এক আকাশ অভিমান পর্ব-১৬+১৭

0
208

#এক_আকাশ_অভিমান
#মার্জিয়া_জাহান_চাঁদনী
#পর্ব : ১৬

রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর।
ঘুমে আচ্ছন্ন নগরী। নিস্তব্ধ চারিদিক।
তরী ঘুমিয়ে আছে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে। এমন ভাবে ধরে আছে যেনো ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে।

সবাই ঘুমিয়ে থাকলেও ঘুম নেই শ্রাবণের চোখে। অনুতপ্ততা, অপরাধবোধ, ভিতর টা নিঃশেষ করে দিচ্ছে। নিজের হাতে সব কিছু শেষ করে দিয়েছে। সে তো জানতোই না তরীর গর্ভে তার অস্তিত্ব বেড়ে উঠছে।অনুভব করতে পারে নি প্রথম বাবা হওয়ার অনুভূতি কেমন। পেটে কান পেতে শুনতে পারে নি সন্তানের নিঃশ্বাসের শব্দ।এমন হতভাগা পিতা সে। তারই অনাগত সন্তান বাবার প্রতি #এক_আকাশ_অভিমান নিয়ে হারিয়ে গেছে। দুনিয়ার আলো পর্যন্ত দেখে নি।
হয়তো তার সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ হতো। বাবা মায়ের হাত ধরে পথ চলা শিখতো।

কেবিনের দক্ষিণ দিকে একটা জানালা আছে। সেখানে গিয়ে বসলো শ্রাবণ। কাঁচ ভেদ করে লাইটের আলো আসছে। বাহিরে কত আলো ঝলমল করছে। একপলক তরীর মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। হটাৎ কিছু একটা মনে হতেই ব্যাগ থেকে তরীর ডাইরি টা বের করলো।
প্রথম দুই পাতা ফাঁকা। এর পরের পাতায় তার বাবা কে নিয়ে কিছু কথা লিখেছে। কয়েকটা পাতায় ছোট ছোট হাসি, কান্না, অনুভূতির কথা লিখেছে।

একটা পাতায় গিয়ে শ্রাবণের চোখ আটকে গেলো

” আজ কলেজের প্রথম দিন। অনেক নার্ভাস ছিলাম।
ভয়ে ভয়ে কলেজে পা রেখেছি। কিন্তু একটা ছেলেকে দেখে সব ভয় পালিয়ে গেলো। মুগ্ধ আমি তাকে দেখে। এক কথায় ক্রাশ খেয়ে গেছি।”

” আজ দ্বিতীয় দিন। ভাইয়া কে ডাকতে গিয়ে সেই ছেলেকে দেখলাম আড্ডা দিচ্ছে।”

” অবশেষে তার নাম জানতে পারলাম – শ্রাবণ ”

আরো কয়েকটা পাতায় শ্রাবণকে ঘিরে অনুভূতির কথা লিখেছে। অবাক হলো শ্রাবণ।তরী তাহলে আমাকে ভালোবাসতো। কিন্তু ছেড়ে দিলো কেনো।
পরের পৃষ্টা মনোযোগ দিয়ে পড়তে লাগলো

” আজ শ্রাবণকে আমার অনুভূতির কথা জানাবো। ভয় হচ্ছে কিভাবে যে বলি। শুনেছি ছেলেরা আগে বলে ভালোবাসার কথা। কিন্তু এই শ্রাবণ মুখে তালা দিয়েছে। ওর আশায় বসে থাকলে আমার আর প্রেম করা হবে না।”

একই তারিকের আবার লেখা

গিয়েছিলাম শ্রাবণকে ভালোবাসার কথা বলতে। ভেবেছিলাম সে আমাকে পছন্দ করে। কিন্তু আমি ভুল। সে আমাকে না আমারই প্রাণ প্রিয় বান্ধবীকে ভালোবাসে। তাইতো সে ফাঁকা রুমে তাকে আলিঙ্গন করেছে। এই দৃশ্য দেখে আমি নিরবে দূরে সরে এসেছি।
ভিতরটা আমার শূন্যতায় খা খা করছে। কাউকে বোঝাতে পারছিনা এই বিষাদের ব্যাথা। ”

” তাকে হারিয়ে আমি হাউমাউ করে কেঁদেছি।কিন্তু কোনো মানুষ শুনতে পায় নি। কারণ আমি নিস্তব্ধ রাতে একা বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদেছি। কেউ ঠের পায়নি। কেউ শুনতে পায় নি আমার মন ভাঙার শব্ধ। বোবা হয়ে রাতের পর রাত চোখের জল ফেলেছি।
নির্ঘুম রাত পার করেছি।”

শ্রাবণের মনে পড়লো সে দিনের কথা। তরী ডেকে পাঠিয়েছে শুনে ক্লাস রুমে এসেছিলো। তখন হুট করেই নদী এসে জড়িয়ে ধরে বললো ক্লাস রুমে নাকি একটা সাপ ডুকেছে।

তরী আরো লিখেছে

” আজ কোচিং থেকে আসার সময় দেখলাম নদী শ্রাবণ একে অপরের হাত ধরে আছে। নিরবে সরে এসেছি। আমি চাই না আমার জন্য আমার প্রিয় মানুষ গুলো অস্বস্তিতে পড়ুক।”

সেদিন শ্রাবণ নদীর সাথে দেখা করেছিল তরীর ব্যাপারে কথা বলার জন্য। নদী তখন শ্রাবণের হাত ধরে আশ্বস্ত করেছিল।
তার পর বেশ কিছু পৃষ্ঠা খালি ছিল।
এর পরের পৃষ্ঠা গুলোতে অনিকের সাথে দেখা হওয়া থেকে শুরু করে বিয়ে , সংসার , ছোট ছোট মুহূর্ত , প্রথম মা হওয়ার অনুভূতি সব কিছু লিখা।

” শামীম ভাইয়ের থেকে জানতে পারলাম সেদিন সাপ দেখে নদী শ্রাবণ কে জড়িয়ে ধরেছে। আমাকে বোঝাবে বলে হাত ধরে আশ্বস্ত করেছে। আর আমি ভুল বুঝে দূরে সরে এসেছি। চোখের দেখা সব সময় সত্যি হয় না।
তবে আরেকটি বিষয় জানতে পেরেছি সেদিন আমি শ্রাবণ কে ডাকি নি আমার নাম করে নদী ডেকেছিল।আর আমাকেও বলেছিল শ্রাবণ ডাকছে। নদী সাপ দেখে জড়িয়ে ধরে না আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরেছে। সবটা ছিল নদীর সাজানো নাটক।
শ্রাবণ কে সে ভালোবাসতো। শুধু মাত্র আমাকে ওর থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য এই মিথ্যে নাটক সাজিয়েছে।
এই জগন্য নাটক না করলেও হতো। আমি যদি জানতাম নদী শ্রাবণকে পছন্দ করে তাহলে নিজে থেকেই সরে যেতাম। ছোট থেকে যাকে বোনের মতো ভালোবেসেছি আগলে রেখেছি আজ তার ছলনার কাছে আমার মায়া মমতা হেরে গেছে।
যাক ওরা সুখী হোক। আমি আমার জীবনটা গুছিয়ে নিয়েছি অনিকের সাথে। তার মায়া আমাকে বেধে ফেলেছে। আজ তার সন্তান আমার গর্ভে বড় হচ্ছে। তাকে ভালোবাসি আমি। তার সাথেই সুখে আছি। ”

এর পরের সব পাতা খালি হয়তো আর সময় পায় নি কিছু লিখার।মাথার চুল খামচে ধরলো শ্রাবণ।

” তারমানে যা কিছু হয়েছে সব নদীর মিথ্যে কারসাজি ছিল? আর আমি ও অন্ধের মত নদীকে বিশ্বাস করেছি।একটা ভুল বোঝাবুঝির জন্য নিজের প্রিয় মানুষটা কে হারিয়েছি। ভাগ্যের জোরে ফিরে পেয়েও মূল্য দিতে পারি নি।আমার অগোচরে এত কিছু হয়ে গেলো আমি বুঝতেই পারিনি।


একটা রেস্টুরেন্টে মুখোমুখি বসে আছে নদী আর শ্রাবণ। শ্রাবণের চোখে মুখে স্পষ্ট রাগের আভাস। নদীর মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলছে।

” চুপ করে আছো কেনো? বলো কেনো করলে এসব।”

” তোমাকে পাওয়ার জন্য এত কিছু । ভেবেছিলাম তরী কে সরিয়ে দিলে তোমাকে আমার করে পাবো। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। একটা মুহুর্তের জন্য তোমার চোখে আমার জন্য ভালোবাসা দেখি নি। তবুও স্বার্থপরের মতো তোমাকে ভালোবেসেছি। আশা ছিল একদিন তুমি আমার হবে। আমি ভুল ছিলাম। তোমার মনে শুধু তরী ছিল।তোমাকে পাবো না বুঝতে পেরেছি।
হেরে গিয়েছি ভালোবাসার যুদ্ধে। ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আমি ভুল পথ অবলম্বন করেছি। অন্যায় করেছি। জানি এখন আর কিছু ফিরে আসবেনা। তবুও বলবো সব কিছু নতুন করে শুরু করো। তরীকে নিয়ে ভালো থাকো। আমি সরে যাচ্ছি তোমাদের জীবন থেকে। পারলে আমাকে মাফ করে দিও।
মাফ করবে না জানি , করা উচিত ও না। আমি তরীর কাছে মাফ চেয়ে নিয়েছি শুধু তুমি মাফ করে দিও।

ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে বললো

আমার বিয়ে এই মাসের শেষেই। তরীকে নিয়ে এসো।আমি খুব খুশি হব। সব ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নাও তরীর সাথে।সে তোমার সাথে রাগ করে আছে হয়তো।
না রাগ না তোমার প্রতি তার #এক_আকাশ_অভিমান।
দূরত্ব মিটিয়ে নাও।”

” উহু। চাইলেই সব কিছু ঠিক করা যায় না। তার অভিমান জমে জমে ঘৃ*ণা*র পাহাড় তৈরি হয়েছে।চাইলেও সেই পাহাড় ভেঙে ফেলা সম্ভব না।
সে আমাকে দেখে ঘৃ*ণা*য় মুখ ফিরিয়ে নেয়।

আমি যে তার অনুভূতিটা কে গলা টিপে মেরে ফেলেছি। দিনের পর দিন নির্যাতন করেছি শুধু তোমার ভুল অভিযোগের ওপর বিশ্বাস করে। বিয়ের পর থেকে ভালো করে কথা টুকু বলি নি। তাকে সান্তনা দেই নি।
খারাপ সময়টা তে পাশে থাকি নি।
ছোট বাচ্চা টা কে বাবার আদর স্নেহ দেই নি। মেয়েটা আমাকে বাবা বলেও ডাকে না। দেখলেই দৌড়ে পালাতো। এখন কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে তবুও বাবা ডাকে না। আমার বড্ডো আফসোস হয়।

আমার নিজের অস্তিত্ব তার গর্ভে ছিল আমি জানতেও পারি নি। নিজের হাতে নিজের সন্তান মেরে ফেলেছি। দুনিয়ার আলো টুকু দেখতে পারে নি। বাবা হওয়ার অনুভূতি টা অনুভব করতে পারি নি। আমার তো শাস্তি হওয়া উচিৎ তাই না?

তোমার জন্য আমার জীবন টা অশান্তির আগুনে পুড়ে গেছে। আমার আর তরীর একটা সুন্দর জীবন হতে পড়তো।
একটা ছোট সংসার হতে পারতো। ধ্বংস করে দিলে আমাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ। তোমাকে মাফ করি কি করে বলো? তুমি যে শান্ত মস্তিষ্কের এক ছলনাময়ী।”

” তাহলে শাস্তি দাও আমাকে।”

” তোমাকে শাস্তি দিতে হবে না। তুমি ঠিক শাস্তি পেয়ে যাবে। সব সময় শাস্তি দিতে নেই উপর ওয়ালার হাতে ছেড়ে দিতে হয়। তিনিই তোমাকে শাস্তি দিবেন নিজ হাতে। যেমন আমাকে দিয়েছেন। নিজের হাতে আমার সন্তান কে কেড়ে নিয়েছেন। আর কখনো বাবা হবার অনুভূতি কেমন সেটাও অনুভব করতে পারবো না। আমি চাই তুমি যেনো কখনো সুখী না হও। সুখ যেনো কখনো তোমার দুয়ারে না দাড়ায়। দুঃখের অনলে জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাও। যতটা তরী সহ্য করেছে তার থেকে হাজার গুন তুমি পাও।”

নদী কিছু না বলে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেলো। চোখ দিয়ে অনবরত জল ঝরছে। এক হাতে চোখ মুছে ফুটপাত ধরে হেঁটে চলেছে।

ভালোবাসা পেতে হলে সৎ থাকতে হয়। ছলনার আশ্রয় নিয়ে জীবনে কিছু পাওয়া যায় না। ভালোবাসা সবার ভাগ্যে জোটেও না।

#চলবে ইনশা আল্লাহ…!

#এক_আকাশ_অভিমান
#মার্জিয়া_জাহান_চাঁদনী
#পর্ব : ১৭

তরীকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে পনেরো দিন হলো।
এই কদিনে তরী শ্রাবণের সাথে একটা কথাও বলে নি।
শ্রাবণ অনেক চেষ্টা করেছে তবুও তরীর মুখ থেকে একটা কথাও বের হয় নি। শ্রাবণ কে দেখলেই মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে নেয়।
তরীর সাথে একান্তে কথা বলার সুযোগ টুকুও পায় না।রাবেয়া বেগম তরীকে কাছ ছাড়া করেন না।
রাতেও তরীর সাথেই ঘুমান।
শ্রাবণ অন্য রুমে থাকে।

সন্ধ্যায় সিরাজুল সাহেব বাড়িতে ফিরে জরুরী বৈঠক বসান। সবাইকে ডেকে বসার ঘরে আনলেন। রমিজুল সাহেব বসে আছেন মুখ কালো করে।
তাহেরা বেগম স্বামীর দিকে তাকিয়ে ইশারায় জানতে চাইলেন কি হয়েছে।
রমিজুল কিছু না বলে চুপ করে রইলেন। ড্রয়িং রুম জুড়ে পিনপতন নিরবতা। রাবেয়া বেগম ধরে ধরে তরীকে এনে সোফার এক কোনায় বসিয়ে দিলেন।

সবাই উপস্তিত দেখে নিরবতা ভাঙলেন সিরাজুল সাহেব। একটা কাগজ রাখলেন টেবিলের ওপর। সবাই একপলক তাকালো কাগজটির দিকে। বোঝার চেষ্টা করলো কি আছে কাগজটির মধ্যে।শুধু মাত্র রাবেয়া বেগম ছাড়া। সিরাজুল সাহেব সবার মনের ভাব বুজলেন। একপলক শ্রাবণের দিকে তাকালেন। শ্রাবণ ও আর সবার মতো কাগজটির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।

সিরাজুল সাহেব মুচকি হাসলেন। সবার উদ্দেশ্যে বললেন

” কৌতুহল দমিয়ে রাখো। একটু পরেই সবাই জানতে পারবে এটা কিসের কাগজ।

ছোট ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললেন

” রমিজুল! তরী আর শ্রাবণের বিয়ে টা আমি কেনো দিয়েছি সেটা তো তোমার অজানা নয়।

” জ্বী ভাইজান আমার সাথেই আলোচনা করেই সমস্ত সিদ্বান্ত নিয়েছেন।

” তোমার সাথে ঠিক কি কি আলোচনা হয়েছে। কেনো আমি বিয়েটা দিয়েছি সেটা তুমি তোমার ছেলেকে একটু বলো সবার সামনে।

রমিজুল সাহেব এক পলক ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন
” তরীর মা তরীকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চাইছিলেন। তার ভাষ্যমতে স্বামী নেই তাহলে স্বামীর ভিটেতে থেকে কি করবে। তরীর বয়স কম চাইলেই জীবনটা নতুন করে শুরু করতে পারে।

একটু থেমে

” তাছাড়া চাঁদ বাচ্চা মানুষ। তার সুস্থ ভেবে বেড়ে উঠতে
মায়ের পাশাপাশি বাবার ভূমিকা রয়েছে। তাই চাঁদের জীবনে একজন অভিভাবক এর প্রয়োজন ছিল। ভাইজান আমাকে বলেন একজন বিশ্বস্ত ছেলে খুঁজতে। যে চাঁদ কে আগলে রাখবে। পিতৃ স্নেহ দিয়ে বড় করবে। তরীর ভরসার স্থান হয়ে উঠবে।
চাঁদ বড় হবার পর ভাইজানের সমস্ত সম্পত্তি চাঁদের নামে হয়ে যাবে। তরীর যদি অন্যকারো সাথে বিয়ে হয়ে যায় তাহলে চাঁদ ও তরীর সাথেই যাবে। তখন ভাইজানের সম্পত্তি হস্তান্তর হয়ে যাবে। আমি চাই নি সেটা হোক। তাই ভাইজানের কাছে প্রস্তাব রাখি শ্রাবণের সাথে তরীর বিয়ের। ভাইজান প্রথমে রাজি হন নি আমিই জোর করেছি।শ্রাবণকে হুমকি দিয়ে রাজি করিয়েছি। তরী বিয়ে করতে চায় নি। ভাইজান ভাবি মিলে চাঁদের দোহাই দিয়ে তরীকে বিয়েতে রাজি করিয়েছেন।

থেমে গেলেন রমিজুল। শ্রাবণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল বাবার পানে।
এইবার সিরাজুল সাহেব মুখ খুললেন

” ভেবেছিলাম বিয়ের পর তরী শ্রাবণের সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে। ভুল ছিলাম আমরা। তরীর না হয় অনিক কে ভুলতে সময় লাগবে। কিন্তু শ্রাবণের তো উচিত ছিল তরীকে একটু সময় দেওয়া। তাকে বুঝা। চাঁদকে পিতৃ স্নেহ দেওয়া। শ্রাবণ তার কিছুই করে নি।
উল্টো দিনের পর দিন তরীর সাথে খারাপ ব্যাবহার করেছে। গায়ে হাত তুলেছে। আমরা দেখেও কিছু বলি নি। যেই পরিস্তিতিতে বিয়েটা হয়েছে এসব একটু হবেই
সামান্য বলেই তুচ্ছ করেছি। কিন্তু এই সামান্য টা অসামান্য হয়ে গেছে।
বিয়ের আগে একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল। বিয়ের পর সেটা চালিয়ে যাওয়া টা ভুল।
শুধু তাই না সেই বান্ধবীর প্রলোচনায় আমার পুত্রবধূর সাথে অপব্যাবহার করা হয়েছে।
সব দেখেও নিরবে মেনে নিয়েছি।এটাই আমাদের ভুল।

আমরা যদি আগেই প্রতিবাদ করতাম তাহলে হয়তো একটা প্রাণ বেচেঁ থাকতো। যদিও এটা একটা এ*ক্সি*ডে*ন্ট। ওপর ওয়ালার ইচ্ছার উপর কারো হাত নেই। তবে এই ঘটনার জন্য মেয়েটার প্রাণ সংশয় হয়ে যেত।

অনেক হয়েছে। আমরা অনেক ভুল করেছি। সব থেকে বড় ভুল হলো শ্রাবণের সাথে তরীর বিয়ে দেওয়া।
আমরা যদি অন্য কারো সাথে বিয়ে দিতাম তাহলে মেয়েটা সুখী হতো। আমার পিতৃহারা নাতনি টা বাবার আদর পেত। যেখানে এই সম্পর্কটার কোনো ভিত্তি নেই তাই সেখানে সম্পর্ক জোর করে ঠিকিয়ে রাখার প্রয়োজন মনে হয় না। বিচ্ছেদ টাই শ্রেয় বলে আমি মনে করি।

কাল রুহুল আসবে।
তরীকে নিজের কাছে নিয়ে যাবে। এখানে রাখতে সে ভরসা পাচ্ছে না। যখন তখন নাকি তাদের মেয়ের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। আমিও সায় দিয়েছি।
তরী ওখানেই ভালো থাকবে। অন্তত রোজ রোজ অত্যাচারিত হতে হবে না।

আমি চাই যাওয়ার আগে শ্রাবণের সাথে বিচ্ছেদ করিয়ে দিতে।

টেবিল থেকে কাগজ টা হাতে নিয়ে বললেন

বাবা শ্রাবণ
এটা ডিভোর্স পেপার। সই করে আমার মেয়েটা কে এই নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দাও। মেয়েটা তার স্বামী হারিয়েছে তবুও সহ্য করে নিয়েছে মেয়ের দিকে তাকিয়ে। তোমার অত্যাচার সহ্য করেছে আমাদের মুখ চেয়ে। এই বার নিজের অনাগত সন্তান হারিয়েছে। আমি জানি না মেয়ে টা কি করে সহ্য করছে। জীবন্ত লাশ হয়ে বেচেঁ আছে হয়তো। মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতে পারি না। আমি একটা উইল করেছি।
আমার অবর্তমানে আমার সম্পত্তির উত্তরধিকারী ছিল চাঁদ। সম্পত্তি আমি দুই খণ্ড করেছি। এক ভাগ আমার নাতনি চাঁদের আরেক ভাগ শ্রাবণের নামে করে দিয়েছি। এই সামান্য সম্পত্তির জন্যইতো বিয়েটা করেছিল শ্রাবণ।

তুমি মুক্তি দাও এই মিথ্যে বন্ধন থেকে। শান্তিতে বাঁচুক মেয়েটা।

বিচ্ছেদের কথা টা শ্রাবণের মনে তীরের মতো বিধলো। নিঃশ্বাস আটকে আসছে। কথা গুলো যেনো কণ্ঠনালীতে পেঁচিয়ে গেছে ।

সিরাজুল সাহেব তরীকে জিজ্ঞেস করলেন

” তরী তুমি কি এই সম্পর্ক টা বয়ে বেড়াতে চাও? নাকি বিচ্ছেদ চাও শ্রাবণের থেকে। তোমার মতামতের ভিত্তিতে আমরা সিদ্বান্ত নিবো।

তরী নিশ্চুপ হয়ে রইলো। সবাই তাকিয়ে আছে তরীর মুখের দিকে। শ্রাবণ অনেক আশা নিয়ে তরীর দিকে তাকালো। শ্রাবণ জানে তরী তাকে ছাড়বে না। কিন্তু শ্রাবণ কে ভুল প্রমাণিত করে তরী বলে উঠলো

” আমি মুক্তি চাই।

মুহূর্তেই শ্রাবণের সব আশা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেলো। অসহায় হয়ে তরীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। আজ সব থেকে বেশি অসহায় মনে হলো। কাপা কাপা কণ্ঠে বলল ” তরী?

তরী মাথা নিচু করে বসে রইল।রাবেয়া বেগম কে উদ্দেশ্য করে বললো
” মা আমার ভালো লাগছে না। সব কিছু মিটিয়ে আমি রুমে যেতে চাই।

সিরাজুল সাহেব কলম টা শ্রাবণের দিকে এগিয়ে দিলেন।

” নাও শ্রাবণ সই টা করে দাও।

শ্রাবণ রেগে গিয়ে টেবিল থেকে ডিভোর্স লেটার টা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেললো।
চিৎকার করে বললো

” কি শুরু করলে তোমরা। মানছি আনি অন্যায় করেছি তাই বলে এত বড় একটা শাস্তি দিবে আমাকে? ভুল তো মানুষই করে। আমিও করেছি। আমাকে শুধরে নেওয়ার একটা সুযোগ তো দিবে?
আমি তো শাস্তি পেয়েছি। নিজের সন্তানকে হারিয়েছি। এর থেকে বড় শাস্তি কি হতে পারে। আর কি সম্পত্তি সম্পত্তি করছেন। চাই না আমার কোনো সম্পত্তি।

তরীর পায়ের কাছে বসে হাত দুটো ধরে বললো

” আমি জানি আমি অন্যায় করেছি। তার জন্য আমি মাফ চাইবো না। সেই মুখ আমার নেই। তবে আমাকে একটা সুযোগ দাও তরী। আমি কথা দিচ্ছি চাঁদের ভালো বাবা হয়ে দেখাবো। তোমার ভরসার স্থান হবো। প্লিজ তরী শুধু একটা সুযোগ দাও।

তরী কিছু না বলে একা একা উঠেই রুমের দিকে যেতে লাগলো। তাহেরা বেগম দৌড়ে গিয়ে তরীকে ধরলেন।

শ্রাবণ চোখে জল নিয়ে তরীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।

কাধে কারো স্পর্শ পেয়ে পিছনে তাকালো। রাবেয়া বেগম দাড়িয়ে আছেন।

” ছেলেদের চোখে জল মানায় না বাবা। তুমি আমাদের সন্তানের মতো। আমরা তোমার খারাপ চাই না। তোমার চোখে আমি অনুতপ্ততা দেখেছি।আর কেউ সুযোগ না দিলেও আমি দিলাম। তরীর অভিমান ভাঙ্গাও। মেয়েদের অভিমান তাদের ভালোবাসার মতোই প্রখর।
তার #এক_আকাশ_অভিমান তোমার এক সমুদ্র প্রেমের কাছে হার মানবে আমার বিশ্বাস। আমি সবাইকে বলে দিবো। বিচ্ছেদ টা যেনো স্থগিত রাখা হয়। তোমাদের সময় দেওয়া হবে। আমি রুহুলের সাথে কথা বলবো। যাও রুমে যাও।

শ্রাবণ জড়িয়ে ধরলো রাবেয়া বেগম কে।

” ধন্যবাদ বড় মা। আমাকে পাশে থেকো তুমি।

” আমি আছি তোর পাশে।

শ্রাবণ এগিয়ে গেলো কক্ষের দিকে। তরীর অভিমান গলিয়ে ভালোবাসা জাগাবে।

#চলবে ইনশা আল্লাহ..!!