এই মনের আঙিনায় পর্ব-০৩

0
334

#এই_মনের_আঙিনায়[৩]
#কুরআতুল_আয়েন

আদুরী অনেকটা’ই সুস্থ।পা’য়ের ব্যথা সারতে কমপক্ষে দু’দিন লেগেছে।এই দু’দিনে আদুরীর অবস্থা দফারফা!রাহেলা খাতুন উঠতে বসতে কথা শুনিয়েছেন।সাথে বড়আপাও ছিলো।গতকালই সুহানা আর ঈশিতা নানুবাড়িতে পদধূলি দিয়েছে ফারিহার বিয়ের জন্য।আদুরীর যেনো খুশীর সীমানা নেই।বড়আপার বকা গুলোও হজম করে নিয়েছে।আদুরী সবেমাত্র গোসল করে এসেছে।বাড়ির পেছনের কলপাড় থেকে বোন’দের সাথে আজকে গোসল করেছে।এখন সুহানা গোসল করতে যাওয়ায় সুবহান’কে রাখার দায়িত্ব’টা আদুরীর উপরই পড়েছে।সুবহান ছোট ছোট হাত গুলো দিয়ে আদুরীর চুল টেনে ধরলো।আদুরী ছাড়িয়ে নিতেই কেঁদে উঠলো।ঈশিতা পাশেই বসে ছিলো।ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত!সুবহান কান্না করে উঠায় ঈশিতা আদুরী’কে তৎক্ষণাৎ বললো,

‘আদু!সুবহান’কে নিয়ে উঠোন থেকে ঘুরে নিয়ে আয়।দেখছিস না কান্না করছে।’

আদুরী অনুকূল মতামত জানিয়ে উঠে দাঁড়ালো।আদুরী যেতেই ঈশিতা পুনরায় কথা বলায় মগ্ন হলো।রায়হানের সাথে ঈশিতার সম্পর্ক কয়েকমা’সের বলা চলে!এই কয়েকমাসে দু’জন যেনো দু’জনের অনেকটাই আপন হয়ে গিয়েছে।ভালোবাসার এই অদ্ভুত মায়াজালে দু’জন একে অপরের সাথে বেশ সুখেই আছে!

আদুরী সুবহান’কে নিয়ে এসে উঠোনে দাঁড়ালো।চোখ পড়লো উঠোনের কোণার দিকে।ফারাজ,শাওন,সীমান্ত আর সজীব গোল হয়ে বসে আছে।হয়তো কিছু নিয়ে কথা বলছে।আদুরী আড়চোখে ফারাজের দিকে একবার তাকালো।চুলগুলো রুক্ষ আর অবিন্যস্ত হয়ে আছে।কালো টি-শার্ট’টা গা’য়ে জড়িয়ে থাকায় অন্যরকম এক আকর্ষণীয় লাগছে।আদুরী চোখ নামিয়ে নিলো।সেদিকে আর না তাকিয়ে সুবহানের প্রতি নজর দিলো।সুবহান এখন হাসছে!ছোট ছোট হাত গুলো নাড়িয়ে চারপাশ দেখাচ্ছে!সুবহানের কাণ্ডকীর্তি আদুরীকে বড্ড আনন্দ দেয়।এই যে এখনো তার ব্যতিক্রম ঘটে নি!

আদুরী’কে দেখে শাওন গোল বৈঠক ছেড়ে উঠে আসলো।আদুরী’র কাছে এসে দাঁড়াতেই ঠোঁট দুটো প্রসারিত হয়ে গেলো।এমতাবস্থায় বললো,

‘আদুরী!পা’য়ের ব্যথা পুরোটাই সেরেছে তো!’

আদুরী সুবহান’কে নিয়ে ব্যস্ত ছিলো।শাওনের গলা পেতেই সুবহানের থেকে চোখ সরিয়ে শাওনের দিকে তাকালো।কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বললো,

‘হ্যাঁ ভাইয়া!পুরোটাই কমেছে।’

‘রোদের মধ্যে এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো।ভেতরে যাও।’

‘সুবহান অনেক কান্না করছিলো তো!তাই একটু হাঁটাহাঁটি করছি।’

‘তাহলে আমাদের সাথে ছায়ায় এসে বসো।ওখানে আরো চেয়ার রয়েছে।’

শাওনের কথার পরিপ্রেক্ষিতে আদুরী কিছু বললো না।তবে,ওখানে সবার সাথে বসা মানে নিজের দমবন্ধ হয়ে আসা।তার একমাত্র কারণ ফারাজ!ফারাজের উপস্থিতি আদুরীকে বেসামাল করে তোলে!শুধু কি তাই!ফারাজের চাহনি যেনো আদুরীর হৃদয়’কে আলোড়ন করতে ব্যস্ত।যাকে বলে তুমুল আন্দোলন তল্লাস!
শাওন পুনরায় শুধালো,

‘চলো যাই।’

আদুরী আমতাআমতা করে জবাবে বললো,

‘না ভাইয়া!আমি এখন ঘরে চলে যাবো।সুবহান’কে খাওয়াতে হবে।বড়আপার গোসল হয়তো শেষের দিকে।’

‘তাহলে চলে যাবে!আচ্ছা যাও।তবে রোদে এতো বাহিরে ঘুরাঘুরি না করাই ভালো।’

আদুরীর চোখ পড়লো ফারাজের দিকে।ফারাজ মাথা ঘুরিয়ে এদিকটা’য় তাকিয়ে আছে।ভ্রুকুটি কুঁচকানো।যেনো দফারফা করে ছাড়বে!আদুরীর আর শাওনের কথার প্রত্যুত্তর করা হলো না।সুবহান’কে নিয়ে যেনো ছুটে পালালো।

সীমান্ত অনেকক্ষণ ধরে পর্যবেক্ষণ করছে ফারাজ’কে।ফারাজের চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি কার উপর গিয়ে সীমাবদ্ধ হয়েছে তা বুঝতে তেমন একটা বেগ পেতে হয় নি।কিন্তু এটার সত্যতা কতটুকু তা নিয়ে সীমান্ত খুবই চিন্তিত।আদুরী!কাজিনমহলের সবচেয়ে ছোট সদস্য।তেমনি ফারাজ সবচেয়ে বড়।বয়সের দিক দিয়েও তফাৎ বা ফারাক অনেকটাই।কিন্তু ফারাজের দৃষ্টি অন্যকিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে।সীমান্ত একবার সজীবের দিকে তাকালো।ফোনে সেই কখন থেকে পাবজি খেলায় মেতে আছে।আশেপাশের কোনো কিছুতে হুশ নেই বললেই চলে।সীমান্ত এটাকেই যেনো কার্যকরী সময় ভেবে নিলো।কণ্ঠস্বর কৃশ করে বললো,

‘আদুরী’কে নিয়ে তোমার চিন্তাভাবনা কি ভাই!’

ফারাজের সহজ উত্তর,

‘বউ!’

সীমান্ত অবাক হলো।বেশখানিকটাই!কি সহজপটুতা উত্তর!ফারাজ সীমান্তের অবাক হওয়া মুখশ্রীতে চোখ বুলালো।এতে যেনো কোনো ভাবান্তর নেই।সীমান্ত ফোঁস করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো।ফারাজে’র উদ্দেশ্যে পুনরায় বললো,

‘পছন্দ কবে থেকে ভাই!’

‘অনেক আগে থেকেই।’

‘তুমি ছিলেই না বিডি-তে!তাহলে কীভাবে কি!’

‘ছবি দেখেছিলাম।মা একবার সবার ছবি দেখিয়েছিলো।তখনি চোখে লেগেছে।’

‘কিন্তু ভাই!আদুরী তো আমাদের সবার অনেক ছোট।তোমারও তো।ব্যপার’টা সহজ হবে না মনে হচ্ছে।’

‘এইসব ব্যপার কখনো সহজে ঘটতে দেখেছিস।’

‘কিন্তু ভাই!আদুরীর আব্বা যে মানুষ।মনে হয় না খুব সহজে মেনে নিবেন।’

সীমান্তের কথার পিঠে ফারাজ শীতল গলায় বললো,
‘আদুরীর আব্বার জায়গায় তুই থাকলে কি করতিস!তুইও তো কখনো অতি সহজ ভাষায় মেনে নিতিস না।সেই অনেক কায়দা কৌশল করে মানানো হতো।’

সীমান্ত চুপ গেলো।ফারাজের সহজ,নৈসর্গিক কথাগুলো মোটেও মেনে নিতে পারছে না।মনে হাজারো চিন্তা উঁকিঝুঁকি বাইতে লাগলো।না জানি এর শেষ পরিণতি কি হয়!
—-
ফারিহার গা’য়ে হলুদের প্রোগ্রামের জন্য ছাদ’টা সুন্দর করে ডেকোরেশন করা হয়েছে।সাথে বাড়ির আশপাশ’টাও মরিচ বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে।আদুরী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।গাঢ় সবুজ রঙের একটা শাড়ি পড়েছে।ঈশিতা পড়িয়ে দিয়েছে।সাথে হালকা সাজ।সুহানা সুবহান’কে কোলে নিয়ে আদুরীর নিকট এসে দাঁড়ালো।হাতে একটা জুয়েলারী বক্স।আদুরী’কে দেখেই সুবহান হাত দুটো বাড়িয়ে দিলো।আদুরী কোলে নিতে গেলেই সুহানা ধমকে উঠে বললো,

‘বাবু’কে এখন কোলে নিতে হবে না।শাড়ি নষ্ট করে ফেলবে।এখন কোলে বসালেই মুচড়ে মুচড়ে শাড়ি নষ্ট করে দিবে।তাতেও তো থেমে থাকবে না খামচি দিয়ে সাজও নষ্ট করে দিবে।তোর কোলে নিতে হবে না,বাবু’কে আমি বিছানায় বসিয়ে রাখছি।তুই চুপ করে বস!’

আদুরী মাথা নাড়ালো।বড়আপার কথাতে দ্বিমত পোষণ করলো না।সুবহান মুখে হাত দিয়ে পাশে বসে আছে।গোল গোল চোখ দিয়ে সুহানা আর আদুরী’কে দেখছে।সুহানা জুয়েলারী বক্স থেকে সবুজ রঙের পাথরের একটা মালা,আর কানের দুল বের করে আদুরী’কে পড়িয়ে দিলো।আদুরী’কে পরখ করে দেখে পুনরায় বললো,

‘চুল গুলো এতো ছোট করেছিস এখন তো একটা খোঁপাও ভালোমতোন হবে না।শাড়ির সাথে খোঁপার কম্বিনেশন’টা মারাত্মক ভাবে যায়।এখন কি করবি এই চুল নিয়ে।বেঁধে রাখবি নাকি ছেড়ে রাখবি।’

‘বড়আপা ছেড়েই রাখি।’

‘দাঁড়া!তাহলে তোর চুল’টা ভালোমতোন চিরুনি করে দেই।আর হাতে একটা কাটা ব্যান্ড রাখিস।গরম লাগলে বেঁধে ফেলবি।আর ঈশু কই রে!’

‘মেঝোআপা সাজছে!’

সুহানা সুন্দর করে আদুরী’কে তৈরি করে দিলো।উপরনিচ একবার তাকিয়ে দেখে নিলো কোনো কিছুর কমতি রয়েছে কিনা!পরমুহূর্তেই,সুহানা আদুরীর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

‘আদু!তুই একটু সুবহান’কে দেখে রাখিস আমি আসছি।আর ঘর থেকে এখনেই বের হবি না।’

আদুরী সম্মতি দিয়ে বললো,
‘ঠিকাছে বড়আপা!’

সুহানা অনেকক্ষণ হয়েছে ঘরে থেকে বেরিয়েছে।আদুরী সুবহান’কে নিয়ে খেলছে।সুবহানে’র দিকে তাকিয়ে আদুরী মিষ্টি হাসলো।আহ্লাদিত হয়ে বললো,

‘ছোট মিমির কোলে আসবে বাবা!ছোট মিমি কি তোমাকে কোলে নিচ্ছে না।’

সুবহান তালে তাল মিলিয়ে উঠলো।আদুরীর দিকে হাত দুটো বাড়িয়ে কেঁদে উঠলো।আদুরী হকচকিয়ে উঠলো।সুবহান’কে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগলো।সুবহান কান্না থামিয়ে আদুরীর চুল মুঠো করে খেলতে লাগলো।চুলে টান খেতেই আদুরী অস্ফুটস্বরে বললো,

‘সুবহান!চুল ছাড়ো বাবা!ছোট মিমি ব্যথা পাচ্ছি তো।’

সুবহান যেনো আর একটু শক্ত করে ধরলো।আদুরী সুবহান’কে বিছানায় বসাতে নিলেই সুবহান খামচে আদুরীর শাড়ি’টা ধরে অগোছালো করে দিলো।বুকের দিক থেকে শাড়িটা এলোমেলো হয়ে অনেক’টা সরে এসেছে।আদুরীর যেনো বেহাল দশা!

পর্দা সরিয়ে ভেতরে এসেই ফারাজ থমকে দাঁড়িয়ে গেলো।চোখের সামনে আদুরী আর সুবহানের কাণ্ডকারখানা দেখছে।সুবহান এইটুকু সময়ে আদুরীর ভালোই সর্বনাশ করেছে।ফারাজ আদুরীর দিকে তাকাতেই মন যেনো বেসামাল হয়ে উঠলো।পর্দা’টা ভালোমতোন ছড়িয়ে দিয়ে আদুরীর নিকট এসে দাঁড়ালো।আদুরী’কে খোঁচা দিয়ে সুবহান’কে বললো,

‘সুবহান বাবা!ছোট মিমির এতো শক্তি নেই তোমাকে সামলানোর।’

আদুরী চমকে উঠলো।ফারাজ’কে এখানে মোটেও আশা করে নি।তার উপর ফারাজের ঠেস দিয়ে কথা।দুটোই যেনো হজম করতে যুদ্ধ করতে হচ্ছে।আদুরী নিজেকে একটু গুটিয়ে নিলো।ফারাজ আদুরীর অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসলো।তবে তা বাহিরে প্রকাশ করলো না।আদুরীর কোল থেকে সুবহান’কে নিয়ে বললো,

‘সুবহান আমার কোলেই থাক।আর বুকের দিকে আঁচল’টা ঠিক করে নাও।’

আদুরী দ্বিতীয়বারের মতো চমকালো।সাথে লজ্জাও পেলো।এভাবেই কিছুটা সময় অতিবাহিত হলো।আদুরী আঁচল’টা বুকের সাথে চেপে ধরে স্পন্দিত স্বরে বললো,

‘আপনি এখানে!’

ফারাজের হিম হয়ে আসা শীতল গলার উত্তর,
‘চুড়ি দিতে এসেছিলাম।সুহানা আমাকে পাঠিয়েছে।’

‘বড়আপা আসলো না কেনো!বড়আপা কই!’

‘সুহানা!অর্পা আর সীমা’কে শাড়ি পড়িয়ে দিচ্ছে।’

আদুরী সহজ হলো!কিন্তু অস্থিরতা কমলো না।মনের ভেতর যেনো ঝড় বয়ে যেতে লাগলো।ফারাজ পূর্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।আদুরী’কে তার বউ ম্যাটারিয়াল লাগছে।একজন নতুন বউ!একজন পূর্ণাঙ্গ নারী!কথায় আছে শাড়িতে নারী!কথা’টা যেনো খাপে খাপ মিলে গেলো।ফারাজ চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো।উষ্ণ নিঃশ্বাস ছাড়লো!নিজেকে সামলিয়ে আদুরীর হাতে চুড়ির গোছা’টা দিয়ে বললো,

‘পড়ে নিও!’

ফারাজ সময় ব্যয় করলো না।সুবহান’কে নিয়েই হাঁটা ধরলো।এক এক করে কদম এগোচ্ছে আর বলছে,

‘সুবহান বাবা!চলো আমরা এখান থেকে চলে যাই।এখানে থাকা মানে আমাদের দু’জনেরই সর্বনাশ।ছোট মিমি’কে শুধু ছুঁয়ে এলোমেলো করে দিতে মন চাইবে!’

আদুরীর বুক’টা ধ্ব’ক করে উঠলো।ফারাজের এমন অসামাল কথায় যেনো আদুরীর যা-তা অবস্থা।আদুরী নিজের সাথে আওড়িয়ে বলে উঠলো,
‘মানুষ’টা আসলেই নির্লজ্জ!’

চলবে..