#তুমি_আসবে_বলে
#হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ২৫
-ভাই হাটতে হাটতে আমার পায়ের কচুরি হয়ে গেছে, চল ফিরে যাই
-কিরে,তুই বলে সেই ঘুরা ঘুরবি,ঘুইরা এক্কেরে দুনিয়াডাই ঘুরাই দিবি , এইটুকুতেই দম শেষ
রাফাতের কথার প্রেক্ষিতে নিবিড় খোঁচা দিয়ে বললো।
-থাম ইয়ার,আমার পা ও ব্যাথা হয়ে গেছে,আজকে আর হাটঁতে পারবো না প্লিজ
-লেও,আরেকজন আইছে, নরম বিবি খরম পায়ে। তো তুমাকে কি কোলে নিতে হবে চান্দু, আক্কাইসা রে ডাকুম নাকি??
বলেই হাহা করে হেসে উঠলো সবাই। আরশির এহেন কথায় আরাব আর ধ্রুব ও মিটমিটিয়ে হাসছে। শিমু মুখটা পেঁচার মতো করে বলে
-তোদের যদি হাটঁতে হয় হাট দৌড়াদৌড়ি করতে ইচ্ছে করলে তাও কর, আমি পারছি নাহ আর
-তুই এক কাজ কর ওই যে খাদ দেখছিস ওখানে গিয়ে ঝা’প দে, স্কাই রাইডিং ও হবে আর তোর আক্কাইসার ও দেখা পেয়ে যাবি। তোর না খুব শখ আক্কাইসারে দেখবার
বলে আবারও হো হো করে হেসে উঠলো
-চল তো,এই বলদির কথা শুনলে আমাগো ঘুরাই হবে নাহ,এখনো বাগানের ওই পাশটা দেখা বাকি।
বলে আদ্রিশ হাটা ধরলো, পেছন পেছন নিবিড় আরশি ও গেলো৷ রাফাত উপায় না পেরে ঢুলতে ঢুলতে ওউ হাটা ধরলো।
শিমু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আশপাশ দেখে একটা কাঠের গুড়ির উপর বসলো।
ওর পায়ে ব্যাথা শুরু হয়েছে, হাটার অভ্যাস না থাকায় বেশ হাঁফিয়ে গেছে।
-তোমার কি কষ্ট হচ্ছে, রিসোর্টে ফিরে যেতে চাও?
পুরুষালি গলায় পাশ ফিরে দেখে বেশ অপ্রস্তুত বোধ করে শিমু, বেশ জড়তা নিয়েই উত্তর দেয়
-আরে না না,আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে নাহ। আসলে হাটার অভ্যাস খুব একটা নেই তাই আরকি
-আচ্ছা,তা আমি তোমার পাশে কিছুক্ষণ বসলে কি খুব সমস্যা হবে?
ধ্রুবের প্রশ্নে কিছুক্ষণ হ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকে শিমু,তারপর ঘাড় নাড়িয়ে না সূচক সম্মতি দেয়।
সম্মতি পেয়ে ধ্রুব গাল প্রসারিত করে হেসে বসে বলে
-আসলে আমারও খুব একটা হাটাহাটি করার অভ্যেস নেই,তাই আমারো ক্লান্ত লাগছে।
-ওহহ
বলেই ছোট্ট জবাব দেয় শিমু। অপেক্ষা না করেই ধ্রুব প্রশ্ন করলো
-আচ্ছা তোমাকে ওরা আক্কাইসা না কি তার বউ কেনো বলে,মানে এমন নামের কোনো কাহিনি আছে নাকি
ধ্রুবর এমন প্রশ্নে ত্যানত্যান করে উঠলো শিমু। গাল ফুলিয়ে বললো
-আরে আমিই তো জানি নাহ,ওরা শুধু শুধুই আমায় ওসব আক্কাস না কি সেসবের বউ বলে, আমিতো এর মানেও জানি নাহ
ধ্রুব বেশ মজা পায় শিমুর কথায়,কিন্তু তবুও মুখ খানা বেশ গম্ভির রেখে বলে
-তাইলে তো বেশ অন্যায়, তা এইরকম অদ্ভুত নাম টা এক্সাক্টলি কে দিলো বলো তো
-কে আবার,ওই যে আমাদের মধ্যমণি গণ্যমান্য আফু ওই তো দিয়েছে এইরকম বাজে নামটা,আর সেই থেকে রাস্তা ঘাট কোথাও বাদ নেই সব জাগায় ওরা এই নাম নিয়ে আমায় যা তা বলে।
-কি বলো পালক? পালক এমন একটা নাম দিয়েছে? ওকে তো আমি বেশ শান্ত শিষ্ট ভেবেছিলাম।
-কে পালক? হাহা,,হাসালেন ওকে চিনেন নি এখনো, আমাদের প্রত্যেকের যেইসব ইউনিক নাম গুলো শুনছেন এইসব তার ই দেওয়া।
-বাহ,তাই নাকি..
আর কিছু বলার আগেই ঝনঝনিয়ে বেজে উঠলো পকেটে রাখা ফোনটা।
“এক মিনিট ”
বলেই ফোনটা নিয়ে সাইডে গিয়ে কথা বলতে লাগলো ধ্রুব। শিমু আড়চোখে চুপচাপ চেয়ে আছে, সামনের লম্বা চওড়া ছেলেটার দিকে। বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলে লোকটা, কেও না চাইলেও কথা বলতে বাধ্য। কালো গভীর চোখ দু’টোয় এক প্রকার মায়া আছে, এক কথায় নিঃসন্দেহে তাকে শ্যামসুন্দর বলা যায়, শ্যামলা গড়নের মানুষের চেহারা এতোটা আকর্ষণীয় সচরাচর লাগেনাহ। কথা শেষ করেই এসে দাড়ালো শিমুর পাশে,বরাবরের মতোই চমৎকার হাসি টা দিয়ে বললো
-তোমার ফ্রেন্ড দের ও দৌড় ফুরিয়েছে, এখন সবাই রিসোর্টে ফেরার জন্য বাইনা ধরেছে,চলো যাওয়া যাক
ছোট্ট করে হুম বলে শিমু হাটা শুরু করলো ধ্রুবের পিছু পিছু, খয়েরী রঙের শার্টে আবৃত হাত টা পকেটে গুজে হাটা টা দেখতে বেশ লাগছে ওর
~
-ভাই চল নাহ, আমারতো ক্ষুধা লেগেছে
-থাম থাম। শিমু আর ধ্রুব ভাই আসুক। পালক কেও তো দেখছি নাহ,ও তো এদিকটাই ই আসছিলো
নিবিড়ের কথায় সকলে বেশ তৎপর হলো,আসলেই তো অনেক্ষণ ধরেই তো আফুকে দেখা যাচ্ছে নাহ,ওদের পেছনেই তো আসছিলো
রাফাত আর নিবিড়ের কথার মাঝেই ধ্রুব এসে উপস্থিত হলো। ধ্রুবকে দেখে রাফাত প্রশ্ন করে
-ধ্রুব ভাই পালক কোথায়।
-সেকি আমাদের সাথেই তো ছিলো, কোথায় গেলো।
এবার পেছন থেকে আরাব বলে
-মেঘালয় কেও তো দেখছি নাহ অনেকক্ষণ। ওরা কি একসাথেই আছে?
আরাবের কথায় শিমু আরশি নিবিড় সবাই একে অপরের দিকে তাকালো, আদ্রিশ মিটিমিটি হেসেই দিলো এবার। ওরা যা ভাবছে তাহলে কি তাই? দুটো মিলে আলাদা ঘুরছে?
-রাফাত দাঁড়া আমি আসছি
পেছন থেকে কারো ডাকে ঘুরে তাকায় সকলে, পালক বাগানের কোণার দিকটা থেকে দৌড়ে আসছে,ওকে দেখে নিবিড় এগিয়ে গেলো
-হ্যাঁ এবার চল।
হাফাতে হাফাতে বললো পালক।
-আরে আস্তে ধীরে, দম নে আগে। কই ছিলি বল তো পেছন থেকে হুট করেই উধাও হয়ে গেলি
রাফাতের কথায়,টিপটিপ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পালক উত্তর দেয়
-আসলে আমি ওই পাহাড়ের কোণার দিকটার বাগান দেখতে গেছিলাম খুব সুন্দর জায়গা টা
-ওহ,তা বলে যাবি তো
নিবিড়ের কথা শেষ হতেই পাশ থেকে রাফাত প্রশ্ন করে
-একি আফু? তোর সারা জামায় এমন ময়লা লাগলো কি করে, তুই কি গড়াগড়ি খেয়েছিস রাস্তায়।
রাফাতের এমন প্রশ্নে পালক মুখ কুচকে তাকালো,এই বলদ টাকে মাঝে মধ্যে মনে চাই চুলগুলো টেনে টেনে ছি’ড়ে দেয়,আরে গড়াগড়ি খাবে কেনো আজব ও কি বাচ্চা নাকি।
মুখ খুলে কিছু একটা বলতে নিলেই, পেছন থেকে ভরাট গলায় আগেই উত্তর দিলো
-গড়াগড়ি খাওয়া টাও অস্বাভাবিক নাহ, রাস্তা ঘাটে এমন ধুপধাপ পরতে পারলে গড়াতেও দেরি নাই।
পেছন ঘুরে চেহারা টা দেখতেই তড়াৎ বেগে ঘাড় ঘুরিয়ে নিলাম আমি, লোকটার দিকে ভুলেও তাকাবো নাহ,ভীষণ.. ভীষণ বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে লোকটা,কিছুতেই আর উনার সামনে আসা যাবে নাহ।
-মানে? রাস্তা ঘাটে কে পরে যায়,আর ভাই তুমি কোথায় ছিলে এতোক্ষণ?
-কে পরবে আবার তোর বান্ধবীকে হাটঁতে শেখা আগে, এভাবে সবখানে ধুপধাপ পরে কোনদিন হাত পা ভাঙ্গবে।যাই হোক,দুপুর হয়ে গেছে অলরেডি, রিসোর্টে ফেরা যাক
রাফাতের প্রশ্নের উত্তর দিয়েই গটগট হাটাঁ ধরলো রাস্তার দিকে।
মেঘের পেছন পেছন সবাই আস্তে আস্তে চলা শুরু করলো,আমি একেবারে পেছনে হাটছি। লোকটা শুধু বেহায়া নয়,চরম খ’বিশ। আমি কি না হাটঁতে জানি নাহ? আবার বলছে আমি নাকি রাস্তায় গড়াগড়ি ও দিতে পারি,পরে গিয়ে হাত পা ও ভাঙ্গতে পারি, আমিতো পারিনাহ ওই সিরিয়াস চৌধুরীর মুখটা ভে’ঙ্গে দিতে। প্রচন্ড অসভ্য লোকটা।
~
হাতে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির ঘসা আর চোখের সামনে এমন অবাধ্য দৃষ্টিতে আমার ভেতরের তোলপাড় বেড়েই চলেছে। লোকটার উষ্ণ শ্বাসের তপ্ততায় হাত থেকে সারা বদন ঝলসে যাচ্ছে আমার। শক্ত হাতের মুঠোয় বন্দি হাতটা সরানোর বিন্দু মাত্র শক্তি পাচ্ছি নাহ।
আমার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই, আমার হাতটা মুখের কাছে নিয়ে ওষ্ঠদ্বয়ের আলতো ছোঁয়া মেখে দিলো আমার হাতের উল্টোপাশে।
ধপ করে চোখ দু’টো বন্ধ করে নিলাম। ঘন ঘন শ্বাস নাসারন্ধ্র ছাড়িয়ে ওষ্ঠফাক হতে ঝড়ের বেগে উঠানামা করছে। মেঘ এমন অভাবনীয় কাজ করবেন ভাবতেও পারিনি।
হাত টা এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাড়াঁলাম। দ্বিধাদ্বন্দে বুদ হয়ে কোনো রকম এক পলক তাকালাম বেহায়া চোখ জোড়ায়, ব্যাস আর এক লহমা ওখানে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস হলো নাহ আমার,এক ছুটে পালিয়ে এলাম। পেছন থেকে বার দুয়েক ডাক দিলেও শুনিনি।
কিছুতেই নাহ, শুনবো না আমি ও ডাক। আমি হারিয়েছি, হারিয়েছি নিজেকে, সত্যিই নীলাভ চোখের অতল গহ্বরে আমিও হারিয়ে গেছি। তা আমার দামামা তোলা মনটা ক্ষণে ক্ষণে বুঝিয়ে দিচ্ছে আমায়, ভেতরের অসহনীয় অনুভূতিরা প্রত্যেক মুহূর্তে বুঝিয়ে দিচ্ছে আমায়। কিছুক্ষণ ছুটার পর, সামনেই খানিক দূরে রাফাত নিবিড় সহ বাকি সকলকে দেখে এগিয়ে যায়….
-আফুউউ??
-হ্যাহহ এ্যাহ কি হয়েছে, এভাবে চিল্লাচ্ছিস কেনো
-চিল্লাবো না তো কি করবো, দুই মিনিট ধরে ডেকেই যাচ্ছি,তোর কোনো হেলদোল নেই, এভাবে সং হয়ে দাড়িয়েই থাকবি নাকি বেরোবি আজব।
আরশির কথা চোখটা পাশ ফিরিয়ে দেখি,সূর্যটা প্রায় হেলে পরেছে,সময়টা অপরাহ্ন এর শেষের দিকে। তখন সবাই একসাথে রিসোর্টে ফিরে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার পর যে যার মতো রেস্ট নিচ্ছিলো। আমি এসে দাড়িয়েছি বারান্দা টায়, দূরের পাহাড়ের চূড়া আর নাম না জানা হরেক রকমের মাথা উচিয়ে থাকা গাছগুলোর দিকে চেয়ে তখনকার ঘটনা মনে করছিলাম।এদিকে আরশি এসে আমায় কখন থেকে ডাকছে আমার খেয়াল ই হয়নি
-বলি এখানেই দাড়িয়ে থাকবি নাকি বেরোবি ও?
-কোথায় বেরোবো?
আমার এমন হ্যাবলাকান্তের মতো প্রশ্ন করা দেখে আরশি কপাল চাপড়ে বললো
-ইয়া মা’বুদ, এই মেয়ের মাথায় কতো ভোল্টেজের ঠা’ডা ডা তুমি ফালাইছো,সব গিইল্লা খাইছে বলদি। বলি মেঘ ভাইকে নিয়ে ভাবার জন্য আরও মেলা সময় বাকি,উনি কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে নাহ, আপাতত রেডি হ। সবাই তোর জন্যেই বসে আছে বেরোতে হবে তো
বলেই গটগট করে চলে গেলো। ইশ আমি যে মেঘের কথা ভাবছি ওকে কে বললো,সব সময় আগ বাড়িয়ে কথা বাদর টার। কিছুক্ষণ থ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে, ফিক করে হেসে দিলাম। কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে, শিরশির অনুভূতি গুলো আমায় ভীষণ জ্বালা’চ্ছে পাগল করে দিচ্ছে আমায়
~
রিসোর্টটা সিলেট নগরীর আম্বরখানা পয়েন্টে, শাহজালাল রহঃ এর মাজারের গেইটের আশেপাশেই। এখান থেকে রাতারগুল সিনএনজি করে যেতে হয়,দূরত্ব প্রায় ২০ কি.মি.। এখান থেকে রওনা দিলে ঘন্টা খানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যাবে রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট, বাংলাদেশের একমাত্র মিঠাপানির জলাবন এবং বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। সিলেটের স্থানীয় ভাষায়: মুর্তা বা পাটি গাছ কে “রাতা গাছ” বলে। সেই রাতা গাছের নাম থেকেই এই বনের নাম রাতারগুল। সারা বছর এই বন প্রায় ১০ ফুট পানির নিচে থাকে। বর্ষাকালে যার পরিমান বেড়ে দাঁড়ায় ২০-৩০ ফুট । এখানে জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা গাছপালার ভিতর দিয়ে ডিঙি নৌকায় ঘুরেবেড়াতে দারুন মজা। এটি পৃথিবীর বিখ্যাত কয়েকটি জলাবনের মধ্যে অন্যতম একটি। সকলে বেশ উৎকণ্ঠিত। সিলেটে এই আমাদের প্রথম আসা। যদিও রাফাত আর নিবিড়ের এর আগেও আসা হয়েছে, আর মেঘ যেভাবে গাইড করছে মনে হচ্ছে সবই উনার জানা,ছিলো তো বিলেত দেশের এতো কিছু কিভাবে জানে এই লোকটা। যাই হোক,আমরা মেয়েরা এই প্রথম যাবো, খুব বেশিই এক্সাইটমেন্ট কাজ করছে।
সেখানে গিয়ে পৌঁছাতে প্রায় চারটা বেজে গেলো। খাওয়া দাওয়া শেষে বেশিক্ষণ সময় নেয়নি কেও, বেলা তিনটার মধ্যেই বেরিয়ে পরেছিলাম সকলে। তাই বিকেলের মধ্যেই পৌঁছে গেছি।
রাতারগুলে নৌকায় উঠার সময় লাইফ জ্যাকেট পরতে হবে সকলকে। এখানে পালক করলো আরেক বিপত্তি। সে কিছুতেই জ্যাকেট পরবে নাহ,ওটা পরলে নাকি ও দম ব’ন্ধ হয়ে মরেই যাবে. ওকে সকলে হাজার বার বোঝানোর পর ও ওর একটাই কথা ও কিছুতেই ওই জ্যাকেট পরবে নাহ
-আফু তুই তো সাঁতার ও পারিস নাহ,পরে গেলে কি করবি
নিবিড়ের কথার পৃষ্ঠে আরশিও সম্মতি দিয়ে বললো
-সেটাই তো আফু৷ নৌকা দুললে তুই যদি ঠা’স করে পরে গিয়ে ভেলার মতো ভেসে যাস,তোকে ধরবো কি করে, প্রাণের বান্ধবীকে চোখের সামনে তলিয়ে যেতে দেখতে হবে
শিমুও ওর বিশ্রি এক্সপ্রেসন দিয়ে বললো
-হ্যাঁ তাই তো,তুই যদি ভেসে যাস তো আমরা কার বিয়েতে নাচবো বল তোহ
ওদের এমন অযৌক্তিক ভুলভাল কথায় মেঘ বেশ বিরক্ত হচ্ছে, ভ্রু কুচকে ওদের দুজন কে হাত উচিয়ে থামিয়ে দিলো। মেঘের জড়ো হওয়া ভ্রু দেখে শিমু আর আরশি টু শব্দ পর্যন্ত করলো নাহ আর।
লোকটা আমার দিকে নিঃশব্দে চেয়ে আছে,আমার এবার বেশ ভয় করছে, উনি কি বকবেন? না ধমক দিবেন? এভাবে সবার সামনে যদি আমায় বকে না আমিও কিন্তু ছেড়ে দেবো নাহ,একেবারেই দমে যাওয়ার মেয়ে নই আমি। উনি আমাকে সবার সামনে ধমক দিলে আমিও সবার সামনেই ভ্যাঁ করে কেঁদে দেবো বলে দিলাম। সবসময় এমন হুমকি ধমকি করবেন আর আমি চুপ থাকবো তাও তো হয়না, এবার আমিও ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে ভাসাবো
-তুমি সিউর,তুমি জ্যাকেট পরবে নাহ?
-হ্যাঁ
উনার গমগমে গলার প্রশ্নে মিনমিন করে উত্তর দিলাম।
মেঘ সকলকে ইশারা করতেই একে একে সবাই নৌকায় উঠে পরলো। ছেরা আগে উঠে শিমু আর আরশির হাত ধরে উঠালো। বাকি আছে মেঘ আর পালক। মেঘ পালকের দিকে এক পলক চেয়ে চশমা টা গলা থেকে খুলে চোখে দিলো। ধপ করে এক লাফ দিয়ে নৌকায় উঠে পরলো, আমি পরেছি বিপদে, এক তো তেড়ামি করে ওই জ্যাকেট পরলাম নাহ,তার উপর নৌকা যেই হারে দুলছে ও দেখে আমার কাম সারা, পা জমে গেছে আমার ভয়ে। চুপচাপ ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। নৌকা ছাড়ার জন্য হাকঁ ছাড়লো মাঝি। আমি এখনো দাড়িয়ে। ওরা সবাই বসে পরেছে,তাহলে কি আমায় ফেলে রেখেই চলে যাবে?
আমার আকাশ কুসুম ভাবনার মাঝেই, বলিষ্ঠ হাত টা আমার দিকে এগিয়ে এলো। ঘাড় তুলে তাকাতেই দেখি মেঘালয় হাত টা বাড়িয়ে আছেন আমার দিকে।
-তুমি কি এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে চাও, তাহলে বলো আমরা যাই দেরি হচ্ছে
বরাবরের মতোই উনার ধমক। কিন্তু এখানে একা দাঁড়িয়ে থাকার মতো ছিটেফোঁটা সাহস আমার নেই, ফট করে হাতটা উনার হাতের উপর রেখে নৌকায় এক পা দিতেই সারা নৌকা দুলে উঠল। ভয়ে আমি এক হাতে উনার শার্ট খামচে ধরলাম। উনি এক হাতে আমার হাত ধরে আরেক হাত কোমরে চেপে ধরে উচিয়ে নিয়ে থপ করে রাখলো নৌকার উপর। এরূপ কান্ডে আমি কিভাবে অবাক হবো বুঝছি নাহ, নৌকার সকলে হা করে চেয়ে আছে,আর মিটিমিটি হাসছে, আমি লজ্জায় মাথা নত করে রেখেছি। আস্ত্ব আস্তে এগোতে লাগলাম লম্বা নৌকাটার উপর দিয়ে, ওরা সকলে একেবারে ওই প্রান্তে বসেছে।
“আস্তে, ওদিকটাই পা ফেলো নাহ”
বলেই আমায় দুহাতে আকঁরে ধরে এগোতে লাগলো মেঘ। এক জাগায় পা দিতেই নৌকাটা এবার বেশ জোরেই হেলে উঠল। আমি ভয়ে চোখ খিচে রেখেছি। মেঘালর আমায় ধরে বললেন
-ভয় পেয়ো নাহ,আমি আছি
বলেই হাত ধরে নিমিষেই নিয়ে গেলো ওপাশটাই। দুটো মানুষের বসার জায়গা ফাঁকা রেখে সবাই জড়ো হয়ে বসেছে। রাফাত, নিবিড়, আদ্রিশ,শিমু, ধ্রুব ভাই সকলে সামনের সারিটায় বসা, আরাব ভাই মাঝখানে ক্যামেরা হাতে এপাশ ওপাশ সব দিকের ছবি তুলছে।
নৌকার দু পাশে দুইজন মাঝি। পানিতে ছপছপ শব্দ তুকে নৌকা এগিয়ে নিচ্ছে বনের দিকে। হাজারো বন্য গাছ, তার বড়ো বড়ো পাতা। পালক হা করে তাকিয়ে দেখছে আশপাশ। সবুজে ভরা পানি আর উপরের গাছে ঢাকা আকাশের দৃশ্যটা দেখে সবাই বিমোহিত।
বনের একেবারে মাঝখানে ঢুকে পরেছে নৌকাটা। এখানে পানির গভীরতা অনেক বেশি,আর সাপের ও প্রকপ আছে, মাঝি সবাইকে সাবধানে বসতে বলে অভিজ্ঞ হাতে নাও ঠেলে নিচ্ছে। এক জাগায় এসে নৌকাটা বেশ জোরে দুলে উঠলো পালক অপ্রস্তুত থাকায় পেছনের দিকে হেলে পরতে নিলেই মেঘ এক হাতে ঝাপটে ধরলো কোমর।
বুকে হাত রেখে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে,বেশ ভয় পেয়ে গেছে পালক।
“আমায় ধরে থাকো, পরবে নাহ ভয় নেই”
এমন সময় মেঘের কথায় যেনো আকাশ সমান ভরসা পেলাম,চুপচাপ লক্ষী মেয়ের মতো উনার এক হাতের বাহু আকঁরে ধরে রইলাম। নৌকা পানির তালে মৃদু দুলছে। শক্ত হাতের বন্ধন এখনো কোমরে উপস্থিত। বেশ অস্থির লাগছে,এভাবে কোমরে হাত রেখে দেওয়ায় আমার শরীরের লোমকূপ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। সামনের সবাই তাদের মতো গল্প আর পরিবেশ অবলোকন করতে ব্যস্ত। হাতটা পেছনের দিকে দিয়ে রাখায় কারো নজরেই আসেনি।
আমি আলতো করে হাতের উপর হাত রেখে সরাতে নিলেই উনি আরও শক্ত করে আকঁরে ধরলেন। বুকের ঢিপঢিপ শব্দ নিজের কানে শুনতে পাচ্ছি,সারা শরীর কাপঁছে আমার এহেন পুরুষালি স্পর্শে।
নড়াচড়া করছি বারবার, বার কয়েক চেষ্টা করেও হাত সরাতে না পেরে মিনমিন করে বললাম
-ছাড়ুন প্লিজ..আমার কেমন লাগছে
আমার কথায়, বেশ নির্লিপ্ত চেয়ে বললেন
-কেমন লাগছে?
আমি আরও মিনমিনিয়ে বললাম
-কেমন কেমন। আমি জানি নাহ ছাড়ুন প্লি…
আমাকে সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বললেন
-হুসসস…চুপচাপ বসে থাকো,, বেশি নড়াচড়া করলে কোলে তুলে নেবো কিন্তু
ফট করে চোখ সরিয়ে নিলাম। লজ্জার কানের লতি গরম হয়ে গেছে। উনার এমন কথায় আমি পারছি নাহ উবে যেতে,উফফ উনার মুখ এতোটা লাগাম ছাড়া কেনো, উনার এরূপ বেহায়া কথায় কোনদিন আমার হ্যার্ট এ্যা’টাক হবে জানা নেই
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ