এক আকাশ অভিমান পর্ব-১৮

0
471

#এক_আকাশ_অভিমান
#মার্জিয়া_জাহান_চাঁদনী
#পর্ব : ১৮

” আমাকে কি একটা সুযোগ দেওয়া যায় না তরী? কথা দিচ্ছি তোমার শুষ্ক ঠোঁটে হাসি ফোটাবে। আর কখনো তোমার চোখে জল আসতে দিবো না। ভালো স্বামী হবো। বেস্ট বাবা হবো।”

হাসলো তরী। শ্রাবণের মুখোমুখি দাড়িয়ে নিজের ডান হাত শ্রাবণের বুকে রেখে বললো ” ভালো স্বামী ভালো বাবা হতে গেলে আগে ভালো মানুষ হতে হয়। তাতে বুকের ভিতর টা জলের মতো সচ্ছ হতে হয়। মানুষের আবেগ অনুভূতি বুঝার মতো ক্ষমতা থাকতে হয়। ঠিক ভুল বিচার করার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়।
অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয় ভালো মানুষ হওয়ার কোন গুনাহই আপনার মধ্যে বিদ্যমান নেই। আগে ভালো মানুষ হয়ে ওঠেন তারপর নাহয় ভালো স্বামী ভালো বাবা হবেন।

তরীর হাত দুটি মুঠোয় পুরে কপালে ঠেকিয়ে বললো

” একটা ভুল বুঝাবুঝির জন্য আমাদের রাস্তা টা ভিন্ন তরী। আমি তোমাকে ভালোবাসতাম কিন্তু কখনো বলা হয়ে উঠে নি। সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম। চোখের দেখা সব সময় সঠিক হয় না। আমরা তো চোখের সামনে মরীচিকা ও দেখি তাই বলে কি সব সত্যি হয়ে যায়? আমি সব জানতে পেরেছি তরী। সেদিন নদীর মিথ্যে কারসাজির কাছে আমাদের ভালোবাসা হেরে গিয়েছে।

তুমি যদি অভিমান না করে একবার মন খুলে সবটা বলতে তাহলে আজ আমাদের একটা সুস্থ জীবন হতো।
অভিমান করে অন্যের হাত ধরে চলে গেলে। একটাবার আমার কথা ভাবলে না। মানলাম তখন তুমি ভুল বুঝেছিলে। আমাকে তো দুইটা চর তাপ্পর দিয়েও জিজ্ঞেস করতে পারতে।তোমার বিয়ের পর অনেক ভেঙে পড়েছিলাম তখন নদী আমার পাশে ছিল। ওর সাহায্যে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হই।

তোমাকে দেখানোর জন্যই তার সাথে সম্পকে যাই। বিশ্বাস করো মন থেকে কখনো তাকে ভালবাসি নি। তোমার জায়গা গত চার বছরেও নিতে পারে নি।

আমারই সব ভুল তরী। অন্ধের মত তাকে বিশ্বাস করেছিলাম। ভুল প্রলোচনায় তোমার উপর নির্যাতন করেছি, অবিশ্বাস করেছি, খারাপ ব্যবহার করেছি।

এই শেষ বার একটা সুযোগ চাইছি। আমাকে কি একটা বার ক্ষমা করা যায় না?”

” সত্যি বলতে আপনার প্রতি আর কোনো অনুভূতি কাজ করে না। আপনার করা প্রত্যেকটা আঘাত আমার শরীলে নয় অন্তরে লেগেছে। যদি শরীলে লাগতো তাহলে হয়তো ওষুধ খেয়ে কমিয়ে নিতাম।
মনের আঘাত কি করে কমাই বলুন। সেই ক্ষত সরানোর কোনো ওষুধ আমার জানামতে নেই। তবে আমি চেষ্টা করবো চাঁদের লিগ্যাল বাবা হিসাবে আপনাকে আপনার প্রাপ্য সম্মান টা দিতে।”


নদীর বিয়ে হয়েছে বেশ কিছু দিন হলো।
ছেলে সরকারি চাকরি করে। তবে দিন শেষে সে একজন নে*শা*খো*র মা*তা*ল। রোজ রাতে নে*শা ভান করে গায়ে হাত তোলে।
উনিশ বিশ কিছু হলেই মারধোর করে।

নদী প্রতিবাদ টুকুও করেনা। কি প্রতিবাদ করবে সে । একজন পাগলের সাথে কথা বলেও তাকে বোঝানো যায় কিন্তু একজন মাতাল কে না।

বারান্দায় দাড়িয়ে একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে নদী। চাঁদ টা একা আজ। আশে পাশে কোনো তারার অস্তিত্ত নেই। আকাশ টা মেঘে ছেয়ে আছে। ঠিক নদীর মনের আকাশের মতো।

” আমার কপালে একটু সুখ রাখলে কি হতো খোদা? আমার ও সুখী হতে ইচ্ছা হয়। ভালোবাসা পাওয়ার জন্য প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে নিজের জীবনটা বিসর্জন দিলাম।
দুঃখ টাই আমার প্রাপ্য। এটাই আমার নিয়তি।
সব কিছুই হারিয়েছি। ভেবেছিলাম নতুন করে শুরু করবো। কিন্তু আমার জীবন যে ভুলে ভরা। বিষাক্ত আমার ভবিষ্যৎ।

কার কাছে অভিযোগ জানাবো। নিয়তির কাছে নাকি উপর ওয়ালার কাছে ?

বাবা মার প্রতি তার কোনো অভিযোগ নেই। এটাই তার ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছে। পূর্বের করা সমস্ত অন্যায়ের শাস্তি হিসেবে মাথা পেতে নিয়েছে। মনে প্রাণে বিশ্বাস করে এটা তরীর দীর্ঘশ্বাসের ফল।

এমন সময় পিছন থেকে সাহেদ জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুজে দিলো। মুখ থেকে ভেসে আসছে মদের বিদঘুটে গন্ধ।
নদী বুঝলো সাহেদ এখন শারীরিক চাহিদা মেটানোর জন্য সঙ্গ চাইছে।
নদী বাধা দিল না। কারণ সাহেদ বাধা মানবে না। ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও নিজের চাহিদা মিটাবে।

উপর ওয়ালা ছাড় দেন ,কিন্তু ছেড়ে দেন না বলে একটা কথা আছে। অন্যায় করলে আজ না হোক কাল শাস্তি ভোগ করা লাগবেই।
সব বিচার মানুষ করতে পারে না। সব অভিযোগ থানায় জানাতে হয় না। উপর ওয়ালার কাছে জানাতে হয় না। তিনি অন্তর্যামী। অভিযোগ গুলো দীর্ঘশ্বাসের মাধ্যমে আল্লাহর আরশে পৌঁছে যায়।

রিনি অ*ন্তঃস*ত্বা!
উচু পেট নিয়ে কিছু করতে পারে না। শামীম তার স্ত্রীর দেখা শোনায় কোনো ত্রুটি রাখে না।
শামীমের রিনির প্রতি যত্ন ভালোবাসা দেখে অনেক খুশি হয় শ্রাবণ। যাক একজন বিশ্বস্ত মানুষের হাতে বোনকে তুলে দিতে পেরেছি। নির্দ্বিধায় শামীম একজন ভালো মানুষ, ভালো স্বামী , নিশ্চই ভালো বাবা ও হবে।

শ্রাবণের বড্ডো আফসোস হলো এই সময়টা তে তরীর পাশে ছিল না। এই যত্ন টুকু তো তরীর ও প্রাপ্য ছিল।
স্ত্রী সন্তানের প্রতি কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারে নি।

মাইশা কে দেখতে এসেছে রুহুল তার পরিবার নিয়ে। তরী শ্রাবণ উপস্থিত সেখানে। রুহুল পছন্দ করেছে মাইশা কে তাই সপরিবারে উপস্তিত হয়েছে। শামীমের মা আমেনা খাতুন রাজি হতে পারছেন না এই বিয়েতে।
মনের বিরুদ্ধে গিয়ে মেহমান অ্যাপায়ণ করছেন। স্বামীর বিরুদ্ধে কথা বলেন না তিনি।যেখানে স্বামী মত দিয়েছেন সেখানে তার কথা সাজে না।
শামীম কে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন

” আরেকটু ভেবে দেখলে ভালো হতো না ?”

” কেনো মা? তোমার কি রুহুল ভাই কে পছন্দ হয় নি?”

” রুহুল দেখতে ভালো। কিন্তু তার পরিচয়?”

” পরিচয়ে কি হয়েছে? যা বলার খোলাসা করে বলো।”

” দেখ শামীম রুহুল যদি তরীর সৎ ভাই হতো আমি কিছু কিছু বলতাম না। কিন্তু সে তো শারমিন বেগমের আগের পক্ষের সন্তান। ছেলে নিয়ে তিনি চলে এসেছেন স্বামীর ভিটে থেকে।তাছাড়া তরীর ওপর করা নির্যাতন এর কথা আমরা জানি।তিনি মোটেও সুবিধা জনক মানুষ নন। মাইশার বয়স কম রুহুল মাইশার বয়সের পার্থক্য অনেক”

শামীম তার মা কে একহাতে জড়িয়ে ধরে বললো

” আমাদের সমাজে বিচ্ছেদ হলেই মেয়েদের দুষ দেই।মায়ের করা অন্যায়ের জন্য সন্তানদের অবহেলা করি। রুহুল ভাইয়ের মা কেমন সেটা আমি জানি না তবে রুহুল ভাই একজন ভালো মনের মানুষ। তাকে আমি কলেজ লাইফ থেকে চিনি। তিনি আমাদের মাইশাকে আগলে রাখবেন। আর মানুষ সব সময় এক রকম থাকেন না মা। পূর্বের করা অন্যায়ের জন্য আমরা তাকে সারাজীবন দোষী ভাবতে পারি না। মানুষ পরিবর্তন শীল। আমার বিশ্বাস আমার বোনটা সুখী হবে। আর রইলো পরে বয়স। ওইটা একটা সংখ্যা মাত্র। ভালোবাসার কাছে বয়স মেটার করে না। একজন বিশ্বস্ত সহযোগী বা বিশ্বস্ত জীবনসঙ্গী পাওয়াটাই ভাগ্যের ব্যাপার।
তুমি চিন্তা করো না মা, মাইশা খুব ভালো থাকবে।

ছেলের কথায় যুক্তি আছে বলে মেনে নিলেন টা।
আকদ সেরে চলে গেলেন। কিছু দিন পর বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হবে।

অনেক চেষ্টা করেও তরীর অভিমান গলিয়ে ভালোবাসা জাগাতে পারে নি শ্রাবণ।
সিদ্বান্ত নিলো তরীর জীবন থেকে চির তোরে হারিয়ে যাবে।আর কখনো ফিরবে না।
নিজেকে ব্যার্থ মনে হচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে মনের আকাশ জুড়ে বিষাদের ছায়া নামছে। অভিমান জমেছে ভালোবাসার প্রতি।

জীবনের এমন একটা সময় এসেছে চাইলেও কিছু করতে পারছে না। কাছে থেকে যদি ভালোবাসা বুঝানো না যায় তাহলে ভালোবাসার মানুষটির কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখাটাই শ্রেয়।

সিদ্বান্ত নিলো দূরে চলে যাবে।তাই অফিস বদলে ফেললো। অফিসের কাছেই একটা বাসা নিলো। কাউকে জানায় নি।প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে বের হয়ে গেলো বাড়ি থেকে। তরী রুমে ছিল না তাই একটা চিরকুট রেখে গেলো বালিশের উপর।

তরী ঘুমন্ত চাঁদ কে নিয়ে রুমে এসে শুইয়ে দিল। বালিশের ওপর একটা কাগজ দেখে ভ্রু কুঁচকালো। অহেতুক ভেবে কাগজটা মুঠো করে নিচে ফেলে দিলো।

ফজরের নামাজের পর তরী অপেক্ষা করছে শ্রাবণের।
সারা রাত বাড়ি ফিরে নি।
এখন তো শ্রাবণ সন্ধ্যার মধ্যেই বাড়ি ফিরে। চাঁদ কে সময় দেয়। আজ হটাৎ কি হলো?
সারা রাত দু চোখের পাতা এক করে নি তরী।

কি হলো মানুষটার?
কোথায় গেলো?

#চলবে ইনশা আল্লাহ….!