#এসো_রূপকথায় (১০)
রিয়া আর রিসানের মনের দ্বন্দ্বটা ভে ঙে ছে দুদিন আগে। সানার বিয়ে উপলক্ষে এসেছে রিয়া। এর আগে শুনেছে রিসানের বেপরোয়া আচরণ গুলো। তখন থেকেই মনটা ভালো নেই। বিয়েতে আসার পর নিজেকে ধরে রাখতে পারে নি কন্যাটি। ছুটে গিয়েছিল মানুষটার কাছে। রিসান ও আগলে নিয়েছে দু হাতে। তারা এখন চাঁদ দেখছে। বিশাল এক চাঁদ ওঠেছে আজ। দুজন দুজনার পাশে বসে। প্রেমিক প্রেমিকার জন্য এর থেকে সুন্দর মুহূর্ত আর দুটি নেই। রিয়া চোখ বন্ধ করে মানুষটার উপস্থিতি অনুভব করছে। এদিকে রিসান মেয়েটির দিকে তখন থেকে তাকিয়ে আছে। সত্যিকার অর্থে ওরা চাঁদ দেখছে কম, একে অপরকে দেখছে বেশি। রিয়া ওর মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। রিসান কিন্তু হাসল না। বরং কন্যাটিকে দু হাতে আগলে নিল। বুকের মাঝে।
“আমাদের ভালোবাসা অনেক দীর্ঘ হোক প্রিয়তমা।”
“টেনশন করবেন না। আমরা দুজন মিলে লড়াই করব। কী পারব না?”
“খুব পারব।”
বাক্যের অন্তিমক্ষণেই রিয়ার কপালে অধর ঠেকাল রিসান। মেয়েটির সমস্ত দেহ চনমনে হয়ে ওঠল। বুকের ভেতর শত প্রজাপতি উড়তে লাগল। পুরুষটির ভালোবাসা বরাবর ই ওকে স্বর্গীয় বার্তা এনে দেয়।
ঘটনাটি ঘটল পরদিন সকালে। রিয়ার বাবা মা আগেরদিন ই চলে গিয়েছিলেন। হুট করে আবার সকালে আসার কারণটা একটা রহস্যই বটে। রিয়া হাত মুখ ধুয়ে এসে বাবা মায়ের পাশে বসল। তাদের চেহারায় মলিনতা ভেসে বেড়াচ্ছে। রিসান অফিসে গিয়েছে। একে একে বাড়ির সকলেই উপস্থিত হলেন। পরিবেশ কেমন গুমোট হয়ে আছে। ধীর পায়ে নেমে এসেছে মেহনূর ও। দুই বোন একে অপরের মুখের দিকে চেয়ে রইল। কথাটি শুরু করলেন বাড়ির সবথেকে বড়ো সদস্য সারোয়ার সাহেব।
“বিষয়টি আমি কল্পনাও করতে পারি না। ইব্রাহিম তোমার কাছে আমরা সর্বদা ঋণী। আমাদের বাড়ির মেয়েকে যেভাবে আদর ভালোবাসায় বড়ো করেছ এটি প্রশংসনীয়। তবে একই সাথে বলতে হচ্ছে সমস্ত কিছুর মাত্রা টানা প্রয়োজন।”
চারপাশ এবার আরো ভারী ঠেকছে। কোথাও একটা শনশন আওয়াজ অনুভব হয়। রিয়া ক্রমশই উত্তেজনা অনুভব করছে।
“তোমার কন্যা আমাদের কন্যাস্বরূপ। তবে পুত্রবধূ করার মতন ভাবনা কল্পনাতেও আনা পাপ। আমরা একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলি। বংশের আলাদা মান রয়েছে। আশা করছি বিষয় গুলো বুঝতে পেরেছ।”
ইব্রাহিম কিন্তু উত্তর করলেন না। রিয়া বিস্মিত হয়ে চেয়ে আছে। মেহনূরের শরীর খারাপ লাগছে। সে অসহায়।
“রিয়া,তোমার জামা কাপড় গোছানো আছে?”
বাবার কণ্ঠ পেয়ে ধ্যান ভা ঙ ল রিয়ার। ও অলস চোখে চাইল।
“গোছানো না থাকলে গুছিয়ে নাও।”
“বাবা…’
“এসব তোমার ভালো লাগছে? নিজের বাবাকে অপমানিত হতে দেখে?”
এবার কন্যাটির চোখ থেকে জল নেমে এল। মেহনূর ইব্রাহিমের দিকে এগোতে চাইলে হাত দিয়ে বাঁধা দিলেন তিনি।
“তোমাকে হয়ত এত গুলো বছর নিজের কন্যার মতন লালন করেছি। তবে এটি সত্য তুমি আমাদের কেউ নও। তোমার প্রতি কোনো অধিকার আমাদের নেই কিংবা খাটাতে পারি না।”
এতটা দুঃখ এ জীবনে পায় নি মেহনূর। রিয়ার দু চোখ থেকে অজস্র জল কণা নেমে যাচ্ছে। কন্যাটির বুকের ভেতর বিকট শব্দে আ র্ত নাদ হচ্ছে। স্বামীর নির্দেশনা পেয়ে ফাহমিদা মেয়েকে নিয়ে কাপড় গোছাতে গেলেন। চারপাশ তখন নিশ্চুপ। রাশেদুল বন্ধুর দিকে এগিয়ে আসতেই পিছিয়ে গেলেন ইব্রাহিম।
“আমাদের বন্ধুত্বের ইতি ঘটে গেছে রাশেদ। খালাম্মা আমায় যে আমানত দিয়েছিলেন তা আমি সাধ্য মতন যত্ন করে রেখেছিলাম। এখন আর কোনো সূত্র নেই।”
“ইব্রাহিম, এভাবে কেন বলছিস?”
“মাফ চাচ্ছি,আমি চাই না ভবিষ্যৎ এ কোনো ঝামেলা হোক। আমার মেয়ে কখনো এ বাড়ি আসবে না। কখনোই না।”
ফাহমিদা মেয়ের লাগেজ হাতে নেমে এলেন। রিয়া কাঁদছে। অসহায় হয়ে তাকাচ্ছে মেহনূর এর দিকে। মেহনূর ও কাঁদছে। দু বোন এত অসহায় যে একে অপরের দিকে ছুটে যাওয়ার মতন বলটুকু নেই।
সন্ধ্যার দিকে ইব্রাহিম বাড়ি এলেন। ও বাড়ি থেকে আসার পর সারাদিনে পানি টুকু মুখে তুলে নি রিয়া। সেটি জানানো হলে ভদ্রলোক বিচলিত হলেন না। অথচ অন্যদিন থেকে সমস্ত বাড়ি অস্থির হয়ে যেত। তিনি বরং স্ত্রী কে ডেকে নিয়ে বললেন,”আগামীকাল সকাল বেলা ছেলে পক্ষ থেকে ওকে দেখতে আসবে। ছেলে ভালো চাকরি করছে,দেখতে শুনতেও ভালো। পরিবারে ও কোনো ঝামেলা নেই। সাজগোছের প্রয়োজন নেই। ছেলে পক্ষ আগেই দেখেছে ওকে।”
কথাটি বলতেই ফাহমিদা করুণ চোখে তাকালেন। এমনটি তিনি আশা করেন না। এদিকে রিয়া নির্বিকার। সবটা শেষ হয়ে যাচ্ছে অথচ তার মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।
কাজের চাপ একটু বেশিই ছিল। রিসানের ফিরতে বেশ রাত হলো। ও দেখল পরিবেশ শান্ত। সহসা এতটা শান্ত হয় না বাড়িটা। আহামরি কোনো চিন্তা না করে নিজের কক্ষে এল। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখল রুবাই আর নিতু ও জেগে আছে। বাচ্চা দুটো রাত নয়টা হলেই ঘুমিয়ে জল হয়ে যায়। আজ তার ব্যতিক্রম। ও হাসল। দু জন কেই এক সাথে কোলে তুলে নিল।
“তোরা জেগে আছিস কেন? কাকি মনি বকেছে?”
দুই ভাই বোন একে অপরের মুখের দিকে তাকাল। তবে কিছু বলল না। রিসান ভ্রু কুঞ্চিত করে শুধাল,”কী?”
“কিছু না ভাইয়া।”
রুবাই এর উত্তর শুনেও তেমন কিছুই বোঝা গেল না। নিতু দাঁত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছে। ওর মন খারাপ হলে এমনটি করে থাকে।
“ছি আপু, এভাবে নখ কামড়ানো ঠিক না। জানো তো অসুখ হতে পারে?”
নিতু শুধুই মাথা দোলাল। দুজনকেই নামিয়ে দিল রিসান। পকেট থেকে চকলেট বের করে বলল,”খুশি?”
অন্যদিনের মতো উল্লাস নেই ওদের মাঝে। রিসানের ভেতরটা কেমন করে ওঠল। ওদের কে রেখে ড্রয়িং রুমে এল। সেখানে একটা মানুষ ও নেই। অথচ রাত বারো টা অবধি সকলে বসেই আড্ডা দিয়ে থাকে। পরিবেশটি এমন যে সংকটটি না চাইতেও অনুভব হলো। ও আর কিছু না ভেবে রিয়ার ঘরে এল। সেখানে মেয়েটা কে পেল না। আশে পাশে খুঁজে মেহনূরের ঘরের কাছে এল। নক করার কিছু সময় পর বের হলো মেহনূর। শুষ্ক তার মুখশ্রী।
“ঘুমিয়েছিলে?”
“না ভাইয়া।”
“আচ্ছা, রিয়া কোথায়?”
মেহনূরের কান্নায় ভেতরটা শেষ হতে শুরু করল। ও কিন্তু জবাব দিল না। রিসান আরো বিস্মিত হয়ে গেল।
“উত্তর দিচ্ছ না কেন?”
“বাসায় চলে গেছে।”
“আজ তো যাওয়ার কথা ছিল না। তাহলে?”
“মা,বাবা এসেছিলেন।”
“অহ।”
রাত অনেক বেশি হওয়ায় আর কিছু বলল না রিসান। মেহনূরকে ঘুমাতে বলে নিজের কক্ষে এল। সেখানে এসে একদমই শান্তি পেল না। রাত প্রায় এগারোটা। গ্রামে এটা অনেক রাত। ফোন করা ঠিক হবে কী না ভেবে ভেবে কল করেই ফেলল। তবে কল রিসিভ না হওয়াতে একটু কষ্ট পেল। তারপর ভাবল এতটা জার্নি করে মেয়েটি নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে।
পরদিন সকালে ঘটে গেল আরেক কান্ড। ফাহমিদা চিৎকার করে ওঠলেন। ওনার কণ্ঠে হন্তদন্ত হয়ে এলেন ইব্রাহিম। তিনি সংবাদ পত্র পড়ছিলেন।
“রিয়া, রিয়া, মা চোখ খোল। মা চোখ খোল। চোখ খোল মা। কি করলি এটা। মা কথা বল,রিয়া মা।”
ফাহমিদা কাঁদছেন সমানে। ইব্রাহিমের মুখশ্রী জুড়ে আতঙ্ক। রিয়ার ঠিক পাশটায় পড়ে আছে ঘুমের ঔষধ।
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি