এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব-৪২

0
955

#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৪২

ঘরটা বেশ ঠান্ডা হয়ে আছে।বাইরে বোধহয় শীতল হাওয়া বইছে।শ্রাবণঝরা বৃষ্টি নামতে পারে।পর্দা উড়ছে।একটু পরপর একফালি আলো ঝলকে পরছে ঘরের সাদা মেঝেতে।বাতি নিভানো।তবে আলোকশূন্য নয় কোনোকিছুই।পাতলা পর্দা ভেদ করে আসা কিরণে সব দৃশ্যমান।তোহার ঘাড়ে গলায় ব্যান্ড-এইড লাগিয়ে দিয়ে তিহান কোমল স্পর্শে তার বামগালে হাত ছোঁয়ালো।চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দিতে দিতে মৃদু স্বরে বললো,”আর কোথাও লেগেছে?”
এতক্ষণ তেজশূন্য ভঙ্গিতে তিহানের বুকে লেপ্টে থাকলেও এই নরম কন্ঠটায় ভেতরের কান্নাটা ফুলে ফেঁপে
উপচে পড়লো তোহার।গালে রাখা হাতটা নামিয়ে নিজের দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে অদ্ভুত আর্তনাদ করে গুঙ্গিয়ে উঠলো সে।সেই সাথে গড়িয়ে পরলো অবিরাম অশ্রুপাত।পান্জাবি ভিজে উঠলো।বুকের উপরের সেই ভেজা জলের অস্তিত্বে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো তিহান।সব কেমন লন্ডভন্ড হয়ে গেলো।তার এই নিষ্পাপ ফুলটাকেই কেনো এতো বেদনা সহ্য করতে হলো?কেনো সে আগে এলোনা?কেনো মেয়েটাকে ওই নরপশুটা ছুঁয়ে দিলো?
তোহার কান্নার বেগ বেড়ে যাচ্ছে।পাহাড়সমান কষ্টে দিশেহারা তিহান উপায় না পেয়ে তোহার মাথাটা বুকের সাথে আরো একটু জোরে চেপে ধরলো।হাত দিয়ে গাল-চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললো,
—“কাঁদেনা,আমি আছিতো।”

তোহার কান্না হুহু করে বেড়ে গেলো।কেমন উন্মাদ হয়ে উঠলো সে।তিহানের বাহু খামছে ধরলো।খুব জোরে।নখগুলো যেনো ভেদ করে গেঁথে যাচ্ছে।তোহা আঁচরে দিচ্ছে।এবড়োথেবড়ো করে।হুঁশ নেই।তিহান বললোনা কিছু।তার বাহু রক্তাক্ত করে যদি মেয়েটার কষ্ট কমে তবে কমুক না।ক্ষতি কি?তোহার হাত থামলো।তিহানের বুকে কপাল ঠেকিয়ে সে আহাজারি করে চিৎকার করলো,
—“আপনি ছিলেননা।আপনি আমার কাছে ছিলেননা।কেউ ছিলোনা।আমি একা ছিলাম”।এটুকু বলতেই বিধ্বংসী রুপটা শান্ত হয়ে এলো।মুখ তুলে একবার তিহানের বাহুতে নজর দিলো।সাদা পান্জাবির উপর দিয়ে বিন্দু বিন্দু রক্তের ছাপ।হাতটা নামালো সে।ধীর গতিতে তিহানের পিঠ জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা গুঁজে দিলো।চোখ বুজে মৃত গলায় বললো,”তারপর লোকটা এলো।চেপে ধরলো।গায়ে হাত দিলো।ঠোঁট ছোঁয়ালো।কাঁমড়ে দিলো।জানেন,আমি চেষ্টা করেছিলাম।অনেক চেষ্টা করেছিলাম।কিন্তু পারিনি।লোকটা ছাড়লোই না।চিৎকার করলাম,কেউ শুনলোই না।ওই স্পর্শগুলো না আমার সহ্য হচ্ছিলো না।কোমড়ে,পিঠে,বুকে,গলায় সব জায়গায়।কেমন দুর্গন্ধ!এরপর..এরপর হঠাৎই আমাকে ছেড়ে দিলো।লিপস্টিক ডলে চুল এলোমেলো করে দিলো।আমি কিছুই করতে পারলাম না।অথচ লোকটা কিছু না করতে পেরেও যেনো সব করে ফেললো।”থামলো তোহা।
কিছুক্ষণ নিরব থেকে ক্রন্দনরত কন্ঠে অভিমান করে বললো,”স্বর্ণা আপু কেনো আরো একটু আগে আসলোনা?আপনি কেনো আসলেননা?আমিতো অপেক্ষা করে ছিলাম।আপনি আসবেন।ছাড়িয়ে নিবেন আমায়।”বলে আবারো দুমরে মুচরে উঠলো আরক্তিম মুখটা।চোখের পানির বাঁধটা ভেঙে গেলো।গড়গড় করে গড়িয়ে পরতে থাকলো তিহানের বুক ভিজিয়ে।
তিহান বুঝলো,জানলো।তোহার সাথে অতিমাত্রায় খারাপ কিছু হয়নি।তবে যেটুকু হয়েছে সেটুকুই বা কম কি?
এই অতিশয় পবিত্র মেয়েটার মনে গভীর কালো দাগ বসিয়ে দেয়ার জন্য এটুকুই খুব যথেষ্ট।আসলেইতো,সে কেনো এলোনা?তার তো দায়িত্ব ছিলো মেয়েটাকে আগলে রাখার।কেনো পারলোনা?পরিপূর্ণতা পাওয়ার শেষ সময়েই কেনো ব্যর্থ হতে হলো তাকে?

“আচ্ছা,আমি কি কলঙ্কিত হয়ে গেছি?”বলেই নির্বোধ শিশুর মতো তিহানের মুখপানে চাইলো তোহা।

তিহানের কঠিন পুরুষচোখেও জলের আনাগোনা।তার একফোঁটা টুপ করে গড়িয়ে পড়লো।তোহার কপালের উপর।চোখের কার্নিশ বেয়ে তা নিচে পরে গেলো নিমিষেই।তিহান সামলালো।তোহার গালে হাত রেখে গাঢ় কন্ঠে বললো,
—“তুমি সবচেয়ে পবিত্র,কলঙ্ক তোমাকে ছুঁয়ে দিতে অপারগ।”

চোখ নামালো তোহা।নিরবে একফোঁটা জল বিসর্জন দিলো।এই লোকটা তাকে পবিত্র মনে করলেও অন্যরাতো তাকে কলঙ্কিতোই মনে করছে।তাদের চোখেতো সে নিকৃষ্ট,অপবিত্র।এই যন্ত্রনা থেকে সে কি করে মুক্তি পাবে?
বেশ কিছুক্ষণ নিরবতায় কাটলো।তোহা বললো,

—“একটা কথা বলি?”

—“বলো।”

—“আপনি আমাকে বিয়ে করেননা।লোকে খারাপ বলবে।”
মূহুর্তেই কানে ঝাঁ ঝাঁ লেগে গেলো তিহানের।ক্রোধানলে হৃদয় পুড়ে ছারখার।তার ভালবাসাটাকে এতোই সস্তা ভাবে মেয়েটা।এর ভিত্তি কি এতটাই নড়বড়ে?এত অকপটে,নির্দ্বিধায় এই কথাটা বলে ফেললো মেয়েটা?এত সহজে?হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করলো তিহান।ক্রোধে শক্ত হয়ে এলো মুখের চোয়াল।কন্ঠে কাঠিন্য নিয়ে সে কোনরকমে উচ্চারণ করলো,”কি বললে তুমি?”

তোহা তাকালো।এক মূহুর্তের জন্য।পরক্ষণেই তিহানের অগ্নিদৃষ্টির সামনে মাথা ঝুঁকে গেলো।দিরুক্তি করলোনা।
তিহান গরম শ্বাস ছাড়লো।পিঠের পিছে বালিশ নিয়ে আধশোয়া হয়ে তোহাকে বুকে জড়িয়ে নিলো।মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো কাঠ কাঠ কন্ঠে বললো,”চোখটা বন্ধ করে রাখো।ঘুমানোর চেষ্টা করো।”

তোহা চোখ বন্ধ করলো।কিন্তু ঘুম আসলোনা।সেই ভয়ংকর মূহুর্তটা মনে পরে গেলো।চকিতে চোখ মেললো। বুকের ধুকপুকানি আবার বাড়ছে।অস্থির লাগছে।হুট করে তিহানের বুক থেকে সরে গেলো সে।তিহান চোখ বুজে ছিলো।তোহার সরে যাওয়ায় চট করে তাকালো।আধশোয়া অবস্থা থেকে একটু উঠে জিজ্ঞেস করলো,”কি হয়ে..”পুরো কথা শেষ হলোনা।তার আগেই তোহা হামলে পড়লো।দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ খুঁজে পাগলের তো কাঁদতে কাঁদতে তুলনাহীন বিষাদ নিয়ে বললো,”আপনি ছোঁয়ায় আগে আমাকে ওই লোকটা ছুঁয়ে দিলো কেনো?”
বেকায়দায় পরে গেলো তিহান।তোহা কস্মিককালেও তার এত কাছাকাছি আসেনি।না এসেছে সে নিজে থেকে।
আমতা আমতা করলো তিহান।তোহার প্রশ্নের উওরটা তার কাছে নেই।মেয়েটাকে শান্ত করার উপায় কি তবে?মস্তিষ্ক শূন্য।সব পরিস্থিতি সামাল দিতে পারলে এখন সে নিজেই বেসামাল হয়ে পরেছে।
তোহা কাঁদছে।হাউমাউ করে।সব কষ্ট যেন ধুয়ে যাচ্ছে সেই পানির সাথে।হৃদয়বিদারক যন্ত্রনা গুলো কান্নারূপে ঝরে পরছে বৃষ্টির মতো।তিহানে কাঁধ ভিজে চুপচুপে।তোহার গায়ের ভারি শাড়ির যাচ্ছেতাই অবস্থা হয়ে আছে।
তিহান দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে আলতো করে হাত রাখলো তোহার বাহুতে।খানিকক্ষণ ইততস্ত করে বললো,
—“তুমি..”
তোহা বাক্য সমাপ্ত করতে দিলোনা।তার আগেই অনুনয়ের স্বরে বললো,
—“আমাকে সরতে বলবেন না।আমি সরবোনা।এভাবেই থাকবো।”
উওরে কিছু বললোনা তিহান।নিজের সাথে একপ্রকার যুদ্ধ করে মৌনমুখে ঠায় বসে রইলো।
তোহার কান্না থামছে।সে হাল্কা হচ্ছে আস্তে আস্তে।চোখ বন্ধ।ক্লান্ত শরীর ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছে ধীরগতিতে।

দরজায় শব্দ।ঠক ঠক ঠক।সাথে আমজাদ সাহেবের ডাক,”তিহান,একটু কথা ছিলো।আসবো?”
তোহা ঘুমিয়ে পরেছে কাঁধে মাথা রেখে।তিহান আলতো করে ধরে সরালো তাকে।বালিশে শুইয়ে দিয়ে শাড়ির আচঁল গুছিয়ে দুরত্ব নিয়ে সোজা হয়ে বসলো।নম্র স্বরে উওর দিলো,”আসো বাবা।”
আমজাদ সাহেব প্রবেশ করলেন।তোহাকে শান্তিতে ঘুমোতে দেখে স্বস্তির শ্বাস ছাড়লেন।ধীরগতিতে বিছানার অপরপাশে বসে ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি টেনে বললেন,”ঘুমিয়েছে তাহলে?”
—“মাত্রই শুয়েছে।”কন্ঠে জোর নেই তিহানের।

আমজাদ সাহেব সময় নষ্ট করলেন না।সোজাসাপটা ভাবে বললেন,
—“অনন্তকে কি করবে?অবস্থা ভালোনা।ওর বাবা মা কে ফোন করা হয়েছে।তোমার খালু দুশ্চিন্তা করছে।মেহমানরা এখনো যায়নি বাসা থেকে।বাজে বকছে।বুঝতে পারছো নিশ্চয়ই?”

—“পারছি।”

আমজাদ সাহেব অপেক্ষা করলেন।ছেলে নিশ্চয়ই কিছু বলবে।তার পূর্ণ বিশ্বাস আছে।
তিহান ভাবলো কিছুক্ষন।কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে তোহার মুখের দিকে চেয়ে শান্ত স্বরে বললো,
—“সবাই যা ভাবছে তেমন কিছু হয়নি বাবা।অনন্ত চেষ্টা করেছে তবে সময় ছিলোনা।স্বর্না তার আগেই এসে পরেছিলো।তিহুকে দেখে যা মনে হয়েছে তা আসলে ঘটেনি।সবাই ভুল ভাবছে।”
আমজাদ সাহেব মৃদু হাসলেন।ঘুমন্ত তোহার মাথায় স্বস্নেহে হাত বুলিয়ে তিহানের দিকে চেয়ে বললেন,”তোমার অতিযত্নে আগলে রাখা মানুষটাকে লোকে বাজে বলছে।তাদের ভুল ধারণা কাটানোর দায়িত্ব কিন্তু তোমারই।”
আমজাদ সাহেব কথাটা শেষ করতেই নড়ে উঠলো তোহা।ঘুমের মাঝেই তিহানের দিকে কাত হয়ে শুয়ে একহাত হাঁতরে তিহানের হাত খুঁজলো।তিহান দুরত্ব নিয়ে বসেছে বিধায় নাগাল পেলোনা।তিহান হাসলো, নিজেই হাত এগিয়ে তোহার হাতের উপর রাখলো।তোহা অবিলম্বে তা আকড়ে ধরে গালের নিচে নিয়ে আবারো ঘুমে তলিয়ে গেলো।তিহানকে বিচলিত দেখালোনা।বাবার দিকে চেয়ে সে নরম তবে একরোখা কন্ঠে বললো,”ওকে ছাড়া আমার কোনোভাবেই সম্ভব না বাবা।”

অনন্ত বসে আছে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে।চেহারার অবস্থা ঢুলুঢুলু।রক্তপাত হচ্ছে এখনো।তূর্য এসে আরো কয়েক ঘা লাগিয়েছে তাকে।আরমান সাহেব,আতিয়াসহ সবাই আছে ড্রইংরুমে।তবে অনন্তকে কেউ ধরছেনা পর্যন্ত।
আতিয়া তোহার কাছে যেতে চাইলেও আরমান সাহেব যেতে দেয়নি।তোহার কাঁটা ক্ষত দেখলে কান্নাকাটি করবে আতিয়া তা দেখে আরো ভেঙে পরবে বাচ্চাটা।তিহান যেহেতু নিয়ে গেছে তারমানে নিরাপদেই আছে তাদের মেয়ে।একটু একান্তে থাকুন দুজন।মেয়েটার মন হাল্কা হবে।তিহানের চোখে যে প্রগাঢ়তা সে আজ দেখেছে তাতে আর কোনকিছু ভাবার অবকাশ নেই।তিহান বলেছিলো কাজি আসলে যেনো তাদের ফ্ল্যাটে নিয়ে যায়।কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কি বিয়ে পড়ানো আদৌ সম্ভব?

বিকেল চারটা…
অনন্তর মা-বাবা এসেছে।বসেছে বসার ঘরে।এই বিকেলে বাড়িতে খুশির বন্যা বয়ে যাওয়ার কথা ছিলো।তা আর হলোনা।একটা আকস্মিক ঝড় সব ওলোট পালট করে দিলো।তিহান থমথমে চেহারায় বসে আছে।রক্তলাল চোখজোড়া অনন্তর দিকে নিবদ্ধ।অনন্তর মা কান্নাকাটি করছেন।ছেলের হয়ে ক্ষমা চাচ্ছেন বারবার।
সেই আঁকুতি কারোর মনই গলাতে পারেনি।এমনকি সোহার্দ্যও বসে আছে চোখেমুখে কাঠিন্য নিয়ে।মায়ের কান্নাটাও তার কাছে তেঁতো ঠেকছে।কিভাবে পারছে মা সব জেনেও এই ছেলের হয়ে ক্ষমা চাইতে?

—“আপনারা যা দেখেছেন তা আসলে ঘটেনি।অনন্ত একটা নিকৃষ্ট কাজ করতে যেয়েও করতে পারেনি।আপনারা যা ধারণা করছেন তা ভুল।সে তিহু..মানে তোহাকে কলঙ্কিত করে ফেলেছে,তোহার ক্ষতি করে ফেলেছে এ ধরণের যা কিছু বলেছে সবই মিথ্যা।এমন কিছুই হয়নি।”রাশভারি কন্ঠে বলে উঠলো তিহান।

তৃতীয় তলার একজন প্রতিবেশি মহিলা তেঁতে উঠলো।গা জ্বালানো কন্ঠে ফোঁড়ন কাটলো,”আমরা সবাই স্পষ্ট দেখেছি মেয়েটার অবস্থা।দেখেই তো বোঝা যায় সব শেষ করে তবেই ছেড়েছে।তুমি বললেই হবে নাকি?”

তিহান আটকে রাখলো নিজেকে।শান্ত শীতল গা হিম করা চাহনী নি:ক্ষেপ করে উঠে দাড়ালো।অনন্তর সামনে যেয়ে একহাঁটু মুড়ে বললো,”তুই কি সত্যিটা বলবি?”অনন্ত তাকালো।নিভু নিভু দৃষ্টি।ভাবলো,তার এই বোকামিটা করা উচিত হয়নি।মেয়েটার ক্ষতি যতটুকু পেরেছিলো করেছিলো তারপর উচিত ছিলো লুকিয়ে বের হয়ে যাওয়া।এভাবে সবার সামনে ধরা দেয়াটা এখন মনে হচ্ছে একদম ঠি ক হয়নি।তিহানের চেহারা,আগুন ধরানো দৃষ্টিতে ভয়ের দাবানলে পুড়ে যাচ্ছে সে।এই লোক যে এত ভয়ঙ্কর সে ভাবেনি।এর আগের বার তো কিছু করেনি।তাই ভেবেছিলো এবারো বৌয়ের শোকে কাতর হয়ে যাবে।
সে উওর দিলোনা।সে যে তোহাকে ছোঁয়া ছাড়া কিছু করতে পারেনি কথাটা স্বীকার করলেতো তার সব কষ্ট পানিতে যাবে।এত মার খেলো।এত অপমান।নাহ্,কিছুতেই স্বীকার করা যাবেনা।
তিহানের মুখের অবস্থা ভয়ংকর।আচমকা দুহাতে অনন্তর দুহাতের কব্জি ধরে মুঁচরে ধরলো সে।আর্তনাদ করে উঠলো অনন্ত।তিহান আরো একটু ঘুরিয়ে মুচরে ধরলো হাতজোড়া।রুগ্ন উত্তেজিত হয়ে বললো,”বল।”

হাল ছেড়ে দিলো অনন্ত।এ ব্যাথা সহ্য করার নয়।মনে হচ্ছে হাড্ডি ভেঙে যাচ্ছে।কোনরকমে বললো সে,”আমি স্বীকার করছি।তোহাকে হাত দিয়ে স্পর্শ করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারিনি।মিথ্যা বলেছি তখন।চুল,লিপস্টিক আমি ইচ্ছে করেই লেপ্টে দিয়েছিলাম।আমাকে..”আরো কিছু বলার আগেই একটা হৃদয় কাঁপানো বিভৎস্য জিনিস ঘটে গেলো।অনন্তর দুহাত মচকিয়ে কনুই থেকে ভেঙে ফেলেছে তিহান।গগনবিদারী চিৎকার করলো অনন্ত।কানে তালা লেগে গেলো সবার।তিহানের রাগের বহি:প্রকাশ দেখে থমকে গেলো পরিবেশ।
অনন্তর মা কাঁদছে।মরা কান্না।তিহান উঠে দাড়ালো।আরমান সাহেবের দিকে চেয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললো,”ওসব পুলিশে আমি বিশ্বাস করিনা খালু।এদের যে টাকা।দু দিনেই বেরিয়ে যাবে।যে হাত দিয়ে ও তিহুর সর্বত্র ধরেছিলো।সেই হাতটা আমার পক্ষে অক্ষত রাখা সম্ভব হলোনা।”

আরমান সাহেব হতভম্ব।মূর্তির ন্যায় দাড়িয়ে আছে প্রতিটি সদস্য।কেউ কেউ ভয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে।অনন্ত অজ্ঞান।তিহান ডাইনিং টেবিল থেকে পানি নিলো।অনন্তের মুখে ছিঁটা দিতে দিতে সবার দিকে তাকিয়ে বললো,
—“আপনাদের মধ্য কেউ আর কখনো তোহাকে খারাপ কিছু বলার আগে দু’বার ভাববেন।ও শুধু বাজে পরিস্থিতির শিকার।আর কিছুইনা।”

আসরের আযান দিয়ে দিয়েছে।বাইরে ঝড় নামছে।গুমোট কালো মেঘের আঁধারে ছেঁয়ে গেছে শহর।তোহা ঘুমোচ্ছে তখনো।নিশ্চিন্তে,নিরবে।মাথার কাছে বসে আছে আতিয়া।তাকে ডেকে এনে তোহার কাছে বসিয়ে রেখে তিহান গেছে ওই ফ্ল্যাটে।অনন্তর মা-বাবা এসেছে।কিছু একটা হয়তো হচ্ছে সেখানে।
তার মেয়েটার মুখটা পানসে,ফ্যাকাশে।দু গালে শুকিয়ে হাল্কা দাগে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে কান্নার সরল রেখা গুলো।আতিয়ার চোখ দিয়ে টুপ করে একটা পানির ফোঁটা পরলো।মেয়েকে খুব করে বধুবেশে দেখার শখ হয়েছিলো তার,এভাবে বিধস্ত অবস্থায় নয়।ধুমধাম শব্দ।সাথে অনেকগুলো পদচারণ।আতিয়া চকিতে সোজা হয়ে বসলো।বিকট শব্দে ঘরের দরজা খুলে যেতেই ঘুম ভাঙলো তোহার।অনন্ত সামনের ফ্লোরে ছিঁটকে পরেছে।পিছে তিহান,তূর্য,বাবা,খালুরা।
আলুথালু অগোছালো আবেশেই ধরফরিয়ে উঠে বসলো তোহা।মুখ চুপসে গেছে।অনন্তকে দেখে ভয়ে কাঁপছে হাত-পা।খুব দ্রুত ঘেমে যাচ্ছে শরীর।পাশে তাকিয়ে একবার মাকে দেখলো তোহা।ভরসা পেলো।আঁকড়ে ধরলো মায়ের হাত।চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললো।কেনো যেন মনে হচ্ছে অনন্ত আবারো হামলে পরবে, আবারো তাকে ছুঁয়ে দিবে সেই নোংরা হাতে।কেউ বাঁচাতে পারবেনা।সে আবারো বাজে স্পর্শের দংশনে দংশিত হয়ে যাবে।
তিহান কাছে আসলো।তোহার পাশে বসে তাকে কাছে টেনে নিয়ে ধীর গলায় বললো,”এখনতো আমি আছি।ভয় নেই।চোখ খুলো।”

তোহা চোখ খুললো।অনন্তর দিকে না তাকিয়েই ভয়ার্ত গলায় থেমে থেমে বললো,”উনাকে নিয়ে যান প্লিজ।উনি আবারো..আমি..নিয়ে যাননা।আমার ভয় করছে।”

তিহান শক্ত করে ধরলো তাকে।ভয় এখন না কাটলে মেয়েটা সারাজীবন এটা বয়ে বেড়াবে।যা সে হতে দিবেনা।তোহার উৎকন্ঠা,ভয়ার্ত চেহারা দেখে ভিজে উঠলো উপস্থিত সবার চোখ।তিহান গলার স্বর তীব্র করলো।বললো,
—“তুমি তাকাবে নাকি না?”

তোহা তাকালো এবার।একেবারে অনন্তর দিকে।তার রক্তাত্ব চেহারা,বিভৎস্য ভাবে ঝুলে থাকা হাত দেখে মূহুর্তেই মাথা ঘুরে উঠলো তার।তিহান তার কানের কাছে মুখ নিয়ে তৃপ্তিভরা কন্ঠে বললো,
—“এই হাত দিয়ে ও আর কখনো বাজে ছোঁয়া দিতে পারবেনা।”

তোহা চিৎকার দিলো।হাঁসফাঁস করলো।অনন্তর হাতটা কেমন দুলছে।অনন্ত ক্ষমা চাচ্ছে।জড়ানো কন্ঠে বলছে,”ক্ষমা চাচ্ছি,আমাকে ছেড়ে দেন।”
যদিও মনে মনে একটা প্রচন্ড রকমের শান্তি হচ্ছে তবুও এই বিভৎস্য হাতের দৃশ্য বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারলোনা তোহা।জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পরলো তিহানের বুকের উপর।

~চলবে~