ডাক্তার মিস পর্ব-৩০

0
644

#ডাক্তার_মিস
পর্ব ৩০

সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত নদীর পাড়েই কাটিয়েছিল দুজনে। বুশরা আবদার করেছিল নদীতে গোসল করার। তবে জ্বর ফেরত আসার আশংকায় আবেদন মঞ্জুর হয়নি।

রুষ্ঠ কন্ঠে বুশরা বলেছিল, “আপনি বড় পাষাণ, চেয়ারম্যান সাহেব।”

আহ্লাদী কিশোরীর মত অভিমানী কথা শুনে হেসে ফেলে রায়হান। কথা দেয় পরেরবার যেকয়দিনের জন্যই আসুক প্রতিদিন নদীতে গোসল করতে পারবে ও।

ব্যস্ত জীবন থেকে ক্ষনিকের অবকাশযাপনের জন্য আসলেও ফোনকল থেকে মুক্তি মেলেনি দুজনেরই। তবে তাতে যে খুব খারাপ লাগছে তা ও না। বরং প্রিয়তমের সাথে একান্তে কাটানো আজকের দিনটা বুশরার মনে থাকবে , বহুদিন।

দুপুর গড়াতেই কোথায় থেকে দুজন মহিলা উদয় হলো কোথা থেকে যেন, একজন মধ্যবয়সী। আরেকজনকে অবশ্য মহিলা বলা যায় না, কিশোরীই সে। দুজনের হাতে থালাবাটি, খাবারদাবার।

“এসব কি?”, অবাক বিষ্ময়ে বলে বুশরা।

” তুমিই না বললে আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানেই বসে থাকবে। তুমি ডাক্তার মানুষ, খাওয়াদাওয়ার ঠিক নেই। কিন্তু আমি তো বাপু ক্ষুধা সহ্য করতে পারিনা।”

বুশরা যখন শিউলি বেগমের সাথে ফোনে কথা বলছিল তখনই এই বাড়ির দেখাশোনা করে যে চাচা তাকে ফোন করে দুপুরের খাবারের ব্যাবস্থা করতে বলেছে রায়হান। তারই স্ত্রী কন্যা এসেছে দুপুরের খাবার নিয়ে।

আয়োজন খুব বেশি না। ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, নদীর পাবদা মাছের ঝাল ঝাল তরকারি, পুইশাকের ডাল চচ্চরি। কিন্তু মোহনীয় পরিবেশের কারনেই হোক, বা হটাৎ পাওয়া অকৃত্রিম সুখের কারনেই হোক, জ্বর মুখেও পেটপুরে খেলো বুশরা। খাওয়াদাওয়া পর্ব শেষ হতেই বিদায় নিল দুই রমনী।

খাওয়া শেষে ঘুম ঘুম লাগছিল বুশরার। রায়হানের কাঁধে মাথা রেখে কিছুক্ষণের জন্য চোখ বন্ধ থাকলো ওখানেই। একহাতে স্ত্রীকে জড়িয়ে রাখে রায়হান। সেই মুহুর্তে সবকিছুই কেমন অপার্থিব লাগছিল বুশরার। জীবন কত সুন্দর। কত মোহনীয়।

চোখ বুজেই রায়হানকে প্রশ্ন করেছিল বুশরা।

“আমি কি স্বপ্ন দেখছি চেয়ারম্যান সাহেব?”

“উঁহু..। না তো।”, একটু থেমে বউকে প্রশ্ন করেছিল রায়হান, “আমাকে বিয়ে করে অযথা কষ্ট টেনে আনলে কেন জীবনে?”

“সত্যি বলব?”

“হুম। মিথ্যা শুনে কি লাভ আমার?”

“বাধা পড়ে গেছিলাম অজান্তেই, আপনার ব্যাক্তিত্বের ফাঁদে। তাই জীবন যখন সুযোগ দিল, একটা বাজি ধরে ফেললাম সাহস নিয়ে। হারানোর তো কিছু নেই আমার।”

“তাই বলে নিজের সারাটা জীবন বাজি ধরে কেউ? পাগল।”

” উঁহু , ওটা পাগলী হবে।”

এই সামান্য কথাতেদুজনেই হেসেছিল প্রাণখুলে। একটু বেলা পড়তেই একটা ছোট্ট নৌকাতে করে উদ্দেশ্যহীনভাবে কাটিয়েছিল পুরো বিকেল। মাঝি ছেলেটার বয়স কতই বা হবে? বড়জোর সতের আঠার। কি মায়াভরা কন্ঠে গলা ছেড়ে গান করছিল ছেলেটা।

সূর্যাস্তের সময় নৌকাবিহার শেষ করে ঘাটে নামে দুজনে। নৌকা থেকে নামার সময় রায়হানের হাত ধরেছিল বুশরা। নামার পরেও হাত ছাড়ার লক্ষন দেখা দেয়নি দুজনের মধ্যেই।

“বুশরা..”

“হুম?”

“আমাকে কখনো ছেড়ে যাবে না তো?”

এই প্রশ্নের কোন উত্তর দেয়নি বুশরা।

তবে আরেকটু শক্ত করে ধরেছিল প্রিয় মানুষটার হাত। আর তাতেই হয়ত লুকিয়ে ছিল সব প্রশ্নের উত্তর। সব কথা কি মুখে বলতে হয়?

রাতটা প্রথমে ওখানেই কাটাতে চাইলেও বুশরার জ্বর কিছুটা ফেরত আসায় গ্রামে ফিরে আসে ওরা। বাড়ি ফিরলে শিউলি বেগম খুব বকাবকি করতে চেয়েছিলেন ছেলেকে, অসুস্থ মেয়েটাকে নিয়ে টই টই করে ঘোরার অপরাধে। কিন্তু বাড়ি ফেরার পর থেকে বুশরার তৃপ্ত চেহারা আর দুজনের মধ্যে বরফগলা সম্পর্ক চোখ এড়ায় না অভিজ্ঞ মানুষটার। মনে মনে শুকরিয়ে আদায় করেন তিনি।

যাইহোক এখন বুশরা আর রায়হানের সম্পর্কটা অনেকটাই স্বাভাবিক স্বামী স্ত্রীর মত। ভোরবেলা একসাথে নামাজ পড়া থেকে শুরু করে রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত অনেক নিয়মেই পরিবর্তন এসেছে। সকালে বের হওয়ার আগে প্রায়ই বুশরাকে হাসপাতালে পৌঁছে দেয় রায়হান, কখনো গাড়িতে আবার কখনো বাইকে।

সন্ধায়ও প্রায়ই একসাথে ফেরে ওরা, অন্ধকারে এলোমেলো পায়ে হাটতে হাটতে গল্প করে পুরো রাস্তা। সারাদিন হাসপাতালে উল্লেখযোগ্য কি কি হলো সে গল্প করে বুশরা। মজার কিছু অভিজ্ঞতার কথা হয়ত বলে রায়হানও। ওদের গল্পে কোন অতীত থাকে না, থাকে না ভবিষ্যতও। পাশাপাশি হাটতে হাটতে আনমনেই দুজনের হাত ছুঁয়ে যায় একে অপরকে। সেই ছোঁয়াতে কামনা বাসনার চেয়ে বরং নির্ভরতার আশ্বাসটাই প্রকট।

একদিন সন্ধ্যায় রায়হান ফিরে দেখলো বুশরা শুয়ে আছে। ঘরে ডিম লাইটের আবছা আলোয় দেখলো মেয়েটা একটা হাত কপালে রেখে চিত হয়ে আছে, ঘুমাচ্ছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। তবে এসময় বুশরা ঘুমায় না। মায়ের ঘরে থাকে। হয়ত শরীর খারাপ। লাইট না জ্বালিয়ে হাতের ফাইলগুলো নিঃশব্দে টেবিলে রাখলো। কম্পিউটারের মাউসে হাত লাগায় মনিটরের আলো জ্বলে উঠলো। স্বাভাবিকভাবেই চোখ পড়লো কম্পিউটারের স্ক্রিণে।

ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার এর লোগোসমেত একটা ডকুমেন্ট ওপেন করা। কৌতুহলী মন নিয়ে তাতে চোখ বুলালো রায়হান। ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপের অফার লেটার। ইস্যু করা হয়েছে আজকেই, বুশরার নামে।

“এই বুশরা? ঘুমাচ্ছো?”

প্রশ্নটা করেই মাথায় হাত দিল। একটু কেপে উঠলো বুশরা। উত্তর না পেলেও রায়হান ঠিকই বুঝলো ঘুমায়নি মেয়েটা। উঠে গিয়ে চট করে লাইটটা জ্বালিয়ে দিল। উজ্জ্বল আলো চোখে লাগায় হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেললো বুশরা।

“কংগ্রাচুলেশনস।”

উঠে বসতে বসতে বুশরা বললো, “ছাই।”

“কেন?এত্ত ভালো একটা অফার পেয়েছো।”

“কারন আমি কোথাও যাচ্ছিনা। বিয়ের আগে এপ্লাই করেছিলাম। হঠাৎ আজকে এক্সেপ্টেন্স লেটার এসেছে।”

বিয়ের আগে রুকুর কাছে অনেকবার শুনেছিল ও যে বুশরা স্কলারশিপের জন্য খুব চেষ্টা করছে। আজ যখন এত বড় একটা সুযোগ এসেছে তখন, বুশরার এই নির্লিপ্ত উত্তরে অবাক হলো রায়হান।

“এত ভালো ইউনিভার্সিটি, যাবে না কেন?”

“হ্যাঁ। কিন্তু আমার এখন যাওয়ার ইচ্ছা নাই।”

ইমেইলটা পেয়ে প্রথমে খুশিই হয়েছিল বুশরা। পরক্ষণেই মনে হয়, ওদের সম্পর্কটা সবে সুন্দর হতে শুরু করেছে। এমন সময় জেনেশুনে দূরত্ব ডেকে নিয়ে আসা ঠিক হবে না। উচ্চশিক্ষার জন্য তো পরেও চেষ্টা করা যাবে।

রায়হান আলতো করে হাত ধরে বললো, “সত্যি ইচ্ছা নাই?”

“মিথ্যা বলে আমার কি লাভ?”

“তোমার পিছুটান কি আমি?”

“আমি কি তাই বলেছি?”

“সব কথা বলে দিতে হয়? আমার কিন্তু পালিয়ে যাওয়ার রোগ নেই। মাত্র তো একটা বছর। অপেক্ষা করবো তো আমি তোমার। আর আমার জন্য তুমি তোমার স্বপ্ন ত্যাগ করো এটা আমি চাইনা।”

অধৈর্য বুশরা বলে, “ডিগ্রীটাও তো পরে করা যায় তাই না? এখনই কেন?”

“পড়াশুনার বয়সটা তো থেমে থাকবে না বুশরা। ”

“এই সুন্দর সময়গুলোও কিন্তু থেমে থাকবে না। চোখের আড়াল তো মনের আড়াল হতে দেরি হয় না।”

মেয়েটার গালে হাতদুটো চেপে ধরে আলতো স্বরে রায়হান বলল, “আমি থামিয়ে রাখবো। কথা দিচ্ছি। আর দূরে গেলে তো টান বাড়তেও পারে তাই না? রিস্ক নিয়ে তো বিয়ে করেছিলে। আরেকবার রিস্ক নিয়ে দেখ দেখো না কি হয়।”

“আমাকে তাড়াতে চাচ্ছো তুমি? খুব বিরক্ত করি আমি?”

অভিমানী গলায় বলল বুশরা। ছলছল চোখে তাকালো প্রিয়তমর দিকে। অদ্ভুত মায়াভরা সে চাহনিতে খুন হয় রায়হানের হৃদয়। এরকম তো আগে কখনো হয়নি, কারো জন্যই না। ঘোরলাগা কন্ঠে বলে,

“বাহ..। তোমার মুখে “তুমি”টা তো বেশ শোনাচ্ছে।”

লজ্জাবনত মুখটা দেখে যে একটা হার্টবিট মিস হলো মানুষটার সে খবর কি বুশরা পাবে?

চলবে..