“তুমি কেন আগে আসোনি?”
১৭.
উত্তপ্ত দুপুর। চারিদিকে হিমেল বাতাস বইছে। কিন্তু সেই বাতাস গায়ে লাগলে আরো গরম লাগছে। গরমে ঘেমেনেয়ে একেবারে গোসল করে ফেলার মতো অবস্থা হয়ে উঠছে। একটু স্বস্তি পেতে ছাদের দরজার সামনে এসে দাড়ালো মিম। সায়ানকে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েও তার আতাপাতা মিলছে না।
কিছুটা ফিসফিসানি শব্দ কানে এসে বারি খেলো মিমের। কান খাড়া করে শুনার বুঝার চেষ্টা করলো কোথা হতে শব্দ আসছে। ছাদের চিলেকোঠা হতে এরকম শব্দ আসছে। একটু এগিয়ে যেতেই বুঝতে পারলো একজোড়া নর-নারীর ফিসফিসানির আওয়াজ। মিম চিলেকোঠার দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেললো। সামনে তাকিয়ে সম্পূর্ণ স্থির হয়ে গেলো। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কোনোভাবেই পারছে না সামনের দৃশ্য মানতে। মনে হচ্ছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখছে।
‘যে অন্যের সংসার ভাঙে, তার সংসার আল্লাহ ভাঙে’। প্রবাদটা একেবারে বাস্তব হয়ে উঠলো মিমের চোখের সামনে। নিজের স্বামী এবং ছোট জা রিহা দুজনকে একে অপরের সাথে এতোটা ঘনিষ্ঠ দেখে এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো সে পৃথিবীতে নেই। পুরো সত্ত্বাটা বিলীন হয়ে গেছে যেনো।
ঘোর কাটতেই ছলছল চোখে তাকালো দুজনের দিকে। মিমের উপস্থিতিতেও যেনো দুজনের কিছু যায় আসেনা। এখনো সেভাবেই আছে দুজন। মিম সহ্য করতে পারলো না। তেড়ে গিয়ে দুজনকে ছাড়িয়ে নিলো। রিহার গালে চড় বসাতেই রিহাও থেমে রইলো না। সেও চড় বসিয়ে দিলো মিমের গালে। মিম হতবুদ্ধি হয়ে গেলো। হামিদ মিমের বাহু চেপে ধরে শাসিয়ে বললো,
— “ডোন্ট ইউ ডেয়ার মিম..! এই দুঃসাহস নেক্সট টাইম আর করবে না।”
মিম একেবারেই হতভম্ব হয়ে গেলো। ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো হামিদের দিকে। হামিদের হাত ধরে বললো,
— “হামিদ তুমি আমাকে এই মেয়েটার জন্য শাসাচ্ছো? তুমি ভুলে গেছো আমাদের ভালোবাসার কথা? আমাদের দশ বছরের প্রেম ছিলো।”
— “ইয়েস ছিলো। কিন্তু এখন আর নেই।”
— “নেই মানে?”
— “তুমি কি করে পারলে আমার সাথে বিট্রেয় করতে?”
— “মা…মানে?”
— “তোমার সবকিছুই আমি জানি মিম। তাই আমি নিজের সুখ বেছে নিয়েছি। যেমনটা তুমি নিয়েছো।”
— “এটা অন্যায়। তুমি আমার সাথে এমন করতে পারো না। তুমি আমাকে ধোঁকা দিতে পারো না।”
— “ওহ সিরিয়াসলি? প্রথমে কে দিয়েছে ধোঁকা? তুমি দিয়েছো মিম, তুমি। আমার ভালোবাসাকে পায়ে ঠেলে দিয়ে সায়ানের সাথে কুকীর্তিতে মেতেছিলে। সেই তুমি আমাকে অন্যায় শেখাচ্ছো? হাসালে।”
মিম রিহাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো,
— “তোকে আমি আমার ছোটবোনের মতো মনে করেছিলাম। আর সেই তুই কিনা আমার সাথে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করলি।”
— “তোমার কথায় বড্ড হাসি পাচ্ছে। তুমি বিশ্বাস বা ভরসা রাখার যোগ্য? কত সূক্ষ্ম খেলা খেলেছো তুমি সিনথিয়ার সাথে। সেই তুমি কিনা বিশ্বাসের কথা বলছো। হাউ ফানি।”
মিমের চিৎকার চেচামেচিতে বাড়িতে একটা গুঞ্জন পরে গেছে। সবাই উপরে উঠে এলো। রিহার স্বামী অয়ন কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো রিহার দিকে। সেদিকে রিহার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আসমা জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে। মিম চিৎকার করে বললো,
— “কি হয়নি সেটা বলুন। আপনার আদরের বড় ছেলে তার ছোট ভাইয়ের বউয়ের সাথে নষ্টামিতে মেতেছে। আরো কিনা দুজন মিলে আমাকে শাসাচ্ছে।”
আসমা অবাকের শীর্ষে পৌছে গেলো। সাথে অয়নও। সিনথিয়ার বাবা আরশ হামিদকে বললো,
— “হামিদ এসব কি সত্য?”
— “হ্যাঁ। আমরা একে অপরকে ভালোবাসি। এবং খুব শীঘ্রই বিয়ে করবো।”
— “কিসব যা-তা বলছিস? মাথা ঠিক আছে? রিহা তোর ছোট ভাইয়ের বউ। তার সাথে কিভাবে?”
— “সিমপ্ল! ডিভোর্স দিবো আমি অয়নকে। তারপর হামিদকে বিয়ে করে নেবো। তারপর…।”
বাকিটা বলার আগেই চড় পরলো রিহার গালে। রিহা চোখ তুলে অয়নের দিকে তাকালো। কিছু বলবে তার আগেই হামিদ অয়নের গায়ে হাত তুললো। একপর্যায়ে হাতাহাতি লেগে গেলো। আশেপাশের বিলিন্ড থেকে মানুষরা সবাই এদিকে তাকিয়ে আছে। আশেপাশের মানুষের মুখে গুঞ্জন শুরু হলো। আসমা এবং আরশ মিলে দুজনকে থামাতে চেয়েও পারছে না। হামিদ জোরে লাথি দিতেই অয়ন ছিটকে পরলো। তারপর উঠে নিচে চলে গেলো। আসমা কঠিন স্বরে বললো,
— “একটা মেয়ের জন্য তুই তোর ভাইকে মারলি?”
— “শুধু তো মেরেছি। দরকার হলো আরো বড় স্টেপ নিবো।”
— “মাথা ঠিক আছে তোর? এই কালনাগিনীর জন্য নিজের ভাইয়ের সাথে শত্রুতা করছিস।”
— “আর কোনো কথা নয়।”
— “কিসের কোনো কথা নয়? তোমাদের সম্পর্ক কতদিন ধরে চলছিলো?” মিম চেচিয়ে বললো।
হামিদ মিমের গাল শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
— “কার সাথে কথা বলছিস এতো চেচিয়ে? নিচু আওয়াজে কথা বলবি সবসময়। বুঝেছিস?”
— “হামিদ তুমি আমার সাথে এমনটা করতে পারো না।” কান্নারত অবস্থায় বললো মিম।
— “আমি অনেক কিছু করতে পারি। তবে চিন্তা করো না জান তোমাকে আমি ডিভোর্স দিবো না। তুমিও থাকবে সাথে রিহাও।”
— “আমি কখনোই এটা মানবো না।”
— “তোমার মানা না মানাতে কিছু যায় আসেনা। রিহারও সম্মতি আছে এতে।”
— “আমি খুন করবো ওকে।”
মিম আশেপাশে তাকিয়ে হাতে ইট তুলে নিলো। রিহার দিকে নিক্ষেপ করার আগেই অনেকটা জোরে থাপ্পড় মারলো হামিদ। মিম মেঝেতে পরে গেছে। হামিদ রেগে তাকিয়ে আছে। রিহা বললো,
— “তোমার এই স্বভাব আর গেলো না তাইনা? এখনো আসছিলে আমাকে মারতে? শুনো আমি রিহা। সিনথিয়া নই। যাকে হাজার অপমান করলেও কিছু বলবে না এটা ভেবে ভুল করবে না। শুধু তোমার কারণে সিনথিয়া প্রতিনিয়ত দগ্ধ হয়েছিলো সায়ানের বাড়িতে। আর এদিকে ইনিয়ে বিনিয়ে বাবা-মায়ের কান ভারি করেছো।”
— “মানে? কিসব বলছো তুমি রিহা? খুলে বলো।” আরশ বললো।
— “এই মেয়েটার কারণেই সিনথিয়ার মিচক্যারেজ হয়েছিলো। শুধু এই মেয়েটার কারণেই। রাক্ষসী কোথাকার।”
— “মা..মানে?”
আসমার কণ্ঠস্বর কেপে উঠলো। এতোদিন সিনথিয়াকে দোষী মনে করেছিলো। কিন্তু যেদিন শুনলো অপ্সরাও চলে গেছে সেদিন থেকে কেমম যেনো সন্দেহ হতো আরশি এবং সায়ানের উপর। মনে মনে অনেক প্রশ্ন উঁকি দিতো। তাদের মেয়ে নাহয় গ্যায়ো ভূত হয়ে থাকতো তাই সায়ানের সাথে ম্যাচ হতো না। কিন্তু অপ্সরাতো ওদের সোসাইটি থেকে বিলং করে। তারপরেও কেনো ম্যাচ হলো না? তাহলে ওদের মা-ছেলে দুটোর মাঝেই ঘাপলা আছে? এমন হাজারো চিন্তা ভিড় করতো আসমার মধ্যে। রিহা এবার সব বলতে শুরু করলো।
— “মা আপনি জানেন না, সায়ান যখন এবরড যাচ্ছিলো সিনথিয়া তখন তিনমাসের প্র্যাগনেন্ট ছিলো। ওই সময়টাতেই সায়ানের সাথে এই মেয়েটার ভাব হতে শুরু হয়। সিনথিয়া ওর প্র্যাগনেন্সির কথা শুধু সায়ানকেই বলেছিলো। সায়ান থেকে যখন জানতে পারলো প্র্যাগনেন্সির ব্যাপারটা তখন এই মেয়ে ফুপিকে ফোন করে কান ভার করে দিয়েছিলো। তিনি সিনথিয়াকে যা নয় তাই বলে অপমান করে। এরমধ্যে সায়ানকে হাত করে ফেলে। তারপরেই তো সায়ান ডিভোর্স দিয়েছিলো। সিনথিয়াকে যখন আমরা হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলাম তখন মনে আছে এই মেয়েটা সিনথিয়াকে পানি খাইয়েছিলো? সেখানেই ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলো। তারপরেই তো ওর মিচক্যারেজ হয়ে গেলো। আর আপনারা কেউ ওর অসুস্থতা নিয়ে মাথাও ঘামালেন না।”
আসমা কাপা কাপা স্বরে বললো,
— “এসব আগে বললে না কেনো?”
— “জেনেছিই তো কিছুদিন আগে। হ্যাঁ সিনথিয়াকে নিয়ে আমি ঠাট্টা বিদ্রুপ করেছি। কিন্তু আমি কখনোই চাইনি এরকম কিছু হোক ওর সাথে। শুধু এখানেই থেমে যায়নি এই মেয়ে। সায়ানদের বাড়িতে যেই ঘটনা ঘটেছিলো সায়ানের বন্ধুকে নিয়ে সেটার পেছনে কিছুটা হাত এই মেয়েটারও ছিলো। সায়ান এবং ফুপিও জড়িত ছিলো এসবের সাথে। পার্টির ঘটনা পর্যন্তই সায়ানের হাত ছিলো। বাকি সবটার পেছনে কলকাঠি নেড়েছে এই মেয়েটা আর ফুপি। এরা দুজন মিলেই ছেলেটাকে ঘরে নিয়ে এসেছিলো। সেদিন পানির কল এই মেয়েটাই বন্ধ করে দিয়েছিলো যাতে সিনথিয়া উপরে আসে ভেজা শরীর নিয়ে। সব ওদের প্ল্যান মতোই হয়েছিলো। সবই হয়েছে। সায়ানকে উলটাপালটা বুঝিয়েছে। সায়ানের সাথে সিনথিয়ার সংসার ভাঙার পেছনে অর্ধেক কারণ ছিলো এই মেয়ে আর ফুপি।”
রিহা আরশের দিকে তাকিয়ে বললো,
— “বাবা আপনি জানেন না আপনার বোন কতটা ধুন্ধুর মহিলা। কতটা অত্যাচার করেছে সিনথিয়ার উপর। কখনোই শুনতে চাননি ওকে। না বুঝতে চেয়েছেন। আমরা কেউ-ই ওর মনের দিকটা বুঝতে চাইনি। সবসময় ওর বাইরের গেটাপ দেখে হাসি ঠাট্টা করেছি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে কতটা মরেছে মেয়েটা আমরা কেউ সেই খবর পর্যন্ত রাখিনি। মিচক্যারেজের মতো এতো বড় একটা ঘটনা নিজের ভেতরেই চেপে রেখেছিলো। কাউকে কিচ্ছু বলেনি। জানতে পর্যন্ত দেয়নি। নিজের কষ্ট নিজের ভেতরেই চেপে রেখে দিয়েছিলো।”
আসমার মাথাটা ফাকা ফাকা লাগছিলো। আশেপাশে সব অন্ধকার হয়ে আসতেই ঢলে পরে গেলো।
______________________________
অপ্সরার ব্যাপারে সব শুনে জাভেদের বন্ধু খালিদও আগ্রহ প্রকাশ করলো। সায়ানের সাথে এখনো ডিভোর্স হয়নি অপ্সরার। ঘর থেকেই বের হতে পারছে না অপ্সরা। সায়ান হুমকি দিয়ে রেখেছে। যদি ঘর থেকে বের হয় ওকে তুলে নিয়ে যাবে। সেই ভয়েই কিছু করতে পারছে না।
দরজায় টোকা পরতেই অপ্সরা গিয়ে দরজা খুলে দিলো। সিনথিয়াকে দেখে মুচকি হাসলো। এই মেয়েটার সাথে কথা বললে অপ্সরার অনেক ভালো লাগে। এতোটা ভালো মনের মেয়েটার সাথেও সায়ান টিকতে পারলো না। সবকিছুর পেছনে নষ্টের মূল সায়ানের মা। ধুন্ধুর মহিলা। সবসময় উল্টাপাল্টা বুঝিয়েছে অপ্সরার ব্যাপারে। তাইতো আরো বিগড়ে গেছে সায়ান। লাগাম টেনে না ধরায় আজ সে মেয়েবাজ হয়ে উঠেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো অপ্সরা।
সিনথিয়া অপ্সরার মেয়ে রুহিকে কোলে নিলো। কিছুক্ষণ রুহির সাথে দুষ্টামি করে অপ্সরাকে বললো,
— “আজ কিন্তু উনিও এসেছেন। সাথে উনার বন্ধু। একবার কথা বলে দেখো।”
— “আ..আমি? কি ক..কথা বলবো?”
— “সেটা কথা বলা শুরু করলেই বুঝবে।”
— “সিনথিয়া আমার কেমন যেনো লাগছে। এখনো ডিভোর্স হলোনা আর এরমধ্যেই আমি কিনা আরেকটা বিয়ের জন্য উঠে পরে লেগেছি।”
— “সায়ানের সাথে তো তোমার বিয়েটা হয়-ই নি। এরকম সম্পর্ক থেকে বাচতেই তোমাকে বিয়েটা করতে হবে। না হলে কিছুতেই শান্তি পাবে না।”
অপ্সরা চুপ করে রইলো। মেয়েটা কেঁদে উঠতেই সিনথিয়া রুহিকে অপ্সরার কোলে দিয়ে দিলো। রুহিকে আগলে ধরলো। এরমধ্যে খালিদের বাচ্চাটা ওদের রুমে চলে এলো। গুটিগুটি পায়ে হেটে এসে অপ্সরার দিকে তাকালো। অপ্সরার খুব মায়া হলো। কতটা নিষ্পাপ দেখাচ্ছে বাচ্চাটাকে। বাচ্চাটার মা নেই ভাবতেই খুব কষ্ট হচ্ছে। মুখটা এতটুকুন হয়ে আছে। নিষ্প্রাণ চাহনি। একটুখানি বাচ্চার মুখেও বিষন্নতা ছেয়ে আছে। রাফি অপ্সরার আঁচল টেনে ধরে বললো,
— “মাম্মাম তোলে নাও না। তুমি আমাতে রেতে তেনো এতানে এচে গেচো? তুমি পচা। আমাতে এতটুও ভালোবাতো না।”
অপ্সরার বুকটা ধক করে উঠলো রাফির মুখে মাম্মাম ডাক শুনে। ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে অপ্সরার দিকে। সিনথিয়া মলিন হেসে রাফিকে কোলে নিলো। রাফি সিনথিয়ার গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
— “আনতি মাম্মাম আমার সাতে কতা বলে না তেনো?”
— “তোমার মাম্মামও তোমার সাথে রাগ করেছে। তুমি কেনো মাম্মামকে আদর করে দাওনি বলো? তাইতো কথা বলছে না।”
— “আচ্চা আমি এতনি আদল দিচ্ছি মাম্মামতে।”
রাফি সিনথিয়ার কোল থেকে নেমে তাড়াতাড়ি করে এসে অপ্সরার গলা জড়িয়ে ধরে গালে চুমু দিয়ে বললো,
— “মাম্মাম আমার সাতে একন কতা বলবে। ইয়ে! ইয়ে!”
হাত তালি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে কথাগুলো বললো রাফি। রুহিকে দেখে অপ্সরার পাশে বসে পরলো। রুহির গালে হাত বুলিয়ে বললো,
— “মাম্মাম ও আমাদেল পুতুল?”
— “হুম! তোমার ছোট্ট বোন। তোমার ছোট্ট পুতুল।”
সিনথিয়াও এগিয়ে এসে পাশে বসলো। রাফিকে বললো,
— “রাফি এখন কিন্তু তোমার অনেক দায়িত্ব?”
— “তি দাতিত্ব আনতি?”
— “এখন থেকে তোমার বোনকে আগলে রাখতে হবে। কান্না করলে ওর সাথে খেলতে হবে। ওকে ঘুম পারাতে হবে। বুঝেছো?”
— “হ্যাঁ। আমি আমাল বোনতে অনেত ভালোবাচবো আনতি।”
কথাটা বলেই রুহির কপালে চুমু দিয়ে হাত গুলো ধরে বললো,
— “আমাল বোন তুমি এদদম তান্না তরবে না হু? আমি তোমাতে আমার চব তেলনা দিয়ে দিবো।”
.
বড় একটা ওড়না দিয়ে নিজেকে ভালো করে ঢেকে ড্রয়িং রুমে আসলো অপ্সরা। রুহি কোলে। রাফি অন্য হাত ধরে রেখেছে। সিনথিয়া জাভেদের দিকে এগিয়ে গেলো। দুজনকে কথা বলতে দিয়ে জাভেদ আর সিনথিয়া অপ্সরার মামা-মামির সাথে কথা বলছে ডাইনিং টেবিলে বসে। এদিক থেকে ড্রয়িংরুম দেখা যাচ্ছে।
রাফি বাবার কোলে চড়ে বসে বললো,
— “বাবাই মাম্মাম আমাদের সাতে যাবে না?”
— “হু যাবে। তবে আজ নয় বাবা। আরো অনেক পরে।”
রাফি ছলছল চোখে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেছে। অপ্সরার খারাপ লাগলো। বাচ্চাটা মায়ের ভালোবাসা পেতে একদম মারিয়া হয়ে আছে। অপ্সরা রাফিকে আদর করে দিয়ে বললো,
— “তুমি প্রতিদিন মাম্মামের কাছে চলে আসবে ঠিকাছে। তারপর তোমার বোনের সাথে খেলবে।”
— “সত্যি?”
— “হু..।”
রাফি হাসছে। হাত তালি দিচ্ছে। রুহির কপালে চুমু দিচ্ছে। অপ্সরা ওদের দেখে মুচকি হাসছে। অপ্সরার কোল থেকে রুহিকে কোলে নিলো খালিদ। তারপর বললো,
— “এরপর বলুন কি ভাবলেন বিয়ের বিষয়টা নিয়ে?”
অপ্সরা মুখটা নত করে ফেলে বললো,
— “আসলে আমি এখনো কিছু ভাবিনি। তাছাড়া আমার তো এখনো ডিভোর্স হয়নি।”
— “আপনাদের বিয়েটাই তো হয়নি। ডিভোর্সের তো প্রশ্নই উঠে না।”
— “মা..মানে?”
— “গর্ভবতী অবস্থায় বিয়ে জায়েজ হয়না। আপনি এতোদিন সায়ানের সাথে যেভাবে ছিলেন সেটাকে বিয়ে বলে না। আপনারা জেনায় লিপ্ত ছিলেন। তাছাড়া আপনি আপনার প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর ইদ্দতও পালন করেননি।”
— “আস..আসলে আমি বু..বুঝতে পারছি না।”
— “বাসায় কুরআনের অনুবাদ নেই?”
— “হু আছে।”
— “সময় পেলে একবার খুলে পড়বেন। আপনার প্রশ্নের উত্তর সেখানেই আছে।”
— “(—–)”
— “যেহেতু দেশের আইন অনুযায়ী আপনাদের কাবিন হয়েছে তাই আইন অনুযায়ী ডিভোর্সের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। নাহলে পরে সায়ান এসে ঝামেলা করতে পারে।”
— “হু। আমি তাই ভাবছিলাম। কিন্তু…।”
— “কিন্তু কি?”
— “না মানে.. আসলে, সায়ান আমাকে হুমকি দিয়েছে ঘর থেকে বের হলে কিছু একটা করবে। তাই কোর্টে যেতে পারছি না।”
অপ্সরা কথাটা বলতেই ভিষণ লজ্জা পাচ্ছিলো। মনে মনে ভাবছে লোকটা কি ভাববে কে জানে। থুতনিটা বুকের সাথে লেগে গেছে। খালিদ বললো,
— “আপনি মত দিন এই বিয়েতে। বাকিটা আমি সামলে নিবো।”
— “আসলে আমি…।”
— “ঠিকাছে ভাবুন আপনি। আপনার মামা-মামিকে জানিয়ে দিবেন। আমি আজকেই লয়ারের সাথে কথা বলবো আপনার ব্যাপারটা নিয়ে।”
— “জ্বী আচ্ছা।”
খালিদ রুহিকে অপ্সরার কোলে দেয়ার সময় তখন একনজর তাকিয়েছিলো খালিদের দিকে। তৎক্ষনাৎ আবার নজর সরিয়ে নিয়েছে। প্রখর ছিলো সেই দৃষ্টি। আন্তর-আত্না কেঁপে উঠেছিলো অপ্সরার। খালিদরা চলে যাওয়ার পরেও একটা ঘোরের মধ্যে ছিলো অপ্সরা। কোনোভাবেই ভুলতে পারছিলো না সেই প্রখর দৃষ্টির চোখজোড়া।
.
রাতে মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে অপ্সরা মাত্রই শুয়েছিলো। তৎক্ষনাৎ মনে পরলো খালিদ বলেছিলো সময় পেলে কুরআনের অনুবাদটা পড়তে। অপ্সরা উঠে গেলো। ওযু করে এসে কুরআন টা নিয়ে বসলো। প্রথম থেকেই পড়া শুরু করলো। যতই পড়ছে ততই শিউরে উঠছে। আর আপসোস হচ্ছে আগে কেন এই কুরআন খুলে দেখলো না। কানাডা থাকাকালীন একদম সেখানের লাইফস্টাইলেই চলাফেরা করতো। মনেই হয়নি ও মুসলিম। শুধু নামটাই রেখেছিলো মুসলিমদের।
রাত তিনটা সময় অপ্সরা ডুকরে কেঁদে উঠলো। পুরো জীবনটাই ভুলেভরা ছিলো। কোথায় সুখে খুজে নি সে? অথচ যেখানে সব সুখ লুকিয়ে আছে সেখানে একবারও ফিরে তাকায়নি। ধরা দেয়নি রবের কাছে। কখনোই সেজদায় পড়েনি।
নফল সালাত তো দূরে থাক কোনোদিন ফরজ সালাতও ঠিকমতো পড়েনি অপ্সরা। অথচ আজ তাহাজ্জুদের সিজদায় পড়ে কাদছে। ক্ষমা চাইছে বারবার রবের কাছে নিজের কৃতকর্মের জন্য। আহ! এখনানেই তো সব শান্তি।
চলনে,,,
® ‘নুরুন নাহার’