গোধূলি বেলায় প্রেম পর্ব-১৪

0
4411

#গোধূলি_বেলায়_প্রেম
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-১৪|

দিয়া রীতিকে কিছু না বলেই ছাদে নিয়ে আসছে।রীতি বারবার জিজ্ঞেস করছে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু দিয়া কিছুই বলছেনা।ছাদের দিকে যেতেই রীতি বিরক্ত নিয়ে বললো,
—-“এই সন্ধ্যায় ছাদে কেনো?”

—-“আপু দরকার আছে।প্লিজ এসো।”

—-“আরে কি দরকার বলবে তো?”

—-“উফফ,এতো অধৈর্য্য কেনো তোমার?গেলেই দেখতে পারবে।এখন চুপ করে থাকো।”

দিয়া ছাদে উঠে রীতির হাত ধরে ছাদের পশ্চিম দিকে নিয়ে যাচ্ছে।রীতি কিছুই বুঝতে পারছেনা।এ মেয়ে কি ওকে ছাদ থেকে ফেলে দেবে নাকি?কি সব অদ্ভুৎ ভাবনা আসছে।

রীতির চোখ পড়ে সাদিবের দিকে।দিয়া দাঁড়িয়ে যায়।রীতিও থমকে যায়।তারমানে দিয়া রীতিকে সাদিবের কাছে এনেছে।রীতি সাদিবের দিকে তাকালো।সাদিবের চোখ মুখ কেমন লাগছে।সাদিবকে খুব ক্লান্ত লাগছে।সাদিব রীতির দিকে এগিয়ে আসছে।
রীতি দিয়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে বললো,
—–“এই তোমার গুরুত্বপূর্ণ কাজ? এসব কাজের জন্য আমার টাইম নেই।আমি যাচ্ছি।”

রীতি দিয়ার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো।তারপর কোনো দিকে না চেয়ে তাড়াতাড়ি ছাদ থেকে নেমে যাচ্ছে।দিয়া সাদিবের দিকে অসহায় ভাবে তাকালো।রীতিকে ডাকার সাহস পাচ্ছেনা।
সাদিব রীতিকে চলে যেতে দেখে পেছন থেকে অনেকবার ডাকলো কিন্তু রীতি পাত্তা দিলোনা।ও ওর মতো চলে যাচ্ছে।
সাদিব দৌড়ে গিয়ে রীতিকে পাশ কাটিয়ে রীতির সামনে দাড়ালো।রীতি ততক্ষণে ৫তলার ফ্ল্যাটের সামনে চলে এসেছে।রীতি দাঁড়িয়ে গেলো সাদিবকে রাস্তা আটকিয়ে দাড়ানো দেখে।রীতি না সাদিবের দিকে তাকাচ্ছে আর না কোনো কিছু বলছে।রীতি অপেক্ষা করছে একবার সাদিব সরে দাড়াক তাহলেই নিচে চলে যাবে।
সাদিবের সাথে একটা কথাও বলবেনা।আর না ওকে দেখবে।
ভালোবাসা,ভালোলাগা এক জায়গায় আর নিজের আত্মসম্মান আরেক জায়গায়।সাদিব যা করেছে তাতে ওকে এতো সহজে ক্ষমা করতে পারবেনা।শরীরের ব্যথার চেয়ে মনের ব্যথা ভয়ানক।শরীরের ক্ষতের উপর সহজেই মলম লাগানো যায় সেরেও যায় কিন্তু মনের ক্ষত?সহজে সারে না।মনের ক্ষত দিন দিন ভয়াবহ রুপ ধারন করে।

সাদিব অনুতাপের গলায় বললো,
—-“আমার উপর তোমার রাগ করাটা অস্বাভাবিক না।আমি তোমাকে অনেক কথা শুনিয়েছি।তোমাকে হার্ট করেছি।কিন্তু বিশ্বাস করো আমি চেয়েছি তোমাকে বিশ্বাস করতে।বারবার চেয়েছি।কিন্তু সাবিহার মুখ ভেসে উঠতেই মনে হয়েছে না আমার বোন এটা করতে পারেনা।ওর আচরণগুলো অন্য রকম,বাচ্চামি টাইপ।তাই আমার মনে হয়নি ও কোনো রিলেশনে জড়ানোর মতো মেয়ে।কিন্তু ভুল ছিলাম।আমি ভুল করেছি ওকে অন্ধ বিশ্বাস করে।চরম ভুল।আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি।আমি ক্ষমা চাইছি।কেউ ভুল বুঝতে পেরে যদি ক্ষমা চায় তবে তাকে ক্ষমা করে দিতে হয়।বিশ্বাস করো ওইদিনের পর থেকে আমি একটুও শান্তি পাইনি।প্লিজ রীতি কিছু তো বলো।”

রীতি চোখ তুলে সাদিবের দিকে তাকালো।তারপর বললো,
—-“দেখুন আপনার সাথে কথা বলার আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।কিন্তু বলতে হলো।প্লিজ রাস্তা ছাড়ুন আমি ঘরে যাবো।”

সাদিব বুঝতে পারছে রীতির অভিমান ভাংগাটা এতো সহজ নয়।ওই সরল মনে প্রচন্ড অভিমান জমেছে।সেই জড়োসড়ো অভিমান সরাতে অনেক খড়-কাঠ পোড়াতে হবে।
তবে আজ রীতির অভিমান ভাংগিয়েই ছাড়বে।
সাদিব রীতির সামনে হাটু গেড়ে বসে দুই হাতজোড় করে মেঝের দিকে চেয়ে শান্ত,অনুতাপের সুরে বললো,
—–“প্লিজ ক্ষমা করো।প্লিজ।আমি আমার সম্মান বিসর্জন দিয়ে তোমার সামনে হাটু গেড়ে বসে দুই হাতজোড় করছি।প্লিজ ক্ষমা করো।”

রীতি সাদিবের কাজ দেখে কথা শুনে হতবাক।এভাবে মেঝেতে বসে গেছে।কেউ যদি চলে আসে,দেখলে কি বলবে।দিয়া যদি ছাদ থেকে নেমে আসে তবে কি হবে?
পরম শত্রুও যদি এভাবে ক্ষমা চায় তাহলেও মানুষের মন গলে যাবে।আর সাদিব তো সেই মানুষ রীতি যাকে মনের গভীরে অতি যত্নে রেখেছে।যাকে ভালোবাসে।যে কিনা ভালোলাগায়, ভালোবাসায় স্পন্দনে মিশে আছে।
রীতি দ্রুত বললো,
—-“একি কি করছেন?উঠুন বলছি।প্লিজ উঠুন।কেউ দেখলে কি ভাববে?”

সাদিব ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,
—-“যা খুশি ভাবুক।তুমি আমাকে শুধু ক্ষমা করো।প্লিজ।তুমি আমাকে এই অপরাধের জন্য যে শাস্তি দেওয়ার দেও।কিন্তু প্লিজ ক্ষমা করো।”

রীতি কি করবে বুঝতে পারছেনা।বারবার নিচের দিকে তাকাচ্ছে।সাদিব কি শুরু করলো।রীতি অন্যদিকে চেয়ে বললো,
—-“ঠিক আছে,ঠিক আছে।উঠুন, করেছি ক্ষমা।এভাবে হাতজোড় করবেন না।ভালো দেখায় না।”

সাদিব উঠে দাড়ালো।রীতি আড়চোখে সাদিবকে দেখছে।তখনই হুড়মুড় করে সিড়ি দিয়ে কারো নামার শব্দ পেলো।দুজনেই বুঝতে পারছে দিয়া আসছে।আর একটু আগে আসলে কেলো হয়ে যেতো।
দিয়া দুজনের দিকে একে একে চেয়ে বুঝার চেষ্টা করছে দু’জনের মধ্যে মিমাংসা হয়েছে কিনা।

—-“এভ্রিথিং অলরাইট?”

সাদিব মুচকি হেসে বললো,
—-“হুম।”

দিয়া অবাক হয়ে বললো,
—-“এটুকুতেই?রীতি আপু মেনে নিলো?হাও দিস পসিবল?”

সাদিব মিনমিন করে বললো,
—-“এটুকু?তুমি দেখলে বুঝতে কতটুকু।এই মেয়ে এতো অভিমানী এর অভিমান ভাংগাতে গিয়ে আমার দু হাটু ব্য্রথা হয়ে গেছে।”

দিয়া শুনতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—-“কি বললেন ঠিক বুঝলাম না।”

সাদিব তাড়া দিয়ে বললো,
—-“কিছু না।আমি যাচ্ছি সাবিহার সাথে বুঝাপড়া করতে।ওর অনেক সাহস বেড়েছে।আমার নাকের ডগা দিয়ে প্রেম করে বেড়াচ্ছে।এই ছেলের সাথে? ছিহ!ওর পায়ে আগে শিকল দেই তারপর রিজভীকে দেখে নিচ্ছি।”

সাদিব যেতে নিলেই রীতি দিয়াকে ইশারা করলো আটকাতে।
—-“সাদিব ভাই।”

সাদিব দাড়িয়ে গেলো।রীতি মুখে ক্ষমা করেছে বললেও সাদিবের সাথে ওর কথা কেমন লাগছে।ফ্রি হতে পারছেনা।কিছু বলতেও পারছেনা।কিন্তু তবুও বলতে হবে।
রীতি মুখ খুলল,
—-“দেখুন এখন রাগের মাথায় উল্টো পাল্টা কিছু করবেন না।আমি এই জন্যই সেদিন রিজভীর পরিচয় দেইনি।”

—-“দেওনি বলেই আজ এতকিছু হয়েছে।সেদিন সত্যিটা জানলে দুটোকে এতোদিন সোজা করে ফেলতাম।”

—-“আচ্ছা তাই নাকি?এত সহজ?সাবিহার কথা ভেবেছেন?ওর বয়সটা ভাবুন।
অল্প বয়স।এই বয়সের ছেলেমেয়েরা আবেগে ভাসে।আর আবেগের বশে ভুল করে ফেলে।নিষিদ্ধ জিনিসে এদের আগ্রহ বেশী।সব কিছু নতুন লাগে।যা দেখে তাই ভালো লাগে।সব কিছু ঠিক মনে হয়।ওরা মনে করে ওরা বড় হয়ে গেছে।সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে শিখে গেছে।তাই যা করে তাই ঠিক মনে হয়।কেউ বাধা দিলে তাকে শত্রু মনে করে।মনে হয় সে তার রঙিন জীবনের সবচেয়ে বড় ভিলেন।ওর ভালো চায়না।
কোনো কিছুতেই এদের বাধা দেওয়া যায় না।উত্তাল সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ।না রাগারাগি করে লাভ হয়।
এখন আপনি যদি সাবিহার সাথে রাগারাগি করেন তবে কেস বিগড়ে যাবে।ওকে বুঝিয়েও কাজ হবেনা।আমি বুঝিয়েছি কিন্তু কাজ হয়নি।উল্টো ওর শত্রু হয়ে গেছি।আমাকে শত্রু মনে করে।
ওই যে বললাম ভালোলাগার পথে যে বাধা দেয় সেই শত্রু হয়ে যায়।
তাই ওকে বুঝিয়েও লাভ নেই।এখন কি করবেন জোর করে আটকে রাখবেন।তাহলে ও নিজের পরিবারকে নিজের শত্রু মনে করতে দু’বার ভাববে না।সবাই শত্রুতে পরিণত হবেন।তখন শুধু রিজভীকে পরম আপন মনে হবে।সুযোগ পেলে আপনাদের ছেড়ে যেতে দুবার ভাববে না।ভয়ানক ঘটনা ঘটে যাবে ওর জীবনে।
ওর চোখে পট্টি বেঁধে দিয়েছে রিজভী।মিথ্যা ভালোবাসার পট্টি।ও রিজভীকে ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করে না।
তাই ওর চোখ থেকে পট্টিটা সরাতে হবে।বিশ্বাসের পট্টি।রিজভীর আসল চেহারাটা সাবিহাকে দেখাতে হবে তবেই একমাত্র সাবিহাকে রিজভীর হাত থেকে বাচানো সম্ভব।
আপনার প্রথম কাজ হবে সাবিহার সেফটি নিশ্চিত করা আর দ্বিতীয় কাজ হবে রিজভীর আসল চেহারাটা সাবিহার সামনে আনা।”

দিয়া এতোক্ষণ মুগ্ধ হয়ে রীতির কথা শুনছিলো।সাদিবের দিকে চেয়ে দেখে সাদিবের চোখে মুখেও মুগ্ধতা।
দিয়ার নিজেকে তুচ্ছ,অপ্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে।ও কেনো কিছুই বলতে পারছেনা।
দিয়া তাই বললো,
—-“রীতি আপুর সাথে আমিও একমত।সাবিহাকে বেশী চাপ দেওয়া যাবেনা।ওর সাথে নরমাল ব্যবহার করে ওকে রিজভীর ট্রাপ থেকে সরিয়ে আনতে হবে।”

রীতি দিয়ার কথা শুনে মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললো।

সাদিব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভাবলো সবটা।একবার রীতির দিকে আরেকবার সাবিহার দিকে তাকালো।দুজনের চোখেই উদ্বিগ্নতার ছায়া।
সাদিব বললো,
—-“হ্যা আই থিংক তোমরা ঠিক বলছো।আমার বোনটা এমন বোকামি করবে তা কোনো দিন ভাবিনি।এমন একটা ছেলের প্রেমে পড়বে?এমন একটা ছেলেকে ভালোবাসবে?”

রীতি চট করে বললো,
—-“কিসের প্রেম কিসের ভালোবাসা?এসব ভালোবাসা টালোবাসা কিচ্ছু না।জাস্ট মোহ।ভালোবাসা এমন হয় নাকি?”

সাদিব রীতির কথা শুনে ভ্রু কুচকে মৃদু হেসে বললো,
—-“তাহলে কেমন হয়?”

রীতি সাদিবের প্রশ্ন শুনে ঘাবড়ে গেলো।ঢোক গিলে শুকনো হেসে বললো,
—-“আমি কি জানি?”

সাদিব রীতির কথা শুনে মুচকি হাসলো।

.

সাবিহা সোফায় পা ঝুলিয়ে বসে বসে ফোন টিপছে।সাদিবকে দেখে ফোন রেখে টিভির দিকে তাকালো।সাদিবের ইচ্ছে করছে সাবিহাকে টেনে একটা চড় মারতে।দুগাল ফাটিয়ে দিতে।কিন্তু পারছেনা।
এই বোন যে এতো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে তলে তলে ওকে দেখলে বুঝাই যায় না।

সাদিব সোফার উপর বসে পড়ল।সাবিহা বারবার আড়চোখে সাদিবকে দেখছে।তারপর টিভি অফ করে ফোনটা হাতে নিয়ে আস্তে করে উঠে চলে গেলো নিজের রুমে।সাদিব দেখেও না দেখার ভান করলো।টেবিলের উপর রাখা টিপস মুখে দিচ্ছে আর গভীর ভাবনায় বিভোর।

সাদিবের মাথায় একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে।
প্রথমে সাবিহার সেফটি নিশ্চিত করতে হবে তারপর রিজভীর আসল চেহারা সাবিহার সামনে তুলে ধরতে হবে।আর সেটা খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে।

এতোকিছুর মধ্যেও রীতির কথা ভেবেই সাদিবের মনে প্রশান্তির শীতল ছায়া বয়ে যাচ্ছে।রীতির কোনো প্রিয়জন নেই।রিজভীকে নিয়ে ভুল বুঝেছিলো।সারা শরীর জুড়ে অদ্ভুত অনুভূতিরা আলোড়ন তুলছে।সাদিবের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটলো।
“তুমি কি সেই?যাকে আমি এতোদিন খুজেছি?তুমি কি আমার সেই অদ্ভুৎ অনুভূতি? তুমি কি আমার কল্পনার সেই মায়া পরী?”

“আমি তোর বিকেলের আকাশ হবো
লাল গোধূলি মাখা।
আমি তোর হাসিতে রং মাখাবো,
মুগ্ধ মোহ আকা।”
–রাকিব

রীতি বারান্দার গ্রিল ধরে দাড়িয়ে আছে।চারদিকে অন্ধকার।আকাশে একটা তারাও চোখে পড়ছেনা রীতির।সাদিব এর কাছে ক্ষমা চেয়েছে এটা ভেবে ভালো লাগলেও সাদিবের পূর্ববর্তী আচরণ ভুলতে পারছেনা।জানে না ভুলতে পারবে কিনা।হয়তো পারবে হয়তোবা না?

চলবে…..