আরশি পর্ব-২৩

0
1804

#আরশি
#Part_23
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

দেখতেই দেখতে ২ মাস কেটে গেল। সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথেই আমার বেড়ে গেল দায়িত্ব ও কর্তব্য। সাথেই বাড়ে চাপ। একা হাতেই সামলে উঠতে হলো সবকিছু। কিন্তু এর মধ্যেও এক জোড়া হাত ছিল যা সবসময় আমায় সাহায্য করে গিয়েছে। আর সেই হাত জোড়ার মালিক হলো সাদ। এই দুইমাসে সে আমার সকল পরিস্থিতিতে আমার পাশে ছিল। পাশে ছিল সাদের মাও। সেই মামাকে হসপিটাল নেওয়া থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত। মামাকে যখন ডিসচার্জ দেওয়া হয় তখন ক্ষণিকের জন্য ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আনমনে শুধু ভাবছিলাম একা হাতে কিভাবে সবকিছু সামলাবো। সেইসময় সাদই আমার পাশে দাঁড়ায়। বিভিন্ন ভাবে হ্যাল্প করে। বিশেষ করে আমাকে বাসা থেকে কাজ করার সুযোগটা দেয়। যার ফলে আমি একা হাতেই সব সামলে উঠতে পারি। প্রায়ই সন্ধ্যার পরে সাদ এসে সকলের সাথে আড্ডা দিয়ে যেত। মাঝে মধ্যে সাদের মাও এসে দেখা করে গিয়েছেন। দেখতেই দেখতে বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে আমাদের মাঝে। আমি এক সপ্তাহ বাসা থেকেই কাজ করেছিলাম। এরপর যখন ভাইয়া ভাবী ফিরে আসলেন তখন সব শুনে ছুটে আসেন। অতঃপর প্রায় দুই সপ্তাহ আমাদের সাথেই ছিলেন। মামা আর আমার দেখাশোনার জন্য। তারা ছিল বিধায় আমি নিশ্চিন্তে জবটা কান্টিনিউ করতে পেরেছিলাম। সাদকেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম তাদের সাথে। ভাইয়ার সাথে বেশ ভাবও জমে গিয়েছিল ওর। অতঃপর মামা বেশখানিকটা সুস্থ হয়ে উঠতেই তারা চলে যান। তখন থেকে একাই সব সামলে নেওয়া শিখে গিয়েছিলাম।

অতীতের কিছু কথা ভেবে দীর্ঘ নিশ্বাস নেই। ফ্রিজ থেকে পুডিং এর প্লেটটা বের করে টেবিলে রাখতে রাখতে অহনাকে ডেকে উঠি।

— মামণি! মামণি! কোথায় তুমি?

কিন্তু কোন সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। তাই আমি অহনাকে খুঁজতে খুঁজতে চলে আসলাম নিজের রুমে। এসেই দেখি ও বিছানায় “হাতের খড়ি” বইটা নিয়ে বসেছে। ‘ক খ’ লিখছে সম্ভবত। দুই সপ্তাহ আগেই তাকে বইগুলো কিনে দিয়েছিলাম। লেখাপড়ায় সে বেশ পিছিয়ে গিয়েছে তাই সেই দিকে এখন বেশ জোর দিচ্ছি। অহনার ব্রেন অবশ্য ভালো। একবার দেখিয়ে দিলেই সে চট করে তা শিখে ফেলে। তাই ভাবছি পরের বছর প্লে ভর্তি না করে একবারে নার্সারিতে ওকে ভর্তি করিয়ে দিব। কথাটা ভেবেই দীর্ঘ নিশ্বাস বেড়িয়ে আসে। আমি দুই এক পা করে ওর দিকে এগিয়ে যাই। ওর পাশে গিয়ে বসি৷ আলতো কন্ঠে বলি,

— আমার মামণি বুঝি পড়ালেখা করছে?

অহনা মুখ তুলে বলে,

— আম্মি তুমি কি নানার মত হয়ে যাচ্ছ?

আমি ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করে বলি,

— নানার মত হয়ে যাচ্ছি মানে?

— মানে নানার মত কি চোখে কম দেখা শুরু করেছ নাকি? দেখতেই তো পাচ্ছ পড়ালেখা করছি তাও তুমি আমায় জিজ্ঞেস করছ। তোমাকে কালকেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। তার আগে চকলেট আঙ্কেলকে বলতে হবে।

আমি অহনার নাক টেনে বলি,

— ওরে দুষ্টু রে! দিন দিন বড্ড দুষ্টু হচ্ছ তুমি। আগে তো এতটা ছিলে না। তা কে শিখালো এত দুষ্টুমি?

অহনা দাঁত বের করে একটা মিষ্টি হাসি দেই। সেই সাথে দুই গালের মাঝে ফুটে উঠে ছোট ছোট গর্ত৷ হাতে থাকা পেন্সিল ঘোরাতে ঘোরাতে বলে,

— আর কে? চকলেট আঙ্কেল।

— ওহ! তাহলে এই দুষ্টুমির মূল আপনার চকলেট আঙ্কেল তাই না। দাঁড়াও আসুক আজকে৷ খবর নিচ্ছি আমি।

অহনা মিটিমিটি হেসে বলে,

— খবর তো তুমি টিভিতেই নিতে পারবে। চকলেট আঙ্কেল আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না।

আমি সরু চোখে অহনার দিকে তাকাই। এই সাদ নামক বাঁদরের সাথে থেকে মেয়ে আমার ওর মতই হচ্ছে। কিন্তু তাও করছেও আমাদের জন্য কম না। তাই আমি সেই কথা বাদ দিয়ে বলি,

— তোমার জন্য পুডিং বানিয়েছি। খাবে?

অহনা দ্রুত মাথা দুলিয়ে বলে,

– হাম! হাম! খাব।

এই বলে দৌড়ে যায় ডাইনিং এর দিকে। আমি মুচকি হেসে ওর পিছু পিছু যাই। অতঃপর ওকে পুডিং দিয়ে বসিয়ে চলে যাই রান্নাঘরে। একটা পাত্রে সুপ ঢেলে নিয়ে হাটা দেই মামার রুমের দিকে। রুমে এসে দেখি মামা চোখ বুঝে শুয়ে আছেন। আমি তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলি,

— ঘুমিয়ে আছ নাকি?

আমার কন্ঠ মামার কর্ণধার পর্যন্ত পৌঁছাতেই সে চোখ খুলে আমার দিকে তাকায়। অতঃপর স্মিত হেসে কিছু না বলে উঠে বসার চেষ্টা করে। আমি সুপটা বেড সাইড টেবিলের উপর রেখে মামাকে সাহায্য করি উঠতে। এখনো সে দূর্বলতা তার পিছু ছাড়ে নি। বেশি দূর্বল না হলেও কিছুটা দূর্বল। তাই তো এখনো আমি তাকে দোকানে যেতে দেয় নি। দুইদিন পর পর ম্যানেজার এসে সবকিছু দেখিয়ে টেখিয়ে কাগজপত্র ঠিক করে নিয়ে যায়। আমি মামাকে বসিয়ে দিয়ে মিষ্টি হাসি৷ মামা তা দেখে বলে,

— তুই কষ্ট করে খাবার আনতে গেলি কেন? ডাক দিলেই তো হতো। টেবিলে গিয়ে খেতাম।

— আমি না থাকলে খাও এই তো। যেহেতু আমি আছি সেহেতু কষ্ট করার কোন দরকার নেই৷

— ওই আরকি একবেলাই৷ এতে আর কি কষ্ট। এইভাবে তুই আমার অভ্যাস খারাপ করছিস। বিছানায় বসিয়ে রেখে রেখে একরোখা বানাচ্ছি।

— বেশ করছি।

কথাটি বলে আমি সুপের প্লেটটা এগিয়ে দেই। মামা তা দেখে নাক ছিঁটকে বলে,

— আবার সুপ!

— হ্যাঁ আবার সুপ। এখন বেশি কথা না বলে তারাতাড়ি খাও।

— একটু পোলাও মাংসও তো খাওয়াতে পারিস৷ তা না কিসব কুখাদ্য খাওয়াস।

আমি মামার দিকে সুরু চোখে তাকিয়ে বলি,

— হ্যাঁ খাওয়াবো নে। পরে যখন কলেসট্রোল বাড়বে আর হসপিটালের বেডে চ্যাপ্টা হয়ে পড়বে তখন ভালো হবে তাই না? চুপচাপ যা দিয়েছি তা খাও।

মামা মুখ কাঁচুমাচু করে সুপ গেলা শুরু করে। আমি মামার এমন মুখ দেখে হালকা হেসে বলি,

— সুপে তো মুরগি দেই। তাও বুঝি মন ভরে না।

— ধুর! এইটার কোন স্বাদ আছে নাকি? পানসে খাবার।

— হ্যাঁ এইটা তো পানসেই। রসালো খাবার তো বেশি মসলা আর ঝাল ওয়ালা হয়।

কথাটা একটু কড়া ভাবেই বললাম। মামা আর কিছু না বলে সুপ খাওয়ায় মন দিলেন। হঠাৎ মাথা তুলে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি কন্ঠে বললেন,

— তোকে না আজ আমার মায়ের মত লাগছে। মাও এইভাবেই শাসন করতো আমায়।

কথা শুনার সাথে সাথে আমি নরম হয়ে যায়। আমি হালকা হেসে বলি,

— বড়রা বাচ্চামো করলে ছোটদেরকেই বড় হতে হয়,বুঝলে! এখন খাওয়া শেষ করো। সকালে ঔষধ আছে কিন্তু তোমার।

— হুম।

______________________

গোধূলির লগ্ন পেরিয়ে আঁধার ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। কিছুক্ষণ আগেই আমি অফিস থেকে এসেছি। ফ্রেশ হয়ে মামার ঘরে একবার উঁকি দিলাম। সে বসে বসে বই পড়ছে। আমি রান্নাঘরের যাওয়ার আগে একবার অহনাকে দেখে নেই। সে টিভিতে ডোরেমন দেখছে। রান্নাঘরে এসে চুলায় রাতের রান্না বসিয়ে দিলাম। কিছু থালাবাসন ছিল সেগুলো ধুয়ে নিলাম। সব গোছগাছ করছি এমন সময় কলিং বেজে উঠে। আমি হাত ধুঁয়ে চলে যাই দরজার দিকে। দরজা খুলতে একজনের হাস্যজ্জ্বল চেহেরা ভেসে উঠে। আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই পিছন থেকে অহনা উৎফুল্ল সুরে চেঁচিয়ে উঠে,

— চকলেট আঙ্কেল!!

কথাটা বলেই সে সাদের দিকে দৌড়ে আসে। তা দেখে আমি মুচকি হাসি। আমার বুঝতে দেরি নি অহনা কলিং বেল এর আওয়াজ শুনে টিভি দেখা রেখে ছুটে এসেছে। এই মেয়েটাও না সাদ বলতে পাগল। যখনই সাদ এই বাসায় আসে অহনা সারাক্ষণ ওর সাথে আঠার মত চিপকে থাকে। অবশ্য পাগল হওয়ারই কথা। সাদ তো ওকে কম ভালবাসে না। বলতে গেলে মাত্রাতিরিক্ত ভালবাসে। প্রচন্ড আদরও করে। আর এইভাবেও কথায় আছে, “বাচ্চারা তো তার কাছেই বেশি যায়, যার কাছে সে বেশি ভালবাসা পায়।” অহনার বেলায়ও তাই।

অহনা সাদের দিকে দৌড়ে আসতেই সাদ ওকে কোলে তুলে নেয়৷ ওর নরম তুলতুলে গালে এক চুমু একে দিয়ে বলে,

— আমার অহুপরী টা কেমন আছে?

— অনেক ভালো। কিন্তু আমি তোমার সাথে রাগ করেছি।

শেষের কথাটা অহনা গাল ফুলিয়ে বলে। সাদ তা দেখে অবাক হওয়ার ভাণ করে বলে,

— ওমা তাই নাকি! তা এই অধমটা কি এমন অকেজো কাজ করেছে যে আমার পরীটা আমার থেকে রাগ করেছে।

অহনা আদো আদো গলায় বলে,

— এতদিন আসো নি কেন? সেই কবে এসেছিলে।

সাদ মিষ্টি হেসে বলে,

— কাজ ছিল তো তাই আসতে পারি নি। কিন্তু এই যে দেখ, কাজ শেষ হতেই এসেছি। সাথে তোমার জন্য চকলেট আর আইস্ক্রিমও এনেছি।

কথাটা বলেই ডান হাতে থাকা পলিথিনের ব্যাগটা উঁচিয়ে ধরে সে। তা দেখে অহনা খুশি হয়ে সাদের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,

— থেংক ইউ!

— ওয়েলকাম।

আমি এইবার ওদের কথার মাঝে ফোঁড়ন দিয়ে বলি,

— বাইরে দাঁড়িয়েই কি সকল কথা শেষ করবে নাকি ভিতরেও আসবে?

সাদ একটু পার্ট নিয়ে বলে,

— জায়গায়টা আসল না বুঝলে, কথা বলাটাই আসল।

কথাটা শুনে আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেই। এই ছেলের কিছু হবে না। অতঃপর সাদ কিছু না বলে ঢুকে পড়ে। আর হাতে আমার দুইটা ব্যাগ ধরিয়ে দেয়৷ একটাতে কিছু ফলমূল আরেকটাতে চকলেট ও আইস্ক্রিম। সাদ যতবারই বাসায় আসে ততোবারই অহনার জন্য চকলেট আর মামার জন্য ফল-টল নিয়ে আসে। এইটা যেন ওর অভ্যাস। আমি সেগুলো নিয়ে দরজা দিয়ে ওদের পিছে পিছে আসি। পিছন থেকেই সাদকে উদ্দেশ্য করে বলি,

— এইসব আনার কি দরকার ছিল? প্রতিবারই কি আনতে হবে তোমার এইসব?

সাদ আমার দিকে ঘুরে বলে,

— তোমার এত জ্বলে কেন বন্ধু? তোমার জন্য কিছু এনেছি নাকি? সো জাস্ট স্টোপ ইউর পকপক।

আমি কিছু না বলে কটমট দৃষ্টিতে তাকাই। সাদ সেটা তোয়াক্কা না করে অহনাকে নিয়ে চলে যায় মামার রুমের দিকে। যাওয়ার আগে বলে যায়,

— এই যে মিস দর্পণ! শুনছেন?

আমি চকিতে তাকাই তার দিকে। তারপর বলি,

— থাক শুনা লাগবে না। বুঝেছি আমি। মিনিট দশকের মধ্যে চা পেয়ে যাবে।

— এই চায়ের টানেই এইখানে বার বার আসা। এত ভালো চা খাওয়ার লোভ কি সহজে সামলানো যায়? তাও আবার আমার মত চা খোর এর পক্ষে? ইম্পসিবল!

এই বলে সে ভূবণ ভুলানো হাসি দেয়। তারপর চলে যায় মামার রুমে। আর আমি বিরবির করতে করতে রান্নাঘরের দিকে যাই।

__________________

ভ্যাপসা গরমের দিনে স্বচ্ছ নীল আকাশের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে কুঞ্জ কুঞ্জ মেঘের ভেলা। নিরবে স্নিগ্ধ বাতাস বইছে। কিছুক্ষণ আগেই গোধূলির প্রহর শুরু হয়েছে। দুপুর একটা দিকে বাসা থেকে বের হলে নিউ মার্কেট এসে পৌঁছেছি এখন। মূলত এইখানে আসা অহনা ও মামার জন্য কিছু মার্কেটিং করতে। অফ সিজন হলেও মার্কেটে ভীড় ভালোই আছে। আমি একেক দোকান ঘুরে ঘুরে দেখছি। কিছুই পছন্দ হচ্ছে না। এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে ছোট বাচ্চাদের ড্রেসের একটা শপে দাঁড়াই আমি। অহনার জন্য জামা দেখতে থাকি। তখন সামনের দিকে নজর যেতেই আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই। নয়ন দুইটি হয়ে যায় স্থির। চোখের সামনে ভাসতে থাকে এক অনাকাঙ্ক্ষিত চেহেরা। এই অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষটির মুখখানি যে আমার খুব চেনা একজন। খুব! এর সাথেই তো প্রায় ১০ টা বছর ছিলাম আমি। ১০ টা বছর! ভেবেই বুক চিরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেড়িয়ে আসে। অনিচ্ছাকৃত ভাবেই তার নামটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, ফাহাদ!

#চলবে