এক শ্রাবণ হাওয়ায় ২ পর্ব-৩৬+৩৭

0
699

#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৩৬
‘ সমস্যা কি তোমার?’

ভরাট কন্ঠ আনভীরের। আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না৷ চুপচাপ কথা এড়িয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম অন্য দিকে। উনার চোখেমুখে স্পষ্ট ক্রোধ। ক্রমেই সেটা প্রকাশ পাচ্ছে নিখুঁতভাবে। আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম,

‘ আমার কোনো সমস্যা নেই।’

‘ তাহলে……..এড়িয়ে যাচ্ছো কেনো আমায়?’

কথাটি বলে আরেকটু সামনে এগোলেন আনভীর। দাঁড়ালেন একেবারেই আমার কাছাকাছি। আমি গাড়ির সামনের সাইডে বসে ছিলাম বলে উনার উচ্চতা আমার সমান সমান এখন। সেই সুবাদে উনার ঘোলাটে চোখজোড়ার তীক্ষ্ণ চাহিনীর উপেক্ষা করা যেমন কঠিন, তেমনই অসম্ভব মুখ ফুটে কথা বলা। আমি দ্বিধায় আছি। এদিকে অপূর্ব ভাইয়ার ভয় আর এদিকে উনাকে সত্য না বলতে পারার ভয়ে ক্রমেই বিষিয়ে যাচ্ছি। আমি নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শক্ত করলাম। মৌন স্বরে বললাম,

‘ আপনাকে এড়িয়ে যাচ্ছি না আমি আনভীর। আমি শুধু এখন একাকীত্ব চাচ্ছি।’

‘ আর সেটা কেনো?’

উনার পাল্টা প্রশ্ন। এর উত্তর আমার জানা নেই। তাই হতাশ হয়েই বলি,

‘ জানা নেই।’

‘ লিসেন আহি! আমি আগেও বলেছিলাম এখনও বলছি, ডোন্ট ট্রাই টু কনফিউজ মি। নিজেকে খুব স্মার্ট ভাবো তুমি তাই না? তাই তো বেশ চালাকির সাথেই এড়িয়ে যাচ্ছো আমায়। তোমার এই ওভার স্মার্টনেস নাহিদ বা অন্য সবার চোখে পড়লেও আমার সাথে চলবে না। আই এম হান্ড্রেট পার্সেন্ট শিউর কিছু লুকাচ্ছো তুমি আমার কাছ থেকে।’

আমি মলিন হাসলাম। বলে উঠলাম,

‘ আর আপনি কিছু লুকান নি?’

সচকিত হলেন আনভীর। আমার অস্থিরভাব পাল্টে আজকের শীতল ব্যবহার উনাকে ভাবিয়ে তুলেছেন আচমকা। বিস্ময়ে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,

‘ মানে?’

‘ বলছি, সবসময় কি আমিই কথা লুকাই? আপনি কখনও আমার কাছ থেকে কিছু লুকান নি?’

প্রশ্নটা আমি করতাম না। কখনোই করতাম না যদি অপূর্ব ভাইয়া বিষয়টা মাথায় না ঢুকিয়ে দিতো। হয়তো অপূর্ব ভাইয়া মানুষটা খারাপ, কিন্ত এটা আনভীরের কোনো একটি ব্যাপার ঠিকই ধরতে পেরেছেন উনি। নাহলে কেন বললেন উনার অতীত ঘাটতে? এ বিষয়ে প্রশ্ন ছিলো আমারও। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন কেন রাহি আপুকে ঘৃণা করেন উনি? আনভীর সবসময় বলেছেন রাহি আপুর জন্যই নাকি উনি ফ্যামিলি থেকে আলাদা হয়েছেন। কিন্ত কেনো? আর আমার হয়ে কেনো অপূর্ব ভাইয়ার প্রতি রিভেন্জ নিতে চাচ্ছেন উনি। এর মানে কি অপূর্ব ভাইয়ার কথাই সত্যি দাঁড়ায় যে আনভীর কিছু লুকাচ্ছেন?

আনভীর হঠাৎ চুপ করে গেলেন আমার এ প্রশ্নে। আমি আবার বললাম,

‘ চুপ হয়ে গেলেন যে?’

‘ কারন তোমার এই ব্যবহার ভাবিয়ে তুলছে আমায়। আগে তো এরকম ছিলে না?’

‘ কারন আগে এরকম কিছু আমি ভাবিনি তাই।’

আনভীর প্রগাঢ় দৃষ্টি দিলেন আমার দিকে। ক্ষোভ নিয়ে বললেন,

‘ কথা পাল্টানোর মতো চালাকি করবে না। আমি বলেছিলাম না যখন সময় হবে তখন সবটাই ক্লিয়ার হবে? এখন ক্লিয়ারলি বলো, এড়িয়ে যাচ্ছিলে কেনো আমায়? আজ সারাদিন কল রিসিভ করলেনা কেনো?’

‘ কাজের প্রেশার ছিলো।’

‘ এতই প্রেশার যে কল ধরার টাইম নেই?’

‘ অনেকটাই তাই।’

আমি নামার চেষ্টা করতেই আনভীর বাঁধা দিলেন। আমি সচকিত হয়ে তাকালাম উনার দিকে। উনার উথাল পাতাল বিক্ষিপ্ত নিঃশ্বাস নিঃড়ে পড়ছে আমার মুখে। মুখভঙ্গি অগোছালো। সেই অগোছালো মুখ বলছে অজস্র কথা। আনভীর কন্ঠস্বর কোমল করলেন। নীরবে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,

‘ আমি জানি যে অপূর্বের কথায় তুমি এখনও ট্রমাতে আছো আহি। বাট রিমেম্বার দ্যাট! অপূর্ব বললেই তুমি তো আর আমার আশ্রিতা হবেনা, তাই না?’

‘ হুম।’

‘ তুমি আমার ওয়াইফ আহি। হোক কয়েকটা বিশেষ কারনে সেটা জনসম্মুখে এখনও অপ্রকাশিত কিন্ত আমরা তো স্বামী-স্ত্রী, এটা মানো?’

‘হ-হ্যাঁ।’

‘ তাহলে? কার ভয় পাচ্ছো তুমি?’

হঠাৎ চোখ অশ্রুতে টুইটুম্বুর হয়ে উঠলো আমার। সময় অতিক্রম না করে আনভীরের বুকে তাই মাথা গুঁজলাম। ক্ষণে ক্ষণে কান্নার শব্দ ছাড়া আর কিছুই করতে পারছিলাম না। একজন মেয়েই জানে যে সেই ভয়াবহ কথাগুলো কতটা তিক্তকর। আনভীর চুলে আস্তে করে হাত বুলিয়ে দিতে মগ্ন হয়ে পড়লেন এবার। আমি বললাম,

‘ আপনার জন্য…..আপনার জন্য ভয় পাচ্ছি আমি আনভীর। আমার সমস্ত ভয় আপনাকে ঘিরেই। আপনি…আপনি জানেন না ওরা কতটা ভয়ঙ্কর। আমার ওই প্রোপার্টি চাই না আনভীর। আমি আগেই বলেছিলাম। মায়ের ওই সিদ্ধান্তই আমার জীবনটাকে এই নরকে পুঁতে ফেলেছিলো। ওরা আমাকে এখন চায় শুধুমাত্র ওই জন্যেই। আর এতে বাঁধা আপনি হয়ে দাঁড়িয়েছেন। আপনি কি ভাবেন ওরা এমনেই আপনাকে ছেড়ে দিবে? আমি আপনার কোনো ক্ষতি মানতে পারবো না আনভীর। ওরা মানুষের চেয়েও অধম…..!’

আনভীর সর্বস্বরে সামলে নিয়েছেন আমায়। নিঃশব্দতা কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর আগ্রাসী কন্ঠে বললেন,

‘ ওরা কিছু করতে পারবে না আমার আহি। তুমি শুধু আমার প্রত্যেকটি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবে। ওরা যতটা না ভয়ঙ্কর, আমি এর থেকে দ্বিগুণ ভয়ঙ্কর হতে পারবো তোমার জন্য।’

রাত বাড়ছে হু হু করে। সেই সাথে বহমান শীতল বাতাস। উনার আগ্রাসী কন্ঠ আমার দেহে এক অন্য মাদকতার প্রতিফলন ঘটালো। আমি তাই কথা বললাম না আর। চুপচাপ গুটিশুটি হয়ে থাকলাম উনার বুকে।

___________________

নাহিদ ভাইয়া কোনো একটা কারনে বিরক্ত আমার ওপর। প্রচন্ড রকমের বিরক্ত। কিন্ত এই বিরক্তির কারন কি তা আমি আঁচ করতে পারলাম না। আমি চুপচাপ ব্রেকফাস্ট করছি আর সামনে মুখ চুপসে বসা নাহিদ ভাইয়া। পাশেই আনভীর নীরবে খাচ্ছেন। নুড়ী আপা এসে নাহিদ ভাইয়ার গ্লাসে জুস ঢেলে দিলো। বললো,

‘ আজকে এত চুপচাপ যে ভাই?’

‘ ওহ! শেষমেষ তুমিই তাহলে বুঝলে নুড়ী আপা। নইলে সামনে যেই দু’জন শুধু মুখে খাবার ঠুসে যাচ্ছে তাদের কাছে তো আমি একজন অধম ছাড়া আর কিছুই না।’

বোধগম্য হলো না আমার নাহিদ ভাইয়ার কথা। তাই সপ্রশ্নে মাথার ঘুরালাম আনভীরের দিকে। উনি প্রতি উত্তরহীন। একঝলক শীতল চোখে নাহিদ ভাইয়াকে পরখ করে আবার খাবারে মনোনিবেশ করলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম,

‘ কি হয়েছে আপনার?’

‘ আপনার বরকেই জিজ্ঞেস করেন। একদিনের ছুটি চেয়েছিলাম। বলেছি আজকে আসিফকে সাথে রাখতে। পেন্ডিং কাজগুলো আমি রাতে করবো। কিন্ত তা আর করতে দিলো কই?’

‘ আপনি হঠাৎ ছুটি চাচ্ছেন যে?’

বিষম খেলেন ভাইয়া। আমতা আমতা করে বললেন,

‘ ইয়ে, মানে, এভাবেই!’

এবার মুখ খুললেন আনভীর। বললেন,

‘ ওকে বলে দাও আহি যে কারন ছাড়া আমি ছুটি দিবো না।’

অপ্রসন্ন হয়ে গেলেন ভাইয়া। শেষমেষ একটা ক্ষীণ আশা নিয়ে বললেন,

‘ আসলে ভাবি, আজকে তো আপনার মামাতো বোন নীলু আসবে। মানে, আপনার কি বাইরে যাওয়ার প্ল্যান আছে তার সাথে? যদি থাকে, নির্দ্বিধায় বলেন। আমি নিয়ে যাবো।’

আমি বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকলাম ভাইয়ার দিকে। নাহিদ ভাইয়ার এমন খামখেয়ালি স্বভাব আমার এই প্রথম দেখা। নাহিদ ভাইয়ার এমন আগ্রাসী চেতনার জন্য বুঝতে পারছিনা কি বলবো। এটা সত্যি যে আজকে নীলু আসবে এখানে। অনেকদিন ধরে ওর সাথে কথা হয়না তাই একটু ঘুরতে চেয়েছিলাম ওর সাথে। আনভীর এবার খাওয়া শেষ করে ন্যাপকিন দিয়ে মুখ মুছে নিলেন। ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,

‘ চল্ এখন। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

হতাশ হলেন নাহিদ ভাইয়া। বললেন,

‘ ঠিক আছে।’

উনারা চলে যাওয়ার পর আমি নুড়ী আপাকে বললাম দরজা লাগিয়ে দিতে। আজকে নীলু আসবে বলে হসপিটালে যাইনি আমি। তারপর ল্যাপটপ নিয়ে একটা মুভি চালু করলাম নেটফ্লিক্সে। দুপুরে ধ্রুব স্যার ফোন দিয়েছিলেন কথা বলার জন্য। হসপিটালের কয়েকজন মিলে এমনিতেই ডিনার থ্রো করছেন তাই উনি চাইছিলেন যে আমিও যাই। তবে আনভীরের কথা ভেবে আপত্তি জানালাম আমি। উনি অনেক মানানোর পর অবশেষে রাজি হয়েছিলাম। তবে কল কাটার পর দেখি যে আনভীর এর মধ্যে বহুবার কল দিয়ে ফেলেছেন। পাগল নাকি ইনি! বুঝে না যে কল বিজি আছে? আমি দ্রুত কল ধরলাম এবার। বলি,

‘ হ্যালো?’

অপরপাশে আনভীর নিশ্চুপ। আমি স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি উনার নিঃশ্বাসের শব্দ। সেটা যে স্বস্তির বুঝতে বাকি রইলো না। আমি পুনরায় বললাম,

‘ হ্যালো আনভীর?’

‘ কল ধরোনি যে? এতবার কল দিচ্ছিলাম বুঝোনা যে কেন কল দিয়েছি? এভাবে আমায় বিপদে ফেলে তোমার ভালোলাগে?’

শেষ কথাটি খানিকটা রেগে বললেন উনি। আমি প্রথমে না বুঝতে পারলেও পরে ঠিকই বুঝেছি এর কারন। অপূর্ব ভাইয়ার সেই ইন্সিডেন্ট এর পর উনি আরও প্রোটেকিভ হয়ে পড়েছেন আমায় নিয়ে। আমি মিনমিনিয়ে বলে উঠি,

‘ অন্য একজনের সাথে কথা বললে আপনার কল রিসিভ করবো কিভাবে?’

‘ কার সাথে কথা বলছিলে?’

‘ ধ্রুব স্যার।’

কথাটি বলে জিভ কাটলাম অজান্তেই। এই মুহূর্তে তার নাম বলে আগুনে ঘি ঢেলেছি এমন হয়ে দাঁড়ালো ব্যাপারটা। প্রথম কিছুসেকেন্ড চুপ ছিলেন আনভীর। অতঃপর বললেন,

‘ হসপিটালে যেহেতু যাওনি তাই জরুরি কল করেনি ও। কেন ফোন দিয়েছিলো?’

এবার মিথ্যে বলার সুযোগ নেই। তাই বলি,

‘ ডিনারের জন্য অফার করেছিলো।’

‘ আর তুমি কি বলেছো?’

‘ রিকোয়েস্ট করেছিলো বলে না করতে পারিনি।’

আনভীর আবার চুপ হয়ে গেলেন। হঠাৎ ওপর পাশ থেকে শুনলাম,

‘ স্ক্রিপ্ট রেডি এআরকে। জলদি আসুন আমাদের সাথে।’

‘ আসছি।’

আনভীর কল কেটে দিলেন এবার। আমি ভেবেছিলাম এবারের মতো আমি বেঁচে গিয়েছি। কিন্ত পাঁচমিনিট পর যেই মেসেজ আসলো সেটা যেন সমস্ত স্বস্তি কাটিয়ে দিলো। আনভীর লিখেছেন,

‘ রেডি থাকো বেবিগার্ল। ধ্রুবর জায়গায় বদলি হয়ে এআরকের সাথে ডিনারে যাবে আজ!’

আমি হতাশ হয়ে ফোন রাখলাম। হিংসা কাহাকে বলে কত প্রকার, কি কি, এসব আনভীরকে দেখেই জানা সম্ভব।
.
.
.
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ

ভুলক্রুটি মার্জনীয়।

#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৩৭
অবলীলায় বিকেল অতিবাহিত হওয়ার পর সন্ধ্যায় ঢাকাকে দেখা যায় এক অন্য রূপে। এ শহরটা অনেক বড় আর রহস্যময় লাগে আমার কাছে। যেমন রয়েছে ঘিন্জি পরিবেশ, তেমনি ভাবে রয়েছে আভিজাত্য এলাকা। আর আনভীর যেই কলোনিতে থাকে সেটা আভিজাত্যেরই প্রমাণ দেয়। কিন্ত আজ এই সন্ধ্যের সময়টাকে আপনমনে উপভোগ করতে পারিনি আমি। এর একটি কারন দুপুরে আনভীরের সেই মেসেজ। যেটা সময়ের পরিক্রমায় আমায় অস্থির থেকেও বেশি অস্থির করে তুলেছে।

নীলু চুপচাপ খাটে বসে দেখে যাচ্ছে আমার কার্যকলাপ। কলেজে পড়ুয়া এই মেয়ের চলা ফেরা উদ্ভট ধরনের হলেও বিচক্ষণতা যেন তুঙ্গে। বিকেলেই এসে পড়েছে ট্রেনে চেপে ব্যাগপত্র নিয়ে। রেলস্টেশন নিয়ে নিয়ে এসেছে আনভীরের একজন বিশ্বস্ত ড্রাইভার। এসে মেয়েটা কই ভেবেছিলো আমার সাথে জম্পেশ আড্ডা দিবে কিন্ত আমার এই অস্থিরতা ক্রমেই ওকে বিরক্ত করে তুললো। হাই তুলে অবশেষে প্রশ্ন ছুঁড়লো,

‘ কাহিনী টা কি রে আপু বল তো! সেই কখন এসেছি। এসেই দেখছি তুই একাই ভ্রমরের মতো ঘরে কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলে যাচ্ছিস। কিছু হয়েছে?’

আমি ঠোঁট কামড়ে ভীত চোখে নীলুর পানে তাকিয়ে থাকি কিছুক্ষণ। কেননা বুঝতে পারছিনা না যে ঘটনাটি বলবো কি-না। অবশেষে ফোস করে বলেই ফেললাম,

‘ আ-আনভীর ড-ডিনারে নিয়ে যেতে চ-চায় আমাকে?’

নীলু প্রতিক্রিয়াহীন ভাবে আমার কথার মানে বুঝতে চেষ্টা করলো কিছুক্ষণ। মৌনতা কাটয়ে বললো,

‘ তোকে ডিনারে নিয়ে যেতে ইচ্ছুক?’

‘ শুধু ইচ্ছুক না নীলু, উনি আজকেই আমায় নিয়ে যাবেন ডিনারে। পাল্টা কোনো কথা শুনেননি আমার।’

প্রথমে নীলু থম মেরে বসে থাকলেও কিছুক্ষণ পর ওর চোখে মুখে দেখা গেলো উল্লাসের হাসি। আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলে উঠলো,

‘ তাহলে তুই হাইপার কেন হচ্ছিস আপু? ও মোর আল্লাহ! আজীবন টিভি সিরিয়ালেই এমন সুযোগ দেখে আসলাম। ভুলে যাসনা আপু তোর বর কে? তার সাথে ডিনারের কল্পনা অজস্র ফ্যানরাই শুয়ে বসে করে। আর সে নিজ থেকে তোকে অফার দিচ্ছে। আর যদি সেটা ক্যান্ডেল লাইট ডিনার হয় উফফ্! আমি তো কল্পনা করেই মরে যাচ্ছি। আর তুই এমন অস্থির হচ্ছিস?’

আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে থাকলাম নীলুর দিকে। এই মেয়ে তো জানে না তার কল্পনার চার্মিং প্রিন্স এআরকে কতটা অসভ্য আর ভয়ঙ্কর ধরনের মানুষ। কথা তো বলে না যেন গুলিবর্ষণ করে। এমন কয়েকটা ধারালো বেলাজ কথা বলবে, ইচ্ছে করে যে ওখানেই লজ্জায় কেটেকুটে একাকার হয়ে যেতে। নীলু এবার তাড়া দিতে থাকলো আমায়। বলে উঠলো,

‘ সেই কখন বলেছে আর এখন তো সন্ধ্যা গড়িয়ে এলো। শাড়ি-টাড়ি কিছু চুজ করেছিস?’

‘ ন-না। কিন্ত আমার কথা একবার………’

আমায় আর বলতে দিলো না মেয়েটা। কাঙ্খিত উত্তর শুনে হতাশ হয়ে বললো,

‘ তাহলে জলদি চুজ কর যে কি পড়বি! এমন সুযোগ কমই আসে গো আপু। তোর জায়গায় আমি থাকলে আজ সারা বিকেল সন্ধ্যা ভেবেই কাটিয়ে দিতে যে কিভাবে উনার সামনে নিজেকে রিপ্রেজেন্ট করবো। তুই আসলেই একটা গাধি!’

আমায় ঠেলেঠুলে আয়নার সামনে দাঁড় করালো এবার। আলমারি থেকে বেশ কয়েকটা ড্রেস বের করে দেখতে লাগলো যে কোনটা আমার মানাবে। আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম নীলুর দিকে। আমার থেকে ওর এক্সাইটমেন্টটাই বেশি দেখছি আমি। নীলু সচকিত গলায় বললো,

‘ উমম্! ব্ল্যাকটা দারুন মানাবে তোকে। তাহলে তুই ব্ল্যাক শাড়ি পড় আজ।’

‘ এই না!

আমার হঠাৎ চিৎকারে বিরক্ত হলো নীলু। প্রশ্ন করলো,

‘ শাড়ি পড়লে হবে টা কি শুনি?’

আমি কথা বলতে পারলাম না। একেতো শাড়ি পড়ায় অভ্যস্ত নই। আর দ্বিতীয়ত শাড়ি নিয়ে করুন স্মৃতি জড়িতে আছে আমার। আমার কালো মুখ দেখে হয়তো সেটা আন্দাজ করতে পারলো নীলু। বলে উঠলো,
‘ পুরনো ঘটনাগুলোর জন্য তুই নিজের বর্তমানকে নষ্ট করবি আপু?’
আমি নিশ্চুপ। নীলু আবার বললো,

‘ দেখ্, অপূর্ব ভাইয়া তোর পাস্ট। একটা ভয়ঙ্কর পাস্ট যেটা ভুলে যাওয়াই ভালো। তাহলে তার জন্য তুই এখন কেন কষ্ট পাচ্ছিস? আমি যতটুকু জানি এআরকে অসম্ভব ভালোবাসে তোকে। আমি কিন্ত টিভিতে, নিউজ পেপারে সব জায়গায়ই ঘটনাটা দেখেছি আপু। টানা তিনদিন উনি হেডলাইনে ছিলেন। উনি লিভ টুগেদারে আছেন কার সাথে আর কেনই বা সেরাত হসপিটালে অপূর্ব হাসানকে মারলেন এটা নিয়ে বিব্রতকর প্রশ্ন ছুঁড়েছে জার্নালিস্টরা। তবে উনি একবারও তোর নাম বলেনি এটা জানা সত্বেও যে এতে উনার ক্যারিয়ারে রিস্ক আছে।
এ সমাজ ভালো না রে আপু। যতই তুই নিজেকে আনভীরের ওয়াইফ বলিসনা কেন, সমাজ যেহেতু দেখেনি তাই বলবে তুই এআরকের আশ্রিতা। আর তোর ক্যারেক্টারে যাতে কেউ আঙুল না তুলতে পারে তাই সময় হলেই সবার সামনে বলবে তুই কে। শুধু সুযোগের অপেক্ষা। উনি বাবাকেও বলেছেন এ কথা।’
নীলুর প্রতিটা কথাই আমি শুনলাম গভীর মনোযোগ দিয়ে। আনভীর নিঃসন্দেহে আমার জন্য নিজেও ক্যারিয়ারও ঢালে ফেলে দিতে পারবেন, এ আমি নিশ্চিত। আমি তাকালাম নীলুর দিকে। বললাম,

‘ এখন শাড়ি পড়ার ভালো টাইম না নীলু। সময় যখন হবে, তখন অবশ্যই আমি পড়বো, শুধুমাত্র উনার জন্য।’

___________________________________

ঘড়ির কাটা গিয়ে ঠেকেছে আটের কোঠায়। আটটা বাজা মাত্রই নীলুর মোবাইল ওয়াচে বিপ বিপ সাউন্ড হলো এবার। আমি আর নীলু চুপচাপ সুইমিংপুলের সামনে বসে আছি। অপেক্ষা করছি আনভীর আর নাহিদ ভাইয়ার আসার। কিছুক্ষণ পূর্বেই আনভীর টেক্সট করলেন যে উনার আসতে আর ত্রিশ মিনিট লাগবে। তাই রেডি হয়ে অগত্যাই অপেক্ষা করতে থাকলাম।
একটা ব্ল্যাক কালার থ্রি পিস পড়েছি আমি। সাথে সিলভার কারুকার্যের ওড়না। এই ড্রেসটা আজরান ভাইয়া গিফ্ট করেছিলো আমায়। আর উনার চয়েস বলতে হবে নিঃসন্দেহে পার্ফেক্ট।তাই শিউলি ভাবির জন্য উনার চুজ করা জিনিস দারুন লাগে আমার কাছে।
এদিকে ধ্রুব স্যার বেশ কয়েকবার কল দিয়েছিলো আমায়। কারনটি আমি জানি। বিকেলে উনাকে মেসেজে বলে দিয়েছিলাম যে আমার একটা প্রোগ্রাম আছে। আসা সম্ভব না। উনি সেটা সিন করেন কিছুক্ষণ আগে। এর মধ্যে কয়েকবার কল দেওয়াতে আমি বিমর্ষ হয়ে মোবাইল সাইলেন্ট করে দিলাম।
নীলু সুইমিংপুলের একপ্রান্তে বসে পা ভিজাচ্ছিলো। আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ নার্ভার্স ফীল করছিস আপু?’
আমি প্রতিউত্তর দেইনি। একটুনা র্ভাস ফীল হওয়াটা আমার স্বাভাবিক মনে হলো। কারন এটা আমার একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা। নীলু উঠে আমার কাছে ঘেঁষে বসল এবার। দুষ্টু হেসে বললো,

‘ চিল আপু! তুই তো এমন ভাব করছিস উনি বুঝি তোর পর কেউ। এমন করলে তো পুরো মজাটাই বিগড়ে যাবে। এবার আমার কথা ভালো করে শোন, বর হয় তোর। হাসিমুখে কথা বলবি, প্রেম প্রেম নিয়ে কথা আগাবি, প্রয়োজন পড়লে দু’তিনটা চু’মুও ফ্রিতে সাপ্লাই করবি। পারবি তো?’

বিস্ফোরিত নয়নে তাকাই আমি নীলুর দিকে। জোড়ালো গলায় বলে উঠলাম,
‘ মরে গেলেও পারবো না।’
‘ কি মরে গেলেও পারবেন না ভাবি?’
হঠাৎ পেছন থেকে একথা শুনে ভড়কে পেছনে তাকালাম আমি। নাহিদ ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। পুরো কথাটি শুনেনি বিধায় স্বস্তি পেলাম। নাহিদ ভাইয়ার চোখে মুখে রাজ্যের ক্লান্তি। দেখেই বুঝা যাচ্ছে ভালোই ধকল গিয়েছে উনার উপর। কিন্ত যেই না নীলুর মুখে উনার চোখ পড়লো ফানুসের মতো রঙ পাল্টালো উনার মুখশ্রী। অপ্রস্তুত হয়ে এবার আমায় বললেন,
‘ আন-আনভীর ভাই গাড়িতে ওয়েট ক-করছে আপনার ভ-ভাবি! যেতে বলেছে আপনাকে।’

আমি তাকালাম নীলুর দিকে। বললাম,

‘ একা থাকতে পারবি?’

নীলুকে বলতে না দিয়েই নাহিদ উশখুশ ভাবে বললো,

‘ আমি আছি না? কোনো সমস্যা হবেনা।’

নীলু প্রতিক্রিয়া করলো না এ কথায়। আমি তাই ওদের বিদায় জানিয়ে পা বাড়ালাম বাইরের দিকে। লনের পাশে মার্বেল বাধাঁ রাস্তায় কালো গাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির সামনে। ভেতরে আনভীর আছে কি না বোঝা গেলো না। আমি দাঁড়ানো মাত্রই ভেতর থেকে দরজা খুলে দিলেন আনভীর। গাড়িতে বসে পড়ি আমি। আনভীরের দিকে তাকানো মাত্রই আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।

একটা সাদা শার্টের ওপর ব্ল্যাক ব্লেজার আর ব্ল্যাক প্যান্ট পড়াতে দারুন মানাচ্ছে উনাকে। সকালে এটা পড়ে বের হননি। বুঝাই যাচ্ছে পরবর্তী সময়ে পড়া। আমি আড়ষ্ট গলায় বললাম,

‘ গুড ইভনিং!’

প্রতিউত্তর দিলেননা উনি। ঠায়ভাবে তাকিয়ে রইলেন আমায় দিকে কিছুক্ষণ। এমন চাহিনীতে আমি অপ্রস্তুত না হয়ে পারলাম না। অস্থির দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাতে থাকলাম তাই। নিস্তব্ধতা গ্রাস করে ফেলেছে সবকিছু। পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হয়ে যাচ্ছে। আনভীর ঘোরলাগা কন্ঠে ডেকে বললেন,
‘ আহি!’

‘ জ-জ্বী?’

আনভীর ঠোঁট ভিজালেন হালকা করে। ভারী কন্ঠে ফোস করে বললেন,

‘ আমার তোমার মতো একটা কিউট মেয়ে বেবি চাই বুঝলে? তাই নিজেকে প্রস্তুত রাখবে। আজকাল তুমি যেভাবে আমায় পাগল করছো, হয়তো ক’দিন পরই বাবা-মাকে সুসংবাদ দিতে হবে।’
.
.
.
.
.
.
#চলবে…….ইনশাআল্লাহ!