তুমি হৃদয়ে লুকানো প্রেম পর্ব-৩২+৩৩

0
298

#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৩২

উন্মুক্ত বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দুয়া। গাত্রে ছুঁয়ে যাচ্ছে শীতল পবন। ঠাণ্ডায় হিম হয়ে আসছে সারা কায়া। তবুও মেয়েটি নড়লো না। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ সম্মুখে। পাহাড়ের কোলে। দূর হতে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের অবয়ব। নীলাভ সে অবয়বের নিম্ন দিকে সবুজের সমারোহ। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে জনপদ। অসংখ্য ঘরবাড়ি। এত কাছ থেকে পাহাড় দেখতে পেয়ে বিমোহিত দুয়া! চক্ষু ফেরাতে ব্যর্থ। হঠাৎ তার মুগ্ধতায় ব্যাঘাত ঘটলো। কাঁধে পেল শীতলতম পুরুষালি স্পর্শ। এতক্ষণে বুঝি শীতের প্রকোপ অনুভূত হলো। শিরশির করে উঠলো দেহ। তড়িৎ পিছু ঘুরে তাকালো সে। তূর্ণ দাঁড়িয়ে। গোসল সেরে এখানে হাজির। সদ্য স্নাত একান্ত মানুষটির নৈকট্যে নাসিকা গ্ৰন্থিতে প্রবেশ করছে মা`তাল করা সুবাস! পড়নে তার হালকা সবুজাভ ফুল স্লিভ গ্ৰাফিক প্রিন্ট সোয়েট শার্ট। ভেজা চুলে চিকচিক করছে বিন্দু বিন্দু জলকণা। গৌর মুখশ্রী দেখাচ্ছে আরো শুভ্র-সতেজ! স্নিগ্ধতা বিরাজমান রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নিজের ওপর কাবু হারিয়ে ফেলছে মেয়েটি। নিভু নিভু করছে মায়াময় আঁখি জোড়া। ক্রমবর্ধমান ধুকপুকানি শ্রবণ হচ্ছে শ্রবণ ইন্দ্রিয়ে। হঠাৎ ছ’লকে উঠলো হৃৎপিণ্ড। ওর বাঁ কপোলে শীতল হাতটি রেখেছে তূর্ণ। নয়নে নয়ন মিলিয়ে শুধালো,

” ভালো লাগছে? ”

মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় হাঁ সূচক মাথা নাড়ল মেয়েটি। তূর্ণ মুচকি হেসে এগিয়ে এলো সন্নিকটে। অধরের ছোঁয়া অঙ্কন করলো দু ভ্রুয়ের সন্ধিস্থলে। আবেশ মুদিত হলো মেয়েটির নেত্রজোড়া। তূর্ণ মৃদু স্বরে বললো,

” ফ্রেশ হয়ে নাও। এতটা পথ জার্নি করে এসেছো। গা চিটচিট করবে‌। যাও। ”

চোখ মেলে তাকালো দুয়া। লজ্জা মিশ্রিত হেসে তূর্ণ’র সান্নিধ্য হতে বেরিয়ে এলো। পা বাড়ালো কক্ষের দিকে।

নিজস্ব কক্ষে মুখোমুখি বসে নিজাম সাহেব এবং তাসলিমা। তাসলিমা সরু চোখে তাকিয়ে স্বামীর পানে।

” তূর্ণ ফোন করেছিল। আমার সাথে কথা বলালে না কেন? ”

নিজাম সাহেব বোকা হেসে বললেন,

” ও-ই…! তূর্ণ বলেছে। ও বলেছে আম্মু যখন কাজ করছে। ডিস্টার্ব করো না। ও পরে ফোন করবে। ”

তাসলিমা অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বললেন,

” ছেলেটা আমার চৌদ্দ ঘন্টার বেশি জার্নি করে ভিনদেশে গেল। এরপর কল করলো আরো কতক্ষন পরে। মা’কে খুঁজলো। অথচ তুমি দিলে না? তুমি জানতে না আমি ওর সাথে কথা বলার জন্য কতটা উদগ্রীব হয়ে আছি? ”

নিজাম সাহেব স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে শান্ত করার চেষ্টা করতে করতে বললেন,

” রাগ করো না লিমা। ওরা বোধহয় এখন রেস্ট করছে। তাই কল রিসিভ করছে না। তূর্ণ বলেছে তো। ও ঠিক তোমায় কল করবে। দেখে নিও। ”

তাসলিমা সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। উদাস বদনে বিছানা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালেন। নিজাম সাহেব একাকী বিড়বিড় করতে লাগলেন,

” মমতাময়ী মা তো। সবটাই বেশি বেশি। রাগ, অভিমান, ভালোবাসা। তূর্ণ বাপ আমার। আব্বুকে বাঁচা। ”

মধ্যাহ্ন প্রহর। তাসলিমা এবং তাহমিদা’র সঙ্গে ফোনালাপ সেরে তূর্ণ এসে বসলো বিছানায়। দুয়া তখনো সোফায় বসে কথা বলে চলেছে। ফোনের অপর প্রান্তে দুই মা।

” হাঁ আম্মু। তুমি চিন্তা করো না। ”

তাহমিদা বললেন, ” চিন্তা কি আর সাধে করি? তোমাকে নিয়েই তো যত রাজ্যের চিন্তা। ”

দুয়া গাল ফুলালো।

” উফ্ আম্মু। আমি কি ছোট বাচ্চা? আমি এখন ভার্সিটি পড়ুয়া। দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছি। কিন্তু তুমি এখনো আমাকে সে-ই প্রাইমারী পড়ুয়া দুয়া’র মতো ট্রিট করো। আমি শিশু নই। ”

তূর্ণ বিছানায় বসে হাসলো। তাসলিমা ফোনের অপর প্রান্ত হতে বললেন,

” ছেলেমেয়ে যত বড়ই হোক না কেন দুয়া। মায়ের কাছে ছেলেমেয়েরা সবসময় ছোটই থাকে। ”

” হুঁ। যেমন তোমার বিগ সাইজ সোনাবাবু। ওপস্। বাবু সোনা।”

বলেই ফিক করে হেসে উঠলো দুয়া। তূর্ণ তীক্ষ্ণ চাহনি নিক্ষেপ করলো। তাকে নিয়ে মজা করা হচ্ছে? তাহমিদা হেসে বললেন,

” এই মেয়ে। আমার জামাই বাবাজিকে নিয়ে দুষ্টুমি করবে না।”

” ঠিক আছে। তুমিও আর আমার মামণির মেয়েকে বাচ্চা বলে বিদ্রুপ করবে না। ওকে? ”

দুই বোন একসাথে হেসে উঠলো। তাহমিদা বললেন,

” ঠিক আছে মা। এখন তাহলে রাখছি। আল্লাহ্’র রহমতে ভালো থেকো। সাবধানে থেকো। ”

তাসলিমা পাশ থেকে বললেন,

” যা যা বললাম মনে থাকে যেন। ঠিক আছে? ”

দুয়া মুচকি হেসে বললো, ” ঠিক আছে। রাখছি। আসসালামু আলাইকুম। ”

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ”

সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। দুয়া গোলাকার ছোট্ট টি টেবিলের ওপর মোবাইল রেখে উঠে দাঁড়ালো। পড়নে তার ধূসর বর্ণের লেডিস ফুল স্লিভ সোয়েটার এবং শুভ্র রঙা লেগিংস। অগ্রসর হলো বেডের পানে। তূর্ণ ততক্ষণে শুয়ে পড়েছে। দুয়া রুম হিটার সঠিকভাবে সেট করে বিছানায় শয্যা গ্রহণ করলো। তূর্ণ’র কাছ হতে ব্ল্যাংকেট নিয়ে দেহে জড়ালো। তৎক্ষণাৎ আ`ক্রমণ করে বসলো তূর্ণ। ব্ল্যাংকেটের অভ্যন্তরে তূর্ণ’র আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দিনী হলো দুয়া। ছটফট করে উঠলো মেয়েটা।

” উঁহু হুঁ। কি করছো? দম বন্ধ করে মে রে ফেলবে নাকি? ছাড়ো বলছি। ”

” নাহ্! তোকে তো আমি আষ্টেপৃষ্ঠে পি`ষেই ক্ষ্যা ন্ত হবো। আমাকে নিয়ে মজা করা? আমি বাবুসোনা? ”

সশব্দে হেসে উঠলো দুয়া। অর্ধাঙ্গের ডান বাহুতে মাথা রেখে আরাম করে শুলো। হাসিমুখে বললো,

” ইয়েস। মামণির বিগ সাইজ বাবুসোনা। ”

” আচ্ছা? তাহলে তো প্রমাণ করতেই হচ্ছে আমি বাবুসোনা কি না? ”

ভাবসাব সুবিধার ঠেকছে না। দুয়া তৎক্ষণাৎ আপত্তি জানালো।

” এই না না। একদম না। আমি প্রমাণ চেয়েছি নাকি? ”

তূর্ণ দাঁত কেলিয়ে হাসলো। বললো,

” কিন্তু আমি যে প্রমাণে বিশ্বাসী। তাহলে প্রমাণ দেয়া যাক? ”

নিভু নিভু মেয়েটির নেত্রপল্লব। মাথা নাড়িয়ে আপত্তি পোষণ করে চলেছে। কিন্তু তা শুনলো কি মানুষটি? মোটেও নয়। মেয়েটিকে চরমভাবে ভীতসন্ত্রস্ত করে আকস্মিক পাল্টি খেলো। সুড়সুড়িতে জর্জরিত করে তুললো কোমল কায়া। খিলখিল করে হেসে উঠলো দুয়া। উদরে পুরুষালি হাতের দুষ্টু ছোঁয়ায় অবর্ণনীয় সুড়সুড়ি অনুভূত হচ্ছে। দু হাতে বারবার বাঁধা প্রদান করার চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু ব্যর্থ সে। তূর্ণ থেমে নেই। মেয়েটিকে সুড়সুড়িতে অতিষ্ঠ করে তুললো। দুয়া যতবার তার বাহুবন্ধন হতে মুক্ত হতে চাইলো। ততবার ই আরো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিলো। শেষমেষ থামলো মানুষটি। হাসতে হাসতে দুয়া’র চোখে নোনাজল। কেঁপে কেঁপে উঠছে কায়া। তূর্ণ নিজেও হাঁপাতে হাঁপাতে হেসে চলেছে। হাসতে হাসতে তাকালো তার বাহুতে শায়িত একান্ত সঙ্গিনীর পানে। নয়নে মিলিত হলো মায়াবী নয়ন। হলো কত অব্যক্ত আলাপণ! অতিবাহিত হলো কত প্রহর। কপোলের কোমল আবরণে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলো তূর্ণ। মিহি স্বরে বললো,

” ঘুমিয়ে পড়ো। ”

অপরাহ্ণ প্রহর। অসংখ্য পুষ্প সমারোহের সান্নিধ্যে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তূর্ণ, দুয়া। হলদে রঙা ফুলগুলো যেন অতি মোহনীয় ভঙ্গিতে কাছে ডাকছে। একটুখানি ছুঁয়ে দেয়ার জন্য, স্বল্প পুলকিত হওয়ার জন্য উদগ্রীব মন। আর তর সইলো না মেয়েটির। ধীরগতিতে ঝুঁকে বসলো। হাতের কোমল আবরণে ছুঁয়ে গেল হলদে রঙা ফুলটি। ফুলেল সান্নিধ্যে আবেশিত হলে তনুমন। মুদিত হলো নেত্রপল্লব। আরেকটুখানি ঝুঁকে গেল দুয়া। নাসিকা গ্ৰন্থিতে শুষে নিলো ফুলেল সুবাস। অফুরন্ত ভালবাসা আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরলো। সে মোহনীয় মুহূর্ত ক্যামেরা বন্দি করতে ভুললো না তূর্ণ। ফটাফট মোবাইলে বন্দি করে নিলো মুহুর্তটুকু। মেয়েটির অধর কোণে মাধুর্যময় হাসির রেখা। তূর্ণ সেথায় বিমোহিত হলো!

নীলচে জলের এক প্রান্তে পথ। সেথায় পথের ধারে অগণিত ফুলের সমারোহ। আরেক প্রান্তে দেখা মিলছে ক্যাসেল এর। তূর্ণ, দুয়া এই মূহুর্তে উপভোগ করে চলেছে লেক জেনেভা এর সৌন্দর্য।

লেক জেনেভা; আল্পসের উত্তর দিকে একটি গভীর হ্রদ। যা সুইজারল্যান্ড এবং ফ্রান্সের মধ্যে ভাগ করা হয়েছে। এটি পশ্চিম ইউরোপের বৃহত্তম হ্রদগুলির মধ্যে একটি এবং রোনের পথে বৃহত্তম। হ্রদের ষাট শতাংশ ( ৩৪৫.৩১ কিমি বা ১৩৩.৩২ বর্গ মাইল) সুইজারল্যান্ড এর ( ভাউড, জেনেভা এবং ভ্যালাইসের ক্যান্টন ) এবং চল্লিশ শতাংশ ( ২৩৪.৭১ কিমি বা ৯০.৬২ বর্গ মাইল ) ফ্রান্সের ( হাউট-সাভোই বিভাগ )।

গোধূলি লগ্নের মিঠি আবহাওয়ায় পুলকিত হৃদয়। পুরুষালি হাতের মুঠোয় বন্দী কোমল হাতটি। পাশাপাশি হেঁটে চলেছে দু’জনে। উপভোগ করছে লেক জেনেভা অপার সৌন্দর্য! কখনো কখনো তূর্ণ হাতের ইশারায় কিছু দেখিয়ে দিচ্ছে। মুগ্ধ নয়নে তা অবলোকন করছে দুয়া। এমন নয়ানাভিরাম সৌন্দর্যের মাঝে এক জোড়া কপোত-কপোতী। একান্ত মানুষটির সান্নিধ্য, সঙ্গে ভিনদেশী সৌন্দর্য। এ যেন এক অবর্ণনীয় সুখময় মুহূর্ত!

রবির কিরণে আলোকিত বসুন্ধরা। রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে গাড়িটি। চালকের পাশের সিট শূন্য। পেছনে বসে তিন বান্ধবী। তৃষা, পুষ্পি এবং বিন্দু। সিনেপ্লেক্স হতে ফিরছে তারা।

” দোস্ত মুভিটা কিন্তু জোশ ছিল। ” প্রশংসায় পঞ্চমুখ বিন্দু।

পুষ্পি বিমোহিত কণ্ঠ বলে উঠলো,

” হিরোটা যা ছিল না! উফ্। খাতারনাক্! হৃদয় কেড়ে নিলো আমার। ”

তৃষা ও বিন্দু মিটমিট করে হাসছে। তৃষা প্রশ্ন করে বসলো,

” তা বান্দুপি! সে তোমার হৃদয় কয় নম্বরে গিয়ে কেড়ে নিলো? ”

পুষ্পি ঘোরের মধ্যে বললো, ” একশো সত্তর। ”

তৃষা ও বিন্দুর চোখ কপালে। একশো সত্তর! লাইক সিরিয়াসলি! বিন্দু ওর বাহুতে চাপর মে রে বললো,

” লু চি মাইয়া! এত ক্রাশ খাস। খাইতে খাইতে তোর হৃদয় তো ভরাট। শেষমেষ জামাইরে কই জায়গা দিবি? হৃদয়ের বাইরে? ”

ফিক করে হেসে উঠলো তৃষা। তাতে ঘোর কেটে গেল পুষ্পির।

” কি বললি তুই? ” পুষ্পি সরু চোখে তাকিয়ে।

তৃষা হাসতে হাসতে বললো,

” তোর জামাইয়ের দুর্দশার কথা কইছে। অভাগা দুলাভাই আমগো। তোর হৃদয়ে জায়গা না পাইয়া শেষমেষ না কিডনিতে চলে যায়। ”

সশব্দে হেসে উঠলো বিন্দু। পুষ্পি রাগে গজগজ করে দু’জনকে মা|রতে লাগলো। হঠাৎ ব্রেক কষলো চালক। হকচকিয়ে গেল তিনজন।

” আংকেল! কি হয়েছে? ” প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে তৃষা।

” মা। সামনে বোধহয় এক্সিডেন্ট হয়েছে। ”

” এক্সিডেন্ট! ”

বিচলিত হলো তিনজন। তৃষা শুকনো ঢোক গিলে সাহস সঞ্চয় করলো। গাড়ির দ্বার খুলে বেরিয়ে এলো। দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো অযাচিত স্থানে। আত্মা কেঁপে উঠলো। গাছের সঙ্গে বি*ধ্বস্ত একটি গাড়ি। সম্মুখের কাঁচ ভে ঙ্গে গেছে‌। ভেতরে থাকা মানুষটি দৃষ্টিসীমার বাহিরে। মেয়েটির কোমল হৃদয় ভীত হলো। সামনে যে এগোবে। সাহায্যের হাত বাড়াবে। সেটুকু বোধ অবধি হারিয়েছে। হঠাৎ কাঁধে হাতের স্পর্শ পেলো। ভাবনাচ্যূত হলো।

” কি হলো? দাঁড়িয়ে আছিস কেন? চল গিয়ে দেখি। হয়তো আমাদের সাহায্যের দরকার। ”

বিন্দুর কথায় সম্মতি পোষণ করলো পুষ্পি। দুই বান্ধবী তাড়া দেয়ায় তৃষা ছোট ছোট কদম ফেলে অগ্রসর হতে লাগলো। যত এগোচ্ছে বুকের মধ্যিখানে ঢিপঢিপ করছে। কেমন একটা অনুভূত হচ্ছে। কোনোমতে নিজেকে সামলিয়ে তৃষা দু|র্ঘটনার শিকার গাড়ির কাছে গেল। পৌঁছালো চালকের স্থানে থাকা মানুষটির জানালার ধারে। গাড়ির কাঁচ অর্ধনমিত। তাতে সুবিধাই হলো। একটু ঝুঁকে ভেতরে তাকালো তৃষা। স্টিয়ারিংয়ে ঠেকে আহত মানুষটির মাথা। মুখখানা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু কেমন চেনা চেনা লাগছে। তৃষা অতকিছু না ভেবে স্রষ্টার নাম স্মরণ করলো। অর্ধনমিত জানালা দিয়ে গলিয়ে দিলো হাতটি। গাড়ির লক খুলতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। ততক্ষণে পাশে এসে দাঁড়ালো দুই সখী। তৃষা তাদের ড্রাইভারকে ডাকলো। পুরুষ মানুষ তো। হাত লাগাতে কেমন অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। তাই ড্রাইভার এলো। আহত মানুষটির মুখ স্টিয়ারিং হতে সরিয়ে সিটে এলিয়ে দিলো। তখন দৃশ্যমান হলো মুখখানা। হতভম্ব হলো তৃষা। কণ্ঠনালী হতে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো,

” নিশাদ ভাইয়া! ”

চলবে.

#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৩৩

হাসপাতালে ফিনাইলের তীব্র গন্ধ। নাসিকা গ্ৰন্থিতে তীব্র গন্ধটি ক্ষণে ক্ষণে প্রবেশ করছে। রোগীদের স্বজনের ভীড় যত্রতত্র। ওয়েটিং জোনে বসে রয়েছে তৃষা। দু হাতের তালুতে লুকানো মুখখানি। কেঁপে কেঁপে উঠছে কায়া। পরিহিত পোশাকের কাঁধের অংশে র’ক্তের ছাপ দৃশ্যমান। ক্রন্দনরত ললনার বাম পাশে এসে বসলো পুষ্পি। বান্ধবীর কাঁধে হাত রাখতেই ওকে দু হাতে জাপটে ধরে কাঁদতে লাগলো তৃষা। পুষ্পি চরমভাবে বিস্মিত! ভাবতেই পারছে না ভাইয়ের বন্ধুর জন্য মেয়েটি এভাবে আবেগপ্রবণ হয়ে গেছে! এই আবেগ, যাতনা কি শুধুই ভাইয়ের বন্ধুর জন্য? নাকি তন্মধ্যে লুকানো কোনো অনুভূতি? পুষ্পির কপালের মাঝখানে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। আস্তে আস্তে করে সে বান্ধবীর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। সামান্য দূরে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বিন্দু। সে-ও পুষ্পির মতো চিন্তিত। বিস্মিত!

তমস্র রজনী। কেবিনের মধ্যখানে বেড। সফেদ বিছানায় শায়িত মানুষটি। কপালের ক্ষত লুকায়িত ব্যান্ডেজের আড়ালে। ছোপ ছোপ লাল দাগ দৃশ্যমান ব্যান্ডেজের উপরিভাগে। তৃষা পাশেই বসে। টুলের ওপর। বি ধ্ব স্ত অবস্থা মেয়েটির। পোশাকে আহত মানুষটির র’ক্তের দাগ। চুলগুলো স্বল্প এলোমেলো। কপোলে অশ্রুর ছাপ। ফুলে গিয়েছে চোখমুখ। যন্ত্রণা মিশ্রিত চাহনিতে তাকিয়ে। তখনই হঠাৎ কেবিনের দ্বার উন্মুক্ত হলো। দ্রুত পায়ে ভেতরে প্রবেশ করলো রাজীব, দানিশ, মনিকা এবং টগর। বন্ধুর খবর পেয়েই ছুটে এসেছে ওরা। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করেই তারা হতভম্ব! তৃষা এখানে!

” তৃষা তুমি? ”

মেয়েলি স্বরে ঘোর কেটে গেল তৃষার। পিছু ঘুরে দেখতে পেল ভাইয়ের বন্ধুরা দাঁড়িয়ে। সৌজন্যতার খাতিরে উঠে দাঁড়ালো তৃষা। মনিকা অভিজ্ঞ চোখে পড়ে নিলো মেয়েটার মুখখানি। কিছু বোধগম্য হতেই উজ্জ্বল হলো বদন। ছেলেরা ছুটে এলো বন্ধুর নিকটে। নিশাদের করুণ দশা দেখে দুঃখ বোধ করলো। টগর প্রশ্ন করলো,

” এসব কি করে হলো তৃষা? আর তুমিই বা এখানে কেন? ”

তৃষা জিভে সিক্ত করলো অধর। মৃদু স্বরে বললো,

” বিকেলবেলা বাড়ি ফিরছিলাম। পথে ড্রাইভার আংকেল গাড়ি থামালেন। এরপর.. ”

তৃষা বর্ণনা করলো কি থেকে কি হয়েছে। চমকে উঠলো ওরা!

রাজীব জিজ্ঞেস করলো, ” ডক্টর কি বলেছে? ”

তৃষা দৃষ্টি নত করে নিলো। নিজের যাতনা সয়ে থেমে থেমে জবাব দিলো,

” উনি এখন আলহামদুলিল্লাহ্ ঠিক আছেন। অতটা ক্ষতি হয়নি। শুধু দু’টো স্টিচ পড়েছে। ডক্টর আংকেল ইনজেকশন দিয়েছে। উনি ঘুমাচ্ছেন। শীঘ্রই জ্ঞান ফিরে আসবে। ”

স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল বন্ধুরা। মনিকা আহত বন্ধুর পানে একবার তাকিয়ে তৃষার দিকে তাকালো। ওর বি ধ্ব স্ত অবস্থা অনুধাবন করে বললো,

” তৃষা তুমি তাহলে এখন বাড়ি যাও। আংকেল আন্টি নিশ্চয়ই চিন্তা করছেন। ওনারা এসব জানেন? ”

না সূচক মাথা নাড়ল তৃষা। রাজীব তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,

” তুমি তাহলে বাড়ি যাও বোন। ওনারা চিন্তা করবেন। ”

তৃষা কোনোরূপ আপত্তি করলো না। হয়তো আপত্তি করার মতো অধিকার তার নেই। তাই তো নীরবে মেনে নিলো। কেবিন হতে প্রস্থান করার পূর্বে একটিবারের জন্য দেখে নিলো আহত মানুষটির অবস্থা। নেত্রকোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু কণা। দানিশ রাজীবকে বললো,

” রাজীব! ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ভাই। রাতের বেলা একাকী.. ”

রাজীব সম্মতি পোষণ করে বেরিয়ে এলো। তৃষা, পুষ্পি, বিন্দু এবং রাজীব একত্রে রওনা হলো। দুই বান্ধবীকে পৌঁছে দিয়ে তারপর ‘ ছায়াবিথী ‘ ফিরবে তৃষা, রাজীব।

দিবাকরের আলোয় আলোকিত ধরনী। সমতল আরশির সম্মুখে দাঁড়িয়ে রেডি হচ্ছে দুয়া। পেছনে দাঁড়িয়ে তূর্ণ লালচে চুলগুলো সেট করে নিচ্ছে। চুল সেট করতে করতে বিরক্তি মাখা স্বরে বলে উঠলো,

” অ্যাই মেয়ে আর কতক্ষণ লাগবে? এবার তো আয়নার সামনে থেকে সর। ”

” দেখতে পাচ্ছো না রেডি হচ্ছি? ”

” সে তো বিগত কয়েক ঘন্টা ধরেই দেখে যাচ্ছি। আর কত? ”

তড়িৎ পিছু ঘুরে তাকালো দুয়া।

” কি বললে? আমি কয়েক ঘন্টা ধরে রেডি হচ্ছি? তুমি জানো কয়েক ঘণ্টা কারে কয়? উল্টোপাল্টা বলবে না বলে রাখলাম। ”

তূর্ণ নাক কুঁচকে দুয়া’র পাশে এসে দাঁড়ালো। বাহুর ধাক্কায় ওকে সরিয়ে নিজে দখল করলো আরশি। দুয়া তো অবাক?

” অ্যাই অ্যাই! এসব কি? সরো বলছি। ”

সরলো না তূর্ণ। বরং দ্রুত চুলগুলো সেট করে নিলো। অতঃপর পড়নের জ্যাকেটের চেন টেনে আঁটকে দিলো। তূর্ণ মহাশয় রেডি। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো সে। নীরবে সরে দাঁড়ালো আরশি হতে। দুয়া ভেংচি কেটে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। চুলগুলো ভালোমতো আঁচড়ে ঠোঁটে হালকা লিপস্টিকের ছোঁয়া এঁকে নিলো। এবার হাতে নিলো লেডিস বিয়ানি। সেটা মাথায় পড়তে উদ্যত হতেই ওর হাতটি ধরে ফেলল তূর্ণ। দুয়া প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে। তূর্ণ নিজ হাতে বিয়ানি নিলো। অতঃপর সযতনে অর্ধাঙ্গিনীর দীঘল কালো কেশ আগলে মাথায় পড়িয়ে দিলো বিয়ানি। সাজগোজ সম্পন্ন হলো।

তূর্ণ পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো তার মাইরা’র পানে। মেয়েটির পড়নে গ্ৰে কালার ফুল নেক সোয়েটার। উপরিভাগে সম রঙের লং কোট। কোটের বাটন আটকে উপরিভাগ আবৃত। নিচে সাইড স্লিট প্যান্ট। মাথায় গ্ৰে লেডিস বিয়ানি। মাশাআল্লাহ্! চক্ষু ফেরানো মুশকিল! তূর্ণ বিমোহিত নয়নে তাকিয়ে রইলো। দুয়া চুলে হাত বুলাতে ব্যস্ত ছিল। হঠাৎ নজর পড়লো স্বামীর পানে। তূর্ণ কেমন তাকিয়ে রয়েছে। চোখেমুখে অপার মুগ্ধতা! সে বিমুগ্ধ চাহনিতে মিইয়ে গেল মেয়েটি। সলজ্জ চোখে তাকিয়ে রইল। নয়নে মিলিত হলো নয়ন। তূর্ণ’র পড়নে গ্ৰে কালার স্ট্রিপড্ কুইল্টেড জ্যাকেট এবং জিন্স প্যান্ট। দু’জনেই ম্যাচিং পোশাক পরিহিত। তূর্ণ মুচকি হাসলো। নিভৃতে এগিয়ে এলো কয়েক কদম। দুয়া থমকে গেল নিজ জায়গায়। তূর্ণ দু হাতের আঁজলায় মায়াবী মুখখানি তুলে নিলো। কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো মায়াময় নয়নে। অতঃপর ওষ্ঠের আদুরে পরশ এঁকে দিলো ললাটে। আনমনে দুয়া’র একটি হাত উঠে এলো। রাখলো কপোলে রাখা অর্ধাঙ্গের হাতের ওপর।

তূর্ণ এবং দুয়া আজ এসেছে চিলন ক্যাসেল। যা লেক জেনেভার সন্নিকটে অবস্থিত। চিলন ক্যাসেল তার বর্তমান আকারে কয়েক শতাব্দীর নির্মাণ ও পুনর্বিকাশের ফলাফল।
উনিশ শতকের শেষ থেকে সম্পাদিত খনন, বিশেষ করে প্রত্নতাত্ত্বিক আলবার্ট নায়েফ এর নেতৃত্বে করা খননগুলি ইঙ্গিত দেয় যে ব্রোঞ্জ যুগ থেকে স্থানটি দখল করা হয়েছে।
যে পাথুরে দ্বীপে দুর্গটি অবস্থিত সেটি প্রাকৃতিক সুরক্ষার একটি রূপ এবং ইউরোপের উত্তর থেকে দক্ষিণে উত্তরণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি কৌশলগত অবস্থান উভয়ই গঠন করে। প্রাসাদটি আসল দ্বীপের ডিম্বাকৃতির আকার ধারণ করেছিল যার উপর এটি নির্মিত হয়েছিল। এটি প্রায় একশো মিটার লম্বা এবং পঞ্চাশ মিটার চওড়া। এটি শিলা থেকে এর নামও নিয়েছে। ‘ চিলন ‘ শব্দের অর্থ একটি প্রাচীন ভাষায় ‘পাথুরে প্ল্যাটফর্ম’। এই দুর্গের ইতিহাস তিনটি মহান সময়কাল দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে। সেভয় পরিবার, বার্নিজ বেলিফ এবং ভাউডের ক্যান্টন। যদিও তথাকথিত ‘স্যাভয়ার্ড’-শৈলীর দুর্গগুলি সাধারণত একটি বর্গাকার প্লটে তৈরি করা হয়েছিল, যার প্রতিটি কোণে নলাকার টাওয়ার রয়েছে। চিলন ক্যাসেলকে যা বিশেষ করে তোলে তা হলো পাথুরে দ্বীপের ডিম্বাকৃতির সাথে এটিকে যেভাবে তৈরি করা হয়েছিল।

চিলন ক্যাসেল একটি প্রাকৃতিক পরিখা দ্বারা বেষ্টিত। দুর্গটি চারদিক থেকে লেকের মাধ্যমে প্রবেশ করা যেতে পারে। এটি একটি ‘জলপ্রান্তর দুর্গ’ হিসাবে বিবেচিত হয়। চিলন একটি সেতু দ্বারা জমির সাথে সংযুক্ত (পূর্বে একটি ড্রব্রিজ, যার পুলি সিস্টেমের অবশিষ্টাংশ এখনও দেখা যায়)। চিলন হলো একটি দ্বৈত-উদ্দেশ্যের দুর্গ: উত্তরের সম্মুখভাগ – তীরচিহ্ন এবং পরে লুপফুল দিয়ে ছিদ্র করা হয়েছে এবং ম্যাকিকোলেশন দিয়ে শীর্ষে রয়েছে – এটি প্রতিরক্ষামূলক অংশ গঠন করেছে যা ভায়া ফ্রান্সিজেনা সড়ককে সুরক্ষিত করেছে। দক্ষিণ দিকে হ্রদের মুখোমুখি, দুর্দান্ত গথিক জানালাগুলি রাজকীয় বাসভবনের সম্মুখভাগকে শোভিত করে; ভাউড রিভেরা, লেক জেনেভা এবং পর্বতমালার সাধারণ ল্যান্ডস্কেপ দেখে। কেন্দ্রে, কিপ এবং ট্রেজার রুম সেন্ট্রি ওয়াক করে কর্পস ডি লগিসের সাথে সংযুক্ত থাকে। শুধু এখানে বসবাস করার জন্য। অভ্যন্তরীণ স্থান তিনটি প্রধান উঠানে বিভক্ত। প্রতিটি তাদের চারপাশের বিল্ডিংগুলির ব্যবহারের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ: ক্যাসেলান এবং প্রভুর বাসস্থান, যা সামন্ত ব্যবস্থার সময়কালের।

তূর্ণ দুয়া’র হাতটি ধরে প্রবেশ করলো ক্যাসেলে। তারা লেকের মাধ্যমে ক্যাসেলে প্রবেশ করেছে। ক্যাসেলের আকৃতি ডিম্বাকৃতির। যা মুগ্ধ করলো দুয়া’কে।

” ওয়াও! কি সুন্দর! কিন্তু এটা এমন আকৃতির কেন? ”

তূর্ণ মুচকি হেসে বললো,

” প্রাসাদটি আসলে দ্বীপের ডিম্বাকৃতির আকার ধারণ করেছে যার উপর এটি নির্মিত। ”

” তাই? ”

” হুম। ”

দুয়া কৌতুহলী দৃষ্টিতে এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে দেখছে। এত পুরনো ক্যাসেলে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্বাস হতে চাইছে না যেন। দুয়া আস্তে করে তূর্ণ’র হাতটি ছাড়িয়ে নিলো। ক্যামেরা বন্দি করতে লাগলো নজরকাড়া দৃশ্যগুলো। ওরা হাঁটতে হাঁটতে একসময় পৌঁছে গেল দক্ষিণ দিকে। সেথায় হ্রদের মুখোমুখি দুর্দান্ত গথিক জানালাগুলো রাজকীয় বাসভবনের সম্মুখ ভাগকে শোভিত করে রেখেছে। ওখান থেকে দেখা মিলে ভাউড রিভেরা, লেক জেনেভা এবং পর্বতমালার সাধারণ কিছু দৃশ্য। দুয়া’র মুখনিঃসৃত হলো,

” মাশাআল্লাহ্! ”

বিমোহিত রমণী ফটাফট ক্যামেরা বন্দি করতে লাগলো এমন অসাধারণ দৃশ্যপট! তূর্ণ পাশ থেকে বলে উঠলো,

” ক্যাসেলের নাম চিলন কেন রাখা হয়েছে জানো? ”

দুয়া ওর দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো। সে জানে না। জানতে ইচ্ছুক।

” চিলন শব্দের অর্থ একটি প্রাচীন ভাষায় পাথুরে প্ল্যাটফর্ম। তাই এর নাম রাখা হয়েছে চিলন। ”

দুয়া আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বললো,

” পারফেক্ট নাম রেখেছে। আসলেই পাথুরে প্লাটফর্ম। ”

” হুম। ”

ওরা দু’জনে মিলে ক্যাসেল ঘুরে দেখতে লাগলো। সেথায় পুরনো আমলের বহু নিদর্শন সংরক্ষিত। সবটাই চমকপ্রদ! চোখ ধাঁধানো। দু’জনে ঘুরে ঘুরে সবটা অবলোকন করতে লাগলো। ক্যামেরা বন্দি হলো অগণিত ফটো।

বিশাল জায়গা নিয়ে সবুজের সমারোহ। তন্মধ্যে গোলাকার আকার ধারণ করে ছয়/সাতটি ফুলের ক্ষুদ্র সমারোহ। সেথায় রয়েছে হলুদ, কমলা, সবুজাভ অসংখ্য ফুল আর ফুল। এই ফুলেল সমারোহ এর কেন্দ্রবিন্দু গোলাকার আরেকটি ফুলের মেলা। বিশাল জায়গা নিয়ে অবস্থিত এই ফুলেল সমারোহ পরিচিত ফ্লাওয়ার ক্লক নামে।

৬,৫০০ টিরও বেশি ফুল এবং গাছপালা রয়েছে ফ্লাওয়ার ক্লক এ। যা L’horloge Fleurie নামে পরিচিত। এই ফ্লাওয়ার ক্লক বিশ্বের দীর্ঘতম সেকেন্ড হ্যান্ড বৈশিষ্ট্যযুক্ত। যার দৈর্ঘ্য ২.৫ মিটার! ১৯৫৫ সালে নির্মিত এই বিশাল ঘড়িটি প্রতি ঋতুর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য বছরে একাধিকবার সাজানো হয়। এই বৈজ্ঞানিক বিস্ময়, ফুলের সৌন্দর্য এবং সবুজ সবুজে ঘেরা। জেনেভাতে দেখার জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত স্থানগুলির মধ্যে একটি হওয়ার পাশাপাশি, ঘড়িটি সুইজারল্যান্ডের প্রিমিয়াম ঘড়ি শিল্পকেও স্মরণ করে। এই ঘড়িতে যাওয়া মানে অন্য সময়ে ভ্রমণ করার মতো!

ঘড়িটি গার্ডেন অ্যাংলাইজের ধারের কাছে বসে আছে এবং একটি স্যাটেলাইট সংযোগের সাথে সংযুক্ত থাকে। যার মানে এটি সর্বদা সঠিক সময় দেখায়! প্রতি ঋতুতে এই ফ্লাওয়ার ক্লকের চব্বিশ ঘন্টা ফুলের আয়োজন পরিবর্তিত হয়।

দুয়া দাঁড়িয়ে ফ্লাওয়ার ক্লক এর কাঁটা সাতের কাছে। সেথায় এই মুহূর্তে হলদে কমলা ফুলের সমারোহ। দুয়া বিলম্ব না করে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো।দু হাতের আঁজলায় ভরে নিলো ফুলের কোমল দেহ। আবেশে সিক্ত হলো তনুমন। আহা! কি কোমল! সুগন্ধময় পরশ! নিমিষেই ভালোলাগায় ছেয়ে গেল হৃদয়। অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,

” মাশাআল্লাহ্! আল্লাহ্ কিইনা পারে? ”

তূর্ণ তা শুনতে পেল।

” এক্সাক্টলি। ছয় হাজার পাঁচশো ফুলের সমারোহ এখানে। এই যে ফ্লাওয়ার ক্লক? এটা স্যাটেলাইট সংযোগের সাথে সংযুক্ত। যার মানে এটি সবসময় সঠিক সময় দেখায়! জানো দুয়া? প্রতি ঋতুতে এই ফ্লাওয়ার ক্লকের ফুলের আয়োজন পরিবর্তিত হয়। সো ইনক্রেডিবল! ”

দুয়া মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। অতঃপর তূর্ণ’র দিকে তাকিয়ে বললো,

” এই যে পার্সোনাল ফটোগ্রাফার! ”

তূর্ণ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। নিজের দিকে তর্জনী তাক করে শুধালো,

” পার্সোনাল ফটোগ্রাফার? মি? ”

” ইয়েস। এবার ফটাফট কয়েকটি ছবি তুলে দাও তো। ”

তূর্ণ কয়েক কদম এগিয়ে গেল। অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীর মতো লাভ-লোকসান হিসেব কষে বললো,

” তাতে আমার লাভ? ”

” লাভ! তুমি এরমধ্যে লাভ খুঁজছো? ”

” অফকোর্স। আফটার অল কমার্সের স্টুডেন্ট বউ আমার। সে সারাক্ষণ লাভ লোকসান নিয়ে পড়ে থাকে। তাহলে স্বামী হিসেবে আমি কেন জীবন যুদ্ধে পিছিয়ে থাকবো? হুঁ? নাউ টেল মি। তোমার রঙচঙা ফটো তুলে আমার কি লাভ? আমি কি পাবো? হুঁ? ”

ভ্রু নাচিয়ে চলেছে মানুষটা। দুয়া ফোঁস করে শ্বাস ফেললো। উঠে দাঁড়িয়ে কাছে এলো মানুষটির। চোখে চোখ রেখে বললো,

” কি চাই তোমার? ”

রহস্যময় হাসলো তূর্ণ। মাইরা’র কর্ণ কুহরে অধর ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,

” সাসপেন্স। সময় মতো জেনে যাবে। ”

তড়িৎ সোজা হয়ে দাঁড়ালো তূর্ণ। ক্যামেরা হাতে কিঞ্চিৎ ঝুঁকে দুষ্টু হেসে বললো,

” আদ্রিয়ান আয়মান তূর্ণ ইন ইওর সার্ভিস। প্লিজ অ্যাক্সেপ্ট মাই সার্ভিস অ্যান্ড স্যাটিসফাই মি। ”

তূর্ণ’র দুষ্টুমিতে মেতে উঠলো দুয়া। খিলখিল হাসির কলরবে মুখরিত হলো চারিপাশ। তূর্ণ বিমুগ্ধ চাহনিতে অবলোকন করলো সে হাসি! চোখেমুখে তৃপ্তির আভা!

চলবে.