এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব-১১+১২

0
895

#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-১১

মাথার উপর প্রখর সূর্যতাপ।জলন্ত আগুনের মতো উত্তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে সূর্য।তোহার কলেজ ছুটি হয়েছে প্রায় বিশ মিনিট আগে।ব্যস্ত নয়নে বারবার ঘড়ি দেখছে তিহান পরক্ষণেই মাথা তুলে অস্থির দৃষ্টিতে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে গেটের এপার থেকে ওপার।এই গরমের মধ্যেও তার পরণে ফুলহাতা সাদা শার্ট।অফিস থেকে এখানে এসেছে সে।তাড়াহুড়োয় শার্টের হাতাটা গুটিয়ে নেয়ার খেয়ালটাও হয়নি।ঘাড় গলা ঘেমে নেয়ে একাকার।মেয়েটা এখনো বের হচ্ছেনা কেনো?এত দেরি হয় নাকি?ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ করে মুখ ফুলিয়ে কয়েকবার জোরে জোরে শ্বাস ছাড়লো তিহান।
অত:পর চোখ মেলতেই তোহাকে বের হতে দেখে স্বতির নি:শ্বাস ফেঁসে দ্রুত পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেলো সে।
তোহার কাঁধ থেকে বইখাতা ভরা ভারি ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়ে তপ্ত কন্ঠে বললো,

—“এত দেরি করলি কেনো?আমি কি তোর পার্সোনাল ড্রাইভার যে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করবো?ইডিয়ট।”

কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালো তোহা।প্রতিউওরে কিছু বলতে যেয়েও তিহানের ঘামে ভেজা শার্ট দেখে চুপ হয়ে গেলো সে।মনে মনে ভাবলো,আসলেই বেশি দেরি হয়ে গিয়েছে।আরো একটু তাড়াতাড়ি বেরোনো উচিত ছিলো।
অনুশোচিত নিচু কন্ঠে সে বলল,
—“সরি।”

একপলক তাকালো তিহান।চোখে মুখে স্পষ্ট মন খারাপের ছাঁপ ফুঁটে উঠেছে তোহার।মনে মনে হাসলো তিহান।তারপর মুখ বাঁকিয়ে হাতের বাহুতে কপালের ঘামটুকু মুছে নিয়ে হাত বাড়িয়ে তোহার দিকে মেলে দিয়ে নরম গলায় বললো,
—“আয়।”

তোহা ক্ষীণ হেসে শক্ত করে তার হাতটা জড়িয়ে ধরতেই সামনের দিকে পা বাড়ায় তিহান।তার সাথে পা মিলিয়ে তোহাও হাঁটতে শুরু করে।গাড়ির সামনাসামনি যেতেই পা দুটোকে থমকে দাড়া করিয়ে দেয় তোহা।
তিহানকেও আটকানোর জন্য তার হাতে টান দিতেই তিহান ঘাড় ফিরিয়ে বিরক্তিকর কন্ঠে বলে,

—“কি হয়েছে তিহু?”

তোহার দৃষ্টি সামনে থাকা আইসক্রিম ওয়ালার দিকে।তিহানের ডাকে সে আবদার মাখা মিষ্টি কন্ঠে বলে,
—“কিনে দিননা প্লিজ।”

তোহার দৃষ্টি অনুসরণ করে আইসক্রিম ওয়ালার দিকে চোখ পরতেই তিহান গম্ভীরভাবে বলে,
—“একদম না।এই গরমের মধ্য হুট করে আইসক্রিম খেলে ঠান্ডা লেগে যাবে।চুপচাপ মুখ বন্ধ করে সামনে হাঁট।”

তোহা দৃষ্টি ছোট করে কাতরকন্ঠে বলে,
—“তিহান ভাই,একটা খেলে কিছু হবেনা।”

—“তিহু…”

তিহানের ধমকে কাজ হয়না।তোহা আবারো বলে উঠে,
—“প্লিজ।”

হার মানে তিহান।দীর্ঘশ্বাস ফেলে তোহাকে আইসক্রিম ওয়ালার কাছে নিয়ে যেয়ে ছোট্ট করে বলে,
—“কোনটা খাবি?জলদি নে।”

তোহা মুচকি হেসে একটা চকলেট ফ্লেবারের আইসক্রিম তুলে নিতেই তিহান টাকাটা মিটিয়ে দিয়ে ব্যঙ্গাত্বক কন্ঠে বলে,
—“এটা যে নিলি,খেতে পারবি?মাখিয়ে ফেলবি তো জামাকাপড়।”

ততক্ষনে আইসক্রিমের কাগজটা খুলে ফেলেছে তোহা।ছোট একটা কামড় দিয়ে সে দৃঢ় কন্ঠে বলে,
—“মাখবেনা।”

তিহান অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকায়।একটু পর কি হবে সেটা তার অজানা নয়।

গাড়িতে বসে আছে তারা।গাড়ি চলছে আপনগতিতে।এসির বাতাসে ঘাম শুকিয়ে গেছে তিহানের।চোখের ক্লান্তি ভাবটাও কেটেছে অনেকটা।রাস্তার জ্যামে একটু পরপরই থেমে যাচ্ছে গাড়ি।তিহানের কপালে বিরক্তির ভাঁজ।আজকে ড্রাইভার আঙ্কেলকে নিয়ে আসেনি।অগত্যা তাকেই ড্রাইভ করতে হচ্ছে।

তোহার আইসক্রিমটা অর্ধেক খাওয়া শেষ না হতেই গলে যেতে শুরু করেছে দ্রুত সেটা চেঁটেপুটে খেতে গিয়ে ইতিমধ্য ঠোঁটের কিছু অংশ মাখিয়ে ফেলেছে সে।কয়েকমিনিট যেতে না যেতেই একটা বড় একটা অংশ গলে পরে যেতে নিলেই দ্রুত গাড়ি ব্রেক করে তোহার থুতনির নিচের অংশে হাত পাতে তিহান।ফলস্বরূপ তিহানের হাতের উপর পরে আইসক্রিমের টুকরোটা।সঙ্গে সঙ্গে আরো দু তিন ফোঁটা আইসক্রিম তার শার্টের হাতার উপর পরতেই তোহা আৎকে উঠে বলে,
—“আরে কি করছেন?হাত সরান।শার্ট মেখে যাচ্ছেতো।”

তিহান উওর না দিয়ে জানালা দিয়ে হাতের আইসক্রিমটা ফেলে দিয়ে গাড়ির সামনের ড্রয়ার থেকে পানির বোতল বের করে তেঁতো কন্ঠে বলে,
—“কি যে করিস তিহু।…দরজাটা খুলতো।হাতটা ধুয়ে দেই।”

পরিষ্কার হাতটা দিয়ে ঠেলে দরজা খুলে তোহা।তিহান ঝুঁকে গিয়ে পানির বোতল খুলে যত্ন করে তোহার হাত ধুইয়ে দিয়ে বোতলটা তোহার হাতে দিয়ে বলে,
—“পানি ঢাল।”

তোহা মুখ গোমরা করে তিহানের হাতের উপর পানি ঢালে।হাতটা পরিষ্কার হলেও ফকফকে সাদা শার্টের হাতাতে চকলেট কালারের দাগগুলো লেগেই থাকে।তিহান আবারো সিটে বসে তোহার হাত থেকে বোতলটা নিয়ে আগের জায়গায় রেখে দেয়।
তিহানের হাতার দিকে তাকিয়ে তোহা মৃদু কন্ঠে বলে,
—“আমাকে বাসায় দিয়ে আপনি এখন অফিসে যাবেন না?”

—“হ্যাঁ,কেনো?”

—“তাহলে শুধু শুধু হাতায় দাগগুলো লাগালেন কেনো?কেমন দেখাচ্ছে।”

তিহান তৎক্ষনাত কোনো উওর দেয়না।তবে তোহাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়ার আগমূহুর্তে তার চোখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নি:ক্ষেপ করে কন্ঠে গাম্ভীর্য নিয়ে বলে,
—“তোমার থেকে ইম্পোর্টেন্ট কিছুই না।অন্তত এসব বিষয় তো নয়ই।মনে রেখো।”

~চলবে~

#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-১২

পড়ন্ত বিকেলের আরক্তিম গোধুলীবেলা।লাল কমলা সূর্য একটু একটু করে হেলে পড়ছে পশ্চিম আকাশে।বারান্দার রেলিংয়ে দুহাত রেখে অদ্ভুত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে তোহা।চোখের পাতা নিভু নিভু হয়ে আসছে বারংবার।বেশ খানিকক্ষণ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের পর তার মনে পরলো একটা কথা,”সূর্যের দিকে বেশিক্ষণ অর্থ্যাৎ চোখ না সরিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা যায়না।এ কথাটা সে আগে থেকে জানলেও কখনো প্রমান স্বরূপ দেখা হয়নি।আজ দেখলো।আসলেই সূর্যের দিকে বেশিক্ষন তাকানো যায়না।চোখ জ্বালা করে।আপনাআপনিই চোখের পাতা বন্ধ হয়ে যায়।এবার চোখজোড়া সত্যি সত্যিই বন্ধ করে ফেললো তোহা।আনমনে ভাবলো,”তিহান ভাইয়ের চোখের দিকেও তো তাকিয়ে থাকা যায়না।বেশিক্ষন তো দূর,একপলকও তাকানো যায়না।আচ্ছা,তার চোখ জোড়াও কি সূর্যের মতো?জলন্ত?নাকি সে মানুষটাই জলন্ত,ভস্মকারী?যার সংষ্পর্শে এলে ভয় হয়?ভরসাপূর্ণ ভয়?যে কিনা কেবল মুখের কথা দিয়েই তার ছোট্ট শরীরের অভ্যন্তরে থাকা রন্ধ্রে রন্ধ্রে,শিরায়-উপশিরায় পর্যন্ত কাঁপুনি ধরিয়ে দিতে পারে?”

এতটুকু ভাবতেই চোখ মেলে ফেললো তোহা।এলোমেলো,অগোছালো,ফাঁকা ফাঁকা লাগছে মস্তিষ্ক।মাথা নুইয়ে রেলিংটা আরো শক্ত করে চেঁপে ধরে সে।কানে বাঁজছে তিহানের “তুমি” সম্মোধন করা সম্মোহনী কথাগুলো।ভাবে,এই কথাগুলো শুনলে কি আদৌ কোন কিশোরীর আবেগি মন শান্ত হয়ে থাকতে পারে।উনি কি বুঝেননা এই বাক্য গুলো আমাকে প্রচন্ডভাবে প্রভাবিত করে?ইচ্ছে হয় সকল বাঁধা নিষেধ উপেক্ষা করে আমি তুমুলগতিতে তার বুকে আঁছরে পড়ি?”

____________

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।পড়ার টেবিলে মনোযোগ সহকারে পড়তে বসেছে তোহা।এখন চলছে গরমকাল।মোটামুটি একবছর পর আগামী গরমকালে তার উচ্চ মাধ্যমিক।পড়াশোনায় তেমন সিরিয়াসনেস না থাকলেও হেলাফেলাও নেই তার।মোটামোটি মাঁঝারি সারির শিক্ষার্থী সে।ভালো ও নয়,আবার ফেল করার মতো খারাপ ও নয়।

বাড়ি প্রায় ফাঁকা।তূর্য গেছে ঢাকার বাইরে,তার কোন এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাড়িতে।তাও আবার এক দিনের জন্য নয়।গুনে গুনে তিনদিনের জন্য।বন্ধুর বড় ভাইয়ের বিয়ে।তাকে যেতেই হবে,বন্ধুর মা বাবা পর্যন্ত তাকে ফোন করে বলেছে।অগত্যা দাওয়াত রক্ষার জন্য এই পড়াশোনার মাঝেও ছুটেছে সে।

তোহার বাবা গেছে অফিসের কাজে।ফিরবে আগামী পরশু।মাঝেমধ্যেই অফিসের কাজে এহেন ছোটাছুটি করতে হয় তাকে।প্রাইভেট কম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সে।দায়িত্বের বোঁঝাটাও তাই বেশি।

বাসায় শুধু তোহা আর তোহার মা আতিয়া।ঘরের দরজা খুলে রেখেছে তোহা।ড্রইংরুমের সোফায় বসে অল্প আওয়াজে টিভি দেখছে আতিয়।তোহা এখান থেকে তাকে স্পষ্ট দেখতে পারছে।মনটা খারাপ হচ্ছে একটু।আগে নিশার সাথে সারাক্ষণ খুঁনসুটিতে মেতে থাকতো।এখন কেমন একা একা লাগে।তূর্য বরাবরই কম কথা বলে আর পড়াশোনায় ডুবে থাকে।তার সাথে হাসি মজা করার উপায় নেই।

ঘড়িতে বাজে সাড়ে সাতটা…
ড্রইংরুমের কোঁণায় রাখা ল্যান্ডফোন বেঁজে উঠলো।আতিয়া তখন স্হির দৃষ্টিতে মনোযোগের সহিত নাটক দেখছে।ল্যান্ডটফোনের অবিরাম শব্দে তিক্ত কন্ঠে সে বললো,
—“তোহা,এসে ফোনটা তোল।”

ঘর থেকে তোহার উওর এলোনা।আতিয়া আবারো গলা বাড়িয়ে ডাকলো,
—“তোহা?”

কোনো সাড়াশব্দ নেই।এবার বিরক্তি নিয়ে পিছে তাকাতেই খেয়াল করলো টেবিলে মাথা রেখে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে তোহা।উপায় না পেয়ে নিজেই উঠে গেলো সে।ফোনটা কানে নিতেই এমন একটা খবর পেলো যা শুনে তার অন্তরাত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠলো।কথা শেষে খট করে ফোনটা কেটে গেলো।
চোখে পানি নিয়ে তোহাকে ডাকার জন্য হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিতেই তুমুল অস্থিরতায় ছটফট করে উঠলো তার মন।গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে তোহার।ঘুমের মাঝেই মেয়েটা কাঁপছে।ঠোঁট শুঁকিয়ে কাঠ।
গ্রাম থেকে আতিয়ার মা ফোন করেছিলো।তার বাবার অবস্থা ভালোনা।অনেকদিন যাবতই অসুস্থতায় ভুগছিলেন সে।আজ সকাল থেকে নাকি কেমন নির্জীব হয়ে আছেন।শুধু নিজের মেয়েদেরকে দেখতে চাচ্ছেন।
কোনো অঘটন ঘটার আগে এখনই তাকে আর আফিয়া কে রওনা হতে বলেছেন তার মা।ছোট মেয়ে অর্থ্যাৎ তোহার ছোটখালা আনিয়া ও নাকি একটু আগে খবর শুনেই রওনা দিয়েছে গ্রামের উদ্দেশ্য।


আফিয়া আর আতিয়া মিলে ধরাধরি করে খাটে শুইয়ে দিয়েছে তোহাকে।প্যারাসিটামল খাইয়ে দেয়া হয়েছে।
আতিয়ার কপালে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট।একদিকে নিজের বাবা আর আরেক দিকে অসুস্থ মেয়ে।কই যাবে সে?বাসায় কেউ নেই যে তোহাকে রেখে যাবে।
খালি বাসায় একা একা অসুস্থ মেয়েটা কিভাবে থাকবে?তাছাড়া রান্নাবান্নাও করা নেই।এই জ্বর নিয়ে তোহা রান্না করতে পারবে না।সবদিকেই বিপদ।

চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে আতিয়া সিক্ত কন্ঠে বললো,
—“আপা,তুমিই যাও।আমি থাকি।আব্বাকে বইলো তোহার জ্বর।তাই আসতে পারিনাই”

ধমকে উঠলো আফিয়া।বললো,
—“তুইতো জানিস তিয়া,আব্বা সবচেয়ে বেশি তোকেই আদর করে।আর এখনো তোর নামই বলছে বেশিবার।তোর দুলাভাইকে ব্যবস্থা করতে বলে এসেছি।একটু পরই রওনা দিবো আমরা তিনজন ”

—“কিন্তু আপা,তোহা?”

—“তিহান অফিস থেকে আসুক।রান্না নিয়ে সমস্যা নেই,তোহার খাবার তিহান দোকান থেকে কিনে দিবেনে একয়দিন।আর অপেক্ষা কর।জ্বর নেমে যাবে।চিন্তা করিস না।”

আতিয়া কোনরকমে চোখের পানি আটকালো।তিহানই তার একমাত্র ভরসার স্হল।ছেলেটাকে সে খুব বেশি বিশ্বাস করে।খুব বেশি।তোহাকে তিহানের দায়িত্বে রেখে যেতে কোনরকম ভয় নেই তার।


তিহান ফিরেছে।বাসায় নিচে ঢুকতে না ঢুকতেই তার ফোন বেঁজে উঠলো।পকেট থেকে ফোনটা বের করে “মা”
লেখা দেখতেই মুখে হাসির রেখা টেনে ফোনটা তুলে কানে লাগালো সে।বললো,
—“হ্যাঁ মা,আমি এসে পরেছি।এখন সিঁড়িতে।”

—“বাবা,তুই একটু তাড়াতাড়ি তোর খালামনির ফ্ল্যাটে আয় তো।একটু সমস্যা হয়েছে।”

—“কি হয়েছে?তি..নামটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো সে।বললো,সবাই ঠি ক আছেতো?”

—“হ্যাঁ,তুই একটু আয় তাড়াতাড়ি।”বলে ফোনটা কাটলো আফিয়া।

তিহান দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠলো।তোহাদের ফ্ল্যাটের দরজা ধাক্কা দিতেই তা খুলে গেলো।দরজা লক করা না।তোহার রুম থেকে কথাবার্তার শব্দ আসছে।কাঁপা কাঁপা মন নিয়ে সেদিকে যেতেই দেখলো বিছানায় সোয়া অবস্থায় আছে তোহা।গায়ে কম্বল দেয়া।চেহারা কেমন শুকিয়ে গেছে।ঠোঁটগুলো শুষ্ক।

তাকে দেখেই আফিয়া বললো,
—“যাক,এসেছিস।শোন…”

—“কি হয়েছে ওর?”আফিয়ার কথার মাঝেই বলে উঠে তিহান।শান্ত তবে কাঁপা কন্ঠ তার।

—“জ্বর এসেছে।এখন ১০১ ডিগ্রি।একটু আগে ১০৩ ছিলো।শোন..তোকে যে জন্য ডাকছি,তোর নানা খুব অসুস্থ।তোর খালামনি আর আমাকে যেতে হবে।নিয়ে যাবে তোর বাবা।কারণ আর কেউ বাসায় নেই।তোহার জ্বর ওকে অসুস্থ শরীর নিয়ে টানাটানি করা যাবেনা।আমাদের পৌঁছাতেই সকাল হয়ে যাবেএতোক্ষণ মেয়েটা জার্নি করতে পারবেনা।তাই বলছি,ওকে তো রেখে যেতে হচ্ছে।তুই একটু ওকে দেখে রাখিস।আর একয়দিন ওর খাবার দোকান থেকে কিনে এনে দিস।আমরা একটু পরেই রওনা দিব।বুঝলি?”

—“আচ্ছা,ঠিকাছে।”সংক্ষিপ্ত উওর তিহানের।
________________

“দায়িত্ব” খুব বড় একটা জিনিস।যার কাঁধে “দায়িত্ব” নামক ভারি জিনিসটা আছে শুধু সেই বুঝে এর গুরুত্ব।
আতিয়া যাওয়ার আগে তিহানকে বলে গিয়েছে,”তোর দায়িত্বে রেখে যাচ্ছি তোহাকে।ওর খেয়াল রাখিস।”।
ব্যাস!এতটুকু কথাই যথেষ্ট।যে এই বিশ্বাসটার মর্মার্থ বুঝে সে অবশ্যই কথাটার মান রাখবে।

শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এসেছে তিহান।ভেজা গায়েই কোনরকম শার্ট চেপে সে বেরিয়ে গেলো।উদ্দেশ্য মোড়ের দোকান থেকে খাবার কিনে আনা।তোহার জ্বর কমেছে হয়তো।সে অবশ্য যায়নি ওই ফ্ল্যাটে।পকেটে ফ্ল্যাটের চাবিটা ভরে দ্রুতপায়ে হাঁটা ধরলো সে।খাবার কিনে এনে আস্তে করে দরজার নব খুললো তিহান।ভেতরে ঢুকে ড্রইংরুমের লাইট জ্বালিয়ে খাবারের প্যাকেটটা টেবিলে রেখে তোহার দরজায় যেয়ে নক করলো।যদিও সে জানে তোহা দরজা লক করেনা কখনো তবুও সেই মেহেদির দিনের কান্ডের পর সে আর নক না করে ভুলেও রুমে ঢুকেনি।সেদিনের ঘটনাটা একেবারেই একটা একসিডেন্ট।ওই ঘটনার আগেও সে নক করে ঢুকলেও ওইদিন তাড়াহুড়োয় হুট করেই ঢুকে গিয়েছিলো।যদি ভুলটা না হতো তাহলে হয়তো আর তোহাকে সেই বাজে পরিস্থিতিটায় পরতে হতোনা।হতাশ শ্বাস ছাড়ে তিহান।অত:পর আবার নক করে বলে,
—“তিহু,আসবো?”

তিহানের কন্ঠে হুঁস ফিরে তোহার।চোখ বন্ধ করে ছিল সে।দরজার আওয়াজ শুনতে পায়নি।ওষুধ কাজে দিয়েছে।জ্বর এখন অনেকটাই কম।নেই বললেই চলে।হুঠাৎ এত জ্বর কেনো এসেছিলো নিজেও বুঝতে পারলোনা।

দুহাতে ভর দিয়ে আস্তে করে উঠে বসলো সে।পাশ থেকে ওড়না নিয়ে সুন্দরমতো গায়ে জড়িয়ে নিয়ে মৃদু কন্ঠে উওর দিলো,
—“জি আসেন।”

আস্তে করে দরজা খুলে রুমে ঢুকলো তিহান।দরজার সামনে দাড়িয়েই বললো,
—“জ্বর কমেছে?”

—“এখন নেই।”

তিহান আর এগোলোনা।তোহার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে বললো,
—“তোর খাবার প্লেটে বেড়ে ঘরে দিয়ে যাচ্ছি।হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিস।”

তোহা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায়।তিহান ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলে,
—“তোর নাম্বারে রিচার্জ করে দিয়েছি।রাতে কোন সমস্যা হলে ফোন দিস।আমি চলে আসবোনে।আর কাল কলেজ যাওয়া লাগবেনা।বাসায়ই থাকিস।সকালের নাস্তা কিনে দিয়ে যাব।ওকে?”

—“আচ্ছা।”মাথা কাঁত করে বলে তোহা।

তিহান বেরিয়ে যেয়ে খাবার বেড়ে তোহার ঘরে নিয়ে গেলো।তোহা তখন রুমে ছিলোনা।ওয়াশরুমে গিয়েছিলো ফ্রেশ হতে।বেরিয়ে এসে তিহানকে খাবার রাখতে দেখে সে বললো,
—“আপনি খেয়েছেন?”

—“নাহ্,খাবো।”

বলে খাবারটা পড়ার টেবিলে রেখে গ্লাসে পানি ঢেলে দিলো তিহান।বেরিয়ে যাওয়ার আগে তোহার মাথায় একহাত রেখে স্নেহময় কন্ঠে বললো,
—“একদম ভয় পাবে না।আমার দায়িত্ব তুমি।দায়িত্বের অবহেলা হবেনা।আমি আছি।”

~চলবে~