গোধূলি বেলায় প্রেম পর্ব-৩১

0
3314

#গোধূলি_বেলায়_প্রেম
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-৩১|

রীতি বাগানের কোনার আম গাছটায় হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে।আজকাল এই জায়গাটা রীতির খুব পছন্দের।মন খারাপ হলে এখানে এসে দাড়িয়ে থাকে।দাড়িয়ে থাকতে ভালো লাগে।খোলামেলা,নীরব জায়গা।মানুষজনের আনাগোনা নেই বললেই চলে।
রীতি চোখ বন্ধ করে ভাবছে নিজের অন্যায়ের কথা,নিজের বাবাকে ঠকানোর কথা।
“বাবাকে এভাবে ঠকাচ্ছি।বাবাকে বাবার চেয়ে বন্ধু বেশী ভেবেছি।বাবা আমার কাছের বন্ধু হওয়ার জন্য সর্বাধিক চেষ্টা করেছেন।আর সেই চেষ্টায় জয়ীও হয়েছেন।বাবার সাথে আজীবন সব কথা শেয়ার করেছি।ভালো লাগা,কষ্টের কথা,স্বপ্ন,ইচ্ছে সবটা শেয়ার করেছি।
বাবার বিশ্বাস অর্জন করেছি।বাবা যখন সত্যিটা জানতে পারবে তখন কি হবে?সাদিবকেও আমি না ভালোবেসে থাকতে পারিনি।ওকে ফিরিয়ে দেওয়ার নূন্যতম ক্ষমতা আমার ছিলো না।আমি অসহায় ছিলাম।সাদিবকে খুব ভালোবেসে ফেলেছিলাম।তাই নিজেকে হাজারো চেষ্টা করে আটকাতে পারিনি।”
গাড়ির হর্নের শব্দে রীতির ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটে।রীতি চোখ খোলে পেছনে ঘুরে দেখে সাদিবের বাবার গাড়ি বের হচ্ছে।
রীতি গাড়িটার গেটের বাইরে না যাওয়া পর্যন্ত গাড়িটির দিকে তাকিয়ে রইলো।
অতঃপর সাদিবকে দেখলো বাইক নিয়ে বের হচ্ছে।
রীতি গাছের আড়ালে লুকিয়ে গেলো সাদিব যেনো ওকে না দেখে তাই।রীতি গাছের সাথে আবারো হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো।
রীতি ভাবছে এতোক্ষণে হয়তো সাদিব বেড়িয়ে গেছে।

তখনই শীতল কন্ঠস্বর বললো,
—-“এখানে কি করছো?”

রীতি হুট করে কারো কথা শুনে চমকে গেলো।তারপর চোখ খোলে সাদিবের দিকে তাকালো।
সাদিব রীতির মুখ দেখে বললো,
—-“আমি মানুষ ভূত-প্রেত নই।আজকাল ভূত-প্রেত নিয়ে খুব পড়াশোনা করছো বুঝি?”

রীতি সাদিবের কথার জবাব দিলোনা।সাদিব রীতির উত্তর না পেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—-“কি হয়েছে? মুড অফ কেনো?”

রীতি সাদিবকে সত্যিটা বলতে চায়না।রীতি চায়না সাদিবকেও অপরাধবোধে ভোগাতে।তাই বললো,
—-“কিছুনা,মুড সুইং।”

সাদিব গাছে একটা হাত রেখে বললো,
—-“চলো বাইরে থেকে ঘুরে আসি।তোমার মন ভালো হয়ে যাবে।”

—-“নাহ,আমার ইচ্ছে করছে না।”

—-“ওহ আচ্ছা,তাহলে আজ আমি বাইরে যাবোনা।তোমার সাথে থাকি।”

রীতি বিরক্তি নিয়ে বললো,
—-“আমি একা থাকতে চাই।আপনি যেখানে যাচ্ছিলেন যান।আমাকে একা থাকতে দিন প্লিজ।”

সাদিব রীতির কথা শুনে অবাক হলেও মন খারাপ করলো না।কারণ সাদিব মেয়েদের মুড সুইং সম্পর্কে জানে।এমন সময় সব কিছু বিরক্ত লাগে।কাছের মানুষ,ভালো কথা সব তেতো লাগে।সাদিব রীতিকে একা থাকতে দিতে চাইছে।তাই বললো,
—-“ওকে থাকো।তোমাকে আর বিরক্ত করছিনা।নিজের মতো থাকো।মুড ভালো করার চেষ্টা করো।প্রয়োজন হলে আমাকে ডেকো।”

সাদিব কথাগুলো বলেই চলে গেলো।সাদিব যেতেই রীতি জোরে শ্বাস নিলো।নিজেকে হালকা করার চেষ্টা করছে।

.

রীতির মন কিছুটা ভালো।বিকেলে ছাদে বসে হুমায়ুন আহমেদ এর “তিথির নীল তোয়ালে” বইটা গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছে।কয়েক পাতা পড়ার পর দিয়া রীতির পাশে এসে বসলো।
দিয়া আমতা আমতা করছে কিন্তু কিছু বলছেনা।রীতিও কিছু জিজ্ঞেস করছেনা।অপেক্ষা করছে দিয়ার নিজ থেকে বলাকে।তখনই গিটারের টুংটাং শব্দ শুনতে পেলো।রীতি বই থেকে চোখ তুলে ওপাশে তাকালো।সাদিব রীতির দিকে তাকিয়ে গিটারে সুর তুলছে।
দিয়া রীতিকে বললো,
—-“তোমার রাজপুত্র এসে পড়েছে গিটার নিয়ে।”

দিয়া উঠে সাদিবের সামনে গিয়ে ওদের সাথে যোগ দিলো।রীতি সাদিবের দিকে গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে।প্রতিদিন বিকেলে গোধূলি বেলায় তাদের প্রেমের সময়।রীতি পড়ার বাহানায় আর সাদিব হাওয়া খাওয়ার বাহানায় রোজ ছাদে আসে।এতো মানুষের মধ্যে রীতি পড়ার ফাকে ফাকে সাদিবের দিকে তাকায়।দুজনে চোখে চোখ রেখে হাজারো কথা আদান-প্রদান করে।

🎶🎶
“বান জা তু মেরি রাণী
তেনু মহল দাওয়া দোংগা।
বান মেরি মেহবুবা
মেইন তেনু তাজ পাওয়া দোংগা।”

(আর পারিনা।😒😒নিজ দায়িত্বে শুনে নিন।)

সাদিব রীতির দিকে তাকিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে গান গাইছে।রীতিও সাবিদের গান শুনে মিটমিট করে হাসছে।গান শেষ হতেই সাদিব আর রীতি একে অপরের দিকে চেয়ে কিছু বলছে চোখের ইশারায়।দিয়া এসে রীতিকে ধাক্কা মেরে বললো,
—-” তোমার রাজা তোমার জন্য মহল,তাজ নিয়ে রেডি।এখন তোমার রাণী হওয়ার অপেক্ষা।”

রীতি দিয়ার কথা শুনে বললো,
—-“আমার মহল,তাজ কিছু চাইনা।এমনকি রাণীও হতে চাইনা।শুধু তাকে চাই আর তার হতে চাই।”

দিয়াও অদ্ভুত কিছু অনুভব করছে।নতুন কিছু অনুভূতির সাথে পরিচিত হচ্ছে।

সাদিব,রীতি দুজনেই অপেক্ষা করছে ছাদ ফাকা হওয়ার।আজ দুজনই দুজনের সাথে কথা বলতে চাইছে।ছাদ কিছুটা ফাকা হতেই রীতি বই রেখে উঠে সাদিবের সামনে এসে মাথা নিচু করে নিচু গলায় বললো,
—-“সরি,আমার মুড অফ ছিলো তাই আপনার সাথে ওমন ব্যবহার করেছি।আমার আসলে এভাবে কথা বলা উচিৎ হয়নি।আমি জানি আপনি হার্ট হয়েছেন অনেক।আমি আসলে ইচ্ছে করে….।”

—–“হিসসসস!”
সাদিব রীতিকে থামিয়ে দিলো।
রীতি মাথা তুলে সাদিবের দিকে তাকালো।
সাদিব বললো,
—-“তোমাকে কে বলেছে আমি হার্ট হয়েছি?মুড খারাপ হলে আমরা অনেক কিছুই বলে ফেলি।অপর পাশের মানুষ যদি না বুঝে তবে ভুল-বুঝাবুঝি হয়।আর আমি যদি তোমাকে না বুঝি তবে কেমন কাছের মানুষ হয়েছি?”

রীতি অপরাধ বোধ নিয়ে বললো,
—-“তবুও!”

সাদিব কি একটা ভেবে বললো,
—-“এতোই যখন অপরাধ ফিল করছো তবে এক কাজ করো।”

রীতি কিছুটা ভয় নিয়ে বললো,
—-“কি কাজ?”

সাদিব মুচকি হেসে বললো,
—-“কান ধরে উঠ-বস করো।”

রীতি সাদিবের দিকে চোখ মুখ কুচকে তাকালো।সাদিব ফিক করে হেসে দিলো।
রীতি গাল ফুলিয়ে রেলিঙ ধরে দাড়িয়ে রইলো।
সাদিব রীতির পেছনে গিয়ে দাড়িয়ে বললো,
—-“লজ্জাবতী এখন অভিমানী হয়ে গেছে।কথায় কথায় অভিমান করে।আমি বেচারা পড়েছি বিপদে।”

রীতি গাল ফুলিয়ে বললো,
—-“আপনাকে কে বলেছে বিপদে পড়তে?আপনি দাড়িয়ে আছেন কেনো চলে যান।”

—-“আমি দাড়িয়ে আছি কারণ এটা আমার বাড়ি।আমার ছাদ।”

রীতি সাদিবের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-“এখন আবার বাড়ির খুটা দিচ্ছেন?আপনার বাড়িতে থাকি বলে কথা শুনাচ্ছেন?”

সাদিব পড়লো মহা-মুশকিলে।রীতিকে পেছনে থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললো,
—-“এই ছাদ,এই চিলেকোঠা,ওই যে নিচে বেলীফুল গাছটা দেখছো এগুলোর সাথে সাথে এই আমিকে তোমার নামে লিখে দিয়েছি।আর কি চাই তোমার?”

সাদিবের ছোয়া আর ফিসফিস করে বলা কথাগুলো গায়ে কাটা দিচ্ছে রীতির।
রীতি নিজেকে ছাড়িয়ে লাজুক ভঙ্গিতে বললো,
—-“আর কিছু চাইনা আমার।”

রীতি নিজের বই আর মুঠোফোন হাতে নিয়ে নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।পেছনে থেকে সাদিব বললো,
“রাতে ফোন করবো।”

রীতি হালকা হাসি উপহার দিলো।

.

এভাবে কেটে গেছে কয়েক মাস।বকুল গাছে বকুলের ফুল ফুটেছে।গাছের নিচে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ফুল।সেগুলো থেকে সুগন্ধ বেরুচ্ছে।রীতির বেলীফুল পছন্দ হলেও বকুল ফুলের ঘ্রাণ বেশি প্রিয়।রীতি সকাল সকাল একটা একটা করে বকুল ফুল কুড়াচ্ছে বাচ্চাদের মতো।
সাদিব বাগানে কাজ করছে এসে দেখে রীতি বকুল ফুল কুড়াচ্ছে।সাদিব চোখ ডলে আবারো তাকালো ভুল দেখেছে কিনা সেটা শিওর হতে।নাহ ও রীতিকেই দেখছে।রীতি ফুল কুড়িয়ে ওড়নায় অতি যত্নে রাখছে।
সাদিব রীতির সামনে এসে দাড়ালো। রীতি সাদিবকে দেখে উঠে দাড়ালো।

সাদিব রীতিকে জিজ্ঞেস করলো,
—-“কি করছো?”

—-“বকুল ফুল তুলছি।”

সাদিব কৌতুহল নিয়ে বললো,
—-“ফুল দিয়ে কি করবে?”

রীতি আগ্রহের সহীহ বললো,
—-“ফুল দিয়ে মালা গাথবো।বইয়ের ভাজে রেখে দেবো।”

—-“মালা শুকিয়ে যাবে।বকুল ফুল দ্রুত শুকিয়ে যায়।”

—-“গেলে যাবে।একটা গান শোনেন নি বকুলের মালা শুখাবে,রেখে দেবো তারো সুরভী।আমি বকুল ফুলের সুরভী রেখে দেবো।দেখুন কি সুন্দর পাগল করা ঘ্রাণ।(ফুল বাড়িয়ে দিয়ে)

রীতি নিজেই শুকে বললো,”আহ,,!কি সুন্দর ঘ্রাণ!”

সাদিব রীতির কান্ড দেখে বললো,
“বকুল ফুলের গাছটাও তোমার নামে লিখে দিলাম।দিতে দিতে সবই দিয়ে দিলাম।আজ আমি নিঃস্ব।(মজা করে) ”

রীতিও সুযোগ নিয়ে বললো,
—-” আপনি এখনো নিঃস্ব হোননি।এখনো আপনার কাছে আপনার জানের জান বাইক আছে।সেটা এখনো দেন নি।”

সাদিব ঢোক গিলে হেসে বললো,
—-“কারণ তুমি বাইক চালাতে পারোনা।বাইক দিয়ে কি করবে?”

রীতি বললো,
—-“তাতে কি?আমি ভাড়ায় দেবো।দিবেন কিনা বলুন?”

সাদিব পড়েছে বিপদে।এখন কি করে নিজের প্রাণের বাইক বাচাবে রীতির হাত থেকে।
—-“তুমি আমার বাইকের পেছনে পড়লে কেনো?ওটা ছেড়ে দেও।”

—–“বুঝেছি,সব বুঝেছি।আপনি আমার চেয়ে বাইককে বেশী ভালোবাসেন।তাই তো এমন করছেন।”

—-“আরে না কি যে বলো।কিন্তু তুমি কাকে ভাড়ায় দেবে?আমার বাইক নষ্ট করে ফেললে?”

—-“আমি কি অন্য কাউকে দেবো নাকি?আমি তো আপনাকে ভাড়ায় দেবো।তবে যখন আমাকে নিয়ে বের হবেন।কারণ তখন আপনি অনেক স্লো চালান।একা থাকলে অনেক স্পিডে চালান।আমার খুব ভয় লাগে আপনার জন্য।তাই আজ থেকে বাইকের মালিক আমি।আমার পারমিশন ছাড়া চালাতে পারবেন না।”

সাদিব অসহায় ফেস করে বললো,
—-“ওকে,কি আর করা।আমার সুখের দিন শেষ।আমার বাইকের মালিক আজ অন্য কেউ।এই দুঃখ কই রাখি?”

—-“পকেটে রাখুন।”

রীতি বকুল ফুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে উপরে যাচ্ছে।আর গুনগুন করে গান গাইছে,”বকুলের মালা শুখাবে,রেখে দেবো তারো সুরভী।”

.

রীতির বাবা রীতিকে বইয়ের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
—-“তোমার ব্যতিক্রম টেস্ট পেপার।এখুনি পড়া শুরু করে দেও।আর তোমার গল্পের বইও আছে।”

রীতির মা রীতির বাবাকে বললো,
—-“গল্পের বই এতো পড়ার কি দরকার? দেখবে একদিন এসব পড়তে পড়তে মাথাটা গেছে।”

রীতির বাবা রীতির মাকে কড়া গলায় বললো,
—-“আমি আমার মেয়ের সব আবদার পূরণ করবো।আমার মেয়ে আমার সব কথা রাখছে।আমার কথা ভেবেই সব ছেড়ে এতো পড়াশোনা করে স্বপ্নের দিকে এগুচ্ছে।অন্য আর ১০টা ছেলেমেয়ের মতো নিজেকে নিয়ে মেতে নেই।”

রীতির বাবা নিজের রুমে যেতেই রীতি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।রীতির মা রীতিকে বললো,
—-“তোর বাবার এতো বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারবি তো?”

রীতি মায়ের কথা শুনে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে।
আসলেই তো ও কি পারছে বাবার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে।
রীতি বইগুলো নিজের রুমে নিয়ে নিজেকে নিজে বললো,
“আমি কোনো অন্যায় করছি না।সাদিবকে নিজের লাইফে রাখার পাশাপাশি বাবার স্বপ্ন পূরণ করছি।আমি দুদিকেই ব্যালেন্স রাখছি।পড়াশোনায় কোনো ঘাটতি রাখছিনা।সাদিব আমার পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটায় না।আমার পড়ার চাপ বাড়লে নিজেই দূরত্ব বজায় রাখে।তাই আমি ভুল করছি না।”

চলবে…!