জোনাকি প্রদীপ পর্ব-২৮+২৯

0
276

#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ২৮)
নুসরাত জাহান লিজা

“বাবা, আমি তোমাকে স্নেহ করি, নিলয়ের বন্ধু হিসেবে। এটা নিয়ে তোমার কোনো দ্বিমত আছে?”

আফনান বলল, “না আন্টি।”

“আমার ছেলেমেয়ে দুটোই ভীষণ আবেগী। তাই ওদের মা হিসেবে আমাকে বাস্তবতা নিয়ে ভাবতে হয়। ওদের অবুঝ আবেগকে আমি প্রশ্রয় দিতে পারি না, তাই না?”

আফনান বুঝতে পারছে আলোচনা কোন পথে যাচ্ছে। সে উত্তর দিল না। রোকেয়াও অবশ্য উত্তরের আশা করেননি। কেবল অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে ওকে পর্যবেক্ষণ করলেন। এরপর দৃষ্টি না সরিয়েই বললেন,

“ছেলেমেয়ের জন্য ভালো চাওয়াটা নিশ্চয়ই তোমার চোখে অন্যায্য নয়?”

আবারও প্রশ্ন। অকাট্য যুক্তি। আফনান তাই তা খণ্ডনের চেষ্টা করল না।

“শুধু আবেগে ভেসে জীবন চলে না। বাস্তবতা ভীষণ কঠিন। একসময় চোখের পর্দা সরে যায়, আবেগ তখন ঠুনকো মনে হয়। একসময় যেই আবেগের স্রোতে ভেসে যেতে ইচ্ছে হয়, তখন সেই আবেগকেই মনে হয় মস্ত একটা ভুল। কেন আরেকটু যুক্তি দিয়ে ভাবা হয়নি সেই নিয়ে আফসোস হয়। জীবনের কাছে আরেকটা সুযোগ চাইতে ইচ্ছে করে। কিন্তু জীবন তাকে আর সেই সুযোগ দেয় না। সম্পর্ক ভেঙে যায়।”

আফনানের চোখে পাঁচ বছর আগের আর সেদিনের নীরার মুখচ্ছবি ভেসে উঠল। সেখানে কেবলই নিছক আবেগ ছিল না। আরেকটা বিষয় ছিল, তা হলো প্রলয়ঙ্কারী ভালোবাসা। আবেগের নদী শুকিয়ে যায়, কিন্তু ভালোবাসা মরা নদীতেও জোয়ার তুলতে সক্ষম। সেটা মরুভূমি হয়ে যাওয়া এতটাই সহজ! নয় নিশ্চয়ই। তাই এবার প্রথম আফনান উত্তর দিল,

“আন্টি, আপনার কথা সত্যি। তবে কিছু আবেগ কখনো ঠুনকো হয় না বোধহয়। কিছু সম্পর্ক হয়তো টেকে না। আমার মা তার জীবন দিয়ে বুঝেছে। কিন্তু তবুও কিছু মানুষ বছরের পর বছর একসাথে এক ছাদের নিচে কাটিয়ে দেয়। সেটা কি নিছকই আবেগের বশবর্তী হয়ে?”

রোকেয়া ক্ষণেকের জন্য থমকালেন। এরপর বললেন, “একসাথে সংসার করতে গেলে শুধু ভালোবাসা যথেষ্ট নয় বাবা। সেখানে আরও অনেক অণুসঙ্গ প্রয়োজন হয়। সেটা হলো নিরাপত্তা। অর্থনৈতিক নিরাপত্তার পাশাপাশি সুখের নিশ্চয়তা, জীবনের নিরাপত্তা। তুমি চাইলেও নীরাকে সবটুকু দিতে পারবে না।”

“কেন পারব না আন্টি?”

“আমি সেসব বলে তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না।”

“আমি শুনতে চাই আন্টি।” দৃঢ় অথচ ভীষণ কাতর গলায় বলল আফনান।

“তুমি বুদ্ধিমান ছেলে আফনান। এই কদিনে যা করেছ, তা রীতিমতো সাহসিকতা। তবুও তুমি নিজেই জানো ছেলেবেলায় তোমরা কী ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছ। আমি চাই না আমার মেয়ে সেসবের আঁচ পাক। তোমার মায়ের স্ট্রাগলকে আমি সম্মান করি। তবুও সমাজ নিয়ে চলতে হয়। তোমার বাবা একজন প্রতারক। তোমার শরীরে যেমন তোমার মায়ের রক্ত আছে, তেমনি তোমার বাবার রক্তও আছে। তুমি অস্বীকার করলেও আছে। তুমিও যে কখনো তোমার বাবার মতো কাজ করবে না, সেটার নিশ্চয়তা কী?”

আফনান প্রচণ্ড অসহায়বোধ করল। ওর সবচাইতে স্পর্শকাতর অংশে আঘাত করেছেন রোকেয়া। যে লোকের সাথে কথা বলতেও ওর ঘৃণা হয়, যে লোকের জন্য ওর মায়ের জীবন শেষ হয়ে গেছে, সেই লোকটা শুধুমাত্র জন্ম দিয়ে ওর বাবা হয়ে বসে আছে। না থেকেও ওর ভালোলাগা বেছে নেবার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে, সম্ভব হলে সে শরীর থেকে ওই জঘন্য মানুষটার রক্ত ধুয়ে মুছে বের করে দিত।

আফনান মনেপ্রাণে তো কবেই সমস্ত ধুয়েমুছে দিয়েছে, সে কেবলই তার মায়ের সন্তান।

“আন্টি, আপনি বললেন আমার মায়ের রক্তও আমার মধ্যে আছে। তবে সেটার প্রতি ভরসা রাখতে পারেন না?”

“পারি না। কোনো বাবা মা এমন অনিশ্চয়তা নিয়ে মেয়ের হাত তুলে দেয় না। একটা বিশ্বস্ত হাত খুঁজে নেয়।”

“আমি আমার মায়ের শিক্ষায় বড় হয়েছি আন্টি। তার শিক্ষা, বিশ্বাস এক মুহূর্তের জন্য মুখ থুবড়ে পড়ে, এমন কিছুই আমি কোনোদিন করব না। এই নিশ্চয়তা আমি আপনাকে দিতে পারি।”

“তুমি যখন বাবা হবে তখন আমার কষ্টটা বুঝতে পারবে আফনান। আমি তোমার চাইতে বয়সে অনেক বড়, তোমার মায়ের মতো। আজ আমি একটা অনুরোধ করছি তোমার কাছে, আমার মেয়েটাকে ফিরিয়ে দাও। তুমি আমার মেয়েকে ভালোবাসো। ভালোবাসা তো অপরপাশের মানুষটার সুখ চায়। সায়মন অনেক ভালোবাসে নীরাকে।”

আফনান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কোনো বাবা-মায়ের সামনে তাদের অত্যন্ত স্নেহ-ভালোবাসার মেয়ের জীবন সঙ্গী বেছে নেবার জন্য অপশন হিসেবে আফনান আর সায়মন দাঁড়ায়, আফনানরা সেখানে বহু আগেই হেরে যায়। মিছেই সে বালুচরে ঘর বেঁধেছিল। পলকা ঢেউয়ের তোড়ে কেমন জলে মিশে গেল সব।

আফনানের মনে হলো সে ওর সমস্তটুকু নিয়ে সাম্পান ভাসিয়েছিল সাগরে। মাঝসমুদ্রে এসে বৈঠা হারানো এক নিঃস্ব নাবিক বলে মনে হচ্ছিল নিজেকে। যে কেবলই একটা প্রবল স্রোতে ডুবে গেল অতলে। সাঁতার সেখানে অর্থহীন।

“কিন্তু নীরা আমাকে ভালোবাসে।” শেষ চেষ্টা হিসেবে যেন ভেসে উঠার জন্য পণ মিশে রইল।

“কত মানুষই তো ভালোবাসে। কিন্তু বিয়ে হয়ে গেলে সব ঠিকঠাক হয়ে যায়। মানিয়ে যায়।”

“আমি চাই নীরা সুখী হোক।”

পরাজিতের মতো বলল আফনান, কিন্তু কোনো দীর্ঘশ্বাস আসতে দিল না, তাতে যদি নীরার সুখ বিঘ্নিত হয়। ওর সুখের কাঁটা সে হতে চায় না। নিজের ভাগ্যের পরিহাসে একটা তীব্র বিষাদ মেশানো হাসি ফুটল। সে হাসি পাষাণের হৃদয়ও এফোঁড়ওফোঁড় করে দিতে সক্ষম।

***
আফনানের দেখা সারাদিনে নীরা পেল না। আপাতত শায়লা আর রবিনসহ আফনানদের বাসায় এসেছে আপাতত। ওরা সুস্থ হলে বাসায় ফিরে যাবে।

নীরা একবার আফনানের ঘরে এলো। আফনান হয়তো ভাবেনি, নীরা এই ঘরে আসবে এখন। ঘরটায় একটা বেশ বড়সড় বইয়ের তাক রয়েছে। তাতে নীরার দেয়া ‘শেষের কবিতা’ বই শোভা পাচ্ছে। বইয়ের ভাঁজে শুকনো ঘাসফুল। সেটাও ওর দেয়া ছিল। সেটা সরাতেই দেখল একটা খাতার কিছু ছেঁড়া পাতা। একবার একটা অংকের কিছুতেই সমাধান করতে পারছিল না সে। আফনানের শরণাপন্ন হয়েছিল। আফনান করে দিয়েছিল ঠিক, কিন্তু একটা তাচ্ছিল্য করেছিল ওকে৷

নীরা রেগে খাতার সেই দুটো পাতা ছিঁড়ে ফেলে এসেছিল আফনানের সামনে। সেই পাতাটাকে কুড়িয়ে কী ভীষণ যত্নে রেখে দিয়েছে ছেলেটা! নীরার ভীষণ ভালো লাগল। একটা অবর্ণনীয় সুখ প্রজাপতির মতো পেলব স্পর্শে মেখে দিয়ে গেল ওর সমস্ত হৃদয়ে।

কিন্তু সেই রেশটুকু স্থায়ী হলো না। সারাদিনে আফনানের অনুপস্থিতি নীরাকে কটাক্ষ হেনে যেন বলল,

“তুই আবারও একই বোকামি করলি।”

সেই রাতের ট্রেনে ওরা বাড়ি ফিরল। তবে নীরা এবার কাঁদল না। ওর কঠিন হৃদয় সামান্য আর্দ্র হয়ে আসছিল, তা আবারও প্রস্তরীভূত হলো। কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠল।

***
আফনান ঘরে এলো তার পরেরদিন। একটা ছোট্ট চিরকুট পেল,

“যাকে ফিরিয়ে দিয়েছ, তার স্মৃতিচিহ্ন আঁকড়ে রাখাটা অন্যায়। তাই আমার জিনিস আমি ফিরিয়ে নিলাম।”

নীরার দেয়া বই, সাথে বাকি জিনিসগুলোও উধাও। কষ্ট যেন দলা পাকিয়ে বুকের ব্যথা বাড়িয়ে দিল আফনানের। কী ভীষণ ব্যথা যে হচ্ছে সেখানে। শূন্য হৃদয়েও ব্যথার সুর ঝঙ্কার তুলল।

***
সময় থেমে থাকে না। চিরায়ত নিয়মেই তা চলমান। ক্যালেন্ডার বদলে গেল, কয়টা ঋতু এলো গেল, সব ঠিকঠাকই তো চলছিল। শুধু আফনানের শূন্য হৃদয় নিঃস্ব হচ্ছিল। পাঁজর ভাঙছিল প্রতিনিয়ত। ভাগ্যিস পাঁজর ভাঙার শব্দ অন্যেরা পায় না!
…….
(ক্রমশ)

#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ২৯)
নুসরাত জাহান লিজা

আনিকা রাজশাহী চলে যাবার প্রথম দুই মাসের মধ্যে কেউ কারো সাথে কথা বলেনি। ততদিনে অবশ্য তাদের পরস্পরের উপরে ক্ষোভ অনেকটা কমে গেছে। বাহ্যিক দূরত্ব কখনো কখনো দুটো মনকে কাছাকাছি নিয়ে আসে। টান বাড়ে, তীব্র আকাঙ্খা তৈরি হয় কাছে যাবার। ওদের তেমনটাই হচ্ছিল। কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছিল না দু’জনেরই টনটনে ইগো মহাশয়ের কারণে।

দু’জনেই মনে মনে উতলা হয়ে ছিল কবে অপরপক্ষ থেকে প্রথম তার দিকে পা ফেলবে। কিন্তু নিজে থেকে এগিয়ে যাবার কথা চিন্তায়ও আনতে পারছে না।

“দোষ যার সে বলুক।” এমন ভাবখানা দুই প্রান্তেই। “আমি যাব না কিন্তু সে এলে ফেরাব না।”

এভাবে আরও মাসখানেক গড়ায়। সেই টান অবশ্য আরও বাড়ে। এরমধ্যে নিলয় দেখত প্রায় প্রতিদিন আনিকার ইন্সটাগ্রামে নতুন ছবি পোস্ট করা হচ্ছে। মেয়েটার মধ্যে এত ঘনঘন ছবি পোস্ট করার প্রতি ভারি অনীহাই নিলয় দেখে এসেছিল এতকাল! হঠাৎ এমন প্রতিদিন ছবি দেবার পেছনের কারণ যে নিলয় নিজেই সেটা সে অনুমান করে নিল। প্রতিদিন সে অন্তত একবার করে আনিকার প্রোফাইলে ঢু মেরে আসত। কখনো টানা তিন-চার দিন যদি ছবি না পোস্ট হতো নিলয় অস্থিরবোধ করত। মনে হতে সামান্য যেটুকু সুতো আছে সেটুকুও যেন কেটে যাচ্ছে।

একসময় নিলয়ই প্রথম হার মানল। প্রথমে নিজের অফিসে গেল। ওর কিছু ছুটি পাওনাই ছিল। আনিকার ছুটি নেবার ব্যপার আছে, আরও আনুষঙ্গিক কিছু কাজ আছে। একটা ট্রাভেল এজেন্সির সাথে কথাও বলল। সামনেই নিলয় এক সপ্তাহের ছুটি নেবে, সে অনুযায়ী সুবিধাজনক সময় বের করতে হবে। এরপর ছুটল রাজশাহী। সোজা চলে এলো আনিকার অফিসে।

আনিকা একটা জরুরি কাজ করছিল, শুনল ওর সাথে একজন দেখা করতে চায়। আনিকার বাবা মা দুইবার এসেছিলেন, কিন্তু তারা অফিসে আসবেন না। এছাড়া আর কে হতে পারে ভেবে এসে দেখল নিলয়কে।

“তুমি কেন এসেছ?” আনিকার গলায় একরাশ অভিমান।

“ভাবলাম বিয়ে করলাম, কিন্তু এতদিনেও হানিমুনটা বাকি রয়ে গেছে।”

“আমার এই অফিস রুরাল এরিয়ার সুবিধাবঞ্চিত মহিলাদের ভাগ্য উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে, হানিমুন সার্ভিস নেই।”

“সুবিধাবঞ্চিত অসহায় পুরুষদের নিয়ে কোনো সুবিধা নেই?”

“না। তাই কথা না বাড়িয়ে চলে যাও।”

“কিন্তু এই অফিসে তো আমার বউ আছে৷ বউকে ছাড়া তো আর হানিমুন হয় না।”

“এমন দেবদাস মার্কা চেহারা করে এলে বউ পটানো যায় না।” নিলয় এই কয়েকদিনে যেন কিছুটা রোগা হয়েছে, চোখের নিচে কিঞ্চিৎ কালচে ছাপ। নিশ্চয়ই অনিয়ম করে। তাই কিছুটা কড়া সুরে বলল আনিকা।

“টম ক্রুজের মতো চেহারা করার দরকার ছিল বুঝি?” আনিকা উত্তর দেয় না।

নিলয় আনিকাকে ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করে বলল, “তোমার গায়ের এই জামার রঙ কী? পেঁয়াজের খোসার মতো রঙ।”

“রঙ জেনে কী করবে?”

“এই রঙের একটা শাড়ি পরেছিলে কয়েকদিন আগে। তোমাকে ভীষণ মানায় রঙটা৷”

“তুমি কোথায় দেখলে?”

“তোমার ইন্সটাগ্রামে৷ আর তিনদিন আগে সবুজ রঙের একটা শাড়ি পরেছিলে। ওইটাতেও…..”

“এক মিনিট, তুমি কি আমার একাউন্ট স্টক করো?”

“এমনভাবে রেগে যাবার মতো কী আছে? অন্য নারীরটা তো করিনি! স্টক করলে নিজের বউয়ের টাই করেছি।”

“এতদিন মনে ছিল না বউ আছে?”

ওরা কথা বলছিল ভীষণ আস্তে আস্তে, ধীর স্বরে। এবার গলা আরেক ডিগ্রি নামিয়ে নিলয় বলল,

“আনিকা স্যরি। তোমাকে তখন ওভাবে বলাটা আমার উচিত হয়নি৷ আমার তোমাকে ছাড়া থাকতে কষ্ট হবে বলে আপত্তি করেছিলাম। কিন্তু গুছিয়ে বলতে পারিনি।”

আনিকার রাগ অবশ্য সাথে সাথে পড়ল না, আরও একটা দিন নিলয়কে কাঠখড় পোড়াতে হলো। এরপর ওদের সম্পর্কের কালো মেঘ বরফ গলে বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়ল। তার সপ্তাহ তিনেক পরেই ওরা হানিমুনে চলে গিয়েছিল নেপালেই৷ ফিরে এসে আবারও রাজশাহীতে চলে গেছে আনিকা। কিন্তু পরবর্তী ছয় মাস ওরা আসা-যাওয়া করেছে। বিয়ের প্রথম বছরটা ওদের মন্দ-ভালো মিলিয়ে চলে গেল।

***
ইরার প্রাণপণ পরিশ্রম সত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হয়নি। প্রথমদিকে ভীষণ ভেঙে পড়েছিল। যতটা না নিজের স্বপ্নের জন্য, তারচেয়ে বেশি শাফিনের সাথে দূরত্বের আশঙ্কায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হয়েছিল। গত আটমাস সেখানেই আছে।

মরিয়ম মেয়েকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন, “দেখ, একটা ভালো সাবজেক্টে তো পড়বি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়নি তো কী হয়েছে।”

মাকে সে আসল কারণটা বলতে পারবে না এখনি। নীরার পরিস্থিতি দেখে সে ভয় পেয়েছে। ওর মা বাবা যদি শাফিনের সাথে ওর সম্পর্ক কখনো মেনে না নেন!

সবার চোখ থেকে লুকালেও সে ইলার চোখকে ধোঁকা দিতে পারল না।

“আপু, তুই কিছুদিন আগেও বলতি বাড়ির বাইরে যাবি না। এখানকার কলেজেই ভর্তি হবি। এখন এমন হাপিত্যেশ করছিস কেন?”

“আগে অত পড়াশোনা করতাম না৷ পরিশ্রম করেছি, ফল না পেলে খারাপ লাগবে না?”

“সে তো লাগবেই। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে ভার্সিটির চাইতে ভার্সিটির স্পেশাল কারোর জন্য তোমার বেশি টান।” বলেই ইলা বইতে মুখ গুঁজল।

ইরার অগ্নিদৃষ্টি নিভে এসে সেখানে জায়গা করে নিয়েছিল বিস্ময়। ইলাকে কষে একটা চড় মারার প্রবল ইচ্ছে রোধ করল। এরকম বিচ্ছু একটা মেয়ে!

শোকতপ্ত ইরা চট্টগ্রামে ভর্তি হলো। বাড়ির বাইরে প্রথম যাওয়া। সবার জন্য প্রথম দিকে মন কেমন করত। শাফিন মাসে দুই তিনবার এখানে যাতায়াত করতে থাকল। ওদের সম্পর্ক তখন অনেকটা লং ডিসট্যান্ট রিলেশনশিপের মতো।

শাফিনের ফটোগ্রাফি চলছে সমানতালে। সে শখের পাশাপাশি প্রোফেশনাল ফটোগ্রাফি শুরু করেছে। এখন ইরা মানিয়ে নিয়েছে। নতুন বন্ধুমহল নিয়ে আর শাফিনের সাথে ফোনে কথা বলে সময় দিব্যি কেটে যাচ্ছে।

শাফিনের তোলা ওর প্রথম ছবিটা, যেটা দিয়ে ওদের পরিচয় সেই ছবিটা সে প্রায়ই দেখে। এই ছবিটা এত অপূর্ব এসেছে। নাহ্, শুধু এই ছবির জন্য ছেলেটাকে একজন ভালো ফটোগ্রাফার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

***
সবার জীবন এগিয়ে গেলেও আফনান যে এক জায়গায় থেমে আছে। সে মনিরের স্ত্রীকে ওর এক বন্ধুর কিন্ডারগার্টেন স্কুলে বাচ্চাদের পড়ানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মেয়েটা ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু পরে আর পড়াশোনা সেভাবে এগোয়নি।

মনিরের মেয়ের পড়াশোনার সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছে। রবিনও সাহায্য করে সবসময়।

আফনান একটা অফিশিয়াল কাজে ঢাকায় এসেছে। তাতেই রোমেল খুব করে ধরেছে ওর বিবাহবার্ষিকীতে যেন আফনান অবশ্যই থাকে। তাই গিফট কিনতে এসেছে শপিংমলে।

অকস্মাৎ চোখ আটকে গেল সামনে। বহুদিন পরে নীরাকে চোখের সামনে দেখল আফনান। এভাবে যে দেখা হয়ে যাবে সে ভাবতেও পারেনি! কিছুটা যেন পরিবর্তন এসেছে মেয়েটার মধ্যে। তবে ওর অতল চোখ এখনো একই আছে। সে চোখের দৃষ্টিসীমায় যদিও তখনও আফনান পড়েনি। হৃদয়ে বহুদিন পরে যেন প্রবল ঢেউ উথাল পাথাল খেলে গেল।

যখনই ডাকার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল মনে মনে, তখনই আফনানের দৃষ্টিসীমার মধ্যে আরেকজন প্রবেশ করল। সায়মন। বুকের গহীনে ভীষণ গোপনে যে ঢেউ ভাঙছিল তা একেবারে গোপনেই থিতিয়ে গেল, শান্ত হয়ে রূপ নিল হাহাকারে!

তবে কী নীরা নতুন জীবন শুরু করেছে! নিলয়কে কখনো সে নীরার কথা জিজ্ঞেস করেনি। ঝলমলে আলো নিমিষেই যেন বিরক্ত লাগল ওর, প্রাণপণে প্রগাঢ় অন্ধকারে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে হলো ওর।
……..
(ক্রমশ)