#ডাক্তার_মিস
পর্ব ৩১
রুস্তম শেখ, শিউলি বেগম দুজনের ডায়াবেটিকস এর রোগী। মিষ্টি খাওয়ার উপর বহু আগেই একশ চুয়াল্লিশ ধারা জারি করেছে বুশরা। তবে কথায় আছে, ডায়াবেটিক্স হওয়ার পর মানুষের মিষ্টি খাওয়ার অদম্য ইচ্ছা তৈরি হয়। নিষিদ্ধ বস্তু সর্বদাই মোহনীয়। যাইহোক, এই রাতদুপুরে রায়হানের হাতে তিনপ্যাকেট মিষ্ট দেখে রুস্তম শেখ যারপরনাই খুশি। চোখদুটো যেন চকচক করছে তার।
“রায়হানের আম্মা, বুশরা দেখার আগেই চট করে কয়টা মিষ্টি দাও দেখি। তুমিও নাও, তুমিও নাও। এমন সুযোগ বারবার আসে না।”
শিউলি বেগম অবশ্য ওঠার নাম নিলেন না। তিনি এখনো সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন টেবিলের উপর রাখা মিষ্টির প্যাকেটের দিকে।
অন্য যেকোন বিষয়ে রায়হান আর বুশরার মনের মিল, মতের মিল যেটুকুই হোক না কেন, বাবামায়ের স্বাস্থ্য বিষয়ে বুশরার কথা বেদবাক্য ওর কাছে, বিয়ের অনেক আগে থেকেই। দারুণ কিছু না হলে নিয়মের ব্যাতিক্রম হওয়ার কথা না। নিজের ছেলেকে হাড়ে হাড়ে চেনেন তিনি।
তাই মিষ্টি খাওয়ার চেয়ে অজানা সুসংবাদটা জানার জন্য বেশি আগ্রহী। তবে কি ঘরে ছানাপোনা আসতে চলেছে? অবশ্য এতো তাড়াতাড়ি…
সাতপাঁচ চিন্তা বাদ দিয়ে বহুল আকাংখিত মিষ্টির প্যাকেট থেকে চোখ ফিরিয়ে ছেলের দিকে চাইলেন শিউলি বেগম,
“ঘটনা কি বল তো বাবু? কোন সুখবর আছে নাকি?”
“আহ মা। আগে মিষ্টি খাও, পরে বলছি। তোমার আদরের দুলালী আসলে আর খাওয়া হবে না। তখন আমাকে বলতে আইসো না। ”
ছেলের কথা শুনে কাজে নেমে পড়লেন শিউলি বেগম। বাটিতে একের পর এক মিষ্টি তোলা দেখে অবশ্য চোখ রাঙালো রায়হান,
“আম্মা এতো না। দুইপিস করে। স্পঞ্জের মিষ্টি আর কাচাগোল্লা নাও। ওইদুইটা মিষ্টি কম।”
খেতে খেতে রুস্তম শেখ বললেন,
“এবার বলো কাহিনী কি?”
“আব্বা, আম্মা, বুশরা একটা অনেক বড় বৃত্তি পাইছে”
শিউলি বেগম বারবার “আলহামদুলিল্লাহ” বললন।
রুস্তম শেখের বুশরার খোঁজ করলেন। দ্বিতীয় মিষ্টিটা পেটে চালান করে বললেন,
“তা মেয়েটা কই? এত বড় সুসংবাদ নিজ মুখে দিতে হয় না? মিষ্টিমুখ ও তো করাতে হয়। তুমি কিন্তু ওকে বলো না যে আমরা দুটা মিষ্টি খাইছি।”
“তোমরা ভাইবোন এইটে, ফাইভে বৃত্তি পাইছিলা পড়ালেখায় ভাল করনের জন্য। কিন্তু বুশরার তো পড়ালিখা শেষ। কিসের বৃত্তি এইটা?”
রায়হান হেসে বললো, ” কি যে বলো আম্মা। ডাক্তারদের পড়ালেখার শেষ আছে নাকি? ইংল্যান্ডের একটা ইউনিভার্সিটি থেকে ফুল ফান্ডেড অফার আসছে আরো পড়াশুনা করার। মানে থাকা, খাওয়া, পড়াশুনার খরচ সব ওরা দিবে।”
স্কলারশিপের কথা শুনে দুজনে যতটা উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন, ইংল্যান্ড শুনে ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেলেন একসাথে।
উদ্বিগ্নস্বরে প্রথম কথা বললেন রায়হানের বাবা,
“একা একটা মেয়ে এতদূর কিভাবে….”
“আব্বা বুশরা কিন্তু সারাজীবন একাই লড়েছে। আর এখন তো আমরা আছি ওকে মনের জোর দেওয়ার জন্য।”
“কিন্তু তাই বলে… আর বিয়ের মাত্র কটা দিন হইছে, এখন বউ বিদেশ চলে গেলে লোকে বলবে কি?”, বললেন শিউলি বেগম।
বাবা মায়ের কথা শুনে অসহিষ্ণু হয়ে উঠলো রায়হান। বহু কষ্টে বুশরাকে বুঝিয়ে এসেছে ও। এখন ঠান্ডা মাথায় বুঝানোর চেষ্টা করলো বাবা মা কে।
“আম্মা আমি যখন বিয়ে করছিলাম না তখনও তো লোকে কথা বলছে। বলে নি? লোকের কথা দিয়ে আমাদের কি আম্মা?”
“তারপরেও, একটা ব্যাপার আছে না? মাত্র বিয়ে করছো। এখন সংসার গুছাবা, নাতিপুতির মুখ দেখবো। তারপর নাহয় আরো পড়াশুনা করবে। দরকার হলে বাচ্চা আমার কাছে রাইখা গেলো, আমি পাইলা পুইষা বড় করে দিলাম।”
“আম্মা সবকিছুরই একটা সময় আছে। ওর এখন পড়াশুনার সময়। একটা গ্যাপ কড়ে গেলে আর সহজে পারবে না সামনে আগাতে। আর বিদেশ পাঠাতে এতই যখন সমস্যা তখন ডাক্তার বউ নিয়ে আসছো ক্যান? ঘরে সাজায়ে রাখার জন্য?”
“এগুলা কি ধরণের কথা বাবু? আমরা কি তোমাগোর খারাপ চাই? একটা পোলাপান হোক তারপর যতখুশি পড়াশুনা করুক, আর দেশে পড়াশুনা করা যায় না? আমি তো মানা করতেছি না।”
“না আম্মা, দেশের পড়াশুনা তো করলো, এবার বিদেশ। রাগ কইরো না। বুশরা নিজেই যাইতে চাইতেছে না, অথচ ওর কতদিনের স্বপ্ন বিদেশ থেকে বড় বড় ডিগ্রি নেওয়া। বড় ডাক্তার হওয়া। অনেক কষ্টে বুঝাইছি। এখন আবার তোমরা শুরু করছো। এসব শুনলে আরোই যাইতে চাইবে না। আমরা তো ওর পরিবার আম্মা। আমরা না পাশে থাকলে হবে ক্যামনে। রুকুর হবু জামাই ডাক্তার, ওরা একসাথে পড়তে যেতে পারবে, বুশরার তো আজ হোক কাল হোক একাই যাওয়া লাগবে। আর এত ভালো সুযোগ তো বার বার আসে না আম্মা। আব্বা, একটু বুঝাও।”
এতক্ষণ মুখ খুললেন রায়হানের বাবা। গম্ভীরমুখে বললেন,
“রায়হানের আম্মা, ছেলে আমাদের ঠিকই বলছে। বিয়েটা আজ না হলে তো মেয়েটা ঠিকই পড়তে চলে যাইতো। আমাদের বাড়ির বউ হইছে দেখে কি সে অপরাধ করছে? তার স্বপ্ন গলা টিপ্পা মাইরা ফেলানোর আমরা কে?”
শিউলি বেগমও ভেবে দেখলেন বিষয়টা ঠিক হবে না। মা থেকে কখন শাশুড়ীর মত চিন্তা করা শুরু করেছেন ভেবে লজ্জা পেলেন তিনি।
“বুশরা কই?”
“ঘরে আছে আম্মা। আবার কাঁনতে বসছে মনেহয়। বিয়েশাদী করে মাথার দুয়েকটা তার ছিড়ে গেছে। সংসার ফালায়ে যাবেন না তিনি। একটু বুঝাও আম্মা। তুমি চাওনা তোমার মেয়েটা মস্ত বড় ডাক্তার হোক? উঠতে বসতে তো দোয়া করতেই থাকো।”
চুপ করে থাকলেন শিউলি বেগম। রায়হানও সময় দিল কিছুটা। কিছুক্ষণ পর নিজেই বললেন,
“কবে যাওয়া লাগবে? কতদিন থাকা লাগবে?”
“মাস দেড়েকের মধ্যে আম্মা। কাগজপত্র ঠিকঠাক করতে যা সময় লাগে। দুই বছরের কোর্স।”
আরো টুকটাক কথা হতেই বুশরা আসলো ঘরে। সাথে চা আর মুড়িমাখা। ট্রে টা টেবিলের উপর রাখতে গিয়ে মিষ্টির বাটিতে চোখ পড়লো ওর। সাথে সাথে শিউলি বেগমের দিকে রাঙা চোখে তাকালো বুশরা।
“আম্মা…”
“আমি কিছু জানিনা। বাবু খেতে দিছে।”, সমর্পণের ভংগিতে বললো শিউলি বেগম। ঠিক যেন পাউডার দুধ খেতে গিয়ে মায়ের কাছে ধরা পড়ে যাওয়া বাচ্চা। হেসে ফেললো বুশরা।
” এদিকে আয়৷ বস।”
শিউলি বেগমের পাশে গিয়ে বসলো বুশরা। ওর সারা মুখে হাত ছুঁইয়ে চুমু খেলেন তিনি। শুরুতে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন সেটা স্বীকার করতে লজ্জা পেলেন। সেটা পুষিয়ে দিতে মাথায় হাত রেখে প্রাণখুলে দোয়া করলেন।
“অনেক বড় হ মা। রায়হানের কাছে শুনলাম খবরটা। ”
বুশরা বললো, “ও এই তাহলে মিষ্টির কাহিনী? ডায়াবেটিস বেশি হয়ে গেলে কি অবস্থা হবে? সন্ধ্যায় ইমেইল পাইছি। আর আমি আসলে যেতে চাচ্ছিলাম না এখন মা। তাই কিছু বলিনি।”
শিউলি বেগম বললেন, “যাবি না কেন মা? অবশ্যই যাবি। আমি তো লেখাপড়া অত বুঝি না মা, কিন্তু বড় ডাক্তার হয়ে ফেরত আসবি, দোয়া করি।”
“তোমাদের ছেড়ে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে না।”
অকপট স্বীকারোক্তি বুশরার। শিউলি বেগমের চোখদুটো জলে ভরে উঠলো।
“আমরাও তোর জন্য পথ চেয়ে বসে থাকবো মা।”
রুস্তম শেখ বললেন, “তা এত বড় খুশির খবর, এই বুড়া বাপের কাছে কিছু চাও মা। যা মনে চায়।”
“আমার কিছু চাইনা আব্বা। দোয়া করেন শুধু।”
“মা রে, বাবা মায়ের দোয়া সবসময় সন্তানের মাথার উপর থাকে। অন্য কিছু চাও।”
“আব্বা পাশের গ্রামে একটা এতিমখানা আছে। ওখানকার বাচ্চাদের আমি একবেলা খাওয়াতে চাই বিদেশ যাওয়ার আগে। খরচপত্র সব আমি করবো, আপনি ব্যাবস্থা করে দিবেন? আসলে আমি যে এতিমখানায় মানুষ হইছি ওইটা উঠে গেছে অনেক আগে। যে দাদু বানিয়েছিলেন উনি মারা গেছে। উনার ছেলেমেয়েরা বাবা মারা যাওয়ার পর বাড়িটা বেঁচে দিছে। এতিমখানাও নাই, কারও সাথে যোগাযোগও নাই।”
“তাও নিজের জন্য কিছু চাইবা না? আচ্ছা মা। কবে খাওয়াতে চাও জানাইও আমারে। আমি সব ব্যাবস্থা করে দিব।”
“আমার নিজের একটা এত্ত সুন্দর পরিবার পাইছি। এত ভাল আব্বা, আম্মা পাইছি, কখনো তো ভাবিনি। আর কি চাইবো বুঝে পাইনা আজকাল আব্বা।”
“মা রে, আব্বা আম্মা দুনিয়ার সবটিই ভালো। যারা ভালো না, তারা আব্বা আম্মা হইতেই পারে নাই।”
বুশরার মনের মেঘ কেটে গেছে অনেকটাই। সেই সাথে শিউলি বেগম আর রুস্তম শেখেরও। একটা সুখী পরিবার, হাসি গল্প, উচ্ছাসে মেতে উঠলো ঘরটা। আর পাঁচটা সন্ধ্যের মত। অবাক হয়ে বুশরাকে দেখে রায়হান। অনুভব করে মেয়েটার প্রাণশক্তি। কি নিদারুণ মায়ার পরিবারটাকে বেঁধে ফেলেছে মায়াবতী মেয়েটা।
মন্তব্য করতে ভুলবেন না 💙