ছায়া হয়ে থাকবো পাশে পর্ব-১৫

0
1722

#ছায়া_হয়ে_থাকবো_পাশে
#Part_15
#Ariyana_Nur

রাতের আকাশে থালার মত মস্ত বড় চাদ উঠেছে। চাদের আলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারোপাশে।চাদের সাথে মিলে পাল্লা দিয়ে আকাশের তারাগুলোও মিটমিট করে জ্বলজ্বল করছে।ব‍্যস্ত এই নগরী আস্তে আস্তে যেন ঘুমপুরীতে রুপান্তিত হচ্ছে।

এক জোরা চোখ অনেকক্ষন ধরে মুগ্ধ নয়নে নুহার দিকে তাকিয়ে আছে।সে আর অন‍্য কেউ নয় সাইফ।
সাইফ ঘুম বাদ দিয়ে নুহার পাশে টুল নিয়ে বসে মুগ্ধ নয়নে সে তার মায়াবী পরিকে দেখে যাচ্ছে।সব কিছু তার কাছে স্বপ্নের মত লাগছে।তার ভাবতেও অবাক লাগছে প্রতিদিন যে মানুষটাকে দেখার জন‍্য ঘুমের দেশে পাড়ি দিত আজ সে মানুষটাকে কাছে পেয়ে ঘুমকে বিদেয় দিয়ে মুগ্ধ নয়নে তার পাশে বসে তাকে দেখে যাচ্ছে।সাইফ মনে মনে আল্লাহ এর শুকরিয়া আদায় করে।যাকে নিয়ে সে কল্পনা করতো আজ আল্লাহ্ তাকে বাস্তবে তার কাছে এনে দিয়েছ।

🌨🌨🌨🌨🌨

নীলাভ বিছানায় শুয়ে শুয়ে ছটফট করছে।কোন ভাবেই শরীর বিছানায় রাখতে পারছে না।পারবে কি ভাবে যে মার পরেছে শরীরে মনে হচ্ছে শরীরের একেকটা হাড়_গোড় ভেঙে গেছে।মাংসগুলো মনে হচ্ছে থেতলে গেলে।জীবনে যে শরীরে একটা ফুলের টোকা পড়েনি সেখানে আজ এতোগুলো মার খেয়ে হজম করতে কষ্ট হচ্ছে নীলাভের।শরীরের ব‍্যথার থেকে রাগে গিজগিজ করছে বেশি নীলাভ।অনেকক্ষন এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি করে কিছুতেই ঘুমোতে না পেরে উঠে বসল নীলাভ।ঘুম না আসার কারনে চোখ দুটো
অনেক লাল হয়ে রয়েছে।নীলাভ বিরবির করে বলতে লাগল…..

—আমার বাড়ি আমার ঘর আমাকেই চোর বানিয়েছে না,ঐ চুরেল কে আমি দেখে নিব।এই নীল কে কথা শোনান।এ নীলাভ চৌধুরীর গায়ে হাত দিয়েছে।সাহস কত বড় ওর। পিচ্ছি একটা মেয়ে এই নীল চৌধুরীকে চোর বানাল আবার উল্টো কথাও শোনান।তাকে তো আমি দেখে নিব।যাষ্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।

ঠিক ধরেছেন আপনারা তখন আশু আর কারো না চোর ভেবে নীলাভের তোরটা বাজিয়েছে😂

ফ্লাশব‍্যাকঃ

নীলাভ সাইফ এর রুমে আশু আর নুহাকে দেখতে এসেছিল।বেডের সামনে এসে দেখে আশু আর নুহা ঘুমাচ্ছে।তাই চলে যাচ্ছিল।কিন্তু হঠাৎ খেয়াল হল বেলকানিতে রাখা খরগোশ এর কথা।তাই ওদিকে পা বাড়াল।

আশু চোর ভেবে এতোক্ষন ঘুমের ভান করে পিটপিট করে তাকিয়ে নীল এর উপর নজর রাখছিল।নীল চলে যেতেই আস্তে করে উঠে গায়ের কম্বল টা হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে বিড়ালের মত পা ফেলে বেলকানির দরজার সামনে দাড়াল।

নীলাভ বেলকানিতে গিয়ে দেখে সাইফ এর খরগোশ দুটো খাচার এক কোনে চুপ করে বসে আছে।নীল খরগোশ দুটোর মাথায় হাত বুলিয়ে পাশের ছোট লাইটা অন করে বেলকানির দরজা চাপিয়ে রুমে ঢুকতে নিলেই আশু কম্বল দিয়ে নীলাভ কে ঢেকে জাপটে ধরে চোর চোর বলে চেচাতে লাগল।

রুনা মাএই আশুর রুমে থেকে ঘর মুছে বের হয়েছে।হাতে তার মপ বালতি।আশুর মুখে চোর চোর শুনে রুনা রুমের ভিতর দৌড়ে এসে দেখে আশু কম্বল দিয়ে একজনকে পেচিয়ে জাপটে ধরে চোর চোর বলে চেচাচ্ছে।রুনা এই দৃশ‍্য দেখে সাথে সাথে বাহিরে দৌড়ে গিয়ে মপ টা হাতে নিয়ে আবার ফিরে আসল।রুনাও এসে নীলাভ কে জাপটের ধরে বলল….

—বউ মনি আমি ধরছি।তুমি এই চোরডারে ইচ্ছা মত ঝাড়ো।
তোমার বেশি শক্তি নাই।তুমি বেশিক্ষন এইডারে ধইরা রাখতে পারবে না।

আশু নীলাভকে ওভাবেই ধরে রেখে বলল…
—তুমি কে??আমাদের বাড়িতে কি করছ???আর কিভাবে ঝাড়বো???

—আমার পরিচয় পরে দিমনে আগে চোরডারে পিডাও।

—হ‍্যা ঠিক বলেছ।কিন্তু কি দিয়ে মারবো???

—এই যে সামনে আমি ঘড় মোছনের লাডি ডা রাখছি তা দিয়া।

আশু আর কোন কথা না বলে মপ এর ডাট দিয়ে ইচ্ছে মত নীলাভকে কেলাতে লাগল।

আর এদিকে নীল হঠাৎ এমন আক্রমণে প্রথমে বেকুব হয়ে গেলেও পরে চেচামেচি করেও এদের সাথে পেড়ে উঠতে পারলো না।এরা ওর কথা না সুনে নিজেরাই বকবক করেই যাচ্ছে।

আশু মারতে মারতে বলল….

—শালা চোর।তোর সাহস তো কম না আমার বাড়িতে তুই চুরি করতে এসেছিস???তোর চুরির সাধ আমি মিটিয়ে দিব।কাজ করে খেতে পারিস না।দেখিস তোর কপালে আস্ত একটা পেত্নী জুটবে,তুই পাজি রাজহাসের দৌড়ানি খাবি,বাচ্চা ওয়ালা মুরগি তোকে ঠোকর দিবে।আমার কথা মিলিয়ে নিস।তুই ড্রেনে পরে হাবুডুবু খাবি।এই আশুর কথা মিলিয়ে নিস।আশু যা বলে তা ভুল হয় না।

রুনাঃআরে বউ মনি জোরে পিডাও।এই বারিতে তো এই চোরের কিছুই হইবো না।

আশুঃদিচ্ছি দিচ্ছি শরীরের সব শক্তি দিয়ে দিচ্ছি।তুমি একটু শক্ত করে শুধু ধরে রাখ।

বেচারা নীল এদিকে আশু আর রুনার সাথে না পেরে দাড়িয়ে দাড়িয়ে মার খেতে লাগলো।কি ভাগ‍্য বেচারার বিয়ের প্রথম দিনই বউ এর হাতের মার জুটল কপালে।

🌨🌨🌨🌨

নিচে বসে সাইফ ওর বাবা মার সাথে কথা বলছিল।উপর থেকে চেচামেচির শব্দ পেয়ে সাইফ উপরে চলে আসে।সাইফ এর রুমের সামনে এসে ভিতর থেকে আশু আর রুনার চেচামেচি শুনে সাইফ তাড়াতাড়ি এসে রুমের লাইট অন করে।লাইট অন করতে দেখে ওরা দুজন একজনকে ইচ্ছে মত ডিটারজেন ছাড়াই ওয়াস করছে।সাইফ চেচিয়ে বলল….

—কি হচ্ছে এখানে???

সাইফ এর গলার আওয়াজ পেয়ে আশু সাইফ এর দিনে না তাকিয়েই বলল…..

—চোর ঢুকেছে আমাদের রুমে।কিন্তু…..

কথাটা শেষ না করেই সাইফ এর দিকে তাকাতেই সাইফকে দেখে অটোমেটিক আশুর হাত থেকে মপটা পরে গেলো।

রুনাও সাইফ কে দেখে নীলকে ছেড়ে দিল।

নীল ছাড়া পেতেই কম্বলটা নিজের উপর থেকে সরিয়ে রাগি গলায় বলল….

—দেখ ভাইয়া এই দুই স্টুপিট আমার কি অবস্থা করেছে।

রুনা নীলকে দেখে হা করে গালে হাত দিয়ে নীলের দিকে তাকিয়ে আছে।

সাইফঃকি হয়েছে রুনা।এভাবে চোর চোর বলে চেচাচ্ছিস কেন???আর নীলের এই অবস্থা কেন???

রুনা কাচুমাচু করে বলল….

—আমার কি দোষ।ছোড বউ মনি চোর চোর চিল্লানি হুইনা আমিও চোর মনে করছিলাম।তাই তো….

আশু এখনও স্টেচু হয়ে দাড়িয়ে আছে।একবার সাইফ আর একবার নীলের দিকে গোলগোল চোখ করে তাকিয়ে অবার মাথা ঘুরে সে নীল এর উপর পড়ে গেল।

আশু নিচে পড়ার আগেই নীল তাকে ধরে ফেলল।

রুনা চিৎকার দিয়ে বলল….

—হায় হায় ছোড বউ মনি দেহি অজ্ঞান হইয়া গেছে।ছোড দাদা বউ মনিরে পাজা কোলে নিয়া বিছানায় শোয়ান।

নীল রেগে রুনার দিকে তাকিয়ে বলল…..

—এতোক্ষন যেই মার মেরেছিস তোর কি মনে হয় এই শরীর নিয়ে আমি এই ময়দার বস্তারে বিছানা পযর্ন্ত নিতে যেতে পারবো।

রুনাঃকন কি দাদা।ছবিতে তো দেহি নায়কেরা মাইর খাইয়াও নাইকারে কোলে নিয়া কই থিকা কই জায়গা।আপনে এতটুক পারবেন না।আর আপনের চোখে কি হইছে।আমগো পুতুলের মত বউমনিরে ময়দার বস্তা কইতাছেন??আপনের থিকা তো আমারো শক্তি বেশি।আমিই তো তারে কোলে নিতে পারুম।

নীল রুনা দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাতে দাত চেপে বলল…..

—তাহলে দাড়িয়ে আছিস কেন।এই ময়দার বস্তাটাকে আমার উপর থেকে সড়া।

রুনাও ভাব দেখিয়ে আশুকে কোলে নিয়ে নিল।নুহার পাশে না শুয়িয়ে আশুকে পাশের রুমে নিয়ে গেল।

রুনা চলে যেতেই নীল সাইফ এর দিকে তাকাতেই দেখল সাইফ মিটমিট করে হাসছে।সাইফকে হাসতে দেখেই নীল আরো রেগে গেল।কিছু না বলেই নিজের রুমে গিয়ে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিল।

এদিকে যে রুমের মধ‍্যে এতো কিছু হয়ে গেল সেদিনে নুহার কোন খবরও নেই।খবর থাকবেই কি করে তাকে তো ঘুমের ইনজেকশনের দিয়ে ঘুমের দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে।

🌨🌨🌨🌨🌨

আশুর চোখে মুখে পানির ছিটে পরাতেই চোখ মেলে তাকালো।সামনে সাইফ কে বসে থাকতে দেখে ধরফর করে উঠে নিজের হাতে নিজেই চিমটি কেটে আহ্ শব্দ করে অবাক হয়ে বলল….

—তার মানে আমি এতোক্ষন স্বপ্ন দেখছিলাম না!!!যা হয়েছে সব সত্যি!!!

সাইফঃতুই ঠিক আছিস পিচ্ছি???কিসের স্বপ্নের কথা বলছিস???

আশু সাইফ এর কথা শুনে কতক্ষন সাইফ এর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ফুপিয়ে কান্না করতে লাগল।আশুকে কান্না করতে দেখে সাইফ আশুর মাথায় হাত রেখে বলল…

—কি হয়েছে পিচ্ছি???এভাবে কান্না করছিস কেন???

আশু ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলল…

—আই…এম সরি ভাইয়া।আমার ফেমেলি এমন দেখে কখনো তোমাকে আমার ফেমেলির ব‍্যপারে কিছু বলিনি।কিন্তু বিশ্বাস কর আমার আপি অনেক ভাল।আমার আপি দুনিয়ার বেষ্ট আপি।আমি….আমি…..

—চুপ!তোকে কিছু বলতে হবে না।আমি সব জানি।আর জেনে সুনেই সব করেছি। সরি তো আমার বলা উচিত তোর অনুমতি না নিয়েই তোকে আমি আমার ভাই এর সাথে বেধে ফেললাম।দেখ এই ছাড়া আমার কোন উপায় ছিল না।আমাকে ভুল বুঝিস না পিচ্ছি।সাইফ একে একে আশুকে সব বলল।সব শুনে আশু বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছে।

সাইফ আশুর মাথায় হাত রেখে বলল….

—তখন একজন ভাই হিসেবে আমার যেটা ভালো মনে হয়েছে সেটা করেছি।পারবিনা তোর এই ভাইকে ক্ষমা করতে???

আশু ছলছল চোখে সাইফ এর দিকে তাকিয়ে থেকে ওকে জরিয়ে ধরে কান্না করতে লাগল।সাইফ ও কিছু না বলে মাথায় হাত বুলাতে লাগল।

আশুর মনে হচ্ছে আজ ও সত‍্যি কারের একটা ভাই পেয়েছে।আর নুহার জন‍্য আল্লাহ এর কাছে প্রতিনিয়ত যে দোয়া করত তা আল্লাহ কবুল করেছে।আশু মনে মনে আল্লাহ্ শুকরিয়া আদায় করল।

🌨🌨🌨🌨

আশু চুপ করে বিছায়ান বসে আছে।একটু আগে মিসেস চৌধুরী এসে ওকে আদর করে খাইয়ে দিয়ে গেছে।তার ব‍্যবহারে আশুর মনেই হয়নি আশুর আজ তার সাথে প্রথম দেখা হয়েছে।

সাইফ হাতে মেডিসিন নিয়ে আশুর রুমে এসে বলল….

—এই ঔষধ গুলো খেয়ে নিস।আর রাতে কোন সমস‍্যা হলে জানাস।আমি পাশের রুমেই আছি।

আশু মাথা নাড়িয়ে হ‍্যা বলল।

সাইফ চলে যেতে নিলেই আশু ডাক দিয়ে বলল….
—ভাইয়া…

সাইফ ফিরে এসে আশুর সামনে দাড়িয়ে বলল….
—কিছু বলবি???

—আপি….

—ও ঘুমোচ্ছে।সকালের আগে মনে হয় না ঘুম ভাঙবে।তুই চিন্তা করিস না ঘুমা।

আশু গম্ভীর হয়ে বলল….
—একটা কথা ছিল???

সাইফ হাত ভাজ করে সাভাবিক ভাবে দাড়িয়ে বলল….
—বল কি বলবি।

—আমাকে না হয় মামার হাত থেকে বাচাতে তোমার ঐ নীলের ডিব্বা ভাই এর সাথে বিয়ে দিয়ে দিলে।কিন্তু আপিকে কেন এতো কাহিনী করে বিয়ে করলে???তার মানে কি তুমি আপিকে…..

ওকে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়ে সাইফ মুচকি হেসে ওর মাথায় হালকা চটি মেরে যেতে যেতে বলল….

—অনেক রাত হয়েছে।কথা বন্ধ করে ঘুমা তাড়াতাড়ি।

সাইফ এর এমন রিয়েক্ট দেখে আশু খুশিতে আত‍্যহাড়া হয়ে গেলো।

#চলবে

(ভুলক্রটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।ধন‍্যবাদ)