এসো রূপকথায় পর্ব-০৮

0
162

#এসো_রূপকথায় (৮)

রিয়া ছুটছে নিজের সবটুকু জোর দিয়ে। রিসান ওকে আটকাতে চাইলেই বাঁধা হলো জাহিদ। ব্যথা মেশানো কণ্ঠে বলল,”ওকে থামিয়ে লাভ নেই রিসান। যা হবার তাই হচ্ছে। যেখানে মেহনূরই সবটা জানে সেখানে রিয়া তো….’

রিসানের দুটো চোখ জ্ব ল তে শুরু করেছে। জাহিদের হাতটা শক্ত করে ধরল ও।

“এখন পরিস্থিতি আরো জটিল হবে ভাইয়া। তুই দেখ,কিছু না জেনেই কেমন করছে। যখন জানবে তখন তো….’

বাক্যটি শেষ না করেই ছুটল রিসান। ততক্ষণে অনেকটা দূর চলে গেছে রিয়া। রিসান ওকে আটকাতে পারল না। ভরা সভায় বোনকে জড়িয়ে ধরল রিয়া। মেহনূরের বুকটা হু হু করে ওঠল। বোনের পিঠে হাত রেখে ভরসা দিল।

“আপা, কথা আছে। প্লিজ চল।”

মেহনূর বিরোধের সুযোগ পেল না। ওকে নিয়ে আড়াল হলো রিয়া। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আপার দিকে।

“কী? এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে?”

“আপা,কেন পালিয়েছিলি তুই?”

মেহনূর কিন্তু বিচলিত হলো না। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল,”মনে হয়েছিল আমাদের স্ট্যাটাসের সাথে ওদের স্ট্যাটাসের অনেক অমিল। তাই পালিয়েছিলাম।”

“এটা কোনো উত্তর হলো না আপা।”

“এমনটাই হয়েছে রিয়া।”

“হয় নি। তুই আমায় মিথ্যে বলছিস। তোরা সত্যিটা আমার থেকে লুকাচ্ছিস।”

রিয়া উত্তেজিত হয়ে পড়ল। মেয়েটির অধিক উত্তেজিত হওয়ার নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ও কেমন করতে লাগল। রিসান খুঁজতে খুঁজতে চলে এসেছে। রিয়ার অবস্থা দেখে দৌড়ে এল। জাপটে ধরল কন্যাটিকে।

“শান্ত হও।”

“স্পর্শ করবেন না। আপনিই সবটা করেছেন। বলেন কী সমস্যা।”

রিসানের মুখটা মলিন হয়ে গেল। মেহনূর বোনের পিঠে হাত রেখে বলল,”রিয়া,এটাই সত্যি।”

“মিথ্যে, মিথ্যে, তোরা মিথ্যে বলছিস।”

মেহনূর আবার কিছু বলতে যেতেই রিসান ওকে আটকে দিল। ইশারায় চলে যেতে বলছে। মেহনূরের বুকের ভেতর তখন উত্তপ্ত। চলে যাওয়ার পূর্বে বার বার বোনের দিকে তাকাচ্ছে।

অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে বসে আছে রিয়া। ওর ঠিক পাশটায় বসেছে রিসান। মেয়েটির হাত ধরার ইচ্ছে হচ্ছে। অথচ ভেতর থেকে সাহস পাচ্ছে না। এমন কয়েকবার হলো। শেষমেশ সাহস পেল ও। খপ করে ধরে ফেলল হাতটি। রিয়া কিন্তু প্রতিক্রিয়া দেখাল না।

“রিয়া,আমি চাই নি এখনই তুমি সত্যিটা জেনে যাও। কখনো জানো,এমনটাও চাই নি।”

রিসান উত্তরের অপেক্ষায় বসে আছে। এদিকে রিয়া মৌনতা ধরে রেখেছে। সেটার জন্য রিসান ই বলতে লাগল।

“আমাদের পরিবারের নিয়ম বংশের বাইরে বিয়ে করা যাবে না। এটির একটি কালো অধ্যায় রয়েছে। যতটুকু শুনেছি, জেনেছি আমাদের বংশের একজন অন্য বংশ থেকে প্রতারিত হয়েছিল। আমাদের সমস্ত অর্থ সম্পদ নিয়ে নিয়েছিল। তখন থেকেই সিদ্ধান্তটি আসে। অন্য বংশের কাউকে বিয়ে করা যাবে না। জানি না কেন, তবে এটিকে এক প্রকার লালন করে চলেছে সবাই। অথচ সময় বদল‍েছে। তারা এখনো র ক্ত কে বিশ্বাস করে। তাদের মতে র ক্ত কখনো প্রতারণা করে না যতক্ষণ না অবধি অন্য বংশের র ক্তের স্পর্শে আসে।”

এত গুলো কথা বলে থামল রিসান। রিয়া এখনো অন্য দিক ফিরে আছে। হাত কিছুটা আলগা হয়ে যাওয়ায় পুনরায় শক্ত করে হাতটি আগলে নিল রিসান।

“তোমাকে ভালোবাসি রিয়া। বিষয়টি খুব দ্রুত ঘটেছে। আমি জানি,তোমার প্রথম অনুভূতিকে ফিরিয়ে দিয়েছি আমি। তবে বিশ্বাস করো, আমি প্রতারক নই। যদি তাকে ফেলে তোমার কাছে আসতাম তবে প্রতারণা হতো না? তুমি কি খুশি হতে, তোমার পছন্দের মানুষটি ডাবল টাইমিং করলে? তখন তো তোমাকেও ঠকানো হতো।”

কথাটি বোধহয় রিয়ার মস্তিষ্কে পৌছাতে পেরেছে তাই এদিক ফিরল ও। চোখের জলটুকু মুছে নিয়ে বলল,”আমরা চাইলেই তো বিয়ে করতে পারব না। তবে সম্পর্ক করে লাভ কী?”

এখানেই থেমে গেল রিসান। রিয়া ওঠতে চাইলে ওকে ধরে রাখল পুরুষটি। এদিকে মেয়েটার ভেতরে ঝড় ওঠে গেছে।

“কিন্তু একটা কথা বলেন, আপার বিয়েটা কেমন করে হলো?”

রিসান চুপ করেই রইল। রিয়া পুনরায় প্রশ্নটি করল।

“বলছেন না কেন?”

“এটির পেছনের সত্য খুব নি ষ্ঠু র রিয়া।”

“হোক,তবু আমি জানতে চাই।”

“এটা তো জানোই আজিম চাচ্চু বেশ অনেক বছর আগেই মা রা গিয়েছেন।”

“হ্যাঁ। কিন্তু এসবের সাথে আপার বিয়ের সম্পর্ক টা কী?”

“আছে। এখান থেকেই সবটা শুরু। আজিম চাচ্চু বংশের বাইরে গিয়ে বিয়ে করেছিলেন। ফলস্বরূপ তাকে পরিবার ছাড়তে হয়। শুধু তাই নয়। বলা হয়েছিল তার পা যেন এলাকায় না পড়ে। দাদিজান অনেক অনুরোধ করার পর ও তাদের বিষয়টি মানা হয় নি। চাচ্চু কে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এরই মাঝে ঘটে যায় আরেক কান্ড। চাচ্চুর মেয়ের বয়স তখন কয়েক মাস। চাচি মা রা যান হুট করেই। স্বাভাবিক ভাবেই ছয় মাসের শিশুকে চাচ্চুর পক্ষে মানুষ করা অসম্ভব প্রায়। তাছাড়া স্ত্রী হারিয়ে তিনি পাগল ছিলেন প্রায়। দাদিজান গোপনে তাদের সাথে যোগাযোগ রেখেছিলেন। চাচ্চুর মেয়েকে আমাদের বাড়িতে আনতে চাইছিল না কেউ। তাই পরিবারের সকলকে জানিয়ে বাবার বন্ধুর বাড়িতে রাখা হয়। দাদিজান বুঝতে পেরেছিলেন মেয়েটির প্রতি বিশেষ কোনো মায়া নেই কারো। তাই ওনার নামে থাকা সমস্ত প্রপার্টি এমন ভাবে দলিল করে রাখছেন যা কেউ ভাবতেও পারে নি। দলিলে বলা হয় যদি জাহিদ ভাইয়ার সাথে ভবিষ্যৎ এ মেয়েটির বিয়ে হয় তবে সমস্ত প্রপার্টি আমাদের নামে এসে যাবে। নতুবা সরকারের হাতে চলে যাবে। আশা করছি মেয়েটি কে এতক্ষণে তা বুঝে গেছ।”

কথা গুলো শেষ করে রিয়ার দিকে তাকাল রিসান। মেয়েটি পাথরের মতন হয়ে আছে। ওর গালে হাত ছোঁয়াতেই চোখ থেকে এক বিন্দু নোনা জল নেমে এল।

“কাঁদছ কেন?”

“আপা আমার নিজের আপা না?”

এই নি র্ম ম সত্যিটা রিসান মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে পারল না। রিয়া কিছু সময় চুপ করে রইল। তারপর ই চিৎকার করে ওঠল। ওর বুকের ভেতর য ন্ত্র ণা হতে শুরু করেছে। যেই আপার সাথে এতদিনের পথচলা, সেই আপা নাকি ওর নিজের আপা না! কী নি ষ্ঠু র সত্যি।

রিয়ার দম বন্ধ হয়ে আসছে। এ বাড়িতে এক সেকেন্ড থাকার ইচ্ছে হচ্ছে না। মেহনূর বসে আছে। গোজগাজ শেষ করে কাছে এল রিয়া। আপার মুখ খানি হাতে তুলে বলল,”জাহিদ ভাই তোকে ভালোবাসে না তাই না আপা?”

মেহনূর মলিন হাসল। বলল,”দাদিজান আমার ভবিষ্যৎ সিকিউর করতে গিয়ে আমাকেই বলি করে গেলেন।”

মেহনূরের দুঃখটা বুঝতে পারে রিয়া। ও অসহায় চোখে তাকায়। কিছু সময় পর বলে,”কিন্তু আমার মনে হয় জাহিদ ভাইয়া সত্যিই তোকে ভালোবাসে।”

“বাসে না।”

কথাটা শেষ করেই টলমলে চোখটা মুছে নিল মেহনূর। তবে বেহায়া চোখ আবারও ভিজে গেল। কান্নায় ভাসিয়ে দিল। রিয়া বোনকে জাপটে ধরল।

“এই আপা। কাঁদছিস কেন তুই?”

“জাহিদ আমায় ভালোবাসে না রিয়া। ভালোবাসে না।”

রিয়া কি বলবে বুঝতে পারছে না। মেহনূর কান্নায় দু চোখ ভাসিয়ে যাচ্ছে।

“শুধুমাত্র আমার জন্য দুটো মানুষের জীবনটা শেষ হলো। কেন এমনটা হলো বল তো। কেন এমনটা হলো।”

রিয়া তখনো বুঝল না মেহনূর কী বলে চলেছে। তবে ও প্রশ্ন করল না। কান্না থেমে যাওয়ার পর মেহনূর ই বলল,”জানিস, জাহিদ কে জোর করে সবটা করানো হয়েছে। সানা আপুর সাথে সেই ছোটবেলা থেকে ওর প্রেম। আর আমি কী না ওদের মাঝে…”

বাক্যটি শেষ না করেই কান্নায় ডুবে গেল মেহনূর। রিয়ার হাত পা শীতল হয়ে ওঠেছে।

“বিয়ের দিন সানা আপু আমায় সবটা জানিয়েছিল। অথচ আমি কিচ্ছু করতে পারি নি। সব শেষ হয়ে গেল। সব শেষ।”

ভাষাহীন রিয়া অব্যক্ত সব অনুভূতি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ড্রয়িং রুমে বসে থাকা সানার মুখের পানে তাকিয়ে মনে হলো পৃথিবী বুঝি সব থেকে নি র্ম ম যন্ত্রণাটা সানার জন্যেই তুলে রেখেছিল। এই যে, ওর চোখের সামনে সব ঘটে গেল। অথচ মুখে মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে প্রিয়তম কে ছাড়তে হলো।

চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি