কাগজের তুমি আমি ৪র্থ পর্ব

0
1052

#কাগজের_তুমি_আমি
#৪র্থ_পর্ব

তার তো জানা ছিলো না তার জন্য আরো বড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিলো। ফোন রিসিভ হতেই মাহি বলে উঠে,
– কেনো ফোন করেছো আমায়?
– কেনো ফোন করেছি মানে? তুমি আসবে না? সবাই অপেক্ষা করছে যে তোমার জন্য।
– সরি অনল আমি আসতে পারবো না। আমি ব্যস্ত আছি।
– ব্যস্ত আছি মানে? আজ তো আসার কথা ছিলো না তোমার?
– ব্যস্ত আছি মানে ব্যস্ত আছি। নেক্সট উইক আমি ইউ.এস.এ যাচ্ছি। অনেক কাজ পড়ে রয়েছে। তাই তোমার ফাও বন্ধুদের আড্ডায় আমি আমি আসতে পারবো না।
– তুমি নেক্সট উইক যাচ্ছো মানে? এটা কবে ডিসাইড হলো?
– সে অনেক কথা, ফোনে বলতে পারবো না। কাল বিকেলে মিট করো সব বলবো।
– …………
– হ্যালো? হ্যালো?
– হ্যাপি বার্থডে। রাখছি।
– অনল আমার কথাটা একবার বুঝতে চেষ্টা করো।

অনল ফোন রেখে দিলো, বন্ধুদের ভুজরুকি বুঝিয়ে সেদিন খালি হাতেই বাড়ি ফিরে গেলো। সারারাত অশান্তিতে কেটেছে, হুট করে কারোর অ্যামেরিকা যাবার প্লান তো রাতারাতি হয় না। তাহলে এক সপ্তাহ পর মাহি চলে যাবে এটা আজ কেনো বললো সে? আগে বলে নি কেনো? বিভিন্ন প্রশ্ন অনলের মাথায় ঘুরপার খাচ্ছে। এখন শুধু কালকের অপেক্ষা। হয়তো কাল সে জানতে পারবে মুল বিষয়টা কি!

সকাল ১১টা,
মুখোমুখি বসে রয়েছে মাহি এবং অনল। কফি কাপে চুমুক দিতে দিতে মাহিকে জিজ্ঞেস করলো অনল,
– প্লানটা কবে করেছিলে?
– অনেক আগেই করেছি, তোমাকে বলার সুযোগ হয় নি
– সুযোগ হয় নি নাকি বলতে চাও নি
– তুমি জানো আমি আমার ক্যারিয়ার নিয়ে কতোটা ডিটারমাইন্ড; তুমি কিভাবে রিয়েক্ট করবে আমার জানা ছিলো না। তাই আমি বলি নি।
– আমি কি কখনো তোমাকে কোনোকিছুতে বাধা দিয়েছি? দেই নি তো। আজ ও দিবো না। কবে ফিরার কথা ভাবছো?
– আমি শিওর না; হয়তো নাও ফিরতে পারি। ওখানে যদি জব পেয়ে স্যাটেল হয়ে যাই নাও ফিরতে পারি
– বুঝলাম, আফটার অল তোমার ভবিষ্যতের ব্যপার। তা আমাদের সম্পর্কের ভবিষ্যতের কি হবে?
– দেখো লং ডিস্টেন্স রিলেশন তো এখন খুব কমন। আমরা না হয় সেটাই মেইনটেইন করবো।
– কতো দিন? কতো মাস? কতো বছর?
– দেখো অনল
– হুম, সব দেখছি। বলো
– এখন আমার ক্যারিয়ার আমার কাছে সব থেকে ইমপোর্টেন্ট।
– ঠিক ই তো একটা তিন বছরের সম্পর্কের জন্য তুমি কি তোমার জীবনের এতো বড় সুযোগ হারাবে নাকি? সমস্যা নাই; আমি অপেক্ষায় থাকবো। যদি আমার কাছে ফেরার ইচ্ছে তোমার হয় আমার মনের দরজা সবসময় খোলা থাকবে।
– অনল
– আজ উঠছি।

বলেই সেখান থেকে বেরিয়ে যায় অনল। এক সপ্তাহের মধ্যে মাহি অ্যামেরিকা চলে যায়। নিজেকে ভালো রাখার ব্যর্থ চেষ্টা চালাতে থাকে অনল। ধীরে ধীরে সব কিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলে, চুপচাপ নিজেকে একটা গন্ডিতে আটকিয়ে ফেলে। মাহি প্রথম প্রথম যোগাযোগ করলেও ধীরে ধীরে তা বন্ধ করে দেয়। অনলের অবস্থা আরো ও খারাপ হয় যখন জানতে পারে বিদেশে মাহি অন্য আরেকজনকে বিয়ে করে ফেলেছে। এই সংবাদটি ভেতর ভেতর অনলকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়। তখন যেনো এক প্রকার ডিপ্রেশনে চলে যায় অনল। মাহিকে সে প্রচুর ভালোবাসতো; এতোটা যে সে যদি বলে দিন তাহলে অনলের কাছে দিন, সে যদি বলে তো রাত। কয়েকবার সুইসাইড এটেম্প ও করে। ছেলের এমন অবস্থা যেনো একেবারেই মেনে নিতে পারছিলেন না সুভাসিনী বেগম। ছেলের এমন অবস্থা দেখে ধীরে ধীরে তিনিও অসুস্থ হতে থাকেন। সুভাসিনী বেগম যখন হসপিটালে ভর্তি ছিলেন তখন অনন্যা অনলকে বুঝায়। অনলকে সে তখন একটা কথাই বলে,
– যে তোর কথা চিন্তা না করে অন্যকাউকে বিয়ে করে ফেলেছে; তার জন্য কেনো নিজে কষ্ট পাচ্ছিস সাথে নিজের মাকেও কষ্ট দিচ্ছিস। আন্টির এই অবস্থার জন্য অনেকটাই তুই দায়ী।
– ……………
– এমন চলতে থাকলে সত্যি একা হয়ে যাবি অনল। মা আছেন তাকে হারাস না।

তারপর থেকে নিজেকে কোনো মতে সামলায় অনল। সুভাসিনী বেগমের জন্য আবার স্বাভাবিক মানুষের মতো বাঁচার কথা ভাবে। তবে তখন থেকেই রাগ, জিদ যেনো শতগুনে বেড়ে যায় অনলের। নিজেকে কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারে না। ছেলের জীবনটা পুনোরায় সাজাতেই ছয় মাস আগে ধারার সাথে অনলের বিয়ে দেন সুভাসিনী বেগম।

বর্তমান,
অনলের দৃষ্টি বাহিরের দিকে, নিজের জীবনের কালো অধ্যায়টি ধারাকে বলতে পেরে যেনো আজ অন্যরকম শান্তি লাগছে। মনের ভেতরের সকল কষ্টগুলোকে কাউকে বলার সুযোগ তো হয়েছে। ধারার চোখে অশ্রু, কিন্তু অশ্রু গুলো কেনো সে জানে না; অশ্রু কি এজন্য যে অনল অন্য কাউকে ভালোবাসতো নাকি অনলের কষ্ট গুলো আজ সে উপলব্ধি করতে পারছে সে কারণে। বাহিরের দিকে তাকিয়েই অনল বললো,
– তুই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলি না কেনো তোকে ভালোবাসতে পারি না, আমার যে কারোর প্রতিই ভালোবাসাটা আসে না। আমি জানি না আর কাউকে কোনোদিন ভালোবাসতে পারবো নাকি।
-…………
– জানিস এমন এক বৃষ্টির রাতে ও আমাকে দেখতে চেয়েছিলো বলে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ওর বাড়ির নিচে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। পরে কি জ্বর এসেছিলো। হাহা
– উনি জানেন তোমার বিয়ে হয়ে গেছে?
– জানি না, হয়তো।
– এখনো ভালোবাসো তাকে?
– নাহ, একটা সময় ঘৃণা করতাম ওকে। এখন ঘৃণাটাও আসে না। তবে ভালোবাসা নামক জিনিসটার প্রতি বিতৃষ্ণা এসে পড়েছে। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সব ছাড়খার করে দেয়। তাই বলছি ভালোবাসতে যাস না; আমার মতো তোকেও পুড়িয়ে দিবে।

অনলের কথায় মুচকি হেসে ধারা মনে মনে বলে,
– বড্ড দেরি করে ফেললে তুমি, আমি যে ইতিমধ্যে তোমায় ভালোবাসার আগুনে জ্বলছি, পুড়ছি। জানি সেটার পরিনতি কি!

সুভাসিনী বেগমের ডাকে ধারা বাস্তবে আসে। অনলকে কিছু না বলেই রুম থেকে বেরিয়ে যায় সে। অপর দিকে সুভাসিনী বেগম ধারাকে অনলের রুম থেকে বের হতে দেখে বেশ অবাক হন। ভেবেছিলেন সে রাতের পর থেকে মেয়েটা অনলকে ভয় পাবে, তার ধারে কাছে যাবে না। কিন্তু ধারার আচরণের স্বাভাবিকতা দেখে তিনিও অবাক। সেদিন আর ধারাকে কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না তিনি।

সকাল ৯টা,
ডাইনিং টেবিলে অনল নাস্তা করতে আসলে, সুভাসিনী বেগম তাকে ধীর এবং শক্ত কন্ঠে বলেন,
– তুমি কি বাহিরে যাবার সিদ্ধান্ত পাকাপুক্ত ভাবে নিয়ে নিয়েছো?
– হুম, কাজ চলছে। আমি চেষ্টা করছি; এই সপ্তাহের ভেতর আমাকে জার্মানি পাঠানো হবে।
– যত তাড়াতাড়ি হবে ততোই ভালো। ধারা তোমার প্রতি এমনিতেই দূর্বল হয়ে পড়েছে। আমি চাই না আরো দূর্বল হোক। ছোট বয়স, কিছুদিন পর এমনেই তোমাকে ভুলে যাবে।
– বুঝেছি।

বলেই অনল সেখান থেকে চলে যায়। সুভাসিনী বেগম যা বলেছে তা যে সম্পূর্ণ সঠিক তা খুব ভালো করেই জানে সে। তবুও মেয়েটাকে এভাবে ছেড়ে যেতে মন চাইছে না। কোথাও যেনো ফাকা লাগছে। অনল এবং সুভাসিনী বেগমের কথোপকথন আড়াল থেকে সবটুকু শুনে ধারা। সুভাসিনী বেগমের মুখের উপর কথা বলার সাহস তার নেই। তাই চুপচাপ নিজ ভাগ্যের নির্মম পরিহাস টুকু মেনে নেয় সে। দিন সাতেক পর অনল জার্মানি চলে যায়। যেদিন অনল চলে গিয়েছিলো ধারা পাগলের মতো আচারণ করা শুরু করেছিলো। অনলের রুমে যেয়ে প্রচুর কেঁদেছে, শেষমেশ অনলের ছেড়ে যাওয়া চিঠিটুকু পায় সে। চিঠিতে লেখা ছিলো,

“ ভেবেছিলাম অনেক কিছু লিখবো। কিন্তু সব কিছু একত্রে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে; তালগোল পাকিয়ে গেছে আমার ভাবনাগুলো। আমি চলে যাচ্ছি, জানি না আর দেখা হবে কিনা। কিন্তু তোকে একটা কথা কোনোদিন বলা হয় নি, তুই অনেক ভালো একটা মেয়ে। আমি চাই তুই অনেক সুখী হো। আমার ভাঙ্গা জীবনে জরিয়ে হয়তো তুই কোনোদিন সুখী হতে পারতি না। কারণ আমার পক্ষে তোকে ভালোবাসাটা সম্ভব নয়। মা তোর ভালোর জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতেই আমাদের মঙ্গল। তোর জন্য আমি ডিভোর্স লেটার সাইন করে দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের কাগজের সম্পর্কটা কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকলো। মাকে বলিস আমি এখানে সব ফরমালিটি শেষ করে দিয়েছি। আর তোকে বাইশ বছর অবধি এই সম্পর্কের ভেতর থাকতে হবে না। ভালো থাকিস।

ইতি,
অনল “

ধারার কিশোর মনে অনলের চলে যাওয়াটা যত না আঘাত হেনেছিলো তার চেয়ে অধিক আঘাত হেনেছিলো যখন অনলের রেখে যাওয়া ডিভোর্স লেটারটা দেখে। ভেবেছিলো অনল হয়তো তার কাছে কোনো না কোনোদিন ফিরবে। কিন্তু সে আশাটুকুও এখন নেই। সেদিন ধারা কিশোরী মনটা একেবারে বড় হয়ে গিয়েছিলো এক ধাক্কায়।

পাঁচ বছর পর,
এয়ারপোর্টে নেমেই হাসপাতালের দিকে রওনা দিলো অনল। আজ পাঁচ বছর বছর পর সে জার্মানি থেকে ফিরেছে। অবশ্য অনেক আগেই ফিরে আসতো তবে বিভিন্ন কারণে সেটা হয়ে উঠেনি। আজ যেমন পাঁচ বছর পর নিজের মাকে দেখবে ঠিক তেমনি পাঁচ বছর পর ধারাকেও দেখবে। আচ্ছা পুচকে মেয়েটা কি বড় হয়ে গেছে? এখনো আগের মতো ছেলেমানুষী করে? নাক্লি বদলে গেছে? এসব নানা চিন্তা মাথা নিয়ে হাসপাতালে পৌছায় অনল। কেবিনের বাহিরে মামা দাঁড়িয়ে আছেন। গিয়ে সেলিম সাহেবকে সালাম দিয়ে বলে,
– মামা, মা কেমন আছে?
– এখন আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছে বাবা। তুমি কি এয়ারপোর্ট থেকেই আসলা?
– জ্বী মামা। মাকে এখন দেখা যাবে?
– হু, যাও দেখা করে আসো।

কেবিনের ভেতর সুভাসিনী বেগম শায়িত ছিলেন। ছেলের পাঁচ বছর দেখে খুশীতে উঠে বসার চেষ্টা করেন তিনি। অনলের চোখ চিকচিক করছে, শান্ত ভাবে মার পাশে বসে সে। পাঁচ বছর পর মা ছেলের মিলনের সাক্ষী দিচ্ছে তাদের অশ্রুগুলো।
– এভাবে কাঁদলে যা একটু ভালো হয়েছিলে আবার অসুস্থ হয়ে যাবে কিন্তু!

পেছন থেকে নারী কন্ঠটি শুনে অনলের ভেতরে এক অন্যরকম শিহরণ বয়ে যায়। অবাক নয়নে পেছন ফিরতেই……………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি