য পাওয়া যায়। ঠিক এমন সময় ফোনের স্ক্রিনে সাদ নামটা ভেসে উঠে। সাথে সাথে মনে হলো আঁধারে কিঞ্চিৎ আলোর আভা দেখা দিচ্ছে। আমি কিছু না ভেবে ওকে ফোন দেই। দুইবার রিং হতেই সাদ ফোন তুলে। ও কিছু বলার আগেই আমি তৎক্ষনাৎ কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠি,

— আমার তোমার হ্যাল্পের প্রয়োজন। প্লিজ হ্যাল্প মি। প্লিজ!

#চলবে