#গোধূলি_বেলায়_প্রেম
#ফাবিহা_নওশীন
|পর্ব-১৩|
সাবিহা সাদিবের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।এক হাতের আংগুলের দিয়ে অন্য হাতের আংগুল ঘষছে।সাবিহার বুক ঢিপঢিপ করছে।সাদিবের মা বিষয় খানি কিছুই বুঝতে না পেরে একবার সাদিবের দিকে আরেকবার সাবিহার দিকে তাকাচ্ছে।
সাদিবের মা আর ধৈর্য্য ধরতে পারছেনা তাই তিনি জিজ্ঞেস করলো,
—-“তোদের দু-ভাই বোনের মধ্যে কি হয়েছে?দুজন এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?সাবিহা কিছু করেছিস?”
সাবিহা মাথা তুলে মায়ের দিকে করুন ভাবে তাকালো।
তারপর কাদো কাদো হয়ে বললো,
—-“মা আমি কিছুই জানিনা।ভাইয়া আমাকে ডেকে এভাবে চুপ করে আছে কেনো?”
সাদিব সাবিহাকে কোচিং-এ না পেয়ে কলেজ,আশেপাশের মার্কেট সব জায়গায় খোজেছে।কিন্তু কোথাও খোজে পায়নি।অজানা আতংকে হাত-পা অসার হয়ে আসছিলো।ঘন্টাখানেক আশেপাশে পাগলের মতো বোনকে খোজে বেড়িয়েছে।টেনশনে ঘেমে নেয়ে যাচ্ছিলো তারপর আবার বাড়িতে ফোন করে।বাড়িতে ফোন করে জানতে পারে আধা ঘণ্টা আগেই সাবিহা বাড়িতে ফিরে আশে।সাবিহার বাড়িতে ফেরার কথা শুনে স্বস্তি পেলেও কোথায় ছিলো সেটা নিয়ে সন্ধিহান ছিলো।
তাই বাড়িতে গিয়েই সাবিহাকে চিতকার করে ডাকে।সাবিহা দৌড়ে ভাইয়ের সামনে এসে হাজির হয়।
সাদিব সাবিহাকে জিজ্ঞেস করলো,
—-“কোথায় গিয়েছিলি তুই?”
কোথায় গিয়েছিলি কথাটা শুনে সাবিহার হাত-পায়ে কাপুনি ধরে যায়।ওর ভাই কি দেখে ফেলেছে রিজভীর সাথে? মাথায় তো হেলমেট ছিলো।তাহলে?
সাবিহা কিছু বলার আগেই সাবিহার মা বললো,
—-“ওর নাকি শরীর খারাপ তাই কোচিং-এ না গিয়ে ফিরে এসেছে।সাবিহা তো তাই বললো।কি রে সাবিহা?”
সাবিহা ঢোক গিলে বললো,
—-“হ্যা তাই তো।”
তারপর আড়চোখে সাদিবের দিকে তাকালো।
সাদিব ভ্রু কুচকে বললো,
—-“তুই কোচিং না করে বাড়িতে ফিরে এসেছিস?তাহলে এতো লেট কেনো হলো?আমি তোর ক্লাস শুরু হওয়ার আধ ঘন্টা পর গিয়েছি।তার আধঘন্টা পর তুই বাসায় এসেছিস।এক ঘন্টা কোথায় ছিলি?”
সাবিহা আমতা আমতা করে বললো,
—-“আমি আসলে প্রথমে লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম খাতা কিনতে।তারপর মাথা ব্যথা শুরু হয় তাই আর কোচিং-এ যাইনি।ফার্মেসী থেকে মাথা ব্যথার ওষুধ নিয়ে বাড়িতে চলে আসি।”
সাদিব বিস্ময় নিয়ে বললো,
—-“খাতা কিনতে তুই?তুই তো নিজে কখনো খাতা কিনিস না।আমি সব সময় এনে দেই।আমাকে সব সময় বলিস।”
—-“আমার খাতার খুব প্রয়োজন ছিলো তাই।”
—-“কই দেখা তোর খাতা।”
—-“ভাইয়া বললাম তো মাথা ব্যথা শুরু হয় ফলে আমি খাতা না কিনেই চলে আসি।”
সাদিবের সাবিহার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না।কোথাও একটা ফাক রয়ে গেছে।
সাবিহা মাকে বললো,
—-“মা ভাইয়া আমাকে এতো জেরা কেনো করছে?আমি কি করেছি?”
সাদিবের মায়েরও কেমন খটকা লাগছে।তার ছেলেকে এতো জেরা করতে দেখেনি কখনো।তার কেনো জানি মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে।যার জন্য সাদিব এমন রিয়েক্ট করছে।
সাদিবের মা সাদিবকে প্রশ্ন করলো,
—-“সাদিব কি হয়েছে? তুই ওকে এতো প্রশ্ন কেনো করছিস?কিছু কি হয়েছে?কি হয়েছে বল।সাবিহা কিছু করেছে?”
সাদিব নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললো,
—-“না মা কিছু হয়নি।যে দিন কাল পড়েছে জানোই তো।বাজে ছেলে-মেয়েদের সাথে মিশে কতজন বিপথে যাচ্ছে।কত আপত্তিকর ঘটনা ঘটে।দূর্ঘটনা ঘটছে।ভাই হিসেবে আমার দায়িত্ব বোনের খেয়াল রাখা তাই আর কি।সাবিহা যা ঘরে যা।মা খেতে দেও।”
সাদিব ডাইনিং টেবিলের দিকে গেলো।সাদিবের সাবিহার উপর থেকে সন্দেহ যায়নি।ওর কথায় অনেক ফাক ফোকর ছিলো।সাদিবের মনে হচ্ছে সাবিহা কিছু লোকাচ্ছে।আর কি লোকাচ্ছে সেটা ওকে খোজে বের করতে হবে।
সাদিবের মা খাবার নিয়ে আসতেই বললো,
—-“মা,সাবিহার উপর নজর রেখো।”
সাদিবের কথা শুনে সাদিবের মায়ের বুক কেপে উঠলো।প্রত্যেক মায়েরই তার মেয়েকে নিয়ে একটু বেশিই চিন্তা হয়।মেয়েকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে থাকে।
—-“কেনো বাবা সাবিহা কিছু করেছে?”
—-“আরে না মা,টেনশন করোনা।কিন্তু নজর রেখো।বয়স কম ভুল কাজ করতে সময় লাগবেনা।বন্ধুবান্ধব সবাই এক না।বিপথে যেতে সময় লাগবে না।এমন হতে পারে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ক্লাস ফাকি দিয়ে ঘুরতে চলে গেলো।কিংবা কারো ট্রাপে ফেসে গেলো।তাই বলছি খেয়াল রেখো।”
—-“হ্যা ঠিকই বলেছিস।বড় হয়েছে তাই ওর দিকে খেয়াল রাখতে হবে।ওকে নিয়ে আমার অনেক চিন্তা হয়।যতক্ষণ বাইরে থাকে চিন্তায় থাকি।বাইরের যে অবস্থা।”
—-“আহা মা,টেনশন করোনা।আমি আছি তো ওর বড় ভাই।”
সাবিহা আর রিজভী যখন যাচ্ছিলো তখন রিজভীর একটা ফোন আসে।বাইক পার্ক করে কথা বলে।তারপর সাবিহাকে বলে ওর একটা ইম্পর্ট্যান্ট কাজ পড়ে গেছে।অন্য সময় ওকে নিয়ে ঘুরতে যাবে।আজ যেতে হবে।সাবিহাও বিন্দুমাত্র রাগ করে নি।কারণ ওর ও কেমন যেতে ইচ্ছে করছিলো না।মনে কেমন খুত খুত করছিলো।তাই বাড়িতে চলে আসে।কোচিং ক্লাস শেষ হওয়ার আগেই বাড়িতে ফিরে আসে তাই ওর মা প্রশ্ন করে এতো তাড়াতাড়ি কেনো আর ও ওই উত্তর দেয়।
রীতি সকালবেলা বারান্দায় গাছে পানি দিচ্ছে।হটাৎ ওর চোখ যায় নিচের দিকে।সাদিব গাছে পানি দিচ্ছে।আজ অনেক দিন পর গাছে পানি দিতে দেখলো।সাদিবের মন ভালো লাগছিলো না তাই সকাল সকাল মন ভালো করতে গাছে পানি দিতে আসে।গাছে পানি দেওয়া শেষ করে আগাছা পরিস্কার করছে।রীতি পানি দেওয়া শেষে ভেতরে চলে গেলো।সাদিব কাজের ফাকে ফাকে রীতির বারান্দার দিকে তাকাচ্ছে।কিন্তু রীতিকে দেখতে পায়নি।কেনো জানি আজকাল রীতিকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে।যতই রাগ অভিমান থাকুক না কেনো।রীতির প্রতি একটা অনুভূতি কাজ করতো।সেই অনুভূতির টানে রীতিকে দেখতে ইচ্ছে করে।
.
দিয়া খেয়াল করছে আজকাল সাদিব মন খারাপ করে থাকে।রীতিও কেমন কথায় কথায় রেগে যায়।
দিয়া তো এখন রীতির সাথে কথা বলতেই ভয় পায়।আজকাল রীতি হুট করেই রেগে যায়।
রীতি আজকাল ছাদেও আসেনা।দিয়ারও সাহস হয়না রীতির বাড়িতে যেতে।তাই তেমন কথা হয়না।
দিয়া হটাৎ সাদিবকে বললো,
—-“জানেন তো আজকাল রীতি আপু কেমন হুট করে রেগে যায়।কি হয়েছে কিছুই বুঝিনা।কত শান্তসৃষ্ট একটা মেয়ে ছিলো কিন্তু আজকাল কেমন জানি হয়ে যাচ্ছে।কিছুই বুঝতে পারছি না কেনো এমন করছে?”
সাদিব দিয়ার কথা শুনে অবাক হলো।রীতি এখন দিয়ার সাথেও খারাপ বিহেভ করছে।প্রথমে সাবিহার সাথে প্রব্লেম আর এখন দিয়া।
সাদিব কৌতুহল নিয়ে বললো,
—-“তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে?”
দিয়া দ্রুত বললো,
—-“না,,আমার সাথে খারাপ ব্যবহার কেনো করবে?জাস্ট হুট করে রেগে যায়।মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে।হয়তো বড় কোনো প্রব্লেম।যা আমার সাথে শেয়ার করছেনা।”
সাদিব ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,
—-“হয়তো পার্সোনাল লাইফে কোনো প্রব্লেম চলছে।ওসবে আমাদের ইন্টারফেয়ার করার অধিকার নেই।”
দিয়া ইতস্তত করে বললো,
—-“পার্সোনাল লাইফ?ইউ মিন বয়ফ্রেন্ড?”
সাদিব ছোট্ট করে বললো,
—-“হুম।”
দিয়া যতদূর জানে রীতির বয়ফ্রেন্ড নেই।কিন্তু এমনও তো হতে পারে বয়ফ্রেন্ড আছে।রীতি হাইড করে রেখেছে।হতেও পারে।দিয়া সিদ্ধান্ত নিলো রীতির সঙ্গে কথা বলবে আর এখুনি।
দিয়া সাদিবকে কিছু না বলে রীতির ফ্ল্যাটের দিকে যাচ্ছে।সাদিব দিয়ার চলে যাওয়া দেখে বললো,
—-“এর আবার কি হলো? ”
.
দিয়া রীতির ফ্ল্যাটে গিয়ে সোজা রীতির রুমে ঢুকে গেলো।রীতি বিছানায় শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে আছে।
দিয়া কোনো ভনিতা না করে বললো,
—-“আপু তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে? ”
রীতি দিয়ার কথা শুনে তাজ্জব বনে গেলো।উঠে বসে দিয়ার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে।
দিয়া আমতা আমতা করে বললো,
—-“এভাবে তাকিও না ভয় লাগে।আমি নিরীহ একটা বাচ্চা।”
দিয়ার কথা শুনে রীতির হাসি পেলেও হাসিটা দমিয়ে রেখে বললো,
—-“এসব উদ্ভট কথার মানে কি?”
—-“আমি ভালো মেয়ে আমি কিছু বলিনি।দ্যা গ্রেট ইন্টিলিজেন্ট বয় সাদিব ভাই বলেছে।”
রীতি,দিয়ার মুখে সাদিবের কথা শুনে চমকে গেলো।তারপর আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—-“কি বলেছে উনি?(হুট করে অভিমান ভর করলো)থাক জানতে চাইনা।উনার নাম নিবে না আমার সামনে।”
—-“এমা তোমার আবার কি হলো?সাবিহার নাম নিলে ক্ষেপে যাও আর এখন সাদিব ভাইও?ঘটনা কি?”
—-“ঘটনা খুবই জঘন্য।আমাকে জিজ্ঞেস করোনা।”
—-“ডাল মে কুচ কালা হে।কিছু একটা হয়েছে আর আমি জানিনা।আপু ইটস নট ফেয়ার।বলোনা কি হয়েছে?”
রীতি বলতে না চাইলেও দিয়ার জোরাজোরিতে সব ঘটনা বললো।দিয়া সব শুনে রীতিমতো হা হয়ে আছে।এতটা হতবাক এর আগে হয়নি।এতো কিছু হয়েছে আর ও কিছুই জানেনা।রীতির চোখে পানি টলমল করছে।বেচারি রীতি অন্যের ভালো করতে গিয়ে অপরাধী হয়ে গেলো।রীতির জন্য ওর খারাপ লাগছে খুব।কিন্তু কি করবে।
সাদিবকে বললে সাদিব কি ওর কথা বিশ্বাস করবে।
দিয়া কিছু একটা ভেবে সাদিবের খোজে ছাদে চলে গেলো।
সাদিব তখনও ছাদে।রেলিঙ ধরে আকাশের দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছে।পশ্চিমা আকাশে লালিমা রেখা ফুটে উঠেছে।গোধূলি বেলা,কিছুক্ষণ পরে সন্ধ্যা তারপর রাত্রি নামবে।তারপর আবারো নতুন দিনের আগমন ঘটবে।
পেছন থেকে দিয়ার ডাকে সাদিব চমকে গিয়ে পেছনে ঘুরলো।
দিয়াকে কেমন অস্বাভাবিক লাগছে।
—-“সাদিব ভাই আপনি রীতি আপুর সাথে একদম ঠিক করেন নি।আমার তো মনে হচ্ছে আপুর এই পরিবর্তনের জন্য আপনি দায়ী।আপু সরল মনের মানুষ।আপনার কথাগুলো মেনে নিতে পারেনি।অনেক হার্ট হয়েছে।এখনো মনে রেখে বসে আছে।তাই স্বাভাবিক আচরণ করতে পারছেনা।আপনি একদম ঠিক করেন নি।”
সাদিবের বুঝতে বাকি নেই দিয়া কি নিয়ে কথা বলছে।সাদিব চোয়াল শক্ত করে বললো,
—-“আর রীতি যা করেছে যা বলেছে তা ঠিক?”
দিয়া জোর দিয়ে বললো,
—-“হ্যা ঠিক।শতভাগ ঠিক।আপনি জানেন না তাই এসব বলছেন।আমার কাছে যথেষ্ট প্রমাণ আছে।”
দিয়া ফোন বের করে একটা পিক দেখিয়ে বললো,
—-“এটা দেখুন।ভালো করে দেখবেন।”
সাবিহার সাথে একটা ছেলে।সেই দিনের ছেলেটা,রিজভী।সাবিহার সাথে রিজভীকে দেখে সাদিব চমকে দিয়ার দিকে তাকালো।
দিয়া বললো,
—-“পিক নট এডিটেড।ভালো করে দেখুন।এই পিকটা সাবিহা আমাকে মেসেঞ্জারে সেন্ড করেছে।যখন আমি প্রথম বার ওর বয়ফ্রেন্ড রিজভীকে দেখতে চেয়েছিলাম।এই ছেলে আস্ত একটা শয়তান।তার চেয়ে বড় শয়তান আপনার বোন।রীতি আপু তো নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে গিয়েছিলো।বেচারি অন্যের ভালো করতে গিয়ে নিজেই খারাপ হয়ে গেলো আপনাদের দুই ভাইবোনের কাছে।আপনি আর সাবিহা সেই মানুষ মাইরি।”
সাদিব কথা বলার অবস্থায় নেই।দুহাতে নিজের মুখ চেপে ধরে আছে।সাদিব অন্য দিকে ঘুরে গেলো।নিজের উপর নিজের ঘৃণা হচ্ছে।রীতিকে সেদিন শুধু অবিশ্বাসই করে নি অনেক কথা শুনিয়েছে।মেয়েটা তো ভালোই করতে এসেছিলো ওর বোনের।
“এটা আমি কি করলাম?কিভাবে করলাম?ছিহ!আমি কি করে,কোন মুখে ওর সামনে গিয়ে দাড়াবো।কত কথা বলেছি।মেয়েটা টু শব্দ পর্যন্ত করে নি।চুপচাপ চলে গেছে।কতটা কষ্ট পেয়েছে।
আমি এতো বড় ভুল কি করে করলাম?ও কি আমায় ক্ষমা করবে?নাহ আমাকে রীতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।”
সাদিব দিয়ার কাছে রিজভীর সম্পর্কে আর রীতির সাথে সাবিহার করা আচরণের কথা শুনতে পেলো।রীতির রিজভীকে অন্য মেয়ের সঙ্গে দেখা,সাবিহাকে সেসব বলা,সাবিহার উল্টো রিয়েকশন সব বললো।
সব শুনে সাদিবের চোখ মুখ কঠিন থেকে কঠিন রুপ ধারন করলো।
চলবে…..?