আবার এলো যে সন্ধ্যা পর্ব-০১

0
513

#আবার এলো যে সন্ধ্যা
পর্ব-১
©Farhana_Yesmin

মেয়েটাকে খুব চেনা চেনা লাগছে রিফাতের। ভীড়ের মাঝে বারবার চোখ চলে যাচ্ছে মেয়েটার দিকে। একদম কোনার দিকে টেবিলে বসে আছে একা একা। দীঘল কালো চুল আর মায়া কাড়া চেহারা বেশ টানছে রিফাতকে। শ্যামা গায়ের রং এ টানা টানা চোখ দুটো অসহায় দৃষ্টি মেলে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। আরেকটা কারনে চোখ যাচ্ছে হয়তো। মেয়েটা খুব সিম্পল একটা থ্রিপিস পরে এসেছে যা এই অনুষ্ঠানের সাথে একদমই বেমানান। রিফাত তার আশেপাশে একবার চোখ ঘুরিয়ে আনলো। সবাই ঝলমলে পোশাক পরে ঘুরছে সেখানে এই মেয়ের এমন পোশাক খুব বেমানান। অনলাইন প্লাটফর্মে কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে এরকম সস্তা পোশাক পরে কে আসে? মেয়েটার এমন পোশাক পরে আসার কারণ দুটো হতে পারে। এক, তার হয়তো দামী পোশাক এফোর্ড করার ক্ষমতা নেই। দুই, অনুষ্ঠানে আসার কোন ইচ্ছে তার ছিল না, বাধ্য হয়ে এসেছে।

রিফাত ভ্রু কুঁচকে ভাবছিল, মেয়েটাকে কোথায় যেন দেখেছে। কিন্তু কোথায় দেখেছে সেটা কিছুতেই মনে করতে পারলোনা। আচমকা পিঠে চাপড় খেয়ে চমকে উঠলো রিফাত। পাশ ফিরে দেখলো মিনহাজ এসে বসেছে তার পাশে। মিনহাজ ইশারা করলো-“অনেকক্ষণ ধরে দেখছি তোকে ওদিকে দেখছিস বারবার। মালটাকে মনে ধরেছে নাকি?”
রিফাতের চোখে মুখে বিরক্তি দেখা দিলো। মিনহাজের এই মুখ পাতলা স্বভাব ভালো লাগে না রিফাতের। যেটা মনে আসে সেটাই বলে ফেলে, ভালো মন্দ বাছবিচার করে না। নেহাত ন্যাংটা কালের বন্ধু তাই কিছু বলে না। মেয়েটাকে দেখতে দেখতেই জবাব দিলো-“মেয়েটাকে খুব চেনা পরিচিত লাগছে। কোথায় যেন দেখেছি। চিনিস নাকি বলতো?”
মিনহাজ উচ্চস্বরে হেসে দিলো। যদিও মাঝে মাঝে উপস্থাপকের গমগমে কন্ঠ, করতালি আর লাউড মিউজিকের কারনে ওর হাসির আওয়াজ খানিকটা চাপা পড়ে গেলো। তবুও কয়েকজন চমকে ফিরে দেখলো ওদের। রিফাত বিরক্ত হয়ে মিনহাজের দিকে তাকাতেই সে হাসি বন্ধ করে রিফাতের কানে ফিসফিস করলো-“ফেসবুকের যুগ। আশেপাশের সবাইকে চেনা চেনাই লাগে। যদিও এই মেয়েটাকে আমি চিনি। ফেসবুকে এর একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। একসাথে পাঁচটা ছেলের সাথে প্রেম করার অভিযোগ ছিল মেয়েটার বিরুদ্ধে। ছেলেগুলো প্ল্যান করে ওকে ডেকে এনে ভিডিও করে ফেবুতে ছেড়ে দেয়।”
“কি বলিস এসব!”
রিফাত সত্যিই অবাক হলো। মিনহাজ কোকের ক্যানে চুমুক দিলো-“বিশ্বাস না হলে কানিজকে জিজ্ঞেস করিস। ও কানিজের সাথেই এসেছে। আর কানিজকে তো জানিস, যেসব মেয়েদের কিচ্ছা আছে ওদের নিয়েই ওর কাজ কারবার।”
“কুর্নিশে কানিজের কানিজ?”
রিফাতের বিস্ময়বোধ বাড়লো। কানিজ মেয়েটা অনেক বোল্ড, আজকাল বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুতে কথা বলে বেশ আলোচনায় থাকছে। যদিও ওর শুরুটা
অনলাইনে কাপড়ের বিজনেস দিয়ে হয়েছিল। এখন ওর কাপড় একটা ব্যান্ড বলা যায়। দু’টো নিজস্ব শোরুম দিয়েছে ঢাকাতে। নতুন করে আরও একটা বিজনেস শুরু করেছে। যেসব মেয়েরা একা একা ঘুরে বেড়াতে চায় তাদের নিয়ে বিভিন্ন দেশে ঘুরতে যায়। লেডি ট্রাভেলার্স গ্রুপ বলে ফেবুতে নতুন গ্রুপও খুলেছে। সেটাও বেশ ধুন্ধুমার চলছে শুনেছে। সেই কানিজের সাথে এই মেয়ে কিছুতেই যায়না। মিনহাজ অসন্তুষ্ট হয়ে জবাব দিলো-“তাছাড়া আর কোন কানিজকে চিনিস তুই? একটাই কানিজ আছে এই তল্লাটে।”
মিনহাজের এই আরেক স্বভাব। সোজা উত্তর দিতে পারে না। সবসময় ঘুরিয়ে পেচিয়ে উত্তর দেয়। কাজেই কথা না বাড়িয়ে রিফাত বিস্মিত হয়ে মেয়েটার দিকে তাকালো। এই মেয়েকে দেখে মোটেও মনে হচ্ছে না যে সে পাঁচটা ছেলের সাথে প্রেম করতে পারে। চেহারা আর আচরণ দু জায়গাতেই মেয়েটাকে বড্ড আটপৌরে দেখাচ্ছে। কোথাও কিছু একটা গরমিল আছে। একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকার কারনেই হয়তো বারকয়েক চোখাচোখিও হলো দু’জনার। রিফাতের চোখে চোখ পড়া মাত্রই কেমন সংকুচিত হয়ে গেলো মেয়েটা। গায়ের ওড়নাটা ঠিক করলো অকারণে। রিফাত মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ালো। মিনহাজ অবাক হয়ে জবাব দিলো-“কোথায় যাচ্ছিস?”
“মেয়েটার সাথে পরিচয় হয়ে আসি।”
“কি বলছিস এসব? ওই মেয়েটার সাথে তুই পরিচিত হবি?”
মিনহাজ অবাক হয়ে রিফাতকে দেখলো। যে ছেলে কোনদিন কোন মেয়ের দিকে ফিরে তাকায় না সে এমন একটা মেয়ের সাথে কথা বলতে যাবে? ব্যাপারটা ঠিক যেন হজম হচ্ছে না মিনহাজের। রিফাত অবশ্য ওর বিস্ময়বোধ নষ্ট করলো না। আলতো হেসে বললো-“কেন? হতে পারি না?”
“এই মেয়েটার সাথে? নিজে যেচে পড়ে!”
“হুমম। আমার বেশ কৌতুহল জাগছে মেয়েটাকে নিয়ে।”
“আজব! তুই সবসময় এমন উদ্ভট আচরণ করিস কেন? এই ফকিন্নি মার্কা মেয়েটার মধ্যে তুই কি এমন ইন্টারেস্টিং দেখলি?”
“আমার কাজই হচ্ছে যে কোন নেগেটিভ বিষয়ে পজেটিভ কিছু খুঁজে বের করা। ইনফ্লুয়েন্সার হয়েছি কি সাধে?”
“তাই বলে যেখানে সেখানে?”
প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো মিনহাজ। রিফাত এবার জবাব না দিয়ে হাঁটা ধরলো। মিনহাজ তাকে ডাকলো কয়েকবার কিন্তু সে শুনলো না।

“হাই। আমি রিফাত, আপনি?”
হইচই আর আওয়াজে কথা চাপা পড়ে যাচ্ছে বলে রিফাত বেশ উঁচু গলায় প্রশ্ন করেছে। মেয়েটা বেশ ঘাবড়ে গেলো-“আমাকে বলছেন?”
রিফাত হাসলো-“আপনি ছাড়া আর কেউ তো নেই এখানে। কাজেই আপনাকেই বলছি। কি নাম আপনার?”
“মেঘা।” তড়িঘড়ি করে জবাব দেয় মেয়েটা।
“বাহ, বেশ কাব্যিক নাম তো? বসতে পারি?”
মেঘা আগের মতোই নার্ভাস হয়ে চারিদিকে তাকিয়ে কাকে যেন খুঁজলো। রিফাত হাসলো-
“কানিজকে খুঁজছেন? ওকে এখন পাবেন না। এইসব পার্টিতে এসে কেউ আপনার মতো জড়ভরত হয়ে বসে থাকে না। এখানে মানুষ আসে নিজের পরিচয়ের গন্ডি বড় করতে যেটাকে এ যুগের ভাষায় কানেকশন বাড়ানো বলে। বুঝলেন?”
মেঘা মাথা দুলালো। রিফাত ওর সামনের চেয়ারে বসলো-“পড়ালেখা করেন তো?”

মেঘা চুপচাপ বসে রইলো। রিফাতের কথার উত্তর দিলো না। ও জানে ছেলেটা কোন ভাবে ওকে চিনতে পেরে গেছে। এখন ফালতু আলাপ জমাতে এসেছে। এরপর হয়তো বাজে প্রস্তাব দেবে। জানতে চাইবে কত টাকা দিলে ছেলেটার সাথে রাত কাটাবে। মেঘার কান্না পেয়ে গেলো। ঘটনার কতদিন হয়ে গেলো এখনো মানুষ ভুলে না কেন? কেন তাকে চিনে ফেলে লোকজন? তার চেহারা এখন যথেষ্ট পরিবর্তন হয়ে গেছে। তবুও নিজেকে লুকাতে পারে না। ভাবতে ভাবতে মুখচোখ লাল হয় তার। আর কতদিন বয়ে বেড়াবে এই যন্ত্রণা?

ঠিক এই কারণে কোথাও যায় না মেঘা। নিজেকে একপ্রকার ঘরবন্দী করে রেখেছে। আজও আসতো না। কানিজ জোর করে ধরে এনেছে ওকে। এইসব পার্টিতে নাকি কেউ কাউকে নিয়ে মাথা ঘামায় না। কে এলো কে গেলো কেউ ফিরে তাকায় না। এখন তো দেখছে উল্টো কেস। মাঝে মাঝে মনেহয় বাংলাদেশের অর্ধেক মানুষ তাকে চেনে। যেখানেই যায় কেউ না কেউ চিনে ফেলে। চিৎকার করে কাঁদতে মন চায় মেঘার।
“মেঘা, কোন ক্লাসে পড়েন?” রিফাত আবার জানতে চাইলো।
“এডমিশন দিচ্ছি।” ভেজা গলায় জবাব দিলো মেঘা।
“আরে আপনি তো দেখছি ছোট্ট বাবু। আঠারো হয়নি নিশ্চয়ই? তা ছোট্ট বাবু এখানে কি করে? এটা তো ছোট বাবুদের জায়গা না।”
মেঘা হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলো। রিফাতের দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো-“শুনুন, আমি জানি আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন। খারাপ মেয়ে ভেবে গল্প করতে এসেছেন। এখন নিশ্চয়ই বাজে প্রস্তাব দেবেন?
কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি ওমন মেয়ে না। আমি আসলে…”
বলে শেষ করতে পারে না মেঘা। কান্না ওর কন্ঠ রুদ্ধ করে। ও আর অপেক্ষা করলো না। এক ছুটে বেড়িয়ে গেলো। রিফাত প্রথমে হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। কি ঘটলো সেটা বুঝতে পেরেই উঠে দাঁড়ায়-“ওহহহ, শিট! মেয়েটা ভুল বুঝলো আমাকে। কানিজ টের পেলে খুব খারাপ হবে। আফটারঅল মেয়েটা ওর সাথে এসেছে।”
বিরবির করে মেঘার পিছু ছুটলো রিফাত। বড় হলরুম পেরিয়ে লম্বা করিডোরের ওপাশে খাবার খাওয়ার জায়গা। মেঘাকে কোথাও পেলো না। তন্ন তন্ন করে খুঁজে হয়রান রিফাত। এতো অল্প সময়ে গেলো কোথায় মেয়েটা? চলে গেছে নাকি? আবারও লম্বা করিডোর দিয়ে হেঁটে গেলো রিফাত। এবার কান খাড়া ছিল বলো মিহি কান্নার আওয়াজ কানে বাঁধলো। ভালোমতো তাকিয়ে মেঘাকে খুঁজে পেলো একদম কোনায়। অন্ধকারে দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে থাকতে দেখলো মেঘাকে।
“আজব মেয়ে তো আপনি? একা একা এই অন্ধকারে বসে আছেন। ভয় ডর নেই?”
মুখ তুলে রিফাতকে দেখে খিচিয়ে উঠলো মেঘা-“আপনি! আপনি কেন এসেছেন? বলেছি না আমি ওমন মেয়ে নই?”
“তাহলে কেমন মেয়ে আপনি?”
মেঘা থমকে গেলো-“মানে! কি বলতে চাইছেন আপনি?”
রিফাত মুচকি হাসলো-“আমি কি বলতে চাইলাম। সব তো আপনি বলছেন। একা একাই মনগড়া কথা বলে যাচ্ছেন সেই তখন থেকে।”
মেঘা চুপ করে গেলো। খানিক পরে মৃদুস্বরে বললো-“আপনি চলে যান। আমার সাথে কেউ দেখলে উল্টো পাল্টা ভাবতে পারে। আপনাকেও খারাপ বলবে।”
“খারাপ বলবে? কেন? আপনি কি কোন খারাপ কাজ করেছেন?”
“করেছি তো। একসাথে পাঁচটা ছেলের সাথে প্রেম করেছি। এটা খারাপ না?”
“সত্যি করেছেন নাকি? করলে বলুন তো এতোগুলা ছেলেকে হাতে রাখার নিনজা টেকনিকটা কি? আমিও একটু শিখে নিতাম। তারপর মেয়েদের উপর এল্পাই করতাম।”
রিফাতের বলার ভঙ্গিতে মেঘা ফিক করে হেসে দিলো-“মজা নিচ্ছেন?”
আরে বাহ! মেয়েটার হাসিটাতো বেশ চমৎকার। দাঁতগুলো দিয়ে ক্লোজআপের বিজ্ঞাপন হবে। মনে মনে নিজেই নিজেকে বললো রিফাত।
“হ্যা, নিচ্ছি। এবার বলুন তো?”
“কি বলবো?”
“নিনজা টেকনিক। মেয়ে বশীকরণের নিনজা টেকনিক।”
মেঘা মুচকি হাসলো-“আমি যেটা পারি ওটা ছেলে বশীকরণের নিনজা টেকনিক। মেয়েদের জন্য কাজে লাগবে না। তাছাড়া ওসব টেকনিক আমি ভুলে গেছি সেই কবেই।”
“মিথ্যে বলছেন। আমাকে শেখাবেন না বললেই হয়।”
রিফাতের কথায় এবার উচ্চস্বরে হাসলো মেঘা-“খুব মেয়ে পটাতে পারেন তো। আপনার কাছে তো আমি নস্যি।”
“আপনি পটে গেছেন? যাক বাঁচলাম তবে। অনেক সময় বাঁচলো আমার।”
মেঘা ঠোঁট টিপে হাসি আঁটকায়। নিসন্দেহে ছেলেটা ভীষণ বাকপটু। সে নিজের ছোট্ট পার্স তুলে নিল। রিফাত অবাক হয়ে জানতে চাইলো-“উঠলেন যে?”
“চলে যাব। ভালো লাগছে না এখানে।”
“চলে যাব মানে কি? যখনই আপনার সাথে গল্প করতে বসছি আপনি উঠে হাঁটা দিচ্ছেন না হয় কান্না করছেন। এটা কেমন ভদ্রতা?”
মেঘা রাগলো না-“এতো আওয়াজ আর কোলাহল ভালো লাগছে না। তাছাড়া রাত হয়ে গেলে হোস্টেলে ঢুকতে পারবোনা।”
“ওহহহ। আপনি হোস্টেলে থাকেন বুঝি?”
উপর নিচে মাথা নাড়ে মেঘা। রিফাত ওর আদুরে মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কয়েক সেকেন্ড। তারপর কি ভেবে নিজেও উঠে দাঁড়ায়-“আপনার যদি আপত্তি না থাকে লিফট দিতে পারি আপনাকে।”
“বাজে কোন মতলব নেই তো?”
মেঘার সরল প্রশ্নে রিফাত মন খুলে হাসলো। মেয়েটাকে চালাক ভেবেছিল এখন দেখছে বোকার হদ্দ।
“আমার কোন মতলব থাকলে তা কি আপনাকে বলবো? বললে আমার সাথে যেতে রাজি হবেন? বরং মাঝ রাস্তায় যেয়ে গাড়ি থামিয়ে গ্লাস লাগিয়ে…”
মেঘা কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হাসলো-
“আপনার সেন্স অফ হিউমার ভালো।”
“আম অনারড ম্যাম।” বাউ করলো রিফাত তারপর বললো-“তবে মতলব একটা আছে অবশ্য। আপনার সাথে কমিউনিকেশন বাড়ানোর জন্য লিফট দিতে চাচ্ছি। আমার সাথে কমিউনিকেশন বাড়াতে আপনি কি আগ্রহী হবেন?”
মেঘা মুচকি হাসলো। দু’জনে হেটে পার্কিং এ এলো।
“আপনার হাসিকে পজিটিভ সাইন ধরে নিচ্ছি। এখানে পাঁচ মিনিট দাঁড়ান আমি গাড়িটা নিয়ে আসি।”
মেঘা ঘাড় হেলিয়ে সায় দিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘার সামনে গাড়ি থামে। পাজেরোর দরজা খুলে ওকে ভেতরে ডাকে রিফাত। এতো দামি গাড়ি হয়তো আশা করেনি মেঘা। সে অবাক হলো তবে কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না।
“কোন দিকে যাব?” রিফাতের প্রশ্ন।
“মোহাম্মদপূর। সুকন্যা গার্লস হোস্টেল।”
মেঘা বাইরে তাকিয়ে ছিলো। কথাগুলো বলে আবারও দৃষ্টি বাইরে নিলো। রিফাত গাড়ি ঘুড়িয়ে নিলো। বনশ্রী টু মোহাম্মদপুর বেশ লং রুট। ভাগ্য ভালো এই মুহূর্তে রাস্তা ফাঁকা। রিফাত একটানে চলে এলো। গুগল ম্যাপে দেখে নিয়ে একদম মেঘার হোস্টেলের সামনে।
“চলে এসেছি আপনার ঠিকানায়।”
মেঘা বিনা বাক্যে গাড়ি থেকে নামে-“থ্যাংকস। আশা করছি আবার আসবেন না।”
রিফাতের মুখে প্রশ্নচিন্হ-“মানে?”
“মানে খুব সোজা। আমাকে লিফট দেওয়ার বাহানায় ঠিকানা চিনে নিলেন। কমিউনিকেশন বাড়াতে হয়তো আবার আসতে পারেন। এইজন্য আগেই মানা করছি।”
রিফাত হো হো করে হাসলো-“ভারি মজার মানুষ আপনি।”
“আজ প্রথম শুনলাম। এতোদিন জানতাম আমি বোরিং মানুষ।”
“কারা বলে? যারা বলে তারা আপনাকে চেনেই না ঠিক মতো।”
“এতো তাড়াতাড়ি চিনে গেলেন আমাকে? আপনি দেখছি বুলেট ট্রেনের গতিতে ছুটছেন?”
রিফাত মাথা চুলকায়-“কি যেন বলছিলেন আমার আসার কথা? আসলে সমস্যা কি? একসাথে চা খেলাম একটু? আপনার পড়ালেখার খোঁজ নিলাম।”
“সমস্যা নেই। তবে মনেহয় না আপনার সময় হবে? কন্টেন্ট বানিয়ে গান গেয়ে কি সময় থাকবে আমাকে দেখতে আসার? থাকলে আসবেন। মাঝে মাঝে আমাকে গান শুনিয়ে যাবেন আমার মাইন্ড রিফ্রেশ হবে।”
মেঘার কথায় কাশি শুরু হয়ে গেলো রিফাতের। মেঘার ঠোঁটের হাসি বিস্তৃত হলো-“শুনুন একটা কথা ভাবুনতো, অপরিচিত একজন হলেও আপনার কাছ থেকে লিফট নিতে রাজি হলাম কেন? পরদিন এলে উত্তরটা দেবেন অবশ্যই।”
বলেই মুচকি হেসে হোস্টেলে ঢুকে গেলো মেঘা। রিফাত হা করে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। মেয়েটা ওকে চিনে ফেলেছে? ও তো ভেবেছে ওকে চেনেনি মেয়েটা? রিফাত হেসে দিলো। বোকা বোকা মেয়েটা বেশ চালাক দেখা যাচ্ছে! রিফাত মাথার চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করে নিজেকে আয়নায় দেখলো অকারণে। মেয়েমহলে তার পপুলারিটি বেশ ইমপ্রেসিভ দেখা যাচ্ছে। ফুরফুরে মেজাজে গাড়িতে উঠে বসলো সে। অনেকদিন পরে আজ মনটা বেশ হালকা লাগছে তার। শিষ দিতে দিতে গাড়ি ঘোরায় সে। তার ঠোঁটের কোনে একটা দুষ্টু মিষ্টি হাসি খেলা করছে তখনও। তাকে এমন রূপে দেখলে মিনহাজের হার্ট অ্যাটাক হতো নির্ঘাত!

ওদিকে মেঘা তখন থেকে মিটিমিটি হেসে যাচ্ছে। এখনো ঘোরের মাঝে আছে সে।
আজ না চাইতেই তার একটা স্বপ্ন পূরন হয়ে গেলো। অনেকদিন ধরে “রিফাত-দা পজেটিভ থিঙ্কার” পেজটা ফলো করে মেঘা। যে কোন পরিস্থিতিতে জীবনকে পজেটিভ ওয়েতে দেখার নানা ভাবনা শেয়ার করে রিফাত যেটা খুব ইন্সপায়ারিং ওর জন্য। বলতে গেলে ওর কারনেই মেঘা নতুন করে নিজের জীবন গুছিয়ে নিতে পেরেছে। মনে মনে ইচ্ছে ছিল রিফাতের সাথে পরিচিত হওয়ার। কিন্তু সেই ইচ্ছে এভাবে পূরণ হবে তা কখনো ভাবেনি। এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, রিফাত নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে তাকে হোস্টেলে পৌঁছে দিয়েছে। নিজের গায়ে চিমটি কাঁটে মেঘা। ব্যাথায় ‘উহুহ” করে আওয়াজ করে ওঠে। পরক্ষণেই হেসে দিলো। আজ অনেক অনেক দিন পরে তার গুমোট জীবনে ভালো কিছু ঘটলো। বহুদিন পরে ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে ঘুমাতে গেলো মেঘা। শেষ রাতে চমৎকার একটা স্বপ্নও দেখলো। ঘুমের মাঝে বিরবির করলো-‘ভীষণ ভালো মানুষ আপনি। শুধু অনুরোধ বাকী সবার মতো ভুল বুঝবেন না আমাকে।’

চলবে—