#কৃষ্ণডাহুক – ৩২
আয়ানা আরা (ছদ্মনাম)
( উপসংহার )
‘ সাহিল,তুমি এখানে? ‘
রুবাইদা কাঁপা স্বরে বললো কথাটা। সাহিল সহ সবাই চমকালেন! সাহিল বলল,’ রুবাইদা! ‘
রুবাইদা কেঁদে উঠলেন শব্দ করে, বললেন,’ এতোদিন কোথায় ছিলে তুমি সাহিল? ২০টা বছর ধরে আমি তোমার অপেক্ষায়! তোমাকে কিছু বলার অপেক্ষায়! কিছু সত্য জানানোর অপেক্ষায় ছিলাম! ‘
রুবাইদার কথায় সকলে চমকালো! বিস্ময়ে সকলের চোয়াল হা হয়ে গেলো, শান্ত রইলো শুধু সাহিল আর মর্তুজা বেগম! লজ্জায় তিনি মাথা নিচু করে আছেন। রুবাইদার নজর তখন কারো দিকে নেই তিনি বললেন,’ তুমি যেদিন বিদেশ চলে গেলে সেদিন রাতেই মীরা প্রস্রব বেদনায় কাতরাতে থাকে! আমি কি করবো ভেবে পাইনা, মেয়েটা তখনো তোমার নামই নিচ্ছিলো! এবং মেয়েটা যখন ম র বে সেই মূহুর্তেও সে তোমার নাম নিয়েছে। ‘
সাহিল অবাক হয়ে তাকালেন!
_
আজমীরার সাথে কঠিন প্রেম সাহিলের। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, খেটেছে এর মাঝেই মার্জিয়াকে বিয়ে করে বাড়ি আনে আদিল, বিয়ের দেড় বছরেই জন্ম হয় আদ্রিকের সেই থেকে মর্তুজা বলল,’ মেঝ পোলার বিয়া দিয়া দাদি হইলাম, কিন্তু তুই এখনো বিয়া করলি না। ‘
সাহিল প্রতিবারই এড়িয়ে যেতো কিন্তু একদিন শক্ত হাতে ধরলেন মর্তুজা! যতক্ষণ না বিয়ে দিবেন তার শান্তি নেই! উঠেপড়ে লেগেছেন! সাহিল ছোট বেলা থেকেই শান্ত থাকায়, তার কোনো কথায়ই কোনো জবাব দেয়নি! বয়স্ক মানুষ! এক দুদিন এ নিয়ে কথা বলে ভুলে যাবেন! কিন্তু মর্তুজা বেগম লেগে পড়লেন পাত্রী খোঁজার জন্য! পেয়েও গেলেন, সম্পর্কে সাহিলের খালাতো বোন! ইতি নাম! মেয়েটা সুন্দর সাহিলের সাথে মানাবে ভেবে সাহিলকে না জানিয়েই বিয়ে পাকা করে ফেলেন মর্তুজা। বিয়ের একসপ্তাহ আগে সাহিলকে তা জানালে, সাহিল সরাসরি মানা করে দেয়! মর্তুজা বেগম নাছোড়বান্দা তিনি বিয়ে দিয়েই ছাড়বেন তখন সাহিল বলে,’ আমি এক মেয়েকে ভালোবাসি বিয়ে করলে তাকেই করবো। ‘
‘ তুই যে আজমীরাকে ভালোবাসিস খুব ভালো কইরাই জানি! মাইয়াডা এতিম! ধন সম্পত্তি কিছু নাই! না আসে মা-বাপ! এমন মাইয়ারে আমি পোলার বউ করমুই না! কার না কার পাপের ফসল আমি কেন কাঁধে নিবো? ‘
‘ মা! ‘
সাহিলকে পাত্তা দিলেন না মর্তুজা বেগম। বড় ছেলের বিয়ে দিয়েই ক্ষ্যান্ত হবেন! প্রতিবেশীরা কিসব বলে তার ছেলেকে নিয়ে! সেসব শুনতে তার ভালো লাগে?
হলুদের আগ অব্দিও মর্তুজাকে বুঝিয়ে আশা আলো দেখলেন না সাহিল। এমতাবস্থায় আজমীরাকে নিয়েও তিনি পালাতে পারবেন না! আজমীরাই পালাবে না! অথচ আজমীরার সাথে তিনি গোপন বিবাহ করেছেন আজ দেড় বছর হতে চললো! আজমীরাকে বাড়ি তুললেও তাকে নানান বঞ্চনা সহ্য করতে হবে যা তিনি চাইবেন না কখনো। কিন্তু আজমীরাকে তিনি হারাতে পারবেন না কিছুতেই। আজমীরাকে বারবার ফোন দিতে লাগলো সাহিল উঠালো না আজমীরা। রাগে ফোন ভেঙে ফেললো সাহিল! আজমীরা ফোন উঠাচ্ছে না কেনো!
তখনই মর্তুজা বেগম এলেন, বললেন,’ আজমীরাকে ফোন দিয়া লাভ নাই! ও একটা লোভী! এক লাখ টাকার বিনিময়ে ও তোরে ছাড়সে! ‘
স্তব্ধ সাহিল, মর্তুজা এই বলেই চলে গেলেন! সাহিল বন্ধুবান্ধব দিয়ে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করলেন।
_
‘ সাহিলকে ছেড়ে কেনো এখানে এলি মীরা? উনি তোকে খুব ভালোবাসে! ‘
আজমীরা কেঁদে উঠলো বান্ধুবি রুবাইদাকে জড়িয়ে। সাহিল আর আজমীরা সমবয়সী হওয়াই দুজনেরই রুবাইদার সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব!
আজমীরা কাঁদতে কাঁদতে বললো,’ সাহিলের জীবন নষ্ট হয়ে যাবে রুবু! কোথায় আমি আর কোথায় সাহিল? ‘
রুবাইদা শক্ত মুখে বলল,’ এসব ও প্রেম করার আগে ভাবতে পারলো না? তোকে ঠকিয়েছে! ‘
‘ ঠকায়নি ও! ওর মা চায়নি আমি তাদের বাড়ির বউ হই! আমাকে এক লাখ টাকার বিনিময়ে চলে যেতে বলেছে। কিন্তু আমি টাকা নেইনি! সরে এসেছি! আমি এতিম হলেও আত্মসম্মানহীন নই। ‘
রুবাইদা অবাক হয়ে বলল,’ ওই মহিলা কে বলার? তার ছেলেই তো বিয়ে করেছে তোকে! আবার ওই মহিলা কোথা থেকে আসলো? ‘
‘ ওর মা আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে! আমি নিজেকে আটকে রাখতে পারিনি, চলে এসেছি! তোর বাসায় থাকতে দিবি দয়া করে? আর কিছুর ব্যাখা চাস।’
‘ দিবো! সাহিল তোকে ফোন দেয়নি? ‘
‘ দিয়েছে, ব্লক দিয়ে দিয়েছি! ‘
‘ তোরা বিবাহিত আজমীরা! ‘
‘ ও আমাকে ছাড়াই সুখে থাকবে রুবু! ‘
‘ আজমীরা, কিভাবে চলবি একা তুই? ‘
আজমীরার চোখের কার্ণিশে জল এসে জমা হলো, অস্ফুট সুরে বলল,’ আমি প্রেগন্যান্ট রুবু! আমার পেটে সাহিলের সন্তান! আমি তাকে জানাতে পারিনি এই কথা। ‘
রুবাইদা চমকালো! সাথে সাথে ফোন হাতে নিলো! ততক্ষনে বুঝি দেরী হয়ে গেলো!
সাহিল বিদেশ চলে গিয়েছে বিয়ের আগেই! চিঠি পেয়ে মর্তুজা একটা সেখানে লেখা,’ আমার মন নিয়ে ভাবোনি, আমার ইচ্ছে নিয়ে ভাবোনি, আমার ভালোবাসা নিয়ে ভাবো নি তাই আমিও ভাবিনি তোমার সম্মান নিয়ে। ‘
_
‘ আজমীরা গর্ভবতী হওয়ার পর আমি সবসময়ই চেষ্টা করতাম যোগাযোগ করার সাহিলের সাথে! কিন্তু ভাগ্য খারাপ পারিনি, এমন হতে হতে সেই কাঙালি মূহুর্তটা চলে এলো! আজমীরা প্রস্রব বেদনায় যখন কাতরাচ্ছিলো তখনো আমি চেষ্টা করেছি যোগাযোগের পারিনি! আজমীরাকে হসপিটাল নিলাম। শেষবার ও আমাকে বলেছিলো,’ আমার বাচ্চাটাকে দেখে রাখিস রুবু, আমি ম রে গেলে! আর আমার সাহিলের খোঁজ পেলে বলিস আমি তাকে বড্ড ভালোবাসি! মৃত্যুর পরেও বেসে যাবো! ‘
বলেই থামলো রুবাইদা সবাই অবাক চোখে তাকয়ে আছে। রুবাইদা সাহিলের দিকে তাকিয়ে আবার বলল,’এটাই ছিলো শেষবার কথা! বাচ্চা হলো, কোলে নিলাম দেখা হলো না আজমীরার সাথে! ঘোষণা হলো সে মৃত্যু বরণ করেছে। কথাটা শুনে আমি থমকেছিলাম তোমার পরিবারের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি পারিনি তখনো! ব্যর্থ হলাম! বাচ্চাটার নাম দিলাম আজমীরার সাথে মিলিয়ে মীরা। মীরার জন্মের পর থেকে আমি চেষ্টা করতাম যোগাযোগের জন্য! শুধুমাত্র সেই বাচ্চার জন্য! পারতাম না! তোমার পরিবার ফোন ধরলেও অপমান করে কেটে দিতো তারপর বাচ্চার মুখে চেয়ে ফোন দিতাম। তারপর মীরার দায়িত্ব নেই আমি। আমার ছোট বোন আতিফাকে নিয়ে একটা অনাথ আশ্রম খুলি! অনাথ আশ্রম খুলি আজমীরার নামে। ‘
বলেই রুবাইদা থামলো। সবাই এক ঝটকায় মীরার দিকে তাকালো। মীরা থম মেরে বসে আছে৷ তার মুখে রা নেই! যেই আশায় এতোদিন বেঁচে ছিলো সেই আশা আজ পূরণ হয়েছে৷
সাহিল মীরার দিকে তাকালেন। মীরার চোখে পানি। আদ্রিক বললো,’ এইজন্য দেশে আসার পর থেকে সাহিল আব্বু আজমীরা নামের এক মহিলার তল্লাশী করছিলেন! আমাকেও বলেছিলেন। সেজন্যই রাতের বেলা আমি তার ঘরে গিয়েছিলাম জানাতে যে এই নামের মহিলা গত হয়েছেন ২০ বছর আগে! ‘
সাহিল ভাঙা কণ্ঠে বললেন,’ আমার মেয়ে মীরা! ‘
সাহিল এগিয়ে এলেন মীরার দিকে, আচমকা মীরাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন। তার কান্না দেখলো সবাই, তিনি কাঁদেননি কখনো! আজকে কাঁদলেন! মেয়েকে কাছে পেয়ে! মীরাও কাঁদলো সাহিলকে জড়িয়ে ধরে! বাবা-মেয়ের কান্না দেখলো সবাই।
‘ আমার মেয়ে আমার এতো কাছে থেকেও টের পাইনি আমি! আমি কেমন বাবা? ‘
মর্তুজা বেগম বললেন,’ আমাকে মাফ কইরা দিস তোরা! আমি অনেক পাপ করসি! যারজন্য ছেলেরেও হারাইসি! মাফ কইরা দিস আমারে। মাফ কইরা দিও রুবাইদা! ‘
দুই মাস পর
রুবাইদাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য হুমায়ূন মঞ্জিলে আনা হয়েছে। মীরার গর্ভাবস্থার এখন চার মাস। পেট খানিকটা ফুলেছে। বাড়ির সবার সাথেই সম্পর্ক খুব ভালো তার! বাড়ির বড় মেয়ে বলে কথা!
রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো মীরা। আদ্রিক পাশে এসে দাঁড়ালো তার৷ স্বযত্নে স্ত্রীকে এক হাতে জড়িয়ে ধরলো। মীরা এক গাল আলতো হাসলো, আনমনে। আদ্রিক বললো,’ সম্পর্কে তুমি আমার বোন হও আবার বউ ও। ‘
‘ আপনার বাচ্চা আপনাকে বাবা নাকি মামা ডাকবে? ‘
আদ্রিক গরম চোখে তাকালেই মীরা হেসে উঠে। এরপর মীরা ফিসফিসিয়ে বলে,’ একটা কথা জানেন? ‘
‘ কি? ‘
‘ আদ্রিকা আপু আর আমার মাঝে কোনো সম্পর্কই ছিলো না। আপু আমাকে শুধুই সাহায্য করেছে। ‘
‘ জানি আমি এমনকি বাড়ির সবাইও। ‘
‘ কিভাবে? ‘
‘ আদ্রিকাই বলেছে। ‘
‘ ওহ। ‘
‘ তোমার প্রাক্তনের আবারো ডিভোর্স হয়েছে জানো? ‘
ইয়ামিনের প্রসঙ্গ উঠতেই চমকালো মীরা। জবাব দিলো না দেখে আদ্রিক নিজেই বলল,’ শুনলাম ইয়ামিন সাহেবের স্ত্রী তার মাকে অনেক খাটাতেন, আবার অনেক টাকাও খরচ করতেন। এই জন্যই মূলত ডিভোর্স হয়েছে। ইয়ামিন সাহেব আর তার মা এখন অনেক আফসোস করে তোমাকে হারিয়ে! ‘
‘ ওহ! প্রতারণার ফল সবসময় প্রতারণাই থাকে। ‘
আদ্রিক ঝট করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো বারান্দায়। মীরার পেটে দীর্ঘ চুমু এঁকে বলল,’ হুশ! অতীত নিয়ে কোনো কথা বলো না! এখন যাই হবে সব সুখকর হবে! কোনো দুঃখ আমাদের স্পর্শ করতে পারবে না কারণ আমাদের সন্তান আসছে সুখ নিয়ে! ‘
সমাপ্ত