তুমি আমি দুজনে৷ পর্ব-৩৪+৩৫

0
658

#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ৩৪

-আমাকে ছাড়ুন প্লিজ

অস্বস্তি আর বিরক্তিতে তুরা বলল, লোকটাকে সে যতটা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে ততটাই পাগল করে তুলছে তাকে। কিন্তু এবার আহান সরে গেলো। কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে নির্লিপ্ত স্বরে বলল

-দিস ওয়াজ দ্যা লাস্ট টাইম,ফারদার আমাকে ইগনোর করা তো দূর ইগনোর করার চেষ্টা করলেও তার ফল খুব খারাপ হবে।

বলে ঘুরে দাঁড়াল,পা বাড়িয়ে ঘরের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বলল

-আইপিএসটার কি হয়েছে, এখনো চালু হলো না কেনো?

বিরক্তিতে আহানের মেজাজ খারাপ অবস্থা। একে তো ভ্যাপসা গরম তার উপর অসময়ে কারেন্ট আইপিএস একসাথে যেতে হলো!
মোবাইলের ফ্লাশলাইট অন করে এগোতে লাগল আহান। আর তুরা চুপচাপ ওর পিছু পিছু হাঁটতে থাকল। ঘর থেকে বেরিয়ে সিড়ির দিকে যেতে লাগলেই তুরার পায়ের সাথে নরম কিছু লাগতেই ও চেঁচিয়ে উঠল। আহান তুরার আকস্মিক চিৎকার শুনে ঘুরে তাকাতেই ধাক্কা লাগল দুজনের, আহান নিজেকে ধাতস্ত করার আগেই তুরা এক লাফ দিয়ে আহানের গলা জড়িয়ে ঝুলে পরল

-বাঁচাও বাঁচাও আয়ায়া,,ভূত,, ভূত আমার পা ধরেছে

দু চোখ বন্ধ করে আহানের গলা ধরে ঝুলে পা ছোড়াছুড়ি শুরু করল তুরা, এহেন কান্ডে আহানের অবস্থা কাহিল, হতবিহ্বল হয়ে বিমূর্ত চোখে এদিক ওদিক বোঝার চেষ্টা করে গলা থেকে তুরার হাত সরানোর চেষ্টা করে বলল

-কি করছ তুরা, ছাড়ো। কিসের ভূত!

আহান ছাড়ানোর চেষ্টা করলে তুরা আরও জোরে খামচে ধরল আহানের টি-শার্ট, দু পা তুলে আহানের কোমর পেঁচিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে বলল

-না না,কিছুতেই ছাড়ব না , ভূত আমার পা খেতে এসেছে, আমার পা খেয়ে ফেলবে

-আরে কিসের ভূত ছাড়ো বলছি

ধমকে উঠল আহান, তুরা অতর্কিতভাবে ঝাপিয়ে ধরায় ফোনটাও আহানের হাত থেকে ছিটকে পরেছে, উলটো হয়ে পরায় লাইটের আলোটাও বন্ধ হয়ে আছে। এহেন অবস্থায় তুরা না ছাড়লে অন্ধকারে নিশ্চিত কোথাও মুখ থুবড়ে পরবে,ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। কণ্ঠের খাদ নরম করে বলল

-তুরা শান্ত হও,এখানে কোনো ভূত নেই। দেখি নামো তো

-না না,প্লিজ আমাকে ছাড়বেন নাহ। ভূতে আমার পায়ের কাছে এসেছিল। প্লিজ ছাড়বেন নাহ। আপনি যা বলবেন আমি তাই শুনব, একটা কথারও অবাধ্য হবো না

এ পর্যায়ে আহানের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি জেঁকে ধরল,অন্ধকারেই পুরু ঠোঁট এলিয়ে মৃদু হাসল,তবে নিঃশব্দে। ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকে গলা খাকারি দিলো। প্রচন্ড রাশভারি কণ্ঠে বলল

-ভেবে বলছ তো? যা বলব শুনবে?

-হ্যাঁ হ্যাঁ, যা বলবেন তাই শুনব। তবুও আপনি ভূত টাকে চলে যেতে বলুন প্লিজ!

আহান ঠোঁট কামড়ে ধরেই নিজের হাসি আটকাল। প্রচন্ড ভীতু তুরা,অন্ধকারে পায়ে কি না কি লেগেছে ওটাকে ভূত ভেবে এমন চুইংগামের মতো চিপকে আছে

-আচ্ছা এবার নামো

-এই নাহ নাহ, আমি তো বললাম সব কথা শুনব তবুও কেনো নামতে বলছেন,আমি কিছুতেই নামব না!

বলে আরও জোরে দু’হাতে আহানের গলা জড়িয়ে ধরল,আহান বিরক্ত হয়ে বলল

-আর কতক্ষণ গলা ধরে ঝুলবে তুমি? না নামলে আমি ফোনটা তুলব কি করে

এ পর্যায়ে এসে তুরা খানিকটা দমল,ধাতস্থ হয়ে নিজের অবস্থান টা উপলব্ধি করেই আহানের গলা ছেড়ে কোমর থেকে এক ঝটকায় আহানের হাত ছাড়িয়ে সরে দাঁড়াল।
আহান নিশ্চল দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে সিড়ির উপর থেকে ফোনটা তুলে আলো জ্বেলে সামনের দিকে ধরতেই ‘ম্যাও’ করে ডেকে উঠল, আহান ধারাল চোখে চেয়ে বলল

-এই যে তোমার পা খেকো ভূত, দুইটাই ষ্টুপিড!

বলেই সিড়ি বেয়ে নামতে লাগল। তুরা আহানের যাওয়ার পানে চেয়ে টুনিকে ছোঁ মেরে কোলে তুলে আহানের পিছু পিছু আবারও চলতে ধরল। অনেকক্ষণ ধরে কারেন্ট না থাকায় অন্ধকার দেখে তুরার বিড়ালটা ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল, ওকে রাইমার ঘরের বারান্দা টাতেই রেখে দেয় তুরা। পায়ের কাছে টুনির লোমশ স্পর্শ পেয়েই তুরা চমকে গেছিল৷ এখন নিজের কপাল ই নিজের চাপরাতে মন চাচ্ছে।

-এই টুনির বাচ্চি, তোর জন্য কতটা ভয় পেয়ে গেছিলাম জানিস। ভয় তো দূর লোকটার গলায় পর্যন্ত ঝুলে পরেছিলাম! সব তোর দোষ,একটা বার বললে কি হত যে তুই,বলতে না পারিস ম্যাও করে ডাকতে তো অবশ্যই পারতিস

আহান পিছু ঘুরে তাকাতেই তুরা বিড়বিড়ানি থামিয়ে চুপ করে গেলো, সিড়ি বেয়ে নেমে আহানের পিছু পিছু রান্নাঘর পর্যন্ত চলে এসেছে।কিন্তু আহান খুঁজছে টা কি

-এভাবে হাঁসের মতো একা একাই পকপক না করে মোমবাতি টা খুঁজে দিলেই তো পারো

তুরা হ্যাবলাকান্তের মতো মুখ করে তাকিয়ে রইল,মোমবাতি? সে মোমবাতি খুঁজছে এটা তুরা কি করে জানবে। মুখ টা তো ফুলিয়ে রেখে কখন থেকে একা একাই খুঁজে যাচ্ছে, ভ্রুকুটি করে হেঁটে অন্যত্র সরে ড্রয়িং রুমে রাখা টেবিলটার উপর থেকে মোমবাতি এনে আহানের সামনে ধরল।
আহান মোমবাতি টা হাত বাড়িয়ে নিয়ে পকেট থেকে গ্যাসলাইট বের করে মোমবাতি টা জ্বালিয়ে আবারও উপরের দিকে গটগট করে হাঁটা ধরল

-ব’জ্জাত উগান্ডা

ফিসফিসিয়ে বলে টুনিকে কোলে করেই আবার আহানের পিছু পিছু ঘরের ভেতর ঢুকল। আহান ড্রেসিং টেবিলের উপরে মোমবাতি টা রেখে থপ করে খাটের উপরে বসে ফোন ঘাটা শুরু করল। তুরা সেদিকে চেয়ে নিজে গিয়ে বসল সোফার উপরে। বসে বসে টুনির গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর ভাবছে কি করা যায়। একে তো গরম তার উপরে কারেন্ট ও নাই ভীষণ একঘেয়ে লাগছে, আর সামনে বসা উগান্ডা থাকা না থাকা একই কথা সেই তো হোপ মার্কা মুখ করেই রাখবে!

-আমার চুলগুলো টেনে দাও তো

ফোন টিপতে টিপতে কাৎ হয়ে শুয়ে পরল আহান। ওর কথায় তুরা ভ্রু কুচকে বলল

-আমাকে বলছেন?

-এখানে তুমি ছাড়া আর কে আছে? ওই আপদ টাকে তো বলিনি নিশ্চয়

-ওকে আপদ বলবেন নাহ,ওর নাম টুনি

-তোমার আজাইরা বিড়াল টার নাম কি সে নিয়ে আ’ম নট ইন্টারেস্টেড, ওটাকে আমার থেকে দূরে রাখো,আর এদিকে এসে আমার চুলগুলো টেনে দাও

আহানের চুল টেনে দিবে? শুনতেই কেমন তিরতির করে উঠল শরীরটা, তবুও কপট দাম্ভিক্য দেখিয়ে তুরা বলল

-আমি কেনো আপনার চুল টানতে যাবো। পরপুরুষের কাছে আমি যাবো না

-একটু আগে যে পরপুরুষের কোলে উঠে গলা জড়িয়ে চুইংগামের মতো চিপকে ছিলে তখন মনে হয়নি সে কথা?

আহানের ঠোঁট কাটা কথায় তুরা বিভ্রান্ত বোধ করল,আমতাআমতা করে কিছু বলতে নিলেও জড়তা ঘিরে ধরল। তুরার উত্তরের আগেই আহান পুনরায় বলল

-আর তুমি না বলেছিলে আমি যা বলব তাই শুনবে? তো এখন কি হলো, অকৃতজ্ঞের মতো আচরণ বন্ধ করে এদিকে এসে চুল টেনে দাও,নাকি চাচ্ছ আমি কোলে তুলে আনি তোমাকে?

বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে চোখ ফুরে তাকাল তুরা, ছিহ লোকটার মুখের কথার কি ছিরি হচ্ছে দিনদিন!

-মুখের কি ভাষা! নির্লজ্জ

-ওহ তুমি যখন নিজেই এসে ঝাপটে ধরবে গলা ধরে ঝুলবে তখন কিছুই না,আর আমি বললেই নির্লজ্জ?

তুরা বেশ বুঝতে পারছে যে তার ওই কথাটা বলায় ভুল হয়েছে, আর তার চেয়েও বড় ভুল হয়েছে লোকটার সাথে কথা লাগাতে যাওয়া।তাই আহানকে আর কথা বাড়াতে না দিয়ে উঠে গিয়ে খাটের এক কোণায় বসল আহানের মাথার কাছে
কাঁপা কাঁপা হাত এগিয়ে চুলগুলো স্পর্শ করল। চিকন আঙুল গলিয়ে দিলো চুলের মাঝে।
আহান চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে, মোমবাতির আবছা আলোতে গৌড় বর্ণের সুদর্শন চেহারা টা স্পষ্ট। ইস চেহারা জুড়ে কি দারুণ মায়া!
দেখলেই প্রেমে পরতে মন চাই। কে বলবে এই লোকটাই এমন ব’জ্জাত স্বভাবের? উষ্ণ শ্বাস ফেলে নিঃশব্দে চুলগুলো টানতে থাকল তুরা।
তুরার বেখেয়ালির মাঝেই আচম্বিত আহান এগিয়ে এসে তুরার কোলের উপর মাথা রেখে কোমর জড়িয়ে ধরল, বিস্ময়ে তুরার ভ্রু কুচকে গেলো, ঠোঁট টানটান হয়ে এলো বিমূঢ়তায়।
সরে যেতে নিলেই আহান বিরক্তিসূচক শব্দ করে বলল

-আহ্,সরছ কেনো। চুপচাপ চুল টানো। তোমার পকপকানির জন্যেই মাথা ধরেছে

কথার সহিত আহানের উষ্ণ শ্বাস আছড়ে পরলো তুরার উদরে, বাক্যের সাথে ছন্দিত ঠোঁট আর খোঁচা খোঁচা দাড়ির স্পর্শ কাঁটার মতো বিঁধে গেলো তুরার নরম পেটে। বৈদ্যুতিক ঝলকানির মতো তরঙ্গিত হয়ে কেঁপে উঠল সর্বাঙ্গ। মুচড়ামুচড়ি করে সরার চেষ্টা করলেও এক চুল নড়াতে পারল না আহানকে। সে নির্লিপ্ত ভাবে দৃঢ় বাহুবেষ্টিনিতে আবদ্ধ রাখল তুরাকে যেনো নিতান্তই স্বাভাবিক কিছু। কিন্তু আহানের এরূপ কাজে সে শান্ত প্রতিক্রিয়ায় থাকলেও তুরার হাড় কাঁপানোর মতো শিরশিরানি প্রবাহিত হচ্ছে ছোট্ট নরম দেহটাতে!
আহানের সুগভীরতার সাথে তার পেটে মুখ ডুবিয়ে রাখাতে তীব্রভাবে খামচে ধরল বিছানার চাদর, অস্থিতিশীল অবস্থাটা প্রাণপণে আঁটকে নিল শুকনো ঢক গিলে।

••••

সকাল বেলা উঠতে বেশ দেরি হয়ে গেছে আজ, তড়িঘড়ি করে রেডি হয়ে বেরোলো তুরা, ড্রয়িং রুম পেরোতে নিলেই রুবির ডাক পরল

-তুরা না খেয়ে যাচ্ছ কেনো?

-আজকে দেরি হয়ে গেছে মা, এসে খাবো

-তা বললে কি করে হয়,এভাবে না খেয়ে এক পা বাইরে রাখবে না।দেরি হলে হোক। চুপচাপ টেবিলে গিয়ে বসো

কড়াকড়ি আদেশে তুরা আর না খেয়ে বেরোনোর সাহস করল নাহ, বাধ্য বাচ্চার মতো টেবিলে গিয়ে বসতেই ভ্রু কুচকে এলো, এই পেত্নীটা আবারও উদয় হলো! চোখাচোখি হতেই ক্রুর হয়ে আসা দৃষ্টি প্রসারিত করে মেকি হেসে বলল

-গুড মর্নিং আপু?

-মর্নিং। ভার্সিটি যাচ্ছ?

-জ্বি আপু

-বাহ, তার তোমার হাসব্যান্ড আজ তোমাকে রেখেই চলে গেলো দেখছি

কটুক্তির স্বরে বলল প্রেমা। তুরা বিভ্রান্ত হলো না, বিনিময়ে হাসিটা আরও প্রজ্জ্বলিত করে উত্তর করল

-আসলে উনার আজ সকালে ক্লাস আছে, আর আমার ক্লাস তো ১০ টাই শুরু হবে তাই না চাইতেও উনাকে একাই যেতে হলো। উনিতো আবার আমায় ছেড়ে একদম যাওয়া আসা করতে পারেন না

কপট উপহাসের হাসি তৎক্ষনাৎ মিলিয়ে গেলো প্রেমার, তুরার আদিক্ষেতা করে বলা কথায় জ্বলে উঠল শরীর। তাই উত্তরহীনা জুসের গ্লাস টা তুলে ঢকঢক করে গিলল। কিন্তু তুরার শয়তানি মন তো এটুকুতেই দমবার নয়! প্রেমার হিংসাত্মক তৎপরতাকে আরেক ধাপ বাড়িয়ে বলল

-আমারই দোষ, উনি আমাকে যাওয়ার আগে কত করে ডাকলেন আমিই উঠলাম নাহ। এভাবে রোজ একসাথে গেলে লোকে কি বলে বলো তোহ! আমারতো চক্ষু লজ্জা বলে কিছু আছে নাকি

বলেই লজ্জা লজ্জা ভাব ধরল। প্রেমা আর কিছু না বলে টেবিল ছেড়ে উঠে গটগট করে হাঁটা ধরল।

-বেশ হয়েছে, পেত্নী আস্ত!

বলেই খিলখিল করে হেসে দিলো তুরা, না জানি পেত্নীটা কোত্থেকে এসে জুড়ে বসে, কোন ফ্রেন্ড এর সাথে দেখা করতে যাবে বলে দুদিন উধাও হয়ে ছিলো আবারও উদয় হলো কোন দুঃখে তুরা বুঝে পাইনা।

~~

আজ বেশ তাড়াতাড়ি ক্লাস শেষ হয়েছে তুরার, বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে আসার সময় গেইটের কাছে পেছন থেকে পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে ফিরে তাকাল

-বাসায় ফিরছিস বুড়ি?

মাহিদের দিকে তাকিয়ে অমায়িক হাসল তুরা, হাসি হাসি মুখে এগিয়ে কাছে গিয়ে বলল

-হ্যাঁ ভাইয়া

-আম্মু তোকে বাসায় নিয়ে যেতে বলেছে

-মামনী? আচ্ছা তোমরা এখানেই থাকছ এখন? বিদেশে আর ফিরবে না?

-কেনো তোর কি ভাল্লাগছে নাহ?

-আরে তা কখন বললাম। তোমরা তো অনেকদিন বিদেশে ছিলে, পড়াশোনাও তো ওখানেই করেছ। এখন এখানে কি থেকে যাওয়ার ইচ্ছে আছে?

-তুই তো জানিস নিজের দেশ নিয়ে আমার কতটা ভালোবাসা, আর বিদেশ থাকাটা আমি কখনও সাপোর্ট করিনি, সে তো আব্বুর বিজনেস পারপাসে এতদিন বাইরে থাকা, একবার যখন ফিরেছি আর যাচ্ছি না

তুরা সামান্য হাসল মাহিদের কথায়৷ দুজন বাকচারিতা করতে করতেই এগিয়ে গেলো বাইরের দিকে,মাহিদ আবারও বার কয়েক বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্যে বলল তুরাকে।
এবার তুরা ভাবল,,আজকে তো বেশ তাড়াতাড়িই ক্লাস শেষ হয়েছে এখনো অনেক সময় বাকি,মামনীকে দেখে আসলে মন্দ হয়না।
তাই ওউ আর আপত্তি করল না, মাহিদের সাথে ওর গাড়িতে উঠে বেরিয়ে গেলো।
– –
অপরাহ্ণের মধ্যভাগ, মাথার উপড়ের খাড়া সূর্য টা ঠিক একটু হেলতে চলেছে, বাড়ির ফটকে প্রবেশ করে দ্রুতপায়ে ভেতরে ঢুকতে নিলেই বরফের ন্যায় শীতল কণ্ঠে পা থমকে গেলো তুরার

-দাঁড়াও!

পিছু ঘুরে তাকিয়ে আহানকে দেখেই অপ্রস্তুত হলো তুরা, বাড়ি ফিরতে একটুখানি দেরি তো সে করে ফেলেছে এটা ভালোই বুঝতে পারছে কিন্তু আহানের চেহারা টা তার অস্বস্তিকে রীতিমতো ভয়ে পরিণত করছে।

-কোথায় ছিলে?

সমুদ্রের ঢেউয়ের ন্যায় প্রশান্ত গভীর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল আহান, ঘর্মাক্ত শরীরে লেপ্টে থাকা শার্ট অগোছালো চুল আর ঢিলে হওয়া টাইয়ের ক্লান্ত শরীর টা নিয়ে এগিয়ে আসল তুরার সামনে। একদম নাকের ঢগা বরাবর সম্মুখে দাঁড়াল

-কিছু জিজ্ঞাসা করেছি তোমাকে?

কথার সাথে যেনো হাড় হিম করা কঠোরতা আর রাগান্বিত ভাব ছুড়ে আসল। তুরা বিব্রত হয়ে বলল

-ম..মানে আমি

-তোতলানোর মতো কিছুই জিজ্ঞাসা করিনি আমি,ছিলে কোথায় তুমি? ক্লাস কখন শেষ হয়েছে আর তুমি ফিরছ কখন?

প্রচন্ড জোরে ধমকে উঠল আহান, তুরা আশেপাশে অপ্রস্তুত ভাবে তাকাল, দারোয়ান ভীষণ কৌতূহল নিয়ে তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে, আহান সেদিকে একবার লক্ষ্য করে তুরার হাতের কবজিটা নিজের মুঠোয় পুরে বিদ্যুতের বেগে হাঁটা ধরল, ঘরে ঢোকার দরজা পেরিয়ে সিড়ির দিকে আগাতে নিলেই পেছন থেকে রুবি বলল

-আহান কি হয়েছে? ওকে এভাবে টেনে নিয়ে যাচ্ছিস কেনো?

-প্রশ্ন করো না মা

ভীষণ সুক্ষ্ম স্বরে বলে আবারও এগোতে নিলে আরও একবার থামতে হলো আমেনা খাতুনের কথায়

-দাঁড়াও দাদুভাই? কি হয়েছে? রেগে আছ কেনো এত, আর তুরাকেই বা এভাবে টেনে হিচড়ে কেনো নিচ্ছ, এটা কেমন ব্যবহার!

আমেনা খাতুনের শাসানির স্বরে বলা কথায় আহান আর দমাল না কিছু, এক টানে তুরাকে সামনে এনে বলল

-ওকে জিজ্ঞাসা করো কি হয়েছে?ওকে জিজ্ঞাসা করো ভার্সিটি থেকে দু ঘন্টা আগে বেরোনো সত্ত্বেও এখন ফেরার সময় কেনো হলো? ওকে জিজ্ঞাসা করো আমাকে না জানিয়ে ও কোথায় গেছিল তাও একটা ছেলের সাথে!

একদমে চেঁচিয়ে বলল আহান কথাগুলো, উপস্থিত সকলের মুখে বিস্ময়, কি বলল আহান? তুরা কার সাথে গেছিল? আর কোথায়?

-শান্ত হও আহান, তুরাকে আগে বলতে দাও,আগেই এতটা উত্তেজিত হয়ো নাহ

রুবির কথায় আহানের ক্রুদ্ধতা মাত্রা ছাড়াল, গুরুগম্ভীর কণ্ঠের জোর আরও বাড়িয়ে বলল

-আমাকে বলছ এ কথা টা? কেনো আমি কি মানুষ নাহ? আমার চিন্তা হয় না ওকে নিয়ে? ভার্সিটি থেকে বেরিয়েছে দু ঘন্টা আগে অথচ বাড়ি আসতেই দারোয়ান বলল ও নাকি এখনো ফেরেনি আমার আমার কতটা চিন্তা হচ্ছিল এটা বুঝো? দু ঘন্টা ধরে ওকে আমি পাগলের মতো খুঁজেছি তখন আমার ভেতরে কি চলছিল এটা ও বোঝে? সব শেষে যখন ক্যাম্পাসের একটা ছেলে বলল ওকে মাহিদের সাথে এক গাড়িতে উঠে যেতে দেখেছে তখন আমার কেমন লেগেছে বোঝো তোমরা? নাকি ও বোঝে? কি হলো বলো? আমায় মানুষ মনে হয়না,আমার চিন্তা হলো কি আমি পাগল হয়ে গেলাম এতে কারো আসে যায়?!!

আহানের চিৎকারে তুরার সাথে যেনো কেঁপে উঠল ঘরের দেওয়াল পর্যন্ত ও। রুবি আর আমেনা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। প্রেমা এমন উচ্চস্বরের কথা শুনে ছুটে বেরিয়ে এসেছে। আহান ফোস ফোস করে শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল

-আ আসলে ইয়াজ ভাই এসেছিল। মামনী আমায় দেখতে চেয়েছিল আর আজ ক্লাস ও তাড়াতাড়ি শেষ হয়েছিল বলে আমি ভাবলাম একবার দেখা করে আসি

থেমে থেমে জড়তা ভরা গলায় বলল তুরা, আহানের কথাগুলো শুনে চোখ ভরে এসেছে পানিতে, সেটা ভয়ে নাকি অনুতাপে সেটা নিজেও বুঝে উঠতে পারছে নাহ!

-কাজটা তুমি একেবারেই ঠিক করোনি তুরা, তোমাকে কোথাও যেতে আমরা নিষেধ করব না তো, তা বলে এভাবে না জানিয়ে?তুমি না ফেরায় আমাদেরই তো কতটা চিন্তা হচ্ছিল

-ইয়াজ? ইয়াজ কে। কার সাথে গেছিলে তুমি? আএ মাহিদ কে হয় তোমার!
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

Humu_♥

#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ৩৫

-আমার কথাটা একটু শুনুন!

কোনো রকম প্রতিক্রিয়া বা জবাব না দিয়েই দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো আহান
এ নিয়ে বার কয়েক চেষ্টা করল তুরা আহানের সাথে কথা বলার বরাবরই প্রতিক্রিয়া শূন্য।
দুপুরের বাড়ি আসার পর দুই ঘন্টা পেরিয়েছে গেছে। তখন বসার ঘরে আহান সবটার ব্যাপারেই অবগত হয়েছে। মাহিদ আর তার মায়ের সাথে তুরার সম্পর্ক নিয়ে সবটাই ওকে বলেছে আমেনা আর রুবি। সবকিছু শোনার পর শুধু একটা কথাই বলেছিল

-তাহলে আর কি! আমাকে তো কেও এটাও বলার প্রয়োজন বোধ করেনি,আমি আর কে যে সব বলতে হবে!

বলে আর কোনো বাক্য ব্যয় না করে চুপচাপ উপরে উঠে গেছে। তুরা তৎক্ষনাৎ আহানের পিছু পিছু এলেও ওর সাথে কথা বলার সুযোগ পাইনি। আহান দুপুরের খাবার টাও খাইনি। রুবি বেগম ডাকতে এলে তাকে ফিরয়ে দিয়েছে আর তুরার সাথে তো কথায় বলেনি। চুপচাপ এড়িয়ে চলছে ওর প্রতিটি শব্দ,কথা সহ পদক্ষেপ ও
কি আজব! কাল অব্দি তুরা আহানকে ইগনোর করছিল আর আজ আহানের এতটুকু সময়ের নিশ্চুপতা তুরার বুকটা কাঁপিয়ে তুলছে বেদনায়!

ভারাক্রান্ত মন নিয়ে নিচে নেমে এলো তুরা,আহান বেরিয়েছে গাড়ি নিয়ে। কখন আসবে জানে না।সবকিছু কেমন ফিকে লাগছে তুরার। বিষণ্ণতায় ঘেরা অপ্রতিরোধ্য মন খারাপ পাহাড় সমান জড়ো হলো। হেলতে দুলতে ড্রয়িং রুমের সোফার উপর বসল, আজকে মিনু ফুফুকে খুব মনে পরছে তুরার।উনি থাকলে নিশ্চয় কিছু না কিছু উপায় বলত, ফুফুর অনুপস্থিতি তুরার অসহায়ত্ব আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিলো।এখন কি করবে সে!

-কি হলো এখন শান্তি হয়েছে তো?

কথাটি কর্ণগোচর হলেও কোনো উত্তর করল না তুরা, নিঃশব্দেই বসে রইল। প্রেমা বুকে ভাঁজ করে রাখা দু হাত টান করে তুরার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আবারও বলল

-রাগ করে বেরিয়ে গেছে তো আহান? এবার খুব ভাল্লাগছে?আমি জানতাম তোমার মতো ষ্টুপিড আর ইমম্যাচিউর একটা মেয়ে কখনোই আহানকে হ্যাপি রাখতে পারবে নাহ, তুমি শুধু পারবে মেসড আপ করতে,যত্তসব

প্রেমার কথায় আজ আর তুরা গলা বাড়িয়ে কিছুই বলল নাহ,কি বলবে সে? আসলেই তো দোষটা তারই,সে যদি আহানকে জানিয়ে যেতো তাহলে তো এতো কিছুই হতো না। মাথা নিচু করেই বসে রইল তুরা,প্রেমা আরও কিছুক্ষণ ভালো মন্দ বলে বেরিয়ে গেলো, ওর যাওয়ার পানে চেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরল কপোল বেয়ে। সত্যিই নিজেকেই সবচেয়ে বড় দোষী মনে হচ্ছে তার
কাঁধের উপর হাতের স্পর্শ পেয়েই তড়িঘড়ি করে চোখ মুছে মুখে নকল হাসি টেনে তাকাল

-মা? বসুন না,কিছু লাগবে?

ঘাড় নাড়িয়ে না সূচক মৌন সম্মতি দিলো রুবি। তুরার পাশে বসল স্থির মুখাবয়ব নিয়ে, তুরা আবারও বলল

-চা খাবেন তো মা? আপনি বসুন আমি এক্ষুনি বানিয়ে আনছি

বলেই হাসি হাসি মুখ করে উঠতে নিলেই রুবি খাতুন এক হাত ধরে থামিয়ে দিলো তুরাকে। গুরুগম্ভীর ভঙ্গিমায় ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ নাড়িয়ে বসতে বলল তুরাকে তার পাশে, তুরা কৌতূহলী দৃষ্টিতে চেয়ে বাধ্য মেয়ের মতো বসল। ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ নির্বাক থেকে তার বরাবরের মতো বিচক্ষণ ভঙ্গিমায় বলল

-আহান খুব রেগে আছে?

মৃদু কণ্ঠের স্পষ্টবাক্যে তুরার মেকি হাসিতে আবৃত মুখটা মিলিয়ে গেলো, মুখ জুড়ে মন খারাপের আধার নামল। কোনোরূপ উত্তর করল না তুরা, অপরাধীর মতো গতানুশোচনায় ঘাড় ঝুঁকিয়ে নিলো,বলতে শুরু করল রুবি

-আমার ছেলে ছোট থেকেই ভীষণ বাক্যসংযত স্বভাবের, তুলনামূলক স্বল্পভাষী আর খুব গম্ভীর। পরিবারের মধ্যেও ভালো সখ্যতা ওর কম, একা থাকত পড়াশোনা ক্যারিয়ার এসব নিয়েই ব্যস্ত ছিলো আমার ছেলেটা। এর মাঝেই একদিন ভীষণ অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই তোমাদের বিয়েটা হয়ে গেলো, যদিও আমরা জোরপূর্বক ওকে বিয়ে করতে বাধ্য করেছিলাম।

খানিকটা দম নিলো, ভারি প্রশ্বাস ছেড়ে আবারও বলতে আরম্ভ করলেন

-শুরুতে ভেবেছিলাম আমার ছেলেটা হয়ত সম্পর্ক টা মেনে নিতে পারবে না,কিন্তু আস্তে আস্তে আমার এই ধারণা টা নিছক ভুল প্রমাণিত করেছে আহান। তুমি কতটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছ আমি জানি না কিন্তু আমি সবটাই পেরেছি। আমি তো ওর মা, আমি খুব ভালো করে বুঝি ওকে। হয়ত তোমাদের মাঝে স্বাভাবিক স্বামী স্ত্রীর মতো সখ্যতা বা চক্ষুগোচর হওয়ার মতো বন্ধন নেই,তবে যা আছে তা এর থেকেও সুগভীর। আহান তোমার প্রতিটি প্রয়োজন, সুবিধা, অসুবিধার খেয়াল নিজে রাখে। তোমাকে রোজ ভার্সিটিতে নিয়ে যাওয়া বাড়ি আনা তোমার কোন জিনিসে অসুবিধা কোনটাতে তোমার ভালো তোমার আঘাতে কিভাবে যত্ন করতে হবে সবটার খেয়াল কিন্তু ও খুব যত্নসহকারে রাখে,আমাদের বলে দিতে হয়নি! কিন্তু ওই যে বললাম ছেলে আমার একটু গম্ভীর। শামুকের খোলসের মতোই ওর উপরের ব্যক্তিত্ব টা প্রখর কঠোর। ভেতরে চিন্তা,মায়া, বা অনুভূতিতে কানায় কানায় পূর্ণ থাকলেও ও নিজ থেকে কখনও প্রকাশ করবে নাহ। ভালোবাসা কি সবসময় মুখে বললেই হয়? এই যে যত্ন, তোমার জন্যে ওর দুশ্চিন্তা, তোমাকে না পেয়ে ওর পাগলপ্রায় অবস্থা এগুলো কি ভালোবাসা নয়,তুরা?

অশ্রুতে পরিপূর্ণ ছলছল নয়ন জোড়া তুলে তাকাল তুরা,বুকের ভেতর টা ধক করে উঠল! সত্যিই তো এভাবে তো সে আগে ভেবে দেখেনি?

-তোমার অনুপস্থিতি, তোমাকে না পাওয়ায় তোমার চিন্তায় ও উন্মাদের মতো আচরণ করেছে।আর তোমাকে কোনো ছেলের সাথে দেখে তা আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করেছে, পুরুষ কখনই তার পছন্দের নারীকে অন্য কারো পাশে সহ্য করতে পারেনা হোক না সে ভাই। আর মাহিদের সাথে তোমার সম্পর্ক টাও তো ও যানতো নাহ। এখন বলো তো যদি দ্বায়িত্ব বোধ নাই থাকত তাহলে কি এভাবে রাস্তায় রাস্তায় বেরাতো? যদি অধিকার বোধ নাই থাকত তাহলে কি মাহিদের সাথে তোমাকে দেখে জবাবদিহিতা চাইতো? যদি হারানোর ভয় নাই থাকত তাহলে কি এভাবে খুঁজতো? আর ভালোবাসা না থাকলে কি দ্বায়িত্ব, অধিকার, হারানোর ভয় এসব থাকতো?

অশ্রুপূর্ণ আখি যুগল থেকে টপটপ করে বয়ে গেলো বারিধারা। নিজের ভুল টা যেনো চোখে আঙ্গুল তুলে দেওয়ার মতো স্পষ্ট হলো। নিতান্তই বাচ্চামি করছিল সে এতদিন। কান্নার বেগ বেড়ে ফুঁপিয়ে উঠল তুরা, ভাঙা ভাঙা গলায় বলল

-আমার ভুল হয়ে গেছে মা,আমি বুঝতে পারিনি উনি এতটা চিন্তিত হবে। এমনটা হবে বুঝলে আমি কখনোই যেতাম না। আর কখনো আমি এমন অন্যায় করব না আমাকে ক্ষমা করে দিন মা

বলেই কান্নায় ভেঙে পরল। রুবি খাতুন পরম মমতার সহিত এক হাতে তুরাকে জড়িয়ে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল

-ধুর পাগলি! এভাবে কাঁদতে নেই। মায়ের কাছে আবার ক্ষমা কিসের,আমিতো শুধু তোমাকে বোঝাচ্ছিলাম

স্নেহ ভরা ছোট আদরে যেনো মা মা গন্ধটা প্রকট ভাবে লাগল তুরার, মমতার সাহারা পেয়ে আরও দূর্বল হয়ে গেলো। কান্নামিশ্রিত স্বরে বলল

-আপনারা সবাই আমাকে কত ভালোবাসেন,আমার জন্যে চিন্তা করেন তবুও আমি ভুল করে বসি

-সন্তানরা তো ভুল করবেই মা। আমি না মা তোমার! তোমার বাবার সাথে আমাদের বহু বছরের সম্পর্ক, তোমার মায়ের সাথে বিয়ের পরেও তা বহাল ই ছিলো। কিন্তু পরে ব্যবসায়ীক খাতিরে দূর শহরে চলে আসায় যোগাযোগ টাও ধীরে ধীরে কমে যেতে শুরু হয়, তুমি হওয়ার পর আস্তে আস্তে তোমাদের বাড়িতে যাওয়া আসাও কমে আসে। কিন্ত আহানের বাবা আর তোমার বাবার সম্পর্ক বরাবরই অটুট ছিলো। তাই তো তারা একে অপরকে কথা দিয়েছিল যে প্রাপ্তবয়স্ক হলে তোমার আর আহানের বিয়ে দেবে। সময়ের সাথে কথাটা আমরা ভুলতে বসলেও বিধাতা সেটা ঠিকই মনে রেখেছিল তাই তো এভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই বিয়েটা হয়ে গেলো।

তুরা চমকিত দৃষ্টিতে তাকাল,তাহলে সেদিন দিদুন মামনীকে এই কথায় বলছিলেন?সে তো এ ব্যাপারে সম্পূর্ণই অজ্ঞাত ছিলো। তুরার ভাবনার মাঝেই রুবি খাতুন বলল

-ছেলেটার আমার অভিমান হয়েছে, জানি আমি তোমার সাথে কথা বলছে না, কিন্তু বলবেও যে না এমন কিন্ত না

তুরা কান্না থামিয়ে রুবির কথায় পূর্ণ মনোযোগ দিলো, তাই তো কথা বলছে না তো কি, বলবে যে না এমন ও তো না,

-কি পারবে না আমার ছেলের রাগ ভাঙাতে?

শাশুড়ির ইঙ্গিত বুঝতে সামান্য অসুবিধা হলো না তুরার,চোখ মুছে অধরে হাসি ফুটিয়ে বার কয়েক মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো।

••••

ঘরের ভেতর বিরতিহীনভাবে পায়চারি করছে তুরা, আবারও তাকাল দেওয়াল ঘড়িটার দিকে। রাত বারোটা পেরিয়েছে মিনিট সাতেক পার হয়েছে অথচ এখনো আহান ফিরল নাহ। ভেতরের অস্থিরতা ক্রমশ দুশ্চিন্তায় পরিণত হচ্ছে, টুনি এসে পায়ের কাছে গা ঘষতে লাগল৷ তুরা দুহাতে টুনিকে তুলে বারান্দায় গিয়ে রাখতে গেলেই গাড়ির হেডলাইটের আলো দেখেই চোখ মুখ চিকচিক করে উঠল, টুনিকে রেখে এক ছুটে ঘর থেকে বেরল। সিড়ি বেয়ে নেমে দরজা খুলতেই হাস্যজ্বল মুখ খানা চুপসে গেলো সামনে দাঁড়ানো আহানের হাত প্রেমার হাতে দেখে।

-কি হলো এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছ কেনো

কটমট করে প্রেমা বলল,তুরা হতভম্বিত হয়ে সরে দাঁড়াতেই আহান ঘরে ঢুকল,আর তার সাথে প্রেমাও। আহানের এক হাত ঝাপটে ধরে চিপকে লেগে আছে। আহান কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও বাঁধাও দিচ্ছে নাহ। নিমিষেই তুরার ছোট্ট মনটা আঘাতে জর্জরিত হলো, আহান প্রেমার হাতটা ঝামটা দিয়ে ছাড়িয়ে গটগট করে উপরে উঠে গেলো। প্রেমা অপ্রস্তুত হলেও তুরাকে দেখে মুখ ভেঙচে ওউ ঘরে ঢুকে গেলো।

কফির মগটা হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকল তুরা, আহান ওয়াশরুমের ভেতর। বেড সাইড টেবিলে মগটা রেখে বিছানা ঠিক করতে লাগলে আহান মাথা মুছতে মুছতে বেরলো। চোখে মুখে গাম্ভীর্যের ছাপ এখনো কড়াকড়ি। তোয়ালে টা হাত থেকে ফেলে বিছানায় সটান আধশোয়া হয়ে শুয়ে পরল এক হাত চোখের উপর দিয়ে। তুরা বিব্রতবোধ জড়তা কাটিয়ে নরম গলায় বলল

-আপনার খাবার আনবো?

নড়চড় হলো না আহানের,ঠাঁই রইল একই অবস্থায়, তুরা এগিয়ে গিয়ে বলল

-আ আপনার কফিটা..

তবুও উত্তর করল না আহান, এ পর্যায়ে আহানের এমন অগ্রাহ্যে তুরার ভীষণ খারাপ লাগল,মনের ভেতর সঞ্চিত অনুপ্রেরণা, প্রাণোদন নিভিয়ে গেলো। ততসত্ত্বেও মন খারাপের মেঘ দমিয়ে এগিয়ে দরজা টা লাগাতে গেলো

-সাথে থাকতে কেও বাধ্য নয়, ইচ্ছে করলেই অন্যঘরে গিয়ে থাকতে পারে

দরজার খিল থেকে হাতটা ছিটকে গেলো। ভেতরের উপহত মন থেকে সারা বদনে ছড়িয়ে গেলো। কাঁপা কাঁপা দৃষ্টিতে ফিরে তাকাল প্রস্তর কঠিন মানুষ টার দিকে। ভেতরে দলা পাকানো কান্না গুলো উগড়ে বেরিয়ে আসতে চাইলো। এ পর্যায়ে আহান মুখ থেকে হাত সরাল। নিভৃতে তাকাল সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে, নির্লিপ্ত ভাবে পরখ করল তুরার কাঁপা কাঁপা লাল হয়ে আসা চোখ, ফুলে থাকা নেত্রপল্লবের গোড়া। কামড়ে রাখা ঠোঁট। চোখ মুখ খিঁচিয়ে কান্না আটকে দাঁড়িয়ে আছে। দু হাতে খামচে রেখেছে পরনের পোশাক, গুটি গুটি পা ফেলে এগিয়ে আসলো আহানের দিকে। আহান আবারও মুখ ঘুরিয়ে নিলো অন্যদিকে স্থৈর্য কণ্ঠে বলল

-আসবে না আমার কাছে

কথা বলা শেষ হতে না হতেই তুরা ঝাপিয়ে পরলো আহানের বুকে, দু’হাতে খামচে ধরল প্রসস্থ বুকে আট হয়ে থাকা সফেদ টি-শার্ট। আকস্মিক আক্রমণে আহান ধাতস্থ হওয়ার আগেই ডুকরে কেঁদে উঠল তুরা, কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে অস্ফুটে বলল

-আমাকে ক্ষমা করে দিন প্লিজ, আমি বুঝতে পারিনি আপনি এতটা চিন্তিত হবেন, তাহলে কখনও যেতাম নাহ। আর কখনও যাব না আমি,কোত্থাও যাব নাহ। আপনি এভাবে মুখ ফিরিয়ে থাকবেন নাহ। আপনি কথা না বললে আমার কষ্ট হয়, খুব কান্না পায়

হতবিহ্বলিত হয়ে বিমূর্ততায় স্থির হয়ে গেছে আহান,তুরার এহেন কৃতকর্ম তার ভাবনার বাহিরে ছিলো। ওকে যেতে বলা সত্ত্বেও এভাবে?! নিজের ভেতরের রম্য কৌতূহল দমিয়ে আলতো ভাবে হাত রাখল তুরার পিঠে। তুরার ওমন হেয়ালি কাজে তার অভিযোগ গূঢ়তা হয়েছিল, ভীষণ মনক্ষুণ্ণ হয়েছিল, তবে তার গভীরত্ব তুরার চোখের পানির সমান তো নয়!
নিজের উপর ছোট্ট শরীর টার উপস্থিতিতে কথা থেমে গেছে আহানের,আচমকা সমস্ত রাগের জোয়ার যেনো তলিয়ে গেলো। বুকের ভেতর মুখ ডুবিয়ে থেমে থেমে বলা ওই কথার নিকষ মায়ায় ডুবতে বাধ্য হলো
এখনো ফুঁপিয়ে হেঁচকি তুলে তুরা ভিজিয়ে দিচ্ছে আহানের বক্ষস্থল। কেমন চিনচিন যন্ত্রণাভুত হলো আহানের৷ তুরার কান্নাতে তিরতির করে কেঁপে উঠল রাগ জেদের পাল্লা। যেনো সবটা এই দুমড়ে মুচড়ে গেলো বলে।

-আপনি আমাকে যা খুশি বলুন,শাস্তি দিন কিন্তু এভাবে মুখ ফিরিয়ে নেবেন নাহ। আমি আর অবাধ্য হবো নাহ। তবুও আমাকে ছেড়ে প্রেমার হাত ধরবেন না

ভীষণ গুরুতর মুহূর্তেও যেনো আহানের হাসি পেলো তুরার কথা শুনে। মেয়েটা প্রেমা হাত না ধরার জন্য কাঁদছে!তবুও উপরে উপরে কপট জেদ ধরেই থাকল। তুরা আহানের বুক থেকে মুখ তুলে তাকালো আধবোজা চোখে, ভাঙা ভাঙা গলায় বলল

-আপনি এখনও রেগে থাকবেন? আমিতো সরি বলছি। কান ধরে উঠা বসাও করব আপনি বললে

তুরার বাচ্চামো কথা শুনে আহানের মনে মনে নিজেকেই দুটো বসাতে ইচ্ছে করল, কার উপরে রাগ দেখাচ্ছিল সে? যে কি না স্বামীর রাগ ভাঙাতে কান ধরে ওঠা বসা করতে চাই!
ভ্রু যুগল দাম্ভিকতার সহিত কুচকে নিলো, নির্লিপ্তে নিঃশব্দে অবলোকন করল তুরার আনন, চওড়া হাত তুলে আঙুলের সাহায্য মুছে দিলো ঘাম আর চোখের পানিতে একীভূত হয়ে ভিজে জবজবা হওয়া মুখ খানা, পরম যত্নসহকারে চোখের পানি মুছে বলল

-মনে থাকবে তো!

-হ্যাঁ,,খুব

বারবার মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি দিয়ে বলল তুরা। আহানের বুকের উপর হাত রেখে আদুরে গলায় বলল

-আপনি আর এমন গোমড়ামুখো করে থাকবেন না তো বলুন?!

ছোট্ট নরম হাত খানার স্পর্শ একেবারে হৃদযন্ত্রটার উপরে লাগলেই কম্পিত হলো আহানের কায়া! মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ গুলো টাইফুনের গতিতে নিউরন গুলোতে অযাচিত আবেদন পাঠাতে লাগল। হৃদবক্ষের উপর নরম হাতের ছোঁয়া টা যেনো চামড়া ভেদ করে ভীষণ গহীন পর্যন্ত ছড়িয়ে গেলো। অস্ফুটস্বরে ‘উফফ!’ করে উঠল।
আহানের লাল হয়ে আসা চোখ দেখে তুরার কপালে কিঞ্চিত ভাঁজ পরল। আহানের রাগ কি তাও ভাঙল না? অহেতুক ভয়ে ভীত হয়ে আরও জোরে চেপে ধরল বুকে রাখা হাতটা, নিজের অজান্তেই বাড়িয়ে দিলো উঠাপরা অনুভূতির অদম্য প্রখরতা।

-কি করলে আপনার রাগ ভাঙবে স্বামী!

অল্প বিস্তর হাসল আহান, শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসা ঠোঁট প্রসারিত হলো মৃদু, পিঠ থেকে নামিয়ে এক হাত তুরার কোমরে স্থির করে বলল

-মাহিদের সাথে এত বেশি মিশবে না বুঝছ?

এটা আবার কেমন কথা হলো, কিসের ভেতর কি বলছে আহান। বোকা বোকা চাহনি দিয়ে তাকালো তুরা, ভাবলেশহীন ভাবে বলল

-আমাদের মাঝে ইয়াজ ভাই কোত্থেকে এলো?

-তোমার ইয়াজ ভাইয়ের সাথে কম মিশতে বলেছি, আমাদের মাঝে তো এক ইঞ্চির ও উপস্থিতি নেই

আহানের শেষোক্ত কথাটা শুনেই তুরা অপ্রতিভতায় নিজের অবস্থান টা উপলব্ধি করতেই শিউরে উঠল। বুকের রাখা হাতটাতে ভর দিয়ে সরে আসতে গেলেও লাভের লাভ কিছুই হলো না উলটে বাহুদ্বয়ের মাঝে দম বন্ধ করা চাপে পরল, অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল আহানের দিকে, কিন্ত আহান তা অহেতুক কথা যেমন এক কানে ঢুকিয়ে আরেক কানে বের করে দেয় ঠিক তেমন অভিব্যক্তির মতোই অগ্রাহ্য করল। তুরা ছাড়া পাওয়ার জন্য রীতিমতো ধস্তাধস্তি শুরু করলে আহান মন্থর স্বরে বলল

-ছেড়ে দেব আমি?

ভরাট গলার গভীর কন্ঠস্বর তুরার ঠিক কতখানি গহীন পর্যন্ত গেলো ধারণার বাহিরে, অদ্ভুতুড়ে দৃষ্টিতে চেয়ে রইল শুধু,হোক ক্লান্তিতে বা মোহে সরাতে পারল না নিজেকে নিস্তব্ধতায় শুধু ফিসফিসানোয় নিঃশ্বাসের শব্দই কানে আসতে থাকলো
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

#Humu_♥