আহনাফ চৌধুরী পর্ব-১৯

0
70

#আহনাফ_চৌধুরী
#পর্ব_১৯
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
______________
অর্ষা বাবার বাড়ি বেড়াতে এসেছে দুদিন হবে। আমেনা বেগম তাই ঐশিকেও শ্বশুরবাড়ি থেকে কয়েকদিনের জন্য নিয়ে এসেছেন। দুই মেয়ের সব পছন্দের খাবার-দাবার রান্না হচ্ছে বাসায়। অর্থি সব খাবারই খাচ্ছে। মাঝেমাঝেই আবার গাল ফুলিয়ে বলছে,

“শুধু আপুদের পছন্দের খাবার রান্না করছ কেন আম্মু? আমার পছন্দের খাবার কই? আজ আমার বিয়ে হয়নি বলে এমন অবহেলা!”

অর্থির এমন পাকনামো কথা শুনে সবাই হাসে। যতগুলো রান্নাই হোক এখানে অর্থিরও যে পছন্দের খাবার নেই এমনটা নয়। তবুও ছোটোদের অভিযোগের শেষ থাকে না। তাদের ভালোবাসায় কেউ ভাগ বসালেও সহ্য করতে পারে না। সে যদি মায়ের পেটের আপন বোনও হয় তাতেও নয়। তবে অর্থি ভীষণ খুশি দুবোন বাড়িতে এসেছে বলে। বাড়িটা আবার আগের মতো লাগছে। বরং আগের চেয়ে আরো বেশিই আনন্দ হচ্ছে এখন। ওসমান আলম প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পথে কিছু না কিছু খাবার অথবা গিফ্ট কিনে নিয়ে আসবে তার তিন মেয়ের জন্য। এছাড়া গতকাল ঐশি, অর্ষা আসার পরই সন্ধ্যায় বাড়ির সবাই মিলে রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিল। আহনাফ ও তামিম অফিসের কাজের জন্য এখানে থাকতে পারছে না। যখন দুবোনের যাওয়ার সময় হবে তখন এসে একদিন বা দুদিন থেকে তারপর ওদের নিয়ে যাবে।

ঐশি আর অর্ষা মিলে আজ রান্না করছিল। মায়ের ছুটি আপাতত আজ। যদিও আমেনা বেগম মেয়েদের দিয়ে মোটেও রান্না করাতে চাননি। কিন্তু কন্যাদ্বয়ের জেদের কাছে হার মানতে হয়েছে। তার কোনো কাজ না থাকায় তিনি ড্রয়িংরুমে বসে বসে অর্থির ড্রয়িং দেখছিলেন। অর্ষার ফোন বাজছিল তখন রুমে। অর্থি দৌড়ে গিয়ে ফোন আনল। আমেনা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,

“কে?”

“ভাইয়া ফোন করেছে।” বলল অর্থি।

এরপর ফোন নিয়েই ছুটে গেল রান্নাঘরে। ব্যস্তকণ্ঠে বলল,

“আপু, ভাইয়া ফোন করেছে।”

অর্ষা আরো ব্যস্ত ছিল। তাই বলল,

“রিসিভ করে কথা বল। বল যে আমি এখন কাজ করছি।”

অর্থি ফোন রিসিভ করে আবার ড্রয়িংরুমে চলে গেল। হোয়াটসএপে ভিডিয়োকল রিসিভ করতেই আহনাফের হাস্যজ্বোল মুখটা ভেসে উঠল। অর্থি সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“কেমন আছেন ভাইয়া?”

আহনাফ হেসে বলল,

“এতক্ষণ তো ভালো ছিলাম না। কিন্তু এখন তোমাকে দেখার পর ভালো আছি।”

অর্থি মুখ ভেংচি কেটে বলল,

“ইশ, ঢং! আপুকে কিন্তু বলে দেবো।”

“কী বলবে?”

“এইযে আপনি আমার সাথে ঢং করেন। এটা বলে দেবো।”

“ঢং না সত্যি। আর সত্যি কথা দিনে নয়শো নিরানব্বই বার বলা যায়।”

অর্থি আবারও ভেংচি কাটল। আহনাফ হেসে বলল,

“তোমার আপু কোথায়?”

“আপু তো রান্না করছে।”

“তাই নাকি? আর আম্মু কোথায়?”

“এইযে এখানেই। কথা বলবেন?”

“হ্যাঁ, দাও।”

আমেনা বেগমকে ফোন এগিয়ে দিল অর্থি। সালাম দিয়ে আহনাফ জিজ্ঞেস করল,

“আম্মু, ভালো আছো?”

আমেনা বেগম বললেন,

“আলহামদুলিল্লাহ্‌ বাবা, ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”

“ভালো আর কীভাবে থাকি আম্মু? বউটাকে তো নিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছ।”

আমেনা বেগম হেসে ফেললেন। বললেন,

“তোমাদের বাড়িই তো থাকে। মাত্র দুদিন হয়েছে এসেছে তাতেই এত চোখে হারাচ্ছ। তাহলে আমি কীভাবে দুই মেয়েকে ছাড়া থাকি বলো তো?”

“তোমার তো সান্ত্বনার জন্য অর্থি আছে। ওর জন্য হলেও বাকি দুজনের কথা ভুলে থাকতে পারো। কিন্তু আমার তো আর কোনো বউ নাই।”

আমেনা বেগমের হাসি থামছে না। এই ছেলেকে তিনি প্রথমে ভীষণ গম্ভীর ভাবতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তামিমের মতো আহনাফও এই বাড়ির ছেলে হয়ে উঠেছে। তার মনেই হয় না যে এই দুজন তার মেয়ে-জামাই। বরং মনে হয় তার নিজেরই ছেলে। সবাই একসাথে হলে বাড়িটা আনন্দে গমগম করে ওঠে। প্রতিদিন নামাজ পড়ে তিনি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেন এমন সোনার টুকরা দুইটা ছেলেকে আল্লাহ্ তার মেয়েদের ভাগ্যে দিয়েছেন তাই।

দুজনের কথা বলার মাঝেই অর্থি গিয়ে অর্ষাকে টেনে নিয়ে এসেছে। অভিযোগের সুরে বলছে,

“আপু দেখো, ভাইয়া আরেকটা বউয়ের কথা বলে।”

অর্ষা এসে মায়ের পাশে দাঁড়াল। ওকে দেখতে পেয়েই আহনাফ বুকে হাত রেখে বলল,

“ইশ! কী শান্তি! বুকটা ভরে গেল।”

অর্ষা ভেংচি কাটল। আহনাফ তখন বলল,

“আম্মু তুমি চোখটা একটু বন্ধ করো তো।”

আমেনা বেগম অবাক হয়ে বললেন,

“আমি? কেন?”

“হু, করো না!”

আমেনা বেগম হাত দিয়ে চোখ ঢাকলেন। আহনাফ সঙ্গে সঙ্গে ফ্লাইং কিস দিল অর্ষাকে।অর্ষা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও কিছু বলল না। আহনাফ বলল,

“আম্মু এবার চোখ খোলো।”

“আপনি একটা বদ!” বলল অর্ষা।

আহনাফ ফের বলল,

“আম্মু কষ্ট করে আরেকবার চোখটা বন্ধ করো।”

আমেনা বেগম হাসছেন আবার লজ্জাও পাচ্ছেন। তিনি চোখ বন্ধ করতেই আহনাফ আবারও ফ্লাইং কিস দিল। এরপর বলল,

“আম্মু চোখ খোলো।”

আমেনা বেগম আর লজ্জায় কথা বলতে পারলেন না। যদিও তিনি কিছু দেখেননি তবে আন্দাজ তো করতে পেরেছেন। তাই ফোন মেয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

“তোরা কথা বল। আমি রান্নাঘরে যাই।”

অর্ষা ফোন নিয়ে নিজের রুমে চলে এলো। চোখ পাঁকিয়ে বলল,

“আপনি খুবই অসভ্য।”

“কেন? আমি কী করেছি?”

“মায়ের সামনে চুমু দেওয়ার মানে কী?”

“আম্মু কি দেখেছে নাকি?”

“না দেখুক। বুঝেছে তো!”

“হুম বুঝুক। এতে মন্দ কী? আম্মুও জানুক, তার মেয়েকে আমি কতটা ভালোবাসি।”

“আপনার মাথা।”

“এই শোনো না?”

“হুঁ?”

“মিস করছি ভীষণ।”

“কাকে?”

“কাকে আবার? আমার বউকে। তুমি কবে আসবে বলো তো?”

“আসব না।”

“আসব না বললেই হলো? তুলে নিয়ে চলে আসব। আমি কালই আসছি।”

“কালই মানে? এক সপ্তাহ্ থাকব বলেছিলাম।”

“হ্যাঁ। কিন্তু এখন আমি তোমায় ছাড়া থাকতে পারছি না। তোমাকে না দেখলে ভালো লাগে না।”

“ভিডিয়ো কলে তো দেখছেনই।”

“এতে কি মন ভরে নাকি? ঘুম থেকে উঠে তোমায় না দেখলে, জড়িয়ে না ধরলে আমার ভালো লাগে না।”

“মাথা গেছে আপনার।”

“সে তো কবেই গেছে তোমায় ভালোবেসে।”
“তাই?”

“নিঃসন্দেহে। তুমি প্লিজ কালই চলে এসো আমার সাথে? কয়দিন পর না হয় আবার যেও?”

“আব্বু, আম্মুর মন খারাপ হয়ে যাবে।”

“আমি ম্যানেজ করব তাদের। তুমি আসবে বলো?”

“আপনি এত পাগল কেন?”

“আগে তো আর ছিলাম না। এখন বউ আছে তাই বউপাগল হয়েছি।”

“হুহ! কাল আসেন তারপর দেখা যাবে। এখন রাখছি।”

“কেন? কোথায় যাবে?”

“রান্না করব।”

“ওহ আচ্ছা। ঠিক আছে যাও। সাবধানে দেখেশুনে কাজ করবে। হাত যেন না কা’টে। আ’গু’ন থেকে সাবধান।”

“আচ্ছা। রাখলাম।”

“বউ?”

“কী?”

“ভালোবাসি।”

অর্ষা মুচকি হেসে বলল,

“ভালোবাসি।”

হঠাৎ আহনাফ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“এই তোমার মুখে দাগ কীসের? আঘাত পেয়েছ কিছুতে?”

অর্ষা ভড়কে গিয়ে বলল,

“কই না তো!”

“দেখি, এদিকে আসো।”

অর্ষা মুখটা ফোনের কাছে এগিয়ে নিতেই আহনাফ ওপাশ থেকে চুমু খেল। লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল অর্ষার মুখ। ঠোঁট টিপে হেসে বলল,

“আপনি খুবই অ’স’ভ্য!”

আহনাফ হাসছে। আরো বেশি লজ্জা পেয়ে কল কেটে দিল অর্ষা।
.
.
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। আহনাফ দাঁড়িয়ে আছে একটা ছাউনির নিচে। তার ঠিক পাশেই একটা মেয়ে। মেয়েটাকে অর্ষা চেনে না। আগে কখনো দেখেওনি। আজই প্রথম। মেয়েটাকে নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু আহনাফের পাশে দেখে বুকে কেমন একটা সূক্ষ্ম চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। অর্ষা ভাবল সে এগিয়ে যাবে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে, মেয়েটা কে! কিন্তু সে এক পা বাড়াতেই মেয়েটা আহনাফের হাত জড়িয়ে ধরল। অর্ষার পা থেমে গেল। মাটি যেন আঁকড়ে ধরে রেখেছে। অস্বস্তি ও কষ্টে বুকটা বিষিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সে আহনাফকে হারিয়ে ফেলছে একটু একটু করে। তার দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।

সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠল অর্ষা। নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করল যখন, কিছুই সে বুঝতে পারছিল না। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ফ্যান বন্ধ। খুব সম্ভবত কারেন্ট নেই। সে যখন বিছানায় তার মানে এতক্ষণ ধরে সে স্বপ্ন দেখছিল! শুধু স্বপ্ন না; খুবই বাজে স্বপ্ন। প্রিয় মানুষ হারিয়ে ফেলার ভয় এত ভয়ংকর কেন? অর্ষা বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু মনে স্বস্তি পাচ্ছে না সে কিছুতেই। চোখ ভেঙে কান্না পাচ্ছে তার। মনকে সে বারংবার বোঝানোর চেষ্টা করছে, এটা শুধু মাত্র একটা স্বপ্ন; দুঃস্বপ্ন। কিন্তু মন সে কথা মানতে নারাজ। শুনতেও নারাজ। সে আহনাফকে হারানোর ভয়ে তটস্থ হয়ে রয়েছে।

শুক্রবার আজ। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার করে অর্ষাকে নিয়ে নিজের বাসায় ফিরেছে আহনাফ। অল্প জার্নি করলেই অর্ষার ঘুম পেয়ে যায়। তাই সে এসেই ফ্রেশ হয়ে শাশুড়ির রুমে গিয়েছিল কথা বলতে। সেখানেই গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে গেছে। আতিক চৌধুরী গিয়েছিল তখন বাইরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে লেকে। তাই সাজেদা বেগম আর অর্ষাকে ডাকেননি। তিনি ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছিলেন এতক্ষণ। কারেন্ট চলে যাওয়ায় রান্নাঘরে গিয়েছেন চা বানাতে।

অর্ষা দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সন্ধ্যা ছয়টা বাজে। সে বিছানা থেকে নামল দ্রুত। বড়ো বড়ো কদম ফেলে গেল নিজের রুমের দিকে। রুমের দরজা ভেতর থেকে চাপানো ছিল। সে শব্দ করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল।

অর্ষা ঘুমুচ্ছিল বলে আহনাফ বাইরে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ আগেই বাসায় এসেছে। চেঞ্জ করার জন্য আলমারি থেকে কাপড় বের করছিল। শব্দ শুনে পেছনে তাকিয়ে অর্ষাকে দেখে দুষ্টুমি করে সুর দিয়ে গান গাওয়া শুরু করে,

“ওরে নিষ্ঠুর, পাষাণী…”

আহনাফের গান পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই অর্ষা ঝড়ের বেগে দৌড়ে এসে আহনাফকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,

“চুপ! কোনো কথা বলবেন না। আমাকে বুকে রাখুন।”

আহনাফ যারপরনাই অবাক হয়েছে অর্ষার এমন আচরণে। শুধু অবাক বললে ভুল হবে, সে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে। কেননা তার বউটা স্বভাবতই রাগী, গম্ভীর, চুপচাপ স্বভাবের। অন্তত সে তো শুরু থেকে এভাবেই অর্ষাকে দেখে আসছে। যদিও অর্ষা পূর্বে চূড়ান্ত দুরন্ত এবং চঞ্চল ছিল বলেই সে শুনেছে। কিন্তু এখনের অর্ষার সাথে এটা যেন ঠিক যাচ্ছিল না। সে এতটাই অবাক হয়েছে যে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরতেই ভুলে গেছে। তাকে আরো বেশি অবাক করে দিয়ে অর্ষা ফুঁপিয়ে উঠল। হুঁশ ফিরে পেল আহনাফ। এক হাতে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরে অন্য হাত দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

“জান, কী হয়েছে? কাঁদছ কেন?”

অর্ষা ভাঙা ভাঙা স্বরে বলল,

“অস্থির লাগছে। কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে খুব।”

“কেন জান? কী হয়েছে আমাকে বলো?”

“আপনি আমাকে কখনো ছেড়ে যাবেন না বলেন?”

আহনাফ অবাক হলো। তবে দৃঢ়কণ্ঠে বলল,

“কখনো না। তোমাকে রেখে আমি কোথায় যাব? তুমি তো আমার জান। আমার বউ।”

“প্রমিস করেন?”

“আচ্ছা প্রমিস।”

অর্ষা একটু দমল। আহনাফ অর্ষার মুখটা তার বুক থেকে তুলে দুহাতের আজলায় তুলে নিয়ে বলল,

“জান, তোমায় আমি কতটা ভালোবাসি তুমি জানো না? তুমি ছাড়া আমি রিক্ত, শূন্য।”

চলবে…