তুমিময়_অসুখ পর্ব-১৩

0
4134

#তুমিময়_অসুখ
#পর্ব-১৩
#লেখিকা-ইশরাত জাহান ফারিয়া

২৬.
বরের হাতের মার খেয়ে নিজেকে খুব উন্মাদ উন্মাদ লাগছে। উন্মাদ উন্মাদ লাগার আরেকটা কারণ, ওনি ফট করে চুমু দিয়ে চলে যাওয়ার পর আমার মোবাইলে ভয়ংকর ম্যাসেজ পাঠালেন। পড়াশোনা না করে আমি যদি এভাবে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি তাহলে ওনি নাকি আমার দু’চোখ কানা করে দিবেন। তারপর আমাকে রাস্তায় ভিক্ষার থালা নিয়ে বসিয়ে দিবেন আর গলায় একটা সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেবেন। সাইনবোর্ডে লেখা থাকবে, ‘পড়াশোনা না করে বরের সুন্দর চেহারার দিকে সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকার অপরাধে মিসেস অভ্র চৌধুরীকে অন্ধ বানানো হলো। এখন ভিক্ষে করাই ওনার শাস্তি!’

আমিতো রীতিমতো এ ম্যাসেজ দেখে বোকা বনে গেলাম। তারপরের ম্যাসেজটা ছিলো আরও ভয়ংকর! সেটা হলো, ‘হে দেশবাসী! আপনারা এ থেকে শিক্ষা নেন। যেসব মেয়েরা বিয়ের পর বরের আদেশ মেনে পড়াশোনা করে না, তাদেরকে এরকম শাস্তি দেওয়া উচিৎ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অশিক্ষা যাতে ছুঁতে না পারে সেজন্য এই শাস্তির কোনো বিকল্প নেই!’

আমার মনে হচ্ছে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি। মাথা প্রচন্ড ঘুরছে। ওনি কি হঠাৎ পাগল হয়ে গেলেন নাকি? এসব কি ধরনের ব্যবহার? পড়াশোনা যার যার নিজস্ব ব্যাপার। সেখানে জোর করে একজনকে শিক্ষা দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ পরিবেশ তৈরি করে দেওয়ার মোটিভটা কি বুঝলাম না। তবে আজ যা হয়েছে ভালো হয়নি। ওনি আমাকে এভাবে মারবেন জানলে জীবনেও ওনার মতো নির্দয় লোকের কাছে পড়তে যেতাম না। হুহ, আমাকে কি পুতুল পেয়েছে! নিজে সুন্দর বলে দোষ নেই, আর আমি তাকালেই দোষ? এই সুন্দর চোখ তো আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেই ভালো আর সুন্দর জিনিস দেখার জন্য। আর ওনি আমাকে মারলেন? হুহ!

আমাকে মারার দুঃসাহস করেছে ওনি। এর জবাবটা আমি সেই কড়াভাবেই দেবো। ঠিক করলাম, দিন দুনিয়ার সব চিন্তাভাবনা ঝেড়ে ফেলে ধুমসে পড়াশোনা শেষ করবো, ওনার দিকে তাকাবো না, মোবাইল অফ করে ফেলবো যাতে আমাকে এসব ব্ল্যাকমেইল টাইপ কিছু বলতে না পারে, আর আজ থেকে ওনার টাকায় খাওয়াদাওয়া বন্ধ! যাক সব চুলোয়। বর বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে আমার? ভালোবাসি ঠিক, কিন্তু আমার সেল্ফ রেসপেক্টটুকু মরে গিয়েছে নাকি? আমিও আনাইরা ইশতি ইরাম! দেখিয়ে দেবো আমি কেমন আর কি কি করতে পারি।

২৭.
পরদিন বিকেলে কম্বলের নিচে জড়োসড়ো হয়ে বসে ধুমসে পড়ায় মগ্ন। মোবাইল টোবাইল বন্ধ করে দিয়েছি। এইবার কেউ আমার পড়ায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারবেনা, ভুল ধরতে পারবে না। ভার্সিটিতে চান্স পাওয়া থেকে আটকাবে কে এবার আমাকে? সব পারি আমি। ওভার কনফিডেন্সের ঠ্যালায় খুশিতে আত্মহারা। এইবার অভ্র বেত্তমিজকে দেখিয়ে দেবো আমাকে মারার ফল। আসিস আমার পেছন পেছন! ফোন বন্ধ করে রেখেছি, ম্যাসেজ পাঠাইস তোর মুন্ডুতে।

বিকেলের দিকে আম্মু এসে আম্মুর ফোনটা আমাকে দিয়ে গেলো। বললো, কে যেন ফোন করে আমাকে চাচ্ছে।

আমি ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে অধরার কন্ঠ শুনতে পেলাম। ফোন ধরে হ্যালো বলতেই গালাগালি শুরু হয়ে গেলো। কুত্তা, বিলাই, ছাগল আর গুন্ডি ডাক শুনে আমি বুঝতে পারলাম বেচারি আমার ওপর রেগে ফায়ার। গালাগালি করতে করতে একসময় অধরা ক্লান্ত হয়ে চুপ করে যায়। আমি এই সুযোগটার জন্য ওয়েট করে ছিলাম। বললাম, ‘আরও কিছু বল!’

অধরা হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, ‘আর পারছিনা দোস্ত!’

—“তো ফোন দিছিস কেন?”

—“তোর ফোন কই? তোরে সারাদিন হাজার হাজার ফোন দিলাম, বন্ধ কয় কেন?”

—“বন্ধ তাই বন্ধ বলছে।”

–“ওহহ!”

—“ফিরলি কবে?”

—“আজ সকালে! তোর নাকি বিয়া হইয়া গেসে কুত্তী? আমারে একবার বললিও না!”

—“ফানিমুনে গেছিস, সেজন্য আর মজাটা নষ্ট করলাম না।”

অধরা ছিঁচকাদুনের মতো কান্নাভেজা কন্ঠে বললো, ‘তুইও আমারে পর কইরা দিলি দোস্ত? তোর বিয়ের চেয়ে বড় ফানিমুন আর কি হইতে পারতো? নাহয় চইলা আসতাম ওখান থেকে!’

—“বাপ-মা, ভাই ছাইড়া তুই ইন্ডিয়া থেইকা আইসা পড়তি?”

—“হ!”

—“শোন! আমার না নিরামিষ বিয়ে হইসে। রংঢং নাই। হঠাৎ আসছে, বিয়েও হইয়া গেসে।যেন ঘুম থেকে উঠসি আবার ঘুমাইয়া গেসি।”

অধরাটা বরাবরই একটু বোকা। তাই বোকার মতো বলে বসলো, ‘এইটা আবার বিয়া কেমনে? বিয়ার মধ্যে লোকজন না থাকলে কোনো বিয়া হয়? কামড়াকামড়ি, ছিঁড়াছিঁড়ি, বর-বউয়ের বিরুদ্ধে প্রতীবেশীদের কূটনৈতিক ষড়যন্ত্র, আহ্লাদিপনা, লাফালাফি, চিৎকার, সাজগোজ, পোলাপাইনদের সাথে ইটিশপিটিশ ছাড়া কি বিয়াবাড়ি জমে? শোন দোস্ত! আমার মনে হয়, তোদের বিয়া হয় নাই।’

আমি রেগে বললাম, ‘তোর এই বিয়ার টপিক বাদ দে অধুরি!’

—“দোস্ত তোর জন্য গিফট আনসি ইন্ডিয়া থেইকা। কাল বিকেলে চল না শপিংয়ে যাই? তোর গিফটটাও নিয়া আসুম। আসবি তো?”

আমি কিছু ভেবে হা বলে দিলাম। অনেকদিন বাসা থেকে বের হইনা। একটু রিল্যাক্স করা যাক। মন ভালো নেই, বাইরে গেলে ফুরফুরে মনমেজাজ নিয়ে তবেই বাসায় ফিরবো।

অধরা! অধরা হলো আমার একমাত্র বেস্টি। আমাকে ছাড়া যার দুনিয়া প্রায় অর্ধেক অচল। পান থেকে চুন খসলে সেই কাহিনী আমাকে শুনতে হয়। ওর নানুবাসা ইন্ডিয়াতে, সেজন্য দু’মাস ওখানে গিয়ে ঘুরেটুরে এসেছে। নেটওয়ার্ক সমস্যার জন্য আমার সাথে যোগাযোগ করার সুযোগ ততটা হয়নি ওর। কিন্তু এই দু-মাসে তো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা অলরেডি হয়ে গিয়েছে। এই সময়টাতে আমার বেস্টফ্রেন্ড হয়েও আমার সাথে থাকতে পারেনি। যাই, বিকেলে ঘুরে আসি ওর সাথে।

২৮.
পরদিন বিকেলে যখন অধরার সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে ফুড গার্ডেন রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে আছি। অধরার জন্য ওয়েট করছি, বেচারি জ্যামে আটকে আছে। বারবার ফোন দিয়ে এক কথা বলছে আর ছিঁচকাদুনের মতো কাঁদছে। আমি ধমক দিয়ে ফোন কেটে ওর জন্য ওয়েট করছি। মৃদু লয়ে মিউজিক বাজছে। আশেপাশে তাকাতেই দেখি অভ্র ভাইয়া রাগী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। পাশে একটা মেয়ে বসে আছে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। ওনি ঝপ করে ওঠে দাঁড়ালেন, আমি মুখ লুকানোর চেষ্টা করছি। ওনি হুট করে এসে আমার মুখোমুখি চেয়ারটাতে বসে রাগী গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

—“তুই? তুই এখানে কি করিস? কার সাথে এসেছিস?”

আমি ভয় না পেয়ে হালকা গলায় বললাম, ‘অধরার সাথে এসেছি!’

—“অধরা আবার কে?”

—“আমার বন্ধু!!”

ওনি ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘বন্ধু? বন্ধুর নাম অধরা? আমাকে তোর কি বোকা মনে হচ্ছে? সত্যি করে বল, কোন প্রেমিকের সাথে এসেছিস!’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘প্রেমিক মানে? আমার কোনো প্রেমিক নেই!’

—“তোর আশেপাশে যারা থাকে সবাই-ই তোর প্রেমে হাবুডুবু খায়, আর তুই এখানে বলিস তোর প্রেমিক নেই!”

—“অধরা আমার প্রেমিক নয়, ও আমার বান্ধবী, বুঝলেন বাংলা কথা?”

—“সে যাইহোক। তোর যে এতো পরিবর্তন সেটা দেখে যে কেউ-ই ভাববে তুই বুঝি প্রেম করে ছ্যাঁকা খেয়েছিস!”

—“বাজে কথা বন্ধ করুন প্লিজ!”

—“আমার ফোন ধরিস না কেন? ম্যাসেজ করি সিন করিস না কেন? পাখা গজিয়েছে?”

—“আপনি এখানে সিনক্রিয়েট করছেন কেন?” আর আপনার সাথে ওই ললনা কে? ঘরে বউ রেখে অন্য মেয়েদের সঙ্গে ঘুরতে লজ্জ্বা করে না?”

—“না করে না। আমি তোর বর সাথে টিচারও। তাই তোর সাথে আমি সিনক্রিয়েট কোথায় করবো না করবো সেটা একান্তই আমার ব্যাপার!”

অভ্র ভাইয়ার রেগে বলা কথা শুনে মনে হচ্ছে ওনি ভিনদেশ থেকে ফিরেছেনই আমার জীবনটাকে তেজপাতা বানাবেন বলে। আমি বিরক্ত চোখে তাকিয়ে রইলাম। ওনি সামনে বসে একনাগাড়ে আমার জীবন তেজপাতা করে চলেছেন। কিছুসময় পর অধরা ফিরলো। আমার সামনে একটা সুন্দর ছেলেকে দেখতে পেয়ে জোরে চেঁচিয়ে বললো, ‘এই যে ভাইয়া! আপনি এখানে কি করছেন?’

অধরার কথা শুনে অভ্র ভাইয়া পেছনে তাকালো। আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই আমি একটা আলগা হাসি দিয়ে বললাম, ‘এই সিটটা ওনার রিজার্ভ করা ভাইয়া। আপনি এখন যেতে পারেন!’

ওনার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। ওঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বললো, ‘পড়াশোনা বাদ দিয়ে বাইরে এসে ঘুরাফিরা করছিস! আমি দেখ তোর কি করি! ফুপ্পিকে যদি না বলছি সবকিছু তাহলে আমার নামও অভ্র নয়, মাইর কয়টা খেতে চাস ঠিক করে রাখিস।’

অধরা অবাক হয়ে ওনার দিকে তাকালো। ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছে ও বুঝি এই মুহূর্তে হার্ট অ্যাটাক করে মরে যাচ্ছে। হঠাৎ করে অভ্র’কে জিজ্ঞেস করলো, ‘আ.. আ..আপনি জি..জিজু?’

অভ্র ভাইয়া বললেন, ‘হুম!’

—“আই কান্ট বিলিভ দিস!”

অভ্র ভাইয়া হালকা মুচকি হেসে বললো, ‘তুমি অধরা?’

অধরাটা গদগদ হয়ে বললো, ‘জ্বি জিজু!’

—“এখানে কি করতে এসেছো?”

—“অনেকদিন দেখা হয়না আমাদের, তাই ট্রিট দিতে এসেছি!”

অভ্র ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, ‘তোমার ট্রিট দেওয়ার দরকার নেই। আমার পক্ষ থেকে আমি তোমাদের আজ ট্রিট দেবো!’

অধরা খুশিতে প্রায় পাগল হওয়ার অবস্থা। আমি বারবার আগুন চোখে ওর দিকে তাকাচ্ছি। কিন্তু বেচারি জিজু নামক রোগে আক্রান্ত হয়ে গলে গিয়েছে। আমার ইচ্ছে করছে দুটোকে গলা টিপে মেরে ফেলি, এরপর জেলে গেলেও সমস্যা নেই। আমার সাথে সবাই শত্রুতা করে, সব হয়েছে এই বিলাইটার জন্য। অভ্র বেত্তমিজ ওয়েটারকে ডেকে খাবার অর্ডার করলো। কিন্তু আমিতো ঠিক করেছি ওনার টাকায় খাবোনা। এখন কি হবে? এই অধরার থেকে ট্রিট নেবার আশায় এতোবড় রেস্তোরাঁতে এসেছি আর এখন কিনা খালি পেটে বসে বসে এদের খাওয়া দেখবো? দেখলে দেখবো, তাও এই অভ্র ভাইয়ার টাকায় খাবোনা মানে খাবোনা। এদিকে অভ্র ভাইয়া আর অধরা দুইটা মিলে কি যে হাসাহাসি শুরু করেছে বলার বাইরে। আশেপাশের সবাই তাকিয়ে দেখছে, একটু দূরের দুইটা মেয়ে অভ্র ভাইয়ার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে আর একটু পরপর চুল ঠিক করছে। নিজেদের বোধহয় বিশ্বসুন্দরী মনে করছে। অভ্র ভাইয়ার এ্যাটেনশন পাওয়ার জন্য যে এমন করছে সেটা আমি ভালোই বুঝতে পারছি, কিন্তু ওনার সেদিকে খেয়াল নেই। আমি মনে মনে হাসলাম। একটুও জেলাসি ফিল করছিনা। নে, তোর এবার বদনজর লাগবে রে অভ্র বেত্তমিজ। সারারাত পেট ব্যাথায় কাটবে, আর আমার প্রতিশোধও অর্ধেক নেওয়া হয়ে যাবে।

আমি মনে মনে প্রমাদ গুনছি। অধরার হাসিখুশি মুখখানাতে ইচ্ছেমতো থাপ্পড় মারতে ইচ্ছা করছে। কিছুক্ষণ পর ওয়েটার একগাদা খাবার নিয়ে এলো। আমাকে জোরাজুরি করা স্বত্ত্বেও আমি খাবার নিলাম না মানে নিলামই না। অভ্র ভাইয়া সন্দেহী এবং রাগী দৃষ্টিতে আমাকে দেখতে লাগলেন। আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম, ‘আমার না পেট ব্যথা করছে একটু একটু। তাই খাবোনা। আপনারা খেয়ে নিন। অধরা একথা শুনে বললো, ‘তাহলে থাক। বাসায় চলে যাই, নইলে বেশি ব্যথা করবে।’

আমি ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললাম, ‘না না। তোরা খা! আমার অল্প একটু ব্যথা করছে। সমস্যা হবেনা।’

অভ্র ভাইয়ার গম্ভীর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ওনি আমার কথা ঠিক বিশ্বাস করলেন না। না করলে নাই। আই ডোন্ট কেয়ার!

👉”তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম হলো ঐ ব্যক্তি, যাকে দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়।”

~ [ইবনে মাজাহ-৪১১৯]

চলবে….ইনশাআল্লাহ!