#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ২২
____________
জোহান কিছুক্ষণ মিতুলের দিকে নীরব তাকিয়ে থেকে বললো,
“তোমার মন আসলে চাইছে এই তুষার জমা পথ দিয়ে পাগলের মতো দৌঁড়াতে।”
জোহানের কথা শুনে মিতুলের হাত থেকে ব্যাগ পড়ে গেল।
“কী?”
জোহান মাথা নাড়িয়ে বললো,
“হুম, এটাই চাইছে তোমার মন। পাগলের মতো ছুটতে চাইছে। আচ্ছা, তুমি এমন কেন বলো তো? নিজের মনের এই সামান্য চাওয়াটুকুও বুঝতে পারো না?”
মিতুলের মন জানার আগ্রহ থেকে রূপ নিলো তীব্র আক্রোশে। রাগ ঝেঁকে বসলো মাথার সর্বত্র। এত বড়ো অপমান করলো জোহান? পাগলও বললো শেষ পর্যন্ত? মিতুলের রাগ হচ্ছে, সেই সাথে কান্নাও পাচ্ছে।
মিতুল কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল জোহানের দিকে। তারপর একটা টু শব্দও না করে, রাস্তা ধরে সোজা হাঁটা শুরু করলো লম্বা পা ফেলে। ওর শপিং ব্যাগ পড়ে রইল রাস্তায়।
জোহান পিছন থেকে ডাকলো,
“হেই মিতুল!”
মিতুল থামলো না। বরং ওর চলার গতি আরও বেড়ে গেল।
জোহান রাস্তা থেকে ব্যাগ দুটো কুড়িয়ে মিতুলের পিছন পিছন ছুটলো।
“আরে মিতুল, দাঁড়াও।”
“ডাকবে না আমাকে। একদম ডাকবে না।” মিতুলের রাগী কণ্ঠ শোনা গেল।
জোহান হেসে ফেললো।
“হেই, ওয়েট ফর মি!…হেই তুলতুল!”
মিতুল থামলো না, হাঁটতেই থাকলো।
জোহান যেতে লাগলো মিতুলের পিছন পিছন।
____________
জোহান কাল রাতে যা বললো, তা মোটেই আশা করেনি মিতুল। ওর মন অন্য কিছু শুনতে চেয়েছিল। কিন্তু ঠিক কী শুনতে চেয়েছিল, সেটা ওর নিজেরই জানা নেই। তবে জোহান যা বললো তা একেবারেই শুনতে চায়নি ও। পাগল…পাগল বললো ওকে? জোহান আস্ত একটা বদমাইশ!
মিতুল জুতোর ফিতা বাঁধতে বাঁধতে মনে মনে আরও কিছু কথা শোনালো জোহানকে ।
আজকে ভ্যাঙ্কুভারে শেষ দিন ওদের। রাতের ফ্লাইটে এডমন্টন ফিরে যাচ্ছে ওরা। তাই আজকে একটু ভালো করে ঘোরাঘুরি হবে। সকাল সকালই যাচ্ছে এখন বিচ দেখতে। স্প্যানিশ ব্যাংক বিচ ও জেরিকো বিচ দেখবে আজকে। রেশমী আন্টি রুম থেকে বেরিয়ে পড়েছে। মিতুল গায়ে একটা হুডি জ্যাকেট চাপিয়ে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লো দ্রুত।
হোটেল থেকে বের হয়েই জোহানকে দেখতে পেল, ট্যাক্সির সাথে গা মিশিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জোহানের গায়েও হুডি জ্যাকেট। কালো রঙের। মাথায় হুডি টেনে রেখেছে। চোখে সানগ্লাস। জোহানকে দেখে মিতুলের রাগ হচ্ছে। জোহানের সামনেও পড়তে ইচ্ছা করে না ওর। মিতুল ট্যাক্সির কাছে এসে গেলে, জোহান পিছনের আসনের দরজা খুলে দিলো মিতুলের জন্য। মিতুল রাগী চোখে তাকালো ওর দিকে।
জোহান একটু হাসলো।
মিতুল ট্যাক্সিতে উঠে বসলো রেশমী আন্টির পাশে। জোহান বসলো সামনের আসনে।
ট্যাক্সি স্টার্ট দিলো ড্রাইভার।
আধ ঘণ্টার ব্যবধানে এসে পৌঁছলো ওরা বিচে। স্প্যানিশ ব্যাংক বিচ ও জেরিকো বিচের অবস্থান পাশাপাশি হওয়ার কারণে, দুটো বিচ মিলে এক চওড়া সী বিচের সৃষ্টি হয়েছে। যা দেখতে মিতুলের কাছে অনেকটা বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের মতো লাগলো। তবে মূল পার্থক্য হলো, কক্সবাজার সৈকতের অবস্থান একেবারে মূল সাগরের ধারে এবং এর অবস্থান সাগর প্রণালীর ধারে। যেখান থেকে উত্তর ভ্যাঙ্কুভার শহর এবং রিচমন্ড শহরের কিছু অংশ পরিষ্কারভাবে দেখা যায়।
শহরের পশ্চিম তীরে অবস্থিত শহরবাসীদের মূল অবকাশ কেন্দ্র হলো এই সমুদ্র সৈকত। শহরের লোকজন সাধারণত সপ্তাহশেষে এখানে পরিবার পরিজন নিয়ে সময় কাটাতে আসে। রেশমী আন্টির কাছ থেকে শোনা গেল গ্রীষ্মকালে না কি এখানে একটু বেশিই ভিড় থাকে। সবাই এখানে নানা বিনোদনমূলক কাজে ব্যস্ত থাকে।
মিতুল চারদিকে তাকিয়ে ভালো ভাবে লক্ষ্য করছে সব কিছু। কেউ কেউ কায়াকিং ও জেটস্কি রাইডিং করছে। কেউ কেউ আবার চওড়া বিচের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কায়াকিং করে সাগর প্রণালীর অপর প্রান্তেও যাওয়া যায়, যখন পানির উচ্চতা কম থাকে। অনেকে এখানে এসেছে মাছ এবং কাঁকড়া ধরার জন্য। জেরিকো বিচের প্রায় একেবারে শেষ প্রান্তে ফিশিং এর জন্য একটি কাঠের তৈরি ডক রয়েছে। যেখানে অনেক মানুষজনকে বড়শি হাতে নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। তবে কাঁকড়া ধরতে হলে ছোট কাঁকড়া ধরা যায় না। একটি নির্দিষ্ট সাইজের চেয়ে ছোট কাঁকড়া ধরা একেবারেই নিষিদ্ধ। সেরকম কাঁকড়া জালে ধরা পড়লে তা আবার সাগরে ফেলে দিতে হয়।
মিতুলেরও ইচ্ছা হয়েছিল মাছ আর কাঁকড়া ধরবে। কিন্তু রেশমী আন্টি এবং জোহান কারো মাঝেই সে আগ্রহ দেখা গেল না। যার জন্য মিতুলের একটু মনোক্ষুণ্ণ হলো। ও আর ওর ইচ্ছার ব্যাপারে জানালো না তাদের কাছে। ওর ইচ্ছাটা ও চেপে গেল।
এই বিচের আশেপাশে অনেক সুন্দর সুন্দর পার্ক রয়েছে। সেই পার্কগুলোতে সবাই বনভোজন করে। ছুটির দিন না থাকায় আজ বেশি কেউ আসেনি বনভোজন করতে। কয়েকজনকে সাইক্লিং করতে দেখা যাচ্ছে। অনেকে আবার হেঁটে বেড়াচ্ছে। ওয়াকিং ও সাইক্লিং এর জন্য আলাদা আলাদা ট্রেইল রয়েছে এখানে। যেখানে জেরিকো বিচ শেষ হয়েছে, সেখান থেকেও একটি ওয়াকিং ট্রেইল শুরু হয়েছে। ট্রেইলটি খুব লম্বা নয়। এখানে হেঁটে বেড়ানো খুবই মনোমুগ্ধকর। সাগরের পার দিয়ে হেঁটে যেতে কার না ভাল লাগে।
মিতুল এখন এই ছোট্ট ট্রেইল ধরে হাঁটছে। রেশমী আন্টি নেই সাথে। উনি পার্কে বসে বিশ্রাম করছেন। জোহান বদমাইশটা আছে পিছনে কোথাও। মিতুলের পিছন ফিরে দেখতে ইচ্ছে হলো না। ওর চোখ এখন সমুদ্র দেখায় ব্যস্ত। এখানে আসার পর শীত যেন অনেক কমে গেছে। ভেবেছিল বিচে আরও বেশি শীত লাগবে। কিন্তু হলো উল্টোটা। শীত কম লাগছে এখন। হয়তো রোদ বাড়ার সাথে সাথে শীতের মাত্রা একটু কমে গেছে। মিতুল গায়ের জ্যাকেট খুলে হাতে নিয়ে হাঁটছে। জ্যাকেট পরাকালীন একটু গরম অনুভূত হয়েছিল সেজন্য।
মিতুলের চোখ যখন সাগর দেখার মুগ্ধ মোহনাতে ডুবে ছিল, ঠিক এমন সময়েই জোহান পিছন থেকে এসে নিজের হাতে খুলে রাখা হুডিটা মিতুলের মাথার উপর দিয়ে দিলো।
জোহানের হুডি চোখের উপর পড়ে ঢেকে দিলো মিতুলের মুগ্ধ দৃষ্টিকে। মিতুল দ্রুত হুডি সরিয়ে জোহানের দিকে কটমট করে তাকালো। জোহান ওকে অতিক্রম করে সামনে উঠে গেছে। সামনে হাঁটতে হাঁটতে ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো।
জোহানের হাসি দেখে মিতুলের ইচ্ছা করলো জ্যাকেটটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় সাগরে। কিন্তু সেই ইচ্ছা দমে গেল জোহানের জ্যাকেট থেকে ভেসে আসা পারফিউমের মিষ্টি ঘ্রাণে। সুগন্ধিটা বেশ ভালো লাগলো মিতুলের। মিতুল জ্যাকেটটা দুই হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে নাকের কাছে এনে কিছুটা মিষ্টি সুগন্ধির ঘ্রাণ নিলো। আর এই সময়েই ওর চোখ চলে গেল সামনে জোহানের দিকে।
দেখলো জোহান ওর দিকে তাকোনো।
মিতুল চকিতে জ্যাকেটটা নামিয়ে ফেললো। জোহান ওর জ্যাকেটের ঘ্রাণ শুঁকে দেখার ব্যাপারটা ধরতে পেরেছে কি না কে জানে! মিতুলের দিকে তাকিয়ে হাসতে দেখা গেল ওকে।
মিতুলের মনে হলো জোহান ওকে বিদ্রূপ করে হাসছে। হঠাৎ কেমন অপমানিত বোধ হলো মিতুলের। সেই সাথে মনটাও মিইয়ে গেল কেমন।
মিতুল এখন আর এসব নিয়ে ভাবতে চাইছে না। মনোযোগ দিলো প্রকৃতি দেখায়। এই ছোট্ট ট্রেইলের শেষে চোখে পড়লো ছোটখাটো একটি সৈকত। এই স্থানটিকে মিতুলের কাছে অনেকটা দ্বীপের মতো মনে হলো।
আরও সামনে হেঁটে যেতে চোখে পড়লো বিভিন্ন ডকইয়ার্ডে নোঙর করা অনেক প্রমোদতরী, এবং অপর ধারে অনেক আঙ্গুরগাছ।
জোহান আঙ্গুর গাছের দিকে গেল। মিতুলও ওর পিছন পিছন চলে এলো আঙ্গুর গাছের সমারোহে। এখান থেকে ফ্রিতে যত ইচ্ছা আঙ্গুর খাওয়া যায়। জোহান কতগুলো আঙ্গুর ছিঁড়ে নিলো গাছ থেকে। মিতুল ঘুরে ঘুরে দেখছে আঙ্গুর গাছগুলো।
জোহান আঙ্গুর খেতে খেতে সামনে এগিয়ে চললো। ওর সাথে সাথে হাঁটছে মিতুল। কালকে রাত থেকে ওর মনে জোহানের প্রতি যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, তা এই মুহূর্তে আর নেই। দুজনে মিলেমিশে আঙ্গুর ক্ষেতটা ঘুরে দেখছে এখন। জোহান নিজে তো আঙ্গুর খাচ্ছেই, মাঝে মাঝে আবার মিতুলকে হা করতে বলে একটা দুটো আঙ্গুর পুরে দিচ্ছে ওর মুখে।
আঙ্গুর গাছের ঝোপে মিতুলের দেখা হয়ে গেল কিছু বুনো খরগোশদের সাথেও। তারাও এই আঙ্গুরগুলোতে ভাগ বসাতে এসেছে।
মিতুলের একটু বেশি সময় ধরেই এখানে থাকার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু জোহান থাকতে দিলো না। জোহান ওকে নিয়ে চলে এলো ওখান থেকে।
এই বিচের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটাও অনেক সুন্দর। মিতুল আর জোহান এখানে খানিকটা ঘোরাঘুরি করলো। এখান থেকে আবার পার্কে ফেরার সময় জোহান হঠাৎ বললো,
“হেই মিতুল, আমার সাথে ক্যাপিলানো সাসপেনশন ব্রিজ ঘুরতে যাবে?”
মিতুল জোহানের পাশে পাশে হাঁটছে। মাথায় জোহানের জ্যাকেটটা দিয়ে রেখেছে। রোদের মাত্রা একটু বৃদ্ধি পেয়েছে যেন এখানে। যদিও অত বেশি তাপ নেই সেই রোদের, তবুও ভালো লাগছে বলে জোহানের জ্যাকেটটা দিয়ে রেখেছে মাথায়। মিতুল বললো,
“ক্যাপিলানো সাসপেনশন ব্রিজ?”
“হুম।”
“এটা কোথায় অবস্থিত?”
“ক্যাপিলানো পার্কে।”
“যাওয়া যায় ওখানে। কিন্তু রেশমী আন্টি?”
“মম থাকুক এখানে। মম ওই পার্ক অতটা পছন্দ করে না। তুমি যাবে?”
মিতুল একটু ভেবে বললো,
“হুম, যাব।”
রেশমী আন্টিকে না জানিয়েই মিতুল জোহানের সাথে বেরিয়ে পড়লো ক্যাপিলানো সাসপেনশন ব্রিজ দেখতে যাওয়ার জন্য।
মিতুলের মনে হলো ক্যাপিলানো সাসপেনশন ব্রিজের কথা ও আগেও শুনেছে। কিন্তু ঠিক মনে পড়ছে না কোথায় শুনেছে এই ব্রিজের নামটা। এখন একেবারেই মনে পড়ছে না। কোথায় শুনেছে নামটা?
জোহান মিতুলের হাত থেকে নিজের জ্যাকেট নিয়ে গায়ে পরেছে। এখান থেকে কিছুদূর হেঁটেই একটা ট্যাক্সি নেবে। আর ট্যাক্সি নিয়ে সোজা ক্যাপিলানো পার্ক।
মিতুল গভীর ভাবে ভাবছিল ব্রিজটি নিয়ে। মনে করার চেষ্টা করছিল কোথায় শুনেছে। যখন মনে পড়ে গেল, তখন চক্ষু দাঁড়িয়ে গেল ওর। পা আপনা থেকেই থেমে গেল। মিতুল পিছন থেকে বলে উঠলো,
“যাব না আমি।”
জোহান দাঁড়িয়ে পড়লো। ভ্রু কুঁচকে পিছন ফিরলো।
“কী? একটু আগেই তো বললে যাবে। যাবে বলে এখন যাবে না কেন? অবশ্যই যেতে হবে তোমার।”
“অসম্ভব। আমার জান থাকতে আমি কিছুতেই পা মাড়াবো না ওদিকে। তুমি এত খারাপ জোহান! এই ছিল তোমার মনে মনে? ক্যাপিলানো সাসপেনশন ব্রিজ ঘোরাতে নিয়ে যাওয়ার মানে এবার বুঝতে পারলাম আমি। তুমি আমায় মার্ডার করতে চাইছো, তাই না?”
জোহানের কুঁচকানো ভ্রু এবার আরও বেশি কুঁচকে গেল।
“কী? কী বললে তুমি? আমি তোমাকে মার্ডার করতে চাইছি?”
“হ্যাঁ, তুমি আমাকে মার্ডার করতে চাইছো! তুমি কি ভেবেছো আমি কিছু জানি না? সব জানি আমি। তুমি কীভাবে ওই ভয়ংকর ব্রিজে আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতে পারো? সেখানে নিয়ে যাওয়ার কারণ কী হতে পারে আমাকে মার্ডার করা ছাড়া?”
“কীসব বকছো পাগলের মতো?”
“পাগল, পাগল করবে না একদম। কে পাগল? আমি? আমি যদি পাগল হই, তবে তুমি তো একটা ঠান্ডা মাথার খুনি। হ্যাঁ, তুমি একটা ঠান্ডা মাথার খুনি। তোমার কি ধারণা আমি কিছু জানি না ওই ব্রিজ সম্পর্কে? সব জানি আমি। আমার ভাইয়েরা আমায় সব বলেছে। ওই ব্রিজটি বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর ঝুলন্ত ব্রিজগুলোর মধ্যে একটি। ওই সেতুটি ঘন বনাঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত। এটি সবচেয়ে বিপজ্জনক হওয়ার কারণ হলো, এই সেতুটির পথ অনেক সংকীর্ণ এবং মানুষ হাঁটার সময় এটি কাঁপতে থাকে। ব্রিজে উঠে অনেক নিচের দূরত্বে ক্যাপিলানো রিভারের দিকে তাকালে, কিছুক্ষণের জন্য সবার হৃদয়েই ভয়ে কাঁপন ধরবে, এমনটা শোনা যায়। যাদের হাই ফোবিয়া আছে তাদের না ওঠাই ভালো ওই ব্রিজে, সে কথাও শোনা যায়। প্রাণ হাতে নিয়ে ওই ব্রিজ পাড়ি দিতে হয়, এমনটাও শোনা যায়। আমার ভাইয়েরা তো কানাডা আসার আগেই সাবধান করেছে আমায়, যাতে ওই ব্রিজে না যাই সেজন্য। এখন তুমিই বলো, তুমি যে আমাকে ওই ব্রিজে নিয়ে যেতে চাইছো, তুমি একটা ঠান্ডা মাথার খুনি ছাড়া আর কী হতে পারো?”
জোহান মিতুলের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে ওর সব কথা শুনছিল। মিতুলের কথা শেষ হলেই ফিক করে হেসে ফেললো জোহান। জোহানের এ হাসি যেই সেই হাসি নয়, অশান্ত হাসি ওর।
জোহানের হাসি দেখে মিতুলের রাগ আর ধরে না। মিতুল তেজি স্বরে বললো,
“হাসবে না বলছি। হাসবে না একদম। তুমি আসলে জেনে বুঝেই করেছো এসব। তুমি জানো যে, রাঙামাটির ওই ঝুলন্ত ব্রিজে উঠেই আমার বমি পর্যন্ত হয়ে যায়। আর এই ক্যাপিলানো সাসপেনশন ঝুলন্ত ব্রিজে উঠে ভয়ে আমার হার্ট অ্যাটাক পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে, এসব তো তুমি আগে থেকেই ধারণা করে রেখেছো। মনে মনে এ সব প্ল্যানই করা তোমার। মারতে চাও আমাকে, তাই না? যাতে আমি মরে যাই সেজন্যই ওখানে নিয়ে যেতে চাইছো আমাকে, তাই না?”
জোহান কোনো রকমে নিজের হাসি সামলিয়ে বললো,
“রেংঙামাটি? তুমি রেংঙামাটি ঝুলন্ত ব্রিজে গিয়ে কী করো, সে কথা আমি জানবো কীভাবে? আমি তো তোমার সাথে যাইনি সেখানে। আমি তো আমার কাজিনস, আঙ্কল, ব্রাদার, গ্রান্ডপ্যারেন্টস তাদের সাথে গিয়েছিলাম রেংঙামাটি ঝুলন্ত ব্রিজে।
আর রেংঙামাটি ব্রিজে উঠে তুমি বমি করে দিয়েছিলে? হেই মিতুল, তুমি এত ভীতু? বাহ! বাহ! এখন তো দেখছি বাংলাদেশি মেয়েদের সাহসিকতারও বড্ড অভাব। ওদের তো কোনো যোগ্যতাই নেই। ওহ না না, একটা যোগ্যতা আছে ওদের। ওরা হাত হলে পা বানিয়ে ফেলতে পারে নিমেষে। তার সাথে আবার আরও একটা যোগ্যতা এড হয়েছে, সেটা হলো ওরা প্রচুর ঝগড়াটে।”
জোহান যে সব ওকে মিন করে বলছে সেটা বুঝতে মিতুলের সময় লাগলো না। মিতুল কড়া গলায় বলে উঠলো,
“মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ! কাকে ঝগড়াটে বলছো তুমি? ভেবেছো কি কিছু বুঝি না? কোন এঙ্গেল থেকে আমাকে ঝগড়াটে মনে হয়? ঝগড়াটে কি আমি? ঝগড়াটে হলে তুমি। নাম্বার ওয়ান বিশ্ব ঝগড়াটে তুমি।
আর কথায় কথায় বাংলাদেশ টানো কোন সাহসে? একদিন না নিষেধ করে দিয়েছি কথায় কথায় বাংলাদেশ টানবে না একদম। বার বার বাংলাদেশ টেনে ইনিয়ে বিনিয়ে কথাগুলো কাকে বলো, সেটা কি আমি জানি না? বুঝি না কিছু? আমি কি ফিডার খাই? আমাকে কি তোমার শিশু মনে হয়?”
“ও আচ্ছা, তুমি শিশু নও? তা কত বয়স তোমার?”
মিতুল গর্বের সাথে বললো,
“একুশ। একুশ প্লাস আমি।”
জোহান একটু টেনে বললো,
“ওহ… একুশ? একুশ হওয়ার সাথে সাথেই দৌঁড়ে কানাডা চলে এসেছো?”
“কী? কী বললে তুমি? কী বোঝাতে চাইলে এই কথা দ্বারা? মানে তুমি কি অপমান ছাড়া কথা বলতে জানো না? কানাডা পা রাখার পর থেকেই দেখছি তুমি প্রত্যেক কথায় অপমান করো আমাকে। কথায় কথায় বাংলাদেশ টেনেও ইনিয়ে বিনিয়ে খোঁচা দিয়ে দিয়ে কথা বলো আমাকে। কেন? তুমি কি আদব কায়দা শেখোনি? মানুষের সাথে কীভাবে আচরণ করতে হয় কেউ শেখায়নি তোমাকে?”
রাগ ঝরে পড়ছে মিতুলের প্রত্যেকটি কথায়।
“শোনো, তোমার সাথে ঝগড়া করার মুড নেই আমার।”
“হ্যাঁ? কী? ঝগড়া করার মুড নেই? মাগো মা! কার মুখে কী শুনছি আমি? একটা বিশ্ব ঝগড়াটে বলছে তার না কি ঝগড়া করার মুড নেই! কোথায় যাব আমি?” মিতুল মুখ চেপে শ্লেষ পূর্ণ হেসে উঠলো।
জোহানকে তেমন প্রতিক্রিয়া করতে দেখা গেল না। ওকে দেখালো খুব শান্ত। শান্ত দৃষ্টি রেখেই এক ধাপ এগিয়ে এলো মিতুলের দিকে। মিতুলের হাসি থেমে গেল। চোখ পড়লো জোহানের ওই বাদামি চোখ পানে।
জোহান মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“হুম, আমি ঝগড়াটে। তুমিই বানিয়েছো। এটা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে এখন। এটা বোধহয় এই জীবনে আর আমার পিছু ছাড়বে না। সারাজীবন আমার ঝগড়া করেই যেতে হবে। আর আমার ঝগড়ায় সঙ্গ দেওয়ার জন্য তোমাকে থাকতে হবে সবসময় আমার সাথে। থাকবে তুমি?”
মিতুল অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,
“কী?”
জোহান কিছু বললো না। শুধু তাকিয়ে রইল।
মিতুল নিজেই ব্যাপারটা স্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টা করলো। বললো,
“দেখো, যাই করো না কেন আমি যাব না তোমার সাথে ওই ব্রিজ দেখতে। তোমার মরার শখ হলে তুমি একাই চলে যাও ওই ব্রিজে।”
বলে মিতুল রেশমী আন্টির কাছে ফেরত যাওয়ার জন্য আবার উল্টো পথে হাঁটা শুরু করলো। দ্রুত পা ফেলতে লাগলো। ক্ষণিকের জন্যও নিজের গতি থামালো না। যেমন ওর হাঁটার গতি দ্রুত, তেমনি দ্রুত ওর হৃদয়ের গতি। পায়ের গতির থেকেও ওর হৃদয়ের গতি বেশি দ্রুত। ওর হৃদয়ের এমন অস্বাভাবিক আচরণ সম্পর্কে ও জানে না। মাঝে মাঝে জোহান অস্বাভাবিক আচরণ করা শুরু করেছে, আর সেই সাথে ওর হৃদয়টাও। এই রকম চলতে দেবে না ও। নিজের অস্বাভাবিক হৃদয়কে স্বাভাবিক বানিয়ে ফেলবে আবার। আগে এডমন্টন ফিরে নিক। কার্লকে দেখার পরই সব ঠিক হয়ে যাবে। কার্লকে অনেক দিন না দেখার ফলে বোধহয় এমন হচ্ছে। কালকেই কার্লকে দেখতে যাবে।
(চলবে)
#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ২৩
____________
অচেনা মিষ্টি সুরে একটা পাখি ডাকছে। পাখিটা মিতুলের রুমের জানালার বাইরে বসে আছে। মিতুল গ্লাস উইন্ডো খুলে দিতেই, পাখিটা ডানা মেলে উড়ে গেল। মিতুলের কাছে বেশ লাগলো ব্যাপারটা। উইন্ডো খুলে দেওয়ায় সকালের সোনালী রোদের আভা জানালার পর্দা ভেদ করে রুমে ঢুকে খানিক জায়গায় নিজেদের বিস্তার ঘটিয়েছে। মিতুল জানালার পর্দা এক পাশে গুটিয়ে রাখলো। ওর ঘুম ভেঙ্গেছে মাত্র কিছুক্ষণ আগে। এরই মাঝে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। কালকে রাতের ফ্লাইটেই এডমন্টন ফিরেছে ওরা। আর সেই সাথে ফেলে এসেছে ভ্যাঙ্কুভারে ওর প্রিয় চেরি ব্লসমের রাজ্য। মিতুল লনের চেরি ব্লসম ট্রিগুলোর দিকে তাকালো। এই কদিনে যেন অনেক ফুল ঝরে পড়েছে। গাছের মাথাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। যদিও এখনও অনেক ফুলই আছে গাছে। তবে আগের মতো নেই। মিতুল জানালার দ্বার ছেড়ে ক্লোজেটের সামনে এসে দাঁড়ালো। ব্রেকফাস্ট সারার পরপরই কার্লের রেস্টুরেন্টে যাবে কার্লের সাথে দেখা করতে।
মিতুল ক্লোজেট খুললো। প্রথমেই চোখ চলে গেল লাল লেহেঙ্গার দিকে। এটা জোহান কিনে দিয়েছিল। পাঞ্জাবি বাজার থেকে।
মিতুল লেহেঙ্গার পাশে থাকা খয়েরি রঙের একটা টপস উঠিয়ে নিলো। সাথে নিলো একটা খয়েরি স্কার্ফ এবং সোয়েটার। কালো জিন্স পরবে সাথে। মিতুল সব কিছু এনে বিছানার উপর রাখলো। তারপর রুম থেকে বেরিয়ে গেল ব্রেকফাস্টের জন্য।
প্রথমে এলো কিচেনে। ক্যামিলা সাধারণত কিচেনেই থাকবে এই সময়। মিতুল ক্যামিলাকে ‘গুড মর্নিং’ জানালো। ক্যামিলাও হাসি মুখে গুড মর্নিং জানায়। ক্যামিলা আঙ্গুর আর আপেলের জুস বানাচ্ছে।
মিতুল জুস বানালো হলে ওর ব্রেকফাস্ট দিতে বললো ডাইনিং রুমে। ক্যামিলা বললো,
“কোথাও যাচ্ছ নাকি? আজকে হঠাৎ ব্রেকফাস্টের জন্য এত তাগিদ!”
ক্যামিলা কীভাবে যে ধরে ফেললো মিতুল জানে না। মিতুল বললো,
“হুম। আমার এক ফ্রেন্ডের সাথে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম না? ওই যে কার্ল নাম? ওর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।”
কার্লের নাম শুনে ক্যামিলা যেন খুশি হয়নি। কেমন গম্ভীর দেখালো তার মুখ। তবুও জোরপূর্বক একটু হেসে বললো,
“জোহান ঘুম থেকে উঠেছে?”
“ও উঠেছে কি না আমি জানবো কী করে? দেখিনি কোথাও।”
“তাহলে সম্ভবত ঘুমাচ্ছে। তুমি ডাইনিংএ যাও।”
মিতুল ডাইনিং রুমে চলে এলো। জায়িনকে বসা দেখে একটু হকচকিয়ে গেল। ভেবেছিল এত তাড়াতাড়ি বোধহয় কেউ ব্রেকফাস্ট করবে না, কেবল ও ছাড়া। কিন্তু না, জায়িনও আছে।
ভ্যাঙ্কুভার থেকে ফিরে জায়িনের সাথে ওর এই প্রথম দেখা। জায়িন মোবাইল ঘাটছিল। ও আসায় একটু চোখ তুলে তাকিয়ে আবারও মোবাইলে ডুব দিয়েছে। মিতুল জায়িনের সামনের চেয়ারটায় বসলো। ও জায়িনের সরু নাকটা দেখছে। কী অহংকার ওই নাকে! পৃথিবীর সকল অহংকারই যেন জায়িনের এই নাকে বসত গড়েছে। সরু নাকের অহংকারী ব্যক্তি!
মিতুল জায়িনের নাকের দিকে তাকিয়ে ছিল, এর মাঝে জায়িন তাকালো ওর দিকে।
মিতুল ঘাবড়ে গেল। অপ্রস্তুত ভাবে চোখ নামিয়ে ফেললো। নামিয়ে ফেলা চোখ তুলে আর সামনে তাকালো না। প্রথম চোখ ওঠালো জায়িনের কথা শুনে।
জায়িন বললো,
“ভ্যাঙ্কুভার ট্রিপ কেমন ছিল?”
মিতুল হেসে বললো,
“খুব ভালো ছিল। এই বসন্তে ভ্যাঙ্কুভার ট্রিপ খারাপ হবে এ তো হতেই পারে না। দারুণ ছিল। পার্কগুলো তো অপূর্ব। আর চেরি ব্লসমে ঘেরা রাস্তাগুলোর কথা কী আর বলবো…”
জায়িন একটু হাসলো। মিতুল ভালো করে তাকিয়ে দেখলো। হাসলে কিন্তু ভীষণ সুন্দরই দেখতে লাগে জায়িনকে। কিন্তু অহংকারীটার মুখে হাসি দেখা যায় না বললেই চলে। হাসলে কি আর নিজের অহংকার ধরে রাখতে পারবে?
“এরপর কোথায় ঘুরতে যাবে?”
“আগে এই এডমন্টন শহরটা ভালো করে ঘুরে নিই। তারপর অন্য জায়গায় ঘুরতে যাব আবার।”
“ভালো বুদ্ধি।”
মিতুল একটু থমকে গেল। জায়িন কি ওর প্রশংসা করলো? না কি কোনো ভাবে অপমান করলো?
_______________
জোহানের ঘুম ভাঙলো দুপুরের দিকে। এখনও শান্তিমতো ঘুম হয়নি ওর। ঘুম এখনও যেন অসম্পূর্ণ। জোহান অসম্পূর্ণ ঘুম নিয়েই রুম থেকে বের হলো। চোখে এখনও রাজ্যের ঘুম। গায়ের গেঞ্জির জায়গায় জায়গায় ভাঁজ। বাদামি চুলগুলো এলোমেলো, উস্কোখুস্কো। এক প্রকার চোখ বুজে বুজেই সিঁড়ি পার হয়ে হলরুমে নামলো।
রেশমী হলরুমে বসে ছিলেন। জোহানকে দেখেই বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে এলো তার। সে বিরক্ত ঝরা কণ্ঠেই বললো,
“উশৃঙ্খল ছেলে! ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতে পারো না? শুধরাবে কবে তুমি?”
মমের কথা জোহানের কানে এলো। কিন্তু গায়ে না মাখার ভাণ করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
দরজা অতিক্রম করে লনে নেমে কয়েক পা হেঁটে এসে, রোদ্দুর জড়ানো ঘাসের উপর শুয়ে পড়লো ধপাস করে।
নিজের চোখের সামনে জোহানকে পড়তে দেখে মিতুলের হৃদয় ছ্যাত করে উঠলো। গেটের কাছেই পা দুটো থমকে গেল ওর। কী হলো জোহানের? অজ্ঞান হয়ে গেল না কি? মিতুল ছুটে এলো জোহানের কাছে।
“এই জোহান, কী হয়েছে তোমার?”
জোহান কোনো সাড়া শব্দ করলো না।
মিতুলের সত্যিই ভয় লাগছে। জোহান শ্বাস নিচ্ছে কি না দেখার জন্য, মিতুল জোহানের নাকের কাছে দুই আঙ্গুল নিয়ে গেল চেক করার জন্য। অসাবধানতাবশত আঙ্গুল লেগে গেল একটু জোহানের নাকে। অমনি জোহান মিতুলের হাতটা ছিটকিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো। চোখ বুজেই বিরক্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“আহ! ডিস্টার্ব করছো কেন? এখানে এসে একটু শান্তিমতো শুয়েছি, তাও কি তোমার সহ্য হচ্ছে না? আমার সুখ কি তোমার দুই চোক্ষের বিষ?”
“ওহ…তার মানে তুমি নিজ থেকে এখানে শুয়েছো? আমি তো ভেবেছিলাম অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে গেছো! কিন্তু তুমি এত জায়গা থাকতে এখানে এসে শুয়েছো কেন?”
জোহান চোখ বুজে বুজেই কথা বললো,
“ভিটামিন। রোদের ভিটামিন জড়াচ্ছি গায়ে। জানো না যে সকালের রোদে ভিটামিন থাকে?”
জোহানের কথা শুনে তাজ্জ্বব বনে গেল মিতুল। এখন কি সকাল? এখন তো দুপুর! মিতুল বললো,
“সকালের রোদে ভিটামিন থাকে বৈ কি। কিন্তু দুপুরের রোদে থাকে না। দুপুরের রোদে যা থাকে, তা হলো উত্তাপ। এই উত্তাপ তোমার চেহারার বারোটা বাজিয়ে দেবে। নিজের এত রূপবতী মুখটা ঢেকে নিচ্ছ না কেন?”
বলে মিতুল নিজের গলা থেকে স্কার্ফটা খুলে জোহানের মুখে দিয়ে দিলো। তারপর যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। কিন্তু যেতে পারলো না।
জোহান মিতুলের এক পা টেনে ধরেছে। মিতুল একটুর জন্য পড়লো না।
জোহান মুখের উপর থেকে স্কার্ফ সরিয়ে মিতুলের দিকে তাকালো। মিতুলের মুখে মেকআপ। ঠোঁটে গাঢ় খয়েরি লিপস্টিক। আইলেশের জন্য চোখের পাঁপড়ি ঘন দেখাচ্ছে। জোহান মিতুলকে এক ঝলক দেখেই বুঝে গেল মিতুল এই মাত্র বাইরে থেকে এসেছে।
মিতুল জোহানকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো,
“হোয়াট?”
“কোথায় গিয়েছিলে?”
“কোথায় গিয়েছিলাম সেটা তোমাকে কেন বলবো? কে তুমি আমার?”
বলে মিতুল পা বাড়ালো। জোহান ওর পা টেনে ধরলো আবারও। মিতুল এবারও পড়তে পড়তে পড়লো না। কিন্তু ক্ষেপে গেল এবার।
“আরে, পা টেনে ধরছো কেন বার বার? এখানে পড়ে আমার কোমর ভেঙ্গে যাক সেটা চাইছো তুমি?”
“কার্লের কাছে গিয়েছিলে, তাই না?”
মিতুল হকচকিয়ে গেল। আশ্চর্য তো! কার্লের কাছে গিয়েছিল তা জোহান জানে কীভাবে?
মিতুল কথাটা অস্বীকার করে বললো,
“কার্লের কাছে যাব কেন আমি? যাওয়ার জায়গার অভাব পড়েছে না কি এডমন্টনে?”
জোহান কিছু বললো না। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে মিথ্যুক মিতুলকে দেখে চোখ বুজলো আবার। মিতুলের স্কার্ফটা আবার মুখের উপর দিয়ে বললো,
“গেট লস্ট!”
“তো তোমার কি ধারণা আমি দাঁড়িয়ে থাকবো এখানে?”
মিতুল দাপটের সাথে হেঁটে ঘরে চলে গেল।
জোহান মনে মনে শ্লেষাত্মক হেসে বললো,
“মিথ্যাবাদী মেয়ে!”
_____________
রাত এগারোটা।
কেউ একজন বাড়ির প্রবেশ দরজা ধাক্কাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন ডাকাত পড়েছে দরজায়।
হলরুমে বসে মনের সুখে নখ কাটছিল মিতুল। কিন্তু দরজা ধাক্কাতে থাকা অভদ্র মানুষটির জন্য ওর নখ কাটার বারোটা বাজলো। মিতুল নেইল কাটারটি রেখে দ্রুত দরজা খুলতে গেল।
দরজা খুলতেই বাজে একটা গন্ধ এসে নাকে ধাক্কা দিলো। সেই সাথে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি হেলে পড়লো মিতুলের গায়ে।
মিতুল আকস্মিক এমন ঘটনায় ভড়কে গেল। মানুষটাকে জোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। মানুষটা মিতুলের ধাক্কার তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল ছিটকে। মিতুল এতক্ষণ মানুষটার মুখ দেখার সুযোগ পায়নি। এখন দেখলো। জোহান!
জোহান নিজের কোমরে হাত দিয়ে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে বললো,
“মাই ওয়েস্ট…আহ্…মাই ওয়েস্ট!”
ভয়ে মিতুলের গলা শুকিয়ে গেল। কোমর কি ভেঙ্গে গেছে জোহানের? মিতুল দৌঁড়ে এলো জোহানের কাছে। ব্যস্ত হয়ে বললো,
“আর ইউ ও কে?”
জোহান পিট পিট করে চোখ মেলে তাকালো মিতুলের দিকে। জোহানের থেকে এখনও সেই গন্ধটা আসছে। মিতুল জানে এই গন্ধ কীসের। এই গন্ধর সাথে পরিচিত ও। জোহানের মাধ্যমেই। এই গন্ধ মদের। ইশ, আবারও মদ খেয়েছে জোহান?
জোহান বেশি পরিমাণ পান করেছে বলে প্রায় অর্ধ মাতাল। ওর চোখে মিতুলের চেহারাটা ধরা দিচ্ছে না ঠিক ঠাক ভাবে। অনেক দেখে অবশেষে কোনোরকম বুঝলো ওর সামনে মিতুল বসে আছে।
জোহান মিতুলের দিকে অঙ্গুলি করে জড়ানো কণ্ঠে বললো,
“ইউ তুলতুল! ইউ হার্ট মি?”
মিতুল কী করবে বুঝতে পারছে না। একটা মাতালের সাথে কী রকম আচরণ করা উচিত ওর? মিতুল বলে উঠলো,
“তুমি আবারও মদ খেয়েছো? তুমি এত নেশাখোর কেন বলো তো?”
“তুমিও খেতে চাও? ড্রিংকস করবে তুমি আমার সাথে? চলো, প্রতিযোগিতা করা যাক। দেখি কে বেশি ড্রিংকে পারদর্শী। তুলতুল না কি জোহান? চলো, শুরু করি।”
“তুমি নিজে তো খারাপ আছোই, এখন অন্য মানুষকেও খারাপ বানাতে চাও? কেন আমি তোমার সাথে মদ গিলবো? আমার মা, বাবা কি আমাকে কানাডা পাঠিয়েছে তোমার মতো নেশাখোর বানানোর জন্য?”
“হেই তুলতুল! কথা ঠিক করে বলো। আমি নেশাখোর নই। আমি হলাম সিঙ্গার। সিঙ্গার জোহান আহমেদ ওরফে জো। ‘জো’র মানে বুঝেছো তো? জো হলো জোহানের শর্ট ফর্ম। সবাই আমাকে ভালোবেসে জো বলে ডাকে। তুমিও ডাকো। কল মি ‘জো’।”
“মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ে আছো, আবোল তাবোল বকছো, আবার বলছো তুমি নেশাখোর নও?
কে ডাকে? কে ডাকে তোমাকে জো বলে? আমি তো কখনো শুনিনি কাউকে জো বলে ডাকতে। আমি কেন ডাকবো?”
“তুলতুল, তুমি আমাকে সন্দেহ করো? আমাকে তোমার মিথ্যাবাদী মনে হয়? তোমার ডাউট আছে কেউ আমাকে আসলেই জো বলে ডাকে কি না? এই জো কে তো তুমি কিছুতেই মিথ্যাবাদী প্রমাণ করতে পারবে না তুলতুল। আমাকে যে সত্যিই জো বলে ডাকা হয়, সে প্রমাণ আমি দেবো। জাস্ট ওয়েট।”
কথাগুলো বলে, এ পকেট ও পকেট হাতড়ে নিজের মোবাইল বের করলো জোহান। অগোছালো আঙ্গুলের স্পর্শে কতক্ষণ মোবাইলটাকে টিপলো। তারপর মোবাইলটা কানে ধরলো। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলে উঠলো,
“হেই জেমস, কল মি ‘জো’। জোরে আমাকে জো বলে ডাক। যাতে আশেপাশের সবাই শুনতে পারে। আমাকে জো ডেকে ডেকে দশটি সেনটেন্স বল। যেমন- হেই জো, তুমি ঘুম থেকে উঠেছো? জো, তুমি কি ব্রেকফাস্ট করোনি? এমন করে বল।”
জোহান জেমসকে আদেশ দিয়ে কান থেকে মোবাইল সরিয়ে এনে মিতুলের উদ্দেশ্যে বললো,
“তোমার জন্য এখন লাউড বাড়িয়ে দেবো আমি। শোনো ও এখন জো বলে ডাকবে আমাকে।”
বলেই জোহান লাউড স্পিকারে দিলো ফোন।
মিতুল শুনতে পেল জেমস বলছে,
“জো, জো, আমার কথা শোন। সোজা নিজের রুমে চলে যা। সময় নিয়ে হালকা গরম পানির লম্বা একটা শাওয়ার নে। তারপর গ্রীন টি পান কর। এরপর সুন্দর একটা ঘুম। হ্যাংওভার কেটে গেলে আবার কথা হবে তোর সাথে। আমি এখন ব্যস্ত। সারাদের এখানে আছি। আজকে ওর ফ্যামিলির সাথে ডিনার। রাখছি। কথা হবে পরে।”
জেমস ফোন রাখতেই জোহান বললো,
“দেখলে তো তুলতুল, আমাকে জো বলে ডেকেছে। আমি তোমার মতো মিথ্যাবাদী নই। সত্যি কথা বলি আমি।”
মিতুলের একটু রাগ হলো। বললো,
“আমি মিথ্যাবাদী হলাম কীভাবে? কী মিথ্যা কথা বলেছি আমি?”
“নিজেই নিজের হিসাব খুলে বসো। সব পেয়ে যাবে।”
মিতুলের রাগ চড়াও হলো আরও।
“বাজে বকো না জোহান। মাতাল হয়ে যা তা বললেই কি আমি মেনে নেবো? তুমি মাতাল হয়ে আমাকে মিথ্যাবাদী বললেই আমি মিথ্যাবাদী হয়ে যাব না। তুমি কিন্তু…”
হঠাৎ করে লিভিং রুমে চোখ পড়তেই থেমে গেল মিতুল। কখন থেকে ক্যামিলা ওখানে দাঁড়িয়ে আছে জানা নেই ওর। মিতুল বললো,
“ক্যামিলা, ওকে নিয়ে ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে রাখো কতক্ষণ। তাহলেই দেখবে ওর সকল হ্যাংওভার কেটে গেছে।”
ক্যামিলা একটু হাসলো। তার বেশ ভালোই লাগে জোহান মিতুলের এমন খুনশুটি।
ক্যামিলার কথা কানে আসতেই জোহান একটা উল্টি দিয়ে দরজার দিকে মুখ করলো। দেখতে পাচ্ছে এখন ক্যামিলাকে। জোহান একটু উচ্চঃস্বরে বলার চেষ্টা করলো,
“সিস, তোমাকে বলেছিলাম না তুলতুল একটা সাংঘাতিক মেয়ে? দেখো ওর দিকে। কেমন হার্ট করে কথা বলে আমাকে। তুমি ওকে নিষেধ করো। ওকে বলে দাও আমার…”
পুরো কথা শেষ না করেই থেমে গেল জোহান। একেবারে চুপ হয়ে গেল।
মিতুল চোখ পিট পিট করে তাকাচ্ছে জোহানের দিকে। কী বলে দিতে বলছে জোহান?
ক্যামিলা হাতের কফির মগ দুটো টি টেবিলে রেখে, জোহানের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
“কী হলো জোহান? থামলে কেন? বলো। বলো, আমি কী বলে দেবো মিতুলকে? বলছো না কেন? বলে দাও।”
জোহান ও বিষয়ে মুখ খুললো না আর। দুই পাশে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“নাথিং।”
ক্যামিলা জোহানের কাছে এগিয়ে এসে বললো,
“চলো। তোমাকে তোমার রুমে নিয়ে যাই।”
জোহান আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বললো,
“এটাই তো আমার রুম।”
তারপর হলরুমের সোফা দেখিয়ে বললো,
“ওই তো আমার রুমের কাউচ। আমি তো ওখানেই ঘুমাই।”
মিতুল জোহানের দিকে তাকিয়ে আছে। জোহান কী বলছে এসব?
জোহান এদিক ওদিক তাকিয়ে কী যেন খুঁজলো। তারপর বললো,
“কিন্তু আমার গিটার? আমার গিটার কোথায় সিস? মম নিয়ে গেছে আবার? মম আমার সাথে এমন করে কেন? মমকে নিষেধ করো আমার সাথে এমন করতে! আমার সাথে এমন করা উচিত নয় তার!”
জোহান এ পর্যন্ত বলেই থেমে গেল। আর কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না ওর।
ক্যামিলা দেখলো জোহানের চোখের কোণ বেয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ছে। ক্যামিলা ডাকলো জোহানকে।
কিন্তু না, আর কোনো সাড়া পাওয়া গেল না জোহানের।
(চলবে)