এক শ্রাবণ হাওয়ায়-২ পর্ব-৪২+৪৩+৪৪

0
701

#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৪২
নিজেকে কারও সাথে আবদ্ধ পেয়ে অগত্যাই আস্তে করে চোখ খুলতে হলো আমায়। আনভীর আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে জরিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। গতকাল রাতে যেভাবে ছিলেন , এখন শুয়ে আছেন ঠিক একই ভঙ্গিমায়। একটা তীব্র ঘ্রাণ টের পাচ্ছি উনার এত কাছাকাছি থাকাতে। গতকাল রাতের উনার সেই আগ্রাসী স্পর্শগুলোর কথা স্মৃতিচারণ করতেই মুখে ছড়িয়ে পড়লো রক্তিম আভা। কোনোমতে নড়েচড়ে উনার কাছ থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা চালালাম তাই। কিন্ত আমি নড়াচড়ার প্রচেষ্টা করতেই আনভীর চোখ বন্ধ অবস্থাতেই আদেশের মতো করে বললেন,

‘ ডোন্ট ট্রাই টু মুভ আহি!’

আমি কিঞ্চিত চমকে উঠলাম। কেননা এই কন্ঠে ঘুমের রেশ এর ছিঁটেফোটা টুকুও ছিলো না। কেমন যেন এক আলাদা মাদকতা কাজ করে মাঝে মাঝে উনার কথাগুলোতে। আমি মাথা উঠিয়ে তাকালাম আনভীরের দিকে। উনি এখনও আছেন চোখ বন্ধ অবস্থায়। কেউ চট করে এসে উনাকে এই মুহূর্তে দেখলে নিশ্চিত ধোঁকা খাবে যে ইনি ঘুমে মশগুল। আনভীর ধীরে ধীরে চোখ খুললেন এবার। চুপচাপ নিজকে আধশোয়া অবস্থায় ধাতস্থ করে আমায় বুকে টেনে নিলেন। কে বলবে এই মানুষটা আমায় বিয়েই করেছে নিছক একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে? যদিও উনি নিজের লক্ষ্য পাল্টে ফেলেছেন তবুও এক চাপা অভিমান কাজ করলো আমার আনভীরের উপর। নিজেকে উনার বাহুবন্ধন থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা পুনরায় করতেই উনি জড়ানো গলায় বললেন,

‘ বড্ড নড়বড়ে টাইপ মেয়ে তো তুমি? শুনো নি যে আমি নড়াচড়া করতে না বলেছি?’

‘ তাহলে এভাবেই সারাদিন কাটাবো নাকি?’

কথাটি অনেকটা রেগেই বলতে হলো আমায়। তবে আমার এই কথার পরোয়া করলেন না আনভীর। পাত্তাহীন ভাব নিয়ে বললেন,

‘ সারাদিন কেন, সারাদিন প্লাস সারারাতই তুমি চাইলে এভাবে থাকতে পারবে। আমার একেবারেই কাছাকাছি। আমি মাইন্ড করবো না। তারপর এভাবেই নাহয় বেবি প্ল্যানিং এর চিন্তা ভাবনা করা যাবে।’

চোখ নামিয়ে ফেললাম আমি টুপ করে। ঠোঁট কামড়ে অন্যত্র তাকিয়ে রইলাম নিজেকে সংযত রাখার জন্য। আচ্ছা এই লোকের কি আসলেই লজ্জা শরমের ছিঁটে ফোটা নেই? যেসব কথা বলে রে আল্লাহ, বুলেটের মতো ছ্যাঁত করে বুকে গিয়ে আটকে যায়। অন্য সময় হলে আমি লজ্জায় আবিষ্ট হয়ে চলে যেতাম, কিন্ত এখনও চুপ থাকতে দেখে আনভীর আন্দাজ করতে পারলেন আমার বিষয়টা। প্রশ্ন করলেন,

‘ রেগে আছো এখনও আমার উপর?’

আমি নিরুত্তর। গতকাল পণ করেছিলাম না উনার কথার জবাব না দেওয়ার, সে পণের সাপেক্ষেই চুপচাপ আছি। আনভীর ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লেন। ভ্রুকুটি করে দেখতে থাকলেন আমার কার্যকলাপ। অতঃপর ঠোঁট ভিজিয়ে বললেন,

‘ ডোন্ট ডেয়ার টু ডু দ্যাট আহি। তোমার এসব লক্ষণ কিন্ত আমার ভালোলাগছে না।’

না লাগলেও কিছু করার নেই। আমি যখন উনাকে শাস্তি দেওয়ার পণ করেছি সেটার শেষ তাহলে করেই ছাড়বো।মাথাঘুরিয়ে ঘড়িতে দিকে তাকালাম আমি। তারপর ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলাম,

‘ আমাকে হসপিটালে যেতে হবে আনভীর। উঠতে দিন।’

আমায় কথায় আনভীর তাই ছেড়ে দিলেন আমায়। আমিও কথা না বাড়িয়ে তাই কাবার্ড থেকে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালাম।

_________

নীলু ড্রইংরুমে বসে মোবাইল স্ক্রল করতে ব্যস্ত আনমনে। বারবার সিড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছে যে আহি কখন আসবে। কিন্ত আসার কোনো নামগন্ধ নেই। মনে মনে ফুসে উঠলো নীলু৷ বিড়বিড়িয়ে বললো,

‘ উফ! আপুর কি ঘুম শেষ হচ্ছে না?’

নাহিদ আজ বেশ সকালেই বেরিয়ে গিয়েছিলো জগিং করতে। সপ্তাহে তিনবার ও ট্রেডমিলে দৌঁড়ায় আর অন্য টাইম গুলোতে বাইরে। কমপক্ষে বিশ মিনিট না দৌড়ালেঁও কেমন যেন ভার লাগে শরীর। আজ প্রায় পৌনে এক ঘন্টা দৌঁড়িয়ে আসলো বাইরে থেকে। এসেই হাঁপিয়ে বসে পড়লো সোফায়। কপালে বিন্দু বিন্দু গাম জমেছে নাহিদের। সেই সাথে মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। নাহিদ কেডস খুলতে খুলতে বললো,

‘ নুড়ী আপা, ফ্রিজ থেকে পানির বোতলটা নিয়ে আসেন তো একটু!’

নুড়ী আপা এখানে নেই। ইয়ার্ডে পানি দিতে গিয়েছে। তাই অগত্যাই উঠলো নীলু। ফ্রিজ থেকে পানি নিয়ে নাহিদের দিকে বাড়িয়ে বললে,

‘ এই নিন।’

পরিচিত কন্ঠ না পেয়ে নাহিদ তাকালো নীলুর দিকে। ঘুম থেকে উঠেছে বেশ অনেকক্ষণ হলেও মুখটা স্নিগ্ধ লাগছে মেয়েটার। নাহিদ ওর হাত থেকে বোতল নিয়ে বিনয়ী সুরে বললো,

‘ থ্যাংক ইউ!’

নীলু কোনো প্রতিউত্তর করলো না। তখনই হঠাৎ ইয়ার্ড থেকে জিমি এলো দৌঁড়িয়ে। কুকুরের আওয়াজে নীলু কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলেও যখন দেখলো সেটা নাহিদের কোলের উপর বসার জন্য উতলা হয়ে আছে তখন ভ্রুকুটি করলো। বললো,

‘ এটা কে?’

‘ এআরকে’র পেট ডগ। জিমি নাম।’

নীলু এখনও বিস্ময়ে। বাচ্চা কুকুর ছানাটি বলতে হবে অনেক সুন্দর দেখতে। তাই বলে উঠলো,

‘ দেখিনি তো একে আগে?’

‘ দেখবে কিভাবে। জিমি তো ইয়ার্ড থেকে এখানে আসতে পারে না। ভাবি ভয় পায় দেখে ওকে ওখানেই রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ‘

মাঝে মাঝে আহির এত ভালো ভাগ্য দেখে মনে মনে হিংসে হয় নীলুর। কিন্তু ও এই ব্যাপারে কিছু বললো না। জিমি নাহিদের কোলে নানারকম ভঙ্গিমায় খেলা করে যাচ্ছে। নীলু এবার বললো,

‘ আপনারও কি পেট ডগ পছন্দের?’

নাহিদ বিষম খেলো। কেননা নীলু কখনও ওর ব্যাপারে এতটা আগ্রহ দেখায় নি। তাই প্রতিউত্তরে বললো,

‘ উমমম! হ্যাঁ বলতে পারো।’

‘ আমার এতটাও পছন্দ না। সত্যি কথা বলতে আগ্রহও দেখাইনি কখনও এ ব্যাপারে। আচ্ছা ভাবুন তো, আপনার উডবি ওয়াইফ যদি আহি আপুর মতোই কুকুর ভয় পায় তাইলে আপনি কি করবেন?’

‘ থাপ্পড় দিয়ে ভয় কাটিয়ে দিবো। আমার আবার এত ধৈর্য নেই বউকে সামলানোর৷ ভাইয়ের বউ সামলাতে সামলাতেই আধমরা হয়ে যাচ্ছি তারপর আমার আপকামিং বউয়ের জ্বালায় তো মরেই যাবো।’

এতক্ষণ এদের কথাবার্তা শুনছিলাম আমি। নাহিদ ভাইয়ার এই কথা শোনামাত্র কটাক্ষ করে বললাম,

‘ কি বললেন?’

থতমত খেলেন নাহিদ ভাইয়া। ভাবতে পারেননি যে আমি এভাবে উনার কথা শুনে ফেলেবো। পিছনে ঘাড় বাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ ভ-ভা-ভাবি লিসেন…….’

‘ আমায় সামলানো খুব কষ্টের কাজ, তাইনা?’

শীতল কন্ঠে কথাটি জিজ্ঞেস করলাম আমি। নাহিদ ভাইয়া শুকনো ঢোক গিললেন। ব্যাটার এই অবস্থা দেখে নীলু না পারছে হাসতে না পারছে কিছু বলতে। তবে এই নাহিদ রেজওয়ানের সাথে যে আমার সম্পর্ক খুব একটা মধুর নয় তা ভালোমতোই আন্দাজ করতে পেরেছে।
আমি পা বাড়িয়ে নাহিদ ভাইয়ার দিকে এগিয়ে গেলাম। কটাক্ষ করে বললাম,

‘ আমায় সামলাতে সামলাতে আধমরা হয়ে যাচ্ছেন তাই না নাহিদ ভাইয়া? তাহলে এমন কিছু করা উচিত যাতে আপনি একেবারেই টপকে যান। টেনশন নট ব্রাদার, এই তায়্যিরাত উম্মে আহি এতটা সহজ মেয়ে নয়, খুব শখ না আমার জ্বালা থেকে ছাড় পাওয়ার? আজ জ্বালাতে জ্বালাতেই আপনাকে মেরে ফেলবো। একটু তিড়িং বিড়িং করলে ডিরেক্ট আপনার ভাইয়ের কাছে বিচার। উনি তারপর কি করবেন তা নাহয় পরেই দেখে নিয়েন৷ ‘

আমার একথায় ভালোমতোই জব্দ হয়েছে নাহিদ ভাইয়া। আমি এবার দুষ্টু হাসি দিয়ে সরে এলাম। একটা ভাব নিয়ে বললাম,

‘ মি. নাহিদ। জলদি গাড়ি রেডি করুন। আমায় হসপিটালে যেতে হবে। আজ আর আনভীরের সাথে যাবেন না আপনি।’

আনভীর নামতে নামতে শুনে ফেললেন আমার কথা। একটা সাদা চেক শার্ট পড়েছেন উনি। সাথে ব্লু জিন্স। আজ উনার একটা টক-শো তে যাওয়ার কথা ছিলো। হয়তো সেখানেই যাবেন৷ আনভীর হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘ আজকে আমার আসতে লেট হবে নাহিদ। আসিফকে নিয়ে যাচ্ছি। তুই আহির সাথেই থাকিস। আমার মনে হচ্ছে সেদিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে জার্নালিস্ট আসতে পারে ওর কাছে। তাই সাবধানে থাকিস৷ ওই দল যেন আহির মুখোমুখি হতে না পারে।’

আনভীর তাকালেন আমার দিকে। আমায় এভাবে নির্বিকার দেখে অবাক হলেন বেশ। তার থেকেও আরও বেশি অবাক হলেন এটা দেখে যে আমি উনি ছাড়া সবার সাথেই কথা বলছি। হসপিটালে যাওয়ার সময় উনি বারবার বললেন সাবধানে যেতে। আর অপূর্ব কন্ট্যাক্ট করার চেষ্টা করলে উনাকে বলতে। আমি তখন বললাম,

‘ আমারটা আমি ভালো বুঝি আনভীর। এই নাটকীয়তার আর দরকার হবে না।’

______________

‘ আহি তোমার নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে? এটা কি সত্যি?’

ধ্রুব স্যারের এ কথায় চমকে উঠলাম বেশ। হসপিটালে এখন লাঞ্চ টাইম। আমরা সবাই এখন ক্যান্টিনে বসে আছি। তিশা একথা শুনে অবাক হয়ে বললো,

‘ কি বলছেন স্যার? আমরাই তো জানিনা।’

‘ ওকে কল দেওয়ার পর ওর উডবি রিসিভ করেই বললো।

ধ্রুব স্যারের এ কথায় কি বলবো ভেবে পেলাম না। তিশা রেগেমেগে তাকালো আমার দিকে। বলে উঠলো,

‘ এভাবে কথাটা লুকালি কেন তুই আহি?’

আমতা আমতা করে উঠলাম আমি। বললাম,

‘ আমি… আমি আজই বলবো ভেবেছিলাম কিন্তু…’

‘ আচ্ছা ওসব কথা বাদ দে। ছেলেটা কে রে? কি করে?’

মনে মনে এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম আমি৷ তিশা যদি শুনে যে ওই ছেলে কে হতে পারে ও তো শোকেই পটল তুলবে৷ ধ্রুব স্যার এবার বললেন,

‘ কি হলো আহি? বলো সে কে?’

আমি চট করে বললাম,

‘ ইটস সিক্রেট গাইস। একদিন উনাকে নিয়ে আসবো এখানে।’

আমার এই মিথ্যে কথায় সবাই আশ্বস্ত হলেও সন্তুষ্ট হলো না। তারপর লাঞ্চ সেরে আমরা যে যার মতো ডিউটিতে চলে গেলাম।

_______

সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে প্রায়। নাহিদ ভাইয়ার সাথে বাড়ি ফিরছি আমি। মনটা কেমন যেন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। নাহিদ ভাইয়া হয়তো সেটা আন্দাজ করতে পারলেন। তাই জিজ্ঞেস করলেন,

‘ কিছু খাবেন ভাবি?’

‘ কি খাবো এখানে?’

‘একটা ভালো ক্যাফে আছে এখানে। চাইলে খেতে পারবেন।’

‘ তাহলে নিয়ে যান ওখানে।’

সেখানেই নিয়ে গেলো নাহিদ ভাইয়া৷ একটা চকলেট কেক অর্ডার দিলেন। বললেন,

‘ আমি প্রায়ই এখানে আসলে পেস্ট্রি খাই যখন প্রচুর চাপে থাকি। খেয়ে দেখবেন, আপনার ভালোলাগবে। ‘

নাহিদ ভাইয়ার কথাটা সত্যি বের হলো। আসলেই ভালো হয়েছে পেস্ট্রিটা। এর জন্য থ্যাংকস জানাতেও ভুলিনি। তখন হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠলো। স্ক্রিনে আনভীরের নাম লিখা। প্রথমে ভাবলাম রিসিভ করবো না। তারপর দু’বার কেটে যাওয়ার পর কি ভেবে পরের বার রিসিভ করে নিলাম কলটি। মৃদু কন্ঠে বললাম,

‘ কি হয়েছে?’

এতক্ষণ কলের ওপর কল দিচ্ছিলেন আনভীর। আমার কল রিসিভ করাতে চুপ হয়ে গেলেন। থমথমে কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

‘ কি হয়েছে তোমার হ্যাঁ? সমস্যাটা কি?’
.
.
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ

ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।

#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৪৩+৪৪
এতক্ষণ কলের ওপর কল দিচ্ছিলেন আনভীর। আমার কল রিসিভ করাতে স্থির হয়ে গেলেন। থমথমে কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ কি হয়েছে তোমার হ্যাঁ? সমস্যাটা কি?’
কপট রাগ ছিলো এই কথায়। আমি মৃদু অভিনয় সুরে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লাম,
‘ আমার আবার কি হবে?’
‘ তাহলে কল রিসিভ করছিলে না কেন এতক্ষণ? খুব ভালো লাগে আমায় অস্থির করতে?’
আমার ঠোঁটে শয়তানি হাসি ফুটে উঠলো এতে। এই মানুষটাকে জ্বালাতে আসলেই ভালোলাগে। একে অস্থির হতে দেখে মনে প্রশান্তি আসে, কলিজা ঠান্ডা হয়ে আসে, আফসোস! এই কথাটা মুখে আনার দুঃসাহস আমি করলাম না। তাই প্রতিউত্তরে বললাম,
‘ আসলে ব্যস্ত আছি একটু?’
সিরিয়াস হলেন আনভীর। প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
‘ ব্যস্ত মানে? হোয়ার আর ইউ নাও আহি?’
এবার নাহিদ ভাইয়ার দিকে তাকাই আমি। উনি আপন মনে কেক খেয়ে চলছেন। এটাই মুখ্যম সময় নাহিদ ভাইয়ার কাছ থেকে রিভেন্জ নেওয়ার। খুব বলেছিলো না যে আমায় জ্বালায় নাকি সে আধমরা হয়ে আছে? আজ পুরোটাই মেরে ফেলবো। আমি ফিসফিসিয়ে আনভীরকে বললাম,
‘ একজনের সাথে কোয়ান্টিটি টাইম স্পেন্ড করছি।’
ওপাশে আনভীরের প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারলাম না আমি। তবে এতটুকু আন্দাজ করতে পেরেছি একজন বলতে উনি আসলে বুঝেছেন ধ্রুব স্যারকে। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
‘ আর সেই একজন টা কে?’
‘ আপনার কাছেরই একজন। ইভেন সে আজকে কেক খেতেও নিয়ে এসেছে। মানুষটা কি যে কিউট। দেখতে আপনার মতোই। চকলেট টাইপ ইয়াম্মি।’
অপরপাশে কিছুক্ষণ চুপ রইলেন আনভীর। না পারছেন আমায় কিছু বলতে না পারছে সহ্য করতে। আমি ব্যস্ত সুরে বললাম,
‘ এখন রাখেন তো। কই মজা করে কেক খাচ্ছিলাম সব মুডটাই নষ্ট করে দিলেন। ‘
উনাকে এড়িয়ে কল কাটতে যাবো তখনই আনভীর রাশাভারি কন্ঠে বললেন,
‘ ক্যাফের এড্রেস সেন্ড করো।’
‘ কিন্তু কেনো?’
‘ সেন্ড করতে বলেছি না? এখনই সেন্ড করো। আমিও আসছি।’
‘ আপনার না আসলেও……..’
আমার কথায় বাধাঁ দিলেন আনভীর। ফোস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলেন,
‘ আপাদত কোনোরকম নিজেকে কন্ট্রোলে রেখেছি আমি আহি। ইচ্ছে করছে তোমায় ঠাসিয়ে চড় থাপ্পড় মারার রাগটা মোবাইলের ওপর ঝেড়ে ফেলতে। এখন তোমায় সামনে পেলে আমি যে কি করতাম আমার নিজেরও অজানা। এখন ফটাফট লোকেশন সেন্ড করো আমায়। চালাকির চেষ্টা করলে সেটা তোমার জন্যই খারাপ বেরোবে।’
বলেই টুট টুট করে শব্দ হলো এবার। বুঝলাম উনি কল কেটে দিয়েছেন। উনার যা ভয়াবহ অবস্থা দেখলাম আসলেই এড্রেসটা না পাঠালে ভয়ঙ্কর কিছু করে বসবেন। অনেকটা ভয়েই লোকেশন পাঠালাম আমি। কিন্ত এর মানে এই নয় যে আমি রাগ ঝেড়ে ফেলেছি। যতক্ষণ না উনি আমায় সত্য ঘটনাগুলো বলছেন ততদিন এভাবেই জ্বালিয়ে যাবো উনাকে।
নাহিদ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি ব্যাপারটা আঁচ করতে পারছেন না। তবে আমার ঘটনা যে সুবিধার না এ নিয়ে বেশ সন্দেহে আছেন। আমি মেকি হেসে বললাম,
‘ কি দেখলেন এভাবে নাহিদ ভাইয়াআআআ!’
এভাবে আমায় টান মেরে ডাকতে দেখে সন্দেহটা তীব্র থেকেও তীব্রতর হলো নাহিদ ভাইয়ার। বলে উঠলো,
‘ ট্রাস্ট মি ভাবি, আপনি যখন আমায় এভাবে ডাকেন, রুহুটা কেমন যেন কেঁপে উঠে। আগেভাগেই সাড়া দেয় যে আমার কপালে দুঃখ আছে। পায়ে পড়ি ভাবি, সকালে যেটা বলেছি, মুখ ফসকে বলেছি। এর জন্য আর আমায় আতঙ্কে রাখবেন না।’
‘ সরি টু সে ভাইয়া! ব্যাপারটা আমার হাত থেকে অনেকদূর গড়িয়েছে।’
কথাটি মনে মনে আমি বলে ফেললাম।
_______________________
অপূর্ব এয়ারপোর্ট থেকে ফিরে এসেছে কিছুক্ষণ হলো। কক্সবাজার থেকে প্লেনে এত দ্রুত ফিরে আসার প্ল্যান ছিলো না মিটিংয়ের জন্য কিন্ত বাবার কল দেওয়াতে অগত্যাই কাজ মাঝে ফেলে ফিরে এসেছে। ফ্রেস হয়ে ড্রইংরুমে বাবার মুখোমুখি বসলো অপূর্ব।
দেখেই বুঝা যাচ্ছে গোসল সেরে এসেছে। উজ্জ্বল গায়ে এক প্রাণবন্ত ছাপ। আধভেজা চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে অপূর্ব গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
‘ ব্যাপার কি?’
থতমত খেয়ে গেলো ওর বাবা। ইকবালের চোখে মুখেও আতঙ্কের রেশ। অপূর্ব পর্যবেক্ষণ করলো এদের দু’জনকে, খুব তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করলো। আন্দাজ করতে পারলো যে কিছু একটা হয়েছে। তাই আবার বললো,
‘ কি এমন হলো যে এভাবে ডেকে আনলে আমায়?’
‘ রাহি ঠকিয়েছে আমাদের।’
ইকবাল বলে উঠলো হতাশার সুরে। অপূর্ব ভ্রুকুটি করলো। কিন্ত অবাকের রেশ দেখা গেলো না। বলে উঠলো,
‘ ওইযে তোমার এডপ্টেড মেয়ের কথা বলছো তো?’
অপূর্বের একথায় আশ্চর্যের চরম সীমানায় পৌঁছে গেলো ইকবাল সাহেব। সেই সাথে আহির বাবাও। হ্যাঁ, এটা সত্য যে রাহি আহির আপন বোন নয়। আহির জন্মের আগেই এডপ্ট করা হয়েছিলো এক বিশেষ স্বার্থের কারনে। আর তাই ইকবাল সাহেব নিজের মেয়ের থেকেও আগলে রেখেছিলো রাহিকে। আহিকে যেভাবে বর্জন করেছিলো, ঠিক তার বিপরীতভাবে এই মেয়েকে আহ্লাদ দিয়ে বড় করেছিলো।রাহি এ কথা জানলেও কখনও এই মেয়েকে যে এডপ্ট করা হয়েছে সেটা বুঝতে দেয়নি ইকবাল সাহেব। তাই হঠাৎ অপূর্বের এ কথায় সে রেগেমেগে বললো ,
‘ মুখ সামলে কথা…..’
‘ আহা, চাচাজান! আমি মুখ সামলেই বলছি। সবাই কি আপনার মতো টাকা পাগল হয়? লিসেন, রাহি আর আমি সমবয়সী, ওর চার বছরে যখন ওকে আপনি আর চাচি নিয়ে এলেন তখন জানতে না পারলেও এখন জানি যে এর পেছনে আপনার উদ্দেশ্য কি ছিলো। হতে পারে সত্যটা ও জেনে গিয়েছে? তাই
এমন করলো! হতে পারে না?’
নিশ্চুপ ইকবাল সাহেব। তাই বলে মেয়েটা এভাবে ঠকিয়ে ওই রকস্টারের সাথে মিলে আহির হেল্প করবে এটা ওর ধারনাতে ও ছিলো না। ওর মাথায় সব সময় বিষ ঢুকিয়েছিলো ইকবাল সাহেব। বলেছিলো যে আহির মা আহির নামে যে প্রোপার্টি উইল করেছে সেখানে রাহির নামও থাকা উচিত। কিন্ত মা শুধু নিজের পেটের সন্তানের কথাই ভাবলো। এটা দেখে রাহি কষ্ট পেয়েছিলো খুব। কারন এই মাকে রাহিও অনেক ভালোবাসতো। এত কষ্ট করে ওর মনে জাগানো আগুন অন্য এক আগন্তুক এসে চট করে নিভিয়ে দিয়ে যাবে, এটা মানতে পারছিলো না ইকবাল সাহেব।
এতক্ষণে কথা বললেন অপূর্বের বাবা। বললেন,
‘ তোমার কি মনে হয় আহিকে একটু বেশি সময় দেওয়া হচ্ছে না?’
অপূর্ব হাসলো। বলে উঠলো,
‘ সেটা তোমায় ভাবতে হবে না। তোমাদের ওর প্রোপার্টি লাগবে তো? পেয়ে যাবে। কাগজপত্র রেডি করছি, আই এম শিউর আহি সাইন করবে যদি ওই রকস্টার ওকে না আটকায়। চিন্তা করো না। আমি ম্যানেজ করে নিবো।’
চলে গেলো দুজনে। অপূর্ব এদের দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। টাকার জন্যও মানুষ কতটা অমানুষ হতে পারে, ভাবা যায়?
_____________________
আমরা যেই ক্যাফেতে এসেছি এটা সাতটার সময়ই কেমন যেন খালি খালি হয়ে গেলো। হয়তো এখন অফিস টাইম শেষ হয়েছে বলে। কিন্ত ঠিক আধ ঘন্টা আগেও মানুষের ভয়াবহ সমাগম ছিলো এখানে। আমি বসে রইলাম। তিনটা পেস্ট্রি খেয়ে ফেললাম ইতিমধ্যে। নাহিদ ভাইয়া মুখ কালো করে বসে আছে। সে ভালোমতোই জানে এর জন্য টাকাটা তার পকেট থেকে যাবে। আমি এবার বললাম,
‘ একটা কোল্ড কফি দিন না ভাইয়া?’
উনি এবার করুন চোখে তাকালেন আমার দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
‘ অর্ডার দিয়ে আসছি।’
এর মধ্যেই এসে পড়লেন আনভীর। একটা লেদার জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে রেখেছেন ঠান্ডা নিবারণের জন্য। মাথায় ক্যাপ আর মুখে মাস্ক লাগাতে বিন্দুমাত্র ভুলেননি। এই বেশে কেউ হাইট ছাড়া আর কিছুই আন্দাজ করতে পারবেন না যে ইনি আসলে কে। আনভীর আমায় দেখা মাত্রই চট করে বসলেন বিপরীত দিকে। মাক্স খুলতে যাবেন আমি চট করে বললাম,
‘ পাগল হলেন নাকি! মাস্ক খুলবেন না খবরদার!’
তাই করলেন আনভীর। প্রগাঢ় গলায় বললেন,
‘ কি করছো এখানে?’
‘ ক্যাফেতে কি মানুষ ভজন শুনতে আসে?’
আমার পাল্টা উত্তর। আনভীর আমার খাপছাড়া কথা দেখে কোনোরকম সংবরণ করলেন নিজেকে। বললেন,
‘ ওই নাহিদ টায় কোথায়?’
তখনই হাতে একটা কোল্ড কফির গ্লাস নিয়ে এলে নাহিদ। চট করে আনভীরকে দেখে বুঝতে না পারলেও পরে বিস্ময় নিয়ে বলে উঠলেন,
‘ আপনি কোথা থেকে টপকালেন ভাই?’
আনভীর যেন বোকা বনে গেলেন। বললেন,
‘ ওর সাথে এতক্ষণ তাহলে তুই ছিলি?’
‘ আমি থাকব না তাহলে কে থাকবে?’
আনভীর রাশাভারি দৃষ্টি নিয়ে আমায় দেখলেন। বুঝতে পারলেন আমার তখনকার ঠাট্টাটি। এই দৃষ্টি দেখে ভিতর ভিতর আমি ভড়কে গেলেও দেখালাম না ব্যাপারটি। গ্লাস টা নিয়ে আনভীরকে বললাম,
‘ যার সাথেই আসি না কেন, আপনার তো দেখার বিষয় না? আফটার অল আমি তো আপনার বিশেষ কেউ নই।’
ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লেন আনভীর। আমার ওপর জমা রাগটা নাহিদের উপর ছেড়ে কটমট করে বললেন,
‘ আমার বউয়ের সাথে আমি ঘুরবো, আমি খাওয়াবো। তুই ওকে এখানে নিয়ে আসার কে? ভাবি ভক্তি কি তোর বুকে জেগে উঠেছে?’
নাহিদ ভাইয়া পড়লেন বিপাকে। বললেন,
‘ আমি কি অতসব ভেবে ভাবিকে এখানে এনেছি? উনার মন খারাপ ছিলো এজন্যই আনলাম
এখানে।’
আমি কথা বাড়ানোর সুযোগ দিলাম না। বললাম,
‘ থাক ভাইয়া, এমন রকস্টার টাইপ মানুষদের সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। বিল দিয়ে আসুন। আমি ফিরে যাবো। নীলু বাসায় একা আছে।’
‘নীলু’ নাম বলতেই যেন এনার্জি পেলেন ভাইয়া। দ্রুত তাই কাউন্টারে চলে গেলো বিল দিকে। আনভীর তীক্ষ্ণচোখে দেখছেন আমাকে। আমি নাহিদ ভাইয়ার দিকে তাকালাম। উনি ওখানে ক্যাশিয়ারের সাথে কথা বলছেন বিকাশে পেমেন্ট করা যাবে কি না। আমি এবার আনভীরকে বললাম,
‘ নাহিদ ভাইয়া দিনদিন আরও সুন্দর হয়ে যাচ্ছে না আনভীর?’
উনি ভ্রু কুচকালেন। বললেন,
‘ এত কিছু খেয়াল করো তুমি?’
‘ তো করবো না? আগে কিউট টাইপ লাগতো। মনেই হতো না যে উনি একজন রকস্টারের পার্সোনাল সেক্রেটারি হতে পারে। তবে এখন মনে হয়। একটা অন্যরকম স্টানিং লুক এসেছে।’
আমার এই কথা শুনে এই প্রথম নাহিদের ওপর হিংসে হলো আনভীরের। নাহিদ ভাইয়া আমার দিকে তাকাতেই আমি একটা মুচকি হাসি দিলাম। বিনিময়ে তাই করলেন নাহিদ ভাইয়া। তবে যেই না আনভীরের দিকে তাকালেন ওমনি উনার মুখ পাংশুটে হয় গেলো। আনভীর শুধু পারছে না নাহিদকে কাচা চিবিয়ে খেতে।
আমি এবার বললাম,
‘ আপনি তাহলে কাজ শেষ করে আসুন। আমি যাচ্ছি।’
‘ ওয়েট, আমিও যাচ্ছি।’
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ দরকার নেই। কাজ সেরে আসুন। আমার মতো ইউজলেস মেয়ের জন্য খামোখা টাইম নষ্ট করতে হবে না।’
এবার যেন নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলেন না আনভীর। আচমকা আমায় টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন এখান থেকে। সেই সাথে নাহিদকে বললেন পেন্ডিং কাজ গুলো ওকে সেরে আসতে। বাড়তি কোনো কথা না বলে আনভীর দ্রুত গাড়িতে বসিয়ে দিলেন আমায়। এবার সত্যিই মনে ভয় ঢুকে গেলো আমার। আল্লাহ! উনি কি আমায় এবার মেরে টেরে ফেলবেন নাকি? ভয়ে আমি কিছু বলতে যাবো তখন উনি বললেন,
‘ একটা ওয়ার্ড বলবে, ঠাসিয়ে চড় লাগাবো। মুখ বন্ধ রাখো। বাসায় গিয়ে তোমায় সাইজ করছি।’
আমার শরীর জমে গলো। কিন্তু এখন ভয় পেলে হবে না আহি। এটা জানা কথাই ছিলো যে উনি ক্ষেপবে। তোর কাজ মস্তিষ্ক ঠান্ডা রাখা আর এই অস্থির লোকটাকে আস্তে করে এড়িয়ে যাওয়া। বাড়িতে ঢুকে নীলুর সামনে দিয়েই টেনে রুমে নিয়ে গেলেন আমায়। ধপ করে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে এগোতে থাকলেন আমার দিকে। লেদারের জ্যাকেটটা খুলে খাটে ছুঁড়ে মারতেই আমি তটস্থ হয়ে গেলাম। বলে উঠলাম,
‘ কি করতে চাচ্ছেন আপনি?’
‘ কেনো এত কিছু বুঝো তুমি, এটা বুঝো না?’
কাবার্ডের সাথে মিশিয়ে দাঁড় করালেন আমায়। উন্মাদ দৃষ্টি আমার হতভম্ব মুখে। আমি শক্ত কন্ঠে বললাম,
‘ ছাড়ুন আমায়। কিসব অসভ্যতামি করছেন?’
আনভীর হাসলেন খানিকটা। ঝুঁকে এসে অসাঢ় গলায় বললেন,
‘ আমি অসভ্য তো, তাই না? নাও লেট মি ডু দিস মিসেস আহি।আর কোনো ছাড়াছাড়ি হবে না।’
.
.
.
.
.
.
~চলবে…….ইনশাআল্লাহ