তুমিময় আসক্তি পর্ব-৩৩+৩৪

0
1178

#তুমিময়_আসক্তি
#কলমে_আলো_ইসলাম

– ৩৩ ” ( বোনাস পর্ব)

–“” দোলা তার বাড়ির সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। ভীষণ ক্লান্ত দোলা৷ সারাটা পথ হেঁটে এসেছে সে। রোকন তার ঘরে ছিলো৷ রাশেদ মিয়া বসে টিভি দেখছে ড্রয়িং রুমে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে অনেক আগেই। দরজায় করঘাত হতেই রাশেদ মিয়া খানিকটা নড়েচড়ে বসে৷ ভ্রু কুচকে দরজার পাণে চেয়ে থেকে উঠে আসে দরজা খোলার জন্য। দোলা দরজাতে এক হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে৷ দাঁড়ানোর শক্তিটা যেনো পাচ্ছে না সে৷ শরীরটা অনেক খারাপ লাগছে দোলার এই মুহূর্তে।

–” রাশেদ মিয়া দরজা খুলে দোলাকে থেকে অবাক হয়। সাথে দোলার মলিন চেহারা দেখে বুকের মধ্যে ধক করে উঠে। দোলা বাবাকে দেখে আর সামলাতে পারে না নিজেকে। বাবার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে৷ দোলার ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে চিৎকার করে কান্না করতে। তার মধ্যেকার যত দুঃখ, কষ্ট গুলো চাপা আছে সব গুলা কান্নার মাধ্যমে বের করে দিতে। রাশেদ মিয়া আগলে নেয় দোলাকে পরম সাদরে৷

–” কি হয়েছে দোলা মা৷ তোকে এমন দেখাচ্ছে কেনো? হঠাৎ তুই এই সময়? কোনো সমস্যা? জামাইকে দেখছি না তো৷ এক সাথে প্রশ্ন গুলো করে থামে রাশেদ মিয়া। দোলা এখনো বাবার বুকে মাথা রেখে চোখের পানি বিসর্জন দিচ্ছে৷ সব চেয়ে নিরাপদ স্থান এটা মনে হচ্ছে দোলার কাছে এখন৷ আসলে বাবা হলো একটা প্রধান আশ্রয়। বিশেষ করে একটা মেয়ের জন্য সব চেয়ে বেশি প্রয়োজনের জিনিস৷ যার ছায়ায় মেয়েরা সারাক্ষন আদরে থাকতে চাই৷ আঁকড়ে থাকতে চাই। প্রতিটি মেয়ে মনে করে! যদি তাদের জীবনের যাবতীয় কর্মকাণ্ড বাবার হাতে দেওয়া হয় তাহলে তাদের মধ্যে কষ্ট, দুঃখ বলে কোনো বস্তু থাকতো না৷ বাবারা নিজ হাতে সুন্দর করে জীবনটা সাঁজিয়ে দিত।

— দোলা চোখের পানি মুছে। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে মুখে হাসি নিয়ে আসার চেষ্টা করে বলে এমনি চলে আসলাম তোমাকে দেখতে। তোমার শরীর কেমন আছে বাবা? অনেক মিস করছিলাম তোমাকে। তাই তো বাবাকে বলে চলে আসলাম তোমাকে দেখার জন্য ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে বলে দোলা। ভেতরটা তার কষ্টে ফেটে যাচ্ছে বাবাকে মিথ্যা বলার জন্য। এছাড়া দোলার কাছে উপায়ও নাই। সে চাইনা তার জন্য তার বাবা চিন্তিত থাকুক। এর মধ্যে রোকন বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। বোনকে দেখে তার মুখে আনমনেই হাসি চলে আসে৷ বেশ প্রফুল্ল কন্ঠে বলে উঠে! আপু তুই। হঠাৎ এই সময়। আয় আয় ভেতরে আয়৷ তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো জানিস। দোলা রোকনের কথায় ছলছল চোখে এগিয়ে যায়। রোকনকে আগলে নিয়ে বলে তোদেরকেও অনেক মিস করছিলাম ভাই। তাই তো চলে আসলাম। এখন থেকে তোদের কাছেই থাকবো ভালো হলো না বল? রোকন তো বোনের কথায় বেজায় খুশি। কিন্তু রাশেদ মিয়ার কাছে ব্যাপারটা খটকা লাগে। দোলার কথাটার মানে বুঝতে না পারায় বলে, এখন থেকে এখানে থাকবি মানে? ওরা তোকে এখানে থাকতে দিবে দোলা মা। বাবার প্রশ্নে দোলা চমকে উঠে আমতাআমতা করে বলে ! না মানে বাবা আমি কিছুদিন তোমাদের এখানে থাকবো সেটাই বললাম৷ কেনো বাবা আমি থাকলে কি তোমাদের অসুবিধা হবে। আমি এসেছি দেখে তুমি খুশি হওনি?

— এ কেমন কথা দোলা মা। বাবা সন্তানকে দেখে খুশি হবে না একটা কথা বললি। আমি তো অনেক খুশি হয়েছি রে মা। যা ঘরে যা ফ্রেশ হয়ে আয়। দোলা আর কথা না বাড়িয়ে ঘরের মধ্যে চলে যায় দ্রুত পায়ে। রাশেদ মিয়ার দোলাকে দেখে কেমন একটা লাগছে৷ দোলাকে ঠিক মনে হচ্ছে না তার কাছে।

অন্ধকার রুমে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে রুদ্র। সব কিছু বিষাদময় লাগছে তার কাছে আজ। ভালোবাসার মানুষের থেকে পাওয়া আঘাত গুলো খুব গভীরে গিয়ে ক্ষত সৃষ্টি করে। যে ক্ষত সেরে উঠতে অনেকটা সময় নেয়। রুদ্র ভালোবাসার আঘাত কাটিয়ে আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলো। সেখানেও তাকে নতুন করে আঘাত পেতে হলো। তার ভেতরটা একবারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে এতে। হয়তো আর কখনো সেরে উঠার সম্ভাবনা নেই ক্ষত গুলো।
রুদ্রর মনের মধ্যে কোথাও একটা খুব করে চাইছে দোলা নির্দোষ হোক। রুদ্র যেনো ভুল হয়। তার দেখা যেনো ভুল হয়। দোলাকে খুব করে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে তার৷ কিন্তু যখনই সজল আর দোলার ছবি গুলো সামনে ভেসে উঠছে তখনই রুদ্রর মাথা গরম হয়ে আসছে৷ হাতের মুঠোয় আপনাআপনি শক্ত হয়ে আসছে।

— সজল আহনাফকে আমি ছাড়বো না। ওর জীবনকে আমি দুর্বিষহ করে তুলবো। দোলাকে কখনো মাফ করবো না। আর না সজলের সাথে ভালো থাকতে দেবো ওকে। ( রুদ্র সজলকে আগে থেকে চেনে। সজল আর রুদ্রর কোম্পানি একই পজিশনে থেকে কমপিটিশন করে প্রতিবার। তাই দুজন দুজনকে খুব ভালো ভাবে চেনে ব্যবসার খাতিরে৷)

— তানিয়া আস্তে আস্তে রুদ্রর রুমের দিকে এগিয়ে আসে। এইভাবে চুপ করে থাকলে কোনো সমাধান আসবে না৷ তাই তানিয়া একটা চেষ্টা করতে চাই। আর কেউ না জানুক সে জানে দোলা নির্দোষ। সব জানার পরও দোলাকে অহেতুক শাস্তি পেতে দিতে পারে না।।তানিয়া চাইনা দোলার জীবনটাও তার মামির মতো হোক।

–‘ তানিয়া অনেক সাহস যুগিয়ে রুদ্রর ঘরে আসে। ঘর জুড়ে কুটকুটে অন্ধকার বিরাজ করছে। তানিয়া খুব সাবধানে দরজার সামনে আসতেই পায়ের নিচে কিছু একটা বাধে। তাতে তানিয়া একটু পিছিয়ে যায়। রুদ্র এসেই ঘরের সব জিনিস এলোমেলো করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে। দোলার সব জিনিসপত্র ফেলে দিয়েছে। জামা কাপড় প্রয়োজনীয় সব কিছু ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

— তানিয়া রুমের মধ্যে এসেই লাইট জ্বালিয়ে দেয়। দীর্ঘ সময় অন্ধকারে থাকার পরে হঠাৎ আলো আসায় রুদ্রর চোখ বন্ধ হয়ে আসে৷ আলোর ছটা গিয়ে তার চোখে ভীড় করে। যার ফলে রুদ্রর চোখ বন্ধ করতে বাধ্য হয়। তানিয়া একবার সারাঘর চোখ বুলিয়ে নেয়। সব কিছু এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। দোলার জিনিসপত্র গুলো যাচ্ছেতাই অবস্থা। সজল আর দোলার ছবি গুলো টেবিলের একপাশে অনাদরে পড়ে আছে।
– রুদ্র চোখ খুলে মাটির দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ রেখেছে।
– তানিয়া রুদ্রর দিকে এগিয়ে আসতে গেলে রুদ্র কাটগলায় বলে কেনো এসেছিস এখানে? কি চাই তোর? আমাকে একা থাকতে দে। যা এখান থেকে। আলো বন্ধ কর। রুদ্রর বলা কথা গুলো তানিয়ার ভয়ের কারণ হলেও তানিয়া তাও ভয় পাই না। কারণ তার যে কথা বলতে হবে রুদ্রর সাথে।

— রুদ্রর কথা উপেক্ষা করে তানিয়া এসে রুদ্রর সামনে বসে৷ রুদ্র এখনো একই ভাবে ফ্লোরের দিকে দৃষ্টি রেখে আছে। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে। গায়ের শার্টটা কুচকে আছে। রুদ্রকে দেখে বৃদ্ধস্ত মনে হচ্ছে৷

— ব্রো! নরম স্বরে ডেকে উঠে তানিয়া। তানিয়ার ডাকে রুদ্র মায়াভরা চোখে তাকায়৷ রুদ্র চোখ লাল হয়ে আছে৷ এটা রাগের জন্য নয়। কান্না গুলো ভেতরে রাখার ফল। রুদ্রর মুখ দেখে তানিয়ার অনেক খারাপ লাগে। রুদ্রও যে কষ্ট পাচ্ছে দোলার জন্য এটা তানিয়ার আর বুঝতে বাকি নেই। তানিয়া এবার রুদ্রর এক হাতের উপর তার হাত রাখে৷ রুদ্র এতে অবাক হয়ে তাকায় তানিয়ার দিকে।
– আমার কথা গুলো একবার শুনো। এরপর তোমার যা বলার বলো আমাকে আমি সবটা মেনে নেবো। কিন্তু প্লিজ ব্রো আমাকে বলতে দাও আগে। রুদ্র কোনো উত্তর দেয় না৷ শুধু আগ্রহ পূর্ণ চোখে কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে।

– বউমনি একদম নির্দোষ ব্রো৷ বউমনিকে ফাসানো হয়েছে। আচ্ছা তুমি মন থেকে একটা কথা বলো তো! বউমনিকে কি তোমার তেমন মেয়ে মনে হয়? তাছাড়া যার সাথে জুড়ে বউমনিকে অপবাদ দেওয়া হচ্ছে তার সাথে বউমনির নয় আমার জীবন জুড়ে আছে৷ তানিয়ার এই কথায় মানে রুদ্র বুঝতে পারে না তাই আগের চেয়ে দ্বিগুণ কৌতুহল নিয়ে তাকায়।

– আমি সজলকে ভালোবাসি আর সজলও আমাকে ভালোবাসে। বউমনির সাথে সজলের কোনো গোপন সম্পর্ক নেই বিশ্বাস করো। হ্যাঁ মানছি বউমনি সজলের সাথে দেখা করতে গেছে৷ ওই ছবি গুলো সত্যি। কিন্তু ছবি দেখে যা বোঝানো হচ্ছে সেটা ভুল। সেটা সঠিক নয়। বউমনি গিয়েছিলো সজলের সাথে দেখা করতে কিন্তু আমার ব্যাপারে কথা বলতে। তার জন্য নয়। (তানিয়া মিথ্যা বলে রুদ্রকে) রুদ্র অবাক হয়ে শুনছে তানিয়ার কথা গুলো। তানিয়ার চোখে পানি ছলছল। এরপর তানিয়া উঠে গিয়ে ছবিগুলো নিয়ে এসে রুদ্রর সামনে ধরে।
– তুমি একটু ভালো করে ছবি গুলো দেখো তাহলে সবটা বুঝতে পারবে। এরপর তানিয়া একটা ছবি রুদ্রকে দেখায় যেটায় সজল দোলাকে ধরে আছে।

– একটু মনোযোগ দিয়ে দেখো ব্রো৷ এখানে সজল বউমনিকে ধরে আছে ঠিকই কিন্তু বউমনিকে দেখো কেমন দুর্বল দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে বউমনির শরীর খারাপ করেছে আর সে সময় সজল বউমনিকে ধরে। আর ঠিক তখনই এই ছবিটা তোলা হয়।
– রুদ্র তানিয়ার থেকে ছবিটা হাতে নিয়ে খুব নিখুঁত ভাবে দেখতে থাকে। তানিয়া যা বলছে একদম সত্যি। দোলা একটা হাত মাথায় দিয়ে আরেকটা সজলের শার্ট খামচে ধরে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে দোলার শরীর খারাপ করছিলো সে সময়। এরপর রুদ্র একে একে সব ছবি গুলো নিয়ে দেখে।

— রুদ্র আহত চোখে তাকায় তানিয়ার দিকে। নিজেকে বড় অপরাধী লাগছে তার এখন। তাহলে কি সত্যি আমি ভুল। দোলার সাথে আমি অন্যায় করেছি। আমার সবটা আগে বোঝা উচিত ছিলো। কিন্তু ছবি গুলো আমাকে পাঠালো কে? কেনো পাঠালো? তাহলে কি সত্যি দোলাকে ফাঁসাতে চাই? এই সব প্রশ্ন রুদ্রর মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে৷
তুমি বউমনির সাথে অন্যায় করেছো ব্রো৷ তোমার ওইভাবে রিয়াক্ট করা ঠিক হয়নি। একবার সবটা শুনতে পারতে বউমনির থেকে। সব জানার পর নাহয় সিদ্ধান্ত নিতে। বউমনি অনেক কষ্ট পেয়েছে আজ কথাটা বলতেই গাল গড়িয়ে পানি পড়ে তানিয়ার।

— রুদ্র মাথা নিচু করে আছে অপরাধবোধে। সত্যি অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে তার। দোলাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছে সে। অনেক বাজে বাজে কথা বলেছে। সব কিছু ভেবে রুদ্রর আরো খারাপ লাগছে।

– আচ্ছা দোলা কেনো তখন কিছু বলল না। সবটা কেনো মেনে নিলো চুপচাপ! রুদ্র জিজ্ঞেস করে তানিয়াকে।

– প্রিয় মানুষটার থেকে আঘাত পেলে কথা থাকে না ব্রো। অনেক কিছু থাকে বলার কিন্তু প্রিয় মানুষটার দেওয়া কষ্ট গুলো সব কথা কেড়ে নেয় তখন৷ চাইলেও কিছু বলা হয় না। বউমনিরও হয়তো এমন হয়েছে৷ তোমাকে তো বউমনি অনেক ভালোবাসে৷ তোমার থেকে ওইসব কথা একদম আশা করেনি৷ তুমি ওই বাজে কথা গুলো না বললেও পারতে বউমনিকে।

— আমি এখন কি করবো তানু? কোন মুখে আমি দোলার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো৷ আমি যে অনেক বড় অন্যায় করেছি ওর সাথে। কোন মুখে ওইবাড়িতে গিয়ে উঠবো আমি বলতে পারিস। এতখনে হয়তো আঙ্কেল রোকন সবটা জেনে গেছে। এখন যদি আমি যায় তাহলে আমি অনেক ছোট হয়ে যাবো ওদের কাছে৷ কি করবো আমি বুঝতে পারছি না চুল টেনে ধরে বলে রুদ্র৷ এর মধ্যে রুদ্রর ফোনটা বেজে উঠে। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে হসপিটাল থেকে ফোন এসেছে। রুদ্র ভ্রু কুচকে ফোনটা রিসিভ করে। এরপর যা শুনে তাতে রুদ্রর মুখে হাসি ফুটে। কান্নার মাঝেও সুখের রেশ দেখা দেয়। বাবা হওয়ার অনুভূতি রুদ্রকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। রুদ্র ফোনটা রেখে তানিয়াকে জড়িয়ে ধরে। তানিয়া বেশ অবাক হয় রুদ্রর কাজে৷

— তানু রে আমি বাবা হবো। দোলা মা হতে চলেছে। হসপিটাল থেকে ফোন দিয়েছিলো। দোলার যে শরীর খারাপ। মাথাঘোরা বমি হওয়া এইসব হয় ওর কনসিভ করার কারণে। আমি বাবা হবো তানু৷ আমার আজ অনেক খুশি লাগছে৷ কতটা খুশি তোকে বলে বোঝাতে পারবো না তানু। রুদ্র চোখে পানি৷ খুশির পানি। রুদ্র মধ্যে তোলপাড় করা উত্তেজনা। হাত পা মৃদু কাঁপছে যেনো রুদ্রর। সত্যি প্রথম বাবা হওয়ার অনুভূতি অন্য রকম হয়। তানিয়াও অনেক খুশি হয়। তার মানে আমি পিপি হচ্ছি৷ আমাদের বাড়িতে পুচকে আসবে ব্রো৷ আমি তো ভাবতে পারছি না। উৎফুল্ল হয়ে বলে তানিয়া।
– আজ এই খুশির দিনে দোলা সাথে নেই আমার৷ আমি নিজ হাতে সবটা শেষ করে ফেলেছি বলে রুদ্র দেয়ালে বাড়ি মারে একটা ।

— ব্রো তুমি আর কিছু না ভেবে বউমনির কাছে যাও। আমার মনে হয়না বউমনি তোমাকে ফেরাবে। খুশির খবরটা বউমনিকে গিয়ে তুমি দাও। অভিমানের পাহাড়টা শক্ত ভীতে পরিনত হওয়ার আগে সবটা শেষ করে দাও৷ তার আগে তুমি মামুর সাথে কথা বলে যাও একবার৷ মামু ভীষণ আপসেট হয়ে আছে৷ ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে তখন গিয়ে। মামুর বয়স হয়েছে৷ এই সময় চিন্তা করা একদম ঠিক হবে না৷ তুমি মামুকে সবটা বুঝিয়ে বলো৷ মামুও যে বিশ্বাস করে না বউমনি এমন কিছু করতে পারে আমি জানি৷ সবাই একটা দ্বন্দ্ব, দোটানায় আছে।
– রুদ্র উঠে দাঁড়ায়। তাকে দোলার কাছে মাফ চেতে হবে। দোলাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। তার আগে তার বাবার সাথে কথা বলে যাবে রুদ্র। দোলাকে যেভাবে হোক নিয়ে আসবে রুদ্র এটা পণ করে। তানিয়ার মুখে এখন হাসি ফুটে। স্বস্তির শ্বাস ফেলে উপর আল্লাহকে শুকরিয়া জানায়৷ রুদ্র যে সবটা বুঝতে পেরেছে৷ সে যে রুদ্রকে সবটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছে এটাই অনেক।

–‘” তানভীর আহমেদ আর জেসমিন চৌধুরীর কথা কাটাকাটি চলছে। তানভীর আহমেদ জানে এইসবের পেছনে জেসমিন চৌধুরীর হাত আছে।

– তুমি আবারও একই খেলা খেলেছো জেসু। ২২ বছর আগে ভাবির সাথে তুমি অন্যায় করেছো৷ সব জানার পরও আমি চুপ করে আছি শুধু মাত্র তোমার দেওয়া কসমের জন্য। তুমি আজ আবার তার পুনরাবৃত্তি করলে। ওইটুকু একটা মেয়ের সাথে এত বড় অন্যায় করতে তোমার একটু বিবেকে বাধলো না। আর কত নিচে নামবে তুমি। কবে থামবে তোমার লোভ লালসার তৃপ্তি।

– দেখো একদম বাজে বকবে না৷ আমি কিছু করিনি৷ আমতাআমতা করে বলে জেসমিন চৌধুরী। এতে তানভীর আহমেদ আরো রেগে যায়।
– একদম মিথ্যা বলার চেষ্টা করবে না। আর কেউ না চিনুক তোমাকে আমি খুব ভালো করে চিনি। তুমি দোলার ছবি গুলো রুদ্রকে পাঠিয়েছো। ওদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করেছো। এই পরিবারের দিকে একবার তাকিয়ে দেখো কতটা অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। কেউ ভালো নেই দোলাকে ছাড়া। কেনো করেছো এই গুলা। কি ক্ষতি করেছে ওই মেয়েটা তোমার।

— অনেক বাড় বেড়েছিলো। তাই উপরে ফেলেছি। আমার পথের কাটা যে হবে আমি তাকে এইভাবেই উপরে ফেলবো। আর তোমাকে বলছি বেশি দরদ দেখাতে যাবে না৷ তাহলে কিন্তু ফল ভালো হবে না। যেমন চুপ ছিলে তেমন চুপ থাকবে সারাজীবন।

– অনেক হয়েছে জেসু আর নয়। আমি আর চুপ থাকবো না৷ সবটা সবাইকে এবার জানিয়ে দেবো। তানভীর আহমেদের কথায় জেসমিন চৌধুরী শব্দ করে হেসে উঠে। এতে তানভীর আহমেদ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকে কৌতুহল হয়ে।

— প্রমাণ কোথায়? তোমার কথায় ভিত্তিতে তো আর সবটা প্রমাণ হয়না। আমি যে করেছি সব তার প্রমাণ আছে তোমার কাছে৷ রুদ্র ভাইজান মানবে তোমার মুখের কথা৷ ওদের আমি এমন বশ করে রেখেছি যে আমার নামে কিছু বললে একদম বিশ্বাস করবে না। উল্টো তুমি ফেসে যাবে৷ তাই সাবধান হেসে বলে জেসমিন চৌধুরী। কিন্তু তার সব কথা যে রুদ্র বাইরে দাঁড়িয়ে শুনছে সেটা জেসমিন চৌধুরী আর জানে না।

চলবে…

#তুমিময়_আসক্তি
#কলমে_আলো_ইসলাম

“৩৪”

–” জেসমিন চৌধুরীর কথা শুনে রুদ্র যতটা না অবাক হয়! তার চেয়ে বেশি রাগ উঠে। রাগে হাতের শিরা গুলো ফুলে ফেঁপে উঠে৷ চোখ দিয়ে আগুন ছুটছে যেনো। যাকে এত ভরসা করেছে! এত বিশ্বাস করছে, সেই এত বড় ক্ষতি করে এসেছে এতদিন। কাছের মানুষ হয়েও এত বড় ষড়যন্ত্র করেছে৷ রুদ্র আর কিছু ভাবতে পারছে না। ইচ্ছে করছে জেসমিন চৌধুরীকে শাস্তি দিতে৷ এখনই গলা টিপে মেরে দিতে৷
— দেখো জেসমিন সব কিছুর একটা শেষ থাকে। তোমার করা পাপেরও শেষ হবে একদিন৷ আর সেদিন হবে তোমার পতন৷ সেদিন কিন্তু কাউকে পাশে পাবে না। না আমি না তোমার সন্তান। আর রইলো রুদ্র আর ভাইজান৷ ওরা তো অনেক আগেই তোমার থেকে দূরে সরে আছে৷ যখন তোমার এইসব কুকর্মের কথা জানতে পারবে। তখন সব চেয়ে বেশি ঘৃণা করবে ওরা তোমাকে। কঠিন শাস্তি পেতে হবে তোমাকে এটা মনে রেখো৷ আমি আর সহ্য করব না। রুদ্র আর ভাইজান কে সব বলব৷ এরপর তোমাকে পুলিশে দেব আমি রেগে বলে তানভীর আহমেদ।

— সত্যি! ব্যঙ্গ করে বলে জেসমিন চৌধুরী। তানভীর আহমেদ ভ্রু কুচকে থাকে।
— তোমার কি মনে হয় পুলিশ তোমার মুখের কথা বিশ্বাস করবে। মানে তুমি গিয়ে বললে আর ওরা মেনে নিলো। আরে প্রমাণ চাই প্রমাণ। আছে কোনো প্রমাণ তোমার কাছে? আদালত প্রমাণ ছাড়া কিছু বিশ্বাস করেনা৷ তাই তোমার মুখের কথায় তারা কিছুই করবে না। তাই নিজের ভালো চাও তো চুপ থাকো। আমাকে আর বিরক্ত করো না যাও এখান থেকে।
– রুদ্র চেয়েছিলো এখনই জেসমিন চৌধুরীর মুখোমুখি হতে কিন্তু জেসমিন চৌধুরীর কথা শুনে আর এগোই না। সত্যি প্রমাণ ছাড়া কেউ কিছু বিশ্বাস করবে না। তাই রুদ্র ঠিক করে জেসমিন চৌধুরীর মুখ থেকেই সবটা বের করবে। তার আগে দোলাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে তাকে। দোলা হয়তো কিছু জানে। নাহলে পিপি দোলার সাথে এমন করবে কেনো? আমাকে সবটা জানতে হবে! মনে মনে ভাবে রুদ্র। এরপর সেখান থেকে চলে যায়। তানভীর আহমেদও আর কিছু না বলে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে।

— অন্ধকার রাত। আকাশে চাঁদের আলো নেই আজ পরিপুর্ণভাবে। তারা গুলো মিটিমিটি জ্বলে তো আবার মেঘের বুকে মুখ লোকায় কিছুখন পর পর। মৃদু বাতাস বয়ছে। দোলা বারান্দার দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা আর মেঘের খেলা দেখছে স্থীর চোখে। গালের উপর দুই ফোঁটা পানি খুবই সাচ্ছন্দ্যে আছে। চোখের মধ্যে পানি টলমল করায় দোলা তারাগুলো কে ঝাপসা দেখছে। বারবার ওই বাড়ির সবার কথা মনে পড়ছে দোলার। সবাই কত আপন হয়ে গেছে এই অল্প সময়ে। আপন হবে নাই বা কেনো? ওইটা তো দোলার নিজের বাড়ি। মানুষ গুলোও নিজের ছিলো। শুধু যার সুত্রে এত প্রিয়জন পাওয়া! সেই শুধু আপন ছিলো না৷ আর না হতে পেরেছে। এই সব কিছু ভেবে দোলার নিশ্বাস আটকে আসে যেনো বারবার। রুদ্রর বলা প্রতিটি কথা প্রতি মুহূর্তে দোলাকে আঘাত করে যাচ্ছে। বিশ্বাস নামক বস্তুর উপর দোলার বিশ্বাস উঠে গেছে৷

– দোলা এসে পর্যন্ত ঘরে বসে আছে। রাশেদ মিয়া দোলাকে খাওয়ার জন্য ডাকলে দোলা খাবে না বলে। ওই বাড়ি থেকে নাস্তা করে এসেছে তাতে তার পেট ভরা আছে। তার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে তাই ঘুমাতে চাই বলে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। রাশেদ মিয়াকে কিছু বলার সুযোগই দেয়নি। কিন্তু রাশেদ মিয়ার ভালো লাগছে না দোলার কর্মকাণ্ড। দোলার চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে। বাবার মন তো তাই হয়তো সন্তানের মন খারাপ টা একটু হলেও আঁচ করতে পারছে।
— রুদ্র তার বাবার সাথে কথা বলে বেরিয়ে আসে গাড়ি নিয়ে। সে তার বাবাকে কথা দিয়ে এসেছে দোলাকে যেভাবে হোক ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।

–“” দোলার ফোন বেজে উঠাই ভাবনার ব্যাঘাত ঘটে। বিরক্ত হয় এতে দোলা। ফোনের রিংটোন’টাও আজ যেনো অসহ্য লাগছে দোলার কাছে। তারপরও শত বিরক্ত নিয়ে রুমে এসে ফোন হাতে নিয়ে দেখে সজলের ফোন। সজলের নাম দেখে দোলার মনটা আরো বেশি খারাপ হয়ে যায়। বিষন্নতায় ঘিরে ধরে তাকে। সজলকে নিয়ে তো আজ দোলাকে অপবাদে দেওয়া হয়েছে৷ কোনো অপরাধ না করেও দুটো মানুষ আজ অপরাধী। জঘন্যতম ট্যাগ দেওয়া হয়েছে। পরোকিয়া নামক বস্তুটি দোলার সাথে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে৷ সব কিছু ভেবে দোলা আবারও একই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এর মধ্যে ফোনটা বেজে কেটে যায়। কিছুখন বাদে আবার বেজে উঠে। দোলা এবার সাথে সাথেই রিসিভ করে।

–“” ব্যস্ত ছিলেন বুঝি? সরি এখন ফোন করার জন্য। আচ্ছা আশেপাশে রুদ্র নেই তো? কিছু কথা ছিলো আপনার সাথে। দোলা কিছু বলার আগেই সজল বলে। দোলা ছোট করে বলে হ্যাঁ বলুন।

–‘” আচ্ছা জেসমিন চৌধুরীর সাথে যদি মনিমার কথা বলায় তাহলে কেমন হয়? সজলের কথায় দোলা ভ্রু কুচকে আসে৷ বুঝতে যে পারিনি সজলের কথা সেটা মুখোভঙ্গি বলে দিচ্ছে। দোলা তারপরও কিছু বলেনা চুপ করে থাকে।
– আমার কথা বুঝেননি তাই তো? সজলই বলে উঠে নিজে থেকে। দোলা সাবলীল ভাবে না বলে।

— মনিমা যদি জেসমিন চৌধুরীর সাথে দেখা তারপর কথা বলে তাহলে আমার মনে হয় জেসমিন চৌধুরী মনিমাকে দেখে কিছু না কিছু তো বলবে আগের কথা। দেখা গেলো নিজ মুখে সব স্বীকার করতেও পারে। তখন আমাদের প্রমাণ যোগাড় করাটা সহজ হয়ে যাবে। জেসমিন চৌধুরীর নিজ মুখে স্বীকারোক্তি পাওয়া যাবে। যদিও জানি কাজটা সহজ হবে না। আবার কতটা প্ল্যান মাফিক হবে তাও জানি না। কিন্তু আমরা চেষ্টা তো করতে পারি একবার। সজলের আইডিয়াটা দোলার ভালো লাগে। কিন্তু সব কিছু এত সোজা হবে না এটা দোলাও জানে৷ কিন্তু কিছু তো একটা করতে হবে। দোলার ওই বাড়িতে এই সময় থাকাটা খুবই দরকার ছিলো। কিন্তু পরিস্থিতি সব কিছু এলোমেলো করে দিয়েছে। এরপরও দোলা থেমে থাকবে না। যা করার করবে। জেসমিন চৌধুরীর কীর্তি ফাস করে ছাড়বে এবার। অনেক সময় নিয়ে ফেলেছে, অনেক খেলা খেলেছে জীবন নিয়ে আর নয়।

–‘আচ্ছা যদি মায়ের কোনো ক্ষতি করে সে। আমার মনে হয় জেসমিন চৌধুরী জানে মা আর বেঁচে নেই৷ এখন যদি মাকে দেখার পর আবার হত্যা করার চেষ্টা করে তাহলে? চিন্তিত হয়ে বলে দোলা।
– আমরা তো থাকবো সেখানে৷ আপনি এত ভয় পাচ্ছেন কেনো দোলা? তাছাড়া ও যদি মনিমার কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করতে যাই তাহলে আরো ভালো হবে আমাদের ওর বিরুদ্ধে প্রমাণ কালেক্ট করা।

– আচ্ছা আমাকে একটু সময় দিন ভাবার জন্য। আমি আপনাকে পরে জানাচ্ছি। আর একটা কথা তানিয়াকে এইসব কিছু বলবেন না দয়া করে। এমনিতে ও অনেক আপসেট আছে সব কিছু শোনার পরে। যতই হোক ফুপি তো তার মা। তাই মায়ের শাস্তি কোনো সন্তানই কখনো চাইবে না। আর না নিজ চোখে দেখতে পারবে।
– দোলার কথায় সজল একটা হতাশার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে আমি সবটা বুঝতে পারছি দোলা। চিন্তা করবেন না। তানিয়া কিছু জানবে না৷ আমি জানি ও সেদিন অনেক কষ্ট পেয়েছে৷ কিন্তু আজ না হোক কাল সত্যিটা তো ওকে জানতেই হতো।
– এরপর একটু কথা বলে রেখে দেয় ফোন দোলা।
–” দোলার মধ্যে এখন জেসমিন চৌধুরী কে শাস্তি দেওয়ার প্রয়াস। অন্য কিছু ভাবার সময় নেই তার। এর মধ্যে দোলার গা গুলিয়ে আসে আবার৷ দোলা দৌড়ে ওয়াসরুমে যায়। হঠাৎ হঠাৎ এমন হওয়াতে দোলার মধ্যেও এবার খুবই সংশয় দেখা দেয়।

— দোলা ফ্রেস হয়ে বের হতেই রাশেদ মিয়ার কন্ঠস্বর শোনা যায়। বেশ উৎফুল্লতার সাথে দোলাকে ডাকছেন তিনি। দোলা বুঝতে পারে না এত রাতে ডাকার মানে কি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত ১১ টা বাজছে। কোনো সমস্যা হয়েছে ভেবে দোলা তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলে দ্রুত পায়ে ড্রয়িং রুমে আসতেই দোলার পা থমকে যায়। সামনে রুদ্রকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠে। সাথে দম বন্ধ হয়ে আসে তার৷ কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে থাকে রুদ্রর দিকে। দোলাকে দেখে রুদ্রর মুখে তৃপ্তিকর হাসি ফুটে উঠে। কিন্তু পরোক্ষে হাসিটা মিলিয়ে যায় দোলার চোখ মুখের অবস্থা দেখে। কান্নার রেশ দোলার ফেসে বিদ্যমান। দোলা চোখ নামিয়ে নেয় রুদ্রর থেকে। রাশেদ মিয়া বেশ খুশি রুদ্রকে দেখে। তার মধ্যে যে সংশয় কাজ করছিলো দোলাকে নিয়ে সেটা এখন আর নেই রুদ্রকে দেখার পরে। রোকন ও অনেক খুশি রুদ্রকে দেখে।

–” জামাই আসবে কই আগে বলিসনি তো দোলা মা। আমি তো তেমন কিছু রান্নাও করেনি। এখন কি খেতে দিই ছেলেটাকে বলতো। ব্যস্ত হয়ে বলে রাশেদ মিয়া।
– দোলা কোনো কথা বলে না।
– না না আঙ্কেল ব্যস্ত হবেন না। তাছাড়া আমি খেয়ে এসেছি চিন্তা করবেন না। ( মিথ্যা বলে)। তাছাড়া আমি যে আসব দোলাও জানে না৷ তাই আপনাকে বলিনি। আমি দোলাকে নিয়ে যেতে এসেছি আঙ্কেল। বাবা পাঠালেন আমাকে দোলাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। দোলাকে ছাড়া সবার মন খারাপ ওই বাড়ির। তাই বাবা আমাকে বললেন তার মেয়েকে নিয়ে যেতে। বেশ হাসি মুখে বলে রুদ্র কথা গুলো। কিন্তু দোলার অনেক বিরক্ত লাগছে রুদ্রর কথা গুলো! সাথে দোলা অবাকও হচ্ছে৷ হঠাৎ রুদ্র আসার কারণ বুঝতে পারছে না। আবার নিয়ে যেতে কেনো চাচ্ছে এটাও বুঝতে পারছে।

–‘ বসো না রুদ্র বাবা। মেয়েটা এলো সন্ধ্যায়। থাকুক না একদিন। নুয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে রাশেদ মিয়া। রুদ্র কি বলবে এখন বুঝতে পারছে না৷
– তুমি থেকে যাওনা বাবা আজ রাতটা৷ কাল সকালে নাহয় যেও দুজন মিলে। রাশেদ মিয়ার কথায় রুদ্র একটা আশার আলো দেখতে পাই। কিন্তু মুখে কিছু বলে না।
– দোলা আর দাঁড়ায় না সেখানে৷ ভেতরে চলে যায়। রুদ্রর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছে তার। তাছাড়া সে চাইও না রুদ্রর সামনে আসতে আর। তাহলে কেনো এসেছে সে মানুষটা?

-” দোলাকে চলে যেতে দেখে রুদ্র আশাহত হয়। দোলা যে ভীষণ রেগে আছে তার উপর রুদ্র বেশ উপলব্ধি করতে পারছে। রেগে থাকাটাই তো স্বাভাবিক। দোলার সাথে যে বিহেভ করেছে রুদ্র এরপর দোলা যে রাগ অভিমান করে থাকবে এটাই তো উচিত ছিলো।

–‘ যাও বাবা ঘরে যাও। দোলা’মার শরীরটা মনে হয় ভালো না। এসে পর্যন্ত দেখি মন খারাপ করে আছে। রাতে খাবার জন্য বললাম তাও খেলো না। বলে ওই বাড়ি থেকে নাকি নাস্তা করে এসেছে৷ এখন আর খাবে না। সব শুনে রুদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সাথে এটাও নিশ্চিত হয় যে দোলা এখানে কাউকে কিছু বলেনি। রুদ্র তো ভয়ে ভয়ে ছিলো দোলা সবটা বলে দিছে ভেবে। আসলেই দোলার তুলনা হয়না । আর আমি এই মানুষটার সাথেই বারবার অন্যায় করি। মনে মনে বলে রুদ্র।

-‘ আঙ্কেল আমাকে দোলার খাবারটা দিবেন। ওর এই সময় না খেয়ে থাকাটা একদম উচিত হবে না৷
– রুদ্রর কথা বুঝতে পারেনা রাশেদ মিয়া। তাই কৌতুহল নিয়ে বলে এই সময় মানে? রাশেদ মিয়ার কথায় রুদ্র ঘাবড়ে যায়। লজ্জায় পড়ে যায় সে। নিজ মুখে বাবা হওয়ার কথাটা কি করে বলে সে তার শ্বশুরকে। রুদ্র কথাটা কাটিয়ে বলে আপনি আমাকে দোলার খাবার টা দিন প্লিজ। এই সময় বলতে আমি রাত বুঝিয়েছি৷ মানে রাতে না খেয়ে থাকাটা ঠিক হবে না। রুদ্রর কথায় রাশেদ মিয়া ওহ বলে দোলার জন্য খাবার নিয়ে আসতে যায়। রুদ্র একটা স্বস্তি শ্বাস ছাড়ে।

–” দোলা বারান্দায় দাঁড়ায় এসে। রুদ্র সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই তার মধ্যে। রুদ্রর সাথে তার আর কোনো কথা থাকতে পারে বলে মনে হয়না।

–‘ রুদ্র দোলার খাবার টা নিয়ে রুমে আসে। দোলার রুমটাও অন্ধকার হয়ে আছে। বারান্দার জিরো পাওয়ারের লাইট জ্বলছে। তার মৃদু আলো ঘরে প্রবেশ করছে৷ রুদ্র খাবার টা টেবিলে রেখে বারান্দার দিকে এগিয়ে যায়। সে জানে দোলা বারান্দায় আছে।
–” রুদ্র বারান্দায় যেতেই দোলা পিছু না ঘুরে বলে কি চাই এখানে? দোলার কথায় রুদ্র থেমে যায়। আহত চোখে তাকায় দোলার দিকে। এরপর অপরাধী কণ্ঠে বলে! তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাই। রুদ্রর কথায় দোলা রুদ্রর মুখোমুখি ঘুরে৷ এরপর মুখে ব্যঙ্গ হাসি নিয়ে এসে বলে! আমার মতো ঠক, প্রতারক, বেইমান,বাজে মেয়ের সাথে রুদ্রনীল চৌধুরীর আবার কি দরকার থাকতে পারে বুঝতে পারছি না। যার জন্য তাকে ছুটে আসতে হয়েছে আমার মতো কল গার্লকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। দোলার প্রতিটি কথা রুদ্রকে চরম ভাবে আঘাত করে ভেতরে গিয়ে। ব্যথিত চোখে তাকায় রুদ্র দোলার দিকে। এরপরও রুদ্রর একটুও খারাপ লাগে না। খারাপ লাগার কথাও না।।কারণ দোলাকে যেভাবে অপমান করেছে, বাজে কথা বলেছে তাতে এই কথাগুলো রুদ্রর প্রাপ্য।

— আমি ভুল করেছি দোলা। তার জন্য আমি অনুতপ্ত। প্লিজ এইভাবে বলো না। তুমি তো জানো আমি মেয়েদের কেমন চোখে দেখতাম, তাদের সম্পর্কে আমার ধারণা কেমন ছিলো। সব কিছু থেকে তুমি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছো। বিশ্বাস করতে শিখিয়েছো। তাই ফের এই আঘাত, অবিশ্বাসের দেয়ালটা আবার সামনে আসায় নিজেকে সামলাতে পারিনি৷ কিছু সময়ের জন্য আমার মনে হয়েছিলো আমি আবারও ঠকে গেছি। যার দ্বারা আমি নতুন করে জীবনের সব কিছু শুরু করতে পারছি সে আমাকে ঠকিয়েছে৷ আমি নিজেকে বুঝাতে পারিনি৷ ঠিক ভুল বিচার করার মতো অবস্থাতেও ছিলাম না তখন। তাই তোমাকে আঘাত করে ফেলেছি, অনেক বাজে বিহেভ করেছি৷ প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও দোলা হাত জোড় করে বলে রুদ্র৷
– দোলা চোখ ফিরিয়ে নেয় রুদ্রর থেকে। রুদ্রকে এইভাবে দোলা দেখতে পারছে না।

— নিজেকে আর ছোট করবেন না রুদ্রনীল চৌধুরী। আপনাকে এইভাবে মানায় না৷ তাই জোর করে কোনো কিছু করতে যাবেন না৷ দোলার মুখে নিজের নাম শুনে রুদ্র করুণ চাহনি নিয়ে তাকায়৷ কারণ দোলা রুদ্রকে ছোট সাহেব ছাড়া কখনো ডাকেনি। অভিমানে দেয়ালটা এত শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে যে রুদ্র ছোট সাহেব ডাক শোনার যোগ্যতাও হারিয়ে ফেলেছে৷

–” দোলা একবার বোঝার চেষ্টা করো। বলছি তো আমার ভুল হয়ে গেছে৷ রুদ্রর কথায় দোলা রাগী লুকে তাকায় রুদ্রর দিকে।
–” বারবার কেনো আমাকে ভুলের স্বীকার হতে হবে বলতে পারেন আপনি। কেনো আমাকে সব কিছু সব সময় মেনে নিতে হবে। আমাকে কি আপনার মানুষ মনে হয়না৷ আমার কি অনুভূতি, অভিমান, আশা প্রত্যাশা থাকতে পারে না৷ কেনো অবিশ্বাসের মালা আমাকে পড়তে হবে। আমি মেয়ে বলে। আপনার সাথে কে একজন প্রতারণা করে গেছে তার দায় কেনো গোটা মেয়ে সমাজ নিবে বলতে পারেন আমাকে? সবাইকে কেনো এক পাল্লায় তুলে মাপতে হবে? অনেক সহ্য করেছি, মেনে নিয়েছি, বলতে পারেন থাকতে চেয়েছিলাম, মনের কোথাও একটা ভালো লাগা ছিলো তাই মানতে বাধ্য হয়েছি কিন্তু আর নয়। অনেক হয়েছে! চাইনা আমি এই সম্পর্ক। যে সম্পর্কে বিশ্বাস নাই৷ একটা মানুষের জন্য অপরপাশের মানুষের মধ্যে সম্মান নেই সে সম্পর্ক আমি চাইনা৷ মুক্তি চাই আমি বুঝেছেন আপনি৷ আমার মতো বাজে মেয়ে কারো সাথে থাকতে পারে না৷ রুদ্রনীল চৌধুরীর সাথে তো নয়ই। তাই প্লিজ আমাকে আমার মতো থাকতে দিন৷ চলে যান আপনি এখান থেকে। ডিভোর্স পেপারে পাঠাবেন বলেছেন না। দিয়ে দিন আমি সাইন করে দেবো কথাটা বলে দোলা কেঁদে উঠে। রুদ্রর চোখের মধ্যেও পানি টলমল করছে। রুদ্র খুব করে চেষ্টা করছে চোখের পানি গুলো চোখের আবদ্ধ রাখতে কিন্তু চোখ কি আর সব সময় কথা শোনে। রুদ্রর কথাও শোনেনি৷ তাই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়েছে দুই ফোটা পানি৷ রুদ্র সেটা সংগোপনে মুছতে গেলে দোলার চোখে পড়ে যায়৷ তারপরও যেনো দোলার একটুও মায়া হয়না আজ রুদ্রর প্রতি। চোখ ফিরিয়ে অন্য দিকে ঘুরে দাঁড়ায় দোলা। তার চোখের পানিও আজ কাউকে দেখাতে চাইনা। চাইনা আর কারো দয়া পেতে। মায়ার কারণ হতে।

–” আমাদের সন্তানের কথা ভেবে অন্তত ফিরে চলো দোলা নুয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে রুদ্র। রুদ্রর থেকে হঠাৎ এমন কথা শুনে দোলা অবিশ্বাস্য চোখে তাকায় রুদ্রর দিকে। চোখ মুখে উপচে পড়া কৌতুহলের ভীড়। রুদ্রর কথার মানেটা কি হতে পারে দোলার জানা নেই।

— আমাদের সন্তান তোমার গর্ভে দোলা। ডক্টর রিপোর্ট দিয়েছে সন্ধ্যায়। তুমি মা হতে চলেছো কথাটা বেশ আগ্রহ নিয়ে বলে রুদ্র৷ দোলার চোখ দিয়ে আরো কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে কিন্তু সেটা কষ্ট বা দুঃখের নয় আনন্দের। দোলার একটা হাত আপনাআপনি পেটে চলে যায়৷ রুদ্রর দিকে এখনো অবাক চোখে তাকিয়ে আছে৷ রুদ্র মুখে হাসি নিয়ে এসে মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ বললে দোলা তার পেটের দিকে তাকায়৷

–‘ দোলার মধ্যে এখন অন্যরকম সুখের অনুভূতি। এত দুঃখ কষ্টের মাঝে এমন একটা সুখকর খবর পাবে দোলা ভাবিনি। দোলার মধ্যের অনুভূতিটা ঠিক কেমন এখন বলে বোঝানোর মতো নয়৷ একজন মেয়ের কাছে প্রথম মা হওয়ার অনুভুতিটা কেমন থাকে সে একজন মা’ই জানে শুধু। দোলার কান্না করতে ইচ্ছে করছে খুব। তার সন্তান তার গর্ভে আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে অথচ সে একটিবারের জন্যও বুঝতে পারলো না। রুদ্র দোলার দিকে গভীর দৃষ্টি রেখে দোলার মা হওয়ার অনুভূতিটা উপভোগ করছে।

….চলবে