তুমি আমি দুজনে পর্ব-৪১+৪২

0
700

#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ৪১

সূর্য ডোবার সাথে সাথে ধরণী আলোকে গোগ্রাসে গিলে টেনে এনেছে কৃষ্ণাভ কুচকুচে পরিবেশ। আশপাশ টা ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ, গাছপালা সটান দাঁড়িয়ে দাম্ভিক্যের সহিত,এক চুল নড়াচড়ার উপস্থিতি নেই। ক্লান্ত সন্ধ্যার অবসরে জুতার থপথপ শব্দে ছুটছে সুপুরুষ, এলোমেলো চুলগুলো লেপ্টে আছে কপালে,তা থেকে চুইয়ে চুইয়ে ঘাম ঝরছে, ইস্ত্রি করা শার্টের ভাঁজ কুচকে ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে লেপ্টে আছে শরীরে

ক্লান্ত শরীরে গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো, হাঁটু ভাজ করে বসে পরলো রাস্তার উপরেই। ফোস ফোস করে জোরে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস টানছে আর ছাড়ছে। ভার্সিটির আশেপাশে হসপিটালের দিকে, আর বাড়ি ফেরার পথের সব জাগায় খুঁজে খুঁজে পাগল হবার উপক্রম তবুও তুরা কোথাও নেই, পরপর তিনবার ঘুরেছে একই রাস্তায় তবুও তুরাকে পাইনি। বিরতিহীন ছুটায় শিরদাঁড়ার জুড়ে চিনচিনে ব্যথার আবির্ভাব হয়েছে, শিরা উপশিরায় টনটনে ঘাড় টা এলিয়ে দিলো গাড়ির সাথে। নিষ্প্রভ মলিন দৃষ্টিতে তাকালো আকাশের পানে৷ চাঁদটা আজ দেখা যাচ্ছে না, তারা গুলো লুকানো মেঘের আড়ালে। নিষ্প্রাণ দৃষ্টির অভ্যন্তরে ভেসে উঠছে তুরার খিলখিলিয়ে হাসার দৃশ্য টা।,বোকা বোকা চাহনি আর বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উলটে কেঁদে দেওয়া। আহানের আত্মচেতনের অজান্তেই গাড়িয়ে পরলো এক ফোঁটা পানি। এতটা অসহায় কখনও লাগেনি নিজেকে,এতটা বেচ্যান, অস্থির,উন্মাদনায় কখনোই জর্জরিত হয়নি মন মস্তিষ্ক। রোন্থন ম্লান কণ্ঠে বলল

-কোথায় তুমি তুরা, কোথায় আছো, কেমন আছো? কত খুঁজেছি তোমাকে,পাচ্ছি নাহ,কোথাও পাচ্ছিনা তোমাকে। একবার সাড়া দাও প্লিজ,তোমাকে কোথাও পাচ্ছিনা, একটা বার বলো তুমি কোথায়। তোমার গোমড়ামুখো ব’জ্জাত লোকটা তোমার অনুপস্থিতি আর এক লহমাও সহ্য করতে পারছে না তুরা। আহান পাচ্ছে না তোমাকে কোথাও পাচ্ছে না!

দাম্ভিকতায় ভরা শক্ত কণ্ঠস্বরটা যেনো হারিয়ে গেছে, ভরাট গলার দাপট নিমিষেই উবে গেছে, কথা গুলোও কেমন ভাঙা ভাঙা, স্থুল শোনাচ্ছে। কথার সাথেই দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো আহানের চোখ থেকে, ডান হাতের তর্জনী উঠিয়ে অশ্রুবিন্দু হাতে নিয়ে তাকালো নিমিষে, বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে, শূন্যতা বেদনার শূঁড় বুকটা এফোড় ওফোড় করে দিচ্ছে। হাতের উল্টো পিঠে মুছে নিলো তপ্ত নেত্রধারা।
নাহ্ এভাবে বসে থাকলে চলবে না,খুঁজতে হবে। তুরার কিচ্ছু হয়নি ও ঠিক আছে, ওকে এক্ষুনি খুঁজে ফেলবে আহান বুকের ভেতর ফাল হয়ে ঢুকে পরা তিক্ত যন্ত্রণার অবসানের জন্যে হলেও তুরাকে চাই, এক্ষুনি লাগবে। তুরার কিচ্ছু হতে পারে না!

হুড়মুড়িয়ে উঠলো আহান, দুহাতের এলোমেলো স্পর্শে চোখের পানি মুছে, গাড়ির দরজা টা খুলতে যাবে তখনই ফোনের সিস্টেমেটিক টোন টা বেজে উঠলো। তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছু একটা ভেবে পকেট থেকে ফোনটা বের করে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকেই চোখ মুখ চিকচিক করে উঠলো। ঘুটঘুটে অন্ধকারেও ফোনের স্ক্রিনের মৃদু আলোটাতে আহানের বিষন্নতা লেপ্টানো চেহারা জ্বলজ্বল করে উঠলো, তিন লাইনের ছোট মেসেজ টা দেখে প্রেরকের নাম নিয়ে মাথা না ঘামিয়েই গাড়িতে উঠে বসলো। মরুভূমির বুকে এক চিলতে পানির খোঁজ পাওয়া তৃষ্ণার্ত পথিকের মতো চাঞ্চল্যে আর উচ্ছ্বাসে ভরা আখিযুগলে সামনের রাস্তায় তাকিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটিয়ে নিলো গাড়িটা।

একজোড়া নয়ম বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঝকঝকে টাইলসের ফ্লোরে, আশেপাশের পরিবেশ থেকে মন মস্তিষ্ক শ-শ মাইল দূরে কেবল নিচের দিকে তাকিয়ে অপলক দৃষ্টিতে অবলোকন করতে ব্যস্ত। চোখে মুখে পানি চিকচিক করছে, বুকের ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মতো ঝাপসা হয়ে আছে। হাত মুষ্টি করে খামচে ধরলো পরনের জামা,চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস ফেললো,আহানের মুখ খানা মনের ভেতর ভেসে উঠতেই চোখ দিয়ে টুপটাপ করে অশ্রু ঝরে পরলো, কাঁধের উপর একটা হাতের স্পর্শ পেয়েও তাকালো না তুরা, ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে

-কাঁদিস না মা, কিচ্ছু হয়নি তো। আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শোকরানা উনি তোকে সহি সালামত রেখেছেন,ভাগ্যিস ইয়াজ তখন ওই পথে গেছিলো। না তো..

পুরোটা না বলেই চুপ করে গেলো তহমিনা, আজ যদি আল্লাহ সহায় না হয়ে মাহিদ তুরাকে না পেতো,কি হতো সেটা ভাবতেই বুকের ভেতর তোলপাড় উঠে গেলো। পাশবিক বিপদের মুখ থেকে বেঁচে আসায় ও অস্থিরতা কমেনি। একহাত তুরার মাথায় বুলিয়ে আরেক হাতে তসবিহ গুণে গুণে দুয়া পড়ে বিড়বিড়ালো।

-অন্তত গ্লাসের পানিটুকু খা বুড়ি, একটু বেটার লাগবে

স্থির কণ্ঠে বলল মাহিদ,তুরা এসে থেকে শুধুমাত্র অস্ফুটস্বরে দু তিনবার আহানের নাম করা বাদে একটা শব্দও করেনি,আর নাইবা এক ফোঁটা পানি পর্যন্ত গলাধঃকরণ করেছে। তহমিনা আর মাহিদ দুজনেই ব্যস্ত তুরাকে শান্তনা দেওয়ার,কিন্ত তুরা তো আগে থেকেই স্থির শান্ত,থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। মাহিদ এক হাত উঠিয়ে তুরার হাত ধরবে তখনই কলিং বেলের ধাতব শব্দ হতেই উচ্ছ্বসিত নেত্রে মাথা তুলে তাকালো, বসা থেকে উঠতে নিলেই কাধে হাত রেখে থামিয়ে দিলো তহমিনা, চোখের ইশারা করতেই মাহিদ উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই চক্ষুগোচর হলো গম্ভীর পরিপাটি চেহারার বিধ্বস্ত অবস্থা টা।
আহান মাহিদকে দেখেও উপেক্ষা করে হন্তদন্ত হয়ে ঘরের ভেতর ঢুকতেই তুরার কান্নামিশ্রিত ব্যথাতুর মুখশ্রী দেখে ধক করে উঠলো বুকের গহীনে লুক্কায়িত জাগায়।
মন্থর গতিতে তুরার দিকে এগোতে লাগলো। তুরার অশ্রুভরা চোখের ঝাপসা ঝাপসা দৃষ্টি স্পষ্ট হতেই দৃশ্যমান হলো আহানের অজস্র ক্লান্তিতে ছেয়ে থাকা মুখ, চোখের মণি শান্ত স্থবির হলো স্বামী নামক মানুষটার মুখ খানা দেখে।
ত্রস্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো,কোনো রূপ চিন্তাভাবনা ছাড়াই ছুটে গিয়ে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ঝাপিয়ে পরল আহানের বুকে,পিঠ খামচে ধরে কান্না ভাঙা গলায় বলল

-আ আমাকে, ও ওরা..

পুরোটা শেষ না করেই হাউমাউ করে কেঁদে দিলো, বুকের ভেতর প্রখর চিনচিনে ব্যথা করে উঠলো আহানের।তুরার কম্পিত অস্পষ্ট কণ্ঠ আহানের মন গহীনে সূচালো তীরের মতো গেঁথে গেলো। কাঁপা কাঁপা হাত উঠিয়ে পরম আবেশে রাখলো তুরার মাথায়। খানিক সময় নিয়ে তুরাকে শান্ত করে দুবাহু ধরে ছাড়িয়ে নিয়ে সোফাতে বসালো। সামনে রাখা পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে তুরাকে পানি খাইয়ে দিলো।
তহমিনা আর মাহিদ তাকিয়ে আছে শুধু নিষ্পলক।কিছুক্ষণ আগ অব্দিও মেয়েটা জমে পাথর হয়ে ছিলো,আর এখন কান্নার জোয়ারে ভেঙে পরছে।

-তুরা? উহু কান্না করে না,কিচ্ছু হয়নি। দেখি এদিকে তাকাও

বলে তুরার মুখটা দুহাতের আঁজলে নিয়ে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে এক হাতে তুরাকে আগলে ধরলো।
তহমিহা বেগম এবার গলা খাকারি দিয়ে বলল

-তোমার সাথে দেখা করার খুব ইচ্ছে ছিলো তবে সেটা এমন অপ্রিতিকর পরিস্থিতিতে হবে ভাবতে পারিনি

ভদ্রমহিলার সাবলীল স্বরে কথায় আহান এবার ধাতস্থ হয়ে তাকালো সামনে দাঁড়ানো মাঝ বয়স্ক মহিলা আর তার পাশেই দাঁড়ানো ছেলেটির পানে যাকে যে আগে থেকেই চেনে। তবে আজকের চেনা টা অন্যরকম। সম্পর্ক, স্থান কাল পুরোটাই ভিন্ন।

-তুরাকে কোথায় পেয়েছেন?

জড়তা ছাড়াই প্রশ্ন করলো আহান। মাহিদ চোখের চশমা টা ঠিক করে এগিয়ে এসে বলল

-সন্ধ্যার দিকে আমি বাড়িতে ফিরছিলাম। তাড়াতাড়ি ফেরার জন্য শর্টকাট রাস্তায় গাড়ি ঢুকালে গাড়ির সামনে দিয়েই কাওকে দৌড়ে আসতে দেখে কৌতুহলবশত থামিয়ে বাইরে আসতেই তুরাকে দেখে যতটা না অবাক হয়েছিলাম তার চেয়েও বেশি অবাক হয়েছি ওকে ধাওয়া করা পেছনের দুটো ছেলেদের দেখে তার চেয়ে বেশি ভয় পেয়েছি। সেসময়ে যদি আমি ওই রাস্তায় না আসতাম..

বলেই চুপ করে গেলো, লোমকূপ তিরতির করে উঠলো না হওয়া পাশবিক মুসিবতের কথা ভেবে। ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলো বুকের মাঝে লেপ্টে থাকা তুরার পানে। এক হাতে আরও শক্ত করে ঝপটে আগলে নিলো বুকের মাঝে।

-এসব থাক না মাহিদ,যা হওয়ার হয়ে গেছে রবের কছে শুকরিয়া যে আমার মেয়েটা সহি সালামত আছে। এটাই অনেক।

প্রত্যুত্তরে কি বলবে ভেবে পেলো না আহান।তুরার নিষ্পাপ মুখে চেয়ে এখনো বুকের ভেতর দিয়ে ঝড় বইছে। ঢোক গিলে শান্ত করলো বেচ্যাইন হওয়া ভেতরাঞ্চল, ভরাট গলায় বলল

-বিকেল থেকে খুঁজে বেরাচ্ছি ওকে। ভার্সিটি হসপিটাল বাড়ি যাওয়ার রাস্তা কোনো টা বাদ রাখিনি। এভাবে অফসাইডে..

বলেই থামলো। এ ব্যাপারে আর একটা শব্দও মুখ থেকে বেরচ্ছে না। ফোস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল

-আমি তুরাকে নিয়ে ফিরতে চাই আন্টি!

তহমিনা কখন থেকে কিছু বলার জন্যেই পায়তারা করছিলো। আহানের কথার পৃষ্ঠে উনি সাফ গলায় বললেন

-আসলে তোমাকে আমার কিছু বলার আছে আহান। তুরা আমার অনেক আদরের, মূলত ওর জন্যেই দেশে ফিরেছি। মেয়েটা আমার অনেক দিন দূরে ছিলো,তাই আমি চাই তুরাকে কিছুদিন আমার কাছে রাখতে

খানিক থেমে আবারও বলল

-এরকম একটা ঘটনার সাপেক্ষে ও যখন বাড়িতে এসেছে, আর রাত ও অনেক হয়েছে আমি চাইনা ও আজ ফিরুক। আর তোমার মা আর দিদুনও তো বাড়িতে নেই। এসময় তুরার একটু সাপোর্ট আর মমতার প্রয়োজন। তাই আমি স্পষ্টত তুরাকে আমার কাছে কিছুদিন রাখতে চাই। আশা করছি এতে তোমার কোনো আপত্তি নেই?

তহমিনার কথায় তুরা ঘাড় তুলে সোজা হয়ে বসলো, মামনীর দিকে তাকিয়েই ফিরে চাইলো আহানের চেহারায়। তুরার চোখে দুদন্ড দৃষ্টি স্থির রেখেই মুখ ফিরিয়ে নিলো আহান। কিছু একটা ভেবে মুখাবয়ব গম্ভীর স্থির করলো। ভারি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল

-ঠিকাছে। তুরা কিছুদিন থাকুক তবে এখানে

চোখ ছলছল করে উঠলো তুরার, মন্থর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো আহানের চেহারা পানে। তার মাঝেই মাহিদ বলল

-রাত ও তো হয়ে গেছে, আজকে এখানেই থেকে যান স্যার

আহান ঠোঁট এলালো অল্প বিস্তর,হাসলো কি না তা স্পষ্ট নয়। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মাহিদের দিকে তাকিয়ে বলল

-স্যার শব্দ টা ভার্সিটির বাইরে ব্যবহার না করলেই খুশি হবো।

সৌজন্য সুলভ হাসলো মাহিদ তবে প্রত্যুত্তর করলো নাহ, তহমিনা এগিয়ে আসলো আহানের কাছে, সামনে দাঁড়িয়ে বলল

-মাহিদ ঠিক ই বলেছে আহান, এতো রাত করে তুমি ফিরোনা বাড়িতে

-সমস্যা নেই আন্টি, আমি কাল এসে ওকে দেখে যাবো

-তবুও এতো রাত করে আজ আর ফিরো না বাবা, আজ প্রথম এসেছ তুমি আমার বাড়িতে

তহমিনার কথার মাঝেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো তুরার দিকে। চাইলো না তুরা আহানের মুখে,মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলল

-উনাকে যেতে দাও মামনী,লাগবে না থাকা

বলে বসা থেকে উঠে গটগট করে ঘরের দিকে গেলো। সেদিকে চেয়ে আহান ঠোঁট কামড়ে হাসলো, শুষ্ক ঠোঁটের মৃদু হাসিটা এবার স্পষ্ট দৃশ্যমান হলো। হোক নিষ্প্রাণ অথবা ক্লান্তি মিশ্রিত তবে মুখ জুড়ে একটা প্রশান্তি ছড়িয়ে আছে, বিষাদের ঘন কালো মেঘ যেনো অবিরাম ধারায় ধুয়ে মুছে গেছে, হোক অভিমান বা রাগ। চোখের সামনে থাকলে সব সহ্য করে নিবে সে!

~

ফ্রেশ হয়ে এসে তোয়ালে হাতে নিয়ে চোখ মুখ মুছতে লাগলে দরজার দিকে চোখ গেলে হাত থেমে গেলো। থপ করে তোয়ালে টা রেখে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।

আহান হাসলো সামান্য, দরজার ছিটকিনি তুলে দিয়ে এগিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়ালো একদম তুরার পেছনে। তুরা সেটা লক্ষ্য করলেও অগ্রাহ্য করলো পুরোটা। ভ্যাপসা গরমে থমথমে হয়ে থাকা আকাশটা এখন মেঘের বজ্রপাতের দাপটে ধরণী কাঁপিয়ে তুলছে। থেকে থেকে বিদ্যুতের ঝলকানি আর বেপরোয়া বাতাসের সহিত সঙ্গ দিতে ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামলো। ঝরঝরে বাতাসের এলোমেলো দাপটে বৃষ্টির পানি উপছে ছিটকে পরছে বারান্দার ভেতরে। চোখে মুখে পানির ঝাপটাই অনেকটাই ভিজে গেলো তুরা,তবুও স্থির দাঁড়িয়ে রইলো বুকে দুহাত গুঁজে, নিরবতার লগ্ন চ্যুত করে এবার শোনা গেলো আহানের শান্ত কণ্ঠস্বর

-ভিজে যাচ্ছো তুমি,ঘরে এসো

-যাবনা আমি,আপনি যান

ঝট করে বলে ফেলল তুরা,শুনবে না কথা। এখানে কেনো এসেছে। যাক না চলে যাক থাকতে বলেছে কে। ক্ষুদ্র সময় পার হলো,আহানের সাড়া শব্দ নেই। তুরাস সংশয় হলো,সে বলল আর আহাম ভালো ছেলের মতো চলে গেলো এমন তো হওয়ার কথা না! কপাল কুচকে পেছনে তাকাতেই ভড়কে গেলো, আহান ঠাই দাঁড়িয়ে, দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বুকে দুহাত গুঁজে, তুরা মুখটা ছোট করে বলল

-আ আপনি যাননি কেনো?

এগিয়ে এলো আহান,দূরত্ব ঘুচিয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। শান্ত আখিযুগল আটকে গেলো তুরার ভেজা মুখমন্ডলে। গোলগাল মুখে বিন্দু বিন্দু স্নিগ্ধতা জমে আছে যেনো। নিষ্পলক চেয়ে থেকেই ঠোঁট নাড়িয়ে নরম গলায় বলল

-ঘরে এসো তুরা, শরীর ভিজে যাচ্ছে। অসুস্থ হয়ে যাবে

মুখে না বলতে চাইলেও অদ্ভুত এক জড়তা ঘিরে ধরলো তুরাকে। ঠান্ডা হিম অনলে শরীরে ঝাকুনি লাগছে বারংবার। তার উপর আহানের এতটা নৈকট্য, চোখ নামিয়ে কোনো মতে জবাব দিলো

-আরেকটু থাকি

কিছুক্ষণ চোখ ছোট করে তাকিয়ে থেকে এক ঝটকায় কোলে তুলে নিলো তুরাকে। বিছানায় এনে শুইয়ে ওর উপর ভর করে থেকে আঙুল তুলে তুরার মুখের ছোট ছোট পানিকণা মুছে দিতে দিতে বলল

-তীব্র বর্ষণের বাড়িধারার অনুমতি নেই তোমাকে ভেজানোর, জমিয়ে রাখো। সঠিক সময় আসুক, ভেজাবো তোমায়, সিক্ত করবো স্নিগ্ধ অনলের অন্যরকম বৃষ্টিতে। ততদিনে জমা থাক? এভাবে আমার সামনে আর বৃষ্টিতে ভিজে নিয়ন্ত্রণহীন করে দিও নাহ

কণ্ঠনালী ধরে এলো তুরার, অনুভূতির প্রখরত্ব দিগুণ হলো। হুট করেই আদরের আহ্লাদী হয়ে আহানকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। কান্নামিশ্রিত গলায় বলল

-আমি আপনাকে অনেক ডেকেছি, কেনো আসেননি আপনি। আমার খুব ভয় করছিলো। ওরা খুব খারাপ,যদি একবার আমাকে ধরতে পারত..

-হুসস,ওসব আর একটুও নাহ

বলেই তুরাকে ঝাপটে ধরে নিজের স্থান পরিবর্তন করলো। বুকের উপর তুরার ছোট শরীর টা চেপে ধরে আদর মিশ্রিত স্বরে বলল

-এখন আছি তো, কিচ্ছু হয়নি তোমার আর হবেও না।

টলমল চোখে আহানের দিকে তাকালেই গাল বেয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো। আহান চোখের জল মুছে দিয়ে ওষ্ঠপরশ বুলিয়ে দিলো তুরার কম্পিত অক্ষিযুগলে। তড়িৎ উথাল পাথাল ঢেউ শুরু হলো তুরার সমস্ত কায়ায়। দু’হাতের বন্ধন আরও শক্ত করলো। আহান দুর্বোধ্য হাসলো বুকের মাঝেই চেপে ধরে রাখলো নিজ অর্ধাঙ্গিনীকে
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

#Humu_♥️

#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ৪৩

সময় বহমান, দেখতে দেখতে সপ্তাহ খানেক বাতাসের মতই উড়ে গেলো। এর মাঝে তিনটা ক্লাস টেস্ট হয়েছে তুরার। আজকে লাস্ট পরীক্ষা টা ছিলো। সেটা দিয়েই বাড়ি ফিরছে তুরা। পরপর কয়েক দিনের তীব্র বর্ষণের ছোঁয়ায় পরিবেশ জুড়ে আয়নার মতো প্রগাঢ় স্বচ্ছতা। শরতের আগমনের আগাম বার্তা জানাতে নীলাভ আকাশে পেঁজা তুলোর ন্যায় রাশি রাশি মেঘ জমেছে, নাম না যানা কিচিরমিচির পাখির কলরবমূখর সুরে প্রস্ফুটিত কলধ্বনি।
বরাবরের ন্যায় ব্যাগটা দু’হাতে জড়িয়ে রেখে হাঁটছে,

-তুরা?

হঠাৎ পেছন থেকে ক্লান্ত স্বরের মেয়েলী ডাক শুনলে তৎক্ষনাৎ পিছু ফিরে তাকালো, বিষন্ন ধরা চোখে অবসাদ মেলে তাকিয়ে আছে আগন্তুক তুরার দিকে, পরিপাটি করে পরিধেয় করা কাপড়টাতেও কুচকানোর ছাপ স্পষ্ট। শরতের হিমেল পরিবেশেও কপাল বেয়ে বহমান টুপটাপ ঘামের বিন্দু।

-কেমন আছিস মা?

বিস্ময় কাটিয়ে কিছু বলবে তার আগেই শাড়ির আঁচলে মুখের ঘাম মুছে নরম গলায় শুধালো, তুরার ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুচকালো। তা বিস্মিত হয়ে নাকি আবেগে তা বলা দায়। অন্তস্থলের বিব্রতবোধ দমিয়ে সামান্য হেসে বলল

-ভালো আছি চাচী,আপনি কেমন আছেন?

সেই আগের মতই নরম নিষ্পাপ বাচনভঙ্গি তুরার,না চাইতেও ভরে এলো। দু চোখ বয়ে জল গড়িয়ে পরলো গাল বেয়ে। অপরাধবোধ গ্লাণি,অনুতপ্ততায় জর্জরিত হয়ে মাথা নামিয়ে নিলো। বুক ভরে শ্বাস ফেলে বলল

-যেমন থাকার কথা ছিলো তেমনই আছি। নিজের পা’পের শাস্তি ভোগ করছি

বলেই আবারও শাড়ির আঁচল তুলে মুছে নিলেও চোখ ছাপিয়ে জল গড়িয়ে পরলো। তুরার দৃষ্টি বিব্রত,জড়িত। কোনো মতে ঠোঁট নাড়িয়ে বলল

-কি হয়েছে চাচী।আপনাকে এমন কেনো দেখাচ্ছে? বাড়িতে সব ঠিক আছে তো, নেহা কেমন আছে?

তুরার দুহাত ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো রাজিয়া বেগম। কান্নামিশ্রিত গলায় বললো

-তোর উপর অনেক অ’ন্যায় জু’লুম করেছিলাম রে মা, যে সময় তোর মাতৃস্নেহের দরকার ছিলো সেসময় তোকে লাঞ্চিত করে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম।তোর হকের জিনিস থেকেই তোকে বঞ্চিত করেছিলাম।আজ তার হিসাব পইপই করে নিচ্ছে আল্লাহ আমার।

তুরা হতবিহ্বলিত হয়ে কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে দু’হাতে আগলে ধরলো রাজিয়ার হাত। ব্যস্ত স্বরে অস্থিরচিত্তে বলল

-চাচী আপনি কাঁদছেন কেনো। কি হয়েছে? বাড়িতে সবাই ঠিক আছে তো?

বলে রাজিয়াকে ধরে রাস্তার পাশের বেঞ্চিতে বসালো।ব্যাগের চেইন খুলে পানির বোতল বের করে রাজিয়ার হাতে ধরিয়ে বলল

-চাচী পানি খান,শান্ত হোন প্লিজ। এভাবে কাঁদলে তো অসুস্থ হয়ে যাবেন

রাজিয়া আধো চোখে তাকালো তুরার চেহারা পানে,পানির বোতল টা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পানি গিলে দম ছাড়লো। আখিযুগল নিচের নিকে স্থির রেখে বলল

-তোর বাবা মারা যাওয়ার পরে তো তার ব্যবসার সব দ্বায়িত্ব তোর চাচার উপরেই এসেছিলো। এতদিন অন্যের দেওয়া টাকায় চলে ফিরে হুট করেই এতগুলো সম্পদের অধিকার পেয়ে লা’লসে গেছিলো তোর চাচা,সাথে আমিও। দুজন অর্থলো’ভে অন্ধ হয়ে তোর উপর অ বিচার তো করেছিই তার সাথে দিন দুনিয়াও প্রায় ভুলেই গেছিলাম

দম নিলো খানিকটা। শ্বাসক্রিয়া ধাতস্থ করে আবারও বলতে আরম্ভ করলো

-তুই ও বাড়ি থেকে চলে আসার পর বাড়ির আয় বরকত সবই বেরিয়ে গেছে। তোর চাচার হেয়ালি দিন দিন বেড়েই চলছিলো। ব্যবসা তো এমনিতেই বুঝতো না তেমন। তবুও সেদিকে মন না দিয়ে অসৎ লোকের পাল্লায় পরে ম’দ জু’য়া করে বেরিয়েছে।
এদিকে ব্যবসাতে দিনের পর দিন অবহেলার জন্যে চরম লোকসান হচ্ছিলো এমনকি আমাদের দৈনন্দিন প্রয়োজন গুলোর তাগিদে অনেক লোকের কাছে ধার দেনা কর‍তে হয়েছিলো। দিনের পর দিন পার হলেও মানুষের ঋণ শোধ করতে না পারায় তারা হুলস্থুল কাজ করে বসে। ব্যবসাও নিলামে উঠে গেলো। এক পর্যায়ে সব হারিয়ে পথে বসার জো, তখন পাশের বাড়ির চাচাকে বলে একটা দোকানের ব্যবস্থা করে ভাড়া নিলাম। সেটা দিয়ে যখন দু পয়সা আসতে শুরু হলো তখনই তোর চাচার অসুস্থতা ধরা পরলো। ডায়াবেটিস, প্রেসার, মাজার ব্যথায় তার চলাফেরার শক্তিও প্রায় শেষের দিকে। এখানে এসেছিলাম বড় আপার কাছে কিছু টাকা পয়সার তাগিদে। কিন্তু বলে না ধর্মের কল বাতাসে নড়ে,সেইরকম ই হয়েছে। তোর হকের জিনিস আত্মসাৎ করে যেমন অন্যায় করেছিলাম। তেমন যেই বোনকে দিনের পর দিন বেহিসেবী টাকা দিয়েছিলাম সেই বোনই দুয়ার থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে

দীর্ঘক্ষণের কথা শেষ করে হাফ ছাড়লো রাজিয়া। বিরতিহীন অশ্রুবিন্দু আবারও মুখ ঘষে মুছে নিলো।
বিষাদময় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো তুরা ফোস করে, যতই হোক চাচী তো মায়ের মতই তার এহেন দূর্দশায় নিজেকে কঠোর রাখার মতো পাষ’বিক কথাটা মাথায় ও আনতে পারলো না। এক হাত তুলে রাজিয়ার কাঁধে রেখে বলল

-কাঁদবেন না চাচী। বিপদ যখন আল্লাহ দিয়েছেন,ঠিক ও তিনিই করে দিবেন। দুহাত তুলে আল্লাহর দরবারে রহম চান তিনি কাওকে ফিরিয়ে দেননা

বলে রাজিয়ার মুখের পানে তাকিয়ে আবারও বলল

-আপনার চোখ মুখ তো দেবে গেছে, শরীরের একি হাল। সকাল থেকে কি কিছুই খাননি আপনি চাচী?

তুরার চিন্তাবৃত্ত ছড়ানো কথায় মুখ তুলে দুচোখ মেলে তাকালো রাজিয়া। ফর্সা গায়ের গড়নের উজ্জ্বলতা আরও বেড়েছে,কানের সোনার দুলগুলো ঝকঝক করছে,পরনের দামী জামা আর পরিপাটি বেশভূষা তুরার সৌন্দর্য আরও ত্বরান্বিত করেছে।
এই মেয়েটাকেই এক সময় কত না ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে তার জন্যে,অথচ মুখ দিয়ে টু শব্দ ও করেনি কখনো। আর আজ যখন ওর উপরেই অ’ন্যায় করা মানুষগুলোর শাস্তি পাবার পালা তখন উল্টো কেমন মায়া,আত্ততা দেখাচ্ছে! মেয়েটাকে সে কম কষ্ট দেয়নি। কিন্তু ওকে আল্লাহ ভালই রেখেছে। নিজের পা’পের শাস্তি তো এখন তাদের পাবার পালা।

-জানি তোর কাছে ক্ষমা চাইবার মুখ নেই আমার,তবুও বেহায়া হয়ে বলছি। আমায় ক্ষমা করে দিস মা, নিজ সন্তানের মতো আগলে রাখার মায়ের মতো ভালোবাসার সময়ে আমি নিষ্ঠু’রতার পরিচয় দিয়েছিলাম তারই ফল আজকের এমন অবস্থা, আমায় তুই ক্ষমা করে দিস রে

তুরা এক হাতে আগলে ধরে চোখের পানি মুছিয়ে দিলো রাজিয়ার। সমবেদী গলায় বলল

-যা হয় ভালোর জন্যেই হয়। আপনাদের উপর আমি কখনো রাগ করিনি না কোনো অভিযোগ পুষে রেখেছি। বরং আমিতো শুকরিয়া করবো। সেদিন যদি ইনসাফ আংকেলের কথায় রাজি না হতেন তাহলে হয়তো আজ আমি এতো সুন্দর অমায়িক একটা পরিবার আর এতগুলো ভালোবাসার মানুষ পেতাম নাহ। সৃষ্টিকর্তা আমায় খুব ভালো রেখেছেন চাচী। আপনারও দুঃসময় খুব জলদিই পার হয়ে যাবে দেখবেন। আল্লাহ কারো দোয়া ফিরিয়ে দেন না,সঠিক সময় মতো ঠিকই পূরণ করে দেন।

রাজিয়া কৃতজ্ঞতা ভরা নয়নে তাকালো তুরার দিকে, বুকটা যেনো হালকা লাগছে আজ। নিজের ভুল, অ’ন্যায় করা কাজটার ভারে এতদিন বুকে পাথর চেপে রেখেছিলো৷ তুরার কাছে ক্ষমা চেয়ে যেনো অনেকটা হালকা হলো। ভাগ্যিস আজ সৌভাগ্যক্রমে তুরার দেখা পেয়েছিলো। না তো সে বাসে উঠতেই তো যাচ্ছিলো। কথায় আছে আল্লাহ ছাড় দেয় কিন্তু ছেড়ে দেয়না, নিজের করা পা’প এখন নিজের গলায় ই শিং মাছের কাঁটার মতো বিঁধে আছে৷ এবার বুঝতে পারছে খারাপ সময়ের যন্ত্রণাটা ঠিক কতটা ভারি

•••

দুতালা ছিমছাম বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালো সাদমান। ফোন চেক করে নিলো আরও আরেকবার। সঠিক ঠিকানাতেই এসেছে। সময় তিনটা বেজে ছাপ্পান্ন মিনিট। পড়ানোর কথা ছিলো ঠিক চারটায়। গায়ের শার্ট টা হাতে টেনে ঠিক করে ভেতরে ঢুকলো। গেটের সামনে যেতেই দারোয়ান জিজ্ঞাসা করলো

-আপনি কে? কাকে চাই

সাদমান জড়তা সুলভ বলল

-আমি সাদমান। এ বাড়িতে আমাকে টিউশনির জন্য ডাকা হয়েছে। ওই যে,,কি যেনো নামটা?..

নিজেই বিড়বিড়িয়ে বলল শেষের কথাটা। মেয়েটার নামই তো মনে করতে পারছে না সাদমান। ফারিহা তিনবার বলেছিলো মেয়েটার নাম

-রিমঝিম?

দারোয়ানের কথায় প্রসস্থ হাসলো সাদমান। ললাট স্ফীত করে বলল

-হ্যাঁ হ্যাঁ, রিমঝিম। হ্যাঁ ওকেই পড়াতে এসেছি। এটা ওরই তো বাড়ি তাইনা?

খানিক বিব্রত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো সাদমান। দারোয়ান মৃদু হেসে সম্মানের সঙ্গে বলল

-জ্বি স্যার,এটা রিমঝিম আপাদেরই বাড়ি। আপনি যান। ভেতরে গিয়ে সিড়ি বেয়ে উঠলেই উনাদের ঘরের দরজা দেখতে পাবেন

সাদমান জবাবে আবারও প্রসস্থ হাসলো, দারোয়ানকে ধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে গেলো ভেতরের দিকে। সিড়ি বেয়ে উঠে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেলে চাপ দিলে মিনিট খানেকের মধ্যেই দরজা খুলে গেলো। সাদমান ভদ্রতা সুলভ হেসে বলল

-আসসালামু আলাইকুম, আমি সাদমান। ঝুমঝুমকে পড়াতে এসেছি

ভদ্রমহিলা সালামের উত্তর দিলেও পরক্ষণেই কিছু একটা ভেবে দ্বিধাদ্বন্দিত ভরা চেহারায় বলল

-কিন্তু এ বাড়িতে তো ঝুমঝুম নামের কেও নেই?

এবার সাদমান পরলো বিপাকে। এ বাড়িতে এই নামের কেও নেই,তাহলে কি ফারিহা ভুল ঠিকানা দিলো? আর দারোয়ান ও কি মিথ্যা বলল?

-এক মিনিট, তুমি রিমঝিমের কথা বলছ?

-হ্যাঁ হ্যাঁ, জ্বি রিমঝিমের কথা বলছি। সরি আসলে নামটা গুলিয়ে ফেলেছি

অপরাধীর ন্যায় লজ্জিত হয়ে বলল সাদমান। ভদ্রমহিলা বিস্তর হাসলো। সবিনয় গলায় বলল

-ওসব ব্যাপার নাহ। তুমি ভেতরে আসো।

সাদমান অপ্রস্তুত হেসে ভেতরে ঢুকলো। কি একটা লজ্জাজনক পরিস্থিতি!প্রথম দিন এসে ছাত্রীর নামই ভুল বলে ফেললো। গার্জিয়ান কি ভাববে কেমন স্যার যে স্টুডেন্টের নামই মনে রাখতে পারে না পড়াবে আর কি!

•••

অনবরত টিভির চ্যানেল চেঞ্জ করছে তুরা। কোনো কিছুই ভালো লাগছে নাহ। কিছুক্ষণ আগেই তহমিনা খাইয়ে দিয়ে গেছে। খাবার খাওয়ার সাথে সাথেই ঘুমাতে পারেনা তুরা। তাই ড্রয়িং রুমেই বসে আছে টিভির সামনে।
দুপুরে রাজিয়া বেগমকে নিজের সাথে করেই এনেছিলো তুরা, সে আসতে না চাইলেও এক প্রকার জোর করেই এনেছে। রাজিয়াকে দেখে শুরুতে তহমিনা মুখ কালো করে রাখলেও তুরার জোরাজুরিতে আর পারেনি। আর সবটা শোনার পরে তার মনটাও কেমন গলে গেছে। যতই হোক ইমতিয়াজ তারই ছোট ভাই।
তোফায়েল আর তহমিনার ছোট ইমতিয়াজ, তিন ভাই বোনে গলায় গলায় সম্পর্ক ছিলো। হুট করেই কি হলো ইমতিয়াজ টা কেমন পথচ্যুত হয়ে গেলো। তোফায়েল বেঁচে থাকতে সবটা সামলে রাখলেও ওর মৃত্যুর পর আরও এলোমেলো হয়ে গেছে সব।
তবে যাই হোক,মনে মনে খানিকটা দমলেও মুখে প্রকাশ করেনি তহমিনা। যতই হোক তুরাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসে সে,তাকে কষ্ট দেওয়া মানুষ গুলোকে এতো সহজে কিছুতেই ক্ষমা করবে না সে।
থপ করে রিমোট চেপে টিভি টা বন্ধ করে দিলো। ধীর পায়ে হেঁটে ঘরের ভেতরে আসলো। দরজা টা লাগিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো, কাজল টা তুলে আরও একটা দাগ দিলো। এ দিয়ে মোট নয়টা হলো। আহান তো বলেছিলো দশ দিনের ভেতরেও কাজ হয়ে যেতে পারে। নিভু নিভু আশা জাগলো মনে তুরার। রোজ রাতেই ওর মনে হয় এই বুঝি কালই চলে আসবে আহান।
আবারও তুরা ব’জ্জাত জল্লাদ বলে ঝগড়া করতে পারবে,আবারও আহান চেঁচিয়ে বলবে ‘তুরা তোমার আজাইরা বিড়াল টাকে সরাও’, আবারও তুরা ভূতের ভয়ের বাহানায় জায়গা করে নিবে আহানের বক্ষস্থলে।
নয়দিন ই তো হয়েছে, এ আর তেমন কি? তবে এই নয় দিন ই যথেষ্ট আহানের অনুপস্থিতিতে তুরার ভেতরটা ছার’খার করে দিতে,বুকের ভেতর শূন্যতায় খাঁ খাঁ করা অমানিশার অনুভূতি দিতে। সাজানো গোছানো আবেগ,আসক্তি গুলোকে ঝড়ের মতো এলোমেলো করে দিতে।
সেদিনের পর আর আহানের সাথে ফোনে কথা হয়নি। কথায় হয়নি আর,শুধু মাঝে একদিন মেসেজ করেছিলো। সেখানে স্পষ্ট করে লিখা ছিলো
“স্টাডির জন্য অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে পরেছি। রিসার্চের কাজে সারাদিন পার হয়ে যায়।সময় করে উঠতে পারছিনা। কবে ফিরবো তাও ঠিক করে বলতে পারছিনা। তুমি কিন্তু নিজের খেয়াল রেখো। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করবে লাফালাফি করবে নাহ,আর হ্যাঁ একা একা একদম কোত্থাও বেরবে নাহ”

তুরা নির্লিপ্ত চেয়ে ছিলো মেসেজটার দিকে কোনো পালটা জবাব ও পাঠাইনি। পাঠাবেও নাহ। থাকুক সে,,যেখানে খুশি থাকুক। যার সাথে ইচ্ছে থাকুক। আর কিছুই বলবে নাহ তুরা।

~~

দেখতে দেখতে আরও চারটা দিন পার হয়ে গেলো, তুরা এর মাঝে দুদিনের জন্য ও বাড়িতে গিয়ে আবারও চলে এসেছে,
মূলত রাইমা এসেছিলো বলেই গেছিলো তুরা। আবারও ফিরে এসেছে ফুফুর বাড়িতেই। ও বাড়িতে থাকলে নিজেকে সামলে রাখতে পারেনা। সবখানটা জুড়েই যেনো আহানের স্মৃতি আহানের সবটা মিশে আছে। রাত হলেই ফুঁপিয়ে কান্না আসে তুরার। ঘর জুড়ে আহানের শরীরের চিরচেনা ঘ্রাণটার মাদ’কময়তায় ভরা। তুরার ভীষণ ইচ্ছে করে ঘ্রাণ টা নাক ভরে নিতে,দু’হাতে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু তা তো পারে না,তখন খুব অসহায় লাগে নিজেকে ভীষণ কষ্ট হয়!
হাতে রাখা শার্ট টাতে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো, দুহাতে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরলো তুরা শার্টটা। সাদা রঙের শার্ট টা তুরা আসার সময় এনেছে ও বাড়ি থেকে, সাথে আহানের ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটাও। এক প্রকার লুকিয়েই এনেছে ছবি আর শার্টটা। বারান্দা থেকে ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পরলো। আনমনেই বলল

-দশদিন পরেই চলে আসবেন বলেছিলেন অথচ তেরো দিন হয়ে গেলো আপনার খোঁজ নেই। একটা ফোন অব্দি করলেন না। এতো নিষ্ঠুর পাষাণ কিভাবে আপনি। আমার কথা কি একটুও মনে পরে না আপনার?

ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো তুরা, সারাদিন সবার সামনে হেসে খেলে বেরালেও রাত হলেই বুকটার ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে, এতটা যন্ত্রণা কেনো হয় তার! স্বামী বলে? নাকি ভালোবাসে বলে?

এসব ভাবতে ভাবতেই চোখ লেগে এলো তুরার। পুরো ঘর জুড়ে অন্ধকার, বারান্দার লাইটের মৃদু আলো এসে পরছে জানালা দিয়ে, হুট করেই বারান্দায় ধপ করে কিছু পরার শব্দ হলেও ঘুম ভেঙে গেলো তুরার,হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো। ধাতস্থ হয়ে বারান্দার দিকে তাকাতেই দেখলো লাইটটা বন্ধ। একটু আগেও তো জ্বলছিলো লাইট টা,এখন নিভে গেলো কি করে? কারেন্ট ও তো যায়নি?
শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো তুরার,সেদিনের বিভৎস দৃশ্যটা আবারও ভেসে উঠলো স্মৃতির দৃশ্যপটে। শুকনো ঢোক গিলে গলার ঘাম মুছে নিলো।
আস্তে করে বিছানা থেকে পা টা নামালো। ভয়ে হাঁটুতেও শক্তি পাচ্ছে না দাঁড়ানোর। কোনো মতে অন্ধকারে হাতড়িয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলো, রাস্তার সোডিয়াম লাইটের আলোতে হালকা ঝাপসা বারান্দাটা স্পষ্টত বুঝা যাচ্ছে।
হুট করেই কালো একটা ছায়া দেখে লোমকূপ তিরতির করে উঠলো তুরার, ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ, ঝাপসা আলোতে স্পষ্ট একটা অবয়বের নড়াচড়া দেখতে পেরেছে সে। ব্যাপারটা আরেকটু কাছ থেকে দেখার অদম্য ইচ্ছে হলো, ভয়টাকে গোগ্রাসে গিলে সাবধানী পায়ে এগিয়ে গেলো, দরজাটা এক হাতে ধরে মাথা এগিয়ে কিছু দেখতে যাবে তার আগেই তুরাকে পেছন ঘুরিয়ে মুখ চেপে ধরলো শক্তপোক্ত একটা হাত।
ছটফট করতে শুরু করলো তুরা,বলিষ্ঠ হাতের চাপে দম বন্ধ হবার জো, গায়ের সর্বোচ্চ শক্তি লাগিয়েও এক চুল নড়াতে পারলো না হাতের অবস্থান,এবার তুরার ভীষণ রাগ হতে লাগলো।
পেয়েছে টা কি প্রত্যেকবার এসে তুরাকে হেনস্তা করবে? কিছুতেই না। ওইদিন তো রাস্তা বলে পালিয়েছে তুরা,আজ কিছুতেই হার মানবে না সে।
হাতের উপর সজোরে একটা কামড় বসিয়ে দিলো। মৃদু আর্তনাদ শোনা গেলো, হাতটা মুখ থেকে সামান্য আলগা হতেই তুরা সরে আসতে গেলে আবারও চেপে ধরলো। তুরা ছটফটিয়ে হাত পা আছড়ালো। এক হাতের কনুই দিয়ে পেছনের দিকে ভীষণ জোরে আঘাত করলেই অন্ধকারের মাঝে “আহ্” করে ছোট আর্তনাদ স্পষ্ট ঢুকলো তুরার কানে। হাতটা ছাড়িয়ে পাশের টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে ফুলদানি টা হাতে তুলে নিলো

-ইতর, অ মানুষ, নির্লজ্জ লুইচ্চার বংশধর। তোকে আজ কুচি কুচি করবো আমি।কতো বড় সাহস সেদিন আমাকে দৌড়ানি দিয়ে আমার বাড়ি পর্যন্ত চলে এসেছিস। আজ তোকে এমন শিক্ষা দেবো যে কোনো মেয়ে তো দূর নিজের বউকে ধরতেও বুক কেঁপে উঠবে তোর খাইস্টা হনুমান

বলেই হাত তুলে ফুলদানিটা ছুড়ে মারলো সামনের দিকে
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

#Humu_♥️