গোধূলি বেলায় প্রেম পর্ব-২৮

0
3497

#গোধূলি_বেলায়_প্রেম
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-২৮|

মার্চ মাস।শীতের তীব্রতা শেষে গরম পড়তে শুরু করেছে।ধীরে ধীরে মিষ্টি রোদ প্রখরতায় পরিণত হচ্ছে।রীতির ভার্সিটিতে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে।রীতি পড়ন্ত বিকেলে ছাদে বই খোলে বসেছে।সাদিব রীতির জন্য ছাদে বেঞ্চের ব্যবস্থা করেছে।পুরো ছাদে ৪টা বেঞ্চ বসানো হয়েছে মূলত রীতির জন্য।রীতির জন্য একটা বেঞ্চ বানালে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো তাই সাদিব চারটা বেঞ্চের ব্যবস্থা করেছে।রীতি যেখানে বসে সেখানে একটা বেঞ্চ বানিয়েছে।এখন রীতি সেই বেঞ্চে বসে বই পড়ছে।
রীতির যখন বইয়ের ভেতর গভীর মনোযোগ তখনই সাদিব হুট করে কোথায় থেকে এসে রীতির কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো।

রীতি বই বন্ধ করে সাদিবের চুলগুলো নেড়ে-চেড়ে বললো,
—-“মশাই আপনি যে এভাবে আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছেন,এখন যদি কেউ এসে পড়ে তাহলে কি ভাববে বলুন তো?”

সাদিব মুখ ভার করে উঠে বসে বললো,
—-“একটু শান্তিতে প্রেমও করতে পারিনা।চলো বিয়ে করে ফেলি।”

রীতি সাদিবের কথা পাত্তা না দিয়ে বই খুলল।সাদিব রীতির নির্লিপ্ত ভাব দেখে বললো,
—–“রীতি আ’ম সিরিয়াস।মজা করছিনা।তুমি জানো আমি সিরিয়াস বিষয় নিয়ে মজা করিনা।”

রীতি বই বন্ধ করে সাদিবের দিকে সিরিয়াস ভঙ্গিতে চেয়ে বললো,
—-“যদি মজা করেন তাহলে ঠিক আছে।আর যদি সিরিয়াসলি বলেন তো শোনেন আমিও সিরিয়াস ভাবেই বলছি এটা সম্ভব না।”

সাদিব বিচলিত চেহারায় বললো,
—-“মানে?কেনো সম্ভব না?”

—-“সাদিব, আমার বাবা কিছুতেই এখন বিয়েতে রাজি হবেনা।আপনি কি জানেন আমি আপনাকে আমার বাবার হার্ট এটাকের পর কেনো ইগনোর করেছি?যদি না জানেন তবে শোনেন আমার বাবার স্বপ্ন আমি পড়াশোনা শেষ করি,বিসিএস পাশ করে ভালো চাকরী করি।তারপর বিয়ে সংসার।বাবা হিসেবে এটুকু চাইতেই পারেন।তার চাওয়ায় কোনো ভুল নেই।অনেক বাবা-মা আছেন যারা মেয়ে একটু বড় হলেই বিয়ে দিয়ে বিদায় করে দিতে চায়।মেয়েকে বুঝা মনে করে।সেখানে আমার বাবা চায় আগে আমি নিজ পায়ে দাড়াই।নিজের পায়ের নিচের মাটি শক্ত করি তারপর বিয়ে করি।”

সাদিব রীতির কথা শুনে বললো,
—-“আমি আংকেলের চিন্তাধারাকে রেস্পেক্ট করি।উনি ঠিকটাই ভেবেছেন।”

রীতি আরোও বললো,
—-“তাছাড়া আপনার মাস্টার্স শেষ হয়নি।আগে পড়াশোনা শেষ করুন।হুট করে ঝুকের মাথায় সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত না।সবকিছুরই একটা উপযুক্ত সময় থাকে।”

সাদিব ভেবে বললো,
—-“রাইট,আমিও হুট করে কি থেকে কি বলে ফেললাম।তাছাড়া আমিও তো বেকার।বাবার টাকায় চলি।আমাকেও কিছু করতে হবে,প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।সব মিলিয়ে দুবছর।ওকে ডান।তুমিও বিসিএস দেও।আমি মাস্টার্স শেষ করে বাবার ব্যবসায়ে বসি।সবকিছু গুছিয়ে নেই।তারপর….।”
সাদিব দূরের বাড়িগুলোর দিকে চেয়ে কথাগুলো বললো।

সাদিব পুরো কথা শেষ করেনি তাই রীতি
বললো,
—-“তারপর কি?”

সাদিব রীতির দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হেসে বললো,
—-“তারপর বিয়ে,তারপর বাসর,তারপর হানিমুন তারপর বাচ্চাকাচ্চা,তারপর নাতিপুতি।”

রীতি সাদিবের কথা শুনে সাদিবের পিঠে মারতে শুরু করলো।
সাদিব রীতির হাত ধরে থামিয়ে বললো,
—-“এটা হাত না রড?তালপাখা এতো শক্তি পেলো কোথায় থেকে? ”

রীতি নাক ফুলিয়ে সরু চোখে চেয়ে বললো,
—-“আপনি আমার এতো সুন্দর হাতকে রড বললেন?জানেন এ হাতের উপর কত ক্রাশ খেয়েছে?”

সাদিব ভ্রু কুচকে বললো,
—-“কে ক্রাশ খেয়েছে?”

—-“রাইসা।”

সাদিব রীতির কথা শুনে টাস্কি খেলে।ভেবেছিলো না জানি কোন ছেলে।এখন শুনে রাইসা।
—-“রাইসা!! মেয়ে হয়ে মেয়ের হাতের উপর ক্রাশ কি করে খায়?”

—-“কি আশ্চর্যজনক কথা! মেয়েরা কি মেয়েদের হাতের উপর ক্রাশ খেতে পারেনা?সুন্দর তাই ক্রাশ খেয়েছে। অদ্ভুৎ!”

সাদিব হাত উঁচু করে বললো,
—-“ওকে বাবা ওকে।সব মেনে নিচ্ছি।পারে অবশ্যই পারে।কোনো সমস্যা নেই।আমি আমার কথা ফিরিয়ে নিচ্ছি।তোমার হাত অনেক সুন্দর।”

সাদিব রীতির হাত ধরে বললো,
—-“চলো দুজন মিলে গোধূলির আকাশ দেখি।”

রীতি বই রেখে সাদিবের সাথে উঠে দাড়ালো।দুজনে মিলে ছাদের রেলিঙের কাছে গেলো।দুজনে হাতে হাত রেখে গোধূলির রক্ত রাঙা আকাশ দেখছে।

“মন আমার হরতাল ডেকেছে
শহরের অলিতে-গলিতে তার
নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি ছাপিয়েছি
আকাশ আমায় দিচ্ছে তাড়া।
গোধূলি বেলায় এক টুকরো
ভালোবাসা হয়ে সে দিলো ধরা।”

সাদিব এতক্ষণ রীতির মুখের দিকে চেয়ে ছিলো।রীতি থামতেই সাদিব স্নিগ্ধ হাসি দিলো।
—-“মন হরতাল ডেকেছিলো কেনো?ওহ সারাদিন দেখা দেইনি বলে?”

রীতি সাদিবের দিকে তাকালো তারপর বললো,
—-“ভার্সিটিতে আপনার দেখা পাইনি।কোথায় ছিলেন?”

—-“আমাদের নতুন বাসার কাজ শুরু হয়েছে।সেটা দেখতে গিয়েছিলাম।”

—-“আপনাদের বাড়ির কাজ শেষ হলে ও বাড়িতে চলে যাবেন?”

—-“হু।”

রীতি মন খারাপ করে বললো,
—-“ওহ।”
তারপর আকাশের দিকে তাকালো।
সাদিব রীতির সামনে আসা অবাধ্য চুলগুলো কানের পেছনে গুজে বললো,
—-“মাত্র বাড়ির কাজ শুরু হয়েছে।শেষ হতে অনেক সময় লাগবে।কাজ শেষ হলে সব গোছগাছ করে যেতে যেতে ২-৩ বছর লেগে যাবে।ততদিনে আমাদের বিয়ে হয়ে যাবে।নতুন বাড়িতে আমাদের নতুন জীবন শুরু হবে।”

রীতি কৌতুহল নিয়ে বললো,
—-“গার্ডেন আছে?”

—-“আছে তো।অনেক বড় গার্ডেন হবে।যদিও এখন পতিত জমি ছাড়া কিছু নয়।বাড়ির কাজ শেষ হলে গাছ লাগাবো।সেখানে বেলীফুলের আলাদা বাগান করবো শুধু তোমার জন্য।একদিন চলো তোমাকে সব দেখিয়ে আনবো।”

—-“আচ্ছা।”

লাল আভা মিলিয়ে যাচ্ছে দূর দিগন্তে।পাখিরা নীড়ে ফিরতে ব্যস্ত।অন্ধকার নেমে আসছে।অন্ধকার শেষে নতুন ভোর নিয়ে আসবে আলোয় ঝলমলে আরেকটা দিন।

.

রীতি ব্যাগ কাধে ভার্সিটির জন্য বের হচ্ছে।গেট দিয়ে বের হতেই দেখে সাদিব বাইকের উপর বসে আছে।রীতিকে দেখে বললো,
—-“সামনে এসো।”
তারপর সাদিব বাইক স্টার্ট দিলো।তারপর কিছুদূর গিয়ে বাইক থামালো।রীতি বুঝতে পারছেনা সাদিব কেনো সামনে যেতে বললো।রীতি সাদিবকে ফলো করে সামনে গেলো।

রীতি সাদিবের সামনে গিয়ে বললো,
—-“কি হয়েছে?এখানে আসতে বললেন কেনো?”

সাদিব একটা হেলমেট বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
—-“এটা পড়ো।তারপর উঠে বসো।”

রীতি চোখ বড়বড় করে বললো,
—-“মানে?”

—-“আমি ভার্সিটি যাচ্ছি তোমাকে নামিয়ে দেবো।কোনো সমস্যা?”

রীতি আমতা আমতা করে বললো,
—-“সমস্যা না,তবে আপনার সাথে যাবো কেমন দেখা যায়?”

—-“কেমন দেখা যায়?”

রীতি সাদিবকে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেয়ে ওর বাইকে উঠে বসা ভালো মনে করলো।রীতি সাদিবের হাত থেকে হেলমেট নিয়ে পড়ে নিলো।কিন্তু হেলমেট পড়া অবস্থায় উঠে বসতে পারছেনা।
—-“রীতি হেলমেট খোলে নেও।আগে উঠো তারপর পড়ো।”

রীতি হেলমেট খোলে সাদিবের হাতে দিয়ে বাইকে উঠে বসে।তারপর হেলমেট পড়ে সাদিবের কাধে হাত দিয়ে বললো,
—-“আস্তে চালাবেন।নয়তো পড়ে মরে গেলে বিয়ের আগে বিধবা হবেন?”

—-“ছেলেরা বিধবা হয়?জানতাম না তো।”

—-“আজ জেনেছেন তো?তাতেই হবে।আস্তে চালাবেন।”

—-“ওকে ওকে আমার তোমার ভাষায় বিধবা হওয়ার ইচ্ছে নেই।আমার কাধে যে হাত রেখেছে সে আমার জীবন, আমার হৃদয়ের স্পন্দন।তাকে আমি হারাতে চাইনা।”

—-“হয়েছে হয়েছে রাস্তায় এতো রোমান্টিক হতে হবেনা।”

সাদিব রীতিকে নিয়ে ভার্সিটিতে গেলো।বাইক পার্ক করে পাশাপাশি হাটছে।
রীতি সাদিবের বন্ধুদের দেখে বললো,
—-“আমি আসছি।আপনার ক্লাস শেষ হলে চলে যাবেন।আমার জন্য অপেক্ষা করবেন না।”

সাদিব রীতিকে বিদায় দিয়ে বললো,
—-“ওকে।নিজের খেয়াল রেখো।”

রীতি ওর বান্ধবীদের সঙ্গে ক্লাশ রুমে চলে গেলো।
রীতি যেতেই সাদিবের বন্ধু বললো,
—-“রীতি তোকে এখনো আপনি করে বলে?”

—-“হ্যা রে ভাই।ওর নাকি আপনি বলতেই ভালো লাগে।তাই আপনি করেই বলবে।আমারো খারাপ লাগেনা ওর মুখে আপনি শুনতে তাই না করিনা।তুমি বলার জন্য জোরও করিনা।তুমি,আপনি ফ্যাক্ট না।ও যেমনটি চায় তেমনটিই হবে।”

.

দিয়া জানালার পাশে বসে এক দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে।
রীতি মায়ের বানানো পিঠা দিতে গিয়ে দিয়ার রুমে উকি দেয়।দিয়া বিষন্ন মনে বসে আছে তাই রীতির দিয়ার কাছে গিয়ে দিয়ার কাধে হাত রাখলো।
দিয়া রীতিকে দেখে ঘুরে বসে ঠোঁট বাকিয়ে বললো,
—-“রীতি আপু ভালো লাগে না।তোমাকে খুব হিংসা হয়।মারাত্মক হিংসা।”

রীতি ঘনঘন পলক ফেলে বললো,
—-“কেনো?কেনো?”

—-“এই যে সাদিব ভাইয়া তোমার কত কেয়ার করে,ভালোবাসে।আমার এমন কেউ নেই।আমারো তোমার মতো একজন চাই।”

—-“সময় হলে অবশ্যই পেয়ে যাবে।এখন শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া করো।ভুল মানুষ জীবনে এসে জীবনটা যেনো বিষাদে রূপান্তরিত না করে দেয়।যখনি আসবে একজন সঠিক মানুষ যেনো আসে।”

দিয়া বিজ্ঞদের মতো বললো,
—-“হ্যা আপু ঠিক বলেছো।আমার লাইফে যেনো রিজভীর মতো কেউ না আসে।সাদিব ভাইয়ার মতো যেনো একজন ভালো মনের মানুষ আসে।যার শরীরের প্রতি না মনের প্রতি লোভ থাকবে।”

রীতি দিয়ার গাল টেনে বললো,
—-“হুম তোমার মি.রাইট যেনো খুব শীঘ্রই তোমার লাইফে চলে আসে।”

চলবে…..!