গোধূলি বেলায় প্রেম পর্ব-৪৪

0
3709

#গোধূলি_বেলায়_প্রেম
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-৪৪|

সাদিবের পুরো পরিবারের সামনে সোফায় বসে আছে রীতি আর সাদিব।
সাদিবের পুরো পরিবার সাদিবের টেনশনে পাগল হয়ে যাচ্ছিলো।।তবে এতো সবের মধ্যে একটা ভালো খবর পাওয়া গেছে।রাসেল ধরা পড়েছ।যেদিন সাদিবকে বাসায় নিয়ে আসে সেদিনই সাদিবের বাবা রাসেলের নামে মামলা করেন।পুলিশ উনার খোজ করছিলো এতোদিন।আজ তাকে তার পুরো গ্যাং সহ ধরেছে।

সাদিবের বাবা বললো,
—-“রাসেল ছেলেটা মাদক ব্যাবসায়ী।ওর অনেক বড় দল আছে।যারা ডিপ্রেসড ছেলে-মেয়েদেরকে টার্গেট করে,তারপর তাদের নেশার জগতে নিয়ে যায়।আজ ওকে ধরার পর পুলিশ ইনভেস্টিগেশন করে জানতে পারে ও মাদক ব্যাবসায়ী।ওর নামে আরো কেইস আছে।”

সাবিহা বললো,
—-“উনি ভাইয়াকে প্রথম দিনই টার্গেট করেছেন।তারপর ভাইয়াকে আস্তে আস্তে কব্জা করে নিয়েছেন।”

সাদিব সেটা শুনে বললো,
—-“কিন্তু আমি তো প্রথম দিকে ড্রাগস নিতাম না।কিন্তু তবুও কেমন নেশা নেশা লাগতো।প্রতিদিন নিদিষ্ট একটা সময়ে এমন হতো।আর তারপর থেকে কিভাবে ড্রাগস নিতে শুরু করলাম আমি নিজেই জানি না।”

—-“পুলিশ জানিয়েছে ওই বদমাইস ছেলে তোরে প্রথম দিকে খাবারের সাথে ড্রাগস দিতো।তারপর আস্তে আস্তে এডিক্টেড হয়ে পড়েছিস।”

সাদিব মাথা নিচু করে ফেললো।নিজের কাছেই নিজেকে ছোট লাগছে।কি করেছে এ-সব।শেষে নেশার জগতে তলিয়ে গেলো।
রীতি সাদিবের কাধে হাত রেখে বললো,
—-“এর সমাধান আছে।আর আপনি আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।তাই নয় কি?”

সাদিব মাথা নাড়িয়ে শায় জানালো।সাদিবের বাবা-মায়ের ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি।

.

অনেক রাত হয়ে গেছে।রীতি এতো রাতে যাবে কি করে।রীতিকে আজ থেকে যেতে বলেছে সাদিবের বাবা-মা।রীতির বাড়ি থেকে ফোন এসেছে।
রীতির মা রীতিকে বললো,
—-“আমি ভেবেছি তুই সন্ধ্যার আগে চলে আসবি।তোর বাবাও বাড়িতে নেই।এসে তোকে না দেখলেই তোর কথা জিজ্ঞেস করবে।আমি কি করবো তখন?”

—-“মা,সরি।আমি বাবাকে ফোন করে জানাবো।এ বাড়ির কেউ আমাকে যেতে দিতে চাইছেনা।”

রীতির মা উৎকন্ঠা নিয়ে বললো,
—-“কি বলছিস?মানুষ জানলে কি বলবে?কেউ যদি জানে তুই তোর বয়ফ্রেন্ডের বাড়িতে রাত কাটাচ্ছিস তবে কি হবে জানিস?”

—-“মা,সাদিবের পাশে থাকাটা জরুরী।
আগামীকাল সকালে উনি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চলে যাবেন।তারপর আবার কবে দেখা হবে জানিনা।”

রীতির মা রাগ দেখিয়ে বললো,
—-“তাই বলে ওখানে থাকবি?সকালে চলে যেতে পারতি।তোর বাবা ভিষণ রাগ করবে।আমি কিছু জানি না।তোরা বাপ-মেয়ে বুঝ।”

—-“মা রাগ করছো কেনো?আমি ইচ্ছে করে থাকতে চাইছি? সাদিব আমাকে যেতে দিতে চাইছেনা।আর তাছাড়া আংকেল আন্টি আমাকে থেকে যেতে বলছেন বারবার।আমি সাবিহার সাথে ঘুমাবো চিন্তা করো না।আমি রাখছি।বাবাকে ফোন করবো।”

—-“আচ্ছা,দেখ বাবা কি বলে।”

রীতি বাবাকে ফোন করলো।রীতির বাবা সবজি-ফল কেনায় ব্যস্ত।তখনই ফোন বেজে উঠলো।
রীতির বাবা ফোন রিসিভ করতেই রীতি বললো,
—-“বাবা,আমি সাদিবদের বাড়িতে আছি।কথায় কথায় রাত হয়ে গেছে।তাই আর যাওয়া হয়নি।”

রীতির বাবা উদগ্রীব হয়ে বললো,
—-“আগে জানাবি তো? আমি আসছি তোকে নিতে।”

রীতি আমতা আমতা করছে।
—-“বাবা আসলে…।”

—-“আসলে কি?”

—-“আসলে এই বাড়ির কেউ আমাকে যেতে দিতে চাইছেনা।সবাই বলছে থেকে যেতে।আগামীকাল সকালে সাদিব মাদক নিরাময় কেন্দ্রে যাবে।তাই সবাই বলছিলো আমি যেনো আগামীকাল সকালে যাই।”

—-“তুমি ও বাড়িতে থাকবে?মাথা ঠিক আছে? ”

রীতি সাবিহাকে ইশারা করলো।সাবিহা ওর বাবাকে ডেকে নিয়ে এলো।তারপর বাবাকে সবটা বললো।
তারপর রীতির থেকে ফোন নিয়ে বললো,
—–“আমি কথা বলছি তোমার বাবার সঙ্গে।”

সাবিহা রীতিকে নিয়ে চলে গেলো।রীতি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।শীতের শেষ সময়।গরম পড়তে শুরু করেছে।মার্চ মাসে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে।রীতির ঠান্ডা লাগছে খুব।বাগানের আলোয় বেলীফুল গাছটা চোখে পড়লো।কতদিন পরে গাছটা চোখে পড়লো।গাছে ফুল নেই।তবে রীতির মনে হচ্ছে আবারো এই গাছে ফুল ফুটবে।ফুলের মাতাল করা ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়বে।রীতি মুচকি হেসে সাদিবের রুমের দিকে উকি দিলো।সাদিবের মা সাদিবকে খাইয়ে দিচ্ছেন।রীতি চলে এলো।

সাদিবের বাবা এসে জানালো রীতির বাবাকে রাজি করেছেন।তিনি রীতিকে থাকার জন্য পারমিশন দিয়েছেন।
রীতি আর সাবিহা সেটা শুনে বেশ খুশি।
রীতি শুধু অপেক্ষা করছে সেই দিনের।যেদিন সাদিব ফিরে আসবে।ফিরে আসবে নিজেকে শোধরে।

.

সাদিব রীতির কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে।সাদিবের মাথা নাকি কামড়াচ্ছে।ঘুম আসছেনা।রীতি তাই সাদিবের চুল টেনে দিচ্ছে।রাত বাড়ছে।রীতির সাদিবের ঘরে থাকতে অস্বস্তি লাগছে।রীতি সাদিবের দিকে তাকালো।সাদিবের চোখ বন্ধ।রীতি সাদিবের মাথাটা আস্তে করে ধরে বালিশে রাখতেই সাদিব চোখ মেললো।রীতি সাদিবের চোখ মেলতে দেখে বললো,
—-“আপনি ঘুমান নি?”

সাদিব রীতির দিকে শক্ত করে তাকিয়ে বললো,
—-“তুমি চলে যাচ্ছিলে?”

রীতি বললো,
—-“সাদিব অনেক রাত হয়ে গেছে।আমাকে যেতে হবে।”

—-“কেনো?”

—-“আপনি বুঝতে পারছেন না? এতো রাতে আমি আপনার ঘরে থাকবো?এটা কি ভালো দেখায়?”

—-“আমি জানি না।তুমি যাবে না প্লিজ।এখানে থাকো।”

—-“সাদিব বুঝার চেষ্টা করুন।ঠিক আছে আপনি ঘুমানোর চেষ্টা করুন।আপনি না ঘুমালে আমি যাবো না।ঘুমানোর পরেই যাবো।”

সাদিব রীতির হাত চেপে ধরে বললো,
—-“তুমি এখানেই থাকবে।আগামীকাল তো আমি চলেই যাচ্ছি।একদিন থাকো।যেও না প্লিজ।”

—-“আমি এখানে কি করে থাকি?একজন অবিবাহিত মেয়ে কি করে একজন অবিবাহিত ছেলের ঘরে থাকবে?”

সাদিব রীতির কথা শুনে দমে গিয়ে বললো,
—-“আমরা তো খারাপ কিছু করছি না।”

রীতি বুঝতে পারছে সাদিবের সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।সাদিব তো আর নিজের মধ্যে নেই।
—-“আচ্ছা ঠিক আছে।আমি যাচ্ছি না।”

সাদিব স্নিগ্ধ হেসে রীতির কোলে আবারো মাথা রাখলো।
রীতির ঘুম ভাঙতেই রীতি নিজেকে আধশোয়া অবস্থায় আবিষ্কার করলো।কখন চোখ লেগে গেছে টের পায়নি।রীতি সাদিবের দিকে তাকালো।সাদিব বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।আজ ড্রাগস নেওয়ার জন্য অস্থির হয়নি।শান্ত ছিলো।রীতি সাদিবকে বালিশে শুইয়ে দিয়ে সাদিবের দিকে তাকালো।
তারপর সাদিবের গায়ে চাদর জড়িয়ে দিলো।ধীর পায়ে ঘরের বাইরে চলে গেলো।

রীতি গিয়ে সাবিহার পাশে শুয়ে পড়লো।
পরের দিন সকালে সাদিব গাল ফুলিয়ে নাস্তা করছে।রীতির দিকে তাকাচ্ছে না।
রীতি বুঝতে পারছে সাদিব কেনো এমন করছে।সাদিব নাস্তা সেরে রেডি হয়ে নিচ্ছে।
রীতি সাদিবের রুমে গিয়ে পেছনে থেকে বললো,
—-“অভিমান সাথে করে নিয়ে যাবেন?”

সাদিব শার্টের বোতাম লাগিয়ে বললো,
—-“তুমি মিথ্যা বলেছিলে কেনো?তুমি তখনই চলে গিয়েছিলে তাই না?”

—-“না আমি অনেক রাতে গিয়েছি।আমি আসলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”

সাদিব কথা বলছে না।রীতি সাদিবকে পেছনে থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—-“ভালো কাজে যাচ্ছেন।রাগ-অভিমান ঝেড়ে একটু হাসেন না।প্লিজ,প্লিজ।”

সাদিব রীতির কান্ড দেখে মুচকি হাসছে।কিন্তু রীতিকে বুঝতে দিতে চাইছেনা।মুখ ভার করে রীতির দিকে তাকিয়ে বললো,
—-“হুম, তোমাকে আর জ্বালাবো না।আমার জন্য তোমার সারাক্ষণ টেনশন করতে হবেনা।”

—-“আপনার কি মনে হয় আপনি দূরে গেলেই আমি আপনাকে নিয়ে ভাবা বন্ধ করে দেবো? কখনোই না।”

—-“হুম ভাবনা রাণী।এখুনি আবার ভাবতে বসে যাবেনা না।পড়াশোনা ঠিক করে করবেন।খাওয়া-দাওয়া ভালো করে করবেন।টেনশন নিবেন না।আপনার বিসিএস ক্যাডার হতে হবে ভুলবেন না।আর তার আগে গ্রাজুয়েট কমপ্লিট করতে হবে।আমি একদম সুস্থ হয়ে তোমার সামনে এসে দাড়াবো।তার আগে নয়।আর তার আগে তুমিও আমার সামনে আসবে না।”

রীতি অসহায় ফেস করে সাদিবের দিকে তাকিয়ে আছে।
সাদিব কঠোরভাবে বললো,
—-“এভাবে তাকিয়ে লাভ নেই।”
রীতি চোখ নামিয়ে নিলো।রীতি মুখ ভার করে আছে।
সাদিব রীতির থুতনি তুলে বললো,
—-“আমার ভালোবাসা আছে তোমার সাথে।আর আমিও তোমার ভালোবাসা সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি।তুমি সব সময় আমার সাথে থাকবে।”
সাদিব রীতির কপালে ঠোঁট ছুয়ালো।

সাদিব সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাবার সাথে চলে গেলো।
সাদিবের পুরো পরিবার সাদিবকে বিমর্ষচিত্তে বিদায় জানালেও এক আশায় বুক বাধছে।সাদিব আবার ফিরে আসবে।

রীতির মন বসে না কোনো কিছুতে।তবুও পড়াশোনা করছে পুরোদমে।সাদিবের ভাবনা এক মুহুর্তের জন্য সরাতে পারছেনা মাথা থেকে।এসবের মাঝেই কেটে যাচ্ছে সময়।সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না।না করছে রীতি সাদিবের জন্য।

শরতকাল।কাশফুল ফুটেছে।কাশফুলেরা তুলোর মতো উড়ছে।রীতি সাদার মধ্যে নীল ছোট ছোট ফুলের সুতার কাজ করা শাড়ি পড়ে কাশবনের ভেতরে এগিয়ে যাচ্ছে।অবাধ্য বাতাসেরা রীতির চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে।সাদা কাশফুলের অংশ চুলে এসে বাধছে।রীতি চুল থেকে ফুলের অংশগুলো হাত দিয়ে সরাচ্ছে।
সাদা কোর্ট পড়ে একটা ছেলে ইটের গাথনির উপর বসে গিটার বাজাচ্ছে।গিটারের টুংটাং শব্দ শুনে রীতি সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
রীতি পেছনে গিয়ে দাড়াতেই সাদিব গিটার রেখে উঠে দাড়ালো।তারপর রীতির দিকে ঘুরলো।
রীতি অপলক সাদিবের দিকে তাকিয়ে আছে।সাদিবের ঠোঁটের কোনে সেই হাসি।সেই হাসোজ্জল সাদিবকে দেখছে কতগুলো মাস পরে।সাদিবের চুলগুলো উড়ছে।রীতি মুগ্ধ হয়ে সাদিবকে দেখছে।সেই প্রথম দিনের দেখা সেই সাদিব।সাদিবকে দেখে আরো একবার প্রেমে পড়ছে।
কি নির্মল,কি স্বচ্ছ,কি সুন্দর মুগ্ধতা ছড়ানো সেই হাসি।

চলবে…..!