#কষ্টের বালুচরে আমি একা (১)
# কে এ শিমলা ( লেখনীতে)
ঘুম ঘুম চোখে হাত বুলিয়ে ফোন হাতে নিয়ে সময় দেখলাম, রাত এগারোটা বাজে। সেই চারটায় ঘুমিয়ে ছিলাম আর এখনো ঘুমিয়ে আছি। এতো রাতে হয়ে গেলো কেউ ডাকেনি আমায় নাকি আমি উঠিনি। আমি উঠে ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হলাম। রুম থেকে বের হয়ে কিছুটা এগিয়ে যেতেই হাসির আওয়াজ আসছে শুনতে পেলাম। ড্রয়িং রুম থেকে আসছে মনে হলো।
আমি গিয়ে দেখলাম সবাই ডাইনিং টেবিলে বসে আছে শুধু আমি ছাড়া। এমনটা নতুন নয় বুঝ হওয়ার পর থেকেই দেখছি এমনটাই হয়। আমি মারজানা খান মৌরি,পরিবারের বড় মেয়ে। অনেক শুনেছি পরিবারের বড় মেয়ে নাকি পরিবারে রাজকন্যা হয়ে থাকে অথচ সেখানে আমি।
হঠাৎ ছোট চাচি ডেকে বলে উঠলেন- কী রে মৌ মা উটেছিস, তোকে ডাকলাম উঠলিনা। খেতে আয় শুধু তুই বাকি। বলে তিনি সবাই কে খাবার বেড়ে দিয়ে নিজেও বসলেন। আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি বড় চাচির সাথে কী নিয়ে কথা বলছেন। আমার দিকে উনার কোনো খেয়াল নেই,আর না কখনো ছিল।
আমি চুপচাপ গিয়ে চেয়ারে বসে পড়লাম। আঙ্গুল দিয়ে খাবার নাড়াচাড়া করছি , খেতে ইচ্ছে করছে না।
খেয়াল করে দেখলাম সবাই কী নিয়ে কথা বলছে, প্রসঙ্গ টা হচ্ছে বিয়ে কিন্তু কার বিয়ে?
দেখলাম মিরা ( বড় চাচার মেয়ে আমার ৩ মাসের ছোট) ওকে বলছে, বিয়ের পর আমাদের ভুলে যাস না আবার ( রাফি)
আরে এই ফ্লাট থেকে ওই ফ্লাট এক তলা থেকে অন্য তলা , এই সামান্য দুরত্বে মধ্যে ভুলে যাবে আমাদের আর দূরে হলেই বা ভুলবে নাকি আপু? ( মারজান)
ওদের কথা শুনে দেখলাম মিরা লজ্জায় লাল নীল হচ্ছে। আমি আমার পাশে মেরিন কে দেখতে পেলাম। ওকে জিজ্ঞেস করলাম কী নিয়ে সবাই কথা বলছে ।
মেরিন: আরে আপু তুমি জানো না মিরা’পুর বিয়ে ঠিক হয়েছে। আগামী শুক্রবার বিয়ে রাফি আমাকে বলল তাই আমি চলে আসলাম। যাই বলো তোমাদের বিয়ে নিয়ে কত প্লান জমিয়ে মার্কেট করবো।
আমি মেরিনের কথা শুনে অবাক হলাম মিরার বিয়ে এই কথা শুনে ওর খালার বাসা থেকে ও চলে এসেছে।
আর আমি বাসায় থেকেও কিছু জানিনা, এরকমটা প্রায়ই হয় এরকম অনেক বিষয়ই আমার অজানা থাকে। খাবার খেতে লাগলাম চুপচাপ,কেন যেন জানার আগ্ৰহ নেই এসবের,যেখানে সবাই এরকম দূরে রাখে সেখানে আমি।
খাবার খেয়ে রুমে চলে আসলাম কিছু ভালো লাগছে না। এতো রাতে ছাদে যাওয়া ঠিক হবে না। তাই রুমের লাইট অন করে ব্যলকনির লাইট অফ করে ব্যলকনিতে চলে গেলাম। একটা বেতের চেয়ারে বসে ভাবতে লাগলাম নিজের জীবনের কথা।
জন্মের পর আমার জীবন কেমন ছিল জানিনা তবে এটা শুনেছিলাম আমি একরকম বড় হয়েছি ছোট ফুপির জন্য। আমার যখন সাত বছর বয়স তখন ফুপির বিয়ে হয়ে যায়। সেই থেকেই আমার নিজের সব কিছু নিজের ওপর। আমার কোনো কিছুর অভাব ছিল না, অভাব শুধু ভালোবাসার। আমার কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে সেটা একবার বললেই হাতে পেয়ে যাই।
শুধু ভালবাসার অভাবেই আমি অভাবি।
আমার মনে কখনো মনে পরে না মা-বাবা বা অন্য কেউ কখনো জিজ্ঞেস করেছে কেমন আছিস। সবার সাথে থেকেও মনে হয় যোজন যোজনের দুরত্ব। হায়রে ভাগ্য আমার নিজের বাড়িতে থেকেও মনে হয় আশ্রিতা হয়ে আছি।
রাত একটা বেজে পঁচিশ মিনিট আমি রুমে চলে গেলাম। কি হবে এসব ভেবে দিন গুলো তো আর ফিরে আসবে না। লাইট নিভিয়ে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে নিলাম। বালিশে মাথা রেখে চোখ বুজতেই দু’ফোটা জল গড়িয়ে পরে নেত্র যুগল থেকে। বুকের ভেতর কেমন যেনো ছটফট করছে।
সকাল বেলা ভার্সিটির যাবো বলে ড্রয়িং পা রাখতেই বড় চাচি বলে উঠলেন কী রে মৌ কোথায় যাচ্ছিস তুই?
আমি বললাম ভার্সিটি যাচ্ছি চাচি আর কোথায় যাবো।
চাচি: এই সপ্তাহ খানেক তোকে কোথাও যেতে হবে না। আমার মেয়ের বিয়েটা ভালোয় ভালোয় হয়ে যাক। এখন হাতে হাতে কিছু কাজ কর যা।
আমি চাচি কে বললাম বিয়েতো আর আজ নয়। তাছাড়া আমার সামনের সপ্তাহে ক্লাস টেস্ট আছে চাচি যেতে হবে।
চাচি : মৌ বেশি কথা বলছিস তুই।
আমি চাচির কথা শুনে নিজের রুমে ফিরে আসলাম। ড্রেস চেঞ্জ করে নিচে এসে কিচেনে গেলাম।
দেখলাম ছোট চাচি,মামি , রহিমা খালা,ঝিমি আপু। চারজনই কাজ করছে চাচি আর মামি টুকটাক।
তার মধ্যে আমি কী করবো বুঝতে পারলাম না। এমনিতে ওতো কিছু করতে হয় না।
তবুও ছোট চাচি কে জিজ্ঞেস করলাম চাচি আমি কী কিছু করবো?
তিনি বললেন কিছু করতে হবে না। আমি কিচেন থেকে বেরিয়ে আসলাম। কী করবো এখন কেমন যানি দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার ভার্সিটি গেলে হয়তো একটু ভালো লাগতো। আমি পা বাড়ালাম ছাদের উদ্দেশ্যে। ওখানে গিয়ে দেখলাম সবাই বসে গল্প করছে।
বাড়ির বড়দের মতো ছোটরাও আমার সাথে তেমন মিশে না, প্রয়োজন ছাড়া একটা কথা ও বলে না।
এমন আচরণ মনে হয় আমি এই বাসার কেউ না। বুঝিনা আমি খারাপ নাকি আমার ভাগ্য খারাপ।
আমি ছাদের অন্য পাশে চলে গেলাম । জানি ওরা কখনো আমায় ওদের কাছে ডাকবেনা আর আমিও যেতে পারবো না। ছাদের রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে আকাশের পানে দৃষ্টি স্থির করলাম। একটা কথা বুঝতে পারছিনা আমি তো মিরার থেকে তিন মাসের বড় তাহলে আমার আগে ওকে বিয়ে দিচ্ছেন তাও এতো তাড়াতাড়ি কেন। আর কার সাথেই বিয়ে হচ্ছে ওর।
আমার চোখ একটা ব্যলকনিতে আটকে যায় একটা মানুষকে দেখে আমার হার্টবিট বেড়ে যায় সাথে সাথে।
আজ প্রায় দু’সপ্তাহ পর প্রিয় মানুষ টাকে দেখছি।
জিসান ভাই দাড়িয়ে আছেন,উনাকে কেন জানিনা খুব বেশি ভালো লাগে আমার অনেক বেশি ভালোবাসি। একবার তা বলেছিলাম উনাকে, উনি বলেছিলেন আগে পড়ালেখা শেষ করো নিজের ক্যারিয়ার গড় পরে অন্যসব। তাই উনার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছি জানিনা কবে এই প্রহর টা শেষ হবে।
আমি আর বেশিক্ষণ ওদিকে তাকালাম না । পিছনে ফিরে দেখলাম তেমন কেউ নেই। মিরাজ ভাই,রাফি, আর মারজান ছাড়া। আমি ও নিচে নেমে আসি। রুমে ঢুকতেই মেরিন রুমে ঢুকে ওর হাতে চারটা শপিং ব্যাগ। ও দপ করে বিছানায় বসে ব্যাগ গুলো আমার হাতে দেয়। পরে বলল মেরিন: নাও আপু এগুলো তোমার । এখানে এঙ্গেজমেন্ট, গায়ে হলুদ বিয়ের কাপড় সহ সবকিছু। এই মাত্র আসলাম কেনাকাটা করে , অনেক গরম লাগছে ফ্রেশ হতে হবে যাই আমি । তুমি দেখ তোমার পছন্দ হয় কী না সবকিছু।
আমি মুচকি হেসে মাথা নাড়লাম মেরিন যাওয়ার পর আমি ব্যাগ খুললাম। প্রথমেই পাঁচটা জর্জেট ওড়না পেলাম, কালার গুলো সুন্দর। আরো একটা ব্যাগ খুলতেই একটা কাঁচা হলুদ রঙা শাড়ি দেখতে পেলাম হয়তো হলুদের জন্য।
আরো একটা ব্যাগ খুলে একটা কালো গাউন পেলাম । এটাও সুন্দর। আবার অন্য ব্যাগ খোলার পর একটা পিংক কালার লেহেঙ্গা বারি সুন্দর।
অন্যান্য ব্যাগ গুলোতেও একটা গাউন, তিনটা থ্রী-পিছ , আর চার জোড়া জুতা পেলাম সবকিছুই সুন্দর।
আজকের মতো সবসময়ই সবকিছু পাই তবে তা আমার পছন্দে না তাদের পছন্দে।
আবার মেরিন আসলো আমার রুমে বলল পছন্দ হয়েছে? আমি বললাম হ্যাঁ।
ও বলল তাহলে তৈরি হয়ে নিও কিন্তু, বড় চাচি বললেন কিছুক্ষন পর মিরা’পুর এঙ্গেজমেন্ট এর অনুষ্ঠান শুরু হবে।
এতোক্ষণে বুঝলাম কী হতে চলেছে বাড়িতে।
আমি ঠিক আছে বললাম , ও চলে যায়।
আমি নামাজ পড়ে তৈরি হয়ে নিলাম । হয়তো কিছুক্ষণ পর অনুষ্ঠান শুরু হবে।
আমি ওখানে ড্রেস গুলো থেকে কালো গাউন পরে নিলাম। কালো ওড়না দিয়ে মাথা পিনা’প করে, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক মুখে একটু পাউডার দিলাম।
হাতে কালো ঘরি, জুতো গুলোর মধ্যে কালো জুতা পরলাম। সবকিছু পড়ে ব্যলকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে বাসার নিচে অনেক গাড়ি দেখতে পেলাম, হয়তো মেহমানরা চলে এসেছেন। আমার রুম থেকে বের হতে মন সায় দিচ্ছে না তবুও বের হলাম। পুড়ো বাড়িতে মানুষের আনাগোনা। একটু দুরেই দেখলাম আমার সব ভাই বোনদের কে সবাই বেশ মজা করছে।
একটু সামনে এগুতেই আমার মা কে দেখলাম। তিনিও কালো শাড়ি পরেছেন খুব সুন্দর লাগছে উনাকে। আসলেই উনি খুব সুন্দর মানুষ। আমি একটু দুরে একটা কর্নারে দাঁড়ালাম। আম্মু আমার দিকে একবার তাকিয়ে চলে গেলেন। মিরাকে সুন্দর করে সাজিয়ে স্টেজে নিয়ে আসা হলো। খুব কিউট লাগছে ওকে, ওর ভাগ্যটাও ওর মতো সুন্দর। যেখানেই যাক সুখে থাকুক এইটাই বললাম মনে মনে। অনুষ্ঠান শুরু হলো, আমার পাশে এসে কেউ দাঁড়িয়েছে , চোখ তুলে দেখলাম মেরিন। ওকে কিছু জিজ্ঞেস করবো তার আগেই আম্মু ডেকে নিয়ে গেলেন ।
আমি ফোন টি’প’তে লাগলাম । মিনিট দু’য়েক পর শুনতে পেলাম কেউ বলছে- বাবা ওর হাতে ওই আংটি পরিয়ে দাও’। আমি সেই দিকে দৃষ্টি দিলাম কিন্তু যা কিছু দেখলাম তার জন্য একদম প্রস্তুত ছিলাম না…
চলবে