#আহনাফ_চৌধুরী
#পর্ব_১২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
______________
আহনাফ ভ্রু কুঞ্চন করে জিজ্ঞেস করল,
“ভেবে উত্তর দিচ্ছেন তো? আমি কিন্তু এখন বেকার!”
পাশ থেকে তখন আহনাফের বাবা আতিক চৌধুরী বললেন,
“নাটক তো তুমি কম জানো না বাবা!”
তামিম তখন জিজ্ঞেস করল,
“কেন আঙ্কেল? কী হয়েছে?”
“কী হয়নি বল? আমি আজ অফিসে যাইনি। ড্রয়িংরুমে নিউজ দেখছিলাম। আহনাফ পাশেই ছিল। হঠাৎ দেখি ওর ফোন বাজছে। ফোন নিয়ে রুমে চলে গেল। কয়েক মিনিট বাদেই হন্তদন্ত হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আমাকে আর তোর আন্টিকে বলতেছে, ‘আমি বিয়ে করব।’ ওর কথার কী জবাব দেবো আর ভেবেই কুল পাচ্ছিলাম না। ছেলের মাথা গেল কিনা কে জানে! পরে তোর আন্টি জিজ্ঞেস করল, কাকে বিয়ে করবে? আহনাফ কোনো উত্তরই দিল না। শুধু বলল, ‘গাড়িতে বলব। চলো।’ এরপর গাড়িতে উঠেই সব বলল। আর তোকে তো গাড়িতেই কল করে বলল কাজী নিয়ে আসতে।”
উপস্থিত সবাই হেসে ফেলল। তামিম হাসতে হাসতেই বলল,
“আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না আঙ্কেল। পরে ওর কণ্ঠ শুনে মনে হয়েছিল যে, আসলেই হয়তো সিরিয়াস। পরে আমি মা আর কাজী নিয়ে বাসায় আসার পথে ঐশিকে কল করে সব বললাম। ঐশি আব্বা-আম্মাকে বলেছে মনে হয়। এরপর তো আপনারাই এলেন।”
অর্ষা বিস্মিত হয়ে সব শুনছিল। কলেজ থেকে বাড়িতে আসার পথে জ্যামে পড়েছিল। কতক্ষণই বা ছিল জ্যাম? সব মিলিয়ে বাসায় আসতে ওর ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিনিট লেগেছে। এর মাঝেই আহনাফ সবকিছু ম্যানেজ করে ফেলল? এমনকি অর্ষার বাবা-মাকেও!
আতিক চৌধুরী বললেন,
“আমাদের নাকানি-চুবানি খাইয়ে এখন বেকারের নাটক করছ না? তোমার জন্য বাসায় ভাত রান্না হলে ওর জন্যও হবে।”
আহনাফ হেসে ফেলল। বলল,
“তুমি বললে তো হবে না আব্বু। যে আমাকে বিয়ে করবে, তার তো উত্তর দিতে হবে।”
অর্ষা তখনো ঘোরের মাঝে ছিল। তৎক্ষণাৎ জবাব দিতে না পারলেও পরক্ষণে বলল,
“আমার সমস্যা নেই।”
সবাই সমস্বরে বলে উঠল,
“আলহামদুলিল্লাহ্।”
এরপর একদম ঘরোয়া পরিবেশেই অর্ষার বিয়ে হয়ে গেল। অল্প সময়ের মধ্যেই বিয়েটা হয়ে যাচ্ছে বলে শপিং করার সময় পায়নি আহনাফ। তবে ওর এক পরিচিত বন্ধু আছে। ওকে কল করে বলে দিয়েছে ইমার্জেন্সি একটা বেনারসি শাড়ি কিনে যেন ওর পাঠানো ঠিকানাতে নিয়ে আসে। এত তাড়াহুড়োতে আহনাফ ওর বাবা-মাকে নিয়ে এসেছে যে, আসার সময় গয়নাও আনতে পারেননি সাজেদা বেগম। এই নিয়ে কিছুক্ষণ তিনি আহনাফকে গালমন্দও করলেন।
ওসমান আলম তখন বললেন,
“সমস্যা নেই বেয়াইন। বিয়ে তো এখন ঘরোয়াভাবে হচ্ছে, হোক। ঐশির বিয়ের পর অর্ষার বিয়েটাও আমি ধুমধাম করেই দেবো ইন-শা-আল্লাহ্। তখন আর কোনো কিছুরই কমতি থাকবে না আশা করছি।”
এরপর আর কারো কোনো কিছুতে আপত্তি রইল না। দুই পরিবারের সম্মতিতেই আহনাফ এবং অর্ষার বিয়ে হয়ে গেল। তামিম আড়ালে গিয়ে আহনাফকে জিজ্ঞেস করল,
“বউ নিয়ে যাবি নাকি রেখে যাবি?”
“রেখে যাওয়ার জন্য কি বিয়ে করেছি? হাত ধরেছি যখন, এখন এই মুহূর্ত থেকে ওর সব দায়িত্বও আমার।”
তামিম ঠোঁট উলটে বলল,
“ব্র্যাভো! আ’ম ইমপ্রেশড্।”
আহনাফ মৃদু হাসল। বিকালে অর্ষাকে নিয়ে আহনাফ বাসায় ফিরল। বাড়িতে ফিরে সাজেদা বেগম অনেকগুলো গয়না বের করে অর্ষাকে দিয়ে বললেন,
“এগুলো সব তোমার। এখান থেকে যেটা তোমার ভালো লাগে পরো। আর বাকিগুলো তোমার কাছেই রেখে দাও।”
“না, না আন্টি। আমার এসব কিছুই লাগবে না।”
সাজেদা বেগম গা ঘেঁষে বসলেন অর্ষার সাথে। গালে হাত ছুঁইয়ে চোখের পাশে তাকালেন। মুচকি হেসে বললেন,
“দাগ এখনো স্বল্প রয়ে গেছে দেখছি! ব্যাপার না, আমার ছেলে এই আঘাত ভালোবাসা দিয়ে শোধ করে দেবে দেখো। শুধু ওর বিশ্বাসটা কখনো ভেঙো না। ওকে অল্প একটু ভালোবেসো। বিনিময়ে পুরো পৃথিবী ও তোমার পায়ের কাছে এনে দেবে। আমার ছেলে বলে যে সাফাই গাইছি এমনটা ভেবো না। একসাথে থাকতে থাকতে তুমি নিজেই সব বুঝতে পারবে। প্রথমদিন বলেছিলাম, মন্দ ভাগ্য নিয়ে আর এসো না। আলহামদুলিল্লাহ্, এবার ভালো ভাগ্য নিয়েই এসেছ। স্বামী, সংসার নিয়ে সুখী হও দোয়া করি, মা।”
অর্ষা কোনো প্রত্যুত্তর করতে পারল না। বিনিময়ে মৃদু হাসল শুধু। সাজেদা বেগম চলে যাওয়ার পর অর্ষা গয়নাগুলো বিছানার একপাশে রেখে দিল। বাড়ি থেকে আনা লাগেজ থেকে এক সেট থ্রি-পিস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল কাপড় বদলাতে। বের হয়ে দেখল আহনাফ আলমেরি থেকে কাপড় সরাচ্ছে।
“কী করছেন?” জিজ্ঞেস করল অর্ষা।
আহনাফ পাশ ফিরে তাকিয়ে বলল,
“ওহ ফ্রেশ হয়েছেন? মা খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে। আপনি গিয়ে খেয়ে আসুন।”
“আপনি এই অসময়ে কাপড় গোছাচ্ছেন কেন?”
“কাপড় গোছাচ্ছি না। সরাচ্ছি।”
“কেন?”
“আগে তো আমারই সব কাপড় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। মা এসে এসে গোছাত। এখন তো আপনার কাপড়ও রাখা লাগবে। এক সাইডে সব আমার কাপড়। আর এখানে আপনার সব কাপড় রাখবেন। থাক, আমিই রেখে দিচ্ছি।”
বলে লাগেজ থেকে কাপড় বের করতে গেল আহনাফ। অর্ষা হাতের বেনারসিটা তড়িঘড়ি করে বিছানার ওপর রেখে আহনাফের হাত চেপে ধরল। বলল,
“না, না। আমিই পরে রেখে দেবো।”
“এভাবে উড়ে এলেন কেন?”
“কোথায় উড়লাম?”
“উড়েই তো এলেন! আমি তো আপনার কাপড় নিয়ে পালিয়ে যাব বলিনি। গুছিয়ে দেবো বলছি।”
“বললাম তো আমি পারব।”
“আমি রাখলে সমস্যা কোথায়?”
“সমস্যা আছে। আপনি বুঝবেন না। মেয়েদের অনেক দরকারি জিনিস থাকে।”
আহনাফ কিছুক্ষণ হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল,
“আচ্ছা। আপনি তাহলে খেয়ে আসুন।”
বলে সে বিছানায় গিয়ে শোয়ার জন্য বসল। অর্ষা বলল,
“আপনি খাবেন না?”
“না। আপনার বাসায় যা খাইয়েছে! দুদিন আরও না খেয়ে থাকতে পারব। আপনি যান। বাসায় তো ঠিক মতো খেলেনই না তখন।”
অর্ষা মাথা নাড়িয়ে চলে যাচ্ছিল। আহনাফ বিছানার ওপর থেকে শাড়ি সরাতে গিয়ে বলল,
“এটাই কি সেই দরকারি জিনিস? যেগুলো লাগেজে আছে বলে ধরতে দেননি?”
অর্ষা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে পেছনে তাকাতেই দেখল আহনাফের হাতে ব্লাউজ এবং ইনার, যেটা সে ব্লাউজের ভেতর পরেছিল। লজ্জায় তার ইচ্ছে করছিল মাটিতে মিশে যেতে তখন। সে ধমক দিয়ে বলল,
“আশ্চর্য! রাখেন ওটা। রাখেন বলছি! যত্তসব!”
লজ্জা এড়াতে রাগ দেখিয়ে অর্ষা দ্রুত প্রস্থান করল। আহনাফ ভ্রু কুঁচকে স্বগতোক্তি করে বলল,
“আমার কী দোষ?”
.
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে অর্ষা আর আহনাফের রুমে গেল না। সাজেদা বেগমের রুমে বসে শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে গল্প করছিল। আহনাফের বোন আশা বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারেনি তখন। তাই এখন ভিডিয়ো কলে কথা বলল অর্ষা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলে অর্ষা সাজেদা বেগমের সাথে রান্নাঘরে গেল সন্ধ্যার নাস্তা বানানোর জন্য। সাজেদা বেগম বললেন,
“তোমার এসব কিছুই করা লাগবে না, মা। তুমি রুমে যাও। গিয়ে দেখো আহনাফ কী করে? এই সন্ধ্যায় ঘুমাচ্ছে কিনা কে জানে!”
“সমস্যা নেই। নাস্তা বানিয়েই পরে ডেকে দিচ্ছি।”
“পাগলি মেয়ে! আমি পারব তো।”
“আমিও পারব।”
সাজেদা বেগম না পেরে রাজি হলেন। দুজনে মিলে নাস্তা বানিয়ে নিল। বাড়ির মেইড তখন রাতের রান্নাবান্নার জোগাড় করছিল।
“এখন গিয়ে আহনাফকে ডাকো।” বললেন সাজেদা বেগম।
অর্ষা মাথা নাড়িয়ে রুমে চলে গেল। গিয়ে দেখল বিছানায় নেই আহনাফ। কিন্তু শাড়িটা সুন্দর করে ভাঁজ করে রাখা। নিশ্চয়ই সে ভাঁজ করেছে। অর্ষা বারান্দায় গেল। একটা সুন্দর দোলনা আছে সেখানে। আহনাফ দোলনায় বসে দোল খাচ্ছিল আর আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল।
অর্ষা মৃদুস্বরে বলল,
“নাস্তা করতে ডাকে আপনাকে।”
“অর্ষা?”
“হু?”
আহনাফ এক হাত বাড়িয়ে দিল। অর্ষার অস্বস্তি হচ্ছিল ভীষণ! হাত বাড়াবে নাকি বাড়াবে না বুঝতে পারছিল না। অবশেষে সে হাত বাড়াল। আহনাফ ওর হাত ধরে নিজের পাশে বসাল। দোলনায় দোল দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি খুশি তো?”
অর্ষা ছোটো করে বলল,
“হু।”
“ছেড়ে যাবেন না তো আমায়?”
অর্ষা তাকাল আহনাফের মুখের দিকে। আহনাফ তখনো অর্ষার হাত ধরে ছিল। অর্ষা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
“না।”
“একটা চুমু খাই?”
আহনাফের হঠাৎ এমন আবদারে আরও বেশি অস্বস্তি তাকে চেপে ধরছিল। সে তো এখনো তার অতীতেই আটকে আছে। বের হতে না পারলে সে কীভাবে আহনাফের সাথে সহজ হবে? আবার আহনাফকে সে না বলবে কীভাবে? যে মানুষটা ওর এক কথাতেই দায়িত্ব নিয়েছে, বিয়ে করেছে তাকে তো সে কষ্ট দিতে চায় না কোনোভাবেই। কিন্তু তার সময়েরও প্রয়োজন আছে।
আহনাফ হেসে বলল,
“ভয় নেই। আকাঙ্ক্ষা কিংবা প্রণয়ের চুমু নয়; ভরসার চুমু দেবো। তবে আপনি রাজি না হলে জোর করব না।”
অর্ষা ভ্রু কুচকে বলল,
“ভরসার চুমু?”
“হু। কেন চেনেন না? বেশ! আমি চিনিয়ে দিচ্ছি।”
বলে অর্ষার দু’গালে হাত রেখে কপালে আলতো করে চুমু খেল আহনাফ। অর্ষার কেন জানিনা ভালো লাগায় চোখে পানি জড়ো হয়ে গেল।
চলবে…