এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব-৩৮

0
913

#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৩৮

এয়ার কন্ডিশনারের হিমহিমে শীতল বাতাস ছড়িয়ে আছে আনাচে কানাচে।রুমজুড়ে কৃত্রিম সুগন্ধির মনমাতানো সুঘ্রাণ।তোহার ছোট্ট নাকের ডগায় একটু একটু লালাভ আভা।বোধহয় অতিরিক্ত ঠান্ডার প্রভাবে।গোলাপী ঠোঁটজোড়া গ্রীষ্মের মরুর মতো রুক্ষ।দু ঠোঁটের মাঝখানে কিন্চিৎ ফাঁক।মাথাটা সযত্নে পরে রয়েছে তিহানের কোলের উপর।
তিহান তাকিয়ে আছে।সম্মোহনী অবিচল দৃষ্টি।নিদ্রাপরীর ঘুমন্ত মুখশ্রীর বর্ননাতীত সৌন্দর্য্য গলে গলে পরছে তার সমস্ত কোলজুড়ে।মেয়েটাকে মানাচ্ছে এখানটায়।খুব বেশিই মানাচ্ছে।মনে হচ্ছে,এই কোলটাই তার নিত্য প্রয়োজনীয় ঘুমানোর বালিশ।
জিভ দিয়ে নিজের ঠোঁট ভেজালো তিহান।বৃদ্ধাঙ্গুল তোহার ঠোঁটে ছুঁইয়ে দিলো নরমভাবে।তারপর এদিক ওদিক তাকালো।পাশের ছোট্ট ফুলদানি রাখা টেবিলটায় একটা পানির গ্লাস রাখা।লম্বা হাত বাড়িয়ে তা নিয়ে হাতের তর্জনীর এক ইন্চি পরিমাণ অংশ ডুবিয়ে দিলো।একফোঁটা পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিলো তোহার শুষ্ক ঠোঁট।গোলাপী ঠোঁটের রংটা যেন আরো একটু গাঢ় হয়ে উঠলো।সেদিকটায় তাকিয়ে ঢোঁক গিললো তিহান।নিজের পায়ে নিজে কুঁড়াল মারাটা কি তার উচিত হলো?
ধূসর মনির দৃষ্টি সরে গেলো তৎক্ষণাৎ।তোহা নড়ছে।হাতের আঙ্গুল কাঁপছে পুন:পুন:।মিনিট না পেরোতেই সে চোখ মেললো।নিভু নিভু পাপড়ি।বারবার বুজে আসছে।পা দুটো প্রলম্বিত করে চোখ কুঁচকে শরীরে টানা দিলো তোহা।ঘুমন্ত ভাবটা একটু কমতেই সে ঘুরে গেলো।দুহাত তিহানের পেট জড়িয়ে ধরে মুখ লুকিয়ে জড়ানো কন্ঠে বললো,
—“পানি খাবো।”

পানির গ্লাস তিহানের হাতেই ছিলো।সে বললো,
—“উঠতে হবেতো।”

মুখটা পেটের আরো একটু গভীরে গুঁজে দিলো তোহা।হাতের বাঁধনটা আরো একটু দৃঢ় করে ঘুমের শ্লেষ মাখানো কন্ঠে বললো,
—“না উঠে খাওয়া যায় না?”

—“গলায় ঠেকবে যে।”কন্ঠে আদুরে ধ্বনির রেশ টেনে বললো তিহান।তোহা অনাগ্রহ দেখালো।মুখ গুঁজে পরে রইলো নির্বিকার চিত্তে।তার নিরুদ্দেশ অঙ্গভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে,”পিপাসায় কাতর হয়ে থাকাও যেন প্রেমিকের কোল ত্যাগের চেয়ে অতি উত্তম।”
খানিকক্ষণ পর কোলে মাথা রেখেই সোজা হলো তোহা।তিহান আগে থেকেই মাখা ঝুঁকিয়ে তার দিকে চেয়ে ছিলো ফলস্বরূপ চারচোখ মিলে গেলো মূহুর্তেই।ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো তিহান।তোহাকে টেনে তুলে পানির গ্লাস চেপে ধরলো ঠোঁটে।ঢকঢক করে গিললো তোহা।দ্রুত খাওয়ার ফলে কয়েকফোঁটা পানি সরলপথে গড়িয়ে গেলো তার চিবুক ধরে।আরো গভীরে যাওয়ার আগেই তিহান ব্যস্ত ভঙ্গিতে তা মুছে দিতে হাত বাড়ালো।ঠান্ডা হাতের কনকনে হৃদয়কাঁনপানো স্পর্শ গলার কাছটায় পেতেই চমকে উঠলো তোহা।তার গলাটা আবার শুকনো শুকনো লাগছে কেনো?এতক্ষন যে পানিগুলো পান করলো তা কি পাকস্থলীর পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই ধুলিস্সাৎ হয়ে গেলো?তিহান হাত সরানোর পূর্বেই সে তিহানের চোখে চোখ রেখে বললো,
—“আপনি আমার পিপাসা বাড়িয়ে দিয়েছেন।আরো পানি লাগবে বোধহয়।”
কথাটা তিহানের বোধগম্য হলোনা হলো আবার হলোনা।বাম ভ্রু উঁচালো সে।তীর্যক কন্ঠে বললো,
—“কোন পিপাসা?”

তোহা আলতো করে মাথা ঠেকালো তিহানের বাহুতে।চোখ বুজে অকপটে উওর দিলো,
—“প্রেমপিপাসা।”

—“পানিতে মিটবে?”

—“জানিনা।”তোহার কন্ঠে মেদুর ছাঁয়া।
তিহান হাসলো।উঠে যেয়ে জগ থেকে আরো একগ্লাস পানি এনে তোহাকে খাইয়ে দিতে দিতে বললো,

—“তোমার প্রেমিক সীমা অতিক্রম করতে অক্ষম।আর ক’টা দিন নাহয় পানিতেই পিপাসা মিটুক।”
____________
নীলরঙা আকাশে সাদা তুলির এলোপাথারি আঁচর।মেঘগুলো আজ বড্ড আকৃতিহীন।সাদা নীলে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে হেমন্তের গগন।মিঠা আলোয় আলোকিত বিকেলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে ঘড়ির কাঁটা।তিহান বসে আছে চেয়ারে।তার সামনে ল্যাপটপ।তোহা পর্দা সরিয়ে দিয়েছে।দুহাত কাঁচের উপর রেখে একাধারে চেয়ে রয়েছে রাস্তার দিকে।সূর্যের আলো পরছে না এদিকটায়।পরলে হয়তো তিহান আর তাকে দাড়িয়ে থাকতে দিতো না।

গেটে ঠকঠক শব্দ।তিহান সময় না নিয়ে উওর দিলো,
—“কাম ইন।”

তোহা ফিরে তাকালো।একজন যুবক ঢুকেছে দরজা খুলে।হাতের ফাইল আর পোশাক আশাক দেখে বোঝাই যাচ্ছে লোকটা অফিসেরই কেউ।দরজা ভিজিয়ে তোহার দিকে একপলক চোখ পরতেই মাথা নামালো সে।
মৃদু কন্ঠে বললো,
—“আসসালামু আলাইকুম ম্যাম।”

তোহা অপ্রস্তুত হলো।তার থেকে বয়সে এত বড় লোকটা তাকে “ম্যাম” বলে সম্মোধন করছে আবার মাথা নিচু করে সালাম দিচ্ছে ব্যাপারটা একেবারেই দৃষ্টিকটু দেখালো।তবুও নিজেকে সামলে সালামের উওর দিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো সে।
তিহান আড়চোখে তোহাকে দেখে নিয়ে হাত বাড়িয়ে বললো,
—“দাও নিরব।আমি দেখে দিচ্ছি।”

নিরব মুচকি হেসে ফাইলটা তিহানের হাতে দিয়ে নতমুখে চেয়ে রইলো মেঝের দিকে।পাশে দাড়ানো মেয়েটাই যে তার স্যারের হবু বউ সে জানে।
তিহান মনোযোগ দিয়ে পাতা উল্টালো।দেখা শেষে অভিজ্ঞ ভঙ্গিতে কলমদানি থেকে একটা কলম তুলে কোথাও একটা সাইন করে দিয়ে ঘড়িতে সময়টা পরখ করে বললো,”তুমি তো আজকে হাফ ডে ছুটি নিয়েছে।সময় তো হয়ে গিয়েছে।এখনই বেরোবে?”

—“জি স্যার।”

—“তোমার স্ত্রী আর মানহা কেমন আছে?”

—“ভালো আছে স্যার।”লাজুক হেসে উওর দিলো নিরব।তিহানও হাসলো।তোহাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

—“ও হচ্ছে নিরব।তোমাকে একবার বলেছিলাম না আমার এক কলিগের বাচ্চা হয়েছে।মনে আছে?”

তোহা যেন একটু লজ্জা পেলো।সেবার তিহানকে হেসে হেসে ফোনে কথা বলতে দেখে কি একটা কান্ডই না করেছিলো সে।মনে পরতেই সে যথাসম্ভব নিচু গলায় বললো,”মনে আছে।”

—“ম্যাম কে নিয়ে একদিন বাসায় আসবেন স্যার।একবার আমাদের বাসায় এসেছিলেন না?তারপর থেকে পুষ্পিতা প্রায়ই বলে আপনার কথা।”

তিহান মাথা নাড়িয়ে হা হুতাশ করে বললো,
—“আসবো নিরব।অবশ্যই আসব।ব্যস্ততাটাই তো কাটছে না।”

নিরব বেরিয়ে যেতেই গটগট করে এগিয়ে আসলো তোহা।তিহানের হাতের কব্জি টেনে ঘড়ি দেখে চোখ কপালে তুলে বললো,কত বেজে গেছে..আপনি আম্মুকে ফোন করেছিলেন?”

—“করেছিলাম।বলেছি তুই আমার সাথে আছিস।অফিস শেষ হলে একসাথে ফিরবো।”

—“রেজাল্টের কথা বলেছেন?”

—“বলেছি।”

—“খুশি হয়েছে আম্মু?”

—“হয়েছে।”

—“আপনি খুশি হননি?”মুখ ফসকে কথাটা বলে দিলো তোহা।বলে নিজেই কেমন যেনো বুঁদ হয়ে রইলো।

তিহান প্রত্যুওর করলোনা।ল্যাপটপের কি-বোর্ডে হাত চালাতে চালাতে ফোন কানে তুলে নিলো।
___________
কমলা রঙা মেঘের আড়ালে দীপ্তিমান গোধুলীবেলা।সূর্য ডুবে যাচ্ছে পশ্চিম আকাশের কোল ঘেঁষে।মনোহরী দৃশ্য।কাঁচের দেয়ালের এপাশ থেকে মুগ্ধনয়নে তা উপভোগ করছে তোহা।সে যখন প্রায় একটা ঘোরের মধ্য আবিষ্ট হয়ে গেছে তখনই পেছন থেকে কাঁচের উপর একটা সচ্ছ ছায়া ঘিরে ফেললো তার ছোট্ট দেহটাকে।তোহার ঘোর ভাঙলো,ধ্যান কাটলো।পেছন ফিরতেই শক্ত বুকটার সাথে ধাক্কা লাগলো।তড়িঘড়ি করে একটু পিছাতেই কাঁচের দেয়ালে পিঠ ঠেকলো।
সোনালি রুপালি আলোর মিশেল রংটা তিহানের মুখের উপর।চোখের ভাষাটা একটু ভিন্ন মনে হচ্ছে।
ঠোঁটে হয়তো একটু হাসি আছে তবে বোঝা মুশকিল।দু’তিনদিনের শেভ না করা খোঁচা খোঁচা চাপচাড়ি।
গায়ের কফি কালারের শার্টের উপরের একটা বোতাম খোলা।
তোহা আড়ষ্ট কন্ঠে বললো,
—“কি হয়েছে?”

তোহার বেণির বেশিরভাগ চুল জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে গেছে।ঠোঁটটা এখন আবারো শুকনো।মেয়েটা লজ্জা পাচ্ছে।লজ্জা পেলে ওর চোখের পাপড়ি কাঁপে।চোখের নিচে কোলজুড়ে সেই কম্পমান পাপড়ির ঘনছায়া পরে।কি অপূর্বই না দেখায়!
তিহান ঝুঁকে গেলো।তোহার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই মুঁচরে গেলো তোহা।তিহানের শরীরের উষ্মতা এই শীতল রুমটাকেও তপ্ত বানিয়ে ফেলছে।ঘন ঘন নিশ্বাসের শব্দগুলো নৈ:শব্দের মতো কানে বাজছে।
মধ্যকার দূরত্বটা আরো একটু ঘুঁচলো।তিহান তোহার গলার দুইপাশ দিয়ে হাত গলিয়ে একটা গাঢ় নীল পাথরের লকেট সমেত চেনের হুক লাগাতে লাগাতে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,”তোমার উপহার।”

~চলবে~