এক শ্রাবণ হাওয়ায়-২ পর্ব-৫০+৫১

0
633

#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৫০

পাহাড়ি বুনো গন্ধ ভেসে আসছে নাকে। চোখ খুলে পাহাড়ি পথের আকেবাকেঁ নিজেকে আবিষ্কার করলাম। অর্থাৎ খাগড়াছড়িতে এসে পড়েছি আমরা। পুরো পিকনিক বাসটা এখনও ঘুমে মগ্ন। আকাশে সবেমাত্র আলো ফুটে ওঠা শুরু করেছে। এসময় পাহাড়ে ঘেরা এই দৃশ্যগুলোকে লাগছে মায়া কাননের মতো। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকালাম। হঠাৎ অপ্রত্যাশিত মানুষটিকে দেখে চমকে উঠলাম বেশ। আনভীর ঘুমিয়ে আছেন। তার একহাত আমার হাতে আবদ্ধ আর মাথাটা আলতো ভাবে সিটে এলিয়ে দেওয়া। সদ্য ফুটে ওঠা আলোয় অন্যরকম লাগছে ঘুমন্ত আনভীরকে। আমি অপ্রতিভ হলাম কেননা হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে উনাকে দেখার জন্য নার্ভ সচল ছিলো না আমার। আমার স্পষ্ট মনে আছে ঘুমানোর পূর্বে আমি আমার পাশে দেখেছিলাম শিউলি ভাবিকে। বাসের এক অংশ মেয়েদের দখলে আর বাকি অংশ ছেলেদের। কড়া করে বলে দেওয়া হয়েছে ছেলে মেয়ে একসাথে বসবে না। কথাটি আজরান ভাইয়া আর আনভীরের উপর বিশেষ প্রয়োগ করে বলা হয়েছিলো। আনভীর তখন কথা বলেন নি আর। বুঝেছিলেন যে নীলু আর রিমি নামের দুই অগ্নি বালিকা থাকলে আমার সাথে আর কথা বলতে পারবেন না। বাসের জার্নিটা প্রথম প্রথম আনন্দের লাগলেও ঘন্টা কয়েক বাদে চোখে ঘুম জরিয়ে এসেছিলো। শিউলি ভাবির সাথে গল্প করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম টেরই পাই নি!

আপাতত বিভ্রান্তে আছি আমি। চট করে মিলিয়ে নিতে পারছিনা শিউলি ভাবির জায়গায় এখানে আনভীর এলো কিভাবে। তাহলে এটাই ধরে নিবো যে মধ্যরাতে সবাই ঘুমে বিভোর হয়ে গেলে আনভীর ভাবিকে ম্যানেজ করে এখানে এসেছেন? আমার ঠোঁটকোলে অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠলো এবার। মানুষটা কিছুটা পাগলাটে জানি, তবে এতটা সীমা ছাড়িয়ে অস্থির হবেন তা ভাবতেই পারিনি আমি, হয়তো ভাবাও অসম্ভব ছিলো। অপ্রতুলতার সাথে উনার গালের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি স্পর্শ করার চিন্তায় হাত বাড়াতেই যেন সঙ্কোচ কাজ করলো। নিজেকে এখন উনার স্ত্রী রূপে মনে হচ্ছেনা। অন্যান্য বাঙালি মেয়েদের মতো হঠাৎ ঘুরপাক খাচ্ছে, ‘এখন না! বিয়ের পর সব।’

আনমনেই হেসে উঠলাম আমি। তখনকার হঠাৎ বিয়ের থেকে এই বিয়ের গ্রহণযোগ্যতা মনে এমন জায়গা নিয়েছে যে সবকিছু নতুন আঙ্গিকে অনুভব হচ্ছে আমার। পাখির কলকাতানও যেন আমার ভাবনাকে সঙ্গে সঙ্গে সায় দিলো।

____________

নাহিদ ভাইয়াদের বিশাল বাড়িটা খাগড়াছড়ি শহর থেকে ১ কি.মি দূরে। আমাদের পৌঁছুতে পৌঁছুতে রোদ উঠে গিয়েছে। বাস থেকে আমার হ্যান্ড ব্যাগ নিয়ে আমি নামলাম। পাশেই শিউলি ভাবি। সবাই ওঠার আগেই আনভীর জায়গা অদল বদল করে নিয়েছিলেন ভাবির সাথে। আমি তখন জিজ্ঞেস করেছিলাম,

‘ আমার ঘুমানোর পর কেন শিউলি ভাবির সাথে জায়গা চেন্জ করলেন আপনি?’

আনভীর আমার কড়া প্রশ্নের পরোয়া করলেন না৷ নিজের মতোই শান্ত সুরে বললেন,

‘ আজরান ভাইয়ের সাথে থেকে শান্তি আছে? যার জিনিস তাকে দেওয়াই ভালো। তাই শিউলি ভাবিকে তার কাছে পাঠিয়েছি।

আমি তাজ্জব না হয়ে পারলাম না। অস্ফুটস্বরে বললাম,

‘ তাই বলে সবার ঘুমিয়ে যাওয়ার পর? আমার পাশে বসে আশেপাশের মশা মেরেছিলেন বুঝি?’

আনভীর দুষ্টু হাসি দিলেন। অতঃপর এগিয়ে এলেন কাছে ফিসফিসানো সম্মোহিত কন্ঠে বললেন,

‘ শুধু মশা মারিনি। আরও অনেককিছু করেছি। তুমি তো ঘুমে কুটুম হয়ে ছিলে। আমার এতকিছু করাতে কি আর টের পেয়েছো?’

উনি স্পষ্টই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন অন্যকিছুর। গাল তখন আমার আপনা আপনিই লাল হয়ে গেলো। নিজেকে মুড়িয়ে ফেলেছিলাম লজ্জায়। তখন থেকে বাস থামার আগ পর্যন্ত একবারও চোখে তাকাইনি উনার। এমনকি বাস থেকে নেমেও না। সবাই ক্লন্ত হয়ে একে একে নামছেন। নাহিদ ভাইয়া আর ছোট মামা ব্যাগ নামাচ্ছেন এবার। আমি চুপচাপ বড় মামুর পাশে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম বিশালাকার বাড়িটি।

বাস আসা মাত্রই ভেতরে খবর পাঠানো হলো যে আমরা এসে পড়েছি। তারপর বাড়ির লোকেরা একে একে সবাই এসে পড়লো বাইরে। এর মধ্যে মধ্যবয়স্কা এক মহিলা প্রথমেই সালাম দিলেন আনভীরের বাবা-মা’কে। জিজ্ঞেস করলেন,

‘ কেমন আছেন ভাইজান? আজ কতদিন পর আপনাদের সাথে দেখা। সুযোগ ছাড়া তো আসতেই চাননা। এই বোনটার কথা কি একবারও মনে পড়েনা?’

মহিলার চোখে বিন্দু বিন্দু জল। ঠাহর করতে পারলাম যে ইনিই নাহিদ ভাইয়ার মা। চাপা রং, পুরু ঠোঁট, ঘোমটা দেওয়া থাকলেও কাচা পাকা চুল অন্যমাত্রা দিচ্ছে মহিলাটিকে। নাহিদ ভাইয়ার চেহারা অবিকল উনার মায়ের মতো। নাহিদ ভাইয়ার বাবাও এসে কোলাকোলি করলেন বাবার সাথে। তবে উনার স্বভাবটা একটু চাপা ধরনের, যা কথাবার্তার ধাঁচেই ধরা যাচ্ছে। তারপর মহিলা একে একে আমার বড় মামু, মামী, ছোট মামার সাথে পরিচিত হয়ে নিলো। বাকি আত্নীয়রা বিকেলের পর আসবে তই তাদের আয়োজন পরে হবে বলে স্থির করা হলো। আনভীর নিজেই তারপর নাহিদ ভাইয়ার মা’কে গিয়ে জরিয়ে ধরলেন। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

‘ কেমন আছো ফুপি?’

মহিলার চোখ মুখ আনন্দে আটখানা। আনভীরের দু’গালে হাত রেখে পরম চোখে দেখতে থাকলেন উনাকে। স্নেহপূর্ণ কন্ঠে বলে উঠলেন,

‘ কতদিন পর তোর চাঁদমুখখানা দেখলাম বাবা? তোর বাবার মতো এই ফুপিকে তো ভুলেই গিয়েছিস তুই। জানিস মাঝে মাঝে তোকে কত দেখতে ইচ্ছে হতো? নাহিদের থেকেও তোর কথা মনে পড়তো বেশি। ছোটবেলায় কত আসতি, কত তুই আর আজরান মিলে এই উঠোনে দৌঁড়োদৌড়ি করেছিস, সময় কত অদ্ভুত তাই না? এখন তো তোর আর সময়ই নেই। হাজারো মানুষের ভালোবাসার ভীড়ে এই তুচ্ছ মহিলাটিকে কি আর মনে থাকে?’

আমি স্পষ্ট টের পেলাম উনার মনের কোণে জমে থাকা মেঘ। আনভীর পরম আদরে আগলে ধরলেন উনার হাত। নরম কন্ঠে আহ্লাদি সুরে বললেন,

‘ সরি ফুপি, তোমার এই ছেলেটাকে এবারের মতো মাফ করবে না?’

উনি হেসে দিলেন আনভীরের এমন কান্ডে। বললেন,

‘ ধ্যুর ছেলে, তোর ওপর কি রাগ থাকা যায়? দিন দিন কত সুন্দর হয়ে যাচ্ছিস রে তুই আনভীর! বিয়েও করছিস। আল্লাহপাক না করুক মানুষের কু নজর যেন তোর ওপর না পড়ে। তো, তোর হবু বেগম কোথায়?’

এই কথা শুনে অস্বস্তি নিয়ে,দাঁড়িয়ে পড়ি আমি। আনভীর মিহি হেসে ইশারায় উনাকে দেখালেন আমার দিকে। এভাবে সরাসরি তাকানোতে আমি যেন আরও অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। অতঃপর এগিয়ে বললেন,

‘ তুমিই তাইলে ইকবালের মেয়ে আহি?’

বুঝলাম উনি চিনেন আমার,বাবাকে। হয়তো সেটা পারিবারিকসূত্র থেকেই। আমি সালাম দিলাম উনাকে। বললাম আমিই সেই মেয়ে। মহিলা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে দেখলেন আমায়। বলে উঠলেন,

‘ মাশাআল্লাহ… মাশাআল্লাহ.. মাশাআল্লাহ! তুমি তো বেজায় সুন্দর দেখতে? আনভীরের পছন্দ আছে বলতে হবে। এমন মেয়ের জন্য তো যে কেউ জানও দিতে পারবে।’

আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম। তবুও কথা আগানোর জন্য উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘ কেমন আছেন ফুপি?’

উনি কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে রইলেন আমার মুখপানে। হয়তো ফুপি বলেছি বলে মনেমনে খুশিই হয়েছেন বেশ। বলে উঠলেন,

‘ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি মা। তোমরা সবাই ভেতরে আসো, বসো। বিশাল বাসা আমাদের। এক ঘর পুরো ছেলেদের জন্য আর আরেক ঘর মেয়েদের জন্য বরাদ্দ। ওই যে রিমি কি যেন বলছিলো ডেস্টিফিশন….’

‘ ডেস্টিনেশন ওয়েডিং মা!’

রিমি আপু বললো। ফুপি প্রতিউত্তরে বললেন,

‘ হ্যাঁ হ্যাঁ ওটাই। এর জন্য কি আবার রিসোর্ট ফিসোর্ট হোটেল বুক করতে লাগে? আমাদের বিশাল বাড়ি। নাহিদের দাদা খুব শখ করে করেছিলেন এই বাড়ি। জম্পেশ মজা করতে পারবে সবাই। বাঁধা দেওয়ার কেউ নেই।’

ফুপির কথা শুনে ভেতরে ভেতরে আনন্দে আটখানা হয়ে গেলো নীলু আর রিমি। আনভীরকে জব্দ করার জন্য হয়তো এরা,ভয়ংকর থেকেও ভয়ংকর কোনো পরিকল্পনা করেছে। আমি তপ্তশ্বাস ছাড়লাম। আসলেই ক্লান্ত আমি। আমি,সহ বাকি সবাই। শিউলি ভাবি যেহেতু প্রেগনেন্ট তাই দায়িত্বটি এড়িয়ে যেতে চাইনি। তার,হাত ধরেই চলে গেলাম ভেতরে।

______________________

রাত ঢলেছে ধরনীর বুকে। শীতল ছমছমে হাওয়া বহমান। বাড়ির সামনে বিশাল ঘাসে আচ্ছাদিত সমান্তরাল জায়গায় সাজানো হচ্ছে স্টেজ। আজ দুপুর নাগাদই ঢাকা থেকে ইভেন্ট ম্যানেজম্যান্টের লোকেরা এসেছে। একে একে আনভীর আর আমায় দেখিয়েছে সকল আয়োজন।সব তো ঠিকছিলো কিন্তু বিরক্ত হলাম এত ভারী লেহেঙ্গা আর মেক-আপের সামগ্রী দখে। সাজগোজে যে আমার অনীহা ব্যাপারটা তা না। কিন্তু একপর্যায় যখন আমায় আর আনভীরকে হাজারো ক্যামেরার মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে তখন সত্যিই নার্ভাস হয়ে পড়বো আমি।

ছাদে সবাই আড্ডা দিচ্ছি আমরা। আমার সাথে ইশা আর ধারা বসা। বিকেলেই প্যাকিং করে এসেছে দু’জন ঢাকা থেকে। এদের রিসিভ করতে গিয়েছে নাহিদ ভাইয়া। নাহিদ ভাইয়াকে দেখেই এদের মাথাঘুরে যাওয়ার উপক্রম হলো।আমার কানে ফিসফিসিয়ে বললো,

‘ দোস্ত! এই হ্যান্ডু দেবরটাকে এতদিন কই লুকিয়ে রেখেছিলি তুই? কি ফিগার মাইরি! তাকালেই হার্ট ধুকপুক করতে থাকে।’

আমি চোখ গরম করে তাকালাম এদের দিকে। বললাম,

‘ তোরা মেয়ে জাতটাকে কলঙ্ক বানিয়ে দিলি রে! ছেলে দেখলেই পিনিক উঠে যায়।’

মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো এরা দু’জন। এদিকে আমি ভাবছি আনভীরের কথা। আসা পর্যন্ত একবারও কথা হয়নি উনার সাথে। বস্তুত কেউ সুযোগই দেয়নি সেটার! নীলু হতো খেয়াল করলো সেটা। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে উঠলো,

‘ ছটফট করছিস কেন আপু?’

‘ আরে বুঝো না মেয়ে? ভাবিজানটা আমার আনভীর ভাইয়ার শোকে পাগল হয়ে যাচ্ছে।’

রিমি আপুর কথায় অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সবাই। ওপাশে নাহিদ ভাইয়াও মিটমিটিয়ে হাসছে। গাল লাল হয়ে গেলো আমার। এরা সবাই ভয়ঙ্কর রকমের অ’শ্লী’ল কথাবার্তা শুরু করেছে। আমি আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলে সত্যি সত্যিই হয়তো পাগল হয়ে যাবো। উঠে যেতে নিবো আমার সাথে সাথে উঠে এলো নীলু, রিমি এমনকি ধারাও। বিরক্ত হলাম আমি। যেখানেই যাই সেখানেই এরা বডিগার্ডের মতো আশপাশে ঘুরঘুর করে। মূলত আনভীরের সাথে যাতে একদন্ডও কথা নাহয় সেই প্রচেষ্টা।

আমি কিছুক্ষণ পরপরই আশপাশে দেখেছি আনভীরকে। বারবার আমায় দেখছেন, চোখাচোখিও হয়েছে কয়েকবার। তবে বাবা, মামু বা আজরান ভাইয়ার জন্য ভয়ে এদিকে এগোতে পারলো না। নাহিদ এবার মোবাইল নিয়ে বসলো আনভীরের পাশে। আনভীর বিড়বিড়িয়ে বললো,

‘ এভাবে কতদিন জ্বালাতন করবি তোরা? আমার বউ দুনিয়ার সবার সাথে হেসেখেলে কথা বলছে অথচ বদমাশগুলো আমায় কথা বলতে দিচ্ছে না। বাবার জন্য এগোতেও পারছিনা ভয়ে।’

অন্য সময় হলে আনভীরের শোকে সমান সমবেদনা জানাতো নাহিদ। তবে এইবার এই প্রথম সে মনে মনে শয়তানি আনন্দে মেতে উঠলো। বিড়বিড়িয়ে বললো,

‘ আপনারা দুই মিয়া বিবি আমার সিঙ্গেল লাইফের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিলেন আনভীর ভাই। এক মাঘে শীত যায় না। এতদিন আমার সামনে বউ নিয়ে দিব্যি কাটিয়ে আমায় বউয়ের অভাব বুঝিয়েছিলেন না! এবার বুঝবেন ঠেলা।’
.
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ

#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৫১

‘ আজকে আপনার এই রূপে আনভীর ভাই হার্টএট্যাক করবে ভাবি!’

নাহিদ ভাইয়ার এই কথায় আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। সবার চোখে মুখে সেই একই অভিব্যাপ্তি। চারিদিকের হৈ চৈ স্বপ্নের মতো লাগছে আমার কাছে। সবার এই হৈ চৈ, আনন্দ, সবকিছু আমায় আর আনভীরকে ঘিরে। আজ আমার আর আনভীরের গায়ে হলুদ। বিষয়টা মনে আসতেই যতটা না আনন্দ অনুভব করি, তার থেকেও আরও বেশি অনুভব করি প্রশান্তি। আর লুকোচুরি নেই, আর ভয়ে থাকতে হবে না কেউ দেখবে কি-না, দেলে কি ভাববে। এখন শুধুই আমাদের ভালোবাসার পূর্ণতা পাওয়ার সময়। দিনে দিনে আনভীর নামক মানুষটি আমার সারা অস্তিস্তে এমনভাবে জুড়িয়ে গিয়েছে যে এর থেকে কখনও পরিত্রাণ পাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। এভাবেই জুড়ে থাকবো উনার সাথে। এভাবেই সাদরে গ্রহণ করে নিবো উনার পাগলামি।
বেডে বসে আছি আমি। আমার গায়ে জড়ানো গায়ে হলুদের হালকা রঙের শাড়ি, মুখে মানানসই সাজ। আয়নায় যতবার নিজেকে দেখি তবারই অবাক হচ্ছি এই রূপে দেখে। মনে হচ্ছে ঘোরে আছি, আমার এই স্বপ্ন নিমিষেই হয়তো চুরমার হয়ে যেতে পারে। কিন্তু না, এমন কিছুই হবে না আমি জানি। নীলু নাহিদ ভাইয়ার সাথে সাথে আমায় দেখে বলে উঠলো,

‘ আহারে! আমার আপুটাকে পুরো রাণী লাগছে। আজ তো আনভীর ভাইয়া এই রূপ দেখে মরেই যাবে। এমনিতেই তার কত কষ্ট, দু’দিন ধরে বউকে তার সাথে ঘেষঁতে দেই না।’

কথাটি শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সবাই। ইশা, ধারা সবাই নিজের শাড়ি পড়ে, মেকাপ করতে ব্যস্ত। শিউলি ভাবি একটি হালকা কারুকাজের থ্রিপিস পড়েছে। আজরান ভাইয়া কড়াকড়ি বলে দিয়েছে এই অবস্থায় কোনো ধরনের কোনো নড়াচড়া না করতে। ভাবির মুখ বিষন্ন দেখে আমি জড়িয়ে ধরলাম তাকে হালকা করে। আদুরে কন্ঠে বললাম,

‘ এমন গুলুমুলু ভাবিটা রাগ করে থাকলে কি ভালোলাগে আমার? তুমি এমন করে থাকলে আমার নিজেরও তো ভালোলাগবে না।’

‘ কি করবো বলো, কত ইচ্ছে ছিলো তোমার আর আনভীরের বিয়েতে একহাতে সব সামলাবো। আমার দেবরটাকে আচ্ছামতো ধোলাই দিবো তোমার সাথে কড়া কথা বললে। আর হলোটা কি? আমি নড়াচড়া করলে দেবর আর দেবরের ভাই মিলে পারলে আমায় ধমকের ওপর রাখে।’

আমি চুপটি হাসলাম ভাবির এমন কথা শুনে। তাই তাকে বসালাম আমি। পেটে হালকা করে মাথা পেতে বললাম,

‘ হেই চাচিজান! তোমার গুলুমুলু মাম্মামটা কত কষ্ট করছে দেখছো? তোমার চাচ্চু-চাচির বিয়েতে ইন্জয়ও করতে পারছে না। তুমি ফটাফট চলে আসো। তারপর তোমায় অনেক বেশি আদর করবো। তোমার গুলুমুলু মাম্মাম পাপাই থেকেও বেশি।’

শিউলি ভাবির বিষন্ন মুখ হঠাৎ হাসিতে মুখরিত হয়ে উঠলো। হাসলে বড্ড সুন্দর লাগে তাকে। আর গর্ভবতী হওয়ার দরুন স্নিগ্ধতার আদল যেন ফুটে ওঠে আরও। ভাবি মিহি হেসে বললো,

‘ আহি!’

‘ হুম?’

‘ আজকে দেখতে মারাত্নক লাগছে তোমায়। আমি জাস্ট ভাবছি যে আমার ভোলাভালা দেবরটা তোমায় এরূপে দেখে নিজেকে সামলাতে পারবে কি-না।’

লজ্জায় গাল লাল হয়ে গেলো আমার। প্রথমত আনভীরের সাথে ‘ভোলাভালা’ ওয়ার্ডটা একেবারেই যায়না। আর দ্বিতীয়ত, বিগত দু’দিন ধরে উনার সাথে কথা হয়নি আমার। বস্তুত নাহিদ ভাইয়া, রিমি আপু নীলু, ইশা ধারা কেউ সেটার সুযোগই দেয়নি। আমি জানিনা আজ হঠাৎ মুখোমুখি হওয়ার পর উনি কি প্রতিক্রিয়া করবেন। তখনই নীলু আর ইশা দৌড়ে আসলো ঘরে। বলে উঠলো,

‘ নিচে ঝাক্কাস এন্ট্রি দিয়েছে দুলাভাই বেইব! তুই রেডি তো? তোর ফুপিশ্বাশুড়ি তোকে নিচে নিয়ে যেতে বলেছে।’

নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এলো আমার। যতটুকু জানি আজকের এই ফাংশনে আনভীরের পক্ষ থেকে আরও বিশেষ কয়েকজন ব্যাক্তিবর্গ এসেছেন। সাথে ক্যামেরাম্যানরা তো আছেই। আমি নার্ভাস ফিল করছিলাম একটু। ভাবি তা দেখে বললেন,

‘ ভয় পাচ্ছো আহি?

‘ একটু।’

ভাবি আলতো হাসলেন। বললেন,

‘ ব্যাপার না। তুমি এসবে অভ্যস্ত না তো! তাই এমন একটু আধটু নার্ভাস ফিল হওয়াটাই স্বাভাবিক। একটু ম্যানেজ করো।’

‘ কিন্তু……’

এতক্ষণে মুখ খুললো নীলু। আমায় এত হেসিটেড হতে দেখে ভ্রুকুটি করে অবিলম্বে বললো,

‘ ভয়ের জায়গা পাস না আপু? সেদিন যখন এতগুলা মানুষের সামনে আনভীর ভাইয়েকে জাপ্টে ধরলি তখন ভয় কই ছিলো? তোর ওভাবে উনাকে জড়িয়ে ধরাতে জানিস উনার কতগুলা ফ্যান হার্টফেইল করেছিলো? তখন যদি সবার সামনে জড়িয়ে ধরতে পারবি তাহলে এখন ঢং করবি না। ভাব তো এমন করছিস যে তোকে চুমু দিতে বলা হয়েছে।’

বাচ্চা একটামেয়ে আর কথার কি অবস্থা? মিটমিটিয়ে হাসলো সবাই। এর কপালে যেই জামাই জুটবে তার যে জীবন ত্যানা ত্যানা তা ভালোমতই বুঝলাম। তারপর রিমি আপু, ধারা আমায় নিয়ে নিচে নামলো। এখানে বহু মানুষ। লো ভলিউমে গান বাজছে বিধায় পরিবেশটা আরও মোহনীয় হয়ে উঠেছে। আমি এখানে দাঁড়ানো মাত্রই সবার দৃষ্টি আমাতে এলো। ওয়েডিং ফটোগ্রাফার ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটা ক্যান্ডিড তুলে ফেলেছে। আমি অদূরেই আনভীরকে দেখে থমকে রইলাম। উনি স্টেজে বসে আছেন। হালকা হলুদ পান্জাবি আর সাদা পায়জামা পরা এই মানুষটির গহীন দৃষ্টি আমার দিকে। উনার উজ্জ্বল গায়ে হলুদ রঙটা নিদারুনভাবে ফুটে উঠেছে।হাতাগুলো ভাঁজ থাকায় নার্ভগুলো দৃশ্যমান আমার কাছে। উনার এমন চাহিনী আর ঠোঁটে লেগে থাকা মারাত্নক হাসি যে কাউকেই স্তব্ধ করতে বাধ্য। আমি নজর সরিয়ে নিলাম। টের পেলাম উত্তেজনায় ঢিপঢিপ করছে বুক। ধারা আমার পাশেই ছিলো। কানে কানে এসে বললো,

‘ দেখছিস এআরকে কিভাবে দেখছে তোকে? হায় মে মারজাওয়া! উনার চাহিনীর উপর আরও একদফা ক্রাশ খেলাম।’

আমি চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই ইতস্তত হলো ধারা। বলে উঠলো,

‘ দুলাভাই রূপেই ক্রাশ খাইসি বেইব। আর কিছু না।’

আমি কিছু বললাম না। তারপর আমায় স্টেজে আনভীরের পাশে বসিয়ে দিলেন মামী। এই পুরোটা সময়ই আমি চুপ ছিলাম। একটাবারও তাকাইনি আনভীরের দিকে। তারপর হলুদের পর্ব শুরু হলো। একে একে বড় মামু, মামী, ছোট মামা, নীলু এসে গালে মুখে হলুদ লাগিয়ে দিলো। আনভীরের বাবা-মা তারপর চাচা চাচী ফুপিরাও হলুদ লাগিয়ে দিয়েছেন। তবে শেষমেষ নাহিদ ভাইয়া ইচ্ছে করেই একবাটি হলুদ দিয়ে সারামুখে লাগিয়ে দিয়ে গেলো। আমি রেগেমেগে কিছু বলতে যাবো তখনই নাহিদ ভাইয়া ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,

‘ আমায় বলেছিলেন না সকিনা বিবি রসাথে বিয়ে দিবেন? এই আপনার শাস্তি।’

নাহিদ ভাইয়ার এই কান্ড দেখে অট্টহাসিতে মেতে উঠেছিলো সবাই। এমনকি আনভীরও। এই প্রথম উনি নাহিদ ভাইয়াকে আমায় জ্বালাতে দেখে সায় দিলেন। উনার বিক্ষিপ্ত হাসি আমায় নাড়িয়ে দিলেও আমি কিছু বললাম না। তারপর ছবি তুলা হলো আমাদের বেশ কয়েকটা। ছবি তোলার সময় ক্যামেরাম্যান বারবার,বলছিলেন একটু ক্লোজ হতে। আমি ইতস্তত করতেই আনভীর পেছন দিয়ে আমার কোমড়ে হাত দিয়ে নিজের কাছাকাছি বসালেন এবার। আমি ভড়কে গেলাম। এলোমেলো দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম আনভীরের দিকে। উনার মুখে ভাবনার লেশমাত্র নেই। আমি অস্ফুটস্বরে বললাম,

‘ কোমড় ছাড়ুন আনভীর। সবাই দেখছে।’

‘ দেখলে দেখুক! কাপল ফটোতে এস কমন বেবিগার্ল!’

কেপে উঠলাম আমি। উনার জড়ানো কন্ঠ, আড়ষ্টময় কথাবার্তার ভঙ্গি যেন,নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিয়েছে। আনভীর খানিকটা হাসলেন। অতঃপর বললেন,

‘ তোমার থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না আহি!’

আমি সচকিত হলাম। তবুও জিজ্ঞেস করলাম,

‘ কেনো?’

আনভীর দুষ্টু হাসি দিলেন। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললেন,

‘ তোমায় প্রচন্ড হটট’ট লাগছে আহি। এতদিনে বুঝলাম ওই দস্যু মেয়েগুলো কেন তোমায় আমার দৃষ্টি সীমানার বাইরে রেখেছিলো। ঠিকই করেছে। এতদিন অস্থির হলেও নিয়ন্ত্রণে ছিলাম। এখন তো মাথা ঠিক রাখতে পারছি না। ইচ্ছে করছে টুপ করে গালে চুমু খেতে। কি বলো, খাবো? ট্রাস্টমি, তাইলে বেস্ট কাপল পিক হবে এটা।’

কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে আমার। এতগুলো কমপ্লিমেন্টের মধ্যে আনভীরের কমপ্লিমেন্ট ছিলো সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আর একেবারেই লাগাম ছাড়া। আমি জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকলাম। এ ধরনের কথা কেবল আনভীরের দ্বারাই সম্ভব।

সময় পার হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। রাত আরও গভীর হওয়াতে নেমে পড়েছে ঠান্ডা। সবাই ক্লান্ত হয়ে প্রোগ্রামের পার্ট চুকিয়ে দিলো। হয়তো আগামীকাল সকালেই আমার আর আনভীরের হলুদের অনুষ্ঠান নিয়ে রসালো খবর ছড়ানো শুরু হবে। আমি ক্লান্ত নিনির্মেষে রুমে পা বাড়ালাম। বড়রা সবাই ইতিমধ্যে চলে গিয়েছে যার যার ঘরে। আমি নাহিদ ভাইয়া আর নীলুকে একসাথে এত হাসাহাসি করতে দেখে অবাক হলাম বেশ। নাহিদ ভাইয়া যে নীলুরাণীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে বুঝতে বাকি নেই। আমায় ঠোঁট টিপে হাসতে দেখে ইশা ধারা অবাক হয়ে বললো,

‘ এভাবে হাসছিস কেন তুই?’

‘ কেন জানি মনে হচ্ছে আমাদের নাহিদ ভইয়ার বউ পেয়ে গিয়েছি।’

আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে ধারা ইশা ওদিকে তাকাতেই বড়সড় ঝটকা খেলো। কাদো কাদো স্বরে ইশা এবার বললো,

‘ তোর এই সুন্দর দেবরটাও শেষ পর্যন্ত আমার হাতছাড়া হয়ে গেলো দোস্তোওও। কই ভাবলাম
এরে পটিয়ে ফেলবো…তাও হলো না!’

একবালতি দুঃখ প্রকাশ করলাম ইশার জন্য। অতঃপর ওদের তাড়া দিয়ে বললাম,

‘ এবার যা তো! শুয়ে পড়। আমি শাড়ি পাল্টাবো। যাওয়ার সময় কষ্ট করে রিমি আপুকে ডেকে দিস তো।’

ওরা দুজন চলে যাওয়ার পর আমি দরজা ভািড়িয়ে দিলাম। অপেক্ষা করতে থাকলাম আপুর জন্য। কিন্তু রিমি আপুর আসার কোনো চিহ্ন নেই। পাঁচ মিনিট, ছয় মিনিট, সাত মিনিট পার হয়ে গেলো শেষমেষ ক্ষান্ত হয়ে ধাতস্থ করলাম আমি নিজেই খুলার চেষ্টা করবো শাড়ির সেফটিপিন। দরজাটা লাগিয়ে দিলাম তাই। বাইরে ঘন অন্ধকার।শো শো বাতাস জানান দিচ্ছে খাগড়াছড়ির আবহাওয়ার। হালকা হালকা কপাট বাড়ি খাওয়ার শব্দে আমি পরোয়া করলাম না। নিভু নিভু আলোয় শাড়ির সেফটিপিন খুলে কুঁচিতে হাত দিতেই পেছন থেকে কেউ জড়ানো কন্ঠে বললো,

‘ আই লাইক ইট!’

হঠাৎ হাত অকেজো হয়ে গেলো আমার। মাথার নিউরণ হঠাৎ সাদরে গ্রহণ করতে পারলো না ভরাট পুরুষালি কন্ঠটি। কি শুনলাম এটা আমি? মনে হচ্ছে যে ঘোরে আছি। চোখকে কোনোমতে নিয়ন্ত্রণে এনে আয়নায় দৃষ্টিপাত করলাম আমি। দেখা মাত্র চোখ আপনা আপনিই বড় হয়ে গেলো। ভুল দেখছি না তো? নাকি এটা নিছক কল্পনা? আনভীর পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন দেয়ালে হেলান দিয়ে। হাত ভাঁজ করে প্রাগাঢ় চাহিনী আমাতে নিক্ষেপ করাতে আমি বিমূঢ় হয়ে রইলাম। ওহ গড! সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে উনি কিভাবে আসলেন এখানে? নড়াচড়া করছিনা দেখে ভ্রুকুটি করে বলে উঠলেন,

‘ ও মাই গড! তুমি এখনই সব খুলে টুলে আমায় কন্ট্রোললেস করার প্ল্যানে আছো নাকি আহি?’
.
.
.
.
.
#চলবে

ভুলক্রুটি মার্জনীয়।