চেরি ব্লসমের সাথে এক সন্ধ্যা পর্ব-৫৭+৫৮

0
376

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৫৭
____________

ঘুমের রেশ কেটে যেতেই মিতুল বুঝতে পারলো, ওর ধারণা ভুল। নাকে ভেসে আসছে চেনা মিষ্টি পারফিউমের ঘ্রাণ। আতঙ্কিত দৃষ্টি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলো তাই। কেটে গেল আতঙ্ক। ভুল ভেবেছিল! এটা জায়িন নয়, জোহান! দুশ্চিন্তা, আর হঠাৎ ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার কারণে জোহানকে জায়িন ভেবে ভুল করেছিল। রুমে ড্রিম লাইট জ্বালানো, ঘুটঘুটে অন্ধকার পরিত্রাণ করে ঝাপসা অন্ধকার ছড়ানো। ঝাপসা অন্ধকারেও ওর চিনতে অসুবিধা হলো না, ওখানে ঠিক জোহানই দাঁড়িয়ে আছে। মিতুলের মুখ থেকে মায়া জড়ানো কণ্ঠে বেরিয়ে এলো,
“জোহান!”

মিতুল দ্রুত বেড থেকে নেমে সাইড টেবিলের ল্যাম্পশেড জ্বালালো। ল্যাম্পশেডের হলুদাভাব আলোয় জোহানের মুখটি দেখতে পাওয়া গেল এবার।

“কোথায় ছিলে তুমি? কত টেনশনে ছিলাম জানো? ফোন দিলাম, ম্যাসেজ পাঠালাম অথচ কোনো রেসপন্স করলে না। কোথায় ছিলে এতক্ষণ?”

জোহান কোনো উত্তর দিলো না।

“বাড়িতে ঢুকলে কীভাবে? বাড়ির গেট তো এখন বন্ধ থাকার কথা।”

জোহান এবার বললো,
“রিল্যাক্স! চোরের মতো উপর থেকে গেট টপকে বাড়িতে প্রবেশ করিনি। তোমার বিগ ব্রো’র কাছে কল দিয়ে গেট খোলার ব্যবস্থা করিয়েছি। তারপর এসেছি। তোমার রুমে যে এলাম, এটাও তোমার ব্রো’র পারমিশন নিয়ে।”

“সেটা না হয় বুঝলাম, কিন্তু এতক্ষণ বাইরে কোথায় ছিলে? কল রিসিভ করছিলে না কেন?”
মিতুলের গলায় উৎকণ্ঠা।

“তোমাদের এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আশেপাশে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করেছি, তারপর দাদা বাড়ি গিয়েছিলাম।”

“দাদা বাড়ি?”

“হুম। কিছুক্ষণ সেখানে কাটিয়ে আবার চলে এলাম। তবে সেখান থেকে একটা জিনিস নিয়ে এসেছি তোমার জন্য। দাদা বাড়িতে মূলত এটা আনতেই গিয়েছিলাম।”

“কী জিনিস?”

জোহান মুঠোবন্ধি হাতটা মিতুলের সামনে খুলে বললো,
“এটা।”

জোহানের হাতের দিকে তাকিয়ে মিতুলের ভ্রু কুঁচকে গেল,
“এগুলো কী?”

“জানতাম তোমার চিনতে একটু অসুবিধা হবে। এগুলো হলো, চেরি ব্লসম!”

চেরি ব্লসম শুনে মিতুলের দৃষ্টি জোহানের হাত থেকে মুখে চলে গেল। তবে বেশি সময়ের জন্য সেখানে দৃষ্টি স্থির রাখলো না। আবারও চোখ ফিরে এলো জোহানের হাতের উপর। জোহানের হাতে চেরির পাপড়ি দেখে মিতুল আবেগে আপ্লুত হয়ে গেল।
জোহানের হাত থেকে পাপড়িগুলো নিজের হাতে নিয়ে এলো। পাপড়িগুলো শুকিয়ে একেবারে চুপসে গেছে। দেখে বোঝার উপায় নেই এগুলো ঠিক কী। জোহান কানাডা থেকে ওর জন্য চেরি ব্লসম নিয়ে এসেছে? আনন্দ এবং ভালোবাসা দুই মিলে চোখে পানি এসে গেল মিতুলের।

মিতুলের চোখে পানি দেখে জোহানের হলো অন্য আশঙ্কা। সে ব্যস্ত ভাবে মিতুলকে বোঝানোর চেষ্টা করলো,
“এই না না মিতুল, আমি তোমাকে অপমান করার চেষ্টা করছি না। আসলে আমি এগুলো তরতাজা তোমার হাতে তুলে দিতে চাইছিলাম, কিন্তু কানাডা থেকে আসতে আসতে এগুলো শুকিয়ে গেছে! আমি কী করবো?
এটা আমার তোমাকে দিতে চাওয়া সেকেন্ড সারপ্রাইজ ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ ফিরে যখন দেখলাম পাপড়িগুলো শুকিয়ে গেছে, তখন সারপ্রাইজটা ক্যানসেল করে ছিলাম।
আমি এই শুকনো চেরি পাপড়ি দিতে চাইনি তোমাকে। তবুও হুট করে আজকে মনে হলো এগুলো তোমাকে দিই, তাই…”
জোহান সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে পারলো না। কথার মাঝেই মিতুল জড়িয়ে ধরলো ওকে। আকস্মিক এমন ঘটনায় জোহানের কণ্ঠ নিজ থেকেই থেমে গেল। থমকে গেল জোহান।

মিতুল যেই ক্ষণের অপেক্ষায় ছিল, সেই ক্ষণ এখনও আসেনি। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে কিছুতেই ধরে রাখতে পারলো না নিজেকে। মিতুল জোহানের বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। বললো,
“সময়টা এত কঠিন যাচ্ছে কেন জোহান? কী ভুল আমাদের?”

_________________

রেশমী খবর পেলেন জোহান কাল গভীর রাতে ফিরে এসেছে। খবরটা পেয়েছে মিলানের কাছ থেকে। এত রাত অবধি কোথায় ছিল জোহান?
রেশমী জোহানের রুমে ছুটে আসেন। দরজা আনলক ছিল। ঢুকে পড়লেন তিনি। জোহান ঘুমে বিভোর। তিনি ডাকলেন,
“জোহান!”

জোহান জাগলো না।
রেশমী একটু জোরেই ডেকে উঠলো এবার,
“জোহান!”

জোহানের বন্ধ চোখের পাপড়ি কম্পিত হয়ে খুলে গেল। চোখে ঝাপসা করে মমের মুখটা স্পষ্ট হয়ে উঠলো ধীরে ধীরে। জোহান উঠে বসলো। দুই হাতে আলতো করে চোখ ডলে ঘুম নিবারণের চেষ্টা করলো।

“রাতে কোথায় ছিলে? ফোন দিলাম ফোন ধরলে না কেন তুমি? তোমার দাদা বাড়ি ফোন দিয়ে জানলাম তুমি সেখানে যাওনি। তোমার মামার কাছে কল দিলাম, সেও জানালো তুমি তাদের ওখানে যাওনি! তাহলে কোথায় ছিলে?”
অশান্ত ভাবে জানতে চাইলো রেশমী।

জোহান ধীর কণ্ঠে বললো,
“দাদা বাড়িতে ছিলাম। তুমি যখন ফোন করেছিলে, তার কিছুক্ষণ পর গিয়েছিলাম ওখানে।”

“তো, তুমি ফোন করে জানাবে না সেটা? এমনিতেই বাংলা জানো না, বাংলাদেশ এসে একা একা চলতে পারো না, কোন সাহসে তুমি ওরকম ভাবে বেরিয়ে গেলে বাইরে? ফারদার এমন কাজ কখনো করবে না। বাংলাদেশ থাকাকালীন কোথাও গেলে অবশ্যই আমাকে জানিয়ে যাবে। বুঝেছো?”

জোহান মায়ের কথায় সম্মতি দিয়ে বললো,
“ইয়াহ।”

রেশমী জোহানের সাথে এখন অন্য কোনো ব্যাপারে কথা বলতে চাইছেন না। এমনিতেই গভীর রাতে ফিরে এসেছে জোহান। এখন ওই ব্যাপারে কথা বলাটা ঠিক হবে না। রেশমী বললেন,
“ঠিক আছে ফ্রেশ হও। আমি যাচ্ছি।”

রেশমী রুমে ফিরে একবার স্বামীর কাছে কল দিলেন। সাদাতকে এখনও জানানো হয়নি বিষয়টি। কালকে রাতে যে কল দিয়ে জানাবে সেই মেজাজে ছিল না সে। এখন বাংলাদেশে সকাল সাতটা। কানাডাতে এর বিপরীত। কানাডাতে এখন বিকেল।
সাদাত কল রিসিভ করতেই রেশমী অন্য কোনো কথা না বলে, সোজা বললেন,
“তোমার ছেলে খুব বাড় বেড়ে গেছে সাদাত। ইতোমধ্যে অনেক ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে ও। এখানে এসে কী কী করেছে তা তোমার ধারণার বাইরে। আমি তো এটা কল্পনাও করতে পারিনি। এমন কিছু হতে পারে আশা করতে পারিনি আমি।”

সাদাত বুঝতে পারলেন রেশমী জোহানকে নিয়ে বলছে। তিনি একটু চিন্তিত বোধ করলেন।
“কী করেছে জোহান?”

রেশমী সব খুলে বললেন সাদাতকে।
সব শুনে সাদাত বললেন,
“জায়িনের সাথে মিতুলের বিয়েটা ওদের না জানিয়ে ঠিক করা হয়েছে। যেহেতু ওরা জানতো না, সুতরাং এই না জানার কারণে মধ্য থেকে জোহান এবং মিতুলের মাঝে রিলেশন তৈরি হওয়ার ব্যাপারটা অস্বাভাবিক কিছু না। এটা ভুল কোনো বিষয় নয়।”

স্বামীর কথা শুনে রেশমীর মেজাজ কিছুটা খারাপ হয়ে গেল। তিনি এই কথা আশা করেননি স্বামীর থেকে। তবুও তিনি নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললেন,
“এটা ভুল কোনো বিষয় নয়? ঠিক আছে, ধরলাম জোহান, মিতুলের মাঝের রিলেশন তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু এই স্বাভাবিক ব্যাপারটা যে সবকিছু অস্বাভাবিক করে তুলছে, সেটার কী করবে? কীভাবে সামাল দেবে এটা?”

“যেখানে তোমার ছোট ছেলের সাথে রিলেশন ছিল, সেই মেয়েকে তো তুমি নিজের বড়ো ছেলের সাথে বিয়ে দিতে পারো না। এটা বেমানান! যেখানে জোহান, মিতুল দুজনই অমত পোষণ করেছে এই বিয়েতে, সেখানে তুমি যদি এখনও এই বিয়ে নিয়ে ভাবো, তাহলে সেটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত হবে আমি বুঝতে পারছি না। আর ধরলাম জোহান, মিতুলের কথাকে প্রধান্য না দিয়ে আমরা বিয়েটা জায়িনের সাথেই দিয়ে দিলাম। এরপর কী হবে ভেবে দেখেছো? জায়িন এবং জোহানের মাঝে সম্পর্কটা কেমন হয়ে যাবে?
মিতুলের আর জায়িনের মাঝের সম্পর্কটাও বা কেমন হবে? দুজনের স্বাভাবিক সংসার হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে?
এক জায়গা, একই বাড়ি, এক সাথে থাকা, সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাবে। আমি তো মনে করি এতকিছুর পর জায়িন এবং মিতুলের বিয়ে নিয়ে ভাবাটা ভুল ছাড়া আর কিছুই নয়।”

রেশমী নিজের রাগ প্রকাশ করেই ফেললেন,
“ও এটা ভুল? আর বড়ো ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করে ছোট ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়া, সেটা খুব সঠিক, তাই না?”

“হ্যাঁ, এটা সঠিক। জায়িনের সাথে মিতুলের বিয়ের ব্যাপারটা অতটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। জোহান আর মিতুলের ব্যাপারটাই এখন গুরুত্বপূর্ণ। এরকম অনেক আছে। বিয়ের কথা হয়েও, বিয়ে হয় না। অনেক সময় তো এমনও হয় যে এনগেজমেন্টের পরও বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে যায়। আর এখানে তো জায়িন এবং মিতুলের এনগেজও হয়নি। তাহলে এই বিয়েটা ভাঙতে কী সমস্যা? জায়িনের সাথে মিতুলের বিয়ে হওয়াটা কি তুমি সঠিক ভাবছো?”

“হ্যাঁ, ভাবছি। যদি জায়িনের সাথে মিতুলের বিয়ে না হয়, তাহলে মান সম্মান কিছু থাকবে না। যেখানে বড়ো ছেলের সাথে বিয়ের কথা হয়েছে, সেখানে ছোট ছেলের বিয়ে দেওয়াটা আমার পক্ষে অসম্ভব!”

“অবুঝের মতো কথা বলছো কেন রেশমী?জোহান, মিতুল একে অপরকে ভালোবাসে, এখানে ওদের বিয়ে দেওয়াটাই তো শ্রেয়। এখানে অসম্ভবের কী আছে? আর মান সম্মানের কথাই বা উঠছে কেন এখানে? এটা তো আমরা আমরাই। মিতুলকে তো তুমি পুত্রবধূ করে আনছোই। হয়তো কথা ছিল বড়ো ছেলের বউ করে আনবে, কিন্তু পরিস্থিতি এখন অন্য দেখে ছোট ছেলের বউ করে আনতে হবে। এটাই তো? এতে মান সম্মান না থাকার তো কিছু দেখছি না আমি।”

রেশমীর মেজাজ এবার চরম খারাপ হলো,
“আমার বোঝা উচিত ছিল তুমি এমন কিছু বলবে। বরাবরই তুমি এমন। তবুও আশা করেছিলাম এবারের কথাগুলো তোমার ভিন্ন হবে। কিন্তু হলো না। তুমি ঠিক আগের মতোই আছো। তোমার চোখে হয়তো মান সম্মান না থাকার মতো কিছু ধরা পড়ছে না, কিন্তু আমার চোখে পড়ছে। যেখানে বড়ো ছেলের বিয়ের সম্বন্ধ করেছি, সেখানে ছোট ছেলের বিয়ে দেওয়াটাই মান সম্মান না থাকার কারণ। এটা আমি কিছুতেই মানতে পারছি না। আমি মিতুলকে পছন্দ করে রেখেছি জায়িনের জন্য। জোহানের সাথে বিয়ে দেওয়াটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আর তাছাড়া তোমার ওই উগ্র ছেলের সাথে কে মেয়ে বিয়ে দেবে? শাসন তো করো না ছেলেকে। মাহিরার সাথে কাল কথা হয়েছে আমার। মাহিরা জানিয়ে দিয়েছে, যদি জায়িনের সাথে আমরা মিতুলের বিয়ে দিতে চাই, তাহলে ওর আপত্তি নেই। কিন্তু জায়িনের সাথে যদি বিয়ে না হয়, তাহলে জোহানের কথাও ভাববে না তারা। অন্য জায়গায় মেয়ে বিয়ে দেবে। মাহিরা একেবারে সরাসরি কথাগুলো বলেছে আমাকে। এমন একটা ঘটনার পর যদি জায়িনের সাথে মিতুলের বিয়েটা না হয় তাহলে কী হবে বুঝছো? আমাদের সাথে মাহিরাদের সম্পর্ক ঠুনকো হয়ে যাবে। যেটা আমি একেবারেই চাই না। মাহিরা আমার খুব আপন একজন মানুষ। সেই ছোট থেকে এখন পর্যন্ত ওর সাথে আমার সম্পর্কটা জোরালোই আছে। অনেক ক্লোজ আমরা। এমন একটা বিষয়ের জন্য আমি ওর সাথে সম্পর্ক ঠুনকো করতে পারব না। ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়ে সম্পর্ক আরও জোরালো করতে চাইছিলাম। কিন্তু এখন বিয়ে না হলে সম্পর্ক জোরালোর বদলে একেবারেই ঠুনকো হয়ে যাবে।”

ফোনের অপ্রান্তে সাদাতও খুব রেগে আছেন। তিনি রুড ভাবেই জিজ্ঞেস করলেন,
“তাহলে কী করতে চাও তুমি?”

“আমি মিতুলকে জায়িনের বউ করেই ঘরে তুলতে চাই।”

“এটা পাগলামি রেশমী!” সাদাতের গলা কঠিন।

“কোনো পাগলামি নয়। এটাই সবচেয়ে সহজ সমাধান। ওদের বিয়ে হয়ে গেলে, মিতুল এবং জোহানের মাঝে প্রেম, ভালোবাসা বলে কিছু থাকবে না। ওসব ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে। এমনও অনেক ঘটনা আছে। বিয়ের আগে প্রেম থাকে একজনের সাথে, এবং বিয়ে হয় অন্য কারো সাথে। এটা স্বাভাবিক। তেমন কোনো ব্যপার নয় এটা।”

“কিন্তু মিতুলের যার সাথে প্রেম সে তোমারই ছোট ছেলে রেশমী। বিয়ের পর মিতুল সেখানে গিয়েই থাকবে, যেখানে জোহান থাকে।”

“ওটা কোনো ব্যাপার নয়। দরকার হলে আমি জোহানেরও দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেবো। বউ রেখে নিশ্চয়ই মিতুলের জন্য ভালোবাসা পুষে রাখবে না।”

“তুমি এত কিছু ভাবতে পারছো অথচ, জোহানের সাথে মিতুলের বিয়ে, এই সহজ বিষয়টা ভাবতে পারছো না? তুমি আগে নাহিদ ভাইদের কাছে বলে দেখো জোহান আর মিতুলের বিয়ের কথা। তারপর…”
সাদাতের বলার মাঝেই রেশমী কল কেটে দিলেন। স্বামীর এই অহেতুক কথা শুনতে ভালো লাগছে না তার।

জোহান মমের রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে। ভেবেছিল মম হয়তো একটু নরম হয়েছে। ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখে বুঝতে পেরেছে আসলে কোনটা ঠিক। কিন্তু না, ওর ধারণা ভুল! মম আগের চিন্তাতেই আছে। ব্রাদার এবং মিতুলের বিয়ে নিয়ে! যদিও জোহান মমের সব কথা বুঝতে পারেনি। মমের কথা বাংলা, ইংলিশ মিলিয়ে ছিল। ইংলিশ টুকুই বুঝেছে শুধু। আর তাতেই বুঝতে পেরে গেছে। জোহান চোখ বন্ধ করে কষ্ট হজম করে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করলো। তারপর ভেজানো দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো।

“কী সিদ্ধান্ত নিলে?” মমের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লো জোহান।

__________________

দীর্ঘ একটা রাত ধরে ভেবে চিন্তে মা-আব্বু সুন্দর একটা সমাধান বের করবে সেটাই ভেবেছিল মিতুল। আর সেই সুন্দর সমাধানটা হবে, ওর এবং জোহানের বিয়ে। এটাই ভেবেছিল ও। কিন্তু ওর ভাবনায় গুড়ে বালি। সকাল হতেও সেই আগের গানই চলছে। জায়িনের সাথেই বিয়ে হবে ওর। নয়তো জায়িন, জোহান কারো সাথেই নয়। তবে জায়িনের সাথে বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ এই বিয়েটা না হলে না কি দুই ফ্যামিলির মাঝে সম্পর্ক ঠুনকো হয়ে যাবে। যেটা এক ফ্যামিলিও চায় না। মিতুল বুঝতে পারলো ওর মা-আব্বুকে বুঝিয়ে পারবে না ও। অন্য কোনো পথ ধরতে হবে ওর। আর এই অন্য পথটা হবে জায়িন। জায়িনকে ও এখন পর্যন্ত কোনো কিছু নিয়ে মাথা ঘামাতে দেখেনি। জায়িনের সাথে ওর বিয়ে নিয়ে এত কিছু চলছে, অথচ জায়িনকে একটা বাক্যও বলতে দেখেনি। যেন একটা রোবট। কোনো কিছুই গায় লাগে না তার। অহংকারী একটা! এই অহংকারীটাকে বিয়ে করা তো ইম্পসিবল। মিতুল মনে মনে ঠিক করলো জায়িনকে বোঝাবে ও। জায়িন যদি বিয়েতে না করে দেয় তাহলে তো এই বিয়ে হওয়া সম্ভব নয়। জায়িন অহংকারী হলেও বুঝদার। বুঝবে নিশ্চয়ই। চোখের সামনে এতকিছু দেখেছে, বোঝাই তো উচিত।

মিতুল আর সময় নষ্ট না করে জায়িনের নিকটে এলো। রুমের দরজা অর্ধ ভেজানো। মিতুল নক করে বললো,
“আসবো?”

জায়িন ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত ছিল, মিতুলের কণ্ঠ শুনে একবার চোখ তুলে তাকালো। কেমন ভাবলেশহীন ভাবে বললো,
“এসো।”

মিতুল রুমে ঢুকলো। জায়িন নিজের ল্যাপটপ রাখলো না। একটা মানুষ এসেছে তার কাছে, তার তো উচিত ল্যাপটপ রেখে এই মানুষটির উপর মনোনিবেশ করা। কিন্তু না, সে ল্যাপটপ নিয়েই বসে আছে। রাগী মাথায় আরও একটু রাগ ভর করলো। তবে প্রকাশ করলো না। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
“তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।”

জায়িন ল্যাপটপের দিকে দৃষ্টি রেখেই বললো,
“হুম, বলো।”

“আমি যা বলবো তার জন্য এরকম পরিবেশ মানানসই নয়। তুমি আমার সাথে বাইরে কোথাও যেতে পারবে?”

জায়িন আগের মতো ল্যাপটপে চোখ রেখেই উত্তর দিলো,
“দুঃখিত! আমার কিছু কাজ আছে। তোমার সাথে যেতে পারছি না।”

জায়িনের কথা শুনে মিতুলের রাগ চড়াও হলো। ওর ইচ্ছা করলো একটা ঘুষি মারে জায়িনকে। এই ইচ্ছা যে ওর ইহজনমে পূর্ণ হবে না সেটা খুব করেই জানে। তারপরও এমন ইচ্ছা হলো ওর। মানুষের ইচ্ছা কি আর বাধ মানে?
মিতুল রাগ দমিয়ে রেখে যথা সম্ভব মৃদু, নরম কণ্ঠে বললো,
“বেশি সময় নেবো না আমি। এখান থেকে যেতে আসতে আট মিনিটের মতো। আর যা বলবো তা মিলিয়ে মাত্র বিশ মিনিটের মতো লাগবে। এই বিশ মিনিট সময়টা দিতে কি খুব বেশি অসুবিধা হবে তোমার?”

জায়িন নিজের ল্যাপটপ বন্ধ করে, মিতুলের দিকে তাকালো। বললো,
“কোথায় নিয়ে যাবে?”

“কাছেই একটা কফিশপে যেতাম।”

“আমার মনে হয়, কফিশপ নয়। কোনো ভালো রেস্টুরেন্টে যাওয়া উচিত আমাদের। কালকে রাতে কিছু খাওনি, আজকে সকালেও ব্রেকফাস্ট করতে দেখা গেল না তোমাকে, কিছু খাওয়া উচিত তোমার।”

মিতুলের মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেল জায়িনের কথা শুনে। ভিতরে রাগ থাকলেও মুখে জোরপূর্বক একটু হাসি ফোঁটাতে হলো ভদ্রতা স্বরূপ। বললো,
“ঠিক আছে, কোনো রেস্টুরেন্টেই যাব আমরা। এখন রেডি হলেই ভালো হয়। দ্রুত বেরিয়ে পড়তাম তাহলে। দশটা বাজে, আর দেরি করা ঠিক হবে না।”

জায়িন সায় দিলো,
“ওকে। এখনই রেডি হচ্ছি।”

মিতুল মুখে আরেকটু বাধ্য হাসি ফুঁটিয়ে চলে গেল।

জায়িনের কথা মতো একটা রেস্টুরেন্টে এলো ওরা। ও খাবে না কিছু, তারপরও অনেক কিছু অর্ডার করলো। অতিথি নিয়ে এসেছে কিছু অর্ডার না করে তো পারা যায় না। আর রেস্টুরেন্টে এসে কিছু অর্ডার না করে বসে থাকা কি মুখের কথা?
ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে গেলে জায়িন বললো,
“হ্যাঁ, এবার বলো। কী বলতে চাও?”

মিতুলের জায়িনকে কথাটা বলতে কেমন যেন লাগছে, তারপরও বললো,
“দেখো তুমি শিক্ষিত একটা ছেলে! তোমার ফ্যামিলির বাকিরাও শিক্ষিত। আমাদের ফ্যামিলির মানুষ জনও শিক্ষিত, তবে তারা শিক্ষিত হয়েও ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছে না। আমার বিশ্বাস তারা না বুঝলেও, তুমি বুঝবে ব্যাপারটা।”
মিতুল এইটুকু বলে একটু থামলো। জায়িনের ভাব ভঙ্গি দেখে নিলো একবার। একবারে স্বাভাবিক জায়িন। মিতুল আবার বলতে শুরু করলো,
“আমাদের ফ্যামিলির মানুষজন চাইছে তোমার সাথে আমার বিয়ে হোক। যেটা আমি মোটেই চাইছি না। আমি চাই না তোমার সাথে আমার বিয়ে হোক। কারণ, আমি তোমার ভাইকে ভালোবাসি। আমি ওকে খুব বেশিই ভালোবাসি!”

জায়িন নীরবে শুনে যেতে লাগলো মিতুলের কথা। এর মাঝে ওয়েটার এসে খাবার দিয়ে গেছে।

মিতুল বলে চলেছে,
“জোহান এবং আমি রিলেশনে আছি এটা জোহান সবার সামনেই বলে দিয়েছে। তুমিও শুনেছো এটা। সবাই শোনার পরও এটাকে গুরুত্ব সহিত দেখছে না, দেখলেও মানছে না। তারা তোমার সাথেই আমার বিয়ের কথাবার্তা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছে। আমি চাই তুমি এই ব্যাপারটা তাদের একটু বুঝিয়ে বলো। শুধু রেশমী আন্টিকে বুঝিয়ে বললেই হয়। তাকে বুঝিয়ে বললেই, সে আবার আমার মা-আব্বুকেও বুঝিয়ে বলতো।
তুমি রেশমী আন্টির খুব আদরের। তুমি বুঝিয়ে বললে নিশ্চয়ই সে শুনবে। তুমি শুধু রেশমী আন্টিকে এটাই বুঝিয়ে বলবে যে, আমি জোহানকে ভালোবাসি। আর তাই তোমাকে বিয়ে করা অসম্ভব আমার পক্ষে। আমিও জোহানকে ভালোবাসি, জোহানও আমাকে ভালোবাসে। সুতরাং তোমার সাথে নয়, আমার বিয়েটা ঠিক জোহানের সাথে হওয়া উচিত…”

মিতুল আরও কিছু বলতে চাইছিল। এর মাঝে জায়িন বলে উঠলো,
“তার মানে এই বিয়েটা ভাঙতে হবে আমার?”

“ঠিক ভাঙা নয়, তুমি শুধু রেশমী আন্টিকে বুঝিয়ে বলবে এটা। তাহলেই…”

মিতুলের কথা শেষ হওয়ার আগেই জায়িন দাঁড়িয়ে গেল,
“স্যরি মিতুল, আমি এটা পারবো না। মমের অবাধ্য হতে কিছুতেই পারব না আমি। তুমি যদি এই বিয়েটা ভাঙতে চাও, তবে নিজেই বুঝে নাও সেটা। আমার পক্ষে মমের অবাধ্য হওয়া সম্ভব নয়।”

বলে জায়িন যাওয়ার জন্য এক পা বাড়ালো, মিতুল বলে উঠলো,
“আমার পক্ষেও সম্ভব নয় তোমাকে বিয়ে করা। একেবারেই সম্ভব নয় এটা।
আমি কারো কারো কাছে খানিক বোকা হতে পারি, আবার কারো কারো কাছে পুরোটাই বোকা! কিন্তু শুনে রাখো, আমি বেইমান নই। সবার কাছ থেকে বোকা উপাধি পেলেও, বেইমান হিসেবে একটা মানুষের কাছেও পরিচিত হবো না। আমি বেইমান, স্বার্থপর নই। ভালোবাসতে জানি আমি। খুব করে ভালোবাসতে জানি। আমি জোহানকে ভালোবেসেছি, আর ওর সাথেই বিয়ে হবে আমার। যদি তুমি এই বিয়ে আটকাতে কোনো সাহায্য না করো, তবে এটা আমি আর জোহানই বুঝে নেবো। তোমাকে তোমার মমের অবাধ্য হতে হবে না। এটার জন্য আমরাই যথেষ্ট। শুধু পার্থক্য হলো এটাই, তুমি যদি বুঝিয়ে বলতে তাহলে ঝামেলাটা একটু তাড়াতাড়ি মিটে যেত, আর আমরা বোঝাতে গেলে হয়তো সময়টা একটু বেশি লাগবে। তবে যত সময়ই লাগুক আমরা আমাদের মা বাবাকে বুঝিয়ে নেবো।”

জায়িন পিছন ফিরে না তাকিয়েই বললো,
“সেটা তোমাদের নিজ ইচ্ছা, নিজ খুশি!”
বলেই রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোনোর পথে যেতে লাগলো।

মিতুল অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইল পিছন থেকে। জায়িন এতটা খারাপ, সেটা আগে জানা ছিল না ওর। আজ নতুন ভাবে চিনলো।

(চলবে)

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৫৮
____________

লিভিং রুমে জোহান একা। রাগ রাগ একটা ভাব ওর মাঝে। মম কিছুতেই বোঝার চেষ্টা করছে না। এখনও ব্রাদারের সাথে মিতুলের বিয়ে নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছে সে। তবে যতই চিন্তা ভাবনা করুক, বিয়ে হবে না ব্রাদারের সাথে। এ ব্যাপারে ও নিশ্চিত। তবুও কেন যেন চিন্তা হয়, একটা শঙ্কা হয়!
এদিকে মিতুলকে দেখতে পাচ্ছে না কোথাও। রুমে নেই, পুরো বাড়িতে কোথাও নেই। কোথায় গেছে?
কারো কাছে জিজ্ঞেস করতেও ইচ্ছা করছে না এই মুহূর্তে।

প্রবেশ দরজা খোলার শব্দে জোহানের দৃষ্টি সেদিকে চলে গেল।
জায়িন প্রবেশ করলো বাসায়। কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা রুমে চলে গেল।
এর কিছুক্ষণ পর দেখা গেল মিতুলকে।
মিতুলের মাথায় চরম রাগ। জায়িন যেমন কথা বলেছে, তাতে ওর সারা শরীরে রাগের তাপদাহ বইছে। মিতুল জোহানকে খেয়াল না করেই হনহন করে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে ছুটছিল। জোহানের কথায় দাঁড়াতে হলো।

“কোথায় গিয়েছিলে?”

জায়িনকে নিয়ে খুব বাজে একটা মন্তব্য করতে ইচ্ছা করছে। মন থেকে যে কঠিন মন্তব্য উদয় হচ্ছে, এতটা কঠিন মন্তব্য জোহানের সামনে করা ঠিক না। শত হলেও জোহানের ভাই। মিতুল জোহানের কাছে কিছুটা এগিয়ে এসে বললো,
“কিছু মনে করো না জোহান। কথাটা বলতে আমি বাধ্য হচ্ছি। তোমার ভাই হলো আসলে একটা, হারামি! অহংকারী, বদ!”

মিতুল আর দাঁড়ালো না, হনহন করে নিজের রুমে চলে গেল।

জোহান মুখে একবার আওড়ালো,
“হারামি, অহংকারী, বদ! হলো কী মিতুলের? ব্রাদারের সাথে বাইরে গিয়েছিল?”

একটু সময় পর জোহান ব্রাদারের কাছে এলো। রুমের দরজা খোলা। ভিতরে না ঢুকে, দরজায় দাঁড়িয়ে ব্রাদারকে একটু দেখে নিলো।
ব্রাদার স্বাভাবিক! জোহান দরজায় দাঁড়িয়েই বললো,
“তুমি এত স্বাভাবিক থাকছো কী করে ব্রাদার? যেখানে এত কিছু ঘটে যাচ্ছে, সেখানে তোমার এত স্বাভাবিকতার মানে কী?”

জায়িন বাইরে থেকে ফিরে, ড্রেস চেঞ্জ করে, ল্যাপটপ নিয়ে বসেছিল। জোহানের কথায় তাকালো জোহানের দিকে।
“তাহলে কেমন থাকা উচিত আমার? অস্বাভাবিক?”

জোহান দরজা অতিক্রম করে ভিতরে পা রাখলো। ব্রাদারের দিকে দুই পা এগিয়ে এসে বললো,
“আমার আর মিতুলের মাঝে দীর্ঘ রিলেশনশিপ। আমি খুব ভালোবাসি মিতুলকে। এরপরও মম চাইছে তোমার সাথে মিতুলের বিয়ে হোক। তোমার কী সিদ্ধান্ত? তুমি বিয়ে করতে চাও মিতুলকে?”

জায়িনকে একটু নীরব দেখালো। মনে মনে কিছু একটা ভেবে নিলো যেন। তারপর বললো,
“মম যেটা বলবে, সেটাই করবো আমি।”

“তার মানে তুমি ঠিক আগের মতোই আছো। তোমার মিতুলকে বিয়ে করার তো কোনো কারণ দেখছি না আমি। তারপরও ওকে বিয়ে করতে সম্মত কেন তুমি? কোনো কারণ আছে? না কি এটা শুধুই আমার সাথে রেষারেষি?”

জায়িন কিছু বললো না।

জোহানই আবার বললো,
“তবে যাই করো না কেন ব্রাদার, এটা ভুলে যেয়ো না যে, আমি আগেকার সেই জোহান আর নেই। তাছাড়া তোমার আগেকার রেষারেষির ব্যাপারগুলোর থেকে মিতুল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি তোমাকে সবকিছু দিয়ে দিতে পারলেও, মিতুলকে দিতে পারব না।”
গলায় অত্যাধিক জোর লক্ষ‍্যণীয় জোহানের। জোহান আর কিছু না বলে মুখে চাপা রাগ ধরে চলে গেল।

_____________

মিতুলের সারা শরীর রাগে জ্বলে যাচ্ছে। এই রাগ নিবারণ হবে না কিছুতে। মিতুল ক্লোজেট খুঁজে একটা হলুদ শাড়ি বের করলো। এটা হলো ওয়েস্ট এডমন্টন মল থেকে জায়িনের পছন্দে কেনা সেই শাড়ি। এটাকে কেটে আজ টুকরো টুকরো করে ফেলবে।
মিতুল ওয়ার্ডোব খুঁজে একটা কাঁচি পেল। কাঁচি আছে সে জন্য সুবিধা। ওর কাছে কাঁচি না থাকলে কিচেন থেকে দা অথবা বটি এনে কাটতো।
রাগের মাথায় শাড়িটা কাটতে মিতুলের বেগ পেতে হলো না। প্রথমে শাড়িটার মাঝ বরাবর কাঁচি চালিয়ে কেটে ফেলেছে। আরও অনেক জায়গা দিয়ে কাটা হলো শাড়িটা।
কাটার পর মিতুল একেকটা খণ্ড ফ্লোরে ছুঁড়ে মারলো তীব্র আক্রোশে। এমন করে জায়িনকে ছুঁড়ে মারতে পারলে শান্তি আসতো মনে। তবে জায়িনের দেওয়া শাড়িটা কেটেও কম শান্তি আসেনি। যদিও তা জায়িনকে ছুঁড়ে মারার শান্তির কাছে খুব নগণ্য। মিতুলের রাগ কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। কী ভেবে জায়িনের সাথে কথা বলতে গিয়েছিল, আর কী হলো! নিজের ছোট ভাইয়ের সাথে রিলেশন, সেই মেয়েকে কীভাবে বিয়ে করতে পারে? হোক মায়ের বাধ্য ছেলে সে। তাই বলে এমন বাধ্যতাও পালন করতে হবে?
মিতুল বসে বসে কিছুক্ষণ জায়িনকে কথা শোনালো মনে মনে। তারপর ফ্লোরে পড়ে থাকা শাড়ির খণ্ডগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলো। এগুলো এখানে ফেলে রাখা যাবে না। কেউ দেখে ফেললে সমস্যা। মিতুল শাড়ির খণ্ডগুলো একটা শপিং ব্যাগে ভরে, আবার ক্লোজেটের ভিতর ঢুকিয়ে রাখলো।

দেখতে দেখতে সময় গড়ালো। ঘড়িতে এখন বারোটা বাজে। মিতুলের পেটের অবস্থা ভালো না। কাল রাতে কিছু খায়নি, আজ সকালেও কিছু খায়নি। রেস্টুরেন্টে গিয়ে এত এত খাবার অর্ডার করলো, সেসব না খেয়েই চলে এসেছে। জায়িনের কথা শুনে যে পরিমাণ রাগ হয়েছে, ওই পরিমাণ রাগ নিয়ে কিছু কি খাওয়া সম্ভব?
খাবে না। একটা দানাও ছুঁয়ে দেখবে না। এটা একটা অনশনের মতো হবে। যতক্ষণে ফ্যামিলির লোকেরা সঠিক সমাধানটা খুঁজে বের না করছে, ততক্ষণে কোনো খাদ্য স্পর্শ করবে না। জেদ কি শুধু তাদেরই আছে? ওর নেই? ওর’ও আছে। এবার সেই জেদটাই বোঝাবে সবাইকে।

দুপুরের খাবারের জন্য মিতুলকে ডাকতে এলো মাহিরা। মিতুল জানিয়ে দিলো ও খাবে না।
মাহিরা কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করলেন, কিন্তু লাভ হলো না। পরে তিনি নিজেই খাবার নিয়ে মিতুলের রুমে এলেন।
খাবার দেখে যেন মিতুলের খিদে আরও বেড়ে গেল। নিজেকে সামলে রাখা দায় হয়ে পড়লো। মন বলছে এখনই সবটা গপাগপ করে খেয়ে ফেলে। আর তাছাড়া ওর প্রিয় হাঁসের গোশত রান্না করা হয়েছে আজকে। এসব দেখে কি আর নিজের লোভ সামলানো যায়? যায় না। মিতুল খুব কষ্টে নিজেকে সামলে রাখলো। যথা সম্ভব কঠিন থাকার চেষ্টা করলো।

মাহিরা ভাত মাখিয়ে হাতে লোকমা তুলে বললেন,
“হাঁ করো।”

মিতুল মুখ কঠিন করে বললো,
“খাবো না আমি।”

“দেখো, পাগলামির একটা লিমিট আছে। হাঁ করো বলছি।”

মিতুলের ইচ্ছা করছে সব ভুলে মায়ের হাতের লোকমাটা খেয়ে নেয়। কিন্তু এমনটা করলে তো হবে না। নিজের দুর্বলতা দেখাবে না কোনো ভাবেই। মিতুল কাঠ গলায় বললো,
“যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা জায়িনের সাথে আমার বিয়ের চিন্তা ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিচ্ছ, ততক্ষণে আমি কোনো খাদ্য স্পর্শ করবো না।”

মাহিরা রেগে গেলেন,
“মার খেতে চাও তুমি? মুখের উপর এমন কথা বলছো কী করে? জায়িনের সাথে বিয়ে বাতিল করে, জোহানের সাথে বিয়ে ঠিক করি সেটাই চাও?”

মিতুলেরও খুব রাগ হলো। ও বলে ফেললো,
“হ্যাঁ, সেটাই চাই।”

মাহিরার রাগ আরও চড়াও হলো। কিছুসময় মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কঠিন চোখে। তারপর কিছু না বলেই খাবারের প্লেট নিয়ে চলে গেলেন।

মিতুলের খুব কষ্ট লাগলো। সামান্য একটা ব্যাপার মেনে নিতে তাদের কী সমস্যা, সেটাই বুঝতে পারছে না।

মা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর ভাইয়েরা এলো।
হাতে প্লেট। ওর জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। মিতুল বললো,
“খাবার নিয়ে এসেছো কেন? খাবো না আমি।”

মিলান, নাবিল মিতুলের কাছে এসে বসলো। নাবিল বললো,
“খাবি না?”
নাবিল জানে মিতুল মুখে খাবে না বললেও, ভিতরে ভিতরে ঠিকই খিদেয় মরছে।

মিতুল কঠিন থাকার চেষ্টা করে বললো,
“না।”

নাবিল বললো,
“খাইয়ে দিতে হবে? একদিন আমায় খাইয়ে দিয়েছিলি, এখন তার শোধ তুলতে চাস?”

মিতুল এমনিতেই কঠিন থাকতে পারছে না, এর উপর আবার ভাইয়ের এমন কথা। মিতুল আবারও বললো,
“বললাম তো খাবো না আমি।”

মিলান বললো,
“খাবি না কেন? না খেলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বি।”

“আমি তো সেটাই চাই। অসুস্থ হতেই চাই আমি। আমি তো অনশন করছি।”

“অনশন?” অবাক হয়ে বললো নাবিল।

মিতুল মাথা দোলালো।

মিলান বললো,
“তোর দরকার এখন শক্তির। তুই যদি অনশন করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়িস, তাহলে তো কাউকে কিছু বুঝাতে পারবি না। উল্টো তোকে সবাই বুঝ দিয়ে তোর মাথা হ্যাং করে দেবে। এখন সুস্থ সবল থাকতেই তাদের বুঝিয়ে কূলোতে পারছিস না। তাহলে ভাব, অসুস্থ হয়ে পড়লে কী অবস্থা হবে!”

মিতুল ভাইয়ের কথাটা ভেবে দেখলো। কথাটা তো সত্যি। একটু আগে মায়ের সাথে জেদ দেখাতে চাইলো, উল্টো মা-ই জেদ দেখিয়ে চলে গেল। অসুস্থ হয়ে পড়লে তো কথা বলার শক্তি থাকবে না। এখনই কথা বলতে গলাটা কেমন কেমন করছে। শক্তির অভাব অনুভব হচ্ছে। পরে তো অবস্থা নাজেহাল হয়ে যাবে।

মিতুল প্লেটের দিকে তাকালো। মনে পড়লো জোহানের কথা। জোহানের হাতে খেতে ইচ্ছা করছে এখন। মিতুল খানিক ইতস্তত করে বললো,
“জোহান খেয়েছে?”

মিলান বললো,
“হুম, খেয়েছে। জোহান জানে তুইও খেয়েছিস।”

মিতুল প্লেটের দিকে তাকিয়ে থেকেই বললো,
“রেশমী আন্টি’রা কি আজ চলে যাবে?”

“কোনো সমাধান বের না করে তারা চলে যাবে কী করে? যতক্ষণে না একটা সমাধান বের হচ্ছে, ততক্ষণে যাবেন না।”

_______________

রাত সাড়ে সাতটা।

ছাদের মুক্ত পরিবেশ। জোহান রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। গাড়ি যাচ্ছে একের পর এক। আছে কিছু মানুষ জনের চলাচল। জোহানের মনে পড়ে যাচ্ছে মিতুলের কানাডা থাকাকালীন দিনগুলোর কথা। দিনগুলো কী ভালো ছিল, কী নিশ্চিন্ত ছিল! আর এখনকার সময়টা কত কঠিন যাচ্ছে। পরিস্থিতি কত ভিন্ন। এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে জীবনে আশা করেনি। জোহান বড়ো করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
চাপা কষ্ট ভিতরে।

পিছনে কারো পায়ের শব্দে জোহান নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। পিছন ফিরে বললো,
“হোয়াট’স আপ লিটল ব্রো?”

নাবিল কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
“খবর শুনেছো?”

নাবিলের বলার ধরণ দেখে জোহানের কালো মুখটা, আরও কালো হলো।
জিজ্ঞেস করলো,
“কী খবর?”
____________

মাহিরাদের রুমের বন্ধ দরজার ভিতর থেকে ক্রন্দনের চাপা একটা সুর ভেসে আসছে। ভিতরে কাঁদছে মিতুল। রুমের ভিতর মিতুল, মাহিরা, নাহিদ সাহেব, মিলান, মেহরিন আছে।
মেহরিন এসেছে আজকে বিকেলে। এসেই পুরো ঘটনাটার সাথে অবগত হয়েছে। এর আগে কেউ জানায়নি তাকে। না মিতুল, আর না নাবিল।
এমন কিছু হতে পারে ধারণা করেনি মেহরিন। যেখানে মিতুল জোহানকে ভালোবাসে, সেখানে জোহানের বড়ো ভাইয়ের সাথে বিয়ে ঠিক, পুরো ব্যাপারটাই কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া ঠেকছে তার কাছে। একটু আগে এই ব্যাপারটা সুনিশ্চিত হয়েছে। জায়িনের সাথে মিতুলের বিয়ে দুইদিন পর। সবাইকে ডেকে এই ঘোষণা দিয়েছে জোহানের মা। জোহান উপস্থিত ছিল না সেই আসরে। ও না থাকাতেই আরও সুবিধা হয়েছে এই ঘোষণা দিতে।
মিতুল ওই আসরে থাকতে কিছু বলেনি। আলোচনা শেষ হতেই মায়ের রুমে এসে কান্নাকাটি শুরু করেছে।

মিতুল কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“এত অবুঝ তোমরা কবে হলে? এত করে বলার পরও, কীভাবে এই সিদ্ধান্ত নিতে পারলে? দুই দিন পর জায়িনের সাথে বিয়ে মানে? এটা কেমন ধরণের ডিসিশন তোমাদের? তোমাদের তো এমন করতে দেখেনি কখনো। এখন কেন তাহলে এমন অবুঝের মতো করছো তোমরা? আমি তো শেষ হয়ে যাব, মরে যাব আমি। ব্রো, মা-আব্বুকে একটু বোঝাও না, আমি তো শেষ হয়ে যাচ্ছি।”

বোনের কথা শুনে মিলানের হৃদয় কেঁদে উঠলো। মিলান বাবা মার দিকে তাকিয়ে বললো,
“এসব কখন বন্ধ করবে তোমরা? আর ভাল্লাগছে না। এতকিছুর পরও কীভাবে জায়িনের সাথে মিতুলের বিয়ে দিতে পারো? বোধ, বুদ্ধি কি সব লোপ পেয়েছে তোমাদের?”

নাহিদ আদেশের সুরে বললেন,
“চুপ করো মিলান। আমরা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সবটা ভেবেচিন্তেই নিয়েছি।”

“ভেবেচিন্তে? আমার কাছে তো তোমাদের এই সিদ্ধান্তকে বোকামি ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না।”

“বোনের সাথে সাথে তুইও কি সব শিক্ষা-দীক্ষা ভুলে গেছিস? কার সাথে কীভাবে কথা বলছিস?” রাগান্বিত কণ্ঠ মাহিরার।

মিলান বললো,
“বলতে বাধ্য হচ্ছি। ছোটবেলা থেকে সবসময় তোমাদের সব কথা মেনে এসেছি। কিন্তু এই ব্যাপারটা কিছুতেই মানতে পারছি না। যেখানে মেয়ে রাজি নয় বিয়েতে, সেই বিয়ের কথা কী করে একেবারে পাকাপাকি করে ফেলতে পারো? জোর করে মেয়ের বিয়ে দেবে? এটা কি তোমাদের কাছ থেকে আশা যোগ্য?”

মাহিরা বললেন,
“বেশি বোঝার চেষ্টা করিস না। আমাদের থেকে নিশ্চয়ই তুই ভালো বুঝবি না।”

“হ্যাঁ, তোমাদের মতো হয়তো অত ভালো বুঝি না। তাই বলে যে কিছুই বুঝি না এটা নয়। আমরাও তো বড়ো হয়েছি, ভালো মন্দ কিছু কিছু আমরাও বুঝি। আর তাই বলছি, তোমরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছো এটা ভুল। এটা গ্রহণ যোগ্য নয়।”

“আমরা সবকিছু ভেবেচিন্তে এই ডিসিশন ফাইন্যাল করেছি। রেশমী চায় না মিতুলের বিয়ে জোহানের সাথে হোক। জায়িনের জন্য মিতুলকে পছন্দ করে, জোহানের সাথে বিয়ে দিয়ে চায় না ও। আর আমরাও…”

“কে কী চায়, না চায় তা আমি জানি না। আমি শুধু জোহানকে চাই।” মায়ের কথার মাঝে বলে উঠলো মিতুল।

মাহিরা মেয়ের এত স্পর্ধা দেখে অবাক। বললেন,
“তোমার চয়েজ দেখে আমি শিহরিত। কী দেখেছো তুমি জোহানের মাঝে? মদ খায়, কোনো কাজ কর্ম করে না, ঘুরে বেড়ায় এদিক-সেদিক। ওই ছেলের কোনো ঠিক আছে? বিয়ের পর তোমার ঠিকঠাক দেখভাল করতে পারবে? বিয়ের পর তুমি থাকবে বিদেশ, কিছু হলে আমরা কি হুটহাট করে যেতে পারব তোমার কাছে? রোজ যদি মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরে, তখন কী করবে? যে ছেলে মায়ের কথা শোনে না, সে কি তোমার কথা শুনবে? তাকে কি তুমি কোনো কথা শোনাতে পারবে? পারবে না। জোহানের সাথে সুখী হবে না তুমি। জোহান যেরকম ছেলে তাতে তুমি কিছুতেই ভালো থাকবে না ওর সাথে। আর এসব ছেলেদের কোনো ঠিক নেই। এরকম ছেলেরা অন্য মেয়ে নিয়েও বাড়ি ফিরতে পারে। দেখা যাবে অন্য মেয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরেছে!”

মায়ের শেষ কথাটা খুব করে গায়ে লাগলো মিতুলের। ও গর্জে উঠলো,
“জোহান মোটেই এমন নয়। ওকে তুমি চেনো না। আমি ওর সাথে থেকেছি, আমি চিনি ওকে। খুব ভালো করে চিনি। আর ও আগে মদ খেলেও এখন খায় না। এটা আগেও বলেছি তোমায়। আর যদি আমার দেখভাল করার কথাই ওঠে, তাহলে তোমাকে বলে দিই, ওর মতো এত কেয়ার কেউ করতে পারবে না আমার। আর জোহান কাজ বাজ যে করে না সেটা তো নয়। জোহান একজন সিঙ্গার। অতটা ফেমাস হয়তো এখনও হতে পারেনি। কিন্তু বলতে গেলে ও ফেমাস। ভবিষ্যতে চাকরিও করবে। হয়তো জায়িনের মতো অত বড়ো চাকরি নয়, তবে ভাগ্য থাকলে জায়িনের থেকেও বড়ো চাকরি পেতে পারে।
আমি ওর সাথে সুখী থাকবো কি না সেটা নিয়েই তো তোমার দুশ্চিন্তা? তোমাকে আমি একশ ভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি মা, জোহানের সাথে আমি যতটা সুখী থাকবো, পৃথিবীর আর কারো সাথে অতটা সুখী থাকতে পারব না। জোহান আমাকে খুব ভালোবাসে। আমার প্রতি ওর অনুভূতি ঠুনকো নয়। খুব জোরালো, খুব!
প্লিজ মা, এমন করো না আর। জায়িনের সাথে বিয়েটা ভেঙে দাও। জায়িনকে বিয়ে করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। জোহানকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ের কথা কীভাবে ভাবতে পারি আমি? তুমি জোহানকে যেমনটা ভাবছো, জোহান তেমন নয়। ওর প্রতি তোমার যে ধারণা, তা ভুল। জোহান খুব ভালো ছেলে। তুমি শান্ত মাথায়, শান্ত ভাবে পরখ করে দেখো ওকে। প্লিজ!”
কান্না ভেজা করুণ কণ্ঠ মিতুলের।

“তুমি বোকা, তাই এমন ভাবছো। যদি তুমি একটু বুঝদার হতে, তাহলে মেনে নিতাম তোমার সব কথা। কিন্তু তুমি তো বুঝদার নও। কোনটা আসল, কোনটা নকল সেটা তুমি বুঝতে পারো না। সবসময় ভুলটাকেই আসল ভাবো। তোমার কথাকে তাই আমরা ভরসা করতে পারি না। যেখানে ওর নিজের মা এসব কথা বললো, সেখানে তুমি আর ওকে কতটুকু চেনো? ওর মায়ের থেকে কি তুমি ভালো চেনো ওকে? আসলে আগা গোড়া পুরোটাই ভুল ধরে বসে আছো তুমি।”

মিতুল এবার অতিষ্ট হয়ে, রাগ দেখিয়ে, প্রায় চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
“কেন এত অবুঝপনা করছো তোমরা? আমি মোটেই ভুল নই। হতে পারি আমি একটু বোকা। কিন্তু জোহানকে চিনতে আমার কোনো ভুল নেই। আমি জোহানকে খুব ভালো করে চিনি। জোহান কেমন সেটা খুব ভালো করে জানি আমি। জোহানের মাঝে কত অপূর্ণতা লুকিয়ে আছে জানো না তোমরা। আমি জানি। আমি বাকি সবার মতো করতে পারব না। জোহান আমাকে ভালোবাসে, আমি ওর ভালোবাসার মূল্যটা দিতে জানি। আমি জোহানকে একদিনের জন্য, বা এক মাস, এক বছরের সময়সীমা বেঁধে ভালোবাসি না। আমার সম্পূর্ণ হৃদয় জুড়ে ও। আর আমি ওকে আমার সম্পূর্ণ জীবনের জন্য ভালোবাসি।”

“মিতুল!” মাহিরা কঠিন গলায় ডাকলো।

মিতুল দুর্বল হয়ে পড়লো। কাঁদতে কাঁদতে মিনতির সুরে বললো,
“প্লিজ মা, তোমরা এমন করো না। আমি জায়িনকে বিয়ে করতে পারব না। প্লিজ আব্বু, এই বিয়ে ভেঙে দাও। তোমরা জোহানকে যেমন ভাবছো, ও তেমন না। ওর ভিতরে কত শূন্যতা, কত অপূর্ণতা, কত কষ্ট লুকিয়ে আছে জানো না তোমরা। ওকে দেখলে বোঝা যায় না। ও তো আর রেশমী আন্টির মতো না। রেশমী আন্টি তো অকপটে সবার কাছে ওর কথা বলে দিয়েছে। ও এটা করে, ও সেটা করে!
কিন্তু ও তো কারো কাছে, কারো কথা বলে বেড়ায় না। নিজের কষ্টগুলো নিজের ভিতর রাখে। আমি জানি ওর ভিতরটা।”

মিতুল একটু বিরতি নিলো। চোখ ফেঁটে জল গড়াচ্ছে অনর্গল। আবার বললো,
“জোহান আমাকে কতটা ভালোবাসে, আমি জোহানকে কতটা ভালোবাসি, এটা বলে প্রকাশ করতে পারব না তোমাদের কাছে।
তবে শুধু এটুকু বলতে পারি, যদি তোমরা জোহানের সাথে আমার বিয়ে দাও, তাহলে এটা নিয়ে কখনো আফসোস জিনিসটার সাথে পরিচিত হতে হবে না তোমাদের। ও আমাকে খুব ভালো রাখবে। আমি ভালো থাকবো ওর সাথে।”

মিতুলের কথা শুনে সবার মুখে থেকে কথা সরে গেছে। মিতুলের এর আগের কথাগুলো কেউ বুঝতে পারেনি। জোহানের কষ্ট…কীসব বললো। কেউ যে এই বিষয়টা নিয়ে প্রশ্ন করবে তাও পারলো না। মিতুল যেভাবে বলেছে কথাগুলো, তাতে প্রশ্ন করতেও সবার দ্বিধা হচ্ছে।

মিতুল আব্বুর দিকে তাকিয়ে বললো,
“প্লিজ আব্বু! কখনো আর কিছু চাইবো না তোমাদের কাছে। শুধু জায়িনের সাথে বিয়েটা ভেঙে জোহানের সাথে ঠিক করো। প্লিজ! আর অবুঝের মতো করো না। কষ্ট পাচ্ছি! কষ্ট হচ্ছে আমার!”

নাহিদ সাহেব মেয়ের এমন কান্না ভেজা কথা শুনে কী বলবে বুঝতে পারছেন না। শুধু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে।

মাহিরাও বিস্ময়াভিভূত। মেয়েকে এই প্রথম এমন করতে দেখছে। এর আগে এত কাঁদতে দেখেনি মেয়েকে। কিছু চাইতেও দেখেনি এমন ভাবে। মাহিরার মনটা ভিজে যাচ্ছে মেয়ের এমন করায়। তবুও তিনি নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করে বললেন,
“জায়িন জোহানের থেকে ভালো। জোহানের থেকে সব দিক থেকে বেশি পারফেক্ট। জায়িন ম্যাচিউর, বিশাল বড়ো চাকরি…”

“জায়িন ম্যাচিউর, বিশাল বড়ো চাকরি, এসব দিয়ে তোমার মেয়ে কী করবে?”
মিলান বলে উঠলো।
“জায়িন যে রকম মানুষ, তাতে তোমার মেয়ে কি থাকতে পারবে জায়িনের সাথে? জায়িনের সাথে মানায় ওকে? আমারই তো জায়িনকে পছন্দ নয়। কেমন একটা ভাব জায়িনের! বেশি কথা বলে না, একা একা থাকে, মিশে না মানুষের সাথে…অমন একটা মানুষের সাথে থাকবে কী করে ও? তোমার মেয়ে কি এভাবে বড়ো হয়েছে? ও কি জায়িনের মতো গম্ভীর একটা মানুষের সাথে থাকতে পারবে? দুজন তো দুই মেরুর মানুষ।
জোহানকে দেখো, কী সুন্দর করে আমাদের সাথে মিশে গেছে। মনেই হয় না যে এই প্রথম ওর সাথে দেখা হয়েছে। আর যদি মিতুলের দেখভালের কথাই ওঠে, তাহলে আমি মনে করি, মিতুলের কথা ঠিক।
কালকে গভীর রাতে বাড়ি ফিরে প্রথমেই মিতুলের কথা জিজ্ঞেস করেছে জোহান। মিতুল ঠিক আছে কি না, খেয়েছে কি না, ঘুমিয়েছে কি না, এসব জিজ্ঞেস করেছে। বাড়ি ফিরেই ও খোঁজ নিলো মিতুলের। যদি মিতুলের কেয়ারই না করতো, তাহলে কি বাড়ি ফিরে এসব জিজ্ঞেস করতো? এখন তুমিই বলো, কে তোমার মেয়ের জন্য ভালো হবে? জায়িন? না কি জোহান?”

ছেলের প্রশ্নে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লো মাহিরা।

মিতুল বলে উঠলো,
“অবশ্যই, জোহান। জায়িন হলো একটা অহংকারী। ওই অহংকারীটাকে আমি বিয়ে করতে পারব না। সম্ভব নয় করা। জোহানকে ভালবাসি! আর বিয়েটা ওকেই করবো। দয়া করে ঠাণ্ডা মাথায় একটু বোঝার চেষ্টা করো। আর এরকম করো না।”

বন্ধ দরজার ভিতর থেকে মিতুলের কান্নারত কণ্ঠ জোহানের হৃদয়ের কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। খুশি মনে বাংলাদেশ এসেছিল, কিন্তু এই বাংলাদেশ যে এত বড়ো একটা কষ্টের পাহাড় তৈরি করে রেখেছিল ওর জন্য, সেটা জানা ছিল না। নাবিলের কাছ থেকে ব্রাদারের সাথে মিতুলের বিয়ের কথা ফাইন্যাল জেনে, জোহান ছাদ থেকে দ্রুত নিচে ছুটে এসেছিল। আর সেই থেকে এই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মিতুলের সব কথা শুনেছে। যদিও বাংলা কথা বুঝতে পারেনি। ভাগ্য গুণে কিছু কিছু শব্দ ধরতে পেরেছে শুধু। কথা না বুঝলে কী হবে, মিতুলের ক্রন্দন কণ্ঠ শুনেই তো বলে দিতে পারে কী নিয়ে কথা হচ্ছে। মিতুলের বলা একেকটা শব্দ বর্শার ধারালো ফলার মতো এসে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করেছে। এই রক্তাক্ত হৃদয় নিয়ে এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না।
জোহান দরজার কাছে থেকে সরে পড়লো। দ্রুত পা ফেলে এগোতে লাগলো ব্রাদারের রুমের দিকে।
জোহানের সাথে নাবিলও দাঁড়িয়ে ছিল দরজার সামনে। পিছন থেকে জোহানের দিকে তাকিয়ে রইল সে। জোহান চলে গেল চোখের বাইরে।

জোহান ভেজানো দরজাটা সশব্দে খুলে ভিতরে ঢুকলো।
জায়িন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল অন্যমনস্ক ভাবে। দরজা খোলার শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন ফিরলো।

জোহান দরজাটা বন্ধ করে দিলো।
ব্রাদারের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
“তুমি এখনও এত চুপ কী করে ব্রাদার? ভেবেছিলাম তুমি একটু হলেও বুঝবে। কিন্তু এখন তো দেখছি সবথেকে অবুঝের ভূমিকা পালন করছো তুমি। তুমি তো একেবারেই মুখ খুলছো না। কেন ব্রাদার?”

জায়িন ধীর কণ্ঠে বললো,
“এ বিষয়ে তোর সাথে কোনো কথা বলতে চাই না আমি।”
জায়িন আবারও জানালার দিকে ঘুরলো।

“তুমি আমার মানুষটিকেই কেড়ে নিচ্ছ, অথচ আমারই সাথে কথা বলবে না! অবশ্যই আমার সাথে কথা বলতে হবে তোমার। কেন এই বিয়েটা করবে তুমি? মমের জন্য? মম বলেছে সে জন্য? না কি অন্য কোনো কারণ আছে?”

জায়িন জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেই বললো,
“মম চাইছে বলে।”

“রিয়েলি? শুধু মম চাইছে বলেই তুমি বিয়েটা করতে সম্মত? অন্য কোনো কারণ নেই? এটাও কি মানার মতো ব্রাদার?”

“না মানার কী আছে? জানিসই তো মমের কোনো কথা অমান্য করি না আমি।”

“তাই বলে এটাও নির্দ্বিধায় মেনে নেবে? এটা একটা, দুটো দিনের ব্যাপার না ব্রাদার। তোমার সারাজীবন জুড়ে জড়িয়ে থাকবে এটা। যেটা ভুল, সেটা জেনেও কেন সম্মতি দিচ্ছ?
আগে জানতে না। এখন তো জানো। মিতুল আর আমি একে অপরকে ভালোবাসি। তারপরও কেন এই বিয়েতে সম্মত তুমি? আমার তো মনে হচ্ছে না তুমি কেবল মমের কথা রক্ষার্থে এই বিয়েতে সম্মতি দিয়েছ। কী কারণ আছে এর পিছনে? এটা কি আমার সাথে রেষারেষি? না কি তুমিও পছন্দ করো মিতুলকে?”

জায়িন থমকে গেল। তবে এই থমকে যাওয়া ভাবটা প্রকাশ করলো না। কিছুটা সময় নীরব থেকে, কাঠ গলায় জবাব দিলো,
“দুটোই ভাবতে পারিস।”

ব্রাদারের কথায় জোহান ঝটকা খেলো। থমকে গেল। মুখ গাঢ় কালো রং ছড়িয়ে, চক্ষু জোড়ায় বিস্ময়ের রূপ নিলো।

জায়িন বলতে লাগলো,
“প্রথম দিকে মিতুলকে গুরুত্বের সহিত দেখতাম না আমি। ভাবতাম একজন অতিথি আমাদের বাড়িতে এসেছে, কিছুদিন থেকে আবার চলে যাবে। এতটুকুই ভাবনা ছিল মিতুলকে নিয়ে, এর বেশি কিছু না। মম মিতুলকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে পাঠালেও বিরক্ত হতাম। নিয়ে যেতাম মমের কথায় বাধ্য হয়ে, কিন্তু মন থেকে না।
তবে তোর সাথে যখন মিতুলকে দেখতাম, তখন সেটা ভালো লাগতো না আমার। ধীরে ধীরে তোর সাথে মিতুলের ঘোরাঘুরি, মেলামেশা বাড়তে লাগলো। যেটা অসহ্য লাগতো আমার। যেদিন তুই উইনিপেগ থেকে ভ্যাঙ্কুভারে এসেছিলি, সেদিন আমি বুঝে গিয়েছিলাম, তোর ভ্যাঙ্কুভার আসার আসল কারণ কী। কারণটা ছিল মিতুল। তুই আমাদের সবাইকে মিস করছিলি না, মিস করছিলি মিতুলকে। মিতুলের কারণেই উইনিপেগ থেকে ভ্যাঙ্কুভার ছুটে এসেছিলি। ওই দিন ধারণা করেছিলাম তোর এবং মিতুলের মাঝে কিছু একটা আছে। আর ধীরে ধীরে এই ব্যাপারটা কনফার্ম হয়ে যাই। মিতুল এবং তোর মাঝে সত্যিই একটা রিলেশনশিপ আছে। এটা একেবারে কনফার্ম হয়েছিলাম ফ্রেডি মিতুলকে জড়িয়ে ধরার পর। ওই ঘটনার পর তোর এবং মিতুলের কথা শুনে কিছু বুঝতে বাকি ছিল না আর।
মিতুলকে আমি সবার সাথে সহ্য করতে পারলেও, তোর সাথে পারতাম না। তোর সাথে মিতুলকে দেখলে আমার জেলাসি ফিল হতো। অন্য কারো সাথে দেখলে এই ফিলটা হতো না, শুধু তোর সাথে দেখলেই হতো। আর এই জেলাসি ফিল থেকেই আমি ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে পারলাম, মিতুলকে ভালো লেগে যাচ্ছে আমার। পছন্দ করি আমি ওকে। তবে ওকে পছন্দ করার বিষয়টি অতটা গাঢ় ছিল না। ওকে পছন্দ করি বলে, আমি যে মমকে বিয়ের কথা বলেছি, সেটা কিন্তু না। আমি বলার আগে মম নিজেই মিতুলের সাথে আমার বিয়ের কথা বলেছে। বাংলাদেশ আসার আগেই এই বিষয়ে জানিয়েছে আমাকে।
তোর ধারণা ঠিক। আমি শুধু মমের কথা মানতে এই বিয়েতে রাজি নই। মমের কথা মানার পাশাপাশি, জেলাসি এবং মিতুলকে পছন্দ করার বিষয় দুটিও সংযুক্ত। আমি সবকিছু জেনে বুঝেই এই বিয়েতে সম্মতি দিয়েছি।”

ব্রাদারের কথা শুনে জোহান স্তব্ধ, রিক্ত, নির্বাক। চোখ ফেঁটে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো কপোল বেয়ে। দু কান অবিশ্বাসের সাক্ষী হয়ে আছে। এসব শোনার চেয়ে, না শোনা বেটার ছিল। জোহান অশ্রু ঝরা চোখে অবিশ্বাস্য, ভারাক্রান্ত কণ্ঠে ডাকলো,
“ব্রাদার!”

জোহানের ডাকে জায়িন সাড়া দিলো না, পিছন ফিরলো না। আগের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল।

জোহানের হৃদয়ে তোলপাড় হচ্ছে। বললো,
“আমি এতটাই পর তোমার? আমি তোমার আপন ছোট ভাই! আমাকে কেন এত পর ভাবো তুমি?”

জায়িন নিরুত্তর দাঁড়িয়ে রইল।

“যখন তুমি কনফার্ম হয়েছিলে আমাদের মাঝে রিলেশন আছে, তখন আসলে আমাদের মাঝে কোনো রিলেশনশিপ ছিল না। অনুভূতিগুলো অপ্রকাশিত ছিল। অথচ তুমি তখনই আমাদের মাঝে রিলেশনশিপ আছে ভেবেছিলে। এত আগে থেকে এটা ভেবে, জেনে, কী করে এখন এমন করতে পারলে? এত হিংসা আমার প্রতি? এতটা অপছন্দ করো আমাকে? ছোট বেলা থেকেই তুমি এমন করো আমার সাথে। তুমি একাই মমের ভালোবাসার বিস্তর জায়গা হস্তক্ষেপ করে ছিলে, আর এখনও আছো। আমি মমের ভালোবাসা পাই সেটা তোমার সহ্য হয় না। তুমি যেমন মমের ছেলে, আমিও তো তেমন মমের ছেলে। মম যেমন তোমার আপন, আমিও তো তোমার আপন। মম যদি আমাকে ভালোবাসে, তাহলে তোমার প্রতি কি তার ভালোবাসা কমে যাবে? এটা তুমি কোনো কালেই বুঝলে না। মম আমাকে ভালোবাসলে, তোমার প্রতি মমের ভালোবাসা কমতো না। অথচ তুমি মমকে সবসময় নিজের করে রাখতে চাইতে। সবসময় এমন একটা ভাব করো, যেন মম তোমার একার। আর মমও তোমায় ভালোবাসার বিস্তর জায়গাটা দিয়ে রেখেছে। মম হয়তো মাঝে মাঝে ভুলেই যায়, আমিও তার একটা ছেলে। মমের এমন করার পিছনে তার মানসিকতা তো আছেই, তার সাথে তুমিও দায়ী। ছোটবেলায় সবকিছুতে তুমি আমাকে দোষী বানাতে মমের কাছে। আমার থেকে বড়ো হয়েও এসব করতে তুমি। ছোটবেলায় কী করতে তুমি? গোছানো ঘর এলোমেলো করে, মম আসলে আমার কথা বলতে। বলতে আমি এগুলো এলোমেলো করেছি।
কিছু কিনতে গেলে কী হতো? নিজের পছন্দ মতো আগে কিনে দেওয়া হতো তোমাকে। এরপর আমার পছন্দ মতো কিছু কিনে দেওয়া হলে, পরে তোমার পছন্দ হয়ে যেত তা। তুমি বায়না ধরে ঠিকই সেগুলো নিয়ে যেতে। এগুলো করলে আমি করতে পারতাম। আমি ছোট ছিলাম। কিন্তু আমার থেকে বড় হয়েও এগুলো করেছো তুমি।
ছোট বেলায় একই স্কুলে পড়তাম। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরলে, তুমি মমের কাছে নালিশ খুলে বসতে। আমি এই দুষ্টমি করেছি, ওই দুষ্টমি করেছি। অথচ আমি কিছু করতামই না।
এরপরে আসে আমার বুলিং এর ব্যাপারটা। তখনও তো আমরা একই স্কুলে ছিলাম। আমি বুলিং এর শিকার হতাম, অথচ তোমাকে কখনো পাশে পাইনি। বলতে গেলে আরও অনেক কিছু আছে ব্রাদার। এখন আর বলতে চাইনা কিছু। আগে যেসব করেছ করেছ, সেসবের সাথে এখন মিতুলকে গুলিয়ে ফেলোনা। বাকি সব কিছুর মতো আমি মিতুলকে ছেড়ে দেবো না। এমনকি মিতুল যদি নিজ ইচ্ছায় তোমার কাছে যেতে চায়, তাও আমি যেতে দেবো না। ওকে নিজের কাছেই আঁকড়ে রাখবো।”
জোহান থামলো। একটু সময় বিরতি নিয়ে আবার বললো,
“কী দিয়েছো তুমি আমাকে ব্রাদার? সব কিছু থেকে বঞ্চিত করা ছাড়া, আর কিছুই দিতে পারোনি। হয়তো তুমি সবকিছু থেকে আমাকে বঞ্চিত করে সুখ পাও। তবে আমি এমন নই। আমি তোমাকে এবং মমকে খুব ভালোবাসি। তোমাদের কাছ থেকেও ভালোবাসা পাওয়ার স্বপ্ন দেখি।”

জোহানের কথায় জায়িন স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। হৃদয়ে শীতল হাওয়ার প্রবাহ বইছে। জীবনে আর কখনো এমন করে বলেনি জোহান। এই অভিযোগ গুলোও তোলেনি আগে।
পিছন থেকে আবারও জোহানের শান্ত কণ্ঠ ভেসে আসলো জায়িনের কানে।
“হেই ব্রাদার, ওদিকে তাকিয়ে আছো কেন? আমার দিকে তাকাও। একবার স্নেহের চোখে তাকিয়েই দেখো না। আমি তো তোমার ভাই! ভাইয়ের মতো দেখো আমাকে। পর করে কেন দেখো? এদিকে তাকাও।”

জায়িনের হৃদয় ছ‍্যাঁত করে উঠলো। ভাই!

জোহানের দিকে তাকাতেও সংশয় হচ্ছে জায়িনের। একটু আগে যে মন মানসিকতা নিয়ে জোহানের সাথে কথা বলেছিল, সেই মন মানসিকতা এখন আর নেই। পাল্টে গেছে। ভিতরটা কী রকম যেন হয়ে গেল হঠাৎ। জায়িন একটু সময় নিয়ে পিছন ফিরলো।

জোহানের দুচোখে এখনও অশ্রু।
জোহান একটু হেসে বললো,
“তোমার কাছ থেকে এত বেশি কখনো আশা করিনি ব্রাদার! তোমার এই অকপটে স্বীকারোক্তি গুলো কোথায় এসে লেগেছে জানো? ঠিক এখানটায়…”
জোহান হাত দিয়ে নিজের বুকের বাম পাশ দেখিয়ে দিলো।
একটু চুপ থেকে আবার বললো,
“মিতুল আমার ভালো থাকা, আমার ভালোবাসা, আমার খুশি! ও কেবল আমারই! তাই আশা করছি এই বিয়ে ভালোয় ভালোয় থেমে যাবে। তুমি থামতে সাহায্য করবে।”
জোহান ব্রাদারের দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। তারপর আর কিছু না বলে পা বাড়ালো দরজার দিকে।

জায়িন বশীভূত চোখে তাকিয়ে রইল।

ব্রাদারের এখান থেকে বেরিয়ে মমের কাছে গেল জোহান। যদিও প্রথমে মমের কাছে আসতে চায়নি। কোনো কথা বলার ইচ্ছা ছিল না মমের সাথে। তবুও আবার এলো। রুমের দরজা খোলা ছিল। জোহান ঢুকে পড়ল।

রেশমীর মাথা গরম। একটু আগেই স্বামীর সাথে রাগারাগি হয়েছে ফোনে। সাদাত কিছুতেই জায়িনের সাথে মিতুলের বিয়ে মেনে নিতে চাইছে না। রেশমী জোহানকে রুমে ঢুকতে দেখে বললেন,
“কী প্রয়োজন?”

জোহান কিছু বললো না। এসে মমের পাশে বসলো। কিছু না বলে মমের হাত ধরলো।
রেশমী ছেলের কাজে কিছুটা অবাক।
জোহান মৃদু কণ্ঠে ডাকলো,
“মম!”

“কী বলতে চাও বলো।” রেশমী সহজ ভাবে বললেন।

জোহান শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“আর কত?”

“কী?”

“আমি তো তোমার ছেলে, আমার সাথে এমন করতে পারো কীভাবে? ব্রাদার যেটা বলতো সেটাই কি ঠিক? সত্যিই কি তুমি আমাকে চাওনি?”

রেশমী অবাক হয়ে বললেন,
“কোন ব্যাপারে কথা বলছো তুমি?”

“আজ সত্যি করে একটা কথা বলো। যখন ছোট ছিলাম ব্রাদার প্রায়শই একটা কথা বলতো আমাকে। বলতো, তুমি নাকি আমাকে চাওনি। আমাকে পেয়ে খুব অখুশি তুমি। তুমি আমার জায়গায় ব্রাদারের জন্য একটা বোন চেয়েছিলে। এটা কি সত্যি?”
জোহানের চোখ থেকে পানি শুকিয়ে গিয়েছিল। কথাগুলো বলতে বলতে আবার চোখে পানি এসে গেল।

“এগুলো ঠিক নয়। আমি কখনো জায়িনের কাছে এমন কোনো কথা বলিনি। জায়িন ভুল বলেছে তোমায়।”

“হ্যাঁ বুঝলাম, ব্রাদার ভুল বলেছে। কিন্তু তুমি আমার সাথে এমন করো কেন? ব্রাদারের মতো তো ভালবাসো না আমায়! এত করে বুঝানোর পরও এমনটা করলে কী করে? কী করে পারলে দুই দিন পর ব্রাদারের সাথে মিতুলের বিয়ের কথা ফাইনাল করতে?”

রেশমী ধরতে পারলেন জোহানের কথা বলতে আসার আসল কারণ কী। রেশমী জোহানের থেকে হাত সরিয়ে আনলেন। শক্ত গলায় বললেন,
“যা করেছি ঠিক করেছি। তুমি বেশি বুঝতে এসো না। তোমার ওই ঠুনকো আবেগের জন্য আমি আমার কথার নড়চড় করতে পারি না।”

“তুমি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো না। তোমার সব ভালোবাসা ব্রাদারের জন্য। ব্রাদার যদি কোনো কারণে মনে কষ্ট পায়, তাহলে তোমার খারাপ লাগবে না মম? লাগবে তো।
কিন্তু আমার জন্য তো তেমন কোনো খারাপ লাগার উপস্থিতি টের পাচ্ছি না তোমার মাঝে। আমার হৃদয় চৌচির হয়ে যাচ্ছে, অথচ তুমি সেটা বোঝারই চেষ্টা করছো না। খারাপ লাগবে কী তোমার!
যে কোনো ভাবেই আমি এই বিয়েটা আটকাবো। দরকার হলে আমি মিতুলকে নিয়ে চলেও যেতে পারি এখান থেকে। কিন্তু আমি সেটা চাই না। আমি চাই তোমরা নিজেরাই এই বিয়েটা ভেঙে দাও।
সবকিছুই তো তুমি ব্রাদারকে দাও। আমার জীবনে তোমার ভালোবাসাটা খুব দরকার ছিল, কিন্তু সেটা তুমি সবটা ব্রাদারকে দিয়ে রেখেছো।
মিতুলকেও আমার জীবনে খুব দরকার, অথচ সেটাও তুমি এখন ব্রাদারকে দিয়ে দিতে চাইছো! কেন মম?
তোমার ভালোবাসা পাইনি। আর এখন যদি মিতুলও আমার না থাকে, তাহলে আমার বাঁচাটা খুব কঠিন হয়ে যাবে! জীবনটা খুব কষ্টকর হয়ে উঠবে। মা হয়ে কেন ছেলের জীবনটা এত কষ্টকর করে তুলতে চাইছো? করো না এমন। সত্যিই কষ্ট হচ্ছে!
মিতুলকে না পেলে তো ব্রাদারের জীবন অপূর্ণ থাকবে না। কিন্তু আমি? আমার জীবনে তো একটা অপূর্ণতার গল্প আছেই। মিতুলকে না পেলে সেই গল্পটা আরও দীর্ঘ হবে। এত অপূর্ণতা নিয়ে আমি থাকবো কী করে? পারব না থাকতে। মিতুলকে কেড়ে নিয়ে আমার জীবনের অপূর্ণতার গল্পটা আর দীর্ঘ করো না। আমি তোমার ছেলে। এমনটা করো না আমার সাথে। এমনটা করা উচিত নয় তোমার। ব্রাদারের সাথে বিয়েটা ভেঙে, আমার সাথে ঠিক করো। নয়তো নিজের জীবনের অপূর্ণতার গল্পটা খুব বাজে ভাবে পূর্ণ করবো আমি!”

জোহান আর বসলো না। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল।
রেশমী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। জোহান কি এই মাত্র হুমকি দিয়ে গেল তাকে?

________________

রাত এগারোটা।
মিতুল জোহানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের আলো ছড়িয়ে আছে ছাদ জুড়ে।
জোহান বললো,
“যদি সত্যিই এই বিয়েটা না থামে, তাহলে আমি তোমাকে নিয়ে চলে যাব এখান থেকে।”

“কী? পালিয়ে যাব?”

“পালিয়ে নয়। চলে যাব আমরা।”

“ওই একই তো কথা।”

“এক কথা নয়। আমরা সবার সামনে দিয়ে চলে যাব। ওটাকে পালিয়ে যাওয়া বলে না।”

“ওটাকেও এক প্রকার পালিয়ে যাওয়াই বলে। আমি পালিয়ে যেতে পারব না। আর আমরা পালিয়ে কেন যাব? পালাবো না আমরা। আমাদেরকে আমাদের ফ্যামিলি মেম্বারসদের বোঝাতে হবে। যতক্ষণে তারা না বোঝে।”

“আমি ক্লান্ত! আর বোঝাতে পারব না। সে তুমি বোঝাও গিয়ে।”

“বোঝাতে হবে। অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিয়ে বাতিল হয়ে যায়। গ্রহণযোগ্য নয় সে বিয়ে। যদি আমরা পালিয়ে বিয়ে করি, তাহলে সেটা বিয়ে বলে গণ্য হবে না। আমরা কি সারা জীবন একটা অবৈধ সম্পর্ক কাটাবো?”

মিতুলের কথা শুনে জোহান দমে গেল। ঘাড় ম্যাসাজ করতে করতে বললো,
“তাহলে এখন কী করবো? আমার ভালো লাগছে না আর।”

“ধৈর্য ধরো। ধৈর্যের ফল অতি সুমিষ্ট!”

____________

মাহিরা সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারলো না। এই রাতের বেলাতেই একরাশ দ্বিধা, সংশয়, জড়তা নিয়ে রেশমীর রুমের দিকে যাচ্ছে। জানে না রেশমী ঠিক কীভাবে নেবে কথাটা!
রেশমীর রুমের সামনে আসতেই জায়িনকে বের হতে দেখলো রুম থেকে। ক্ষণিকের জন্য চোখাচোখি হলো জায়িনের সাথে।
জায়িন কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
মাহিরা জায়িনের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে, রেশমীর রুমে প্রবেশ করলো।

(চলবে)