তুমিময় আসক্তি পর্ব-৪৬ এবং শেষ পর্ব

0
1418

#তুমিময়_আসক্তি
#কলমে_আলো_ইসলাম

“অন্তিম পর্ব”

–” দোলা রুদ্রর দুই গালে আলতো করে হাত রেখে মোহনীয় চোখে তাকিয়ে বলে, আমি জানি! আপনি রাগী, বদমেজাজি কিন্তু আপনি খারাপ নন। আপনার মন অনেক ভালো, আপনি ভালবাসতে জানেন৷ তবে এইটুকু বলতে পারি পরিস্থিতি যাই হোক না কেনো আমি কখনো আপনাকে ছেড়ে যাবো না৷ আপনার সাথে থাকবো আপনার পাশে ছায়া হয়ে। আপনার অস্তিত্ব যে আমার মধ্যে ছোটো সাহেব। সে অস্তিত্ব ভুলে যাওয়ার উপায় আছে নাকি৷ দোলার কথায় রুদ্র দোলার পেটের উপর হাত রাখে। দোলা মৃদু কেঁপে উঠে৷ মায়াবী চোখে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে থাকে৷ রুদ্র ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে এসে বলে আমাদের সন্তানকে সাক্ষি রেখে বলছি আমি কখনো তোমাকে ভুল বুঝব না৷ তোমার সাথে খাবার বিহেভ করবো না৷ অনেক অনেক ভালবাসবো৷ রুদ্রর কথায় দোলা মুচকি হেসে উঠে।

–” আচ্ছা আপনার কি চাই? মানে মেয়ে নাকি ছেলে কোনটা হলে খুশি হবেন? কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে বলে দোলা। রুদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুখন নিরব চাহনিতে দোলার দিকের তাকিয়ে থেকে বলে, আমার মেয়ে চাই একটা। ফুটফুটে সুন্দর একটা মেয়ে। আমি প্রথম মেয়ের বাবা হতে চাই। যে মেয়েদের আমি ঘৃণা করতাম, অবহেলা করতাম, দোষী ভাবতাম। সে মেয়ে সন্তানের বাবা হয়ে আমি আমার মতো মানুষ গুলো কে দেখাতে চাই যে, মেয়েরা ঘৃণা জন্য নয়। তাদের অবহেলা নয় ভালবাসতে হয়৷ তাদের আদরে রাখতে হয়। আমি আমার মেয়েকে অনেক অনেক আদর যত্ন দিয়ে বড় করতে চাই। একজন মেয়ে দোষী মানে সবাই দোষী হয়না এটা বোঝাতে চাই। আমি খুব করে চাই আমার একটা মেয়ে সন্তান আসুক৷ আমি তাকে কোলে পিঠে আদর দিয়ে বড় করব। আমার সে ইচ্ছে পূরণ করবে তো দোলা। আশাবাদী হয়ে বলে রুদ্র। রুদ্রর প্রতিটি কথা মুগ্ধ হয়ে শুনতেছিলো দোলা। ভেবেছিলো রুদ্র হয়তো ছেলের কথা বলবে৷ কিন্তু দোলাকে অবাক করে দিয়ে রুদ্র মেয়ের কথা বলে। এতে দোলা ভীষণ ভীষণ খুশি হয়৷

— জানি না কি আছে ভাগ্যে। তবে আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেনো আমার স্বামীর মনের ইচ্ছেটা পূরণ করে। আমিও চাই আমাদের প্রথম সন্তান মেয়ে আসুক৷ দোলার কথা শেষ হতেই রুদ্র দোলার কপালে একটা ভালবাসার পরশ ছুঁয়ে দেয়৷ দোলা পরম আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে৷ এরপর রুদ্র দোলার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস কন্ঠে বলে, আজ তোমাকে অনেক ভালবাসতে চাই দোলা৷ অনেক অনেক আদর করতে চাই। যদি তুমি অনুমতি দাও তবে। রুদ্রর এমন মাতাল করা কন্ঠের কথা দোলাকে শিহরিত করে দেয়৷ লজ্জায় রাঙা হয়ে আসে দোলার মুখশ্রী। ঠোঁটের কোণে লাজুক মৃদু হাসি। দোলা আর বসে থাকতে পারে না রুদ্রর সামনে। মুচকি হেসে উঠে আসতে চাইলে রুদ্র হাত টেনে ধরে দোলার৷ দোলা কেঁপে উঠে ঠাঁই দাঁড়িয়ে যায়৷ বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ শব্দ করছে। মনের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়। দোলার আচরণে রুদ্র তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যায়৷ তাই দোলাকে আবারও কোলে তুলে নিয়ে রুমের মধ্যে আসে৷ দোলার সাহস হয়না একবারের জন্য রুদ্রর দিকে তাকানোর। ভীষণ ভাবে লজ্জা করছে তার এই মুহূর্তে। রুদ্র দোলাকে নিয়ে এসে খাটের উপর বসিয়ে দেয়৷ দোলার দৃষ্টি মাটিতে আবদ্ধ। এরপর রুদ্র দোলার পায়ের কাছে বসে যায়৷ রুদ্রকে নিচে বসতে দেখে দোলা অবাক চাহনিতে রুদ্রর দিকে তাকায়৷ চোখ মুখে উপচে পড়া কৌতুহলের আবেশ।

– রুদ্র পাশে থাকা টেবিল থেকে একটা বক্স হাতে নেয়। দোলা এখনো একই লুকে তাকিয়ে আছে।

–” রুদ্র বক্স থেকে একটা লকেট বের করে যাতে সুন্দর করে ইংরেজিতে D.R লেখা বড় হাতের অক্ষরে। আর একটা পায়েল বের করে। পায়েলটা অসম্ভব সুন্দর লাগছে। দোলা অবাকিত চোখে দেখছে শুধু। রুদ্র লকেট’টা রেখে আগে পায়েলটা পড়িয়ে দেয় দোলার পায়ে। অনেক সুন্দর মানিয়েছে দোলার পায়ে পায়েলটা। এরপর উঠে লকেট’টা পড়িয়ে দেয়।

– আমার তরফ থেকে ছোট্ট একটা উপহার আজকের দিনে। বিয়েতে তো তোমাকে কিছু দিতে পারিনি। আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে এটা বানিয়ে নিয়ে এসেছি তোমার জন্য। তোমার পছন্দ হয়েছে? সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে রুদ্র। দোলা মুচকি হেসে বলে অনেক পছন্দ হয়েছে৷ স্বামীর দেওয়া প্রথম উপহার কোনো স্ত্রীর কাছে খারাপ লাগতে পারে বলে আমার জানা নেই। আমি অনেক খুশি হয়েছি। সত্যি নিজেকে আজ বড় ভাগ্যবতী লাগছে আপনার মতো একটা জীবন সঙ্গী পেয়ে। দোলার কথায় রুদ্র কিছু না বলে মুচকি হাসে শুধু।

–‘ একটু নিরবতা যাওয়ার পর রুদ্র দোলার দিকে মাদক চাহনিতে তাকায়। রুদ্রর নেশাময় দৃষ্টি দেখে দোলাও লজ্জায় কুঁকড়ে উঠে।
–‘ এবার কি আমি একটু ভালবাসতে পারি ম্যাডাম? রুদ্রর কথায় দোলা কেঁপে উঠে। বিসানার চাদর খামছে ধরে। মাথা নিচু করে লাজুক হাসে৷ রুদ্র ঠোঁট কামড়ে হাসে৷ আসলে কথাটা দোলাকে লজ্জা ফেলার জন্য বলে রুদ্র৷ এরপর দোলার গলায় মুখ ডুবিয়ে দেয় রুদ্র৷ দোলা যেনো অতল সুখের রাজ্যে একধাপ এগিয়ে যায় এতে। আস্তে আস্তে তাদের ভালবাসা প্রকাশ পেতে থাকে৷ সূচনা হয় এক গভীর ভালবাসাময় রজনীর। সেখানে আছে দুটি মানুষের মনের ইচ্ছে,দুজন দুজনের মাঝে বিলীন হয়ে যাওয়া।

———————————————-

—-” দীর্ঘ পাঁচ বছর পর…
–” একটা ড্রেস নিয়ে মারামারি করছে রাদ আর রোদ দুবোন। রোদ বলে এটা তার ড্রেস তো রাদ বলে নাহ এটা তার ড্রেস। একটা ড্রেস দুবোনের হাতের মধ্যে অল্প অল্প করে আছে৷ জামার যদি প্রাণ থাকতো বা কথা বলতে পারতো তাহলে নিশ্চয় রাদ আর রোদের থেকে ছুটে পালাতে চাইতো। মারামারির এক পর্যায়ে রুদ্র রুমের মধ্যে প্রবেশ করে তাদের৷ দুবোন কে একটা ড্রেস নিয়ে টানাটানি করতে দেখে অবাক হয়ে যায়।

— একি মামনীরা! কি করছো এই গুলো তোমরা। জামা তো ছিড়ে যাবে মা এই ভাবে টানাটানি করলে। রুদ্রকে দেখে রাদ ন্যাকা কান্না জুড়ে বলে, বাবা দেখো রোদ আমার ড্রেস দিচ্ছে না। এটা নাকি ওর ড্রেস।
– বাবা বলো এটা তুমি আমার জন্য নিয়ে এসেছো না পিপি বাড়ি যাবো বলে। রাদ আমার ড্রেস নিয়ে বলে এটা নাকি ওর জন্য নিয়ে এসেছো তুমি। দুজনের কথা শুনে রুদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দুজনকে কোলে তুলে নেয়।

– রুদ্র আর দোলার টুইন বেবি হয়েছে। দুইটা মেয়ে সন্তানের জন্ম দেয় দোলা। রিসিপশনের পর থেকে রুদ্র আর দোলার ভালবাসাময় দিন গুলো সুন্দর থেকে সুন্দর হয়ে উঠে। রুদ্রর ভালবাসা দিন দিন বাড়তেই থেকেছে দোলার প্রতি। একেকটা দিনে একেক রকম ভাবে নিজেকে উপস্থাপন করেছে রুদ্র তার ভালবাসা দিয়ে। দোলা মন উজাড় করে রুদ্রর ভালবাসা উপভোগ করে গেছে এমনকি এখনো করছে।
– যেখানে দোলারই কথা ছিলো রুদ্রকে সামলানো। তার রাগ জেদ মানিয়ে নেওয়ার কথা সেখানে রুদ্রকে সবটা সামলাতে হয়েছে। রুদ্র কখনো দোলার উপর রাগ বা অভিমান করেনি আর। যা কিছু করার দোলায় করতো সব সময় আর রুদ্র সেগুলো হাসি মুখে সামলে এসেছে৷ দোলার কেয়ার করেছে। দোলা কনসিভ করার যখন ছয়মাস তখন থেকে দোলা অন্য রকম হয়ে উঠে। হুটহাট রেগে যাওয়া। নানান ধরনের বায়না করা৷ মুড সুইং হওয়া। আসলে মেয়েরা কনসিভ করার পর তাদের ব্যবহার আচার আচরণ কিছুটা বেবি সুলভ হয়ে উঠে। অনেক রকম ইচ্ছা জাগ্রত হয় সে সময়। মন খারাপ থাকে, একা একা ফিল হয়৷ কিন্তু এইসবের কিছু দোলার সাথে হতে দেয়নি রুদ্র৷ সব সময় দোলার পাশে থেকেছে৷ দোলার কেয়ার করেছে৷ দোলার সকল আবদার মেনে নিয়েছে৷ দোলা প্রায়ই মাঝরাতে উঠে হাঁটতে যাওয়ার বায়না ধরতো। অনেক সময় দেখা যেতো রুদ্র অফিস শেষ করে অনেক রাতে ফিরেছে। ভীষণ ক্লান্ত এর মধ্যে দোলার আবদার তাকে নিয়ে বাইরে যাওয়ার। রুদ্র তখনো বিরক্ত হয়নি৷ হাসিমুখে সবটা করে গিয়েছে৷

–‘ এরপর যেদিন দোলার ডেলিভারি হয়। সেদিন দোলার থেকে বেশি আপসেট আর টেনশনে ছিলো রুদ্র। সারা হসপিটাল জুড়ে পায়চারি করে গেছে যতখন দোলা অপারেশন থিয়েটারে ছিলো। প্রতিটি মুহূর্তে ছটফট করেছে শুধু। ডক্টর যখন এসে খবর দেয় তাদের দুটি মেয়ে সন্তান হয়েছে৷ সেদিন রুদ্র আবেগে কেঁদে দিয়েছিলো সবার সামনে। নিজেকে সামলাতে পারিনি সেই সময়। একসাথে দুজন মেয়ের বাবা হবে রুদ্র কখনো কল্পনা করেনি৷ এরপর যখন দোলার সাথে দেখা করতে যায় তখন রুদ্রর খুশি যেনো ধরে না৷ দুই মেয়েকে কোলে নিয়ে রুদ্র বসে ছিলো দোলার সাথে। কারো কাছে দেয়না রুদ্র তার মেয়েদের। রুদ্রর এমন ছেলেমানুষী দেখে সবাই অনেক অবাক হয়েছিলো সাথে অনেক আনন্দিত ছিলো রুদ্রর খুশিতে।

–” রুদ্র আর দোলার এক মেয়ের নাম রোদেলা চৌধুরী আরেক মেয়ের নাম রুদ্রাণী চৌধুরী। রোদেলা বড় আর রুদ্রাণী ছোট। মাত্র পাঁচ মিনিটের ছোট বড় ওরা৷ সবাই ওদের ছোট করে রোদ আর রাদ বলে ডাকে৷ রোদ আর রাদের এখন চার বছর বয়স। দুজনে সব সময় দুষ্টামি করতে থাকে৷ আর ভীষণ দুষ্টু স্বভাবের। দোলার দুজনকে সামলাতে নাজেহাল অবস্থা হয়ে যায়৷ তবে বাবার কাছে তারা গুড গার্ল। রুদ্র অফিস থেকে বাড়ি ফিরলে তার কাছেই থাকে তারা৷ সারাদিনের জমে থাকা গল্প দোলার নামে অভিযোগ সব বাবার কাছে দেওয়ার জন্য বসে যায় দুবোন। জাহির চৌধুরী আর রত্না চৌধুরীর বেশ আনন্দে দিন কাটছে দুই নাতনিকে পেয়ে।

— তানিয়া, সজল আর আশা, রাজের বিয়ে একদিনে হয়৷ এটা রুদ্রই করে৷ দুই জোড়া বিয়ে একসাথে হওয়ার প্ল্যান রুদ্রর ছিলো৷ এতে সবাই খুশিও হয়েছিলো। অনেক হাসি মজার মধ্যে দিয়ে ওদের বিয়েটা হয়েছিলো। এরপর সবাই যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তানিয়া আর সজল আসে মাঝে মাঝে । রুদ্র দোলাও যায় ওদের বাড়িতে। আশা রাজের আসা যাওয়া চলতে থাকে প্রায়।

–” রাজ আর আশার একটা ছেলে সন্তান হয়েছে। যার বয়স তিন বছর। নাম আবির। অনেক কিউট আর সুন্দর দেখতে। তানিয়া আর সজলের একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে। যার বয়স এখন এক বছর৷ তানিয়া আর সজলের মেয়ের নাম তানজিলা আহসান । আজ তানজিলার প্রথম জন্মদিন। তাই সবাই ওদের ওইখানে যাবে। রোদ আর রাদ খুব এক্সাইটেড পিপির বাড়ি যাবে বলে। আগে থেকে রেডি হয়ে বসে থাকে যাওয়ার জন্য। এখন বিপত্তি বাধে ড্রেস নিয়ে। দুজনে একটা ড্রেস ধরে বসে আছে পড়ার জন্য।

–‘ রুদ্র ওদের কোলে নিয়ে দুজনের গালে দুটো পাপ্পি দিয়ে বলে, তোমরা তো গুড গার্ল মামনী। এইভাবে কেউ মারামারি করে। রোদ না তোমার বোন রাদের দিকে তাকিয়ে বলে। এবার রোদের দিকে তাকিয়ে বলে, রাদ না তোমার বোন! তাহলে এমন দুষ্টামি করো কেনো তোমরা। রুদ্রর কথায় দুজনে মন খারাপ করে বলে সরি বাবা৷ আর করব না।
– ওদের কথায় রুদ্র মুচকি হেসে বলে, তাহলে ভাব করে নাও। এরপর রোদ আর রাদ দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে জড়িয়ে ধরে।

– রুদ্র ওদের কোল থেকে নামিয়ে কাবার্ড থেকে আরেকটা ড্রেস বের করে ওদের হাতে দেয়। দুজন ওই ড্রেসটা দেখে অবাক। কারণ দুটি ড্রেস এক রকম। দুজনে অবাক হয়ে রুদ্রর দিকে তাকালে রুদ্র মুচকি হেসে বলে আমি তো দুটো ড্রেস একই রকম নিয়ে এসেছি তোমাদের জন্য। তোমরা শুধু শুধু দুষ্টামি করছিলে। রুদ্রর কথা শেষ হতেই দুজন হামলে পড়ে দুটো জামা নিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায়। ওদের যাওয়া দেখে রুদ্র মুচকি হেসে উঠে।
– এর মধ্যে রুমে প্রবেশ করে দোলা। ভীষণ ব্যস্ত সে। সংসারের সব কাজ সামলিয়ে, দুটো মেয়েকে সামলাতে দিন পার হয়ে যায় তার। দোলা এখন সব সময় শাড়ি পড়ে থাকে। তার ভীষণ ভালো লাগে শাড়ি পড়ে থাকতে। তাছাড়া রুদ্রও অনেক পছন্দ করে শাড়ি পড়া। তাই দোলার আগ্রহ আরো অধিক হয়ে যায়। দোলার চুল গুলো খোপা করে পিঠের উপর পড়ে আছে, শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুঁজে। রান্নাঘর থেকে আসছে দোলা।
– রুদ্রকে রুমে দেখে দোলা একবার রুদ্রর দিকে তাকিয়ে আবার কাজে মন দিয়ে বলে এতখনে আসার সময় হলো আপনার। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিন। বাবা মা রেডি হয়ে গেছে৷ রোদ আর রাদকে রেডি করে দিয়ে আমি রেডি হতে যাবো। মেয়ে দুটো একদম জ্বালিয়ে মারে। ড্রয়ারে কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে বলে কথা গুলো দোলা। রুদ্র অপলকভাবে তাকিয়ে আছে দোলার দিকে৷ দোলা রুদ্রর দিকে তাকিয়ে দেখে রুদ্র কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। দোলা কোমর থেকে আঁচলটা ছাড়িয়ে দেয়। লজ্জামিশ্রিত লুকে বারবার কানের পাশের চুল গুলো সরাতে থাকে। রুদ্র আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় দোলার দিকে।

–‘ এ.. একি করছেন এগুচ্ছেন কেনো। যান রেডি হয়ে আসুন। অনেক দেরি হয়ে গেছে কিন্তু। তানিয়া.. বাকিটা বলার আগে রুদ্র দোলাকে টান দিয়ে তার সাথে মিশিয়ে নেয়। দোলার কথা বন্ধ হয়ে যায়।
-‘ তোমাকে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে এই লুকে। একদম পাক্কা গৃহিনী যাকে বলে। এমনভাবে আসো কেনো আমার সামনে। নিজেকে সামলাতে পারিনা তো৷ ফিসফিস করে বলে রুদ্র কথাটা। দোলা কেঁপে উঠে রুদ্রর এমন কথায়৷ দম বন্ধ হয়ে আসে তার৷
– ছাড়ুন দরজা খোলা আছে৷ কেউ চলে আসবে৷ আমার হাতের কিছু কাজ আছে সেগুলো করতে হবে। তাই বলে রুদ্রর থেকে নিজেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে যায় দোলা৷ কিন্তু বরাবরের মতো ব্যর্থ হয় সে৷ রুদ্র দোলাকে ঘুরিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে দেয়৷ দোলা বড় বড় চোখে তাকায় এতে৷
-‘ রোদ আর রাদ ছুটে আসে এর মধ্যে।
* বাবা দেখো আমাকে কত সুন্দর লাগছে ড্রসটা পড়ে কথাটা বলে দুবোন ছুটে আসে৷ এসে মা আর বাবাকে এই অবস্থায় দেখে চোখে হাত দিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। আর রুদ্র ছিটকে দূরে সরে যায় দোলার থেকে । ওদের কথা শোনা মাত্র রুদ্র দোলাকে ছেড়ে দেয়।
– সরি সরি সরি৷ আমরা কিছু দেখিনি৷ এই রোদ বল আমরা কিছু দেখেছি? রাদের কথায় রোদ মাথা ঝাকিয়ে না বলে। রুদ্র মেয়েদের কথায় মুচকি হাসে৷ আর দোলা রাগী লুকে তাকিয়ে আছে রুদ্রর দিকে।

— সব দোষ আপনার। মেয়েগুলোও হয়েছে তেমন। যেমন বাবা তার তেমন মেয়েরা কথাটা বলে দোলা বেরিয়ে যায় দ্রুত রুম থেকে। দোলা যেতেই রুদ্র ওদের ডাকে৷ কিন্তু ওরা আর আসে না৷ দাদুর কাছে যাবো বলে আবার ছুটে চলে যায়৷ রুদ্রও রেডি হতে যায়।

–‘ সবাই রেডি সজলের বাড়ি যাওয়ার জন্য। সন্ধ্যায় জন্মদিনের পার্টি। তানিয়া অলরেডি অনেকবার ফোন দিয়ে ফেলেছে দোলা’রা কখন আসছে তাই জানার জন্য । রুদ্র আর দোলা রেডি হয়ে একসাথে নিচে নামে। দোলা আজ অফ হোয়াইট কালারের শাড়ি পড়েছে৷ রুদ্রই নিয়ে এসেছে দোলার জন্য নিজে চয়েস করে। রুদ্র সাদা শার্ট আর সাদা কোর্ট পড়েছে দোলার সাথে ম্যাচিং করে। রাদ আর রোদের ড্রেসের কালার পিংক। তানভীর আহমেদ রোদের সাথে ছবি তুলতে ব্যস্ত৷ রোদের সাথে ভীষণ রকম বন্ডিং তার। রাদ তো তানভীর আহমেদের সাথে ঝগড়া করে সময় পার করে দেয়৷ তানভীর আহমেদ রাদকে ছোট গিন্নি বলে ডাকায় তার সাথে বেশ ঝগড়া লেগে থাকে। সবাই তাদের দুষ্টু মিষ্টি ঝগড়া ইঞ্জয় করে।

— রুদ্র,রা বের হতেই রোকন এসে হাজির হয়৷ সেও যাবে দোলাদের সাথে। রোকন এখন অনেক বড় হয়ে গেছে৷ ডাক্তারি পড়ছে। রুদ্র রোকনের সব খরচ বহন করে সাথে রাশেদ মিয়ারও। রাশেদ মিয়া অসুস্থ তাই রোকন একাই আসে।
– রোকনকে দেখা মাত্র রোদ আর রাদ ছুটে যায় মামা বলে। রোকন ওদের দেখে মিষ্টি একটা হাসি দেয়। এরপর সবাই রওয়ানা দেয় তানিয়ার বাড়ি যাওয়ার জন্য ।

— তানিয়া ভীষণ ব্যস্ত। অনেক মানুষকে ইনভাইট করা হয়েছে৷ সজল একজন সফল বিজনেসম্যান। তার একমাত্র মেয়ের জন্মদিন বলে কথা। সজল মেহমানদের দেখা শোনা করছে। তানিয়া তানজিলাকে কোলে নিয়ে অপেক্ষা করছে দোলাদের৷ এর মধ্যে রাজ আর আশা এসে উপস্থিত। ওদের দেখে তানিয়া একটু স্বস্তি পায়৷ আশা এসে তানজিলাকে কোলে নেয় তানিয়ার থেকে। আবির রাজের কোলে আছে। ওরা গল্প করতে করতে রুদ্ররা হাজির হয়।
–” তানিয়াকে দেখা মাত্র রোদ আর রাদ ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। তানিয়া ভীষণ প্রিয় একজন ওদের৷ তানিয়াও নিজের সন্তানের মতো করে আগলে রাখে রোদ আর রাদকে। ওরা যেদিন জন্ম নেয় সেদিন রুদ্রর সাথে তানিয়াও ছিলো সব থেকে খুশি। ওর এক্সাইটমেন্ট ছিলো অনেক বেশি ওদের দেখে।

— দোলা তানিয়াকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে। এরপর আশার সাথে কৌশল বিনিময় করে। রাজ আর রুদ্র একসাথে ব্যবসা করছে৷ এখন তাদের দেশ বিদেশে বিজনেস। বাইরের দিকটা রাজ সামলাই আর এদিকটা রুদ্র।

–‘ তানভীর আহমেদ তানজিলাকে কোলে নিয়ে একটা ডায়মন্ডের রিং পড়িয়ে দেয়৷ একমাত্র মেয়ের সন্তান বলে কথা৷ তানভীর আহমেদের সবই তানিয়ার জন্য। তানিয়াকে সুখে থাকতে দেখে তানভীর আহমেদও ভীষণ সুখী৷ শুধু হলো না তার প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে সারাজীবন সাথে থাকা। মাঝে মাঝে যায় জেসমিন চৌধুরীর সাথে দেখা করতে৷ জেসমিন চৌধুরীর মধ্যে এখন বয়সের ছাপ পড়ে গেছে৷ চোখের নিচে কালো দাগ, চোখ মুখে মলিনতা। তানভীর আহমেদের ভীষণ কষ্ট হয় জেসমিনকে এইভাবে দেখে৷ কিন্তু কথায় আছে পাপ তার বাপ কেও ছাড়ে না৷ কথাটা একদম ঠিক। জেসমিন চৌধুরী তার পাপের ফল ভোগ করছে৷

–” সজল এসে যোগ দেয় ওদের মাঝে৷ সবাই অনেক খুশি আজ৷ অনেক দিন পর সবাই একসাথে হয়েছে আবার৷ সবার মধ্যে উত্তেজনা অন্য রকম আজ।
— তানিয়া মনটা খারাপ হয়ে যায় হঠাৎ। রুদ্র ব্যাপার টা লক্ষ্য করে এগিয়ে আসে তানিয়ার দিকে৷
– পিপির কথা মনে পড়ছে বুঝি৷ রুদ্রর কথায় তানিয়া রুদ্রকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে। সবার মনটা খারাপ হয়ে যায় নিমিষে।
– মন খারাপ করিস না। পিপি যা করেছে তার জন্য এটা হওয়ারই ছিলো। আজ যদি পিপি ওই কাজ গুলো না করতো। লোভ তাকে গ্রাস না করতো। তাহলে সবার সাথে আজ পিপিও থাকতো আমাদের মাঝে। পিপিও নিশ্চয় আনন্দ করতো আমাদের মতো।

— কি এমন হতো যদি সবটা ঠিক থাকতো৷ জীবনে এত সুখ আনন্দের মাঝে একটা কষ্ট, একটা অপুর্ণতা থাকা কি খুব দরকার ব্রো? তানিয়ার কথায় কি উত্তর দেবে কারো জানা নেই৷

–” এর মধ্যে রাদ আর রোদের শোরগোল শোনা যায়৷ তানজিলাকে কোলে নেওয়া নিয়ে আবার ঝামেলা বাধে তাদের৷ রোদ বলে সে নিবে তানজিলাকে আর রাদ বলে না সে নেবে। তানজিলা বেচারা পড়েছে এবার বিপদে। ফ্যালফ্যাল চোখে দুবোনের কান্ড দেখছে৷ সবাই হাসি মুখে ওদের দুষ্টামি দেখছে। রুদ্র এগিয়ে এসে তানজিলাকে নিয়ে রোদ আর রাদকে থামিয়ে দেয়৷

— তোমরা কেউ নেবে না এখন৷ বোনু তো অনেক ছোট আর তোমরাও ছোট। তাই বোনুকে তোমরা বড় হলে নেবে কেমন। এখন যদি বোনু তোমাদের থেকে পড়ে গিয়ে ব্যথা পায় তাহলে ভালো লাগবে তোমাদের সেটা? রুদ্রর কথায় রোদ রাদ মাথা ঝাকিয়ে না বলে।

–‘ তানিয়া এসে রাদ আর রোদকে নিয়ে বলে আমরা এবার কেক কাটবো কেমন। অনেক অনেক কেক খাবো৷ এরপর আমি নিজে বোনুকে তোমাদের কোলে দেবো কেমন। তানিয়ার কথায় রাদ আর রোদ ইয়ে বলে লাফিয়ে উঠে তানিয়ার গালে ভালবাসার পরস দেয় দুজন একসাথে৷ এরপর সবাই একে একে চলে যায় কেক কাটার স্থানে। জাহির চৌধুরী, রত্না চৌধুরীকে নিয়ে একপাশে বসে গিয়ে। তানভীর আহমেদও যোগ দেয় তাদের সাথে৷

–” সবাই একসাথে হাসি, মজা, আনন্দ করতে করতে পুরো সময়টা কাটিয়ে দেয়। সাথে আছে রোদ আর রাদ৷ পুরো সময়টা আরো উজ্জ্বলময় করতে ওরাই যথেষ্ট।

“সুখ, দুঃখ, হাসি কান্না
সব মিলিয়ে একটা জীবন
কখনো পূর্ণতার ভীড় ” আবার”
কখনো অপূর্ণতার মিলন।

সমাপ্তি –