তুমি আমি দুজনে পর্ব-৪৩+৪৪

0
439

#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ৪৩

সময় বহমান, দেখতে দেখতে সপ্তাহ খানেক বাতাসের মতই উড়ে গেলো। এর মাঝে তিনটা ক্লাস টেস্ট হয়েছে তুরার। আজকে লাস্ট পরীক্ষা টা ছিলো। সেটা দিয়েই বাড়ি ফিরছে তুরা। পরপর কয়েক দিনের তীব্র বর্ষণের ছোঁয়ায় পরিবেশ জুড়ে আয়নার মতো প্রগাঢ় স্বচ্ছতা। শরতের আগমনের আগাম বার্তা জানাতে নীলাভ আকাশে পেঁজা তুলোর ন্যায় রাশি রাশি মেঘ জমেছে, নাম না যানা কিচিরমিচির পাখির কলরবমূখর সুরে প্রস্ফুটিত কলধ্বনি।
বরাবরের ন্যায় ব্যাগটা দু’হাতে জড়িয়ে রেখে হাঁটছে,

-তুরা?

হঠাৎ পেছন থেকে ক্লান্ত স্বরের মেয়েলী ডাক শুনলে তৎক্ষনাৎ পিছু ফিরে তাকালো, বিষন্ন ধরা চোখে অবসাদ মেলে তাকিয়ে আছে আগন্তুক তুরার দিকে, পরিপাটি করে পরিধেয় করা কাপড়টাতেও কুচকানোর ছাপ স্পষ্ট। শরতের হিমেল পরিবেশেও কপাল বেয়ে বহমান টুপটাপ ঘামের বিন্দু।

-কেমন আছিস মা?

বিস্ময় কাটিয়ে কিছু বলবে তার আগেই শাড়ির আঁচলে মুখের ঘাম মুছে নরম গলায় শুধালো, তুরার ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুচকালো। তা বিস্মিত হয়ে নাকি আবেগে তা বলা দায়। অন্তস্থলের বিব্রতবোধ দমিয়ে সামান্য হেসে বলল

-ভালো আছি চাচী,আপনি কেমন আছেন?

সেই আগের মতই নরম নিষ্পাপ বাচনভঙ্গি তুরার,না চাইতেও ভরে এলো। দু চোখ বয়ে জল গড়িয়ে পরলো গাল বেয়ে। অপরাধবোধ গ্লাণি,অনুতপ্ততায় জর্জরিত হয়ে মাথা নামিয়ে নিলো। বুক ভরে শ্বাস ফেলে বলল

-যেমন থাকার কথা ছিলো তেমনই আছি। নিজের পা’পের শাস্তি ভোগ করছি

বলেই আবারও শাড়ির আঁচল তুলে মুছে নিলেও চোখ ছাপিয়ে জল গড়িয়ে পরলো। তুরার দৃষ্টি বিব্রত,জড়িত। কোনো মতে ঠোঁট নাড়িয়ে বলল

-কি হয়েছে চাচী।আপনাকে এমন কেনো দেখাচ্ছে? বাড়িতে সব ঠিক আছে তো, নেহা কেমন আছে?

তুরার দুহাত ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো রাজিয়া বেগম। কান্নামিশ্রিত গলায় বললো

-তোর উপর অনেক অ’ন্যায় জু’লুম করেছিলাম রে মা, যে সময় তোর মাতৃস্নেহের দরকার ছিলো সেসময় তোকে লাঞ্চিত করে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম।তোর হকের জিনিস থেকেই তোকে বঞ্চিত করেছিলাম।আজ তার হিসাব পইপই করে নিচ্ছে আল্লাহ আমার।

তুরা হতবিহ্বলিত হয়ে কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে দু’হাতে আগলে ধরলো রাজিয়ার হাত। ব্যস্ত স্বরে অস্থিরচিত্তে বলল

-চাচী আপনি কাঁদছেন কেনো। কি হয়েছে? বাড়িতে সবাই ঠিক আছে তো?

বলে রাজিয়াকে ধরে রাস্তার পাশের বেঞ্চিতে বসালো।ব্যাগের চেইন খুলে পানির বোতল বের করে রাজিয়ার হাতে ধরিয়ে বলল

-চাচী পানি খান,শান্ত হোন প্লিজ। এভাবে কাঁদলে তো অসুস্থ হয়ে যাবেন

রাজিয়া আধো চোখে তাকালো তুরার চেহারা পানে,পানির বোতল টা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পানি গিলে দম ছাড়লো। আখিযুগল নিচের নিকে স্থির রেখে বলল

-তোর বাবা মারা যাওয়ার পরে তো তার ব্যবসার সব দ্বায়িত্ব তোর চাচার উপরেই এসেছিলো। এতদিন অন্যের দেওয়া টাকায় চলে ফিরে হুট করেই এতগুলো সম্পদের অধিকার পেয়ে লা’লসে গেছিলো তোর চাচা,সাথে আমিও। দুজন অর্থলো’ভে অন্ধ হয়ে তোর উপর অ বিচার তো করেছিই তার সাথে দিন দুনিয়াও প্রায় ভুলেই গেছিলাম

দম নিলো খানিকটা। শ্বাসক্রিয়া ধাতস্থ করে আবারও বলতে আরম্ভ করলো

-তুই ও বাড়ি থেকে চলে আসার পর বাড়ির আয় বরকত সবই বেরিয়ে গেছে। তোর চাচার হেয়ালি দিন দিন বেড়েই চলছিলো। ব্যবসা তো এমনিতেই বুঝতো না তেমন। তবুও সেদিকে মন না দিয়ে অসৎ লোকের পাল্লায় পরে ম’দ জু’য়া করে বেরিয়েছে।
এদিকে ব্যবসাতে দিনের পর দিন অবহেলার জন্যে চরম লোকসান হচ্ছিলো এমনকি আমাদের দৈনন্দিন প্রয়োজন গুলোর তাগিদে অনেক লোকের কাছে ধার দেনা কর‍তে হয়েছিলো। দিনের পর দিন পার হলেও মানুষের ঋণ শোধ করতে না পারায় তারা হুলস্থুল কাজ করে বসে। ব্যবসাও নিলামে উঠে গেলো। এক পর্যায়ে সব হারিয়ে পথে বসার জো, তখন পাশের বাড়ির চাচাকে বলে একটা দোকানের ব্যবস্থা করে ভাড়া নিলাম। সেটা দিয়ে যখন দু পয়সা আসতে শুরু হলো তখনই তোর চাচার অসুস্থতা ধরা পরলো। ডায়াবেটিস, প্রেসার, মাজার ব্যথায় তার চলাফেরার শক্তিও প্রায় শেষের দিকে। এখানে এসেছিলাম বড় আপার কাছে কিছু টাকা পয়সার তাগিদে। কিন্তু বলে না ধর্মের কল বাতাসে নড়ে,সেইরকম ই হয়েছে। তোর হকের জিনিস আত্মসাৎ করে যেমন অন্যায় করেছিলাম। তেমন যেই বোনকে দিনের পর দিন বেহিসেবী টাকা দিয়েছিলাম সেই বোনই দুয়ার থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে

দীর্ঘক্ষণের কথা শেষ করে হাফ ছাড়লো রাজিয়া। বিরতিহীন অশ্রুবিন্দু আবারও মুখ ঘষে মুছে নিলো।
বিষাদময় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো তুরা ফোস করে, যতই হোক চাচী তো মায়ের মতই তার এহেন দূর্দশায় নিজেকে কঠোর রাখার মতো পাষ’বিক কথাটা মাথায় ও আনতে পারলো না। এক হাত তুলে রাজিয়ার কাঁধে রেখে বলল

-কাঁদবেন না চাচী। বিপদ যখন আল্লাহ দিয়েছেন,ঠিক ও তিনিই করে দিবেন। দুহাত তুলে আল্লাহর দরবারে রহম চান তিনি কাওকে ফিরিয়ে দেননা

বলে রাজিয়ার মুখের পানে তাকিয়ে আবারও বলল

-আপনার চোখ মুখ তো দেবে গেছে, শরীরের একি হাল। সকাল থেকে কি কিছুই খাননি আপনি চাচী?

তুরার চিন্তাবৃত্ত ছড়ানো কথায় মুখ তুলে দুচোখ মেলে তাকালো রাজিয়া। ফর্সা গায়ের গড়নের উজ্জ্বলতা আরও বেড়েছে,কানের সোনার দুলগুলো ঝকঝক করছে,পরনের দামী জামা আর পরিপাটি বেশভূষা তুরার সৌন্দর্য আরও ত্বরান্বিত করেছে।
এই মেয়েটাকেই এক সময় কত না ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে তার জন্যে,অথচ মুখ দিয়ে টু শব্দ ও করেনি কখনো। আর আজ যখন ওর উপরেই অ’ন্যায় করা মানুষগুলোর শাস্তি পাবার পালা তখন উল্টো কেমন মায়া,আত্ততা দেখাচ্ছে! মেয়েটাকে সে কম কষ্ট দেয়নি। কিন্তু ওকে আল্লাহ ভালই রেখেছে। নিজের পা’পের শাস্তি তো এখন তাদের পাবার পালা।

-জানি তোর কাছে ক্ষমা চাইবার মুখ নেই আমার,তবুও বেহায়া হয়ে বলছি। আমায় ক্ষমা করে দিস মা, নিজ সন্তানের মতো আগলে রাখার মায়ের মতো ভালোবাসার সময়ে আমি নিষ্ঠু’রতার পরিচয় দিয়েছিলাম তারই ফল আজকের এমন অবস্থা, আমায় তুই ক্ষমা করে দিস রে

তুরা এক হাতে আগলে ধরে চোখের পানি মুছিয়ে দিলো রাজিয়ার। সমবেদী গলায় বলল

-যা হয় ভালোর জন্যেই হয়। আপনাদের উপর আমি কখনো রাগ করিনি না কোনো অভিযোগ পুষে রেখেছি। বরং আমিতো শুকরিয়া করবো। সেদিন যদি ইনসাফ আংকেলের কথায় রাজি না হতেন তাহলে হয়তো আজ আমি এতো সুন্দর অমায়িক একটা পরিবার আর এতগুলো ভালোবাসার মানুষ পেতাম নাহ। সৃষ্টিকর্তা আমায় খুব ভালো রেখেছেন চাচী। আপনারও দুঃসময় খুব জলদিই পার হয়ে যাবে দেখবেন। আল্লাহ কারো দোয়া ফিরিয়ে দেন না,সঠিক সময় মতো ঠিকই পূরণ করে দেন।

রাজিয়া কৃতজ্ঞতা ভরা নয়নে তাকালো তুরার দিকে, বুকটা যেনো হালকা লাগছে আজ। নিজের ভুল, অ’ন্যায় করা কাজটার ভারে এতদিন বুকে পাথর চেপে রেখেছিলো৷ তুরার কাছে ক্ষমা চেয়ে যেনো অনেকটা হালকা হলো। ভাগ্যিস আজ সৌভাগ্যক্রমে তুরার দেখা পেয়েছিলো। না তো সে বাসে উঠতেই তো যাচ্ছিলো। কথায় আছে আল্লাহ ছাড় দেয় কিন্তু ছেড়ে দেয়না, নিজের করা পা’প এখন নিজের গলায় ই শিং মাছের কাঁটার মতো বিঁধে আছে৷ এবার বুঝতে পারছে খারাপ সময়ের যন্ত্রণাটা ঠিক কতটা ভারি

•••

দুতালা ছিমছাম বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালো সাদমান। ফোন চেক করে নিলো আরও আরেকবার। সঠিক ঠিকানাতেই এসেছে। সময় তিনটা বেজে ছাপ্পান্ন মিনিট। পড়ানোর কথা ছিলো ঠিক চারটায়। গায়ের শার্ট টা হাতে টেনে ঠিক করে ভেতরে ঢুকলো। গেটের সামনে যেতেই দারোয়ান জিজ্ঞাসা করলো

-আপনি কে? কাকে চাই

সাদমান জড়তা সুলভ বলল

-আমি সাদমান। এ বাড়িতে আমাকে টিউশনির জন্য ডাকা হয়েছে। ওই যে,,কি যেনো নামটা?..

নিজেই বিড়বিড়িয়ে বলল শেষের কথাটা। মেয়েটার নামই তো মনে করতে পারছে না সাদমান। ফারিহা তিনবার বলেছিলো মেয়েটার নাম

-রিমঝিম?

দারোয়ানের কথায় প্রসস্থ হাসলো সাদমান। ললাট স্ফীত করে বলল

-হ্যাঁ হ্যাঁ, রিমঝিম। হ্যাঁ ওকেই পড়াতে এসেছি। এটা ওরই তো বাড়ি তাইনা?

খানিক বিব্রত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো সাদমান। দারোয়ান মৃদু হেসে সম্মানের সঙ্গে বলল

-জ্বি স্যার,এটা রিমঝিম আপাদেরই বাড়ি। আপনি যান। ভেতরে গিয়ে সিড়ি বেয়ে উঠলেই উনাদের ঘরের দরজা দেখতে পাবেন

সাদমান জবাবে আবারও প্রসস্থ হাসলো, দারোয়ানকে ধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে গেলো ভেতরের দিকে। সিড়ি বেয়ে উঠে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেলে চাপ দিলে মিনিট খানেকের মধ্যেই দরজা খুলে গেলো। সাদমান ভদ্রতা সুলভ হেসে বলল

-আসসালামু আলাইকুম, আমি সাদমান। ঝুমঝুমকে পড়াতে এসেছি

ভদ্রমহিলা সালামের উত্তর দিলেও পরক্ষণেই কিছু একটা ভেবে দ্বিধাদ্বন্দিত ভরা চেহারায় বলল

-কিন্তু এ বাড়িতে তো ঝুমঝুম নামের কেও নেই?

এবার সাদমান পরলো বিপাকে। এ বাড়িতে এই নামের কেও নেই,তাহলে কি ফারিহা ভুল ঠিকানা দিলো? আর দারোয়ান ও কি মিথ্যা বলল?

-এক মিনিট, তুমি রিমঝিমের কথা বলছ?

-হ্যাঁ হ্যাঁ, জ্বি রিমঝিমের কথা বলছি। সরি আসলে নামটা গুলিয়ে ফেলেছি

অপরাধীর ন্যায় লজ্জিত হয়ে বলল সাদমান। ভদ্রমহিলা বিস্তর হাসলো। সবিনয় গলায় বলল

-ওসব ব্যাপার নাহ। তুমি ভেতরে আসো।

সাদমান অপ্রস্তুত হেসে ভেতরে ঢুকলো। কি একটা লজ্জাজনক পরিস্থিতি!প্রথম দিন এসে ছাত্রীর নামই ভুল বলে ফেললো। গার্জিয়ান কি ভাববে কেমন স্যার যে স্টুডেন্টের নামই মনে রাখতে পারে না পড়াবে আর কি!

•••

অনবরত টিভির চ্যানেল চেঞ্জ করছে তুরা। কোনো কিছুই ভালো লাগছে নাহ। কিছুক্ষণ আগেই তহমিনা খাইয়ে দিয়ে গেছে। খাবার খাওয়ার সাথে সাথেই ঘুমাতে পারেনা তুরা। তাই ড্রয়িং রুমেই বসে আছে টিভির সামনে।
দুপুরে রাজিয়া বেগমকে নিজের সাথে করেই এনেছিলো তুরা, সে আসতে না চাইলেও এক প্রকার জোর করেই এনেছে। রাজিয়াকে দেখে শুরুতে তহমিনা মুখ কালো করে রাখলেও তুরার জোরাজুরিতে আর পারেনি। আর সবটা শোনার পরে তার মনটাও কেমন গলে গেছে। যতই হোক ইমতিয়াজ তারই ছোট ভাই।
তোফায়েল আর তহমিনার ছোট ইমতিয়াজ, তিন ভাই বোনে গলায় গলায় সম্পর্ক ছিলো। হুট করেই কি হলো ইমতিয়াজ টা কেমন পথচ্যুত হয়ে গেলো। তোফায়েল বেঁচে থাকতে সবটা সামলে রাখলেও ওর মৃত্যুর পর আরও এলোমেলো হয়ে গেছে সব।
তবে যাই হোক,মনে মনে খানিকটা দমলেও মুখে প্রকাশ করেনি তহমিনা। যতই হোক তুরাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসে সে,তাকে কষ্ট দেওয়া মানুষ গুলোকে এতো সহজে কিছুতেই ক্ষমা করবে না সে।
থপ করে রিমোট চেপে টিভি টা বন্ধ করে দিলো। ধীর পায়ে হেঁটে ঘরের ভেতরে আসলো। দরজা টা লাগিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো, কাজল টা তুলে আরও একটা দাগ দিলো। এ দিয়ে মোট নয়টা হলো। আহান তো বলেছিলো দশ দিনের ভেতরেও কাজ হয়ে যেতে পারে। নিভু নিভু আশা জাগলো মনে তুরার। রোজ রাতেই ওর মনে হয় এই বুঝি কালই চলে আসবে আহান।
আবারও তুরা ব’জ্জাত জল্লাদ বলে ঝগড়া করতে পারবে,আবারও আহান চেঁচিয়ে বলবে ‘তুরা তোমার আজাইরা বিড়াল টাকে সরাও’, আবারও তুরা ভূতের ভয়ের বাহানায় জায়গা করে নিবে আহানের বক্ষস্থলে।
নয়দিন ই তো হয়েছে, এ আর তেমন কি? তবে এই নয় দিন ই যথেষ্ট আহানের অনুপস্থিতিতে তুরার ভেতরটা ছার’খার করে দিতে,বুকের ভেতর শূন্যতায় খাঁ খাঁ করা অমানিশার অনুভূতি দিতে। সাজানো গোছানো আবেগ,আসক্তি গুলোকে ঝড়ের মতো এলোমেলো করে দিতে।
সেদিনের পর আর আহানের সাথে ফোনে কথা হয়নি। কথায় হয়নি আর,শুধু মাঝে একদিন মেসেজ করেছিলো। সেখানে স্পষ্ট করে লিখা ছিলো
“স্টাডির জন্য অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে পরেছি। রিসার্চের কাজে সারাদিন পার হয়ে যায়।সময় করে উঠতে পারছিনা। কবে ফিরবো তাও ঠিক করে বলতে পারছিনা। তুমি কিন্তু নিজের খেয়াল রেখো। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করবে লাফালাফি করবে নাহ,আর হ্যাঁ একা একা একদম কোত্থাও বেরবে নাহ”

তুরা নির্লিপ্ত চেয়ে ছিলো মেসেজটার দিকে কোনো পালটা জবাব ও পাঠাইনি। পাঠাবেও নাহ। থাকুক সে,,যেখানে খুশি থাকুক। যার সাথে ইচ্ছে থাকুক। আর কিছুই বলবে নাহ তুরা।

~~

দেখতে দেখতে আরও চারটা দিন পার হয়ে গেলো, তুরা এর মাঝে দুদিনের জন্য ও বাড়িতে গিয়ে আবারও চলে এসেছে,
মূলত রাইমা এসেছিলো বলেই গেছিলো তুরা। আবারও ফিরে এসেছে ফুফুর বাড়িতেই। ও বাড়িতে থাকলে নিজেকে সামলে রাখতে পারেনা। সবখানটা জুড়েই যেনো আহানের স্মৃতি আহানের সবটা মিশে আছে। রাত হলেই ফুঁপিয়ে কান্না আসে তুরার। ঘর জুড়ে আহানের শরীরের চিরচেনা ঘ্রাণটার মাদ’কময়তায় ভরা। তুরার ভীষণ ইচ্ছে করে ঘ্রাণ টা নাক ভরে নিতে,দু’হাতে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু তা তো পারে না,তখন খুব অসহায় লাগে নিজেকে ভীষণ কষ্ট হয়!
হাতে রাখা শার্ট টাতে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো, দুহাতে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরলো তুরা শার্টটা। সাদা রঙের শার্ট টা তুরা আসার সময় এনেছে ও বাড়ি থেকে, সাথে আহানের ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটাও। এক প্রকার লুকিয়েই এনেছে ছবি আর শার্টটা। বারান্দা থেকে ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পরলো। আনমনেই বলল

-দশদিন পরেই চলে আসবেন বলেছিলেন অথচ তেরো দিন হয়ে গেলো আপনার খোঁজ নেই। একটা ফোন অব্দি করলেন না। এতো নিষ্ঠুর পাষাণ কিভাবে আপনি। আমার কথা কি একটুও মনে পরে না আপনার?

ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো তুরা, সারাদিন সবার সামনে হেসে খেলে বেরালেও রাত হলেই বুকটার ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে, এতটা যন্ত্রণা কেনো হয় তার! স্বামী বলে? নাকি ভালোবাসে বলে?

এসব ভাবতে ভাবতেই চোখ লেগে এলো তুরার। পুরো ঘর জুড়ে অন্ধকার, বারান্দার লাইটের মৃদু আলো এসে পরছে জানালা দিয়ে, হুট করেই বারান্দায় ধপ করে কিছু পরার শব্দ হলেও ঘুম ভেঙে গেলো তুরার,হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো। ধাতস্থ হয়ে বারান্দার দিকে তাকাতেই দেখলো লাইটটা বন্ধ। একটু আগেও তো জ্বলছিলো লাইট টা,এখন নিভে গেলো কি করে? কারেন্ট ও তো যায়নি?
শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো তুরার,সেদিনের বিভৎস দৃশ্যটা আবারও ভেসে উঠলো স্মৃতির দৃশ্যপটে। শুকনো ঢোক গিলে গলার ঘাম মুছে নিলো।
আস্তে করে বিছানা থেকে পা টা নামালো। ভয়ে হাঁটুতেও শক্তি পাচ্ছে না দাঁড়ানোর। কোনো মতে অন্ধকারে হাতড়িয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলো, রাস্তার সোডিয়াম লাইটের আলোতে হালকা ঝাপসা বারান্দাটা স্পষ্টত বুঝা যাচ্ছে।
হুট করেই কালো একটা ছায়া দেখে লোমকূপ তিরতির করে উঠলো তুরার, ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ, ঝাপসা আলোতে স্পষ্ট একটা অবয়বের নড়াচড়া দেখতে পেরেছে সে। ব্যাপারটা আরেকটু কাছ থেকে দেখার অদম্য ইচ্ছে হলো, ভয়টাকে গোগ্রাসে গিলে সাবধানী পায়ে এগিয়ে গেলো, দরজাটা এক হাতে ধরে মাথা এগিয়ে কিছু দেখতে যাবে তার আগেই তুরাকে পেছন ঘুরিয়ে মুখ চেপে ধরলো শক্তপোক্ত একটা হাত।
ছটফট করতে শুরু করলো তুরা,বলিষ্ঠ হাতের চাপে দম বন্ধ হবার জো, গায়ের সর্বোচ্চ শক্তি লাগিয়েও এক চুল নড়াতে পারলো না হাতের অবস্থান,এবার তুরার ভীষণ রাগ হতে লাগলো।
পেয়েছে টা কি প্রত্যেকবার এসে তুরাকে হেনস্তা করবে? কিছুতেই না। ওইদিন তো রাস্তা বলে পালিয়েছে তুরা,আজ কিছুতেই হার মানবে না সে।
হাতের উপর সজোরে একটা কামড় বসিয়ে দিলো। মৃদু আর্তনাদ শোনা গেলো, হাতটা মুখ থেকে সামান্য আলগা হতেই তুরা সরে আসতে গেলে আবারও চেপে ধরলো। তুরা ছটফটিয়ে হাত পা আছড়ালো। এক হাতের কনুই দিয়ে পেছনের দিকে ভীষণ জোরে আঘাত করলেই অন্ধকারের মাঝে “আহ্” করে ছোট আর্তনাদ স্পষ্ট ঢুকলো তুরার কানে। হাতটা ছাড়িয়ে পাশের টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে ফুলদানি টা হাতে তুলে নিলো

-ইতর, অ মানুষ, নির্লজ্জ লুইচ্চার বংশধর। তোকে আজ কুচি কুচি করবো আমি।কতো বড় সাহস সেদিন আমাকে দৌড়ানি দিয়ে আমার বাড়ি পর্যন্ত চলে এসেছিস। আজ তোকে এমন শিক্ষা দেবো যে কোনো মেয়ে তো দূর নিজের বউকে ধরতেও বুক কেঁপে উঠবে তোর খাইস্টা হনুমান

বলেই হাত তুলে ফুলদানিটা ছুড়ে মারলো সামনের দিকে
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

#Humu_♥️
#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ৪৪

-একি আপনি!!

এক হাত মাথায় চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে আহান। তুরা ভূত দেখার মতো চমকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।অভিব্যক্তি হতবিহ্বলার শীর্ষে,দু তিনবার চোখের পলক ঝাপটালো। নাহ,স্বপ্ন তো দেখছে নাহ। তাহলে আহান? আহান এখানে! এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলে আহান চাপা স্বরে ধমকে বলল

-চেঁচামেচি বন্ধ করো ষ্টুপিড, জেগে যাবে তো সবাই!

তুরা চমকে উঠে ফুলদানি টা রেখে দিলো। শুকিয়ে আসা চোখ মুখে এগিয়ে আহানের কাছে গিয়ে বলল

-আপনার কি খুব লেগেছে?

আহান স্থুল দৃষ্টিতে তাকালো। এর জবাবে কি বলা উচিত তার? ফুলদানি দিয়ে মাথা ফা’টিয়ে এখন বলছে ‘আপনার কি খুব লেগেছে’। এক হাতে মাথা টা ডলে তুরার দিকে তাকিয়ে বলল

-সারারাত কি এখানেই দাঁড় করিয়ে রাখবে? নাকি চাচ্ছো আমি চলে যাবো?

মুখ ফুলিয়ে সরে দাঁড়ালো তুরা,এবার আহানের উপর আরও রাগ হচ্ছে। চোর হলে তো পি’টিয়ে রাগ কমানো যেত। নিজের স্বামী চোর টাকে কি করে পি’টাবে সে? এমনিতেই তো ফুলদানি দিয়ে একটা বারি বসিয়ে দিয়েছে কপাল বরাবর। যদিও খুব জোরে লাগেনি কিন্তু কমও তো লাগেনি। আহান ঘরের ভেতর এগিয়ে গেলে তুরা সুইচ টিপে বড় লাইট গুলো জ্বালিয়ে দিলো। আহান কপাল থেকে হাত সরাতেই বৃত্তাকার ফোলা জায়গা টা চক্ষুগোচর হলো তুরার। আঘাত টা বেশ জোরেই লেগেছে যার দরুন তাৎক্ষণিক ভাবেই লালচে চিহ্ন বসে গেছে।

-তোমাকে আমি ভোলা ভালা ভেবেছিলাম। তুমি তো সাংঘাতিক মেয়ে।আজ আমার মাথার খুলিই উড়িয়ে দিতে। শেষে কাল খবরের কাগজে বড় বড় হেডলাইন উঠতো ‘বউ কে সারপ্রাইজ দিতে এসে নিজেই নিহত হলো প্রফেসর ইরফান মাহমুদ আহান’

আহানের কথায় তুরার রাগ তিরতির করে বেড়ে উঠলো। এক তো লোকটা চোরের মতো এসে ভয় পাইয়ে দিয়েছে এখন আবার আবল তাবল বকছে। তুরা গাল ফুলিয়ে বলল

-তো রাত বিরেতে বারান্দায় চোরের মতো এসে দাঁড়িয়ে থাকলে কি আমি বরণডালা সাজিয়ে স্বাগতম করবো?

-করলে আপত্তি করতাম নাহ। আফটার অল স্বামী হই তোমার।

‘হুহ স্বামী হই তোমার ‘ বলে আহানকে মুখ ভেংচিয়ে এগিয়ে গেলো। দুহার মাজায় রেখে বলল

-আপনি না বিদেশ ছিলেন? এত রাত করে কিভাবে আসলেন? তাও আবার চোরের মতো বারান্দা টপকিয়েছেন কেনো?

আহান কপাল থেকে হাতটা নামিয়ে বিছানার কাছে এগিয়ে গিয়ে বসলো। ধুসর বর্ণের শার্টের উপরের একটা বোতাম খুলতে খুলতে বলল

-পুরো ২২ ঘণ্টা জার্নি করে নিউইয়র্ক থেকে ফিরে দেশে পা রেখে বাড়িতে না গিয়েই সোজা চলে আসলাম এখানে।এতো রাতে যাতে কেও টের না পায় তাই বারান্দা বেয়ে উঠলাম।কিন্তু বাঁদর টাকে দেখতে এসে নিজেই তকমা খেয়ে গেলাম। এইকয়দিনেই দস্যি হয়েছে পুরো

আড়চোখে চেয়ে বলল।পকেট থেকে ফোনটা বের করে খাটের উপর রাখলো। তুরা আহানের কপালের দিকে তাকালে আঘাতের দাগটা দেখে ভীষণ খারাপ লাগলো। শেষে কিনা তার জন্য এতটা ব্যথা পেতে হলো লোকটার। কিন্তু সে তো আর জেনে বুঝে করেনি। আহানের কথার মর্মার্থ না বুঝেই অপরাধীর মতো মুখ করে এগিয়ে আহানের পাশে বসে হাত তুলে আহানের কপালে দাগ হওয়া যায়গাটাতে নরম আঙুলে বুলিয়ে দিয়ে ধরা গলায় বলল

-খুব লেগেছে?

ক্লান্ত পরিশ্রান্ত নয়নে নিষ্পলক চেয়ে রইলো আহান তুরার আদুরে মুখ খানার দিকে। নিমিষেই সুদীর্ঘ সময়ের ক্লান্তি অবসাদ মিলিয়ে গেলো। বুকের ভেতর শীতলতায় ছেয়ে গেলো। এই মুখটা দেখবার জন্যেই তো এসেছে সে,সুদূর পথ পারি দিয়ে, বিশ্রাম বা শরীরের পরোয়া না করে বাড়ির কাওকে না জানিয়েই এতো রাতে সোজা এয়ারপোর্ট থেকে এখানে এসেছে।
মৃদু হাসলো আহান,রুক্ষ শুষ্ক পুরু ঠোঁট সামান্য প্রসারিত হলো। কপালের উপর অবস্থানরত তুরার ছোট্ট হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় ধরে বলল

-এখন আর লাগছে নাহ! তবে তুমি চাইলে পুরোপুরি সারিয়ে দিতে পারো ব্যাথাটা

তুরা কৌতুহলী হয়ে চাইলো। সে ব্যথা সারিয়ে দিতে পারবে? আগ্রহী স্বরে ঝিলিক দিয়ে বলল

-সত্যি? কি করলে সেরে যাবে বলুন। আমি এক্ষুণি সারিয়ে দেবো

মুঠোতে পুরে রাখা হাতের আঙুল নিজের বলিষ্ঠ হাতের আঙুলের ভাঁজে চেপে ধরলো আহান। ধীমি গলায় সামান্য ফিসফিসানির মতো করে বলল

-তোমার নরম ঠোঁট দুটি যদি এখানে ছুঁয়ে দাও তাইলেই সব ব্যাথা সেরে যাবে

কথার সাথে গভীর চোখের চাহনি দিয়ে তুরার ঠোঁটের দিকে ইশারা করলো আহান, বিদ্যুতের ঝলকানির ন্যায় ঝিলিক দিয়ে উঠলো তুরার সারা শরীর। আহানের কথায় যেনো কোনো মা’দকতা মেশানো ছিলো যা তুরার শরীরে নে’শার মতো অসাড়তা ধরিয়ে দিলো। চট করে ঢোক গিলল বার দুয়েক, কপট রাগ দেখিয়ে বলল

-ছি ছি, মুখের কি ভাষা। বিদেশ থেকে অসভ্যতা শিখে এসেছে

তুরার বলার ধরনে আহান হাসলো। প্রত্যুত্তরে বলল

-সে আমার ইচ্ছে, আমি চাইলে শুধু অসভ্যতা কেনো আরও অনেক কিছুই করতে পারি

তুরা চোখ মুখ মুদে ফেলল। কিসব কথাবার্তার ছিরিছাঁদ। নাক ছিটকে বলল

-আপনি অত্যন্ত অসভ্য প্রজাতির একটা লোক। কথায় বলা উচিত না আপনার সাথে

বলেই উঠে দাঁড়ালো। আহানকে অপেক্ষা করতে বলে দরজার দিকে পা বাড়ালো, দরজা খুলতেই ড্রয়িং রুমের অন্ধকারাচ্ছন্ন পিনপতন নীরবতার পরিবেশ টায় জহুরি দৃষ্টিতে চোখ বুলালো। চারপাশ টা মানবশূণ্য। অবশ্য হবেই বা না কেনো। মামনী আর মাহিদ অনেক আগেই তো ঘুমিয়ে পরেছে। রাত ও তো কম হলো না। ঘড়ির কাটায় একটা বেজেছ মিনিট বিশেক আগেই।

অন্ধকারে ড্রয়িং রুমে চুপি চুপি সাবধানী পদক্ষেপ ফেলে এগিয়ে ফ্রিজ খুলে কতগুলো আইস কিউব বের করে নিলো তুরা। ছোট একটা বাটিতে করে আইস কিউব গুলো নিয়ে আবারও চুপি চুপি পায়ে ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিলো।বুকের ভেতর এখনো লাফালাফি করছে,যদি মামনী বা ইয়াজ ভাই দেখে ফেলতো কোনোভাবে!

এগিয়ে এসে হাতের বাটিটা রেখে নিজের ওড়নার কাপড়ে একটা বরফের টুকরো পেঁচিয়ে আলতো স্পর্শে চেপে ধরলো আহানের কপালটাতে। ব্যথায় টনটনে জায়গাটাতে বরফের অত্যাধিক শীতল স্পর্শে নড়ে উঠলো আহান, ব্যথায় চোখ খিঁচিয়ে নিলো। তুরার ভীষণ খারাপ লাগলো আহানের এমন অবস্থা দেখে। অনুতপ্ততায় ভেতর টা মুছড়ে উঠলো। তুরার ছোট করে রাখা শুকনো মুখের দিকে অপলক তাকালো আহান, তুরার নির্বিন্ন চেহারা দেখে তার কারণ টাও আন্দাজ করতে অসুবিধা হলো নাহ। ফট করে তুরার কোমর চেপে ধরে টেনে নিলো কাছে,তুরা হকচকিয়ে উঠে অপ্রস্তুত গলায় বলল

-ক্ কি করছেন? ছাড়ুন

-ছাড়ার জন্যে তো আর ধরিনি। চুপচাপ নিজের কাজ করো

তুরা বরফ লাগানোতে মনোযোগ দিতে গেলেও পারলো নাহ। মোচড়ামুচড়ি করতে গেলে বরফ গলার পানি ছিটে পরলো আহানের শার্টে। ভিজে গেলো অর্ধেকাংশ, তবুও আহান ওভাবেই স্থির রইলো।
পুরুষালি স্পর্শ কোমরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত থাকায় নিঃসাড় হয়ে আসছে শরীর, খাটে বসা অবস্থায় আহানের সামনে দাঁড়ানোই আহানের মাথার উচ্চতা ঠিক তুরার পেট বরাবর। গায়ে ভ্রম ধরানো অতি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নিঃশ্বাসের ধার তীরের মতো বিঁধে যাচ্ছে তুরার পেট,নাভী আর তার আশেপাশে। কাঁপা কাঁপা হাতে কোনোমতে বরফ লাগিয়ে ছিটকে সরে এলো।
বিপরীতে মুখ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লো নিজেকে শান্ত করার প্রচেষ্টায়। হাতের বাটিটা টেবিলের উপরে রেখে পেছনে ঘুরতেই চোখ ছানাবড়া হওয়ার উপক্রম, দু’হাতে চোখ ঢেকে চরচরে গলায় বলল

-এই এই আপনি শার্ট খুলছেন কেনো

আহান শার্টের বোতামে হাত চালিয়ে আড়চোখে তাকালো তুরার দিকে। মন্থর গলায় বলল

-ভিজে গেছে শার্ট

-আ আপনি প্লিজ শার্ট খুলবেন না,ওভাবেই থাকুন

আহান এখনো ঘাড় কাত করে তাকিয়ে আছে তুরার দিকে। বাকা হেসে এগিয়ে গেলো তুরার সামনে। কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে বলল

-হাত সরাও,তাকাও আমার দিকে

তবুও তুরা দু’হাত চোখের উপর ঠেসে ধরেই রইলো। আহান ওর হাত দুটো তুলে চোখ থেকে তুরার হাত সরিয়ে দিলো। তুরা চোখ খিঁচিয়ে বন্ধ করে রাখলে আহান আবারও একই গলায় বলল

-আমার দিকে তাকাও তুরা

তুরা ঘাড় নামিয়ে নিলো। কিছুতেই তাকানো যাবে না,তা দেখে আহান ফিচেল গলায় বলল

-আমি শার্ট খুললেই উল্টা পালটা চিনতা করো কেনো। দিনদিন শেইমলেস হচ্ছো তুরা রাণী

ফট করে চোখ খুলে তাকালো তুরা, কড়া চাহনি দিয়ে বলল

-উলটা পালটা চিনতা মানে?

-মানে এই যে আমাকে এভাবে শার্টলেস দেখলে তোমার মনে ভুলভাল চিন্তাভাবনা আসে,নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারো না। তাই তো চোখ ঢেকে নাও

আহানের কথার প্রেক্ষিতে কিছুই মুখে আসলো না তুরার,আমতা-আমতা করে চুপ করেই রইলো। তুরার অপ্রস্তুত অবস্থা দেখে আহান ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকে দূরে সরে গেলো। আধখোলা বোতাম গুলো ছড়িয়ে শার্ট টা পুরোপুরি খুলে ফেলল। লজ্জায় অপ্রতিভতায় তুরার গাল লাল হয়ে আসলো। চোখ তুলে তাকাতেও পারছে। নাহ। দু’হাতে জামা খামচে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। আহান তুরার লজ্জা,বিমূঢ়তা আরও বাড়িয়ে বলল

-ওখানে দাঁড়িয়ে আমাকে স্ক্যান বন্ধ করো। আমারও তো লজ্জা শরম আছে নাকি। এভাবে নিশুতি রাতে যদি একটা মেয়ে এভাবে বেহায়াদের মতো তাকিয়ে চোখ দিয়ে গিলে খাই তাহলে আমার মতো নিরীহ পুরুষের কি করা উচিত!

তুরা পারছে না মাটি ফাঁক করে ঢুকে পরতে। লোকটা এতো ব’জ্জাত। শুকিয়ে আসা ঠোঁট জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে কড়া গলায় বলল

-ছিহ্, বিদেশের হাওয়া গায়ে লেগেই এই অবস্থা আপনার। যা নয় তা বলে যাচ্ছেন

আহান বিছানায় আধশোয়া হয়ে বলল

-বিদেশের হাওয়া ইচ্ছে করেই গায়ে লাগিয়েছি। বউ তো বাচ্চা,আমিও ভদ্র হয়ে থাকলে বংশ এগোবে কি করে, তাই একটু আকটু অসভ্য হলে ক্ষতি নেই!

-আমি বাচ্চা? কোনদিক থেকে বাচ্চা মনে হয় আমাকে?

আহান চোখ ছোট করে তুরার মাথা থেকে পা পর্যন্ত চোখ বুলালো। তুরা আহানের এরূপ কাজে বেশ অস্বস্তিতে পরলো। চোখ মুখ কুচকে বলল

-এভাবে তাকাচ্ছেন কেনো?

-দেখছি

-কি?

-দেখতে পিচ্চি হলেও একেবারেও ছোট না,ঠিকঠাক ই আছে সব৷ শুধু বুদ্ধির বিকাশ দরকার

আহানের লাগামহীন বেলাজ কথাবার্তায় তুরার হৃদযন্ত্র থেমে গেলো। খামচে ধরে রাখা জামাটাও হাতের করপুট ঢিলে হয়ে খুলে গেলো। চোখ বন্ধ করে থ মেরে দাঁড়িয়ে রইলো, খানিক সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্ত করে এগিয়ে আসলো। সাদা রঙের একটা শার্ট আহানের সামনে ধরে বলল

-এটা পরে নিন।

আহান ভ্রু কুচকে তাকালো। এটা তো তারই শার্ট তুরার কাছে কি করে? এ বাড়িতে তো তার কোনো জিনিসই থাকার কথা নাহ!

-এটা এখানে আসলো কি করে?

-এতো জানতে হবে নাহ। এভাবে নির্লজ্জের মতো উদাম গায়ে না থেকে এটা পরুন আর আমাকে উদ্ধার করুন

আহান আর প্রত্যুত্তর করলো না। তুরা এগিয়ে গিয়ে লাইট বন্ধ করে দিলো, আহানকে খাবার কথা বললেও সে নাকচ করে দিলো। তুরা নিজেও জানে এতো রাত করে আহান কখনও খাবে নাহ। তাই আর কথা না বাড়িয়ে এসে শুয়ে পরলো আহানের পাশে। বালিশ ঠিক করে মাথা রাখতে গেলেই আহান এক টানে নিজের বুকের উপর ফেলল তুরাকে।

-কি করছেন,ঘুমাতেও কি দিবেন নাহ

-হুসস,তোমার কি মনে হয় রাত বিরেতে চোরের মতো মই বাধিয়ে বারান্দা টপকে এসেছি তোমাকে দুই হাত দূরে শুয়ে থাকার জন্যে।

-কিন্তু..

বলেই নড়াচড়া করে আহানকে সড়িয়ে দিতে উদ্যত হলেই আহান আরও প্রগাঢ় ভাবে চেপে ধরলো তুরাকে বুকের উপর,,নেশাক্ত গলায় বলল

-উহুম,একচুল নড়বে না। নাহলে কিন্তু আমার এক মিনিট ও লাগবে না সংযমচ্যুত হতে। কিন্তু আমি তা চাইছি না এখন। তাই চুপচাপ ঘুমাও।

স্তব্ধ হয়ে গেলো তুরার সমস্ত বদন,শরীরে মৃদু বল টুকুও পেলো নাহ। চুপ করে আহানের বুকে মুখ গুঁজে পরে রইলো। হয়তো মনে মনে সেও চাচ্ছিলো আহানের এই আদরটুকু!

•••••

ভোরের আলো ফুটতেই ঘুম ছুটে গেলো তুরার। খানিক এপাশ ওপাশ করে আহানের কথাটা মনে হতেই ধপ করে চোখ খুলে তাকালো। কিন্তু কই! আহানতো কোথাও নেই? কিন্তু কাল রাতে যে সে..তাহলে কি স্বপ্ন দেখছিলো সে এতকিছু? নিমিষেই ভারাক্রান্ত হয়ে মনটা বিষিয়ে গেলো। প্রচন্ড মন খারাপ করে ঘাড় ফেরাতেই বালিশের উপর ছোট সাদা কাগজের একটা কিছু ভাঁজ করা অবস্থায় দেখতে পেলো। তড়িৎ গতিতে কাগজটা হাতে নিয়ে খুলতেই গোটা গোটা অক্ষরের লেখা দেখতে পেলো

“গুড মর্ণিং তুরা রাণী, আপনি উঠার আগেই চলে যাচ্ছি। সারারাত আমার বুকটা কব্জা করে ঘুমিয়ে সকালেও জেঁকে ধরেই ছিলে। ঘুমন্ত মুখটা দেখে আর ডাকার ইচ্ছে হলো না। তাই না বলেই চলে যাচ্ছি। আর এবার থেকে আমার শাশুড়ীকে বলবা নিচতলায় থাকতে এভাবে বারান্দা টপকে উঠতে গিয়ে কোনদিন পরে হাড় ভাঙবে তো!”

ফিক করে হেসে দিলো তুরা। স্বপ্ন দেখেনি সে,তার মাস্টার মশাই সত্যিই এসেছে। মাঝরাতে চোরের মতো এসে আবার ভোরের আগেই পালিয়েছে। সশব্দে হেসে উঠলো তুরা।
তহমিনার ডাক শুনেই খাট থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে নিলো। নাস্তা সেরে রেডি হয়ে ভার্সিটির উদ্দেশে বেরিয়ে পরলো।
যথাসময়ে ভার্সিটি এসে ক্লাসে ঢুকলো হাসি মুখে। আজ সাদমান ও এসেছে। তবে ওদের দুজনের মুখভঙ্গি দেখে ভ্রু কুচকালো তুরা। কি ব্যাপার। সবসময়ই কোনো কিছু নিয়ে হাঙ্গামা করতে থাকা দুটো আজ দুদিকে ফিরে আছে কেনো?
ললাটে ভাঁজ ফেলে এগিয়ে গেলো। তুরা যেতেই ফারিহা সরে গিয়ে মাঝখানে জায়গা করে দিলো। ব্যাগ রেখে বসে সোজাসাপ্টা ভাবে জিজ্ঞাসা করলো তুরা

-কি ব্যাপার বলতো।দুজন এমন বাংলার পাঁচ করেছিস কেনো মুখ?

তুরার কথায় একবার আড়চোখে তাকালো সাদমান। কিন্তু জবাব দিলো নাহ। তুরা বেশ অবাক হলো,কেসটা জটিল ঠেকছে! কনুই দিয়ে ফারিহাকে গুঁতো দিয়ে বলল

-এই কি হয়েছে বল। দুটিতে এমম ভেটকাইছিস কেনো?

-সেটা আমাকে না জিজ্ঞাসা করে ওই ভেজাল টারে জিজ্ঞাসা কর। বেটা জলজ্যান্ত ভেজাল। সব কাজেই ভেজাল লাগায়

খটমট করে বলল ফারিহা। তুরা বেশ হতম্বিত হলো। ব্যাপার কি! দুজন আবার কি ঝামেলা পাকিয়েছে। সাদমানকে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই ও নিজেই বলল

-আমি ভেজাল নই, তুই নিজে জালিয়াতি। তুই মানেই জাল

-এই দেখ একদম আমার নামে আজেবাজে বকবি না। এই জন্যেই বলে বাঙালির ভালো করতে নেই

ক্ষিপ্ত স্বরে বলল ফারিহা,প্রত্যুত্তরে সাদমান ও তেজিয়ান গলায় বলল

-কে বলেছিলো ভালো করতে, মিথ্যা বলে ভালো করার কোনো দরকারই ছিলো না

-আমি মিথ্যা বলেছি? আমি মিথ্যাবাদী?

-থামমম! দুজনই থাম,শান্ত হ। কি নিয়ে এতো ঝামেলা করছিস দুজনে?

তুরার ধমকে শান্ত হলো দুজন। সাদমান চুপ করে গেলে ফারিহা গাল ফুলিয়ে বলল

-ওর আম্মু অসুস্থ থাকায় ও পুরো পাঁচদিম টিউশনি করাতে যেতে পারেনি বলে ওই স্টুডেন্ট এর মা ওকে বাদ দিয়ে দিয়েছে। এমন অবস্থায় আমি ওকে একটা টিউশনি জোগাড় করে দিলাম। কই আমাকে ধন্যবাদ বলবে তা না উল্টো আমাকেই কথা শোনাচ্ছে।

ফারিহার কথা পুরোটা শুনে তুরা সাদমানকে কিছু জিজ্ঞাসা করবে তার আগেই ও নিজে থেকে বলে উঠলো

-কিন্ত ও আমাকে বলেনি যে স্টুডেন্ট ওর নিজেরই বোন।আমি কাল পড়াতে গিয়ে দেখি ও স্টুডেন্ট এর বাসায় বসে আছে। পরে এসে জিজ্ঞাসা করলে বলল যে ঝুমঝুম ওরই চাচাতো বোন

গাল ফুলিয়ে বলল সাদমান। ফারিহা কটমট করে বলল

-ঝুমঝুম না রিমঝিম। কে কার বোন কোনটা কার বাড়ি সে নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে স্টুডেন্ট এর নাম মনে রাখ তাতেও লাভ।

বলেই মুখ ভেংচালো ফারিহা। এবার বুঝলো তুরা সবটা। ফারিহা সাহায্য করতে গিয়ে ওর নিজের চাচাতো বোনকে পড়াতেই সাদমান কে ঠিক করেছে, অন্যদিকে সাদমানের মতো ব্যক্তিত্বের মানুষ নিজের বান্ধবীর বাড়িতে টিউশনি করাবে এটাও তার কাছে লজ্জাজনক। দুজনের কথা শুনে তুরা বলল

-তো এখন তুমি কি চাও সাদমান। তুমিকি রিমঝিমকে পড়াতে চাও না?

-অন্য কোনো স্টুডেন্ট হলে আমার আপত্তি ছিলো না,কিন্তু,,এভাবে..

তুরা বুঝতে পারছে সাদমানের অস্বস্তিটার ব্যাপারে। কিন্তু তবুও সাদমানকে শান্তনা দিয়ে বলল

-দেখো টিউশনিটা তো তোমার দরকার। আর ওর বোন তো কি হয়েছে,স্টুডেন্ট তো স্টুডেন্ট ই হয়৷ আর ও তো তোমাকে জালাবেও না ওই সময়টাতে। তুমি অন্যসব স্টুডেন্টসদের মতই রিমঝিম কে পড়িয়ে চলে এসো

সাদমান ভাবুক মুখ করলেই ফারিহা ফটাফট করে বলল

-ওর ইচ্ছে না থাকলেও পড়াতেই হবে। ওর জন্য আগের টিচার টাকে ভূতের ভয় দেখিয়ে বাদ দিয়েছি আমি আর রিম,এখন ও না পড়ালে ওকে বস্তায় ভরে তুলে নিয়ে যাবো

-দেখলে? শুনেছো কথার ধরন? ও যেমন ওর বোন তার চেয়েও এক কাঠি উপরে,তাহলে ভাবো আমার কি অবস্থা হবে দুটো ডাকাতের সাথে একসাথে ডিল করতে হলে!

ওদের কথা শুনে তুরা কি বলবে ভেবে পাইনা,তুরা আর কি বোঝাবে ওদের আবারও শুরু করেছে ননস্টপ ঝগড়া!
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

#Humu_♥️