এক আকাশ অভিমান পর্ব-১৯ এবং শেষ পর্ব

0
322

#এক_আকাশ_অভিমান
#মার্জিয়া_জাহান_চাঁদনী
#পর্ব : ১৯ ( শেষ পর্ব )

সকাল বেলা এলার্মের বিকট শব্দে ঘুম ভাঙলো শ্রাবণের। হাই তুলতে তুলতে চোখ খুলে পাশের টি টেবিলে ধোঁয়া ওঠা গরম কফির কাপ দেখে অবাকের শীর্ষে পৌঁছল। চোখ কচলে ভালো করে দেখে নিল।
হ্যা এটা কফির কাপ।
” আরেহ এখানে কফি কে বানিয়ে রাখলো? আমি তো কাজের লোক রাখি নি? তাহলে কে?

কফির কাপে আঙ্গুল ডুবিয়ে দেখলো এখনো পর্যাপ্ত গরম। শ্রাবণ দুটানায় পড়ে গেলো। খাবে কি খাবে না ?
” না বাবা এটা না খাওয়াই ভালো। বলা তো যায় না কেউ আবার বি*ষ মিশিয়ে দিতে পারে। কিন্তু বি*ষ মিশাবে কি করে দরজা তো বন্দ করেই ঘুমিয়েছি।
রাতে চোর এলো না তো ? ধুর কি সব ভাবছি চোর এলে কফি বানিয়ে রেখে যাবে নাকি?
শামীম এসেছে হয়তো। সে ছাড়া তো আর কেউ ঠিকানা জানে না।

বিছানা থেকে নামতেই দ্বিতীয় দফায় অবাক হলো। সোফার ওপর জামা কাপড় বেড় করা। তাও গুছিয়ে বের করা। এগিয়ে গেলো সোফার দিকে। সেখানে একটা চিরকুট রাখা। হাতে নিল কাগজ টা
” গোসল সেরে এই পোশাক পরিধান করবে। তার আগে কফি টা শেষ করো। চিন্তা নেই অতে বি*ষ প্রয়োগ করা নেই। সব শেষ করেই রুম থেকে বের হবে। আমি ডাইনিং টেবিলে অপেক্ষা করছি। যদি আমার কথার অন্যথা হয় তাহলে সত্যি সত্যি বি*ষ দিয়ে মেরে দিবো।

শ্রাবণ কফির কাপ টা হাতে নিয়ে এক চুমুকে শেষ করে দিলে। ওয়াশরুমে ডুকে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং এ গেল।

শামীম একটা চেয়ারে বসে নিশ্চিন্ত মনে খেয়ে চলছে।
রান্না ঘর থেকে টুক টাক আওয়াজ আসছে। তার মানে রান্না ঘরে কেউ আছে।

রান্না ঘরের দিকে পা বাড়াতেই শামীম বলে ওঠে ” কি রে শালা। এতক্ষণ লাগে তোর ? মেয়েদের মতো ওয়াশরুমে বসেছিলি নাকি?

” আমি তোর শালা নই সমন্ধিক হই। কথা টা বার বার ভুলে যাস কেনো?
কথা টা বলেই রান্না ঘরে ছুটে গেলো।

লাল তাতের শাড়ি পরে পরোটা ভাজছে এক রমণী। চুল গুলো খোঁপা করা। শাড়ির আচল কোমরে গুজা।
মুহূর্তেই থমকে গেলো শ্রাবণের হৃদয়। স্বপ্ন ভেবে চোখ বন্ধ করে নিলো। চোখ খোলার সাহস পাচ্ছে না যদি ঘুম ভাঙলেই হারিয়ে যায়?

” তরী !

শ্রাবণের ডাক শুনে পিছনে থাকায় তরী। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শ্রাবণ। চোখের পলক ফেলতে যেনো ভুলে গেছে। হাতে সোনার চিকন চুড়ি, গলায় চিকন হার, নাকে নাক ফুল, কানে দুল। শ্রাবণের দৃষ্টিতে নতুন বউয়ের মতো লাগছে তরী কে। সাত দিন পর আজ তরীকে দেখছে। তাও ভিন্ন রূপে। এই রূপে আগে কখনো দেখেনি।
শ্রাবণ কে তাকাতে দেখে লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো তরী।
একপা একপা করে তরীর দিকে এগুতে যাবে তখনই পা আটকে গেছে। মনে হলো পা দুটি যেনো কেউ শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে।
পায়ের দিকে তাকাতেই দেখলো চাঁদ পা জড়িয়ে আছে।
চাঁদ কে কোলে নিয়ে সমস্ত মুখশ্রী তে চুমু খেলো।
” কেমন আছে আমার মা টা?

চাঁদ আদো আদো গলায় বললো ” চাঁদ রাগ করেছে। তুমি কেনো চাঁদকে একা ফেলে চলে আসলে। চাঁদ ও অনেক কান্না করেছে।

” তাই নাকি? চাঁদ কত টা রাগ করেছে ?

চাঁদ দুহাত মেলে দিয়ে বললো ” এত্ত টা। আমি কান্না করেছি মাম্মা ও কান্না করেছে। তুমি আমাদের ছেড়ে আর যাবে না পাপা।না হলে আমরা আরো কান্না করবো।

চাঁদের মুখে পাপা ডাক শুনে শ্রাবণের উত্তপ্ত হৃদয় যেনো শীতল হয়ে গেলো। কত গুলো দিন অপেক্ষা করেছে চাঁদের মুখ থেকে এই ডাক টা শুনার জন্য। কত চেষ্টা করেছে। আজ সেই কাঙ্ক্ষিত শব্দ টা শুনে চোখ চিকচিক করে উঠলো। নিজের হাতে সব কিছু শেষ করে শেষ করে দিয়েছিল। ভাবতেই এক ফোঁটা অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল।
চাঁদ নিজ হাতে চোখের জল মুছে দিয়ে বললো
” তুমি কান্না করো না পাপা। আমরা তোমাকে বাড়ি নিয়ে যাবো। দাদু কান্না করে তোমার জন্য। মাম্মা কে বকা দিয়েছে।

শ্রাবণ হাসলো। তরীর দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতা করলো। তরী মুখ ঝামটা দিয়ে পরোটার বাটি হাতে নিয়ে ডাইনিং এ গেলো। যাওয়ার সময় বলে গেলো ” কারো যদি খিদে থাকে খেয়ে নিতে পারে। চিন্তা নেই এটা সম্পূর্ণ নিরাপদ। প্রাণ সংশয়ের ঝুঁকি নেই।

শ্রাবণ তরীর পিছু পিছু গেলো। চেয়ারে বসলো চাঁদ কে নিয়ে। পাশের চেয়ারে তরী বসে চাঁদ কে খাইয়ে দিচ্ছে।
শ্রাবণ ও চুপ চাপ খেয়ে যাচ্ছে। তরীর মুখশ্রী তে স্পষ্ট রাগ। তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। শ্রাবণ বুঝে পায় না এই অভিমানী মেয়ের হটাৎ এত রাগ কোথা থেকে চলে আসলো। তাকানো যাচ্ছে না মুখের দিকে?যেনো চোখ দিয়েই গিলে খাবে। সে আবার কি করলো?

খাওয়া শেষ করে চাঁদ কে শামীম নিয়ে গেলো।
তরী এখনো শ্রাবণের সাথে কথা বলে নি। মনে সাহস জোগালো শ্রাবন। যে করেই হোক তরীর সাথে কথা বলতে হবে।

” বলছি যে হটাৎ এখানে এলে যে ? ঠিকানা কে দিলো ?

” গাধার মতো প্রশ্ন করছেন কেনো?
শামীম ভাই যখন নিয়ে এসেছে তাহলে নিশ্চয় সেই ঠিকানা দিয়েছে?

শ্রাবণের হুস ফিরল সে কি বলেছে। জিবে কামড় দিয়ে মনে মনে ভাবলো ” ধুর আমার হলো টা কি। এই মেয়ে কে হটাৎ এত ভয় পাচ্ছি কেনো? সব কেমন আওলিয়ে যাচ্ছে।

” কাপুরুষের মতো চলে এসেছিলেন কেনো? বউ বাচ্চার দায়িত্ব নিতে পারবেন না নাকি? সেই ক্ষমতা টাও কি নেই? তাহলে বিয়ে করেছেন কেনো?

” ক্ষমতা ঠিকিই আছে তবে আমি দায়িত্ব নিতে পারি নি। আমার ব্যর্থতা আমি সন্তানের দায়িত্ব নিতে পারি নি। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্য পালন করতে পারি নি।তাই তো চুপ চাপ চলে এসেছি সব ছেড়ে।

তরীর মনে পড়লো সে দিনের কথা
শ্রাবণ বাড়ি ফিরে নি দুই দিন পার হয়ে গেলো। ছেলের চিন্তায় তাহেরা বেগমের পাগল পাগল অবস্থা। এই দিকে তরীর ও চিন্তা হচ্ছে। খারাপ লাগছে মানুষটার জন্য। শামীমের কাছে গেলে সে জানে না বলে জানিয়ে দেয়। শ্রাবণের আগের অফিসে খুঁজ নিলে রিজাইন করেছে বলে জানিয়ে দেয়।এই দিকে শ্রাবণকে দেখতে না পেয়ে চাঁদ ও কান্না কাটি করে। মেয়েটা শ্রাবণকে বাবার স্থানে আবিষ্কার করে ফেলেছে। এই দিকে তরীর #এক_আকাশ_অভিমান ও ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। ছয় দিন কেটে গেছে এই ভাবে। হঠাৎ কাল বিকেলে সালমা খালা একটা চিরকুট নিয়ে এলেন।

” বৌমা দেহো তো এইডা কিয়ের কাগজ। তোমার ঘরের এক কোণে পইড়া আছিলো। আমি মুখ্যসুক্ষ মানুষ পড়তে পারি না। তাই তোমার কাছে লইয়া আইলাম। যদি দরকারি কিছু ওয়।

তরী কাগজ টা হাতে নিয়ে দেখলো সে দিনের কাগজ টা যেটা তরী মুঠো করে ফেলে দিয়েছিল। কাগজ টা খুলে পড়তে শুরু করে।


প্রিয় তরী,
তোমাকে প্রিয় বলে সম্বোধন করার অধিকার হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। তবুও আমার কাছে তুমি চিরতরে প্রিয় হয়েই থাকবে। আমি অনেক অন্যায় করেছি যার কোনো ক্ষমা হয় না। তোমার জায়গায় আমি থাকলেও হয়তো কখনো ক্ষমা করতাম না। অনেক চেষ্টা করেও তোমার মন গলাতে পারি নি।
নারীর অভিমান তাদের ভালোবাসার মতোই প্রখর।আমার বিশ্বাস ছিল তোমার মনে আমি নিজের জন্য পুনরায় স্থান করে নিবো। কিন্তু আমি ব্যর্থ। আমি পারি নি তোমাকে আমার করে নিতে। যেখানে ভালোবাসা হারিয়ে গেছে চিরতরে সেখানে বিচ্ছেদ টাই শ্রেয়। আমি পারি নি তোমার চাহনিতে নিজের জন্য ঘৃনা দেখতে। আমি পারি নি তোমার মনে আমার জন্য আতঙ্ক দেখতে। তাই দূরে সরে এসেছি। চিন্তা করো না আমি তোমাকে আর বিরক্ত করবো না। আমি পারলাম না তোমাকে কাগজে কলমে মুক্তি দিতে তার জন্য আমি ক্ষমপ্রার্থী। আমি চাই না তুমি আমার থেকে মুক্তি পাও। চাই না তোমার নামের পাশে ডিভোর্সী থকমা টা লাগুক। আমি চাই তুমি সারা জীবন মিসেস শ্রাবণ হয়েই থাকো। সবাই কে বলে দিও যেনো চিন্তা না করে। বাবা মা কে বলো আমি নতুন চাকরি নিয়েছি। ওদের বললে আসতে দিতো না। ভালো থেকো আমার চাঁদ কে ভালো রেখো।

চাঁদের কান্না মাখা মুখ দেখে শামীম মুখ খুলেছে। তরীকে নিয়ে এই অবধি এসেছে।

তরী রেগে গিয়ে শ্রাবণের শার্টের কলার চেপে ধরলো।
” কি মনে করেন নিজেকে আপনি? কোনো সিনেমার হিরো নাকি ভিলেন? কোনটা? একে তো অন্যায় করেছেন তার ওপর আবার অভিমান করে বাড়ি ছাড়েন। এত সাহস হয় কি করে আপনার ? ওহ বুঝেছি আপনার নদীর বিয়ে হয়ে গেছে বলে গৃহ ত্যাগ করে সন্ন্যাসী সাজবেন। সেটা তো হতে দেওয়া যায় না। আপনাকে আমাদের দায়িত্ত্ব নিতেই হবে।
কেমন মানুষ আপনি? সামান্য অভিমান টুকু ভাঙাতে পারেন না।আপনি আবার মুখে বড় বড় কথা বলেন। নারী কে যেমন ভালোবাসতে হয় সম্মান করতে হয় তেমনি অভিমান ভাঙ্গানোর দায়িত্ব নিতে হয়। এত অধৈর্য্য কেনো আপনি। আর কটা দিন অপেক্ষা করতে পারেন নি? বাড়ি ফিরে চলুন আপনার হচ্ছে।

শ্রাবণ তরীর হাত দুটো মুঠোয় নিয়ে বললো ” তোমার চোখের দিকে তাকালে আমি সহ্য করতে পারতাম না তরী। অনুতপ্ততা অপরাধবোধ ভিতর থেকে শেষ করে দিচ্ছিল।বার বার মনে হতো আমি খু*নি আমি ধ*র্ষ*ক। তাই তো চলে এসেছিলাম। বিশ্বাস করো তরী আমি ইচ্চা করে কিছুই করি নি। তোমার প্রতি অভিমান থেকে আমি এসব করে ফেলেছি। মানুষের রাগ সহজেই ভাঙ্গানো যায় কিন্তু অভিমান ভাঙাতে সবাই পারে না। আমি অন্যায় করেছি তরী। আমাকে তুমি শাস্তি দাও।

” হয়েছে এত ড্রামা করতে হবে না। অনুতপ্ততার থেকে বড় শাস্তি কিছু হতে পারে না। আপনাকে একটা সুযোগ দিলাম। তবে আমার হৃদয়ের এক অংশ জুড়ে অনিক থাকবে। তাকে আমি ভুলতে পারবো না।

” আমি চাই না তুমি আমার ভাই কে ভুলে যাও। সে থাকুক আমাদের মাঝে এক অদৃশ্য সুতা হয়ে। বেধে রাখুক আমাদের। তরী তুমি আর অভিমান করে নেই তো ?

” অভিমান তো আছেই। তবে একটু না, #এক_আকাশ_অভিমান জমে আছে।

” তোমার #এক_আকাশ_অভিমান কমাতে কি করতে হবে ?

” আপাতত আমরা মা মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে যেতে হবে।

” যথা আজ্ঞা মহারানী। এখনই চলুন। আপনার #এক_আকাশ_অভিমান গলাতে আমি সব কিছু করতে রাজি। শুধু তুমি পাশে থেকো। আর আমাদের রাজকন্যা আমাদের মধ্যে ভালোবাসার বন্ধন হয়ে থাকুক। কথা দিচ্ছি দুঃখ আর তোমাদের ছুঁতে পারবে না।

_____ সমাপ্ত_______