তুমি আসবে বলে পর্ব-২৬+২৭

0
321

#তুমি_আসবে_বলে
#হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ২৬-২৭

আকাশ ভরা তারারা টিমটিমে আলো জ্বলছে, রূপালি চাঁদের আলোয় আশপাশ জুড়ে স্বর্গীয় সৌন্দর্য নেমেছে, বৈরী হিম হাওয়ায় আকাশের বুকে তারাদের খেলা,আর জমিনের বুকে গাছেদের মৃদু দোলনে পরিবেশ টা স্পন্দিত হচ্ছে যেনো। প্রকৃতি এতোটাই সুন্দর! মন ভালো করে দেওয়ার জন্য প্রকৃতির এই অসম, সৃষ্টিকর্তার তর্জমার এ ছোট্ট প্রতিমায় যথেষ্ট। এই যে রাতের আকাশের জোৎস্না ভরা দৃশ্যের মখমলে ঘ্রাণ, গা ছমছম করা অল্প বাতাসের টান নিস্তব্ধতায় পাতার হাল্কা মরমর শব্দ সবকিছু যেনো বিমোহনের প্রান্তপথে এলিয়ে নিচ্ছে।

চোখ বন্ধ করে বড়ো নিঃশ্বাস টেনে পরিবেশের এমন মাদকতার ঘ্রাণ নিচ্ছি। রাতারগুল থেকে ঘুরাঘুরি করে রিসোর্টে ফিরতে প্রায় রাত নয়টা বেজেছে, সকাল হতে দু বার এমন জার্নি আর ঘুরাঘুরি করার কারণে সবাই বেশ ক্লান্ত, তাই ফ্রেশ হয়ে খেয়েই ঘুম,কাল সকালেও তো আবার বেরোতে হবে। কিন্তু আমার চোখের ঘুমেরা যেনো ছুটি হীনায় পালিয়েছে, কিছুতেই ধরা দিচ্ছেনাহ। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করে দু ঘন্টা পার করেও ঘুম এলোনাহ,তাই বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়েছি। এই বিশাল বেলকনিটা সব রুমের সাথে অ্যাটাচড। মানে এক সারিতে পরপর তিনটা ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে বেরোলেই এই বেলকনি পরবে। মধ্যরাতের পরে একেবারেই খাঁ খাঁ করছে রিসোর্টটা। একপাশের পুরো কটেজ টাই বুক করে রাখা আমাদের,তাই এদিকটাই আমরা ব্যতীত অন্য কোনো মানুষের উপস্থিতি নেই।
চুপচাপ রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আশপাশের এমন স্নিগ্ধ রূপ চোক্ষের ডালিতে সাজাচ্ছি। ডান পাশের সুইমিংপুলের নীল পানিতে রূপালি চাঁদের প্রতিফলনটা যেনো একটা হিরার মতো লাগছে।। একদম শান্ত পরিবেশে শুধু আমার মনটাই অশান্ত। এই রাতের পরিবেশ টা ঠিক যতোটা নিস্তব্ধতা আর শান্ত রূপ ছড়িয়ে রেখেছে, তার তিনগুণ বেশি অশান্ত আর দামামা আমার বুকের ভেতর চলছে,যা আমায় এক লহমা স্থির হতে দিচ্ছে নাহ। মনের ভেতর কেমন একটা উৎকণ্ঠা জাগছে। আনন্দ, ভয়, শিরশিরানি সব মিলিয়ে বৈরী এক পেলব অনুভূতির উপস্থিতির খুব দৃঢ় ভাবে জানান পাচ্ছি। যা আমার কানে রাত দিন একই নাম জপে চলেছে… মেঘালয় আর মেঘালয়। ওই চেহারা ওই চোখ ওই চাহনি সবকিছু আমায় নাম না জানা কোনো প্রান্তরে ঠেলে দিচ্ছে, আমার ষষ্ঠইন্দ্রিয় আমায় কড়া ভাবে অবগত করছে যে আমি হারাচ্ছি, কঠিন ভাবে হারাচ্ছি, কোন জগতে পা রাখছি জানি নাহ তবে সেখানে শুধু ওই নীল চোখের উপস্থিতিই আমায় টানছে, তবে কি প্রেম? আমার উনিশটি শরৎ পার হয়ে এ কোন ঋতুতে মন হারালো,কোন রূপের আবহাওয়ার জড়ালো জানি নাহ, শুধু জানি যে বদ্ধ ঘরের দেওয়ালের মতো বারংবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ওই একই নাম। জ্বলজ্বল করা আয়নায় ঘেরাও করে প্রতিফলিত করছে একই চেহারা।

আপন মনেই নিজের ভাবনার মাঝেই, নাকে সেই চিরচেনা ঘ্রাণ টা লাগলো, চোখ বন্ধ রেখেই পাশে কারো উপস্তিতি টের পেলাম, হুট করেই মনটা কেমন চঞ্চল হয়ে উঠলো, কই এতোক্ষণ তো এমন ছিলো নাহ, মনের ভেতর কেমন প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর শব্দ শুনতে পাচ্ছি। চোখ দু’টো খুলে তাকাতেই কাঙ্খিত চোখ জোড়া দেখতে পেলাম। এক হাত ব্যবধানে দাঁড়িয়ে আছে আমার পাশে, চোখ দু’টো সুদূর আকাশের ওই মাহতাব টার দিকে নিবন্ধিত। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছি অপলক। গাঢ় নীল রঙের টি-শার্টটা পেশিবহুল হাতে আট হয়ে আছে, দমকা বাতাসে চুলগুলো বেপরোয়া খেলায় মেতেছে, দু হাত পকেটে গুজে দাড়িয়ে ঘনঘন নিঃশ্বাস ছাড়ার শব্দ শ্রবণেন্দ্রিয় হতে পায়ের তালু পর্যন্ত শিউরে দিচ্ছে।
মনটা আমায় কড়া ভাষায় ধমকে বললো, এ কেমন বেহায়া রূপ তোর,কেনো হারাচ্ছিস এই পুরুষে বারবার, চোখ টা ফিরিয়ে নিতে নিলেই আবার সেই একই কণ্ঠে ভেতরে বললো, হারাক না হৃদয়ে ঝংকার তোলা এই সুপুরুষে মরতেও আপত্তি নেই।

-ঘুমাওনি কেনো?

নিস্তব্ধতা ভাঙলো ভরাট গলার স্বরে। বার দুয়েক পলক ঝাপটে নিভৃতে উত্তর দিলাম
-আসছে নাহ

কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও জিগাসা করলেন -এখানে কি করছো

তার দিকে চেয়েও উত্তর দিলাম
-দেখছি

আমার উত্তরের সাথে সাথেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন আমার দিকে,আমি তড়াৎ ঘাড় নামিয়ে নিলাম। আমি যে মন্ত্রমুগ্ধের মতো উনার দিকে চেয়েই কথাটা বলেছি তা নিশ্চয়ই বুঝেছেন।
খানিকটা সরে এসে দূরত্ব কমিয়ে জিগাসা করলো

-রাতে ডিনারের পর আরাবের সাথে ইয়ার্ডে কি করছিলে

উনার কথায় মনে পরলো রাতের খাবার শেষ করে রুমে আসার সময় আরাব ভাই পেছন থেকে ডেকে বলেছিলো আমার সাথে কিছু কথা বলতে চাই আলাদা ভাবে,তাই ইয়ার্ডের দিকে গেছিলাম,কিন্তু উনার কথা শোনার আগেই রাফাতের ডাকে ফিরে যেতে হয়েছিলো।

-এতো ভাবার কি আছে ও কেনো ডেকেছিলো তোমায়?

হঠাৎ এমন তেজি গলার খাকারি তে কেঁপে উঠলাম, রেগে গেলো কেনো? চোখ দুটো নামিয়ে রেখেই উত্তর দিলাম

-জানি নাহ,উনি কিছু বলার আগেই রাফাত এসে ধরে নিয়ে গেছিলো।

ফোস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে চাপা স্বরে হিসহিসিয়ে বললেন

-নেক্সট টাইম যেনো ওর সাথে এদিক ওদিক যেতে না দেখি, এতো কিসের আলাপ তোমার একান্তে। আর শুধু ওই কেনো কোনো ছেলের সাথেই যদি বেশি ঘেসাঘেসি করতে দেখি, তাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেও হবে নাহ

আমি হা করে চেয়ে আছি এরূপ কথায়,এটা কেমন কথা হলো? আমি কারো সাথেই কথা বলতে পারবো নাহ? আর কথায় কথায় এমন ধমক দেওয়া উনার স্বভাব না অভ্যাস বুঝিনা।
আমি অন্য ছেলের সাথে কথা বললে ঘেসাঘেসি করলে উনার কি। হুট করে মনের ভেতর অদ্ভুত একটা দোলা লেগে গেলো, আচ্ছা আমি অন্য ছেলের সাথে কথা বললে কি উনার খারাপ লাগে? হিংসা হয়? ঠিক আমার যেমনটায়া হয় অন্য মেয়ে উনার দিকে তাকালে। মনটা কেমন বাচ্চাদের মতো করে উঠলো, জিদ ধরে বসলো, খুব জানতে ইচ্ছে করছে

-কেনো অন্য ছেলেদের সাথে কথা বললে কি হবে?
সাহস করে প্রশ্ন টা করেই ফেললাম,কিন্তু আমার আশায় একি বালতি পানি ঢেলে উনি গমগমে গলায় বললো

-ঠ্যা’ঙ ভে’ঙে রেখে দেবো, সাহস বেড়ে গেছে তাইনা। এইটুকু মেয়ে ছেলেদের সাথে ঢলাঢলি করতে লজ্জা লাগে না

উনার এহেন কথায় চাপা রাগ টা বেড়ে গেলো। সবসময়ই কি এভাবে কথা বলতে হবে। সবসময় হুমকি ধমকি দিতেই হবে, উনি কে এমন করার।আর ভালো করেও তো বলা যায় তাইনাহ। হুট করেই মেজাজ টা চড়ে গেলো।গলা উচিয়ে বললাম

-কেনো আমি যার সাথে মন তার সাথে কথা বলবো আপনার কি তাতে,আপনি কে বলার, আমার যার সাথে ইচ্ছে করবে কথা বলবো ঘুরবো,প্রেম ও করবো আপনার কোনো অধিকার নেই এ বিষয়ে কথা বলার

বলেই এক মুহূর্ত দাঁড়ালাম নাহ ঘরের দিকে যেতে নিলেই হাতে টান পরলো,পা দুটো থমকে গেলো। হাত মুচরেও কোনো লাভ হচ্ছে না। ওমন বলিষ্ঠ হাতের থেকে পালকের মতো দূর্বল মানুষ কিছুতেই পেরে উঠছে নাহ। তবুও হাত মুচড়াতে লাগলো। পালকের এমন ছটফট করা দেখে বাকা হাসলো মেঘ। ছোট্ট হাতটাই এক টান দিয়ে রেলিঙ বরাবর দাড় করালো। পালক ছিটকে গিয়ে দাঁড়ালো

ভ্রু কুচকে এগিয়ে এলো মেঘ। মেঘালয়ের এমন ক্রুর চোখ দেখে পালক বেশ ভরকে গেলো, লোকটার রাগ সম্পর্কে সে একটু হলেও অবগত। ঝোকের বসে তো যা তা বলে দিলো এখন কি হবে। মেঘ আরও এগিয়ে আসলো এক পা এক পা করে, পালক একদম রেলিঙের কিনারা ঘেঁষে লেগে আছে আর ছুটার জন্য ভেতর ভেতরে ছটফট করছে। মেঘ দু হাত পালকের দুপাশে রেখে ঝুকে এলো। দূরত্ব একদম ঘুচে গেলো,পা দুটো ভেঙে ভেঙে আসছে পালকের, শরীরের সবটুকু ভর ছেড়ে দিচ্ছে। বুকের দ্রিমদ্রিম শব্দে অতিষ্ঠ লাগছে। মেঘালয় মুখটা একদম কাছাকাছি আনলো,দুজনের নাক ছুঁই ছুঁই, মেঘের উষ্ণ নিঃশ্বাস অনুভূতির তুমুল বর্ষন করছে পালকের ভীতু মনে। এই মানুষটা তার মনে প্রচন্ড তোলপাড় তুলে দিচ্ছে, অব্যক্ত মন চিৎকার করে বলছে পালক তুই প্রেমে পরে গেছিস,এই নিষ্ঠুর লোকটার প্রেমে পরে গেছিস।
ভয় আর অস্থিরতায় চোখ বন্ধ করে আছে পালক। এতো কাছ থেকে পুরুষালী স্পর্শ সে সইতে পারছে নাহ, মেঘ এক হাত তুলে আঙুল দিয়ে আলতো ভাবে পালকের মুখের উপর থেকে ছড়িয়ে পরা চুল সরিয়ে দিয়ে ঘোর লাগা গলায় বললো

-আমি কে সেটা সময় আসলেই বুঝতে পেরে যাবে, আর অধিকার আছে কি না সেটা না জানলেও চলবে, আপাতত এইটুকু জেনে রাখো এ জীবনে তোমার আর প্রেম করা হবে নাহ, কারো বক্ষপিঞ্জরে বন্দিনী হয়ে গেছো তুমি, মৃত্যুর আগ অব্দি ছাড়া পাচ্ছোনা,আশা করি বুঝতে পেরেছো

কথাটা বলেই অভাবনীয় এক কাজ করে বসলো।ধপ করে চোখ খুলে তাকালাম,নিজেকে পাগল মনে হচ্ছে, উন্মাদ,উন্মাদের মতো অস্থির লাগছে, নিজের হাতটা আপনা আপনি বাম গালে চলে গেলো,নড়ে উঠলো ভেতরটা, পুরুষালি ঠোঁটের স্পর্শ এখনো লেগে আছে গালে। বিস্ফোরিত চোখে তাকালো মেঘের দিকে,ও কল্পনাও করতে পারেনি মেঘ এমন একটা কাজ করবে।

হাত দু’টো সরিয়ে, খানিক দূরে সরে দাড়ালো পকেটে হাত গুজে, চোখ মুখ একদম স্বাভাবিক, যেনো কিছুই হয়নি। এমন মারাত্মক কাজটা করেও লোকটা নির্লিপ্ত, আমি এখনো রেলিঙের সাথে ঘেঁষে লেগে আছি।

-এখনো দাঁড়িয়ে আছো? আরও একটা চাই নাকি? চাইলে কিন্ত আমার আপত্তি নেই। ওই নরম গালে একবার না হাজার বার ঠোঁট ছোঁয়াতে রাজি।

সারা মুখে রক্তিম আভা ছড়িয়ে গেলো, মনের ভেতর হাজারো অনুভূতির তান্ডব শুরু হয়েছে, এখানে আর এক লহমা থাকা যাবে নাহ,প্রচন্ড, প্রচন্ড বেহায়া লোকটা। এক ছুটে ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দিলাম,বুকের অসহনীয় কাপঁনে আমার হাত পা অবশ,ভাঙা ভাঙা পায়ে এগিয়ে গেলাম। বিছানার এক কোণে গুটিসুটি মেরে শুয়ে রইলাম, মাথা টা দপদপ করছে,একটু ঘুম দরকার না তো পাগল হয়ে যাবো আমি।

~

-ধ্রুব ভাই একটা গান ধরো তোহ, এভাবে নিরামিষ যাত্রা একদম ই ভাল্লাগছে নাহ

-এটা একদম ঠিক বলেছে রাফাত, একটা গান ধরা যাক
ধ্রুবের কথায় আরশির মনে যেনো আনন্দের ফোয়ারা বইয়ে গেলো, উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো

-আরাব ভাই আপনিই একটা গান শুরু করেন না,খুব ভাল্লাগবে

আরাব বেশ ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে বললো
-আমি?

-অবশ্যই আপনি, কোনো না শুনবো নাহ,শিগগির শুরু করেন

-ঠিকাছে করাই যায়

সকলে বেশ এক্সাইটেড আরাব ভাইয়ের গান শোনার জন্য, আরাব ভাই গান আরম্ভ করে দিলো

“সে মানুষ চেয়ে চেয়ে, ফিরিতেছি পাগল হয়ে..
সে মানুষ চেয়ে চেয়ে ফিরিতেছি পাগল হয়ে
মরমে জ্বলছে আগুন আর নেভে না……
সে মানুষ চেয়ে চেয়ে ফিরিতেছি পাগল হয়ে
মরমে জ্বলছে আগুন আর নেভে না
,,,,,আমায় বলে বলুক লোকে মন্দ বিরহে তার প্রাণ বাচে না বলে বলুক লোকে মন্দ বিরহে তার প্রাণ বাচে নায়ায়ায়া,,,দেখেছি.. দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা…..”

এবার আরাব ভাইয়ের গলার সাথে গলা মিলিয়ে সবাই একসাথে গেয়ে উঠলো
“দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা”

এতোগুলো মানুষের গলায় যেনো লেগুনা টাও সুরে ছন্দে এগিয়ে যাচ্ছে। গন্তব্যস্থান বিছানাকান্দি। বিছনাকান্দি যেতে সিলেটের আম্বরখানার সিএনজি স্টেশন থেকে লোকাল সিএনজিতে চড়ে হাদারপার নামক জায়গায় যেতে হয়। হাদারপার এসে নৌকা ঘাট থেকে নৌকা ঠিক করেই সোজা বিছনাকান্দির মেইন পয়েন্ট। কিন্ত আমরা আম্বরখানা থেকেই একটা লেগুনা ভাড়া করে নিয়েছি,একবারে হাদারপার নৌকা ঘাটে যাওয়ার জন্য। সামনাসামনি সিটে লেগুনাতে একপাশে ধ্রুব ভাই, আরাব ভাই, আর আদ্রিশ বসেছে, আর তার সামনে বরাবর আমি আরশি শিমু নিবিড় রাফাত। আর ও হ্যাঁ সামনের সারিতে ওই লোকটাও আছে যার নামটা আমি নিতে চাচ্ছি নাহ।

লেগুনার ভেতর সবাই হাত তালি দিচ্ছে আর একসাথে গলা মিলিয়ে গাচ্ছে।
আমি চুপচাপ কোনো প্রতিক্রিয়া হীনা বসে আছি,এমনকি একবার ঘাড় তুলে তাকায় ও নি। কিন্তু আমার এই ব্যবহার হয়তো কারো সহ্য হলো নাহ। সবাই যখন গলা ছাড়িয়ে গানের তাল মেলাতে ব্যস্ত তখন, নিজের পায়ের উপর আরেকটা পায়ের স্পর্শে চমকে উঠলাম। এক পায়ের জুতা খুলে তার উপর পা রেখেছে, আরেক পায়ের জুতা খুললেও সেই পা টার অবস্থান আমার পায়ের উপর, এহেন কান্ডে আমি অবাকের শীর্ষে। তড়াৎ মাথা তুলে দেখি আমার একদম সামনের হালকা আঁকাশি রঙের শার্ট পরিহিত ব্যক্তিটির আপনমনে ফোন টিপে যাচ্ছে, এদিক যে আমার অবস্থা ঠাডা পরা গাছের চেয়েও বাজে সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। উনার অভিব্যক্তি বুঝাও দায়। চোখ জোড়া কালো চশমা দিয়ে ঢাকা, খয়েরী ঠোঁটটা কামড়ে ধরে ফোনে এক ধ্যানে চেয়ে আছে। আমি পারছি না মরে যেতে, পায়ের উপর পা রাখায় আমার শরীরে কাপন ধরেছে,এই লোক কি চাই আসলে আমি কোনদিন হ্যার্ট এ্যা’টাক করে মরবো উনার জন্যে।

সবাই একসাথে রিমিক্স গান গাওয়ায় এদিক কারো ধ্যান নেই, রাফাত ওর ব্যাগ টা কোলের উপর রেখে হাত দিয়ে ধপাধপ ঢোল বাজাচ্ছে, আরশি আর শিমু হাতে তালি দিয়ে তাল মেলাচ্ছে আরও সকলে একসাথে গান গেয়ে যাচ্ছে,এই অপরূপ দৃশ্যের সাথে লেগুনায় চলা ঠান্ডা বাতাস আর গানের তালে যেনো আনন্দের বাহার ছড়িয়েছে।
কিন্ত আমি অসস্তিতে স্থির থাকতে পারছি নাহ। নিজের পা টান দিয়ে সরাতে নিয়ে,আরও জোরে চেপে ধরলো,মেরুদণ্ড বয়ে শীতলতার স্রোত বয়ে গেলো আমার,চোখ বন্ধ করে জামা খামচে আছি, এসময় সেই চেনা ভরাট গলা শ্রবণযন্ত্রে এলো

“একবার ধরতে পেলে মনের মানুষ ছেড়ে যেতে আর দিও না,ওওও দেখেছি, দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা ”

চোখ তুলে দেখি চশমা টা খুলে গলায় ঝুলানো, মেঘালয় ও গান ধরেছে,এবার যেন সবার হৈ-হুল্লোড়ের বাধ ভাঙলো। আরও উচ্চস্বরে গেয়ে উঠলো সবাই,এক একটা গানের কলি।
দ্রতগামী গাড়িতে চড়ে,হইহট্টগোলের মাঝ দিয়ে দেড় ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ঘাটে, ঘাটে এসে একটা নৌকা নিলো। পানিতে কিছুক্ষণ এগোতেই পালক দেখতে পেলো দূরে একটা পাহাড়, পাহাড় এতোটাও সুন্দর হয়! নীল জলের মাঝে গাঢ় সবুজে ঢাকা পাহাড় টা যেনো আকাশ ছুঁই ছুঁই।
ওই সুবিশাল, নজরকাড়া সৌন্দর্যে ভরা পাহাড় টা দেখে পালক আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে হাত তুলে দেখিয়ে বললো

-ওইটা কি?

-মেঘালয়
পেছনে তাকিয়ে দেখে মেঘ নামক মানুষটা,গুরুগম্ভীর মুখ করে উত্তর দিলো, আজব উনার নাম যে মেঘালয় তা তো জানিই এতে শুনানোর কি আছে। ভ্রু কুচকে সামনে তাকিয়ে বললাম

-দূরের ওই পাহাড়ের মতো বড়ো আকাশ সমান ওইটা কি।

পেছন থেকে আবারও গমগমে গলায় উত্তর দিলো মেঘ
-মেঘালয়

আবারও পেছন ঘুরে দেখি লোকটা প্রতিক্রিয়া হীন চুপ করে আছে, আজব তোহ রোবট নাকি লোকটা, আমি যাই বলছি নিজের নাম উত্তর দিয়ে যাচ্ছে,

-আমি কি কারো নাম জানতে চেয়েছি, আমিতো বারবার বলছি দূরে ওই ইয়া বড়ো সবুজ পাহাড় টার নাম কি

পেছন থেকে লোকটা আবারও মুখটা স্থির রেখেই উত্তর দিলো
-মেঘালয়

এবার আমার বেশ রাগ হলো,
-আজব তোহ আপনি বারবার মেঘালয় মেঘালয় কেনো করছেন, আপনি যে দ্যা ওয়ান এন্ড অনলি মি.খ’বিশ সিরিয়াস চৌধুরী অরফে মেঘালয় চৌধুরী সেটা আমরা সবাই যানি এভাবে বারবার শুনাচ্ছেন কেনো। আপনার নাম শুনতে আমি একটুও আগ্রহী নই।

-আরে পালক, ও নাম বলছে নাহ, তুমি যেই ইয়া বড়ো পাহাড়ের মতো আকাশ সমান জিনিসটার কথা বলছো ওইটাই মেঘালয়, খাসি গারো আর জৈন্তিনা হিলস জেলাগুলি নিয়ে তৈরি মেঘালয় রাজ্য।

ধ্রুব ভাইয়ের কথায় পালকের ইচ্ছে হলো নৌকা থেকে ঝা’প দিয়ে পরে যায়, লোকটা তো ঠিকই বলেছিলো, সে শুধু শুধুই ওতোগুলো কথা শুনিয়ে দিলো। আস্তে করে ঘাড় কাত করে তাকিয়ে দেখে লোকটা চোখ ছোট করে ওর দিকে চেয়ে আছে, পালক ঢক গিলে অন্যদিকে তাকালো,ভাগ্যিস এখানে সবাই আছে নয়তো আমায় তুলে নিয়ে ওই মেঘালয়েই ছু’ড়ে মার’তো লোকটা।

-যাহ বাবা,ভাই তো ঠিকি বলেছিলো আফু,তুই শুধু শুধু ভাই কে এতোগুলা কথা শুনালি, খ’বিশ সিরিয়াস এসব কি আফু, এসব কি ভাইয়ের নাম?

রাফাতের কথা শুনে ইচ্ছে করলো হয় আমি ম’রে যায় নয় ওকেই মে’রে ফে’লি, ও আবার রিপিট টেলিকাস্ট করছে বলদ টা,আমার এমনিতেই ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেছে, রেগে মেগে বলে তো দিয়েছি এখন পরে আমার কি অবস্থা হবে সেই ভেবে হাত পা ছড়িয়ে কাদতে ইচ্ছে করছে। ও আবার মনে করিয়ে দিচ্ছে সা’লা

-রাফাইত্তা, তোর মুখটা যদি বন্ধ না রাখিস তাইলে এই পানিতে তোরে তিন মিনিট চুবি’য়ে স্বর্গের সফর করিয়ে দেবো

-কে রাফাত? আর স্বর্গ, ও খালি আজাইরা কথা আর খাওয়া ছাড়া জীবনে ভালো কিছু করেনি স্বর্গ তো দূর ওরে চ্যালচ্যালাইয়া নরকে পার্সেল করবো আল্লাহ।

নিবিড়ের কথায় তেঁতে উঠে রাফাত বললো

-আর তুই তো খুব আউলিয়ার লেভেল এ চলে গেছিস নাহ,সা’লা ভন্ড।

-নিবিড় একা নাহ,তোরা তিনটাই ভন্ড। মনে নাই ফার্স্ট ইয়ারের একটা হাবাগোবা পোলারে পাইয়া ভুলভাল ভবিষ্যত বাণী শুনায়ে তিনটাই তিন প্লেট বিরিয়ানি সাবার করছিলি

আরশির কথায় আদ্রিশ নিবিড় রাফাতের মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেলো,মানছে ওরা এমন করেছে কিন্ত বড়ো ভাইদের সামনে এসব বলার কোনো মানে হয়
আদ্রিশ এসে দুম করে একটা কিল বসিয়ে বললো

-আপদের আপদ মুখটা বন্ধ রাখ, তুই যে ছোট ছোট মাইয়া গো দিয়া তোর ক্রাশ রে লাভ লেটার পাঠাইছিস সেইটা বলবো

আদ্রিশের কথায় আরশির মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেলো,ও তো আরাব কেও চিঠি পাঠিয়েছিলো,এভাবে আদ্রিশ সবার সামনে বললো এখন যদি বুঝে যায়

-ওমা তাই নাকি, তা আরশি রাণী কাকে লাভ লেটার দিয়েছিলে, লাকি বয় টা কে,আমাদের ক্যাম্পাসের ই নাকি?

আরাবের কথায় আরশি হ্যাবলাকান্তের মতো তাকিয়ে আছে,এখন সে কি করে বলবে সে তাকেই পাঠিয়েছিলো। কোনো রকম আমতাআমতা করে বলে

-না মানে ওটা একটা ডেয়ার ছিলো, শি শিমু ডেয়ার দিয়েছিলো আমায়, তাছাড়া কিছুই নাহ

-মানে? আমি কখন ডেয়ার দিয়েছি, তোদের সাথে তো আমি ট্রুথ আর ডেয়ার খেলিই নাহ, একবার ডেয়ারে আমায় ভুলভাল গানে নাচিয়ে ভিডিও করেছিলি তোরা তারপর থেকে আমি তোদের সামনে ওই খেলার নাম ও করি নি

এই আরেকটা বলদ,এক একটা বলদের ঘরের বলদ, গন্ডমূর্খের দল এর ওর সাথে লাগতে গিয়ে নিজেদের ইজ্জতের ফালুদা করে নিজেও বোঝে নাহ, আমি সবগুলোর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই সব চুপ মে’রে গেলো। আমি পারছিনা এদের এক লা’ত্থি দিয়ে তল্লাটে পাঠাতে।
এই যে এদের বলদামির জন্য এখম আরাব আর ধ্রুব ভাই হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে।

আরও কিছুক্ষণ গল্প গুজব আর হুরহুর দলের উলটা পালটা ইয়ার্কি দিয়ে পার হলো নদীপথ, পুরো রাস্তা পালক মেঘালয়ের দৃশ্যের সৌন্দর্য দেখে বিমোহিত হয়ে চেয়ে রইলো আর মেঘালয় চেয়ে রইলো পালক নামক মেয়েটির দিকে, যাকে হাজার বার দেখে কি নাও মন ভরে নাহ, পাগলীটাকে ইদানিং বুকের ভেতর মিশিয়ে রাখার খুব অবাধ ইচ্ছে করে মেঘালয়ের।

বেশ অনেকটা সময় পার হয়ে পৌঁছালো কাঙ্খিত গন্তব্যস্থল বিছানাকান্দিতে।সেখানে পৌঁছে সকলের আনন্দের সীমা থাকে নাহ,এতো সুন্দর দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য যেনো বারবার হয়। হাজারো বড়ো ছোট পাথরের মাঝে নীল রঙের পানির স্পষ্ট দৃশ্য নয়নাভিরাম, উপরে সুবিস্তির্ণ আকাশ নিচে এমন বহমান পানির ধারা,আশেপাশের সবুজে ভরা পাহাড়, দূর থেকে একটা ঝর্ণা ও দেখা যাচ্ছে, সব মিলিয়ে পাগল করে দেওয়ার মতো সৌন্দর্য। সকলে এদিক ওদিক ছুটে গেলো, আরশি গিয়ে একটা একটা পোজ দিচ্ছে আর আরাব তার ক্যামেরাই তুলছে,এসে থেকে কম হলেও হাজার খানেক ছবি তুলা ওর সারা, রাফাত নিবিড় আদ্রিশ পানিতে লাফালাফি শুরু করেছে, শিমু পানির ভেতর থেকে ছোট ছোট পাথর কুড়াচ্ছে,আর ধ্রুব ভাই একটা করে ছবি তুলছে আর এদিক ওদিক দেখছে।

আমি পারিনা খুশিতে পাগল হতে, আমার সামনেও মেঘালয় পাশেও মেঘালয়।
সামনে মেঘালয়ের সুবিশাল পাহাড় সবুজে মাখা দৃশ্য যতদুর তাকায় মেঘালয়ের বিস্তীর্ণ পাহাড় গুলোই দেখা যাচ্ছে , আবার পাশে তাকালেও মেঘালয় নামের মাত্রাতিরিক্ত সুদর্শন চেহারা টা। ঝর্ণার কলকল ধ্বনিতে যেনো প্রজাপতিরা ডানা মেলছে,আনন্দে আত্মহারা হয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো পালক।
ছোট বাচ্চারা খেলনা পেলে যেমন লাফিয়ে ওঠে, পানির মধ্যে গিয়ে ঠিক সেভাবেই লাফাচ্ছে,হাত দিয়ে পানিতে ছপছপ শব্দ করে পানি ছিটাচ্ছে আশেপাশে, পালকের হাসির ছলকানিতে মেঘের মনের ভেতর যেনো তান্ডব চলছে, মেয়েটার হাসি বাধ ভাঙা খুশি সবকিছুই তাকে অদ্ভুত প্রশান্তি দিচ্ছে, মনে চাচ্ছে সময়টা থেমে যাক৷ এইযে বাচ্চাদের মতো পানি ছিটাচ্ছে নিজেও ভিজে যাচ্ছে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মেঘালয় কেও ভিজিয়ে দিচ্ছে।
কিছুক্ষণ ইচ্ছামত লাফালাফি করে থপ করে একটা পাথরের হেলান দিয়ে বসে পরলো। পাশে শব্দ পেয়ে তাকিয়ে দেখে মেঘালয় এসে বসেছে তার পাশে, লোকটা আজকে হালকা নীল রঙ টা কি তার সাথেই মিলিয়ে পরেছে? পালকের গায়েও আকাশি রঙের হালকা জরজেটের জামা। লোকটার শার্ট ভিজে ভেতরের সাদা রঙের টি-শার্ট টাও গায়ের সাথে লেপ্টে আছে।
থপ করে পালকের পাশে বসে বললো

-লাফানো শেষ? নাকি আরও ইচ্ছে আছে?

-আপনিও তো লাফিয়েছেন,আমাকেই কেনো বলছেন

-তোমাকে কে বললো আমি লাফিয়েছি

-এই যে নিজের জামা কাপড় ভিজিয়ে ফেলেছেন,নিজের বেলায় কিছুই নাহ,শুধু পারে আমাকে কথা শোনাতে

মেঘ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকে,এই মেয়েটা একবার বলা শুরু করলে কি বলছে কিছুই ভেবে বলে না, হরবর করে বলে পরে ভুল বুঝতে পেরে মুখটা এইটুখানি করে রাখবে

-লাফানোর সময় আশেপাশে দেখেছিলে কেও আছে কি নাহ? তা দেখবে কেনো তোমার তো পাকনামি করার একটা সুযোগ চাই

এই রেহ, তখন লাফানোর সময় এই লোকটাও তো পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিলো,নিশ্চয় আমার লাফালাফির জন্য ভিজে গেছে, এখন কি হবে,তখন তো যা তা বলে পার পেয়ে গেছি কিন্তু এখন।
পালকের এমন আতংকিত মুখ দেখে মেঘের দমক ফাটা হাসি পাচ্ছে, কিন্তু হাসিটা দমিয়ে রেখে বেশ কঠিন মুখ করে বললো

-তোমার সাহস একটু বেশিই বেড়ে গেছে , তখন নৌকাতে আমায় কি যেনো বলছিলে খ’বিশ আর সিরিয়াস চৌধুরী না কি,আবার বলো তো।

পালক তুতলিয়ে বললো

-ক কই নাহ তো,কিছুই নাহ

-কিছুই নাহ? আচ্ছা,,তুমি যখন কিছুই করোনি,তাহলে আমার তো করা উচিত, দুজনই ভালো হলে কেমন হয় বলো

বলেই এগিয়ে আসছে পালকের দিকে, পালক ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে,কিন্তু যাবে কোথায়, সব দিকেই তো পানি।
মেঘ এগিয়ে আসতে আসতে শার্টের বোতামে হাত দিলো
পালকের চোখ ছানাবড়া, এই লোক শার্টের বোতাম কেনো খুলছে?!!
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ