#গোধূলি_বেলায়_প্রেম
#ফাবিহা_নওশীন
|পর্ব-৪৩|
রীতি বাবার সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে রেখেছে।ওর কেনো জানি মনে হচ্ছে বাবা খুব রেগে আছেন।
রীতি মিনমিন করে বললো,
—-“বাবা,আ’ম সরি।আসলে এতোদিন সাদিব নিখোজ ছিলো তাই নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি উনার ফেরার কথা শুনে।”
রীতির বাবা বললো,
—-“ঠিক আছে,এখন বাড়িতে চলো।”
রীতি আর রীতির বাবা হটাৎ গেইট খোলার শব্দ পেলো।দুজনেই আকস্মিক শব্দে পেছনে ঘুরে তাকালো।
সাদিবের বাবা আসছেন।দুজনে একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করছে।ততক্ষণে সাদিবের বাবা ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন।কিছু বলতে চাইছেন কিন্তু পারছেনা।
সাদিবের বাবা নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,
—-“আসলে আমার বলার মুখ নেই তবুও বলছি আমাকে ক্ষমা করবেন।আমার অন্যায়ের শাস্তি আমি আমার ছেলেকে দিতে চাইনা।সাদিবকে নিয়ে আমি অনেক বড় কথা বলেছিলাম,অনেক অহংকার করেছি।আর আমার সেই অহংকার চূর্ণ হয়ে গেছে।আজ আমার সেই ছেলের জীবন বিপর্যয়ের মুখে।এ-সব আমার জন্য হয়েছে।আমি যদি ওর উপর জোর করে সিদ্ধান্ত না চাপিয়ে দিতাম তাহলে আজ হয়তো এমন হতোনা।
আমি আপনার সাথে অনেক বাজে ব্যবহার করেছি।আর এর শাস্তি আমি পাচ্ছি।দয়া করে আমাকে মাফ করে দিন।আমি আমার ব্যবহারের জন্য অনুতপ্ত,লজ্জিত।”
(হাত জোর করে)
রীতির বাবা ইতস্ততবোধ করছেন।মেয়ের দিকে কনফিউশন নিয়ে তাকালো।নেহাৎ ভদ্রলোক তাই ভদ্রতা করে বললো,
—-“কি করছেন হাত জোর করছেন কেনো?নিজেকে অসম্মানিত করবেন না।আমি ও-সব ভুলে গেছি।”
সাদিবের বাবা খুশি হয়ে গেলো রীতির বাবার কথা শুনে।তারপর অনুনয়ের সুরে বললো,
—-“আরেকটা কথা বলবো যদি রাখেন।”
—-“হ্যা হ্যা অবশ্যই বলুন।”
—-“সব ভুলে গিয়ে সাদিবকে মেনে নিন।আমি বুঝতে পেরেছি ওরা একে অপরকে কতটা ভালোবাসে।ওদের ভালোবাসা লোক দেখানো না।”
রীতির বাবা চুপ করে আছেন।এই ব্যাপারে তিনি কিছু বলতে পারছেন না।
রীতির বাবাকে চুপ দেখে বললো,
—-“ভাই কিছু বলুন।আমার ছেলেটা মরে যাবে।আমি স্বার্থপরের মতো কথা বলছি জানি।কিন্তু কি করবো ছেলেমেয়ের জন্য বাবা-মাকে নির্লজ্জ হতে হয়।তাই নির্লজ্জ হয়ে আপনার কাছে হাতজোড় করছি।আমার ছেলেটা মরে যাবে।”
—-“আমি হুট করে কিছু বলতে পারবোনা।আমাকে আগে এ বিষয়ে ভাবতে হবে।পরিবারের সাথে ডিসকাশন করতে হবে।তারপর,,।”
—-“ঠিক আছে আগামীকাল আপনারা আসুন আমাদের বাড়িতে তখনই কথা বলবো।”
—-“আচ্ছা।আজ তাহলে আসি।”
.
সাদিব মাঝরাতে উঠে পাগলামি শুরু করে দিয়েছে।ওর নিজেকে পাগল পাগল লাগছে।ওর সারা শরীর কাপছে।মাথা কেমন জানি করছে।শরীর কামড়াচ্ছে।নিজেকে ব্যালেন্স করতে পারছেনা।
সাদিব নিজের দুহাত নিজের নখ দিয়ে আচড়ে দিচ্ছে।নিজের চুল ধরে টানছে।
কেউ ওকে থামাতে পারছেনা।সাবিহা ডাক্তারকে ফোন করলো।তারপর তার কথা মতো একটা ইঞ্জেকশন নিয়ে সাদিবের শরীরে পুশ করার চেষ্টা করছে।অভি সাদিবের বড় বোনের ছেলে সেও মামাকে ভয় পাচ্ছে প্রচুর।মায়ের পেছনে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।যার কিনা সাদিব মামা বলতে জান ছিলো।
সাদিবের বাবা-মা সাদিবকে জোর করে ধরে ইঞ্জেকশন দিয়ে দিলো।সাদিব নিস্তেজ হয়ে পড়লো।ধীরে ধীরে ওকে ধরে শুইয়ে দিলো।
সাদিবের বাবা-মা সবাই বেশ চিন্তায় পড়ে গেলো।সাদিবকে কি করে ঠিক করবে৷সাদিবের মা কেদে ভাসিয়ে দিচ্ছেন।সাদিবের পাশে বসে সাদিবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
।
পরের দিন রীতির বাবা-মা সদিবদের বাসায় গেলো।রীতি অস্থিরতায় ভোগছে।ঘরজুড়ে পাইচারি করছে।নখ কামড়ে যাচ্ছে।কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারছেনা।ও বাড়িতে কি হচ্ছে এ-সব ভেবেই ওর মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
সাদিবের বাড়িতে আলোচনা সভা বসেছে।আলোচনার বিষয় হচ্ছে সাদিব – রীতির সম্পর্কের পরিনতি।
রীতির বাবা বললো,
—-“দেখুন এতোকিছু হওয়ার পরেও আমি এখানে এসেছি আমার মেয়ের জন্য।আপনি গতকাল বললেন না যে ছেলে-মেয়ের জন্য বাবা-মা নির্লজ্জ হতে পারে।ঠিক তাই।রীতি আমার অনেক আদরের মেয়ে।আমি চাই ও সুখে থাক।”
সাদিবের মা বললো,
—-“রীতিকে নিয়ে আমার কোনো কালেই সমস্যা ছিলো না।এখানে ওর কোনো অযত্ন হবেনা।আমি ওকে ওর মায়ের মতো আগলে রাখবো।আর আপনারা সাদিবকে জানেন।সাদিব রীতির প্রতি কতটা সিরিয়াস।সাদিব এখন একটু অসুস্থ কিন্তু নিজের ছেলে বলে বলছিনা সাদিবের মতো রীতিকে কেউ ভালোবাসবেনা,কেউ ভালো রাখতে পারবেনা।”
তখনই ভেতর থেকে ভাঙচুরের আওয়াজ এলো।সবাই ভেতরে ছুটে গেলো আতংকিত চেহারা নিয়ে।রীতির বাবা-মা ব্যাপারটা বুঝতে পারছেনা।তারা দুজনেই দাঁড়িয়ে আছেন।
সাদিব ঘরের জিনিসপত্র সব ভেঙে ফেলছে।কাচ ভাঙা এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।দরজার সামনে ওর বাবা-মাকে দেখে বললো,
—-“আমাকে যেতে দেও,আমি এখানে আর এক মুহুর্ত থাকতে পারবোনা।আমাকে যেতে দেও।”
সাদিবের বাবা-মা সাদিবকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করছে।সাদিবের বড় বোন সাদিবের কাছে গিয়ে বললো,
—-“সাদিব রীতির বাবা-মা এসেছে।তোর আর রীতির কথা বলতে।ভাই এখন এমন করিস না।উনারা কি ভাববেন?একটু শান্ত হয়ে বস।”
সাদিব ভালো ছেলের মতো চুপ করে বিছানায় বসে রইলো।
.
রীতির বাবা কিছুই বুঝতে পারছেনা।সাদিব কেনো চিতকার করলো।
সাদিবের মা ওদের সামনে এসে জোরপূর্বক ভদ্রতাসূচক হাসি দিয়ে বললো,
—-“আপনারা চা নেন নি কেনো?নিন।”
উনাদের চোখে-মুখে প্রশ্নের ছাপ।রীতির মা প্রশ্ন করেই ফেললো,
—-“সাদিব এভাবে চিতকার করলো কেনো? ও কি খুব অসুস্থ?”
সাদিবের মা কেদে ফেললেন।সাদিবের বাবাও চুপ করে আছেন।
কিছুক্ষণ পরে বললো,
—-“কি করবো বুঝতে পারছিনা,,ও দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে।হুট করে ডেস্পারেট হয়ে যাচ্ছে।কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিনা।”
রীতির মা বললো,
—-“আমার মনে হচ্ছে ওকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে নেওয়া উচিৎ।এতে ও নিজেকে এসব থেকে দ্রুত বের করে আনতে পারবে।অনেকেই শুনেছি এতে উপকার পায়।”
সাদিবের বড় বোন বললো,
—-“পাশাপাশি আমার মনে হচ্ছে ওর সাইকোলজিক্যাল কন্ডিশনস ভালো না।
মানসিক সমস্যায় ভুগছে।ওর জন্য একজন মানসিক ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ।”(কিছুটা সংশয় নিয়ে বললো)
সবাই এতে একমত প্রকাশ করলো।
সাদিব পেছনে থেকে বললো,
—-“আমাকে তোমাদের পাগল মনে হচ্ছে? আমি পাগল?”
অভি মামার কন্ঠস্বর শুনে মায়ের পেছনে লুকিয়ে গেলো।
মারিয়া বললো,
—-“সাদিব তোকে পাগল কে বলেছে?তোর মনে অনেক কষ্ট চেপে রেখেছিলি।মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলি।তাই তোর মানসিক ট্রিটমেন্ট করার জন্যই বলেছি।এতে তোর ভালো হবে।মন ফ্রেশ হবে।তুই আবার সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবি।”
সাদিব দাতে দাত চেপে বললো,
—-“দরকার নেই।আমি ঠিক আছি।আ’ম অলরাইট।”
সাদিব চলে যেতেই রীতির বাবা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
—-“সাদিবকে আগে সুস্থ করার চেষ্টা করুন।ওর কন্ডিশন খুবই দরুন।পরে ওদের সম্পর্ক নিয়ে ভাবা যাবে।আগে সুস্থ হোক।আমি একজন মেয়ের বাবা। মেয়েকে অসুস্থ কারো হাতে তুলে দিতে পারিনা।তাই আগে সাদিবের সুস্থ হওয়া জরুরী।বিয়ের চেয়ে এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সাদিবের সুস্থতা।আমি কিছুতেই রীতিকে এমন অসুস্থ ছেলের হাতে তুলে দিতে পারিনা।ক্ষমা করবেন।”
সাদিব রুমের সামনে দাড়িয়ে সবটা শুনলো।
।
রীতির বাবা-মা রীতিকে সবটা খোলে বললো। রীতি বাবার পায়ের কাছে বসে মিনতির সুরে বললো,
“বাবা,আমি কোনো দিন তোমার অবাধ্য হইনি।কখনো তোমার মতের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করিনি।সব কিছু তোমার সাথে শেয়ার করেছি।শুধু মাত্র সাদিবের বিষয়টি ছাড়া।আমি কোনো ভুল মানুষকে ভালোবাসিনি বাবা।হয়তো মানুষটা এখন ভুল হয়ে গেছে।তাই বলে হাত ছেড়ে দেবো?তাকে ফেরানোর চেষ্টা করবোনা?তাকে কোনো সুযোগ দেবোনা?বিপদে তার পাশে না থেকে সরে যাবো?তাহলে কি সে প্রকৃত মানুষ হতে পারবে?
আমার এখন উনার পাশে থাকা উচিত।আমি যদি এখন উনার পাশে না থাকি তবে উনি আরো ভেঙে পড়বে।বাবা প্লিজ।আমার কথা ভেবেই ওসব বলেছো আর এখন আমার কথা ভেবেই সাদিবকে মেনে নেও।আমার আর কিছু চাওয়ার নেই তোমার কাছে।আর কোনো দিন কিছু চাইবোনা।তুমি যা বলবে তাই করবো শুধু সাদিবকে মেনে নেও।”
রীতির বাবা মেয়ের আকুতিভরা কথা,টলটলে চোখ,রীতির ব্যথাকে অগ্রাহ্য করতে না পেরে রীতির মাথায় হাত দিয়ে বললো,
—-“বিপদে যে আপনজনকে ছেড়ে দেয় সে বেইমান,অমানুষ।আমার মেয়ে বেইমান,অমানুষ নয়।”
।
রীতির ফোন বেজে উঠলো।সাবিহা ফোন করেছে।রীতি সাবিহার ফোন রিসিভ করতেই জানতে পারলো সাদিব লাপাত্তা।ওকে পাওয়া যাচ্ছে না।
রীতি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো।কিছু একটা ভাবছে।রীতি বাড়িতে কাজ আছে,আসছি বলে বের হয়ে গেলো।
রীতি সেই ব্রিজের সামনে গিয়ে নামলো।দূর থেকে সাদিবের বাইক দেখতে পারছে।রীতির ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটলো।সাদিব তাহলে এখানেই আছে।রীতি বাইকের আশেপাশে কাউকে দেখতে পাচ্ছেনা।রীতি আশেপাশে যতদূর যায় দেখলো কিন্তু কোথাও সাদিব নেই। রীতির মনে কু ডেকে উঠলো।সাদিব রাগের মাথায় আবার কোনো কিছু করে ফেলে নি তো?
রীতি ব্রিজের নিচে তাকালো।উত্তাল ঢেউ বয়ে যাচ্ছে।রীতির হাত-পা কাপছে।না চাইতেও আজেবাজে চিন্তা মাথায় ভর করছে।
সাদিব রাস্তার পাশের ঘাসের উপর বসে সিগারেট ফুকছে।
রীতি সাদিব,সাদিব বলে চিতকার করে ডাকছে।সাদিবের কানে রীতির স্বর যেতেই সাদিব উঠে দাড়ালো।রীতিকে খোজছে।রীতি সাদিবকে দেখা মাত্রই হাফ ছেড়ে বাচলো।ওর মনের ভেতর খুশির ঝড় বয়ে যাচ্ছে।রীতি দৌড়ে সাদিবের সামনে গিয়ে দাড়ালো।হাতে সিগারেট দেখে মেজাজ চটে গেলো।রীতি প্রচন্ড মাত্রায় রেগে গেলো।
হাতের সিগারেট নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে রাগে ফুসতে ফুসতে বললো,
—-“আপনি সবাইকে টেনশন দিয়ে মনের সুখে সিগারেট ফুকছেন?কি পেয়েছেন আপনি যা খুশি তাই করবেন?আমাকে আপনার পেছনে দিন-রাত দৌড় করাবেন?আমাকে মেরে ফেলতে চান?তাহলে মেরে ফেলুন।তারপর যা খুশি করুন।কেউ বাধা দিবে না।কেউ না।”
(কাদো কাদো হয়ে)
সাদিব রীতির দিকে কিছুটা এগিয়ে গেলে রীতি অভিমান নিয়ে এক কদম পিছিয়ে গেলো।
—-“রীতি আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো।ভালো লাগছে না কিছু।ওরা বলছিলো আমাকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে পাঠাবে।কিন্তু তোমার বাবা আমাদের সম্পর্ক মানতে নারাজ।উনি উনার দিক হতে ঠিক আছেন।কে চাইবে তার মেয়েকে কোনো নেশাগ্রস্থের হাতে তুলে দিতে।তাই আমি আর ফিরতে চাইনা।এই অন্ধকারে ডুবে যেতে চাই।ধুকে ধুকে মরতে চাই।”
রীতি সাদিবের মুখে হাত দিয়ে বললো,
—-“এসব একদম বলবেন না।ওই দেখুন আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে!”
সাদিব রীতির ইশারা করা দিকে তাকালো।সূর্য ঢলে পড়েছে।মুগ্ধতা ছড়ানো গোধূলি।সাদিবের ইচ্ছে ছিলো এখানে একদিন রীতির সাথে গোধূলি দেখবে কিন্তু হুট করে সেটা পূরণ হয়ে যাবে ভাবতে পারেনি।
সাদিবের চোখে মুখে বিস্ময়।আর রীতির চোখে নতুন করে বাচার অঙ্গিকার।ঠোঁটের কোনে হাসি।সে হাসি জানান দিচ্ছে আনন্দের কথা,অন্ধকারকে দূরে ঠেলে আলোকিত জীবন গড়ার দৃঢ়তা।
সাদিব দেখছে সে হাসি,সে চোখ।আর ভাবছে এই চোখের খুশি,ঠোটের হাসির জন্য নতুন করে বাচবে।বাচার জন্য লড়াই করবে।
চলবে….!