#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ২৬)
নুসরাত জাহান লিজা
খানিকটা সুস্থির হয়েছিলেন আজমল সাহেব। কিন্তু সকাল থেকে উত্তেজনা অনুভব করছিলেন। নির্বাচন শুরু হয়েছে। কিন্তু এমন অসহায় অবস্থা এর আগে অনুভব করেননি। মিডিয়া আজ আরও তোলপাড়। বুকে আবারও ব্যথা অনুভব করছেন তিনি।
দুপুরের পরে একসাথে জীবনের সবচাইতে খারাপ দুটো খবর শুনলেন। নির্বাচনে তার ভরাডুবি হতে যাচ্ছে এটা তো অনুমেয় ছিলই, সাথে তাকে দল থেকে অব্যহতি দেয়া হয়েছে। এই যে হাসপাতালে শুয়ে আছেন, তার পাশে নিজের এতদিনের বিশ্বস্ত কিছু সাগরেদ ছাড়া অন্য কেউ নেই। স্ত্রী একবারও আসেননি তাকে দেখতে। নিজের চাহিদার বেশি পেয়েছেন সবসময়, সাথে স্বামীর ক্ষমতার দর্প। তাই নিজের মতোই থেকেছেন। পাশাপাশি থেকে দুজন সরে গেছেন যোজন যোজন দূরত্বে।
আজমল খানের মনে হলো এই যে তিনি জীবনে এতকিছু করলেন, তার তো আসলে প্রাপ্তি বলতে সমস্ত শূন্য, এ বিগ জিরো। স্বাচ্ছন্দ্যে চলার জন্য জীবনে যতটুকু প্রয়োজন তারও অনেক বেশির পেছনে তিনি আজীবন ছুটেছেন। তার মনে হলো এর শাস্তি তিনি শ্বাস চলমান অবস্থায়ই পেলেন।
তার মনে হচ্ছে তার সময় যেন শেষ হয়ে আসছে, এই সময় তার কোনো আপন মানুষ পাশে নেই। তার জন্য একফোঁটা চোখের জল কারোর পড়বে না। এরচাইতে বড় শাস্তি মানুষের জীবনে আর কী হতে পারে। এত অর্জন যদি প্রয়োজনেই না লাগে, তবে সমস্তই যেন বৃথা, অর্থহীন।
বুকে ব্যথা ক্রমশ বাড়ছিল তার, মনে হচ্ছিল একটা ভালো কাজ অন্তত করতে। হাসানকে নিষেধ করতে চাইছিলেন। কিন্তু আশেপাশে নিজের মোবাইলটা কোথাও দেখলেন না। তিনি প্রাণপণে চিৎকার করতে চাইলেন, কিন্তু গোঙানির শব্দ বের হলো। বুকের একপাশে হাত দিয়ে চেপে ধরলেন, শ্বাস আটকে আসছে। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। শুধু একবার মনে হলো, সমস্ত কর্ম ইরেজার দিয়ে মুছে জীবনটা যদি একবার নতুন করে শুরু করা যেত!
উপলব্ধিটুকু হলেও আত্মশুদ্ধির সময় তিনি পেলেন না। পৃথিবীতে তার যাত্রা এটুকুই ছিল।
***
হাসান গতকাল থেকে সুযোগ খুঁজছিল, রবিনের পরিবারের অন্তত একজনের হলেও যেন চরম ক্ষতি করা যায়। নিজের জীবন গুছিয়ে সে বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠেছিল আজমল খানের মতো মহীরুহের। তার জন্য কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি তাকে। মহীরুহকে আশ্রয় করে সে হয়ে উঠেছিল ত্রাস। কিন্তু মহীরুহই যখন উপড়ে গেছে, সে-ও এখন উদ্বাস্তু। আজমল খান হাসপাতালে, বেঁচে ফিরবে কিনা ঠিক নেই, বাঁচলেও তিনি এখন একজন সাধারণ মানুষের মতোই মূল্যহীন।
নতুন আরেকটা আশ্রয় হাসান আবার কতদিনে পাবে! ওই আফনান তাকে একেবারে নিঃস্ব করে দিয়েছে। অনেক মাথা খাটিয়ে সে দেখল, সদ্যোজাত শিশুটাই সকলের কেন্দ্রবিন্দুতে। প্রতিপক্ষকে ভেঙে দেবার মোক্ষম টার্গেট।
হাসানের চাপদাড়ি আর গোঁফ ছিল, গতকাল রাতে সব কেটে ফেলেছে। বেশ পরিবর্তন করে নিজের হাঁটাচলা অবধি পাল্টে ফেলেছে। এখন খুব বেশি পরিচিত কেউ ছাড়া তাকে কেউই চিনবে না। সে সকাল থেকে হাঁটাহাঁটি করছে শায়লার কেবিন যেই ফ্লোরে, তার আশেপাশে। সাথে একজন মহিলাকে জোগাড় করেছে, সে-ও তার দলেরই একজন কর্মী। ভাবখানা এমন যে এই ফ্লোরে তাদের কোনো একজন আত্মীয়ের সন্তান হয়েছে, তারা দেখতে এসেছে।
ওদের সিকিউরিটির খানিকটা ঢিলেমির জন্য, একসময় সুযোগ এলো। পকেটে হাত দিয়ে ছু রিটার অস্তিত্ব আরেকবার পরীক্ষা করে নিল। এরপর ঢুকে পড়ল কেবিনে।
***
আফনান গতকাল থেকেই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে হতে ঠিকমতো বিশ্রামও জোটাতে পারেনি। একেক চ্যানেল থেকে আসছিল, নিলয়ের হস্তক্ষেপে সেটা একটা প্রেস কনফারেন্স হিসেবে করা হয়েছে। তবুও তাদের এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ লাগবে। পুলিশের চুলচেরা জেরা তো আছে। কিছু সাংবাদিকের প্রশ্ন আবার ভীষণ আপত্তিকর। প্রশ্ন শুনে মেজাজের পারদ চড়ে যায়। সে বিরোধী দলের সাথে আঁতাত করে কোনো ষড়যন্ত্র করেছে কিনা, কারণ নির্বাচনের সময়েই এমন একটা ঘটনা।
আফনান চেষ্টা করেছে মেজাজ না হারিয়ে জবাব দিতে। এখন আবার থানায় এসেছে শফিককে সাথে নিয়ে। শাফকাত সাথে ডেকেছেন।
***
নীরা আয়েশাকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে বিশ্রাম নেবার জন্য। তিনি আসতেন না, কিন্তু দুপুরের খাবারের বন্দোবস্ত করা দরকার বলে চলে এসেছেন। নিজের হাতে রান্না করে খাবার নিয়ে ফিরবেন।
রবিনকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে অন্য ওয়ার্ডে দেয়া হয়েছে। অনেকরকম শারীরিক আর মানসিক ধকল গেছে ওর। এই মুহূর্তে পরিপূর্ণ বিশ্রাম আর নিরবচ্ছিন্ন ঘুম না হলে মানসিকভাবে বড় ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। নীরা শায়লার সাথে আছে। বাচ্চার গায়ে লাল লাল কিছু একটা যেন উঠেছে। ভীষণ কাঁদছিল। সে এসেছিল একবার ডাক্তারকে বিষয়টা জানাতে। যদিও আসতে চাইছিল না, কিন্তু শায়লা জোর করে পাঠাল। বাচ্চার কান্নায় বেচারি কষ্ট পাচ্ছে।
সিকিউরিটির দুইজনের একজন গিয়েছে চা খেতে, আরেকজনের চোখে তন্দ্রা এসে পড়ায় বসে গা এলিয়ে দিয়েছিল। তারা তেমন সন্দেহজনক কিছু দেখেনি বলে খানিকটা গা ছাড়া ভাব চলে এসেছিল। এই সুযোগে ভেতরে এলো কেউ একজন।
শায়লার চোখে পড়তেই সে চিৎকার করল, “কে আপনি?”
হাসান এগিয়ে এলো দ্রুত। হাতে বেরিয়ে এসেছে ছু রিটা।
……….
ক্রমশ
#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ২৭.১)
নুসরাত জাহান লিজা
নীরা শায়লার কেবিনের কাছে আসতেই আর্তচিৎকার শুনতে পেল। তড়িঘড়ি করে ভেতরে ঢুকতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালো। মুখে মাস্ক পরা একটা লোক শায়লার বেডের খুব কাছাকাছি। হাতে একটা ছু রি। উদগ্র চিৎকার প্রাণপণে অনবদমিত করল নীরা। ওর নার্ভ ভীষণ শক্ত। তাই এমন ভয়ার্ত মুহূর্তেও মাথা কাজ করছিল। ওর উপস্থিতি জানান দিলে মুহূর্তেই একটা অঘটন ঘটাতে পারবে লোকটা। নীরার তখন কিছুই করার থাকবে না।
সময় নেই দ্রুত ভাবতে ভাবতে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিল নীরা। তেমন কিছু চোখে পড়ল না, তবে ওর হাতে সদ্য কেনা ওষুধের বোতল। ছোট কিন্তু ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পারলে কার্যকর। পা টিপে টিপে সে এগিয়ে গেল আততায়ীর ঠিক পেছনে। এই সময়জুড়ে মনে মনে সে কেবল আল্লাহকে ডেকে গেছে।
শায়লা তখনও চিৎকার করছিল। লোকটা হিসিয়ে উঠে বলল, “চুপ। তোরে কিছু করব না, ওই পিচ্চিটারে, চিক্কুর দিলে কিন্তু…”
হুমকি ধামকি দিতে থাকা আততায়ী পেছনে নীরার উপস্থিত সম্পর্কে অবগত নয়। তবে এবার জানানোর সময় আসন্ন। ছোট্ট বোতলটাকে কাজে লাগাতেই হবে। ওইটুকু প্রাণ, তার সাথে এদের কীসের শত্রুতা! যে এখনো পৃথিবীর আলো-বাতাসই ঠিকঠাক অনুভব করেনি!
আল্লাহর নাম আরেকবার নিয়ে নিচু হলো নীরা, ওষুধের বোতলটা সজোরে মা র ল ফ্লোরে। এরপর ত্বরিত বেগে মাথা সোজা করল। ততক্ষণে ওর দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে লোকটা। আর কোনোকিছুই চিন্তা করার জন্য সময় নিল না নীরা। ভাঙা বোতলটা এখন ধা রা লো অ স্ত্র। সেটা সোজা বসিয়ে দিল লোকটার ঘাড়ের উপরে। খানিকটা গাঁথল ওটা।
লোকটার চোখে বিস্ময়, তবে সেও ছু রি বাগিয়ে এবার নীরাকে টার্গেট করছিল, কিন্তু এই অতর্কিত আক্র মনের জন্য লোকটা একেবারেই প্রস্তুত ছিল না, উপরন্তু আঘাতের কারণে খানিকটা বিপর্যস্ত। নীরা আপার হ্যান্ডে আছে৷ সে লোকটার হাঁটু বরাবর লাথি কষালো। লোকটার হাত থেকে ছু রিটা নিচে পরে গেল, কিন্তু ভারসাম্য পুরোপুরি হারালো না৷
নীরা আরেকবার পা দিয়ে লা থি কষালো। এবার লোকটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। তবে সে-ও মরিয়া। হাসান এবার হাত দিয়ে ধাক্কা দিল নীরাকে। সে পড়ে গেল, ওর হাত গিয়ে পড়ল ছুরির উপরে৷ খানিকটা কে টে র ক্ত পড়ছে। সেদিক নীরা ভ্রুক্ষেপ করল না। ওই হাতেই তুলে নিল ওটা।
হাসান ততক্ষণে সামলে নিয়েছে। নীরাও উঠে বসেছে ততক্ষণে। শায়লা ততক্ষণে ধাতস্থ হয়ে মোবাইল তুলে নিয়ে কল করেছে সিকিউরিটির একজনকে। দুইজনের নাম্বার ওর ফোনে আজ সকালেই সেভ করে দিয়েছিল আফনান।
নীরার সাথে ধ স্তা ধ স্তি চলছিল, তবুও ছু রি টা সে হাতছাড়া করছে না। সে জানে এটা হাতছাড়া করলে মৃ ত্যু অবধারিত।
যখন হাতে ঢিলে পড়ল ঠিক তখনই কয়েকজন ভেতরে এলো। ধরা পড়ল হাসান। নীরা ততক্ষণে ঘেমে নেয়ে একাকার। এতক্ষণ সাহস নিয়ে লড়লেও এবার শরীর এলিয়ে দিল। ভীষণ ধকল গেছে। হাতে ফিনকি দিয়ে র ক্ত পড়ছিল তখনো।
শায়লা ওভাবেই জড়িয়ে ধরল নীরাকে। কাঁদছে। সে নিজের জন্য ভয় পাচ্ছিল না একবিন্দু। কেবল নাড়িছেঁড়া সন্তানের জীবনের আশঙ্কায় সে শেষ হয়ে যাচ্ছিল। এরপর নীরার ওই অবিশ্বাস্য দুঃসাহসিক কাণ্ড। অল্প কয়েক মিনিটে কত কী ঘটে গেল। নীরার কাছে সে সারাজীবনের জন্য কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেল। এখনো হৃদযন্ত্র প্রবল ছুটছে।
নীরাও কাঁদছে এতক্ষণে। একজন সদ্য মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়া মায়ের জন্য কিছু করতে পেরে এক অদ্ভুত ভালোলাগায় ওর চোখে জল গড়াচ্ছে। দুটো ভিন্ন সত্তার দুইজন রমনীর অনুভূতি আজ যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল!
……..
#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ২৭.২)
নুসরাত জাহান লিজা
আফনানের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হবার পর সেই সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ নীরা নিজেকে বের করে আনার জন্য নানারকম ভাবে নিজেকে গড়ে নিতে চেয়েছে। পড়াশোনা তো ছিলই, এর সাথে নিজের মনোবল বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন কাজে নিজেকে সংযুক্ত করেছিল। তার মধ্যে একটা ছিল আত্মরক্ষার কৌশল রপ্ত করার চেষ্টা। গান, আবৃত্তি, মাছ ধরা থেকে শুরু করে পাখি শিকার পর্যন্ত আয়ত্ত করেছিল। তবে আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে কারাটে খুব একটা রপ্ত হয়নি। কারণ এটায় তখন পুরোপুরি আগ্রহ হয়নি। তবে মাস দুয়েকের চেষ্টায় প্রাথমিক কিছু বিষয় সে নিজের মধ্যে ধারণ করেছিল। তার মধ্যে প্রথম ছিল, যেকোনো পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে ভেঙে না পড়ে সেই অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া দেখানো। সেই কৌশল ভীষণ ভাবে কাজে লেগেছে আজ৷
এছাড়া ওর এই অসম্ভব ভালো রেজাল্টের ক্ষেত্রে ওর লেগে থাকা পরিশ্রম তো ছিলই, পাশাপাশি সে কখনো গ্রন্থগত বিদ্যায় নিজেকে বেঁধে রাখেনি। সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত ক্ষুরধার মেধাকে সে ঝালাই করেছে প্রতিনিয়ত। শেখা কৌশলের সাথে ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তা আর আল্লাহর রহমত ওকে জিতিয়ে দিয়েছে আজ।
সকলেই ওকে এপ্রিশিয়েট করেছে। একমাত্র আফনানের সাথে এখনো কথা হয়নি। নীরা অবশ্য ওকে দেখানোর জন্য কিছু করেনি, সহজাত মানবিক প্রবৃত্তির জোরেই সে এমন ঝুঁকি নিয়েছিল।
আফনান ওর দিকে একবার গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। নীরা সেই দৃষ্টিতে যেন অনেককিছু দেখেছে। আস্থা, শঙ্কা, শ্রদ্ধা সাথে আর কী যেন! খানিকটা দুর্বোধ্য হলেও নীরা যেন পড়তে পারল সেই দৃষ্টির অব্যক্ত ভাষা! তবুও মুখে শুনতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু এটা যে সম্পূর্ণ বৃথা, তা-ও ভালো করে বুঝতে পেরেছিল আফনান হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যেতে। ছেলেটা এখনো নিজেকে লুকাতে মরিয়া! নীরাও আর মুখে কিছু বলতে চায় না। নিজেকে সে এরমধ্যে প্রকাশ করে ফেলেছে, আর নয়। এবার কেবলই শুনতে চায়। যা শুনতে ওর এত এত প্রতীক্ষা!
যদি না শুনতে পায়, তবে নিজের ব্যর্থতা মেনে নিয়ে সে ফিরে যাবে বহুদূরে। আর কখনো কোনো দাবি নিয়ে আফনানের মুখোমুখি সে দাঁড়াবে না। ওর আত্মমর্যাদা ওর সামনে একটা অদৃশ্য অথচ দুর্ভেদ্য দেয়াল তুলে দিল। ওপাশ থেকে আফনান কড়া নাড়লেই কেবল সে দুর্ভেদ্য দেয়ালের দরজা খুলে দেবে, নয়তো নয়। কক্ষণো নয়!
***
আফনানের ব্যস্ততা বাড়ছিলই। নিজেকে নিয়ে ভাববার অবকাশ একেবারেই পাচ্ছিল না। গত রাতে হাসপাতালে ফিরে সে সমস্ত খুঁটিনাটি বিবরণ শুনেছিল। সাহস করে নীরার সাথে কথা বলতে পারেনি। একটা অবর্ণনীয় ভয় ওকে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরেছিল।
তাছাড়া কী-ই বা বলত সে! মুখে ধন্যবাদ সে বলতে চায় না। এটা তো কেবলই এক সৌজন্যতা। ভেতরের আন্তরিকতা তাতে প্রকাশ পায় না। নীরা তো নিজের জীবন বাজি রেখেছিল। তার বিনিময়ে একটা ধন্যবাদ কিংবা দুটো আন্তরিক বাক্যের কী এমন সাধ্য যে এত আত্মত্যাগের মূল্য দিতে পারে! বরং সময় এলে সে-ও নাহয় নিজের জীবন বাজি ধরেই নিজেকে প্রকাশ করবে।
আফনান জানে না, ভালোবাসায় আসলে শোধবোধ বলে কিছু নেই। ভালোবাসায় উভয়পক্ষ হতেই কিছু ঋণ থেকে যায়। ভালোবাসার ঋণ শোধ করতে গেলে ভালোবাসা-ই হয়তো একসময় ফিঁকে হয়ে যায়।
রাতে নীরা আফনানের বাড়িতে যায়নি। হাসপাতালে শায়লার সাথেই থেকেছে। আয়েশার প্রেশার বেড়ে যাওয়ায় তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। কেবিনে দুটো বেডের একটিতে ক্লান্ত নীরা ঘুমিয়েছিল। আজ বাইরে আরও একজন বেড়েছে নিরাপত্তা দেবার জন্য। আফনানও ছিল। সে কেবিনের বাইরে অনেকক্ষণ পায়চারি করে ভেতরে এসেছিল। একটায় শায়লা ঘুমিয়ে আছে সদ্যোজাত সন্তানকে নিয়ে।
অন্যটায় নীরা। আফনান নীরার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল, ক্ষণ যেন থেমে গিয়েছিল ওর। ঘুমন্ত নীরার মুখে ক্লান্তির সাথে কী যেন এক বিষণ্ণতার ছাপ! গভীর চোখ দুটো বন্ধ হলেও অদ্ভুত মায়া যেন ওকে টানছিল। নীরার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ানোর দুর্দমনীয় ইচ্ছেকে আফনান প্রবল মনোবলে রুখে দিয়েছে।
এক পৃথিবী ভালোবাসার সাথে সাথে সেখানে একরাশ শ্রদ্ধা এসে মিলেমিশে আজ আফনানকে যেন ভাসিয়ে নিয়ে গেল। দুর্বোধ্য এই রমণীকে আজ মা আর শায়লার পাশাপাশি হৃদয়ের একটা অংশ বলে মনে হলো। নিজের সংযম পাছে ভেঙে পড়ে, সেই ভয়ে সে বেরিয়ে এলো। যদি এমন কিছু করে বসে, তাহলে আর কোনোদিন মেয়েটাকে নিজের মুখ দেখাতে পারবে না! ভয়ে আর একবারও ভেতরে গেল না। পুরো রাত কেবিনের বাইরে বসেই কাটিয়ে দিলো।
যদি নীরার কিছু হয়ে যেত, সে কীভাবে নিলয়কে মুখ দেখাত! ওদের ভরসায় তো বোনকে এখানে রেখে গেছে। হাসানের ছু রি টা যদি নীরাকে বিদ্ধ করত, কিংবা শায়লা আর ওর সন্তানকে! ভয়ের চোরাস্রোত বয়ে গেল আফনানের শিরদাঁড়া বেয়ে। নিলয় আর নীরার দুই ভাইবোনের কাছে অনবরত যেন ঋণের পাহাড় জমে যাচ্ছে ওর।
সকাল হতেই বিজয়ী নতুন পার্লামেন্ট সদস্য নিজে এসেছেন আফনানের সাথে দেখা করতে।
“তোমার মতো তুখোড় আর সৎ ছেলেদের বেশি বেশি রাজনীতিতে আসা উচিত। তাহলে দেশের কল্যাণ হবে। আমার দ্বার তোমার জন্য উন্মুক্ত রইল।”
আফনান সবিনয়ে বলল, “আমি সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হতে চাই না। তবে যদি দেশের জন্য সত্যিই কোনো উপকারে আসে, এমন কোনো কাজে ডাকলে আমি অবশ্যই সাথে থাকব নিজের যতটুকু সাধ্য আছে ততটুকু নিয়ে।”
তিনি তার বহর নিয়ে বেরিয়ে গেছেন এরপর।
নিলয় আসছে আজ। গতকালই আসত। কিন্তু ওর না নাকি আসার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন নীরার কাণ্ড শুনে। তাই বাড়ি গিয়ে মাকে সাথে নিয়ে সে আসছে। আসতে আসতে দুপুর গড়িয়ে যাবে।
যেহেতু এই কেসে পলিটিক্যাল ইনভলভমেন্ট রয়েছে, এবং দেশজুড়ে এর রেশ ছড়িয়ে পড়েছিল, তাই ওর দৌড়াদৌড়ি বেশি করতে হচ্ছে। পুলিশ, উকিল, কোর্ট, সাংবাদিক, স্যোশাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার, নতুন গজিয়ে উঠা অখ্যাত পোর্টালের নামধারী সাংবাদিক সব একসাথে সামাল দেয়া ভীষণ ক্লান্তিকর। তাই সেভাবে সুযোগও হচ্ছে না আলাদা করে নীরার সাথে কথা বলার।
তবে সে উপলব্ধি করছে নীরাকে ছাড়া থাকতে গেলে ওর হৃদয়ের একটা অংশ টুকরো করে ফেলতে হবে। তাতে যে রক্তক্ষরণ হবে, তা রোধ করার সাধ্য আর শক্তি কোনোটাই আর আফনানের মধ্যে অবশিষ্ট নেই। এবার ধরা দিতেই হবে ওর, নীরার কাছে। বাঁধা তো পড়েই গেছে, এবার ঠিক করল নীরা ফেরার আগেই সে ধরা দেবে।
***
রোকেয়া ভীষণ জেদ করেই নিলয়কে বাধ্য করেছেন সাথে নিয়ে আসতে। তিনি বলেছিলেন, “তুই না নিয়ে গেলে আমি সায়মনকে সাথে নিয়ে যাব। এটা কি ভালো দেখাবে?”
নিলয় আর কিছু বলেনি। মায়ের মনোভাব ওর ভালো লাগছে না। মনে মনে একটা অশনি সংকেত পাচ্ছে নিলয়। একটা ঠিক হচ্ছে তো, অঅন্যদিক থেকে সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
আফনান ওর প্রাণের বন্ধু, আত্মিক এক টান অনুভব করে সে বন্ধুর জন্য। অপরদিকে নীরাকে অসম্ভব ভালোবাসে। দুই ভাইবোনের মধ্যে চমৎকার একটা বোঝাপড়া সবসময় ছিল। আর বিপরীতে দাঁড়িয়ে মা। যে ওকে সমস্ত কিছুর চাইতে বেশি ভালোবাসেন। ওর কোনদিকে যাওয়া উচিত!
আনিকাও পুরোদমে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। দু’দিন পরেই রাজশাহী চলে যাবে। সামনে আরেকটা বড় প্রলয়ের আঁচ সে পাচ্ছে, কী করে সব দিক সামলাবে, নিলয় জানে না। শুধু মাকে একবার বলল,
“মা, ওখানে আফনানের সাথে ওর পরিবার আছে। তুমি প্লিজ তাদের অসম্মান কোরো না।”
রোকেয়া আহত দৃষ্টিতে একবার ছেলেকে দেখেছেন কেবল। কিছু বলেননি।
***
আজ শায়লাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়া হয়েছে। ওর বাসায় আসার খানিক বাদেই নিলয় আর তার মা এসে পৌঁছুলেন।
আয়েশার সাথে বেশ সাবলীলভাবেই রোকেয়া মিশলেন। শায়লার সাথেও কথা বললেন, তার মেয়েকে কোলে নিয়ে দোয়াও করলেন। এরপর নীরার অনুপস্থিতিতে তিনি আফনানকে বললেন,
“বাবা, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। খুব জরুরি। কথাগুলো শুধু তোমাকেই বলা প্রয়োজন। তোমার সময় হবে?”
আফনান দ্বিধা নিয়ে বলল, “জ্বি আন্টি।”
এরপর দুজনের প্রায় মিনিট পনেরোর একটা বৈঠক চলল। বলাই বাহুল্য, সেটা আফনানের জন্য মোটেও সুখকর নয়।
……..
(ক্রমশ)