আড়ালে আবডালে পর্ব-৩৮+৩৯

0
3606

#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_৩৮
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________

নদী ভাঙন দৃশ্য চোখে পড়লেই দৃশ্যমান হয় নদীর স্রোত, ঢেউ এসে স্থলভাগ নদীগর্ভে টেনে নিয়ে যাওয়ার। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই পানি শুধু থৈ থৈ করে। কৃষকের কৃষিজমি, সকলের বাড়ি-ঘর সবকিছু নদীতে তলিয়ে যায়। যারা হারায় তারা নিঃস্ব হয়। তাদের কষ্ট হয়। কিন্তু এই নিয়তিকেই তাদের মেনে নিতে হয়। মেনে নেওয়ার পরও বুকের ভেতর হারানোর যেই হাহাকার সেই হাহাকার কি কেউ কখনো টের পায় নাকি পেয়েছে কখনো? অনলের বুকে আজ নদী ভাঙন নয় পুরো মনটাই ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। এই সত্যকে অস্বীকার করার মতো সাহসও তার নেই। যেদিকে তাকাচ্ছে সেদিকেই শুধু শূন্যতা। কানে ভেসে আসছে মিহির বলা কথাটা। নিহি তাহলে নিজেরই ভাইয়ের বউ! আল্লাহ্ এত কঠিন শাস্তি কী করে দিতে পারে?

অস্থিরতায় পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। বন্ধ চোখের পাতা পিটপিট করছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মৃদু চিৎকার দিয়ে চোখ মেলে তাকায় অনল। বিছানার পাশে অনামিকা রহমান এবং আজমল আহমেদ। শিয়রে দাঁড়িয়ে আছে সাকিব আর মিলন। অনলের চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে নিহিকে, আমানকে। ওরা কোথায়?অনল চারদিকে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারে এটা আমানেরই বাড়ি। অনামিকা রহমানের চোখে পানি। অনলকে তাকাতে দেখে ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করেন,
“আব্বু, আব্বু কেমন লাগছে এখন তোমার?”
অনল কোনো উত্তর দিলো না। উঠে বসল। বিছানা থেকে নামার সময় বাঁধা দেন আজমল আহমেদ।
.

বিছানার ঠিক মধ্যখানে এখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে নিহি। এরমাঝে যে এতকিছু ঘটে গেছে তা কিছুই জানে না সে। আমান নিহির পাশেই কপালে হাত রেখে বসে আছে। চোখ বন্ধ করতেই অনলের কথা মনে পড়ে।
নিহির দিকে কাঁপা কাঁপা হাত তুলে কী করুণস্বরেই না নিহির নামটা বলল! অনলের আর্তনাদ, চোখের পানি বুকের ভেতর যন্ত্রণার বীজ বপন করে দিয়েছে। আমান তার দিকে এগিয়ে যেতেই অনল ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিল। বিড়বিড় করে বলছিল,
“আমায় তুমি ধরবে না। তুমি আমার ভাই না। কী করে পারলে আমার ভালোবাসাকে ছিনিয়ে নিতে?”

‘কী করে পারলে আমার ভালোবাসাকে ছিনিয়ে নিতে’ এতটুকু কথাই যথেষ্ট ছিল আমানের বুকে যন্ত্রণার তীর ছুঁড়ে দিতে। অনলের ভালোবাসা! মানে নিজের ছোট ভাইয়ের ভালোবাসা? আমান আর কিছু ভাবতে পারেনি। চোখের সামনেই মাথায় হাত চেপে ধরা ছোট ভাইয়ের শরীর ফ্লোরে গড়িয়ে পড়ে। সকল ভাবনা-চিন্তা বাদ দিয়ে ভাইকে ধরে তোলে আমান। আবুল আর আমান মিলে অনলকে অন্য ঘরে নিয়ে যায়। বাবা-মাকে ফোন করে আসতে বলে। ফোন রেখে নিজের এক সুট শার্ট-প্যান্ট নিয়ে অনলের জামা-কাপড় পাল্টে দেয়। মাথার কাছে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে চোখের পানি উপচে পড়ে। কত আদরের ছোট ভাই! ছোট থেকে যার কোনো চাহিদা, কোনো চাওয়া-পাওয়া বাবা-মা অপূরণ রাখেনি। এমনকি আমান নিজেও না। বাবা-মায়ের থেকে আমানের কাছেই ছিল অনলের সবচেয়ে বেশি আবদার। মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা। যেদিন অনল প্রথম পৃথিবীর আলো দেখেছিল। তখন আমানের বয়স পাঁচ বছর। হাসপাতালের করিডোরে বাবার সঙ্গে অপেক্ষা করছিল ছোট ভাইয়ের জন্য। অনলের কান্নার শব্দ শুনে ছোট আমান বাবার পাঞ্জাবি খামচে ধরে বলেছিল,
“ও আব্বু আমার ভাই কাঁদে কেন? ওরা কি আমার ভাইকে মেরেছে?”
বাবা সেদিন হেসেছিলেন। আমান দেখেছে, বাবার চোখে অশ্রু ছিল। সেদিন হয়তো এই অশ্রুর মানে বোঝেনি। কিন্তু বড় হওয়ার পর বুঝেছিল। আনন্দের অশ্রু! বাবা আমানকে কোলে নিয়ে আদর করে বলেছিল, “না আব্বু! তোমার ভাই যে দুনিয়াতে এসে পড়েছে তারই জানান দিলো।”

আমানের খুশিরা তখন বাগানের ফুল ফোঁটার মতো সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়েছিল। নার্স যখন অনলকে তোয়ালে দিয়ে প্যাঁচিয়ে বাবার কোলে দিয়েছিল তখন আমান চোখ ভরে দেখেছে ওকে। মুখে একটা আঙুল পুরে চুষছিল। দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য আমানের কাছে সেদিন এটাই ছিল। আমানের এখনো মনে আছে, অনলের ছোট হাতখানা ধরতেই অনল আমানের একটা আঙুল ধরে রেখেছিল। খুশিতে আমান কেঁদেই ফেলেছিল সেদিন।

“ভাইজান, আপামুনি কেমন জানি করতাছে।”
আবুলের ডাকে অতীত থেকে বেরিয়ে আসে আমান। গালে হাত দিয়ে দেখে, অতীত ভাবতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছে বাস্তবেও। আবুলকে অনলের পাশে বসিয়ে সে নিহির কাছে যায়। ঘরে গিয়ে দেখে নিহি ছটফট করছে আর বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বর বেড়েছে অনেক। টুকটুকি আমানকে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। নিহির পাশে বসে তার এক হাত নিজের হাতে নিয়ে মৃদুস্বরে ডাকে,
“নিহু! নিহু! ঠিক আছো তুমি?”
ছটফট করতে করতে এক সময়ে শান্ত হয়ে যায় নিহি। চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে দেয় আমান। বড় করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

তখন ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় আজমল আহমেদ এবং অনামিকা রহমান। বিছানায় নিহিকে দেখে স্তব্ধ হয়ে যান। বাকশক্তি হারিয়ে যায় কিছু সময়ের জন্য। অনামিকা রহমান কোনোরকমে বলেন,
“নিহি এখানে? অনল কোথায়?”
টুকটুকি এসে তাদেরকে অনলের ঘরে নিয়ে যায়। অনলের এমন অবস্থা দেখে অনামিকা রহমান কেঁদে ফেলেন। আজমল আহমেদ ব্যথিত হন। নিহি এখানে, অনলের এই অবস্থা! তিনি হিসেব মেলাতে পারছেন না। ড্রয়িংরুমে আমানকে ডেকে পাঠান। আমান টুকটুকিকে নিহির কাছে রেখে ড্রয়িংরুমে যায়।

ড্রয়িংরুমে গিয়ে বাবার মুখোমুখি দাঁড়ায় মাথা নত করে। আজমল আহমেদ জিজ্ঞেস করেন,
“এসবের মানে কী আমান? ঐ মেয়ে তোমার বাসায় কেন? তাও তোমার বিছানায়!”
“নিহি আমার ওয়াইফ!” আমানের সোজাসাপ্টা উত্তর।
আজমল আহমেদ ভড়কে যান। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর বলেন,
“তুমি কি আমার সাথে মজা করছো?”
“মজা নয় আব্বু। সত্যিই বলছি।”
“কীভাবে সম্ভব আমান? ঐ মেয়েকে তো অনল ভালোবাসে!”

আমান এবার চোখ তুলে তাকায় বাবার দিকে। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। তিনি সব খুলে বলেন আমানকে। সব শুনে আমান ব্যথিত ও অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে। নিহি কেন আগে এসব বলেনি? আমান এবার সোফায় বসে পড়ে। ঝাপসা দৃষ্টিতে এদিক, সেদিক তাকাচ্ছে। চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন অনামিকা রহমান। অনল নিহিকে ভালোবাসে? কেন জানায়নি তাকে! আমানের সঙ্গে নিহির বিয়ের কথা সবটা খুলে বলে আমান। কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না কেউ। আজমল আহমেদের অজানা কারণে রাগ হলো। তিনি প্রায় চেঁচিয়েই আমানকে বললেন,
“মানলাম ঐ মেয়ে তোমার বিয়ে করা বউ। তাই বলে তুমি কেমন মানুষ আমান? অনল তোমার ভাই হয়। নিজের ভাই! এরকম অসুস্থ ভাইকে রেখে তুমি ঐ মেয়ের পাশে গিয়ে বসে আছো?”

আমান অবাক হয়। বাবা ঠিক কোন কারণে রাগ দেখাচ্ছেন তা সে বুঝতে পারছে না। তবুও উত্তরে বলে,
“আব্বু নিহিও অসুস্থ!”
“অসুস্থ? অনলের চেয়েও নিশ্চয়ই বেশি নয়! ঐ মেয়ের পরিবার কোথায়? তারা কি সব জানেন?”
“জানে।”
“বাহ্! একটাবারও ছেলের পরিবারকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি?”
“আব্বু এটা উত্তেজিত হওয়ার সময় নয়। মাথা ঠান্ডা করো।”
“তুমি কীভাবে এসব বলছো আমান? মানে আমি বুঝতে পারছি না! তুমি আমার ছেলে আমান তো? নাকি বিয়ে করে চেঞ্জ হয়ে গেছ?”

আমান কিছু বলার আগে টুকটুকি ড্রয়িংরুমে আসে। নিহি আবারও ছটফট করছে জানায়। আমান বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
“পরে কথা বলছি।”
তারপর ছুটে চলে যায় রুমে। আজমল আহমেদ অবাক হয়ে ওর যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকেন। এত পরিবর্তন!
_________________

নিহির এক হাত আমানের হাতের মুঠোয় ছিল। কেউ একজন হেঁচকা টানে নিহির হাত সরিয়ে নেয়। তখনই আমান চোখ মেলে তাকায়। সামনে অনল দাঁড়িয়ে। ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমানের দিকে।
“নিহি তোমার হতে পারে না ভাইয়া! নিহি আমার।”
অনলের পেছনে পেছনে বাকি সবাই এসেছে। আমান কী করবে বুঝতে পারছে না। অনল নিহির দিকে হাত বাড়ায়। আমান তার হাত ধরে ফেলে। বলে,
“নিহু অসুস্থ!”
“আমি ওর সঙ্গে কথা বলব। আর সেটা এখনই।” চেঁচিয়ে বলল অনল।

চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে নিহির ঘুম ভেঙে যায়। আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকায়। ঘরে এত মানুষকে দেখে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। অনল আবারও পাগলের মতো শুরু করে। নিহির হাত শক্ত করে ধরে বলে,
“নিহি সবাই বলে তুমি নাকি আমার ভাইয়ের বউ। ওরা মিথ্যা বলছে তাই না? এই নিহি তুমি কী করে পারো আমায় এত কষ্ট দিতে? তুমি তো এত নিষ্ঠুর নও নিহি। কিছু বলো প্লিজ! চুপ করে থেকো না।”

নিহির বুকের ভেতর উথালপাতাল ঢেউ বয়ে চলেছে। যেটা বাহির থেকে দেখা যাচ্ছে না। অনলের এমন পরিণতি নিহিকে কেন পোড়াচ্ছে? এখনো কি তবে ওর জন্য মনের কোথাও কোনো অনুভূতি আছে? নাকি করুণা! অনল উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে আছে। আমান তাকিয়ে আছে নিহির দিকে। নিহি অনলের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। খুব শান্ত কণ্ঠে বলে,
“আমার হাত ছাড়ুন। আমার হাত ধরার কোনো অধিকার নেই আপনার।”

অনল স্তব্ধ হয়। এক পলকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু হাত ছাড়ে না। নিহি আবার বলে,
“কেউ কোনো মিথ্যে বলেনি। ঠিকই শুনেছেন আপনি। আমি মিসেস আমান। আপনার ভাইয়ের বউ!”
নিহির হাতটা বিছানার ওপর পড়ে যায়। অনল বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে। পিছিয়ে গিয়ে ড্রেসিংটেবিলের ওপর থেকে পারফিউমের বোতল নিয়ে সজোরে ছুঁড়ে মারে আয়নার মধ্যে। আয়না ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। চেয়ার-টেবিল সব ছুঁড়ে ফেলে দেয়। আজমল আহমেদ, সাকিব, মিলন অনলকে থামানোর চেষ্টা করে। অনলের গায়ে যেন অসুরের শক্তি ভর করেছে। সবাইকে ঠেলেঠুলে সরিয়ে দিচ্ছে। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলছে,
“এটা কেমন করে হতে পারে? কেন হবে আমার সাথে এমন? তুই কেন আমার হবি না? আমি তোকে সহ্য করতে পারব না। অন্য কারো সঙ্গে আমি তোকে সহ্য করতে পারব না। তোর আল্লাহ্ কি তোর একার? সে কেন আমার ডাক শুনলো না? বল কেন?” নিহির দিকে তেড়ে যেতে যেতে বলল অনল।
ওকে জড়িয়ে ধরে আটকে রেখেছে মিলন আর সাকিব। অনল নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে আর বলছে,
“আমি নিজেকে শেষ করে দেবো রে নিহি। তুই যদি আমার না হস! আর নয়তো তোর আল্লাহ্কে বল আমায় মৃত্যু দিতে। প্রকৃতি এত কঠিন প্রতিশোধ কেন নিবে বল? কেন নিবে? এর চাইতে প্রকৃতি আমায় মৃত্যু দিতে পারল না?”

নিহি কাঁদছে। চোখ থেকে বিরতিহীন পানি পড়ছে। অনল নিজের বুকের ওপর চাপড় দিতে দিতে বলে,
“তুই কি আমার কষ্টটা বুঝতে পারছিস নিহি? বুঝতে পারছিস আমার বুকের ভেতর দহন? বুকটা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে রে। তোর সঙ্গে আজ যখন দেখা হয়, তখন আমি ধরেই নিয়েছিলাম আল্লাহ্ আমার দোয়া কবুল করেছে। তোকে ফিরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ভুল! তুই তো তখনকার কথা না,এখনকার কথা মিন করেছিলি। তুই চেয়েছিল, ভাইয়ের সঙ্গেই আমি তোকে দেখি। তুই বলেছিলি, পরের আঘাতটা বুকে করবি। এটাই সেই আঘাত ছিল নারে? তুই তো আমায় জীবন্ত লাশ বানিয়ে দিলি!”

অনলের কান্নার পরিমাণ বেড়ে যায়। অনামিকা রহমান মুখে শাড়ির আঁচল গুঁজে কাঁদছেন। আবুল, আর টুকটুকির চোখেও পানি। শান্ত হয়ে আসে অনল। শরীরটা ছেড়ে দিচ্ছে। সাকিবের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে বলে,
“আল্লাহ্! আল্লাহ্ গো, এত কষ্টই যখন দেবে তখন কেন মনে ভালোবাসা সৃষ্টি করেছিল? মন ভাঙার এত করুণ শাস্তি কেন গো আল্লাহ্!”

এবার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে অনল। ঢলে পড়ে নিচের দিকে। সাকিব আর মিলন সামলে নেয়। সবাই মিলে ধরাধরি করে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য বের হয়। আজমল আহমেদ আমানকে বলেন,
“তুই হাসপাতালে আসিস না। তোকে দেখলে আবারও পাগলামি শুরু করবে।”
“আমি ওর সামনে যাব না। বাইরে থাকব।”
“তবুও আমি চাই না তুই আসিস!”

আমান দাঁড়িয়ে রইল বাইরে। অনলকে নিয়ে ওরা হাসপাতালে চলে গেল। মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বুঝতে পারছে না এই মুহূর্তে কে সবচেয়ে বেশি অসহায়? অনল, নিহি নাকি নিজে! আমান বাড়ির ভেতর যায়। নিহি সেখানেই বসে আছে। গালে চোখের পানি শুকিয়ে লেগে আছে। শান্ত হয়ে বসে আছে। নিহির সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর জিজ্ঞেস করে,
“আমায় আগে কেন বলোনি এসব?”
নিহি মাথা তুলে তাকায় না। বিছানার দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করে রাখে। আমান আবার বলে,
“আমার দিকে তাকাও। আর উত্তর দাও।”

টলমল অশ্রুশিক্ত নয়নে নিহি আমানের চোখের দিকে তাকায়।উত্তরে বলে,
“আজকের দিনটা দেখার জন্য। আমি দেখতে চেয়েছিলাম অতীতটা নিজ থেকে জানার পর আপনি কী করেন! আমায় ছেড়ে যান নাকি রেখে দেন।”

আমানের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসে। রুদ্ধশ্বাস স্বরে বলে,
“নিজেকে অনেক নিরুপায় মনে হচ্ছে আমার নিহু। এত অসহায় কি শুধু আমিই? একদিকে আমার ছোট ভাইয়ের ভালোবাসা তুমি, আর অন্যদিকে আমার ভালোবাসা তুমি। অনলের ভালোবাসাকে আমি নিতে পারি না, অন্যদিকে তোমাকেও আমি ছাড়তে পারব না। প্রকৃতি কি শুধু কঠিন প্রতিশোধই নিলো? নাকি তিনটে জীবনকে আটকে দিল এক গোলকধাঁধায়! অনলের কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছি না নিহু। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি না আমার কী করা উচিত। কী করব আমি! আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতেও পারব না। ভাইকেও কষ্ট দিতে পারব না।”

“কষ্ট যেকোনো একজনকে পেতেই হবে। হোক সেটা আমাকে বা অনলকে! আপনি আমায় ছেড়ে দিলে হয়তো আমার কষ্ট হবে ঠিক! তাই বলে ভাববেন না, আমি অনলের কাছে কখনো ফিরে যাব। আপনার পথ থেকে আমি সরে দাঁড়াবো।”

আমান এক পলকে নিহির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর নিহির দু’হাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। হাতের দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখে বলে,
“বিয়ের দ্বিতীয় দিন বলেছিলাম, ‘আপনি থেকে যান। আমি রেখে দেবো।’ আপনি আমায় ছেড়ে যাননি। থেকে গেছেন। আমিও আপনাকে ছাড়ব না। সারাজীবন নিজের কাছে রেখে দেবো।”

চলবে…

#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_৩৯
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________

দিগন্তের ছোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। কারো জীবন রঙে রাঙানো তো কারো জীবন সাদা-কালোয় আচ্ছন্ন। কারো হৃদয় ব্যথায় জর্জিত। নিজের ভুলের জন্য কষ্ট পেতে হচ্ছে মর্মে মর্মে। এজন্যই বোধ হয় বলে ‘সময় গেলে, হয় না সাধন।’ তাই তো সময় থাকতেই সাধন করা উচিত। তিনটে জীবন এখন সম্পর্কের টানাপোড়নে আটকে আছে। একজন ভুলের মাশুল সইতে পারছে না, একজনের মন দোনোমোনো অবস্থায় স্থিত তো আরেকজনের পিছুটান না থেকেও কিছু পিছু টানছে৷ হ্যাঁ, ঠিকই ভেবেছেন৷ আমি অনল, আমান এবং নিহির কথাই বলছি।

গতদিন ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনাটা লুকানো হয়েছে নিহির পরিবার থেকে৷ এমনকি মিহি আর সৈকতের থেকেও। সামনে যে বড়ো ঝড় আসতে চলেছে তার আভাস পাচ্ছে দুজনই। আপাতত এখন তার পরিবার জানলে ঝামেলা দ্বিগুন বেড়ে যাবে। সারারাত ধরে ঘুমাতে পারেনি নিহি। শুধু নিহির কথাই বা বলছি কেন! ঘুম আসেনি আমানেরও। সারাটা রাত ছটফট করেছে। একটু পরপর অনামিকা রহমানকে ফোন দিয়ে অনলের খবর নিয়েছে। সকাল হতেই আমান চলে গেছে হাসপাতালে। তরু চিন্তিত মুখে বসে আছে। নিহি কাপড় গোছাচ্ছে। বাবার বাড়ি চলে যাবে আজ। আর তার পরেরদিন সোজা সিলেটে। এখানে থাকলে দেখা যাবে কোনো না কোনোভাবে বাবার কানে এসব কথা চলেও যেতে পারে। তারচেয়ে ভালো দূরেই থাকুক! ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে নিহি। বুক থেকে ভার নামানোর চেষ্টা করে। ব্যাগ গোছানো শেষ হলে নিহি বলে,
“তুই ব্যাগ গুছিয়েছিস?”
“হুম।” আনমনে উত্তর দেয় তরু।
নিহি ওর গায়ে ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“এত কী ভাবছিস?”
তরু লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,
“তোর কথাই ভাবছি৷ সামনে যে তোর জন্য কী অপেক্ষা করছে! আমি বুঝি না সব সমস্যা কি তোর জীবনেই?”
“জানিনা রে। আল্লাহ্ হয়তো কোনো পরীক্ষা নিচ্ছেন।”
“একটা কথা বলি নিহি?”
“বল।”
“রাগ করিস না! তোর মুখে অনলের করা পাগলামির কথা শুনে আমার খুব খারাপ লাগছে। তোদের তিনজনের জন্যই মনটা অস্থির হয়ে আছে।”
“কিছু বলার নেই আমার!”

মিহি মাহিরকে নিয়ে ঘরে আসে। নিহিকে দেখে মাহির ঝাঁপিয়ে ওর কোলে যায়। সে মাহিরকে কোলে নিয়ে চুমু খায়। মিহি জিজ্ঞেস করে,
“সত্যিই চলে যাবি আজ?”
মাহিরকে কোলে নিয়ে দোলাতে দোলাতে নিহি উত্তর দেয়,
“হুম আপুই৷ জানোই তো পরীক্ষার আর বেশি দেরি নেই৷ পড়তে হবে তো!”
“তাই বলে আর দু’দিন থাকবি না?”
“পরীক্ষা শেষ হোক। আবার আসব। এরমাঝে পারলে তুমি দুলাভাইকে নিয়ে যেও।”
“তোর দুলাভাইর কি আর ছুটি আছে? তুই কিন্তু পরীক্ষার পর আসবি আবার।”
“আচ্ছা আসব।”

মিহি নিহির কাছে এগিয়ে গিয়ে কপালে হাত রেখে বলে,
“দেখি তো, জ্বর আছে নাকি!”
কপালে ভালো করে হাত চেপে রেখে বলে,
“এখনো তো জ্বর আছে রে নিহি!”
“ও কিছু না। সেরে যাবে।”
“তোর তো কিছুই না। ফাঁকিবাজি শুধু৷ সকালে ওষুধ খাসনি না?”
“উঁহু। উনি খাইয়ে দিয়ে গেছে।”

মিহি মুচকি হাসে। হাসতে হাসতে বলে,
“ভাগ্য করে একটা স্বামী পেয়েছিস।”
“এটা সত্য।” তৃপ্তির হাসি হেসে বলে নিহি।
______________________

অনল উন্মাদের মতো করছে আর বলছে, “আমি নিহিকে চাই। ওকে আমার কাছে এনে দাও। আমি নিহিকে চাই, চাই, চাই!”

অনলের মানসিক অবস্থা ভালো না। কাল থেকে পাগলামি করে যাচ্ছে। শারীরিক অবস্থা ভালো না হওয়া পর্যন্ত সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নেওয়া যাচ্ছে না৷ শারিরীক অবস্থা কিছুটা ডেভেলপ হলে তারপর সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাবে। হাসপাতালের ডাক্তারও এটাই সাজেস্ট করল৷ অনামিকা রহমানের চোখের পানি বাঁধ মানে না। অনলের শারিরীক অসুস্থতায় যতটা না কষ্ট হচ্ছে তারচেয়েও বেশি কষ্ট হচ্ছে ওর মানসিক অসুস্থতায়। তার কী ছেলে কী হয়ে গেল! সামনে কেউ যেতেই পারছে না৷ যাকে পাচ্ছে তার কাছেই বলছে,নিহিকে দেখবে। হাসপাতালের করিডোরে কপালে হাত রেখে বসে আছেন আজমল আহমেদ। পাশেই অনামিকা রহমান কাঁদছেন আর চোখের পানি মুছছেন। ডাক্তার কেবিন থেকে বের হয়ে তাদের চিন্তিত ভঙ্গিতে বলেন,
“পেশেন্ট যার কথা বলছেন, যাকে দেখতে চাচ্ছেন আপনারা নিশ্চয়ই তাকে চিনেন?”
আজমল আহমেদ একবার আমানের দিকে তাকালেন। তারপর গম্ভীরমুখে বললেন,
“হুম।”
“আমার মনে হয় তাকে একবার এখানে আনা উচিত৷ এভাবে তো বারবার ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে রাখা যাবে না। শরীর আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে। সে যদি আসে, একটু কথা বলে তাহলে হয়তো একটু উন্নতি হতে পারে।”
আজমল আহমেদের উত্তরের অপেক্ষা না করে আমান বলে,
“ঠিকাছে। আমি নিহিকে নিয়ে আসছি।”
“ধন্যবাদ।” বলে ডাক্তার চলে যায়। আজমল আহমেদের চাহনী অবাকময়। আমান আর দেরি না করে বেরিয়ে পড়ে।
.
.
নিহি আর তরু আমানের বাড়িতে এসেছে আবুল আর টুকটুকির সঙ্গে দেখা করতে। ওরা দুজন তখন ঘরের ভাঙা আয়নার টুকরো পরিষ্কার করছিল। নিহিকে দেখতে পেয়ে ব্যস্ত হয়ে বলে,
“আপাজান আপনে অসুস্থ শরীর নিয়া কষ্ট কইরা আইছেন ক্যান? আমরাই একটু পর যাইতাম।”
“আমি এখন অনেকটাই সুস্থ টুকটুকি আপা। আজ চলে যাব। তাই তোমাদের সাথে দেখা করতে এসেছি।”
ওদের মন খারাপ হয়ে যায়। আবুল প্রশ্ন করে,
“আবার কবে আইবেন আপামুনি?”
“দেখি!”

নিহির ফোন বেজে ওঠে। আমান ফোন করেছে। ফোন রিসিভ করতেই আমান বলে,
“কোথায় আছো?”
“আপনার বাসায়। কেন?”
“আচ্ছা। থাকো আমি আসছি। বাড়ির সামনেই আছি।”
“আচ্ছা।”
কিছু সময়ের মধ্যেই আমান ওপরে চলে আসে। নিহিকে রেডি দেখে বলে,
“কোথাও যাবে তুমি?”
“বাড়ি যাব।”
“মানে? কেন?”
“কাল রাতে বললাম তো সব!”
আমান একটু চুপ করে থাকে। তারপর আবার বলে,
“আচ্ছা এটা নিয়ে পরে কথা বলছি৷ এখন চলো।”
“কোথায়?”
“হাসপাতালে।”
“কেন?”
আমান এবার একটু ইতস্তত করে বলে,
“অনল তোমায় দেখার জন্য পাগলামি করছে। ডাক্তার তোমায় নিয়ে যেতে বলেছে।”

উপস্থিত সকলে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। অবাক হয় নিহি নিজেও। কোন পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছে মানুষটা সবাই বুঝতে পারছে। মানুষটার কষ্ট নিহি বুঝতে পারে। এমন একজন মানুষের জন্য নিহিকে নিয়ে যাচ্ছে যে ব্যক্তি তারই ভালোবাসার মানুষটিকে কেড়ে নিতে চায়, আবার সে ভাইও হয়! দোটানায় যে পড়ে সে বোঝে কষ্টের মর্ম৷ নিহি আমানকে আর কষ্ট দিতে চাইলো না৷ কোনো প্রশ্নের সম্মুখীনও করল না আর। তরুর দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই মিহি আপুর বাসায় অপেক্ষা কর। হাসপাতাল থেকে এসেই বাসায় যাব।”

তরু মাথা নাড়ালো। আমানের দিকে তাকিয়ে নিহি বলল,
“চলুন।”
সারা রাস্তা কেউ আর কোনো কথা বলল না৷ চুপচাপ কেটে যায় অনেকটা সময়। আমানের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ অবিন্যস্তভাবে হচ্ছে। বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে। তবুও যে কিছু করার নেই। ভিউ মিররের দিকে তাকিয়ে লুকিয়ে দীর্ঘশ্বাস নিলো আমান। নিহি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।

হাসপাতালে গিয়ে নিহিকে অস্বস্তিতে পড়তে হলো৷ আজমল আহমেদের রাগী, গম্ভীর মুখের আদল। অনামিকা রহমান তাকাননি। অনলের বন্ধুরাও আছে। কারো কারো চোখে ক্রোধ, রাগ, আবার কারো চোখে খুশি! ভেতরে ভেতরে ঘাবড়ে যাচ্ছে সে। এখনো অনলের এক্সিডেন্টের জন্য নিজেকেই দায়ী মনে হয়। আমান পেছন থেকে এসে নিহির হাত চেপে ধরে। নিহি আমানের দিকে তাকাতেই সে বলে,
“চলো।”

ভরসা খুঁজে পায় নিহি। ধরে রাখা হাতটির দিকে তাকিয়ে হাঁটা শুরু করে। কেবিনের দরজার সামনে এসে দুজনে থেমে যায়। ডাক্তার বেরিয়ে এসে বলেন,
“আপনারা সবাই বাইরেই থাকুন। আর উনিই কি নিহি?” নিহিকে উদ্দেশ্য করে আমানকে জিজ্ঞেস করলেন।
আমান মাথা নাড়লো। নিহির হাত ছাড়তে গিয়েও ছাড়তে পারছে না। হাত কাঁপছে। মনের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে হাত ছাড়ল। বলল,
“আমি এখানেই আছি৷ তুমি ভেতরে যাও।”

নিহি আর ফিরে তাকালো না। ভেতরে গেল। সঙ্গে ডাক্তারও। অনল বেডে বসে আছে। নার্সকে নিহির কথা জিজ্ঞেস করছে। ডাক্তার তখন বলেন,
“এইযে নিহি এসে পড়েছে।”
অনলের চোখেমুখে খুশিরা উপচে পড়ে। ডাক্তার আর নার্সকে বেরিয়ে যেতে বলে অনল। নিহি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। তারা বেরিয়ে যেতেই অনল খুশি খুশি মুখে বলে,
“দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো বসো।”
টুল আনার জন্য অনল নিচে নামতেই নিহি বাঁধা দিয়ে বলে,
“আপনার উঠতে হবে না। আপনি বসুন। আমি নিয়ে নিচ্ছি।”

তারপর টুলটা এগিয়ে নিয়ে সেখানে বসলো নিহি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অনলকে পর্যবেক্ষণ করছে৷ খুশি খুশি মুখটায় কষ্টেরও ছাপ দেখতে পাচ্ছে। অনল কিছুক্ষণ এক ধ্যানে নিহির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকে পেয়ে শান্ত হয়। তারপর হঠাই-ই ব্যস্ত হয়ে বলে,
“তুমি এসেছ নিহি? আমি জানতাম তুমি আসবে। তুমি তো আমায় এখনো ভালোবাসো তাই না? আমি জানি, তুমি আমায় এত শাস্তি দিতে পারবে না।”

নিহি কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে অনলের দিকে তাকিয়ে থাকে। সারাটা রাস্তায় অনেককিছু ভেবেছে আসতে আসতে। আমানের মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তারপর বলে,

“আপনি বারবার কেন বলেন আমি আপনাকে শাস্তি দিয়েছি? কী করে আমি আপনাকে শাস্তি দিলাম? যেই শাস্তিগুলো আপনি পাচ্ছেন তাতে কি আমার কোনো হাত আছে? নেই তো! সব হচ্ছে আল্লাহ্ তায়ালার হুকুমে। আমি তো আপনার ওপর কোনো প্রতিশোধ নিতে চাইনি। আর নিইও নি। আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিলেও প্রকৃতি কি আপনাকে ক্ষমা করত? এই শাস্তি কি আপনার প্রাপ্য ছিল না? কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি চাইনি ভালোবাসার আসল মর্ম আপনি আমার জন্যই বুঝুন। কিন্তু আল্লাহ্-র ইচ্ছে বোধ হয় এটাই ছিল। আজকে আপনার সীমাহীন কষ্ট হচ্ছে। আপনি আমায় দোষারোপ করছেন। কিন্তু সেদিন! মনে পড়ে সেদিনের কথা? যেদিন পুরো কলেজের সামনে আপনি আমায় অপমান করেছিলেন? যেখানে আমি নিজের কথা না ভেবে, আব্বুর সামনে বলে দিয়েছিলাম আমি আপনাকে ভালোবাসি! আর সেদিন আপনি! আপনি প্রত্যাখান করেছেন আমার ভালোবাসাকে। অপমান করেছেন সকলের সামনে। আমি চাইলেই পারতাম, সেদিন সব সত্যিটা সবাইকে বলে দিতে। আমি তো আপনাকে জড়িয়ে ধরিনি। জড়িয়ে ধরেছিলেন আপনি! আর আমি যদি সত্যিটা বলতাম তাহলে যথেষ্ট প্রমাণও সঙ্গে দিতে পারতাম। আপনি যে আমার পেছন পেছন ঘুরতেন এটা পুরো কলেজ জানতো। তাই প্রমাণ করতে আমার খুব একটা অসুবিধা হতো না। কিন্তু আমি সেটা করিনি। আমি ফিল করেছিলাম, আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা। আর তাই আমি পারিনি আপনাকে কারো কাছে অপমান করতে, ছোট করতে। বিশ্বাস করুন, আব্বুর সামনে ভালোবাসার কথা স্বীকার করতেও আমার বুক ততটা কাঁপেনি যতটা কেঁপেছিল আপনার অস্বীকারোক্তি শুনে। কী অবললীয় আপনি সেদিন বলে দিয়েছিলেন, আপনি আমায় ভালোবাসেন না। আপনি বুঝতে পারছেন আমার মান-সম্মান, আমার ভালোবাসা সেদিন কতটা অপমানিত হয়েছিল? আপনি বুঝতে পেরেছিলেন, সেদিন আমার কষ্টটা? আপনার ঠোঁটে ছিল সেদিন বিশ্বজয় করার মতো হাসি। কারণ আপনি আপনার উদ্দেশ্যে সাক্সেস হয়েছিলেন। আমি সেদিন নিজের মাঝে ছিলাম না অনল!”

একটু থামল নিহি। গলা ধরে আসছে। চোখে পানি টলমল করছে। নিচের ঠোঁট কামড়ে সে আবার বলে,
“এরপরও আমি আপনার কাছে ফিরে যেতে চেয়েছিলাম। সেদিনও আপনি কলেজে সবার সামনে আমায় অপমান করেছেন। আমার পরিবারের কারো সামনে আমি দাঁড়াতে পারিনি। সকলের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছিলাম। আমার আব্বু! আমার আব্বু আমার সঙ্গে কথা বলা তো দূরে থাক, আমার মুখের দিকে তাকাতোও না পর্যন্ত!”

নিহি এবার শব্দ করে কেঁদে ফেলে। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে বলে,
“না বাড়িতে আমি শান্তি পেতাম, আর না কলেজে। কলেজে আমায় দেখলেই কানাঘুষা শুরু হতো। বাজে বাজে মন্তব্য করত সবাই আমায় নিয়ে। আমার চরিত্র নিয়ে আঙুল তুলত সবাই। যেখানে কিছু না করেও আমায় এসব সহ্য করতে হতো সেখানে আমার বেঁচে থাকাটা কত দুরুহ ছিল আপনি বুঝতে পারছেন? তার মধ্যে আপনাকে যখন দেখতাম, আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারতাম না। আমায় দেখে আপনার হাসি-ঠাট্টা, তাচ্ছিল্য আমায় মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিত। সবকিছুর সঙ্গে যখন নিজেকে মানিয়ে নিতে শুরু করলাম, তখন আপনি নতুন গার্লফ্রেন্ড নিয়ে আমার সামনে আসলেন। তাকে দিয়েও কলেজে আমায় অপমান করালেন। আপনি কি বুঝতে পারছেন, সেদিন আমার কতটা কষ্ট হয়েছিল আপনাকে ইরার সঙ্গে দেখে? আমি বাইরে নিজেকে যতটা স্ট্রং দেখাতাম, ভেতরে ভেতরে ঠিক ততটাই ভেঙে গুড়িয়ে যেতাম। এমন রাত ছিল না, আমি না কেঁদেছি। হাসতে কষ্ট হতো আমার। ভালো থাকার অভিনয় করতে আমার কষ্ট হতো। আমি ভালোবাসতাম আপনাকে!”

নিহি এবার বাচ্চাদের মতো শব্দ করে কেঁদে ফেলে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে যায়। অনলের চোখ থেকে নিরবে অশ্রু ঝড়ছে। পুরো ঘরে পিনপতন নিরবতা। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আমান সব শুনছে। তার চোখেও পানি চিকচিক করছে। ক্রন্দনরত স্বরে নিহি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলা শুরু করে,
“আজকে আপনার এই কষ্টের দিনে আপনার পরিবার আপনার পাশে আছে। এমনকি আপনার ভাইও। যিনি আমার স্বামী! আজ এখানে আমায় কে নিয়ে এসেছে জানেন? আপনার ভাই! শুধুমাত্র আপনার কষ্ট কমানোর জন্য। সেদিন কিন্তু আমি পরিবারের সাপোর্ট পাইনি। সকলের চোখের বিষ ছিলাম। আমি কীভাবে তখন নিজেকে সামলিয়েছিলাম আপনি বলতে পারেন? আপনি জানতে চেয়েছিলেন কখনো, আমি কেমন আছি? আপনি বুঝতে চেয়েছিলেন কখনো আমার ভালোবাসা? আর আজ যখন একটা চরম সত্যর মুখোমুখি হয়েছেন, তখন আপনি বলছেন আমি আপনার! মানে সত্যিই? আপনার মুখে বাঁধে না এই কথাটা বলতে? আমি কী বলব আপনাকে বলেন? আপনার এই কষ্ট আমার নিজেরও সহ্য হচ্ছে না। আমার কষ্ট হয় ভীষণ। আমি এত কঠিন শাস্তি তো চাইনি কখনো। আমি এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি যেখানে আপনার কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছি না, আবার এটাও সত্য নিজের থেকেও অনেক বেশি ভালোবাসি আমি আমানকে। ইউ কান্ট ফিল মাই পেইন!”

অনল কাঁদতে কাঁদতে হাসে। এই হাসি বিষাদের! বিষণ্ণতায় আবদ্ধ এই হাসির অর্থ চমৎকারভাবে লুকায়িত। অনল কাঁদছে আবার হাসছে! সেভাই জিজ্ঞেস করে,
“আমায় কি তবে তুমি ভালোবাসো না আর?”
“এই প্রশ্নটা করাও আপনার বেমানান! আপনি আমার অতীত। আমান আমার বর্তমান, আমার ভবিষ্যৎ। আপনার সঙ্গে আমার কিছুই হয়নি। আমি যেদিন ভালোবাসার কথা প্রকাশ করলাম, সেদিন আপনিই আমায় প্রত্যাখান করলেন। হয়তো কোনোকালে কোনো পূণ্য করেছিলাম, যার বিনিময়ে আল্লাহ্ আমানকে আমার জীবনে পাঠিয়ে দিয়েছে। তার ভালোবাসাকে আমি উপেক্ষা করতে পারিনি। অতীত আঁকড়ে ধরা থাকাটা বোকামি। অতীত থেকে আমি শিক্ষা নিয়েছি। হ্যাঁ, আপনি আমার চরম শিক্ষা! তবে আমি জানিনা, আড়ালে-আবডালে আপনার প্রতি আমার সুপ্ত কোনো অনুভূতি এখনো বিদ্যমান আছে কী-না!”
“চলে যাও!”
নিহি অবাক হয়ে তাকায়। অনল এবার ধমক দিয়ে বলে,
“চলে যাও!”
নিহি কিছুক্ষণ মৌন থেকে অনলের দিকে তাকিয়ে থাকে। অনলের চোখ থেকে অশ্রু পড়ছে গাল বেয়ে। ঠোঁট কামড়ে ধরে বুকের ওপর হাত রেখে অনল নরমস্বরে বলে,
“চলে যাও নিহি। চলে যাও! বুকের ভেতর অসহনীয় কষ্ট হচ্ছে। আগুনের শিখা দাউদাউ করে জ্বলছে। তুমি সেদিন বলেছিলে না, আমার নাম রাখাটা আমার জন্য স্বার্থক হয়েছে? আজ আমিও বলছি নিহি, নামের মতোই ভালোবাসার অনলে আজ এই অনলও জ্বলেপুড়ে মরছে। একটাবার বিশ্বাস করো, আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি এখন!”
“মেরে ফেলুন! ভালোবাসার ডালপালা ছড়ানোর আগেই মেরে ফেলুন এই ভালোবাসাকে। যত আমার জন্য ভালোবাসা মনের মাঝে পুষে রাখবেন, ততই আপনি কষ্ট পাবেন। আমি বলেছিলাম,আমি কখনো আপনাকে ক্ষমা করব না। কিন্তু আমি পারলাম না আমার কথা রাখতে! আপনার কষ্টে কেন জানিনা বুক ভারী হয়ে আসছে। আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিলাম। আর আল্লাহ্-র কাছে চাইব, অন্য কাউকে নিয়ে আপনি সুখী হন।”
“আমার চোখের সামনে থেকে যাও তুমি।” চেঁচিয়ে বলল অনল। নিহিকে আঘাত করতে গিয়েও থেমে যায়। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দেয়ালে ঘুষি দিতে শুরু করে। নিহি মুখের ওপর হাত রেখে চিৎকার দিয়ে ওঠে। বাহির থেকে আমান এবং ডাক্তাররা তখন দৌঁড়ে কেবিনে আসে।

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]